Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পলাশের রঙ || Saswati Das

পলাশের রঙ || Saswati Das

পলাশের রঙ

“কোপাই গ্রাম” নামটার সাথে পলাশের একটা নাড়ির টান আছে। ওর মনে আছে ও তখন খুব ছোট, সেবার বসন্তকালে গ্রামের পলাশ গাছগুলো লাল ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল। তখন ওর মাসি হঠাৎ বলে ওঠে- ‘জানিস ক্যেনে পলাশ, তুয়ার নাম ক্যেনে পলাশ রাখ্যা হ’ল্য?’
‘না মাসি ! কে আমার নামটো পলাশ রাইখলো?’
‘তুয়ার মা রে! তুয়ার মা! ওই পলাশ গাছটার তলায় তুকে জনমটো দিয়েই মরেটো গ্যেলো; মরার আগে উ বুলে র‍্যেখেছিলো, ছিল্যাটো হল্যে যেন পলাশ নামটো রাকখি।’
‘মা!’
‘হাঁ রে তুয়ার মা! সে বুছর ওই পলাশগাছ ভেইঙ্গে ফুলটো ইস্যেছিল; ই রকম লাল।’
পলাশ দেখছে গাছটা যেন সত্যিই তার দিকে চেয়ে হাসছে।
তখন থেকে ওই গাছটার তলায় এলেই ও মা মা গন্ধ পায়। গাছটাকেই মা বলে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। সেদিন ওই গাছতলায় বসে মায়ের জন্য খুব কেঁদেছিল পলাশ। সেই থেকে বসন্তকাল আর পলাশ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। পলাশফুল ফুটলেই ওর মনে হয় ওর মা এসে ওর পাশে বসেছে। পলাশগাছটার তলায় ও চুপটি করে বসে থাকে। গাছ থেকে একটা ফুল পড়লেই ওর মনে হয় মা ভালোবেসে ওকে স্পর্শ করছে। তারপর পলাশ বড় হলো, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ। ছোট্ট কোপাই গ্রাম, কোপাই নদী, বসন্তের পলাশফুল এই সব ছেড়ে কলকাতার মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে চলে আসা। তারও পর বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া এবং সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া। কিন্তু এখনো চোখ বুজলেই পলাশ দেখতে পায়- তার ছেলেবেলার কোপাইগ্রাম; ছোট্ট গ্রামটাকে বেষ্টন করে রেখেছে কোপাইনদী। ছোট ছোট লাল মাটির ঘর আর ছাতিমের ছায়া ঘেরা পুকুর পাড়, এ’সব এখনো পলাশ তার চোখের সামনে ছবির মত দেখতে পায়। দেখতে পায় লাল ফুলে ভরা পলাশগাছটাকে। এইসব স্মৃতি আঁকড়েই তো এতোগুলো বছর পার হয়েছে। আজও মনে হয়, মা যেন পলাশগাছের তলা থেকে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আজ অনেকগুলো বছর পর পলাশ কলকাতায় ফিরেছে। প্রথমেই ও ঠিক করে ফেলে আগে একবার কোপাই গ্রামে যাবে। ওখানে গিয়ে ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো একবার তাজা করে নেবে। আচ্ছা ওই পলাশগাছটা আছে এখনো! মাসি গত বছর দেহ রেখেছেন। মাসির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়ও আসা হয়ে ওঠেনি। সেই যে ও গ্রাম ছেড়ে চলে গেল ডাক্তারি পড়তে, তারপর আর সে’ভাবে গ্রামে যাওয়াই হয়নি। পলাশ মনে মনে ভাবে এ’বার গ্রামে গিয়ে কিছুদিন থাকতে হবে।
কিন্তু গ্রামে ফিরে পলাশ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার সে পুরোনো চেনা গ্রামটা আর নেই। ছাতিমের ছায়ায় ঘেরা পুকুর পাড় নেই, লাল মাটির বাড়িগুলো এখন বেশিরভাগ ইঁটের গাঁথনি হয়ে গেছে। এখন বসন্তকাল, পলাশগাছ লাল হয়ে ফুল ফুটে আছে। পলাশ ছুট্টে গেল তার ‘মা’ পলাশ গাছটার কাছে। কিন্তু পলাশ সেখানে এসে দেখলো একটা শুকনো মরা গাছ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা কী গাছ দেখে বোঝার উপায় নেই। লোকের মুখে শুনে বুঝলো ওটাই সেই পলাশ গাছ। পলাশ সেই মরা গাছের কাছে এসে ছোট্ট শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, ‘মা.. মা..গো তুমি আমায় ছেড়ে আবার চলে গেলে মা..! আমি যে আজ আবার মাতৃহারা হলাম।’
গাছটা থেকে একটা সরু শুকনো ডাল ভেঙে পলাশের পিঠের উপর পড়লো। পলাশের মনে হলো তার মা তাকে বলছে, ‘বাপ আমার কানদিস্ নে বাপ, মুই তো তুয়ার সঙ্গে আছি তুয়ার সাথ্যে সাথ্যে।’
দু’চোখের অবিরাম ধারায় শুষ্ক পলাশেও বুঝি রঙের ছোঁয়া লাগে।
পলাশ ওই মরা গাছটার গোড়া থেকে এক মুঠো মাটি কুড়িয়ে নিয়ে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আজ থেকে কোপাই গ্রাম তার কাছে পুরোনো স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাক। তার মাকে এবার সৎকার করে এখান থেকে সে চিরকালের মত চলে যাবে। পলাশ উঠে কোপাই নদীর ধারে এলো। শুকনো পলাশ গাছের নিচের মাটি, যা সে কুড়িয়ে এনেছিল, সেই মাটি বিসর্জন দিলো নদীর জলে। নদীতে স্নান করে প্রণাম করে বলল ‘মা, আজ তোমাকে আমি মুক্ত করে দিলাম। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো, তোমার খোকা আজও তোমাকে খোঁজে মা; আমি তোমার হাসি-মুখটা দেখতে পাই, যখনই পলাশগাছ লাল ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। তোমার খোকা, ওই পলাশের রঙ হয়ে বেঁচে থাকবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress