পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 03
ইচ্ছে করলেই মহানাম ফিল্ম ইন্সটিট্যুটে থাকতে পারতেন। গেস্ট হিসেবে। সেইরকমই ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু চন্দ্রশেখর বলল—‘আপনার অনেক প্রোগ্রাম ডক্টর রয়। ওখানে থাকলে আপনার অসুবিধে হবে। আমার ব্যাচেলরের বাড়ি বলে কি ভয় পাচ্ছেন? কি রকম রাঁধতে পারি দেখুনই না। আপনি কদিন থাকলে আমার একাকীত্বটাও সাময়িকভাবে ঘোচে।’
কলকাতায় গেলে চন্দ্রশেখর মহানামেরই আতিথ্য গ্রহণ করে। একটি লাইব্রেরি, দুটি পড়ুয়া। মাঝে যজ্ঞেশ্বরের সেবা। এখানে অবশ্য যজ্ঞেশ্বর জাতীয় কেউ নেই। তাতে চন্দ্রশেখরের অসুবিধে নেই। বহু বছর বিদেশে কাটিয়েছে। রান্না নিজে করাই বরাবরের অভ্যাস। রোজ সকালে মহানামকে মস্ত বড় দুটো স্যান্ডউইচ, সস, কলা, এবং পেল্লাই গেলাসে শুধু দুধে কফি তৈরি করে দেয়। দুপুরের খাওয়া প্রথম কদিন ম্যাকসমূলর ভবনে। সেখানকার লেকচার-কোর্স শেষ হল মঙ্গলবার—মাঝে বুধবার বাদ দিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে ফিল্ম ইন্সটিট্যুটের সেমিনার।
এই ধরনের ঠাসা প্রোগ্রাম ভালো লাগে মহানামের। মাঝখানে বুধবারের হাইফেনটা না থাকলেও তাঁর কিছু মনে হত না। অসম্ভব শক্তি, শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক। কোনটারই যথেষ্ট সদ্ব্যবহার হবার সুযোগ জীবনে হল না। পুরো জীবনটা যেন খেলতে খেলতে কেটে গেল। ধুলোমাটি নিয়ে খেলা। স্বভাবের মধ্যে নিশ্চয় এক প্লেবয় রয়ে গেছে, এই সবের জন্যে সে-ই দায়ী। বেশ ওজনদার কিছু পাওয়ার হিসেব কষতে গেলে এই ফাঁক এবং ফাঁকি ধরা পড়ে। নয়ত মহানাম বেশ আছেন। সেইজন্যেই চিন্তা করবার অবকাশ যত কম জোটে ততই তাঁর উপভোগ বেড়ে যায়। বৃহস্পতিবার চন্দ্রশেখর য়ুনিভার্সিটি থেকে ফিরে তাঁকে কুলফি খাওয়াতে নিয়ে গেল। এই জিনিসটা মহানামের খুব প্রিয়। খেতে খেতে বললেন—‘দ্যাখো শেখর, খাওয়ার ব্যাপারে আমার এই অতিরিক্ত বিলাসটা লক্ষ করলে আমার আজকাল মনে হয় আমি তোমাদের সেই ওর্যাল সাকিং স্টেজে থেকে গেছি। ওর্যাল সাকিং, ওর্যাল বাইটিং সব আছে না উদ্ভট উদ্ভট!’
চন্দ্রশেখর হেসে বলল—‘তাহলে আপনার এত স্বাধীন হবার কথা নয়। আপনি তো খুবই ইনডিপেন্ডেন্ট।’
‘কোথায়? কলকাতায় যজ্ঞেশ্বরের ওপর সেন্ট পার্সেন্ট নির্ভর করি। এখানে দ্যাখো, কত সহজে তোমার নিমন্ত্রণটা নিয়ে নিলুম। অন্যত্র থাকলে নিজের দায় নিজেকে খানিকটা তো বইতেই হত।’
‘এখানেও তো বইছেন। রুমাল গেঞ্জি কাচছেন। ব্রেকফাস্টের বাসন ধুচ্ছেন, বিকেলে আমাকে চা করে খাওয়াচ্ছেন।’
‘কিন্তু দ্যাখো, আমার এই ইজি-গোয়িং স্বভাবটা। কোনও কিছুকেই জীবনে গুরুত্ব দিলুম না। ওই হচ্ছে, হবে, যা হল হল। এটা কিন্তু পরিণত ব্যক্তিত্বের লক্ষণ নয়।’
চন্দ্রশেখর বলল—‘আগে তো আপনি নিজেকে নিয়ে এতো মাথা ঘামাতেন না, কি হল?’
