স্নান করে এসে হরি
স্নান করে এসে হরি জামাপ্যান্ট পরে চুল আঁচড়াচ্ছিল, এমন সময় ঘোমটা-টানা একটা বউ থালায় ভাত ডাল তরকারি বেড়ে নিয়ে এসে কোণের টেবিলটায় রাখল।
থালায় ভাতের পরিমাণ দেখে হরি আঁতকে উঠে বলল, “আমি অত ভাত খেতে পারব না। কমিয়ে আনুন।”
বউটা একথার কোনও জবাব দিল না। নিঃশব্দে চলে গেল।
ভাল জ্বালা হল হরির। এই নির্জন বাড়িতে কথা বলার মতো লোক বলতে ওই দু’জন। দরোয়ানটা গোমড়ামুখো, বউটাও যদি তাই হয় তো মহা মুশকিল।
ভাতের রুচিও ছিল না হরির। স্কুলের চিন্তায় তার পেটে পাক দিচ্ছে। শুনেছে, খুবই কড়া স্কুল। তার ওপর বাড়ির জন্য মন খারাপ তো আছেই। ফেলে-ছড়িয়ে খানিকটা ভাত খেয়ে সে উঠে পড়ল। গোবিন্দদা এখনও ফেরেনি। সহজে ফিরবেও না। দারুণ আড্ডাবাজ লোক। তার
জন্য অপেক্ষা না করে দুখিরামবাবুর চিঠি আর স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা পকেটে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। ঘরটা ভোলা রইল। থাক, দরোয়ান আছে, আর তা ছাড়া তার চুরি যাওয়ার মতো তেমন কিছু নেইও।
আধমাইল হেঁটে সে যখন স্কুলের দরজায় পৌঁছল তখন তার বুকটা দমে গেল। এরকম নিরাপদ স্কুলবাড়ি সে দ্যাখেনি। সাদা একটা দোতলা ব্যারাকবাড়ি। খুব উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। দেখলে স্কুল নয়, জেলখানা বলে মনে হয়। হরি যখন স্কুলে ঢুকছে, তখন স্কুল বসবার ঘণ্টা বাজছিল। ঘণ্টার শব্দটাও যেন কেমন, গম্ভীর, মন উদাস করে দেয়। স্কুলের মধ্যে ছেলেদের কোনও হইহই নেই। সব শান্ত, ঠাণ্ডা।
খুব ভয়ে-ভয়ে সে দেউড়ি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল। একটা বজ্রগম্ভীর গলা বলে উঠল, “কী চাই?”
হরি সভয়ে দ্যাখে ব্যারাকবাড়ির একতলার বারান্দার কোণে, ফটকের মুখেই এক বিশাল চেহারার ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, রংটি ঘোর কালো, হাতে বেত, চোখে প্রখর দৃষ্টি।
কাঁপা গলায় হরি বলল, “আমি হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করব।”
ভদ্রলোক হাতের বেতখানা তুলে তাঁর পিছনের দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওই ঘরে গিয়ে বোসো।”
হরি ভয়ে-ভয়ে বারান্দায় উঠল এবং ভদ্রলোকের পাশ দিয়ে একটা পিঁপড়ের মতো গলে গিয়ে ঘরটায় ঢুকল। ঘরে একটা সবুজ রেকসিনে-মোড়া ডেস্ক আর গুটিকয় চেয়ার, কয়েকটা আলমারি, আলমারির মাথায় গ্লোব, ফাঁইল ক্যাবিনেট, হাজিরা-খাতা, নোটিসবই সব রয়েছে। হরি বসল না। হেডস্যারের ঘরে বসতে নেই, সে জানে। সে একটু কোণের দিকে সরে দাঁড়িয়ে রইল।
স্কুল বসবার দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে মাস্টারমশাইরা অনেকটা মিলিটারিদের মতো গটমটে পায়ে একে-একে ঢুকে একটা করে হাজিরা-খাতা তুলে নিয়ে ক্লাসমুখে চলে যেতে লাগলেন। এরকম স্বাস্থ্যবান সব মাস্টারমশাই হরি কদাচিৎ দেখেছে। প্রত্যেকেরই বেশ চওড়া কব্জি, বিশাল-বিশাল বুকের ছাতি, কারও মুখে হাসির লেশমাত্র নেই, আর প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টিই ভয়ঙ্কর।
মাস্টারমশাইরা ক্লাসে চলে যাওয়ার পর সেই বেতওয়ালা ভদ্রলোক
এসে ঘরে ঢুকলেন। নিজের চেয়ারে বসে তার দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি দুখিরামবাবুর চিঠি নিয়ে এসেছে, না? দাও দেখি চিঠিখানা।”
হরি চিঠিটা দিল। “টাকা এনেছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“যাও, এর পাশের ঘরেই অফিস। ভর্তি হয়ে সোজা দোতলায় উঠে বাঁ দিকের প্রথম ঘরে চলে যাবে। সেটাই ক্লাস সেভেন ডি সেকশন।”
“আজ্ঞে।”
ভর্তি হতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। একজন একশো বছর বয়সী বুড়ো লোক টাকা গুনে নিয়ে একটা লেজারে তার নামধাম লিখল। একখানা রসিদ আর বুকলিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ক্লাসে চলে যাও।”
দোতলার ক্লাসঘরে তখন টকটকে ফর্সা ব্যায়ামবীরের মতো চেহারার এক মাস্টারমশাই ইংরিজির ক্লাস নিচ্ছিলেন। সে দরজায় দাঁড়াতেই কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “বাঁ দিকে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ো।”
ক্লাসে জুনা-ত্রিশ ছেলে। প্রত্যেকেই নিশ্চপ। মাস্টারমশাই একজন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “বিউটিফুল বানান কী?”
“বি ইউ…”
“বারান্দায় কান ধরে নিলডাউন।” ছেলেটা নিলডাউন হল। “বলাই, জাঁকজমক ইংরিজি কী?”
“প… প… প….”
“পাঁচ বেত। এদিকে এসো।”
পাঁচ ঘা বেতের শব্দ হরি চোখ বুজে শুনল। কী শব্দ রে বাবা। অন্য ছেলেকে মারা হচ্ছে, আর হরি যেন নিজের শরীরে টের পাচ্ছে।
ক্লাসের ছেলেদেরও হরি লক্ষ করল। এ-ক্লাসে সব ছেলেই বেশ ধেড়ে এবং তাগড়াই চেহারার। কারও বয়সই হরির চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই হবে। কেমন যেন বন্য, ক্ষুধার্ত দৃষ্টি সকলের চোখে।
ছেলেগুলো যে সুবিধের নয়, তা বোঝা গেল মাস্টারমশাই প্রথম পিরিয়ড পড়িয়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তিনটে মুশকো চেহারার ছেলে তিনদিক থেকে গদাম গদাম করে এসে লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। দু’জন দুটো হাত চেপে ধরল, একজন তার চুলের মুঠি ধরে মুখটা তুলে বলল, “দেখি, দেখি চাঁদ, কোন্ গগন থেকে উদয় হলে!”
আকস্মিক এই আক্রমণে হরি এমন ঘাবড়ে গেল যে, তার মুখে কথাই ফুটল না। সভয়ে চেয়ে রইল শুধু। যে ছেলেটা চুল ধরেছিল, সে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “বোবা নাকি হে? কিন্তু বোবারও যে এখানে মারের চোটে বুলি ফোটে তা জানো?”
পিছন থেকে কে যেন ঘাড়ে একখানা রদ্দা মেরে বলল, “না রে, বেশ ঘাড়ে-গদানে আছে। ভাল পানচিং ব্যাগ হতে পারবে।”
সকলে হিহি করে হাসল।
এই স্কুলে মাস্টারমশাইরা ক্লাসে আসতে মোটেই দেরি করেন না। বারান্দায় গটমটে জুতোর শব্দ পেয়েই ছেলে তিনটে তাকে ছেড়ে দিল। একজন শুধু চাপা স্বরে বলল, “নালিশ করলে আস্ত রাখব না, মনে থাকে যেন!”
রাগে দুঃখে হরির চোখে জল এসে গিয়েছিল বটে, কিন্তু সে নালিশও করল না।
দ্বিতীয় পিরিয়ডে বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন ঠিক মহিষাসুরের মতো চেহারার এক মাস্টারমশাই। সন্ধি সমাস প্রত্যয়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর হাতের বেতও ফোঁসফোঁস করতে লাগল। সাতজন বেত খেল, তিনজন নিডাউন হল, চারজনের মাথায় পড়ল ডাস্টারের ঘা।
দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হতেই আবার গোটা চারেক ছেলে উঠে এসে ঘিরে ফেলল হরিকে।
“বাঃ, বেশ রাঙামুলোর মতো চেহারাটি তো তোমার ভাই। কিন্তু এ চেহারা কি রাখতে পারবে? শুকিয়ে যে হকি হয়ে যাবে বাছাধন?”
“দেখি তো ভাই তোমার হাতের লেখা কেমন। খাতায় লেখো তো ‘আমি একটি গাধা। লেখো, লেখো-.”
“কাতুকুতু তোমার কেমন লাগে থোকা? ভাল নয়?”
“জিভ ভেঙাতে পারো? একটু ভেঙাও তো!”
