বনানী গারো পাহাড় ও কিছু স্মৃতি
গারোপাহাড়ে আমার যাওয়া হঠাৎই ঠিক হলো। যার যাওয়ার কথা ছিল, বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে সে বাড়ি চলে গেল। কাজটা এমনই। প্রায়ই পাহাড় জঙ্গলে যেতে হয়। এক এক জায়গায় ২-৩ মাসের কাজ থাকে। তারপর আবার অন্য কোথাও। এমনই মুসাফির আমাদের জীবন। গারোপাহাড়ে আমার যাওয়া ঠিক হতেই আমাদের সিনিয়র কলিগ সমীরদা বলে উঠলেন, দেখো ভাইয়া! পাহাড়ী নারী থেকে সাবধান, তারা মন্ত্রপুত করে ভেড়া বানিয়ে দিতে পারে আর বিশুতো গারোপাহাড়ের রাস্তা সম্বন্ধে জুজুর ভয় দেখালো।
এখন ভাবি, ভাগ্যিস ওদের কথা শুনিনি।
আমার গন্তব্য সদর তুরা। গৌহাটি থেকে দুধনৈ, কৃষ্ণাই হয়ে পথ। বাজেঙডুবা, জেঞ্জাল,আসানং, রংরাম, রংখন ইত্যাদি গ্রামগুলি পেরিয়ে তুরা। আঁকাবাঁকা সর্পিল এই পথের দুইধারের বনরাজির সৌন্দর্য অপরূপ। সেপ্টেম্বরে প্রকৃতির যৌবন যেন ফুটতে শুরু করেছে। রংখন থেকে চড়াই আরম্ভ। তুরার উচ্চতা প্রায় বারোশো ফুট। রংখন পেরোতে না পেরোতে প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। অবাক লাগলো তুরাতে পৌঁছে, এখানে বেশ রোদ্দুর। কয়েক পশলা ছাড়া বৃষ্টি হয়নি। পরে শুনলাম, এখানকার পাহাড়ের বৈচিত্র এমনই।
তুরাতে নামতেই দেখি তুরা অফিসের ইনচার্জ মিস্টার অরবিন্দ সাংমা মহাশয় দাঁড়িয়ে আছেন। সাংমাবাবুর সঙ্গে গৌহাটি অফিসে পরিচয় হয়েছিল। সমতলে পড়াশোনা করা, বেশ ভালো বাংলা বলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে সামনে এসে বললেন, নমস্কার শুভঙ্কর বাবু, আমরা আপনারই অপেক্ষা করছি। চলুন গরিবের ঘরেই আপনার একটা ব্যবস্থা করেছি। আমিতো বর্তে গেলাম। চিন্তা ছিল রাতে গিয়ে কিভাবে কি করব, দু-তিন মাস তো থাকতেই হবে। সাংমাবাবুর বাড়ি হাওয়াখানায়। বাজার থেকে বড়জোর এক কিলোমিটার। তুরা শহরটা চমৎকার লাগছে। সমস্ত শহরটাই উঁচু-নিচু পাহাড়ের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাওয়াখানা যাওয়ার পথে রাস্তার ডানদিকে চড়াই, বাঁদিকে উৎরাই। যতদূর নজর যায় কেবল অগুন্তি বাড়ি। তবুও ইদানিং বাইরের বহু বহুজাতিক কোম্পানির অফিস খোলাতে এখানে গৃহসমস্যাটা প্রকট হয়ে ওঠেছে।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই সাংমাবাবুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। নিজের থাকা ঘর ছাড়াও বেশ কয়েকটা ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে। পাশে একটি গেস্টরুম। গেস্ট রুম আমার জন্য খুলে দিলেন, সঙ্গে ছোট কিচেন। সঙ্গেই বাথরুম, সেনেটারি ল্যাট্রিন। সামনে ছোট একটি ব্যালকনি। ব্যালকনিতে নানারকম অর্কিড ও ফুলের গাছ। রকমারি ফুলে চারিদিক মোহময় উঠেছে। এমনিতেই মনটা ভালো লেগে যায়। ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব পরিশ্রান্ত লাগছিল। অল্পতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙলো। বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ফ্রেশ হয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করছি। এমন সময় সব সদ্যকৈশোর পেরোনো এক তরুণীর আগমন। হাতে ফুলকো ফুলকো গরম লুচি ও তরকারি। তার পিছন পিছন সাংমাবাবু এলেন। এ আমার মেয়ে। আমি দুবার এসে আপনাকে দেখে গিয়েছি, আপনি অঘোরে ঘুমাচ্ছিলেন। আপনাকে আর ডিসটার্ব করিনি। আপনারা গল্প করুন। আমি একটু বাজার থেকে আসছি। এই বলে সাংমাবাবু বেরিয়ে গেলেন।
