Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অপূর্বর এমন করিয়া বাহির হইয়া যাওয়াটা সকলকেই বিস্মিত করিল। ঘরে আলো বেশী ছিল না, কিন্তু তাহার অস্বাভাবিক মুখের ভাব ও অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠস্বর যেন অতিশয় বে-মানান দেখাইল। ব্যারিস্টার কৃষ্ণ আইয়ার ক্ষণকাল নীরবে থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ইনি কে ডাক্তার? অত্যন্ত সেন্টিমেন্টাল! তাঁহার শেষ কথাটার উপরে স্পষ্ট একটা অভিযোগের খোঁচা ছিল। অর্থাৎ, এ-সকল লোক এখানে কেন?

ডাক্তার শুধু একটুখানি হাসিলেন, কিন্তু তাড়াতাড়ি এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন তলওয়ারকর। কহিলেন, ইনি মিস্টার হালদার—অপূর্ব হালদার। এক আফিসে আমরা কাজ করি, আমার সুপিরিয়র অফিসর। একটু থামিয়া সশ্রদ্ধ স্নেহের সহিত বলিলেন, কিন্তু আমার একান্ত অন্তরঙ্গ,—আমার পরম বন্ধু। সেন্টিমেন্টাল? ই—য়েস্‌। ডাক্তারবাবু আপনি বোধ করি হালদারের রেঙ্গুনের প্রথম অভিজ্ঞতার গল্প শোনেন নি? সে এক—

সহসা ভারতীর প্রতি চোখ পড়িতেই তিনি সলজ্জে থামিয়া গিয়া কহিলেন, সে যাই হোক, প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই কিন্তু আমরা বন্ধু,—বাস্তবিক পরম বন্ধু।

তলওয়ারকরের ব্যগ্রতায় ও বিশেষ করিয়া তাঁহার পরম বন্ধু শব্দটার পুনঃ পুনঃ প্রয়োগে সেন্টিমেন্টালিস্‌মের প্রতি খোঁচা দিতে ব্যারিস্টার সাহেব আর সাহস করিলেন না, কিন্তু তাঁহার মুখের চেহারাটা যেন সন্দিগ্ধ এবং অপ্রসন্ন হইয়া রহিল।

ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, সেন্টিমেন্ট জিনিসটা নিছক মন্দ নয় কৃষ্ণ আইয়ার। এবং সবাই তোমার মত শক্ত পাথর না হলেই চলবে না মনে করাও ঠিক নয়।

কৃষ্ণ আইয়ার খুশী হইলেন না, বলিলেন, তা আমি মনেও করিনে, কিন্তু এটুকু মনে করাও বোধ হয় দোষের নয় ডাক্তার, এই ঘরটা ছাড়াও তাঁদের চলে বেড়াবার যথেষ্ট প্রশস্ত জায়গা পৃথিবীতে খোলা আছে।

তলওয়ারকর মনে মনে ক্রুদ্ধ হইলেন। যাঁহাকে তিনি পরম বন্ধু বলিয়া বারংবার অভিহিত করিতেছেন, তাঁহাকে তাঁহারই সম্মুখে অবাঞ্ছিত প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টায় নিজেকে অপমানিত জ্ঞান করিয়া কহিলেন, মিস্টার আইয়ার, অপূর্ববাবুকে আমি চিনি। আমাদের মন্ত্রে দীক্ষা তাঁর বেশী দিনের নয় সত্য, কিন্তু বন্ধুর অভাবিত মুক্তিতে সামান্য বিচলিত হওয়া আমাদের পক্ষেও মারাত্মক অপরাধ নয়। সংসারে চলে বেড়াবার স্থান অপূর্ববাবুর যথেষ্টই আছে, এবং আশা করি এ ঘরেও স্থান তাঁর কোনদিন সঙ্কীর্ণ হবে না।

কৃষ্ণ আইয়ার ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইয়া আজ অপূর্বকে লক্ষ্য করিয়াছিলেন, তিনি চুপ করিয়া রহিলেন, কিন্তু ডাক্তার তাঁহার স্বাভাবিক শান্তির সহিত কহিলেন, নিশ্চয় হবে না তলওয়ারকর, নিশ্চয় হবে না। এই বলিয়া তিনি উপস্থিত সকলের মুখের প্রতি ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে ভারতীকেই যেন বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়া হঠাৎ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কিন্তু এই বন্ধুত্ব জিনিসটা সংসারে কতই না ক্ষণভঙ্গুর ভারতী! একদিন যার সম্বন্ধে মনে করাও যায় না, আর একদিন কতটুকু ছোট্ট কারণেই না তার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ হয়ে যায়! সেটাও দুনিয়ার অস্বাভাবিক নয় তলওয়ারকর, তার জন্যেও প্রস্তুত থাকা ভাল। মানুষ বড় দুর্বল কৃষ্ণ আইয়ার, বড় দুর্বল! তখন এই সেন্টিমেন্টের দরকার হয় তার ধাক্কা সামলাতে।
এই-সকল কথার উত্তর দিবারও কিছু নাই, প্রতিবাদ করাও চলে না; উভয়েই মৌন হইয়া রহিল, কিন্তু ভারতীর মুখ ম্লান হইয়া উঠিল। ডাক্তারের প্রতি তাহাদের অবিচলিত ও অসীম শ্রদ্ধা, অহেতুক একটি বাক্যও উচ্চারণ করা তাঁহার স্বভাব নয়, এ সত্য ভারতী ভাল করিয়াই জানে, কিন্তু কি এবং কাহাকে ইঙ্গিত করিয়া যে এ কথা তিনি কহিলেন, এবং ঠিক কি ইহার তাৎপর্য তাহা ধরিতে না পারিয়া মনের মধ্যেটা তাহার শুধু উদ্বেগ ও আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

ডাক্তার সম্মুখের ঘড়ির দিকে চাহিয়া কহিলেন, আমার ত ক্রমশঃ যাবার সময় হ’য়ে এল ভারতী, আজ রাত্রের গাড়িতে আমি চললাম তলওয়ারকর।

কোথায় এবং কি জন্য, নিজে হইতে না বলিলে এরূপ অনাবশ্যক কৌতূহল প্রকাশের বিধি ইহাদের নাই। একমুহূর্ত জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া থাকিয়া তলওয়ারকর প্রশ্ন করিল, আমার প্রতি আপনার কি আদেশ?

ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, আদেশই বটে! কিন্তু একটা কথা। বর্মায় স্থানাভাব যদি হয়ও, নিজের দেশে হবে না তা নিশ্চয়। শ্রমিকের দিকে একটু দৃষ্টি রেখো।

তলওয়ারকর ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আচ্ছা। আবার কবে দেখা হবে?

ডাক্তার কহিলেন, নীলকান্ত যোশীর শিষ্য তুমি, এ আবার কি প্রশ্ন তলওয়ারকর?

তলওয়ারকর চুপ করিয়া রহিল। ডাক্তার পুনশ্চ কহিলেন, আর দেরি করো না যাও,— বাসায় পৌঁছতে প্রায় ভোর হয়ে যাবে। প্র্যাক্‌টিস তা’হলে এখানেই স্থির ক’রলে কৃষ্ণ আইয়ার?

কৃষ্ণ আইয়ার মাথা নাড়িয়া সায় দিলেন। ভাড়াটে গাড়ি বাহিরে অপেক্ষা করিয়া ছিল, দুজনে বাহির হইবার সময়ে তলওয়ারকর কেবল একবার কহিল, অন্ধকারে অপূর্ববাবু কোথায় চলে গেলেন একবার দেখা হ’ল না—

কিন্তু এ কথার উত্তর দেওয়া বোধ করি কেহ প্রয়োজন মনে করিলেন না। কিছুক্ষণেই বাহিরে গাড়ির শব্দে বুঝা গেল তাঁহারা চলিয়া গেলেন। তখন ডাক্তার বলিলেন, তোমার কি মনে হয় অপূর্ব বাসায় চলে গেছে?

ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না, খুব সম্ভব আশেপাশে কোথাও আছেন, একটু খুঁজে দেখলেই পাওয়া যাবে। আপনার সঙ্গে আর একবার দেখা না ক’রে তিনি কখনো যাবেন না।

ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, তা হ’লে দশ-পনর মিনিটের মধ্যেই এ কাজটা তার সেরে নেওয়া আবশ্যক। তার বেশী ত আমি সময় দিতে পারবো না ভাই!

না, এর মধ্যেই তিনি এসে পড়বেন, এই বলিয়া ভারতী শুধু যে কেবল উপস্থিত ডাক্তারের কথার একটা জবাব দিল তাই নয়, সে আপনাকে আপনি ভরসা দিল। একাকী এই অন্ধকারে অপূর্ব কিছুতেই যাইবে না, অতএব কোথাও নিকটেই আছে এ বিষয়ে সে যেমন নিশ্চিত ছিল, তাহাদের অশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধাভাজন এই অতিমানবের বিদায়ের পূর্বক্ষণে আর একবার সর্বান্তঃকরণে তাঁহার ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া লওয়ারও প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধেও সে তেমনি নিঃসংশয় ছিল। নানাদিক দিয়া নানাকারণে আজ অপূর্ব বহু অপরাধ জমা করিয়াছে, সময় থাকিতে তাহাকে দিয়াই সেগুলার ক্ষালন করিয়া না লইয়াই বা ভারতী বাঁচে কি করিয়া? কিন্তু, সেই অমূল্য স্বল্পকালটুকু বৃথায় শেষ হইয়া আসিতে লাগিল,—অপূর্বর দেখা নাই! আঁধার দ্বারপথে ভারতীর চঞ্চল চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হইয়া আসিল এবং উৎকর্ণ চিত্ত বাহিরে পরিচিত পদশব্দের প্রতীক্ষায় একেবারে অধীর হইয়া উঠিল।
কোথাও সে হাতের কাছেই আছে, একবার ইচ্ছা হইল ছুটিয়া গিয়া সে একমুহুর্তে খুঁজিয়া আনে, কিন্তু এতখানি ব্যাকুলতা প্রকাশ করিতে আজ তাহার অত্যন্ত লজ্জা বোধ হইল। ডাক্তার তাঁহার স্ট্র্যাপ-বাঁধা বোঁচকার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া হাই তুলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, ভারতী দেয়ালের ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিল আর মিনিট পাঁচ-ছয়ের অধিক সময় নাই, কহিল, আপনি কি হেঁটেই যাবেন?

ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না। দুটো কুড়ি মিনিটে সদর রাস্তার উপর দিয়ে খুব সম্ভব একটা ঘোড়ার গাড়ি ফিরে যাবে, চলতি গাড়ি—গণ্ডা-ছয়েক পয়সা ভাড়া দিলেই স্টেশনে পৌঁছে দেবে।

ভারতী বলিল, পয়সা না দিলেও দেবে। কিন্তু যাবার পূর্বে সুমিত্রাদিদিকে একবার দেখা দিয়ে যাবেন না? তিনি সত্যই পীড়িত।

ডাক্তার কহিলেন, আমি ত বলিনি তিনি অসুস্থ নন। কিন্তু ডাক্তার না দেখালেই বা সারবে কি করে?

ভারতী বলিল, কিন্তু তাই যদি হয় ত আপনার চেয়ে বড় ডাক্তারই বা পৃথিবীতে আছে কে?

ডাক্তার রহস্যভরে জবাব দিলেন, তাহলেই হয়েছে! দীর্ঘ অনভ্যাসে ও-বিদ্যে ত মন থেকে ধুয়ে মুছে গেছেই, তা ছাড়া বসে বসে কারও চিকিৎসা করি সে সময়ই বা কৈ?

কথা তাঁহার শেষ না হইতেই ভারতী বলিয়া উঠিল, সময় কৈ! সময় কৈ! কেউ মরে গেলেও সময় হবে না— এমনিই দেশের কাজ? দেখুন ডাক্তারবাবু, বিদ্যে মুছে যাবার মন ও নয়; মুছে সত্যিই কিছু গিয়ে থাকে ত সে দয়া-মায়া!

ডাক্তারের হাসিমুখ কেবল মুহূর্তের তরে গম্ভীর হইয়াই পুনরায় পূর্বশ্রী ধারণ করিল। কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টি ভারতী সেই একমুহূর্তেই নিজের ভুল বুঝিতে পারিল। তাহাদের ঘনিষ্ঠতা বহুদূর পর্যন্ত গিয়াছে সত্য, কিন্তু এদিকে অঙ্গুলি-সঙ্কেত করিবার অধিকার আজও তাহার ছিল না। বস্তুতঃ, সুমিত্রা কে, ডাক্তারের সহিত তাহার কি সম্বন্ধ, এবং কবে কি করিয়া সে যে এই দলভুক্ত হইয়া পড়িল অদ্যাবধি ভারতী তাহার কিছুই জানিত না। তাহাদের সম্প্রদায়ে ব্যক্তিগত পরিচয় সম্বন্ধে কৌতূহলী হওয়া একান্ত নিষিদ্ধ। সুতরাং, অনুমান ভিন্ন সঠিক কিছুই জানিবার তাহার উপায় ছিল না। শুধু মেয়েমানুষ বলিয়াই সে সুমিত্রার মনোভাব উপলব্ধি করিয়াছিল। কিন্তু নিজের সেই অনুভূতিমাত্রটুকু ভিত্তি করিয়া অকস্মাৎ এতবড় ইঙ্গিত ব্যক্ত করিয়া ফেলিয়া সে শুধু সঙ্কুচিত নয়, ভয়ও পাইল। ভয় ডাক্তারকে নয়,—সুমিত্রাকে। এ কথা কোন মতেই তাঁহার কানে উঠিলে চলিবে না! তাঁহার অন্য পরিচয় জানা না থাকলেও প্রথম হইতেই সেই নিস্তব্ধ তীক্ষ্ণ-বিদ্যা-বুদ্ধিশালিনী রমণীর দুর্ভেদ্য নিবিড়তার পরিচয় কাহারও অবিদিত ছিল না। তাঁহার স্বল্পভাষণে, তাঁহার প্রখর সৌন্দর্যে প্রতি পদক্ষেপে, তাঁহার অবহিত বাক্যালাপে, তাঁহার অচঞ্চল আচরণের গাম্ভীর্যে ও গভীরতায় এই দলের মধ্যে থাকিয়াও তাঁহার অপরিসীম দূরত্ব স্বতঃসিদ্ধের মতই যেন সকলে অনুভব করিত। এমন কি তাঁহার অসুস্থতা লইয়াও গায়ে পড়িয়া আলোচনা করিতেও কাহারো সাহস হইত না। কিন্তু একদিন সেই দুর্লঙ্ঘ্য কঠোরতা ভেদ করিয়া তাঁহার অত্যন্ত গোপন দুর্বলতা যেদিন অপূর্ব ও ভারতীর সম্মুখে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল, যেদিন একজনের বিদায়ের ক্ষণে সুমিত্রা নিজেকে সংবরণ করিতে পারে নাই, সেদিন হইতেই সে যেন সকলের হইতে আরও বহু দূরে আপনাকে আপনি সরাইয়া লইয়া গেছে। সেই দীর্ঘায়ত ব্যবধান অপরের অযাচিত সহানুভূতির আকর্ষণে সঙ্কুচিত হইবার আভাসমাত্রেই যে তাহার সেই আত্মাশ্রয়ী অন্তর্গূঢ় বেদনা একেবারে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিবে এই কথা নিঃসংশয়ে অনুভব করিয়া ভারতীর ক্ষুব্ধ চিত্ত শঙ্কায় পূর্ণ হইয়া যাইত।
ডাক্তার আরামকেদারায় ভাল করিয়া হেলান দিয়া শুইয়া সুদীর্ঘ পদদ্বয় সুমুখের টেবিলের উপর প্রসারিত করিয়া দিয়া সহসা মহা আরামের নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আঃ—

ভারতী বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, শুলেন যে বড়?

ডাক্তার রাগ করিয়া বলিলেন, কেন, আমি কি ঘোড়া যে একটু শুলেই বেতো হয়ে যাবো? আমার ঘুম পাচ্চে,— তোমাদের মত আমি দাঁড়িয়ে ঘুমোতে পারিনে।

ভারতী বলিল, দাঁড়িয়ে ঘুমোতে আমরাও পারিনে। কিন্তু কেউ যদি এসে বলে আপনি দৌড়তে দৌড়তে ঘুমোতে পারেন, আমি তাতেও আশ্চর্য হইনে। আপনার ওই দেহটা দিয়ে সংসারে কি যে না হ’তে পারে তা কেউ জানে না। কিন্তু সময় হল যে; এখনি না বেরুলে গাড়ি চলে যাবে যে!

যাক গে।

যাক গে কিরকম?

উঃ—ভয়ানক ঘুম পাচ্চে ভারতী, চোখ চাইতে পারচি নে। এই বলিয়া ডাক্তার দুই চক্ষু মুদিত করিলেন।

কথা শুনিয়া ভারতী পুলকিতচিত্তে অনুভব করিল, কেবল তাহারই অনুরোধে আজ তাঁহার যাওয়া স্থগিত রহিল। না হইলে শুধু ঘুম কেন বজ্রাঘাতের দোহাই দিয়াও তাঁহার সঙ্কল্পে বাধা দেওয়া যায় না। কহিল, আর ঘুমই যদি সত্যি পেয়ে থাকে ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন না!

ডাক্তার চোখ মুদিয়াই প্রশ্ন করিলেন, তোমার নিজের উপায় হবে কি? অপূর্বর পথ চেয়ে সারারাত বসে কাটাবে?

ভারতী বলিল, আমার বয়ে গেছে। পাশের ছোট ঘরে বিছানা করে এখনি গিয়ে শুয়ে ঘুমবো।

ডাক্তার কহিলেন, রাগ করে শোওয়া যেতে পারে, কিন্তু রাগ করে ঘুমোনো যায় না। বিছানায় পড়ে ছটফট করার মত শাস্তি আর নেই। তার চেয়ে খুঁজে আনো গে,—আমি কারও কাছে প্রকাশ করব না।

ভারতীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু সে লজ্জা ধরা পড়িল না। কারণ, ডাক্তার চোখ বুজিয়াই ছিলেন। তাঁহার নিমীলিত চোখের প্রতি চোখ রাখিয়া ভারতী মুহূর্ত-কয়েক মৌন থাকিয়া আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, বিছানায় পড়ে ছটফট করার মত শাস্তি আর নেই এ আপনি জানলেন কি করে?

ডাক্তার উত্তর দিলেন, লোকে বলে তাই শুনি।

নিজে থেকে কিছুই জানেন না?

ডাক্তার চোখ মেলিয়া কহিলেন, আরে ভাই, আমাদের মত দুর্ভাগাদের শুতে বিছানাই মেলে না, তায় আবার ছটফট করা! এতখানি বাবুয়ানার কি ফুরসত আছে? এই বলিয়া তিনি মুচকিয়া হাসিলেন।

ভারতী হঠাৎ প্রশ্ন করিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, সবাই যে বলে আপনার দেহের মধ্যে রাগ নেই, এ কি কখনো সত্যি হতে পারে?

ডাক্তার বলিলেন, সত্যি? কখনো না, কখনো না! লোকে মিথ্যে করে আমার বিরুদ্ধে গুজব রটায়,—তারা আমাকে দেখতে পারে না।

ভারতী হাসিয়া কহিল, কিংবা অত্যন্ত বেশী ভালবাসে বলেই হয়ত গুজ রটায়। তারা আরও বলে আপনার মান-অভিমান নেই, দয়া-মায়া নেই, বুকের ভেতরটা আগাগোড়া একেবারে পাষাণ দিয়ে গড়া।

ডাক্তার কহিলেন, এও অত্যন্ত ভালবাসার কথা। তারপর?

ভারতী কহিল, তারপর সেই পাষাণ-স্তূপের মধ্যে আছে শুধু একটি বস্তু,—জননী জন্মভূমি! তার আদি নেই, অন্ত নেই, ক্ষয় নেই, ব্যয় নেই—তার ভয়ানক চেহারা আমাদের চোখে পড়ে না বলেই আপনার কাছে-কাছে থাকতে পারি, নইলে,—বলিতে বলিতে সে অকস্মাৎ একমুহূর্ত থামিয়া কহিল, কিরকম জানেন ডাক্তারবাবু, সুমিত্রাদিদিকে নিয়ে আমি সেদিন বর্মা অয়েল কোম্পানির কারখানা ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম; সেদিন তাদের নতুন বয়লারের পরীক্ষা হচ্ছিল।
অনেক লোক ভিড় করে তামাশা দেখছিল। কালো পাহাড়ের মত একটা প্রকাণ্ড জড়পিণ্ড,—কিন্তু, জড়পিণ্ডের বেশী সে আর কিছুই নয়। হঠাৎ তার একটা দরজা খুলে যেতে মনে হল যেন গর্ভেতে তার অগ্নির প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। সেখানে এই পৃথিবীটাকেও তাল করে ফেলে দিলে যেন নিমিষে ভস্মসাৎ করে দেবে। শুনলাম সে একাই নাকি এই বিরাট কারখানা চালিয়ে দিতে পারে। দরজা বন্ধ হল, আবার সেই শান্ত জড়পিণ্ড, ভিতরের কোন প্রকাশই বাহিরে নেই। সুমিত্রাদিদির মুখ দিয়ে গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেসা করলাম, কি দিদি? সুমিত্রা বললেন, এই ভয়ানক যন্ত্রটাকে মনে রেখো ভারতী, তোমাদের ডাক্তারবাবুকে চিনতে পারবে। এই তাঁর সত্যিকার প্রতিমূর্তি। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

ডাক্তার অন্যমনস্কের মত একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, সবাই কি ভালই আমাকে বাসে! কিন্তু ঘুমে যে আর চোখ চাইতে পারিনে ভারতী, কিছু একটা কর! কিন্তু তার আগে সে লোকটা গেল কোথায় একবার খোঁজ করবে না?

আপনি কিন্তু কারও কাছে গল্প করতে পারবেন না।

না। কিন্তু আমাকে বুঝি লজ্জা করবার দরকারই নেই?

ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না। মানুষের কাছেই শুধু মানুষের লজ্জা করে! এই বলিয়া সে হ্যারিকেন লণ্ঠনটা হাতে তুলিয়া লইয়া বাহিরে চলিয়া গেল।

মিনিট দশ-পনেরো পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, অপূর্ববাবু চলে গেছেন।

ডাক্তার বিস্ময়ে উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, এই অন্ধকারে? একা?

তাই ত দেখছি।

আশ্চর্য।

ভারতী বলিল, আমার বিছানা করা আছে, শুতে চলুন।

তুমি?

আমি মেঝেতে একটা কম্বল-টম্বল কিছু পেতে নেব। চলুন।

ডাক্তার উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, তাই চল। লজ্জা-সঙ্কোচ মানুষে মানুষকেই করে,—আমি পাষাণ বৈ ত নয়।

উপরের ঘরে গিয়া ডাক্তার শয্যায় শয়ন করিলে ভারতী মশারি ফেলিয়া দিয়া সযত্নে চারিদিক গুঁজিয়া দিল, এবং তাহারই অনতিদূরে নীচে মেঝের উপর আপনার বিছানা পাতিল। ডাক্তার সেই দিকে চাহিয়া ক্ষুণ্ণকণ্ঠে কহিলেন, সকলে মিলে আমাকে এমন করে অগ্রাহ্য করলে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে।

ভারতী হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, আমরা সকলে মিলে আপনাকে মানুষের দল থেকে বার করে পাথরের দেবতা বানিয়ে রেখেচি।

তার মানে আমাকে ভয়ই নেই?

ভারতী অসঙ্কোচে জবাব দিল, একবিন্দু না। আপনার থেকে কারও লেশমাত্র অকল্যাণ ঘটতে পারে এ আমরা ভাবতেই পারিনে।

প্রত্যুত্তরে ডাক্তার হাসিয়া শুধু বলিলেন, আচ্ছা, টের পাবে একদিন।

শয্যা গ্রহণ করিয়া ভারতী হঠাৎ প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, কে আপনাকে সব্যসাচী নাম দিলে ডাক্তারবাবু? এ ত আপনার আসল নাম নয়। ডাক্তার হাসিতে লাগিলেন। কহিলেন, আসল যাই হোক, নকল নামটি দিয়েছিলেন আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাই। তাঁর মস্ত উঁচু একটা আমগাছ ছিল, কেবল আমিই তার ঢিল মেরে আম পাড়তে পারতাম। একবার ছাত থেকে লাফাতে গিয়ে ডানহাতটা আমার মচকে গেল। ডাক্তার এসে ব্যান্ডেজ বেঁধে গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে দিলেন। সবাই আহা আহা করতে লাগলো, শুধু পণ্ডিতমশাই খুশী হয়ে বললেন, যাক, আম ক’টা আমার ঢিলের ঘা থেকে বাঁচলো। পাকলে দুটো-একটা হয়ত মুখে দিতেও পারবো।
ভারতী বলিল, বড্ড দুষ্টু ছিলেন ত!

ডাক্তার বলিলেন, হাঁ, দুর্নাম একটু ছিল বটে। যাই হোক পরের দিন থেকেই আবার তেমনি আম পাড়ায় লেগে গেলাম, কিন্তু পণ্ডিতমশাই কি করে খবর পেয়ে সেদিন হাতেনাতে একেবারে ধরে ফেললেন। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললেন, ঘাট হয়েছে বাবা সব্যসাচী, আমের আশা আর করিনে। ডানটা ভেঙ্গেছে, বাঁ-হাত চলছে, বাঁ-টা ভাঙ্গলে বোধ হয় পা-দুটো চলবে। থাক বাবা, আর কষ্ট করো না, যে ক’টা কাঁচা আম বাকী আছে লোক দিয়ে পাড়িয়ে দিচ্ছি।

ভারতী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল, পণ্ডিতমশায়ের অনেক দুঃখের দেওয়া নাম।

ডাক্তার নিজেও হাসিয়া বলিলেন, হাঁ, আমার অনেক দুঃখের নাম। কিন্তু সেই থেকে আমার আসল নামটা লোকে যেন ভুলেই গেল।

ভারতী ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সকলে যে বলে দেশ আর আপনি, আপনি আর দেশ—এই দুই-ই আপনাতে একেবারে এক হয়ে গেছে,—এ কি করে হল?

ডাক্তার কহিলেন, সে-ও এক ছেলেবেলার ঘটনা ভারতী। এ জীবনে কত কি এলো, কত কি গেলো, কিন্তু সেদিনটা এ জীবনে একেবারে অক্ষয় হয়ে রইল। আমাদের গ্রামের প্রান্তে বৈষ্ণবদের একটা মঠ ছিল, একদিন রাত্রে সেখানে ডাকাত পড়লো। চেঁচাচেঁচি কান্নাকাটিতে গ্রামের বহুলোক চারিদিকে জমা হল, কিন্তু ডাকাতদের সঙ্গে একটা গাদা বন্দুক ছিল, তারা তাই ছুঁড়তে লাগলো দেখে কোন লোক তাদের কাছে ঘেঁষতে পারলে না। আমার জাটতুতো একজন বড়ভাই ছিলেন, তিনি অত্যন্ত সাহসী এবং পরোপকারী, যাবার জন্যে তিনি ছটফট করতে লাগলেন, কিন্তু গেলে নিশ্চয় মৃত্যু জেনে সবাই তাঁকে ধরে রেখে দিলে। নিজেকে কোনমতে ছাড়াতে না পেরে তিনি সেইখান থেকে শুধু নিষ্ফল আস্ফালন, এবং ডাকাতদের গালাগালি দিতে লাগলেন। কিন্তু কোন ফলই তাতে হল না, তারা ওই একটিমাত্র বন্দুকের জোরে দু’তিন শ লোকের সুমুখে মোহন্ত বাবাজীকে খুঁটিতে বেঁধে তিল তিল করে পুড়িয়ে মারলে। ভারতী, আমি তখন ছেলেমানুষ ছিলাম, কিন্তু আজও তার কাকুতি-মিনতি, আজও তার মরণ চীৎকার যেন মাঝে মাঝে কানে শুনতে পাই। উঃ—সে কি ভয়ানক বুক-ফাটা আর্তনাদ!

ভারতী নিরুদ্ধশ্বাসে কহিল, তার পর?

ডাক্তার কহিলেন, তারপর বাবাজীর জীবন-ভিক্ষার শেষ অনুনয় সমস্ত গ্রামের সম্মুখে ধীরে ধীরে সাঙ্গ হল, তাদের লুটপাটের কাজও নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগে পরিসমাপ্ত হল,—চলে যাবার সময় সর্দার বড়দাদার উদ্দেশে পিতৃ উচ্চারণ করে শপথ করে গেল যে আজ তারা শ্রান্ত, কিন্তু মাস-খানেক পরে ফিরে এসে এর শোধ দেবে। বড়দা জেলার সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে কেঁদে কেটে পড়লেন একটা বন্দুক চাই। কিন্তু পুলিশ বললে, না। বছর-দুই পূর্বে একজন অত্যন্ত অত্যাচারী পুলিশ সাব-ইন্‌স্পেক্টরের কান মলে দেবার অপরাধে তাঁর দু’মাস জেল হয়েছিল। এবং এই অপরাধেই সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, কোন মতেই না। দাদা বললেন, সাহেব, আমরা কি তবে মারা যাবো? সাহেব হেসে বললেন, এত যার ভয় সে যেন ঘর-বাড়ি বেচে আমার জেলা থেকে অন্য জেলায় চলে যায়।

ভারতী উত্তেজনায় বিছানায় উঠিয়া বসিয়া কহিল, দিলে না? এতবড় সর্বনাশ আসন্ন জেনেও দিলে না?

ডাক্তার কহিলেন, না। এবং কেবল তাই নয়, বড়দা ব্যাকুল হয়ে যখন তীর-ধনুক ও বর্শা তৈরি করালেন, পুলিশের লোক খবর পেয়ে সেগুলো পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে গেল।
কি হল তার পর?

ডাক্তার বলিলেন, তার পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। সেই মাসের মধ্যেই সর্দার তার প্রতিজ্ঞা পালন করলে। এবারে বোধ করি আরও একটা বেশী বন্দুক ছিল। বাড়ির আর সকলেই পালালেন, শুধু বড়দাকে কেউ নড়াতে পারলে না। কাজেই ডাকাতের গুলিতে প্রাণ দিলেন।

ভারতী রক্তহীন পাংশুমুখে বলিয়া উঠিল, প্রাণ দিলেন?

ডাক্তার কহিলেন, হাঁ। ঘণ্টা-চারেক সজ্ঞানে বেঁচে ছিলেন। গ্রামসুদ্ধ জড় হয়ে হৈচৈ করতে লাগলো, কেউ ডাকাতদের, কেউ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে গাল পাড়তে লাগলো, শুধু দাদাই কেবল চুপ করে রইলেন। পাড়াগাঁ, হাসপাতাল দশ-বার ক্রোশ দূরে, রাত্রিকাল, গ্রামের ডাক্তার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে এলে তাঁর হাতটা দাদা সরিয়ে দিয়ে কেবল বললেন, থাক, আমি বাঁচতে চাইনে। বলিতে বলিতে সেই পাষাণ দেবতার কণ্ঠস্বর হঠাৎ একটুখানি যেন কাঁপিয়া গেল। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, বড়দা আমাকে বড় ভালবাসতেন। কাঁদতে দেখে একটিবার মাত্র চোখ মেলে চাইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ছিঃ! মেয়েদের মত এই-সব গরু ভেড়া ছাগলদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তুই আর কাঁদিস নে শৈল। কিন্তু রাজত্ব করার লোভে যারা সমস্ত দেশটার মধ্যে মানুষ বলতে আর একটা প্রাণীও রাখেনি তাদের তুই জীবনে কখনো ক্ষমা করিস নে। এই ক’টা কথা, এর বেশি আর একটা কথাও তিনি বলেন নি। ঘৃণায় একটা উঃ আঃ পর্যন্ত তাঁর মুখ দিয়ে শেষ পর্যন্ত বার হল না, এই অভিশপ্ত পরাধীন দেশ চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে গেলেন। কেবল আমিই জানি ভারতী, কত মস্তবড় প্রাণ সেদিন বার হয়ে গেল।