প্রতি পিরিয়ডের পরই এরকম চলতে লাগল। টিফিন পিরিয়ডে তাকে একরকম ধরেবেঁধেই স্কুলের পাশের মাঠটায় নামানো হল।
হুকুম হল, “গোরু সেজে ঘাস খাও।”
তা-ই করতে হল হরিকে।
তারপর হুকুম হল, “চোখের পাতা একবারও না ফেলে পাঁচ মিনিট চেয়ে থাকো।”
তা-ই করতে হল।
ফের হুকুম, “এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সারা মাঠ চক্কর দাও।”
হরি তাও করল।
যখন ছাড়া পেল, তখন সে হেঁদিয়ে পড়েছে।
ছুটির পর যখন ক্লাসের ছেলেরা দুদ্দাড় করে বেরোচ্ছিল, তখন হরি বুদ্ধি করে তাদের সঙ্গে বেরোনোর চেষ্টা করল না, ক্লাসেই চুপ করে বসে রইল। কারণ ছেলেগুলো রাস্তায় তার ওপর ফের হামলা করতে পারে। স্কুল ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর সে গুটিগুটি বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
কিছুদূর হাঁটার পরই হরি একটা অস্বস্তি বোধ করছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ তার পিছু নিয়েছে। কেউ পিছু নিলে বা তাকিয়ে থাকলে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে তা ধরা পড়েই, এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু টের ঠিকই পাওয়া যায়। হরিও পেল। চৌপথিতে ডান হাতে মোড় নিতে গিয়েই সে ছেলেটাকে লক্ষ করল। কালো, লম্বামতো। সে ফিরে তাকাতেই ছেলেটা হাত তুলে থামতে ইশারা করল।
হরি আর দাঁড়াল না। হাঁটা ছেড়ে ছুটতে শুরু করে দিল। পিছন থেকে ছেলেটা ডাকল, “এই খোকা, শোনো, শোনো। ভয় নেই, আমি ওদের দলের নই।”
হরি দাঁড়াল, সন্দিহান চোখে ছেলেটার দিকে চেয়ে রইল।
ছেলেটা কাছে এসে বলল, “আমার নাম গোপাল। আমি তোমার সঙ্গেই এক ক্লাসে পড়ি। আজ তোমাকে ওরা যা করছিল, দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তোমার ভাই, ভীষণ সহ্যশক্তি।”
হরি স্বস্তির খাস ছেড়ে বলল, “ওরা ওরকম কেন বলো তো!”
গোপাল মৃদু একটু হেসে বলল, “এখানে ওরকম সব ছেলেই সংখ্যায় বেশি। তুমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলো না! পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম কয়েকটা দিন যা একটু কষ্ট। নতুন ছেলে এলেই এসব হয়।”
দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
গোপাল জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় থাকো?”
“কাঠগোলার দুখিরামবাবুর বাড়িতে।”
“সেটা কোথায়?”
“এই দিকে।” বলে হাত তুলে রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে হরি বলল, “রাস্তার শেষ দিকটায়। বাগান-ঘেরা বাড়ি।”
গোপাল বলল, “ওটা হল সাহেবপাড়া। এককালে সাহেবরা থাকত। এখন আর ও-পাড়ায় কেউ থাকে না। আমরা মাঝে-মাঝে পেয়ারা লিচু পাড়তে যাই। তোমাদের বাড়িটার কোনও নাম আছে?”
“খেয়াল করিনি তো!”
“কুসুমকুঞ্জ নয় তো! শুনেছিলাম কে এক বড়লোক কুসুমকুঞ্জ কিনে নিয়েছে।”
“হতে পারে।”
“যদি কুসুমকুঞ্জ হয়, তবে…”
“তবে কী?”
“না, বাড়িটার তেমন সুনাম নেই কিনা।”
“সুনাম নেই কেন? ভূত আছে নাকি?”
“কে জানে বাবা। এ-পাড়ার সব বাড়িই পুরনো। ভূত থাকতেই পারে। আমার ভীষণ ভূতের ভয়। তোমার?”
“আমারও।”
সামনের চৌপথিতে এসে গোপাল বলল, “আমি এবার বাঁ দিকে যাব। তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে বেশ হল। কাল থেকে তুমি আমার পাশে বসবে। বাঁ দিকে থার্ড বেঞ্চ।”
হরি মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
একজন বন্ধু পাওয়ায় হরির বেশ ভালই লাগছিল। গোপালের কথা ভাবতে ভাবতেই সে দুখিরামবাবুর বাড়ির ফটকে এসে পৌঁছল। ফটকের দু’ধারে দুটো মস্ত থাম। দুটোর গায়েই লতা বেয়ে উঠে ঢেকে ফেলেছে প্রায়। বাঁ দিকের থামের গায়ে একটা শ্বেতপাথরের ফলক লতার আড়ালে ঢেকে গেছে। হরি লতাপাতা সরিয়ে বিবর্ণ ফলকটা লক্ষ করল। অক্ষরগুলো প্রায় মুছে গেছে, তবু পড়া যায়। হরি দেখে নিশ্চিন্ত হল যে, বাড়িটার নাম কুসুমকুঞ্জ নয়। এমনকী বাংলা নামই নয়। ইংরিজিতে লেখা ‘গ্রিন ভ্যালি।’