কি নাম তোমার? খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে মেয়েটি বলল, বনানী মারাক। ( গারোরা মাতৃতান্ত্রিক তাই সন্তানেরা মায়ের পদবী গ্রহণ করে )। সত্যি মানিয়েছে বটে। বনের কন্যা বনানী। চোখ ঝলসে দেওয়ার মত সুন্দরী নয় সে, বরং অরণ্যের সবুজের মতো তার সৌন্দর্য, যা স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়।
আপনার নাম কি? আমি একটু চমকে উঠে বললাম, শুভঙ্কর ব্যানার্জি। কি খটমট নাম রে বাবা। বলে সে হেসে উঠলো। এমন অকৃত্রিম হাসি বোধহয় প্রথম দেখলাম। পাহাড়ের মানুষেরা সহজেই এভাবে হাসি দিয়ে মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। আপনাকে কিন্তু আমি শুভদা বলেই ডাকবো।
এই কয়েকদিনেই বনানীর সাথে আমার বেশ মিতালী হয়ে গেছে। বেশ মিশুকে। স্থানীয় সরকারি কলেজে সে টুয়েলভ ক্লাসে পড়ে। তার বান্ধবীদের কথা অনেক গল্প করেছে। আজ বায়না ধরেছে বিকেলে সে আমাকে তার কলেজ দেখাতে নিয়ে যাবে। ইস শুভদা, আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না, এখনো রেডি হননি। আজ বনানী সুন্দর একটা দাকমান্দা ( গারো মেয়েদের জাতীয় পোশাক – অনেকটা লুঙ্গির মতো ) পড়েছে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
পাহাড়ের চড়াই ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমরা উঠছি। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের সামনে দিয়ে টিভি টাওয়ার কে পাশ কাটিয়ে একটু এগোতেই কলেজের বিশাল কমপাউন্ড চোখে পড়লো। কি পথ রে বাবা যেন প্রাণ বেরিয়ে যায়। কি যে বলেন আপনি এ পথে আমি নীতা সীমা বন্যা আমরা দিনে কতবার আসা যাওয়া করি। আর আপনি একবারেই কাত। বলেই হেসে উঠলো বনানী। তোমরা তো এক একটা আস্ত বাঁদর। মুচকি হেসে আমি বললাম।
প্রকাণ্ড কলেজের নির্জনতা এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। দিনের এক সময় এটাই হয়তো হাজারও ছাত্রের কলধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। কি যে এত ভাবেন আপনি। বনানীর কথায় সম্বিত ফিরে এলো। চলুন সামনে সুন্দর একটি দৃশ্য দেখাবো আপনাকে। একটু এগিয়ে গিয়ে গির্জার পাশের পিলারগুলোর একটিতে বসলাম আমরা। এই পাহাড়টা এখানেই শেষ হয়েছে। পশ্চিমদিকটা সম্পূর্ণ খোলা। তখনো বেশ বেলা রয়েছে। আশপাশের পাহাড়ের উপরে রৌদ্র পড়ে যেন সবুজ অরণ্যে ময়ূরের পেখম ধরেছে । ওই দেখুন আমাদের কলেজ প্লেগ্রাউন্ড,ওই স্টেডিয়াম, ওই সার্কিট হাউস, ওই হান্ড্রেড বেড হাসপাতাল। বনানী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমের পাহাড়গুলি যেন দূরে সরে যেতে যেতে দিগন্তে গিয়ে স্পর্শ করেছে। দূরের আকাশের বুকে মেঘগুলো যেন নাম না জানা চিত্র করে এলোমেলো আঁকানো ছবি। কিছুক্ষণ পরেই সূর্য ডোবা শুরু হলো। মুহূর্তেই প্রকৃতিকে কে যেন লাল আবিরে রাঙিয়ে দিল। মধুর কলধ্বনিতে দূরের পাখিরা গান গেয়ে বাড়ি ফিরছে। আমরা দুজন যেন নিঃসঙ্গ হারানো পথিক।
দেখতে দেখতে সময় কিভাবে কেটে গেল। উচ্ছলতা যেন সময়কে আরো এগিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে আমার অফিসের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বুধবার আমার যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। আজ রবিবার। আজ বনানী আমাকে পার্কে নিয়ে যাবে। আমরা অনেক গল্প করব। ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির পাশের সুন্দর রাস্তাটা সিভিল হাসপাতাল বাবুপাড়াকে পাশে রেখে পার্কে এসে মিশেছে। ইউক্লাপটাস গাছের তলায় আমি আর বনানী বসেছি। ঢিলছোড়া দূরত্বের পাহাড়টা সবুজ চাদর জড়িয়ে হঠাৎ করে উপর দিকে উঠতে শুরু করেছে।
ওই যে দেখছেন একটা ওয়ারলেসের পোস্ট। ওটাই তুরাপিক। তার পাশেই তুরাপিকের টুরিস্ট বাংলো।বনানী বলল। আসার সময় সাইনবোর্ডে লেখা দেখেছি এখান থেকে পিকের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। সমস্ত রাস্তা পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে উঠতে হয়। আর কটা দিন থেকে যান না শুভদা। বনানী বলল। সামনে ইস্টারের ছুটি। পিকে পিকনিক করতে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রতিবছর যাই। জানেন পিক থেকে তুরাকে ছবির মতো দেখায়। ঘরগুলো যেন ছোট ছোট দেশলাই বাক্স। খুব দূরে একটা সরু জলের রেখা দেখা যায়। ওটাই নাকি বাংলাদেশের মেঘনা নদী। সন্ধ্যার দিকে স্টিমারের সার্চলাইটের আলো চোখে পড়ে। এবার তো আর থাকতে পারবো না, একবার আসবো সময় করে। আমি বললাম। সত্যি বলছেন তো? খুব মজা হবে তাই না? বনানী খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো। তার সহজ বিশ্বাসের কাছে মনে মনে আমি পরাজিত হয়ে গেলাম।
আজি আমি ফিরে যাব। মেঘালয় ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের নাইট সুপারে টিকিট কাটা হয়ে গেছে।স্টেশনে সাংমাবাবু ও বনানী আমাকে সি অফ করতে এসেছে। বনানীর আজ সকাল থেকেই মনভার। মাঝে মাঝে সবার অলক্ষে চোখ মুছছে। তার চাউনিতে গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। এই ভালোবাসায় নাই কোন কামনা,আছে শুধু নির্মল ভালোবাসার ছোঁয়া। এই ভালোবাসা মনের অনন্ত শূন্যতা একটু একটু করে ভরিয়ে দেয়। আপনাদের আদর যত্ন আমি কোনদিন ভুলবো না। আমার কথার উত্তরে সাংমা বাবু বললেন।আর লজ্জা দিবেন না তেমন কিছু আর কোথায় করতে পারলাম। সত্যিই পাহাড়ি মানুষ কত সহজ সরল অমায়িক। সবাই যদি এমন হতো তাহলে দেশে দেশে আর যুদ্ধ অশান্তি হতো না। কিছুক্ষণ আগে বাস ছেড়ে রংখন পেরোলো। সামনেই রংরাম। এমনি করে সময় এগিয়ে যাবে। নতুন স্মৃতি এসে পুরোনো স্মৃতিকে ঢেকে দেবে। কিন্তু ও সুন্দরী গারোপাহাড়! ও সুন্দরী বনানী! আমি তোমাদের ভুলবো না।