‘চল্লিশোত্তর ডিপ্রেশন বোধহয়। অনেক দিন ধরে চলছে।’ মহানাম আর একটা পেস্তা-কুলফি নিলেন। পুরো খোয়াক্ষীরের স্বাদ, পেস্তায় সবুজ হয়ে রয়েছে। দেখতেও খুব সুন্দর। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জাপানি কাপের মতো দেখে প্লেটটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন মহানাম—‘খাবার জিনিস দেখতেও খুব সুন্দর হওয়া চাই, শেখর, বুঝলে? এই কুলফিটা দেখো সাজ-সজ্জা করা নর্তকীর মতো রূপসী।’
‘স্টেজে নামতে না নামতেই খেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে, বেচারার এই যা!’ চন্দ্রশেখর বলল।
‘পুরো জীবনটা আমার এইরকম তাৎক্ষণিক উপভোগে কেটে গেল শেখর।’
‘আপনাকে আজকে কিছুই-তো হল-না বিলাসে পেয়েছে, সামহাউ।’
‘দ্যাট রিমাইন্ডস মি, শেখর—রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যদি কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, গান, লোকশিল্প, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক ট্যুর, মায় কৃষিব্যাঙ্ক পর্যন্ত করে বলে থাকতে পারেন—হায়, কিছুই তো হল না। তাহলে আমাদের মতো লোকে কি বলবে, হে!’
‘অন্যদিক থেকে দেখুন। কিছুই তো হল না এ ফীলিং যাঁদের আসে তাঁদের পার্ফেকশন-এর নেশা আরও তীব্র বলেই আসে। তাই নয়?’
‘বাজে বকছ। তোমার এ ফীলিং হয়?’
‘একেবারেই নয়! সারাদিনের শেষে রোজ নিজে নিজের পিঠ চাপড়াই ওহ্ কত কাজ করা হল। পৃথিবীতে একটা দাগ রেখে যাচ্ছি।’
চন্দ্রশেখর শব্দ করে হাসতে লাগল। ‘নিজে রান্না করে খাই বলে পর্যন্ত পৃথিবী এবং সমাজের কাছেও অতিরিক্ত কৃতিত্বের প্রশংসা দাবী করি।’
‘তা কিন্তু তুমি করতেই পারো. শেখর। তুমি একটা এ-ক্লাশ শেফ্।’
‘স্যান্ডউইচ খেয়েই রান্না বুঝে গেলেন?’
‘আরে আমাদের ওখানে বলে চা আর পান যারা ভালো তৈরি করতে পারে তারা অবধারিত ভাবে সুরাঁধুনি। তুমি যখন স্যান্ডউইচটাকেই পানের মতো ব্যবহার করো, তখন⋯’
‘কি বললেন স্যান্ডউইচটাকে পানের মতো ব্যবহার করি?’
‘তাছাড়া কি? যখনই তোমার মুখোমুখি হই একটা করে স্যান্ডউইচ ধরিয়ে দাও, নিজেও চবৎ চবৎ করে চিবোচ্ছ, আমাকেও চিবোতে দিচ্ছো। ফলে, রাত্তিরে এত কম খিদে থাকছে যে তুমি কি মহাবস্তু রাঁধছ চাখবার সুযোগই পাচ্ছি না।’
চন্দ্রশেখর হো-হো করে হাসতে লাগল।
‘আগে বলবেন তো, ইস! আসলে বাইরে থেকে থেকে স্যান্ডউইচ, হট ডগ আর হামবার্গার-এ এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে⋯। কি আশ্চর্য, বলবেন তো আপনার অসুবিধে হচ্ছে!’
‘অসুবিধে হলে তো বলব!’ মহানাম মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললেন—‘শুদ্ধু খাদ্যের মাধ্যমে ছাত্রজীবনে অর্থাৎ প্রথম যৌবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছো আমাকে, এর পরেও অসুবিধে? শেখর,জীবনের প্রত্যেক স্মৃতির একটা আনুষঙ্গিক গন্ধ থাকে লক্ষ্য করেছো? তোমার হ্যাম স্যান্ডউইচের সঙ্গে কি একটা সস দাও, উর্সটার সস্ বোধহয়, আমি যত না খাই ওই গন্ধটার মধ্যে ডুবে থাকি, আর আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করে লাল ইঁটের সাতশো আটশ বছরের পুরনো সব বাড়ি,—ফায়ার প্লেস, চিমনি, সাদা কেশর প্রোফেসর, স্মার্ট ডন, গোলাপ ফুলে ভরা বাগানে ইংরিজি ঘাসের গন্ধ। সঙ্কীর্ণ সব ঐতিহ্য ভরা অলি গলি। ট্রিনিটি কলেজ, ক্রাইস্ট চার্চ, মডলিন, পেমব্রোক, কুইন্স্।’
‘জীবনের সুস্বাদু সময় কি তবে শুধু অতীতেই? এটা আমি মানতে পারছি না কিন্তু।’
‘শুধু অতীতেই? না তা বলব না। তবে গুজরাতিরা যেমনি মিষ্টি দিয়ে শুরু করে ভোজ, জীবনটাও আমরা সেই রকম মধুরেণ আরম্ভ করি। তেতো, কটু, কষায়, ঝোল, গরগরে এসব স্বাদগুলো পরে আসে। ধরো রসোগোল্লা দিয়ে আরম্ভ করে মাঝখানে বিরিয়ানি, শেষে নিম-বেগুন দিয়ে ভোজ সমাপ্ত করার মতো।’
‘নিম-বেগুন জিনিসটা কি?’
‘খাইয়েছি তোমাকে, ভুলে মেরে দিয়েছে, নিমপাতা, মার্গোসা লীভস্ হে, তাই কুড়কুড়ে করে ভেজে ছোট ছোট করে কাটা বেগুনের ভাজার সঙ্গে মেলানো।’
‘ওঃ, সে তো সাঙ্ঘাতিক তেতো।’
‘আরে বাবা, খেতে জানো না তাই, কফি, চীজ এসবেরও একটা পানজেন্ট স্বাদ আছে, অনেকেই প্রথমটা পছন্দ করে না। পরে রীতিমতো ভক্ত হয়ে যায়। আমাদের বেঙ্গলি নিম-বেগুনও তাই। তাছাড়া এর গুণ অনেক। খুব ভালো অ্যাপিটাইজার।’
‘তা, সেই অ্যাপিটাইজার দিয়ে ভোজ শেষ করবেন কেন?’
‘কেন আবার কি? খাদ্যের ভোজ তো অ্যাপিটাইজার দিয়েই আরম্ভ হয়। জীবনের বেলায়, তেতোটা শেষের দিকে পড়ে, ভালো লাগে, খাসা লাগে। বৃদ্ধদের লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে। মুখে বলছেন, তেতো-তেতো সব তেতো হয়ে গেল। তারপরেই ও কি দিদিভাই, কি খাচ্ছো—ফুচ্কা—দেখি দেখি আমাকেও একটা দুটো দাও তো, টেস্ট করে দেখি।’
‘মানে ঠোঁট আর জিভে জীবনের স্বাদ ঘনীভূত হয়ে এসেছে। ওর্যাল সাকিং স্টেজ!’
‘ওর্যাল সাকিং স্টেজ। ইয়েস। বউমা তখন মা, মেয়ে আরেক মা, তারা আর কারুর দিকে মন দিলেই ঠোঁট ফুলতে থাকে।’
‘আপনার এসব জানা হল কি করে? বাড়িতে তো সেই কোনকাল থেকে যজ্ঞেশ্বর আর আপনি।’
‘তুমি কি মনে করো পরোক্ষ অভিজ্ঞতার স্টক আমার কম? কিছুই দৃষ্টি এড়ায় না শেখর।’
দুজনের বাড়ি ফিরতে প্রচুর রাত হল। অটো-ট্যাক্সি নিয়ে পুনে-ক্যাম্প প্রায় চষে ফেললেন মহানাম। বাঁধ-গার্ডেনে ঝকঝকে আলো, শেখর বলছিল নেমে দেখে আসতে। মহানাম বললেন, ‘এখন কোনও গার্ডেন কোনও বাগ নয়। আমি শুধু শহরটাকে অনুভব করবার চেষ্টা করছি শেখর। তবে মোটমাট কয়েক’ শ’ বছরের ইতিহাস সত্ত্বেও তোমার পুনের ব্যক্তিত্ব যেন কেমন দানা বাঁধেনি, চরিত্র ফোটেনি। পেশোয়াদের পুনে, আর মডার্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুনে মিশ খায়নি। চওড়া চওড়া রাস্তা, শপিং কমপ্লেক্স, বাড়ি, কলেজ, য়ুনিভার্সিটি এবং পার্ক হলেই যে প্রাণবন্ত শহর হয় না, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় তোমার এই পুনে।
‘যারা এখানে বসবাস করে তারা কিন্তু অন্যত্র গেলে খুব ক্র্যাম্প্ড, বোধ করে। এত স্পেস!’
‘ঠিক বলেছো। স্পেস। শুধুই স্পেস। নিরালম্ব। হতে পারে এটা আমার কলকাতাইয়া সংস্কার। কিন্তু বম্বে দিল্লি মাদ্রাজের মতো শহর ছেড়ে দিলেও, বাঙ্গালোর, আমেদাবাদ, চণ্ডীগড় সবারই যেন আরও স্পষ্ট চরিত্র আছে। আমাদের বিখ্যাত রোম্যান্টিক লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন এখানে। জানো নাকি?’
উঁহু।’ চন্দ্রশেখর বলল।
চন্দ্রশেখরের বাড়ি একতলা। সামনে সুন্দর খানিকটা নিজস্ব লন আছে। তাছাড়াও অন্যান্য ফ্ল্যাটের সঙ্গে ভাগের বাগান। দুটো শোবার ঘর, তার একটাকে পড়ার ঘর তৈরি করেছে চন্দ্রশেখর। মহানাম এই ঘরটাই পছন্দ করেছেন। বইয়ের গন্ধে ঘুম ভালো হয়। রাত এগারটা বেজে গেলে লনের মাঝখানে স্তব্ধ মহানামের গায়ে একটা চাদর দিয়ে দেয় চন্দ্রশেখর। প্রথমে কথা, তারপরে আরও কথা, তারপরে আস্তে আস্তে দুজনে চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর মহানাম বললেন—‘তোমার পুনেতে অতীতকে যাদুঘর বানিয়ে রাখা হয়েছে, বর্তমানও যেন নেই-নেই, খালি ভবিষ্যৎ। কিন্তু একটা জিনিস আছে বড় সুন্দর।’
‘কি?’
‘নীল রাত। নীলচে ভোর। এই শব্দবন্ধগুলো দিয়ে কবিরা ঠিক কি বোঝাতে চান, চন্দ্রশেখর, তোমার পিঁপরি আমায় বুঝিয়ে দিল।’
‘খুলে বলুন।’
‘দ্যাখো, তোমাদের এই স্যাটেলাইট টাউনে সব নতুন নতুন বাড়ি। পরিকল্পিত শহরতলি। প্রচুর পরিসর। কোথাও চোখ আটকায় না। যেদিকেই তাকাও অখণ্ড নীল আকাশ। রাত্তিরে এই সব আশপাশের দৃশ্যও ডুবে যার অন্ধকারে, শুধু চারপাশ ঘেরা নীলের তাঁবুর মধ্যে বসে আছি মনে হয়। একেবারে আক্ষরিক অর্থে নীলরাত। ভোরবেলাও ঠিক এই জিনিসটাই হয় একটু অন্যভাবে। একটু একটু কুয়াশা এখনও থাকছে না, থাকলেও আকাশ দশ দিক দিয়ে এমন ভাবে নেমে এসেছে, ঘিরে ধরেছে যে তার তুলনায় বাড়ি-ঘরের গাছ-পালার উন্নতিরেখা নগণ্য।’
চন্দ্রশেখর বলল—‘তাহলে যখন কবিরা বেগুনী চাঁদ, মেরুন আলো এ সব বলেন সেগুলোকেও সত্য বলে ধরে নিতে হবে?’
‘সত্য মানে? একেবারে বাস্তব, কংক্রিট, সাবয়ব। শান্তিনিকেতনে দোল পূর্ণিমায় চাঁদ উঠল, একেবারে সাদা ঝকঝকে। আমরা লাল চাঁদ দেখতেই অভ্যস্ত। পূর্ণিমার নতুন চাঁদ সাদা হবে ভাবতেই পারি না। আসলে অ্যাটমসফিয়ারে ধুলো যত কম থাকে, চাঁদও স্বভাবতই তত পরিষ্কার দেখায়। ভায়োলেট চাঁদও ওই ধূলিকণারই খেলা, মেরুন আলোও। কখন কোন অ্যাঙ্গল-এ সূর্যরশ্মি এসে পড়ছে তার ওপর সবটা নির্ভর করছে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, ব্যঞ্জনার খাতিরে বা কল্পনার দৃষ্টি নিয়ে কবিরা কিছু বলেন না। আমি শুধু তোমায় মনে করিয়ে দিতে চাইছি কবির অভিজ্ঞতার অনেকটাই বাস্তব।’
তাহলে যখন কবি বলছেন ‘হোয়েন দা ইভনিং ইজ স্প্রেড আউট এগেনস্ট দা স্কাই/লাইক আ পেশেন্ট ইথারাইজড আপন আ টেবল্’—সেটাও একটা কংক্রিট ব্যাপার?’
‘সেকি? এটা তো পুরো একটা উপমা। উপমা দিয়ে দৃশ্যপটের সাধারণ মেজাজ এবং দর্শকের মনের ওপর তার প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।’
চন্দ্রশেখর লজ্জিত হয়ে বলল—‘আসলে, ডক্টর রায়, আপনি এতো সুন্দর আবৃত্তি করেন, কবিতা সম্পর্কে একটা আগ্রহ জন্মে যায়। আমরা যে কোনও শিল্পকীর্তিকেই ইদ-এর সাবলিমেশন, কিম্বা নির্জ্ঞান স্তরের কোনরকম বিস্ফোরণ, কিম্বা কোনও একটা ডিফেন্স মেকানিজম বলে দেখতে অভ্যস্ত তো! কবিতার সৌন্দর্য নিরপেক্ষভাবে উপলব্ধি করবার ট্রেনিং আমাদের নেই। আপনি যখন পড়েন, তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়। কোনদিন মনস্তত্ত্ব পড়েছিলাম বলেই আর মনে পড়ে না।’
‘শুধু মনস্তত্ত্ব নয়, চন্দ্রশেখর, কিছুই পড়েছ বলে মনে হবার কথা নয়। নান্দনিক অভিজ্ঞতা আমাদের অনুভবের সারাংশটুকুকে কাজে লাগায় শুধু। সে সময়ে আমরা শুধুই অনুভূতি শুধু উপলব্ধিসার সত্তা থাকি। পরে আবার ফিরে আসি শিক্ষিত, পরিশীলিত, মার্জিত সামাজিক সত্তায় যার মধ্যে স্মৃতি একটা মস্তবড় নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। আসলে শিল্পের রসাস্বাদনের সময়ে ঠিক কি ঘটে সেটা তোমাদেরই বলবার কথা। আমি অনধিকার চর্চাই করছি।’
‘তা নয়। রসাস্বাদক হিসেবে আপনি অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ দিকটা দেখতে পাচ্ছেন। তত্ত্বজ্ঞ হিসেবে আবার তার কার্য কারণ বিশ্লেষণ করছেন। আপনার তো কোনটাই অনধিকার চর্চা নয়।’
মহানাম হঠাৎ বললেন—‘আচ্ছা চন্দ্রশেখর, তুমি অরিত্র চৌধুরীকে চেনো? আগে ওল্ড পুনেতে থাকত। ইদানীং বোধহয়⋯.’
চন্দ্রশেখর বলল—‘জে পি জে ইন্ডাস্ট্রীজ-এর চীফ পাবলিক রিলেশনস ম্যান অরিত্র চৌধুরী? ওকে কে না চেনে? বিশেষ করে আপনাদের বাঙালি কমিউনিটির তো মাথা। পুজো-টুজো, জলসা, কবি-সম্মেলন। এসব বিষয়ে খুব উৎসাহ। ওঁর স্ত্রী-ও তাই। আরে ওদের জন্যেই আমাদের এখানে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলো থরোলি দেখা জানা হয়ে গেছে। আপনার সঙ্গে আলাপ আছে আগে বলেননি তো?’
‘না, তা বলিনি। তবে কতকগুলো পুরনো স্কোর⋯তুমি বলছিলে না মহারাষ্ট্র পশ্চিমবঙ্গ সাংস্কৃতিক সংহতি দৃঢ় করতে আমার সব থরোলি দেখা উচিত, তা সেই থরোলি দেখতে হলে আমার পয়লা আইটেমই হওয়া উচিত অরিত্র চৌধুরী।’
‘কেন বলুন তো! বাংলা কালচার মহারাষ্ট্রে প্রচার করে বলে? আপনি সেটা জানতেন?’
‘না না’ মহানাম হেসে উঠলেন—‘হী হ্যাজ আ ভেরি ইনটারেস্টিং হিসট্রি।’
‘ব্যাপার কি বলুন তো? ইজ হী সর্ট অফ অ্যান এগজিবিট?’
‘এগজিবিট তো বটেই। পোয়েট টার্নড এগজিকিউটিভ, বোহেমিয়ান টার্নড হাউজহোল্ডার, রেবেল টেমড বাই সিলভার!’
চন্দ্রশেখর আশ্চর্য হয়ে বলল—‘রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি। পুরনো বন্ধু না কি আপনার? একটু জুনিয়র বলে যেন মনে হয়।’
‘একটা বয়সের পর সিনিয়র-জুনিয়র, গুরু-শিষ্য, পিতা-পুত্র সব এক হয়ে যায় শেখর; তুমি এখনও সে বয়সটাতে পৌঁছওনি মনে হচ্ছে!’
শেখর বলল—‘কি জানি আমাদের ভারতীয় মন তো, কেমন একটা সম্ভ্রমহানির ভয় সব সময়ে ভেতরে কাজ করে। কর্নেলে যখন প্রথম আপনার সঙ্গে দেখা হয় সেই থেকে যে অগ্রজ-অগ্রজ একটা সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে আছে!’
‘তুমি কিন্তু এটা আমাকে আদৌ কমপ্লিমেন্ট দিলে না শেখর। কোনদিনই আমি নিজেকে কারুর থেকে ছোট অথবা বড় ভাববার পক্ষপাতী নই। তাহলে কমিউনিকেট করতে অসুবিধে হয়। তাছাড়া সময়কে অত সমীহ করতে নেই, তাহলে পেয়ে বসে। আই প্রেফার টু বি ইন্টারন্যালি থার্টি নাইন। চল্লিশে পৌঁছলে আবার শ’য়ের মতে স্কাউন্ড্রেল হবার ভয় থেকে যাচ্ছে।’
হাসছে চন্দ্রশেখর। মহানাম বললেন—‘তোমার বন্ধু ওর বাড়িটা চেনে। আসবার দিন একবার ঢুঁ মেরে এসেছি। উজিয়ে গিয়ে। তোমার বন্ধুটিকে ফোন করে দেখো না যদি ওকে পাওয়া যায়।
চন্দ্রশেখর বলল—‘ওর দরকার কি! আমার গাড়ি সার্ভিসে গিয়েছিল, কালই এসে যাচ্ছে। খড় কি ওয়েস্টে প্রিয়লকরনগর। আমিই আপনাকে নিয়ে যেতে পারব।
‘উহুঃ’ মহানাম বললেন।
‘কেন? আমার কোনও অসুবিধে নেই।’
‘তোমার না থাকতে পারে, আমার আছে—’ মহানাম রহস্যময় হেসে বললেন—‘আমি তোমাকে নিচ্ছি না। একাই যাবো।’
আনমনে পাইপে তামাক ভরছেন মহানাম। তিনি এখন ডাফ লেনের বাড়ির সাদা-কালো মার্বলের মেঝের অলঙ্কৃত দাওয়ায় ডক্টর সাধুর কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে আসা য়ুনিভার্সিটির রিসার্চ-স্কলার একটি তরুণের সঙ্গে কথা বলছেন। ছেলেটি আজ তৃতীয়বার এলো। আজ সঙ্গে একটি মেয়ে। মহানামের ডাইনে বিশালাকায় পেতলের টবে অ্যারিকা পাম। বাঁ দিকে পাথরের বালক মূর্তি কন্দুক হাতে লীলারত। এই দৃশ্য, এই সাক্ষাৎ, এবং এর পরবর্তী কথোপকথন অনেক অনেকবার পুনরাবৃত্ত হবে। ছেলেটি অত্যন্ত চঞ্চল, বুদ্ধিমান, নাছোড়বান্দা। মেয়েটি যে ঠিক কি রকম তা মহানাম ভালো করে বুঝতে পারছেন না।