ভারতী নীরবে স্থির হইয়া রহিল। কবে কোন্‌ পল্লী-অঞ্চলের এক দুর্ঘটনার কাহিনী। ডাকাতি উপলক্ষে গোটা-দুই অজ্ঞাত অখ্যাত লোকের প্রাণ গিয়াছে। এই ত! জগতের বড় বড় বিরোধের দুঃসহ দুঃখের পাশে ইহা কি-ই বা! অথচ এই পাষাণে কি গভীর ক্ষতই না করিয়াছে! তুলনা ও গণনার দিক দিয়া দুর্বলের দুঃখের ইতিহাসে এই হত্যার নিষ্ঠুরতা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। এই বাঙলা দেশেই ত নিত্য কত লোকে চোর-ডাকাতের হাতে মরিতেছে! কিন্তু একি শুধু তাই? ও পাথর কি এতটুকু আঘাতেই দীর্ণ হইয়াছে? ভারতী অলক্ষ্যে চাহিয়া দেখিল। এবং বিদ্যুৎশিখা অকস্মাৎ অন্ধকার চিরিয়া যেমন করিয়া অদৃশ্য বস্তু টানিয়া বাহির করে, ঠিক তেমনি করিয়া ওই পাথরের মুখের পরেই সে যেন সমস্ত অজ্ঞাত রহস্য চক্ষের পলকে প্রত্যক্ষ করিল। সে দেখিল, এই বেদনার ইতিহাসে মৃত্যু কিছুই নয়,—মরণ উহাকে আঘাত করে নাই, কিন্তু মর্মভেদী আঘাত করিয়াছে ওই দুটো লোকের মৃত্যুর মধ্য দিয়া শৃঙ্খলিত পদানত সমস্ত ভারতীয়ের উপায়বিহীন অক্ষমতা! আপন ভাইয়ের আসন্ন হত্যা নিবারণ করিবার অধিকারটুকু হইতে সে বঞ্চিত—অধিকার আছে, শুধু চোখ মেলিয়া নিঃশব্দে চাহিয়া দেখিবার। ভারতীর সহসা মনে হইল, সমস্ত জাতির এই সুদুঃসহ লাঞ্ছনা ও অপমানের গ্লানি ওই পাষাণের মুখের পরে যেন নিবিড় নিচ্ছিদ্র কালি লেপিয়া দিয়াছে।

বেদনায় সমস্ত বুকের ভিতরটা ভারতীর আলোড়িত হইয়া উঠিল, কহিল, দাদা!

ডাক্তার সবিস্ময়ে ঘাড় তুলিয়া কহিলেন, দাদা বলে কি তুমি আমাকে ডাকচো?

ভারতী বলিল, হাঁ, তোমাকে। আচ্ছা, ইংরাজের সঙ্গে কি তোমার কখনো সন্ধি হতে পারে না?
না। আমার চেয়ে বড় শত্রু তাদের আর নেই।

ভারতী মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, কারও শত্রুতা, কারও অকল্যাণ তুমি কামনা করতে পারো এ আমি ভাবতে পারিনে দাদা।

ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া ভারতীর মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিয়া কহিলেন, ভারতী, এ কথা তোমার মুখেই সাজে এবং এর জন্যে আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি, তুমি সুখী হও। এই বলিয়া তিনি পুনরায় একটুখানি হাসিলেন। কিন্তু, এ কথা ভারতী জানিত যে এ হাসির মূল্য নাই, হয়ত ইহা আর-কিছু,—ইহার অর্থ নিরূপণ করিতে যাওয়া বৃথা। তাই সে মৌন হইয়া রহিল। ডাক্তার আস্তে আস্তে বলিলেন, এই কথাটা আমার তুমি চিরদিন মনে রেখ ভারতী, আমার দেশ গেছে বলেই আমি এদের শত্রু নই। একদিন মুসলমানের হাতেও এ দেশ গিয়েছিল। কিন্তু সমস্ত মনুষ্যত্বের এতবড় পরম শত্রু জগতে আর নেই। স্বার্থের দায়ে ধীরে ধীরে মানুষকে অমানুষ করে তোলাই এদের মজ্জাগত সংস্কার। এই এদের ব্যবসা, এই এদের মূলধন। যদি পারো দেশের নর-নারীকে শুধু এই সত্যটাই শিখিয়ে দিও।

নীচের ঘড়িতে টং-টং করিয়া চারিটা বাজিল। সম্মুখের খোলা জানালার বাহিরে রাত্রিশেষের অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া আসিল, সেইদিকে নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া ভারতী স্তব্ধ, স্থির হইয়া বসিয়া কত কি যে ভাবিতে লাগিল তাহার স্থিরতা নাই, কিন্তু একটা সমস্ত জাতির বিরুদ্ধে এতবড় অভিযোগ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে কিছুতেই তাহার প্রবৃত্তি হইল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *