Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পায়ের ছাপ || Pallav Sanyal

পায়ের ছাপ || Pallav Sanyal

পায়ের ছাপ

কৃষ্ণনগরের চৌধুরী বাড়ি অনেক দিনের পুরনো। দোতলা বাড়ির পিলারের গায়ে এখনো নকশা করা আছে, যা চৌধুরী বংশের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে। বাড়ির উঠোন পেরোলেই পেছনের দিকটা ধ্বংসস্তুপের মতো, যেটা এক সময় জমিদারদের কাচারি ছিল। এই বাড়ির মধ্যে বসে থাকা জিনিসগুলোকে ঘিরে বহু কাহিনি প্রচলিত। তবে সবচেয়ে রহস্যময় গল্পটি সেই পায়ের ছাপ নিয়ে।

চৌধুরী বংশের বড় ঠাকুরদা, হরিহর চৌধুরী, একদিন একটি পায়ের ছাপ দেখেছিলেন উঠোনের কাদায়। পায়ের ছাপটি ছিল এক নারীর, এতটাই স্পষ্ট আর নিখুঁত যে মনে হচ্ছিল, শিল্পী নিজ হাতে গড়ে তুলেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই পায়ের ছাপ কোনো দিকেই এগোয়নি—যেন এক স্থির পায়ের ছাপ, কোনো শরীরের ভার ছাড়া। তবে আরও ভয়ের কথা হলো, সেই পায়ের ছাপ যেন দিনের পর দিন গভীর হতে লাগল।

পঞ্চাশের দশকে কৃষ্ণনগরে এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে। হরিহর চৌধুরীর নাতি অভিজিৎ তখন সদ্য কলেজ থেকে ফিরেছেন। কলকাতার নামকরা আর্ট কলেজে তিনি চিত্রকলার ছাত্র ছিলেন। পায়ের সৌন্দর্য নিয়ে তার আলাদা আকর্ষণ ছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখতেন, তার মা যখন পায়ে আলতা পরতেন, তখন গোটা ঘর যেন সৌন্দর্যের মাধুর্যে ভরে উঠত। সেই আকর্ষণ তাকে নারীর পায়ের সৌন্দর্য আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

কলেজ থেকে ফিরে তিনি চৌধুরী বাড়ির সেই পুরনো অংশে ছবি আঁকা শুরু করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত কাচারির খোলা বারান্দায় বসে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় ছবি আঁকতেন। সেই সময় থেকেই অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করে।

একদিন রাতে ছবি আঁকার সময় অভিজিৎ লক্ষ্য করলেন, কাদামাটির মেঝেতে কারও পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। ছাপগুলো সরু, সুন্দর, যেন এক রমণীর। পায়ের আকার এতটাই নিখুঁত যে তার মনে হলো, এটি হয়তো কোনো সৃষ্টিশীল চিত্রকরের হাতের কাজ। কিন্তু পায়ের ছাপটি কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।

পরের দিন সকালে ছাপটি আরও গভীর দেখা গেল। চৌধুরী বাড়ির বৃদ্ধা গৃহকর্মী মাধবী দিদা বললেন, “বাবু, ও পায়ের ছাপ ভালো নয়। তোমার ঠাকুরদাও এই পায়ের ছাপ দেখেছিলেন। শেষে কী হয়েছিল, জানো তো? তোমার ঠাকুরমা…।”

মাধবী দিদা কথা শেষ করার আগেই অভিজিৎ থামিয়ে দেন। কৌতূহল হলেও তিনি সেই রাতে আরও গভীরভাবে ছাপটির নিখুঁত আকৃতি পর্যবেক্ষণ করেন।

রাত বাড়লে অদ্ভুত কিছু ঘটতে থাকে। অভিজিৎ একদিন দেখলেন, সেই পায়ের ছাপের জায়গা থেকে কুয়াশার মতো কিছু একটা উঠছে। মনে হলো, যেন কোনো এক মায়াবী নারী সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার গলায় ঘুঙুরের মৃদু শব্দ শোনা গেল। অভিজিৎ চমকে উঠে বললেন, “কে আছেন?”

কোনো জবাব এলো না। তবে মনে হলো, পায়ের ছাপের জায়গা থেকে একটি অস্পষ্ট মুখ তাকে দেখে মুচকি হাসছে।

পরদিন অভিজিৎ তার দাদুর পুরনো ডায়েরি খুঁজে বের করলেন। সেখানে লেখা ছিল, “এই পায়ের ছাপের রহস্য পুরনো। যখনই এটি দেখা দেয়, তখন পরিবারের কেউ না কেউ বড় বিপদের মুখে পড়ে। আমার স্ত্রী—তোমাদের ঠাকুরমা, শোভনা, একবার এই পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তিন দিন পর তাকে বাড়ির পেছনের পুকুরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু তার মুখে তখনো এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল।”

ডায়েরি পড়ে অভিজিৎ কেঁপে উঠলেন। তার মনে হলো, কিছু একটা এই পায়ের ছাপের মাধ্যমে ফিরে আসতে চাইছে।

রাতের আঁধারে অভিজিৎ ঠিক করলেন, তিনি এই পায়ের ছাপের রহস্য ভেদ করবেন। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে তিনি বারান্দায় অপেক্ষা করলেন। রাত বারোটার সময় হঠাৎ সেই পায়ের ছাপ থেকে মৃদু ঘুঙুরের শব্দ শোনা গেল। এবার তিনি পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে শুরু করলেন।

পায়ের ছাপ তাকে নিয়ে গেল ধ্বংসপ্রাপ্ত কাচারির নিচে একটি পুরনো কুঠুরিতে। সেখানে একটি কাঠের বাক্স পাওয়া গেল। বাক্স খুলতেই ভেতরে পাওয়া গেল একজোড়া রক্তে ভেজা ঘুঙুর। অভিজিৎ চমকে উঠে দেখলেন, তার চারপাশে অদ্ভুত হাওয়া বইছে। এক নারীকণ্ঠ বলল, “তুমি কেন এসেছ?”

অভিজিৎ নারীকণ্ঠের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, এক ধোঁয়াশার শরীরের নারী তাকে দেখছে। নারীর মুখে প্রশান্তির ছায়া। তিনি বললেন, “আমি শান্তি চাই। এই পায়ের ছাপ আমাকে বন্দি করে রেখেছে। আমাকে মুক্তি দাও।”

অভিজিৎ সেই ঘুঙুর দুটি পুরনো পুকুরে ফেলে দিলেন। তখনই নারীর ছায়া মুছে গেল।

এরপর থেকে চৌধুরী বাড়ির উঠোনে আর কোনো পায়ের ছাপ দেখা যায়নি। অভিজিৎ সেই ঘটনার কথা আর কাউকে বলেননি। কিন্তু তার ছবিতে সেই পায়ের সৌন্দর্য বারবার ফুটে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *