পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 10
চন্দ্রশেখর ওর সার্ভের কাজে শহরে যাবে, সারাদিনেরই কাজ। যাবার পথে মোড়ের কাছে ছেড়ে দিয়ে গেল মহানামকে। বলল—‘সকাল সকাল না গেলে চৌধুরীকে ধরতে পারবেন না, এখনও অফিসে জয়েন করেছে কি না অবশ্য জানি না, যদি বেরিয়ে যায়!’ মহানামের ইচ্ছে ছিল বিকেলের দিকে যাওয়া। সকাল বেলাটা কারো বাড়ি গেলে তাকে বিব্রত করা হয়। কিন্তু বিকেলে লোকের বাড়িতে আরও অতিথি আসা সম্ভব, মহানাম অরিত্র আর নীলম ছাড়া আর কোনও লোকের সঙ্গে, বিশেষত অপরিচিতর সঙ্গে দেখা করার তাগিদ অনুভব করছেন না। চন্দ্রশেখরও বলল—‘বিকেলে বেড়াতে বা কারো বাড়ি যেতে পারে, চৌধুরী-দম্পতি খুব জমাটি লোক।’ মেন রাস্তার ওপরই চন্দ্রশেখরের কাছ থেকে বিদায় নিলেন মহানাম। বাঁক ফিরে হাঁটছেন, যেন আসল গল্প বা প্রবন্ধ আরম্ভ হবার আগে, উপক্রমণিকা, উপক্রমণিকাটুকু বেশ ভালো করে উপভোগ করে, ব্লক বি’র সামনে এসে দাঁড়ালেন মহানাম। শনিবার, ঘড়িতে প্রায় সাড়ে-আটটা। খুব তাড়ার মুখে গিয়ে তাঁকে ধরতে হচ্ছে অরিত্র চৌধুরীকে। আর একটু সময় পাওয়া গেলে ভালো হত। সামনে ছোট লন। গোটা তিনেক বেতের চেয়ার, একটা মোড়া, একটা স্টিলের ফোল্ডিং টেবল। একটা কুশন ঘাসের ওপর পড়ে গেছে। আশেপাশে খাবার-দাবারের টুকরো কিছু পড়েছে নিশ্চয়। কারণ কিছু কাক ঘাস থেকে খুঁটে খুঁটে কিসব মুখে তুলছে। আদর্শ গৃহস্থ অরি চৌধুরী। কাক, বিড়াল এদের ব্যবস্থা করেই সংসার পেতেছে। পুরো বাড়িটার আপাদমস্তক ভালো করে চেয়ে দেখলেন মহানাম। এইখানে কিছু পাখি বাসা বেঁধে রয়েছে। এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে এসে। এক আশ্রয় থেকে আরেক আশ্রয়ে। তাঁর না আসলেও চলত। কয়েকটা প্রশ্নের জবাব, রহস্যের সমাধান..কিন্তু সব প্রশ্নের জবাব কি পাওয়া যায়, আর সব রহস্যের সমাধান জীবনে করতে পারবেন এতো অহমিকা মহানামের নেই। অঙ্কের ফিগার নয় হিউম্যান ফ্যাক্টর নিয়ে যেখানে রহস্য। সম্ভবত এই পাখিরা তাঁকে শিকরে বাজ, কি পেঁচা কি ওই রকম একটা কিছু ভয়ঙ্কর অশুভকর মনে করছে। করুক, তিনি যে সত্যি তা নন তা এই মুহূর্তে এদের জানতে দিতে তাঁর ইচ্ছে নেই। কিছু শঙ্কা, কিছু মোহ থাক না? মন্দ কি? সত্যিকারের বীতরাগভয়ক্রোধ যতক্ষণ না হওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ জীবনযাপনে একটু উৎকণ্ঠার ভাগ থাকা ভালো। নইলে অরাজকতা বাড়ে। দু ধাপ সিঁড়ি উঠে ছোট্ট চত্বর পেরিয়ে মেরুন রঙের দরজার ধারে বেল টিপলেন মহানাম। বেজেছে কি বাজেনি, দরজা খুলে গেল। সামনে এষা। আকাশ নীল আর সাদা ছোট ছোট ছাপ-ছাপ শাড়ি পরে, কাঁধে একটা পাতলা কালো চাদর, চুলগুলো মুখের দু পাশ দিয়ে যথেচ্ছ সামনে এসে পড়ছে, কানের পেছনে তাদের গুঁজে দিতে দিতে অরিত্রর বাড়ির দরজা খুলছে এষা। মহানাম জীবনে কখনও এতো অবাক হননি। এষা মুখখামুখি দাঁড়িয়ে আছে, বিস্ময়ে নির্বাক। মহানামের আগমনের সংবাদ এখনও তাকে শোনানোর কথা মনে পড়েনি নীলম কিম্বা অরিত্রর। এষাকে নিয়েই এখন ওরা ব্যস্ত। এত ব্যস্ত যে মহানামের মতো অতবড় সংবাদও বিস্মরণ হয়ে গেছে অরিত্র বোধহয় মনে মনে আশাও করেছিল যে মহানাম শেষ পর্যন্ত আসবেন না।
মহানাম বললেন—‘আমি, ঠিক দেখছি? তুমি এষাই তো?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
‘এষার মতো কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি নও। আমার না-জানা যমজ-টমজ। সিনেমায় যেমন ডাবল রোল-টোল দেখায়’—
এষা হেসে ফেলল। মহানাম ভেতরে এক পা বাড়িয়েছেন। বললেন—‘কোনও সায়েন্স ফিকশনের মধ্যে ঢুকে পড়িনি? এ বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে উনসত্তর সত্তরে চলে যাওয়া যায় না তো? হে নারী, যদি তুমি এষাই হও, তাহলে সত্তরের এষা হয়ে কি করে সায়েন্স ফিকশন ছাড়া অষ্টআশিতে⋯’
এষা বলল—‘এই কথাটা আমি শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছি মহানামদা। যারা সর্বক্ষণ চলে, সময় তাদের ছুঁতে পারে না চট করে, রেসে হেরে যায়, তাছাড়া আপনিও তো খুব বদলান নি!’
মহানাম খুব ইঙ্গিতপূর্ণভাবে নিজের জুলপিতে হাত দিলেন, দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলেন। বললেন—
‘থোড়ি দাড়ি পক্কা, থোড়ি ঔর কঁচ্চা/
ওহী আদমি অচ্ছা, ওহী আদমি সঁচ্চা। তা ব্যাপার কি বলো তো। সেদিন রাত্তিরে দেখলুম নীলম বেরিয়ে এলো, আজ সকালে দেখছি তুমি। অরিত্র কি তাহলে তোমাদের দুজনকেই বিয়ে করে ফেলেছে?’
এষা আর থাকতে পারল না, উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। হাসির শব্দ পৌঁছল বাথরুমে, দাড়ি কামাতে কামাতে কাঁধে তোয়ালে অরিত্র অবাক হয়ে বেরিয়ে এলো, নীলম রান্নাঘর থেকে হাতে মশলার কৌটো, পড়ার ঘরের দরজার পর্দা সরিয়ে পুপু।
এদিকে মহানামের মাথা সবাইকে ছাড়িয়ে। সাদা ধবধবে পায়জামা, পাঞ্জাবি, বিশাল মানুষ একটি। ওদিকে পুপুর মাথা। পুপু বাবাকে প্রায় ধরে ফেলেছে। পাঁচ ফুট সাড়ে নয় ইঞ্চি লম্বা অসাধারণ দীর্ঘকায়া তরুণী এক।
মহানাম বললেন-‘বাঃ। এষা, তোমার শঙ্খধ্বনিতে এক এক করে কুশীলবরা সবাই এসে পড়েছে। তিনটি মুখ আমার সর্বসাকুল্যে চেনা, যদিও কাউকে কাউকে চিনতে একটু দৃষ্টি বিস্ফারিত করতে হচ্ছে। চতুর্থ ব্যক্তিটির সঙ্গে আলাপ হোক।’
অরিত্র পুপুর পিঠে হাত দিয়ে প্রায় যেন তাকে বেষ্টন করে ধরে বলল—‘পুপু ওরফে সমিদ্ধা চৌধুরী! আমার একমাত্র সন্তান। আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করছে। পুপু ইনি বিখ্যাত ডক্টর মহানাম রায়। হিসট্রি, সোসিওলজি, সাহিত্য, শিল্প, অঙ্ক কোনটা যে ঠিকঠাক ওঁর বিষয় আমার জানা নেই। এ যুগের ভারতবর্ষের অ্যারিস্টটল বলতে পারো, তবে তোর বাস্তুবিজ্ঞানটা ওঁর একেবারে জানা নেই।’
পুপু অবাক হয়ে চেয়ে আছে মহানামের দিকে। নীলম দেখছে পুপু চেয়ে আছে, মহানাম দেখছেন, নীলমের মুখ শুকিয়ে গেছে।
হাতজোড় করে নমস্কার করছে পুপু, বলছে—‘হ্যাভ আই মেট য়ু সামহোয়্যার প্রোফেসর? আই মাস্ট হ্যাভ।’
মহানাথ বললেন—‘ডিড য়ু বাই এনি চান্স গো টু দা ফিল্ম ইনস্টিট্যুট অর ম্যাক্সমূলার ভবন লেকচার্স লাস্ট উইক! আই ডোন্ট থিঙ্ক দ্যাটস লাইকলি।’
‘নো, বাট, আই হ্যাভ নেভার সীন আ ফেস সো ফ্যামিলিয়ার। এক্সকিউজ মি প্লীজ, আমি একবার বাজারে যাচ্ছি।’ পুপুর ভঙ্গিটা এমন যেন সে ঘোরের মধ্যে কথা বলছে।
এষা বলল—‘আমি রেডি। দাঁড়া একটু, থালিগুলো নিয়ে নিই। মহানামদা, একটু বসুন। আমরা এক্ষুণি ফিরে আসছি।’
রান্নাঘরে থলি আনতে গিয়ে এষা দেখল নীলম নিঃশব্দে কাঁদছে। বেসিনের ওপর বাসনধোয়ার নাম করে কাঁদছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে বড় বড় ফোঁটায় জল নেমে সব ভিজিয়ে দিচ্ছে।
‘এ কি নীলম? কি হচ্ছে!’ এষা ফিসফিস করে বলল, ‘কেঁদোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তাড়াতাড়ি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে স্কুটারের পেছনে চড়ে বসল এষা। বাড়ির পাশ থেকে ভটভট করতে করতে স্কুটার এগিয়ে গেল খোলা দরজার সামনে পোর্টিকোর ওপারের ঢালু রাস্তা বেয়ে। বিদ্যুদ্বেগে বেরিয়ে গেল। সামনে পুপু, প্যান্ট আর ঢোলা জামা পরে, ছোট চুল, বিশাল কান-ছোঁয়া চোখে একটা বিস্ময় থমকে আছে। ভ্রূ কুঁচকে আছে সামান্য। হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে রয়েছে দু হাত, যেন ফসকে যেতে পারে বলে তার রোখ চেপে গেছে। পুপু পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে কোন দূর মায়ার দেশে চলে যাচ্ছে। পেছনে যাদুকরী। সঙ্কটের সময়ে ওকে সাহায্য করবে কথা দিয়েছে। পুপুর কি সাহায্য লাগবে?
অরিত্র একটু দমকা জোর দিয়ে বলল—‘বসুন মহানামদা। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?’
মহানাম বসতে বসতে সোজাসুজি বললেন—‘মেয়েটি কি আমার?’
অরিত্রর মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল—‘হতে পারে ক্ষেত্রজ, কিন্তু কন্যাটি আমারই।’
মহানাম বললেন—‘এরকম অদ্ভুত মিল আমি আর কক্ষণো দেখিনি। যেন আয়নায় নিজেকে দেখছি। নীলম কি গর্ভিণী অবস্থায় সারাক্ষণ আমাকেই ধ্যান করেছিল! তাই যদি হবে তো চলে এলো কেন?’
এই সময়ে নীলম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল—‘মেয়েটি যদি তোমারই হয়, তুমি কি ওকে নিয়ে যাবে এখান থেকে ছিঁড়ে, না চতুর্দিকে ঢোল শহরৎ করে ঘোষণা করবে? কোনটা করতে চাও?’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। জট বড্ড পাকিয়েছে। আমি একটা একটা করে গিঁট খুলি। মেয়েটি তাহলে, প্রকারান্তরে স্বীকারই করছ, আমার। এতদিন ধরে অরিত্র ওকে পালন করেছে, এতই স্নেহে যে অনায়াসে বলতে পারল ক্ষেত্রজ হলেও হতে পারে, কিন্তু কন্যা ওরই। অর্থাৎ পিতৃস্নেহেই পালন করেছে। নীলম, তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি সুখেই আছো, সুখের বরং একটু আধিক্যই ঘটে গেছে! না, না। সমিদ্ধাকে আমি নিয়ে তো যাবই না, কিন্তু ও যে স্বপ্রকাশ। আমার ধারণা আমাকে ওকে একত্রে দেখার পর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকতে পারে না কারও ও কার। হায় অরিত্র, বিধাতা তোমার সঙ্গে বেশ বড়সড় একটা ঠাট্টাই করেছেন মনে হচ্ছে। সেই ঠাট্টাটাকেই তুমি বোকার মতো বয়ে বেড়াচ্ছ। ওকে ওরকম ছেলেদের মতো সাজিয়ে রেখেছো কেন? তাইতে সাদৃশ্যটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে।’
‘ও ওরকমই পছন্দ করে।’ নীলম সংক্ষেপে বলল।
‘ভাগ্যিস ওর দাড়িটাও নেই! একমাত্র বাঁচোয়া। তা এখন উপায়!’—মহানাম বললেন।
অরিত্র রুক্ষ গলায় বলল—‘একমাত্র উপায় আপনার চলে যাওয়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পুনে থেকে।’
মহানাম মাথা নেড়ে বললেন—‘তুমি অতিথির সৌজন্যও একসময় পালন করোনি, গৃহস্বামীর আচারও আজ পালন করছ না। এ আমি জানতাম মোটামুটি। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় অরিত্র। আমার একটা নির্দিষ্ট কার্যক্রম আছে, তোমার ছোট সুবিধের জন্য আমি তো আমার বড় অসুবিধে করতে পারি না। তবে, তোমার জানাশোনাদের আসরে আমি না-ই এলাম। একটা বাঙালি সাহিত্যসভার জন্য বলতে এসেছিল, শেখরকে আমি বরং না করে দেবো। কিন্তু এষা কোত্থেকে এলো? আমার সব হারানো মণি-মাণিক্যগুলো তোমার কবলীকৃত হয়ে গেছে দেখছি। কোন মন্ত্রে? তুমি কি যক-টক হয়ে গেছো?’
অরিত্র বলল—‘মন্ত্র নিশ্চয়ই কিছু আছে, যা আপনার জ্ঞানের অগম্য।’
এই সময়ে দরজায় বেল বাজল, অরিত্র তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিল। ওপরের ফ্ল্যাটের মহিলা। কখন প্যাসেজের বাতি কেটে গেছে, সেই বিষয়ে কিছু বলতে এসেছেন।
মহানাম তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে পকেট থেকে পাইপটা বার করে তামাক ভরতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মহিলা চলে যেতে নীলমের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হেসে বললেন—‘নিজের পেছনটা তো দেখতে পাওয়া যায় না। নীলম, দেখো তো, আমার পেছনটা আবার সমিদ্ধার মতো নয় তো?’
অরিত্র ফিরে এসে বসতে বসতে বলল—‘লোকে কি ভাববে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তবে আপনার দাড়ি-গোঁফের জন্য মিলটা খানিকটা অপ্রকট থাকবেই। আমি ভাবছি পুপুর নিজের কথা। ওর যদি কিছু মনে হয়?’
নীলম গালে হাত দিয়ে বসেছিল, বলল—‘আমিও ঠিক তাইই ভাবছিলাম।’
মহানাম বললেন—‘এ নিয়ে অত ভাবাভাবির কি আছে? ও অলরেডি জেনে গেছে।’
নীলম বিবর্ণ হয়ে বলল—‘কী বলছো কি তুমি?
অরিত্র উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, বলল—‘ননসেন্স!’
‘ঠিকই বলেছি। সমিদ্ধা এটুকু জেনে গেছে যে ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব গভীর। মেয়েটি শুধু প্রখর বুদ্ধিমতীই নয়, খুব পরিপক্ক ওর ইনটুইশন। ভারি আশ্চর্য সৃষ্টি করেছি তো! অরিত্র আশা করি, অধিকার নয়, কিন্তু সৃষ্টির এই আনন্দটুকু উপভোগকরতে আমাকে তুমি বাধা দেবে না।’
অনিমেষ চোখে মহানামকে দেখছে নীলম। জুলফিতে সামান্য পাক ধরেছে, চুলে দাড়িতেও একটু একটু। অসাধারণ বলিষ্ঠ চেহারা। অথচ আকর্ণ টানা উদাসীন চোখ। সবচেয়ে লক্ষণীয় নাকটা। পাতলা, ভঙ্গুর, যেন মানুষের নয়, এই নাক আর ওই চোখই নীলমকে পাগল করেছিল বলা চলে। মা রেখে গেলেন হোস্টেলে। লোক্যাল গার্জেন মায়ের বন্ধুপুত্র। ছাত্রমহলে নাম অ্যারিস্টটল। কিছুটা উপহাসে, কিন্তু কিছুটা সম্ভ্রমে তো বটেই। হোস্টেল থেকে অ্যারিস্টটলীয় জ্ঞানের সন্ধানে প্রতিদিন মহানামদার কাছে না ছুটলে ঘুম হত না নীলম যোশীর।
সেইসব বেলাভূমিহীন সমুদ্রের মতো দিন! মুগ্ধ হরিণী চিনতে কতটা সময় নিলেন মহানাম! মেয়েরা নিজেরাই জানে না বাঞ্ছিতকে পাবার জন্য তারা কি কি প্রয়োগ করে, কতভাবে! নীলম কি সে সব নিঃশেষে প্রয়োগ করেছিল? তার তূণে যত তীর, দশ হাতের যত প্রহরণ! ভরদুপুরের নির্জন বেলায় সেই উদ্ভিন্ন হাসি, নিপুণ ধানুকী তার সমস্ত অঙ্গভঙ্গীতে শরসন্ধান করছে! নিশ্বাসে আত্মনিবেদন। মহানাম যদি আবিষ্ট, নীলম নিজে তবে সম্পূর্ণ আত্মভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মুগ্ধ, সম্মোহিত। সম্মোহন মহানাম স্বেচ্ছায় করেননি। নীলমের ভাগ্য নীলমকে নিয়ে এ খেলা খেলল। দুটি সম্মোহন মিললে একটি চূড়ান্ত মিলন ঘটেই যায়। এখনও দেখতে পাচ্ছে নীলম বিশাল দুই চোখ তার মুখের ওপর স্থির, নাকের পাটা কাঁপছে, সহসা মহানামের মুখ তার মুখের মধ্যে নেমে এলো। এইভাবে, ঠিক এইভাবে পুপুর জন্ম দিল। মুগ্ধতার মধ্যে, সম্মোহনের মধ্যে, অথচ মোহ বলে কিছু পুপুটার নিজের চরিত্রে আছে কি না সন্দেহ।
নীলমকে কেঁপে উঠতে দেখে অরিত্র বলল—‘ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আছে। নীলম, তুমি গায়ে একটা সুতির চাদর-টাদরও দাও!’
মহানাম হেসে বললেন—‘এ ঠাণ্ডার কাঁপুনি না রোমাঞ্চের শিহরণ কে জানে অরি।’
অরিত্র গম্ভীর হয়ে গেল। মহানাম যেন প্রমাণ করতে চাইছেন, যতই নীলমের ঠাণ্ডা-লাগার বিষয়ে স্বামী-সুলভ উৎকণ্ঠা সে প্রকাশ করুক, তাকে আরও অন্তরঙ্গভাবে জানেন মহানাম।
নীলম হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘তোমাকে চা দিচ্ছি মহানামদা। কিন্তু তুমি আজ খেয়ে যাচ্ছো।’
মহানাম বললেন—‘ভরপেট ব্রেকফাস্ট খেয়েছি, দু তিন কাপ চা। আমি আর চা খাবো না নীলম। আচ্ছা এক কাজ করো পাতলা করে লেবু-চা বানিয়ে দাও।’
অরিত্রর খুব অবাক লাগল। অরিকে একবারও না জিজ্ঞেস করে নিজের দায়িত্বে নীলম নেমন্তন্ন করে বসল মহানামকে, যে মহানাম আসলে মহাকাল কি না এখনও স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। খেয়ে যাওয়া মানে অনেকক্ষণ বসা, এষা ফিরবে, গল্প করবে, পুপু ফিরবে, পুপুর সঙ্গে কি কথা বলবেন মহানাম? এমন শনিবারটা মাটি তো হয়ে গেলই, উপরন্তু ফাউ জুটল সর্বক্ষণের উদ্বেগ।
মহানাম বললেন— ‘অরিত্র, কিছু গান টান বাজাও।’
‘হঠাৎ!’
মহানাম হাসতে হাসতে বললেন—‘অপ্রস্তুত হোস্টরা যখন কথা খুঁজে পায় না, এবং কথা দিয়ে নির্বোধ নীরবতা ঢাকবার প্রয়োজন অনুভব করে তখন তো গানই বাজায়। জগজিৎ সিং গোলাম আলি কিম্বা জালোটা যা হোক। গজল কী গজল্লা, বা ভজনের ভুজুং ভাজুং!’
অরিত্র উষ্ণ হয়ে বলল—‘আমাকে কি আপনি উপহাস করছেন মহানামদা! উপহাস সহ্য করবার বয়স আমার অনেক দিন চলে গেছে।’
মহানাম বললেন—‘দ্যাখো ভায়া, তা যদি বলল, তোমার আমার যা সম্পর্ক তাতে করে ফরাসী কেতার একটা ডুয়েল আমরা অনায়াসেই লড়ে যেতে পারি। সে ডুয়েলের ফলাফল কি হবে আমার ব্যায়ামের চার্টখানা দেখলেই বুঝতে পারবে। না দেখলেও শুধু চেহারাখানা দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু সে সবে দরকার নেই। কবিদের ওপর দার্শনিকদের জয় ঠিক কোনখানে বলো তো? কবিরা যখন মিথ্যে স্তব-স্তুতি করে বোকা মেয়েদের ভোলায়, দার্শনিকরা তখন সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারে। মিথ্যে বলে তো লাভ নেই, নীলমকে যেতে না দিলে তুমি যত বড়ই চোর হও, তাকে নিয়ে যেতে পারতে না। তবে একটা মস্ত দোষ তোমার, বড্ড বেশি মিথ্যার আশ্রয় নাও। কবিরা তো এমনিতেই যথেষ্ট মোহন মিথ্যা বলার অধিকার পেয়েছে, তার চেয়েও নীচু স্তরের মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তুমি নিজেকে আমার কাছে বড্ডই ঘৃণ্য প্রতিপন্ন করেছে। নীলমকে তুমি এমন কি বলেছিলে, যার জন্য বেচারি অমন সঙ্কট অবস্থায়ও আমার ওপর ভরসা রাখতে পারল না। দেখো অরিত্র, প্রতিদ্বন্দ্বীকে আমি ঘৃণ্য বলে ভাবতে ভালোবাসি না, আমার ঘৃণাটা উচ্ছেদ করতে তুমি আমায় একটু সাহায্য করতে পারো না? যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এখন আর ঘৃণা নিয়ে বাঁচতে ভালো লাগে না।’
অরিত্র প্রাণপণে সংযত হয়ে বলল—‘আপনি কি নীলমের ব্যাপারে আমার কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত দাবী করতে এসেছেন? একযুগ পরে? যেহেতু এককালে আমার মাস্টারি করেছেন কিছুটা এবং যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি আপনার কাছে তাই চূড়ান্ত অপমান সত্ত্বেও কিছু বলছি না। এর চেয়ে বেশি এগোলে কোর্টে যেতে হয়।’
মহানাম বললেন—‘ডিফ্যামেশন তখনই হয় অরিত্র যখন অপবাদটা মিথ্যা দেওয়া হয়। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি মিথ্যার কথাটা সত্যিই বলেছি। একঝুড়ি মিথ্যা দিয়ে তুমি নীলমকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলে, আরেক ঝুড়ি মিথ্যা দিয়ে এষাকে আমার কাছে পৌঁছতে দিলে না। সেই মিথ্যেগুলো ঠিক কি বলো তো!’
অরিত্র ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল—‘আপনি এতই আত্মতুষ্ট যে নিজের সম্বন্ধে নিজেই কিছু জানেন না। আপনাকে আমাদের সার্কলে সবাই কি বলত জানেন? ওম্যানাইজার। বুঝলেন? ডার্টি ওম্যানাইজার। একটার পর একটা মেয়েকে আপনি নষ্ট করেন, জ্ঞান-বুদ্ধি-পাণ্ডিত্যের ভাঁওতা দিয়ে। নিজেকে ডন জুয়ান ভেবে যতই আনন্দ পান, অক্সফোর্ডে যে বেলেল্লাপনা চলে, সত্তর দশকের কলকাতায় তা চলত না। নীলমের কাহিনীটা যদি পুরো প্রকাশ করে দিতাম তাহলে নকশালদের হাতে প্রথম খুন হতেন আপনিই।’
মহানাম শান্ত হয়ে বসেছিলেন—অরিত্রের কথা সম্পূর্ণ শেষ হলে বললেন—‘আশ্চর্য! তোমাদের সার্কল-এ তোমার মতো প্রতিভাবান নারীপ্রেমিক থাকা সত্ত্বেও তোমার বন্ধুরা আমাকেই ওম্যানাইজার বলে শনাক্ত করল? খুবই আশ্চর্য। সেইজন্যেই তুমি আমার চরিত্রের এই বিখ্যাত দিকটাকে বিষয় করে নীলমকে বেশ কয়েকটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলে সেই সময়ে। না? বাঃ। এবার জটগুলো বেশ সরল হয়ে আসছে। কিন্তু আমি যদ্দূর জানি এষা তোমার জন্য উন্মুখ ছিল, আমাকে বঞ্চিত করবার জন্য তুমি এষাকে উচ্ছিন্ন করলে কেন? এবং তারও পর এষা যখন ওর দারুণ রক্ষণশীল বাড়িতে কোনরকম সান্ত্বনা না পেয়ে ধিক্কারে, লজ্জায়, আমার দ্বারস্থ হচ্ছিল সেখানেও তুমি তোমার গোপন তীর ছুঁড়তে ভুললে না তীরন্দাজ। নীলমকে দিয়ে এষাকে তুললে, তারপর এষাকে দিয়ে আবার⋯ না না অরিত্র তুমি ঠিক কিভাবে এদের ব্যবহার করেছ আমার কাছে কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। কি যে তোমার বিচিত্র রসায়ন।’
নীলম পেছনের দরজা দিয়ে ওপরে লেবু আনতে গিয়েছিল। লেবু-চা এনে রেখে চলে গেল। সে বুঝতে পেরেছে, অরিত্রর সঙ্গে মহানামের কিছু একটা বোঝাপড়া হচ্ছে, এটা হওয়া দরকার। অনেক দিন ধরে বকেয়া হয়ে আছে।
অরিত্র অবাক হয়ে লক্ষ করল—যেভাবে রেগে যাওয়া তার উচিত ছিল সে রাগছে না সেভাবে। চোখা-চোখা কথাগুলো সে বলে ফেলতে পেরেছে। উপরন্তু বিজয় লক্ষ্মী তো তারই দিকে। সে হঠাৎ হেসে বলল—‘অনেক রকম অকথ্য অপবাদ তো দিয়ে গেলেন একটার পর একটা। তবুও নীলম আমারই রান্নাঘরে আপনার জন্য রান্না করছে, এবং এষা আমার ঘরে আপনাকে অভ্যর্থনা করে আপনারই জন্য বাজার করতে গেছে।’
মহানাম শব্দ করে হেসে উঠলেন, বললেন—‘গুড, গুড। এই তো অরিত্র, তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছ। এইটাই আমি তোমাদের বরাবর বলে এসেছি। ম্যাচিওরিটি দরকার। কি আবেগের। কি বুদ্ধির। এখন হৃদয় এবং বুদ্ধিকে একটা উল্লম্ব রেখায় একত্র স্থাপন করতে পারলেই তোমার বুদ্ধির মুক্তি এবং মুক্তির বুদ্ধি হবে। সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে। ভালো, ভালো। আমার তোমার ওপর বিন্দুমাত্র রাগ নেই।’
এই সময়েই এষা ও পুপু ফিরল। দুজনেরই মুখ লাল হয়ে গেছে রোদে। অরিত্র একটু ধমকের গলায় বলল—‘পুপ্, তোমাকে কতবার টুপি পরতে বলেছি। এষা, তুমিও তো মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিলে পারতে। ভীষণ রোদ। এই রোদে তুমি যে কি করে ঔরঙ্গাবাদ যাবে, আমি তো বুঝতেই পারছি না। ইলোরা তো রীতিমতো কষ্টসাধ্য ব্যাপার! আপনি কি বলেন মহানামদা!’
‘আমি আপাতত কিছুই বলি না। আগে যাই। আমাকে তো যেতেই হবে।’
এষা বসে পড়ে বলল—‘কোথায়? ইলোরায়? আপনি যাচ্ছেন মহানামদা! আমাদের সঙ্গে চলুন তবে। আমরা, মানে আমি তো যাচ্ছিই। আপনাকে যেতে হবেই বলছেন কেন?’
‘একটা লেখার জন্য।’ মহানাম বললেন, ‘তোমাদের প্রোগ্রাম ঠিক কি না জানলে তো⋯?’
নীলম এই সময়ে বেরিয়ে এসে বলল—‘প্রোগ্রাম যা-ই হোক, তুমি ওদের সঙ্গে যাচ্ছোই।’
পুপু বলল—‘ডক্টর রয়, আপনি কি আর্টের ওপর লিখবেন?’
মহানাম ফিরে তাকালেন, বললেন, ‘কিসের ওপর লিখলে তুমি খুশি হও?’
পুপু জবাব দিল—‘আর্ট অ্যান্ড রিলিজন।’
মহানাম বললেন-‘অল রাইট, তাই-ই লিখব। তুমি বাংলা পড়তে পারো?’
পুপু খুব লজ্জিত গলায় বলল—‘ভালো করে নয়।’
‘নীলম, এটা ঠিক করোনি, মাতৃভাষা ছাড়াও বাংলা যথেষ্ট সুন্দর ভাষা। তোমরা ওকে এটা না শিখিয়ে ভুল করেছ। পশ্চিমবঙ্গে যেসব অবাঙালি থাকেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু যে যার মাতৃভাষা লিখতে পড়তে পারে।’
পুপু বলল—‘ওটা আমারই দোষ। আমি শিখেছিলুম ঠিকই, চর্চার অভাবে ভুলে গেছি। দেখে নেবো। আপনি কি বাংলায় লিখবেন?’
মহানাম বললেন না যে এটা একটা বইয়ের পরিকল্পনার অন্তর্গত। বিদেশী পাবলিশারের ফরমাশ। শুধু অন্যমনস্কভাবে বললেন—‘তুমি বাংলাটা শিখে নেবে বলছ বলে আমি বাংলাতেই লিখব সমিদ্ধা, তোমায় পাঠিয়ে দেবো। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে ধর্মের সম্বন্ধ নিয়ে তুমি এতো ভাবছো কেন?’
পুপু বলল—‘আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং ইফ আর্ট কুড বি ইন্টারপ্রেটেড অ্যাজ আ কাইন্ড অফ রিলিজন! ডক্টর রয়, আমার মার একটা রিলিজন আছে, ওই ঘরের তাকে কয়েকটি মূর্তিকে ফুল, আগরবাতি নদীর জল—এসব দিয়ে পুজো করে, মানে শী প্রেজ বিফোর দোজ ইমেজেস। আমার বাবার সঙ্গে মার মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয়, অলটার্কেশন। বাবা বলে,—‘কি পাপ পাপ করো, পাপ আসলে মানসিক অসুস্থতা, আর পুণ্য হল মানসিক স্বাস্থ্য। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার সবচেয়ে বড় উপায় কাথার্সিস, অর্থাৎ নিজের যা ইচ্ছা তাই করা উইদিন লিমিটস। আর যদি কনসেনট্রেশন দিয়ে শান্তি পেতে চাও তো বই পড়ো, ছবি আঁকো, মূর্তি গড়ো, কবিতা লেখো। এখন মার রিচ্যুয়াল আর বাবার রিচুয়্যালের মধ্যে কি সম্পর্ক জানতে আমার খুব ইচ্ছে হয়। মানে আই ফীল ইট ইজ অফ ভাইট্যাল ইমপর্ট্যান্স টু মি।’
অরিত্র নীলমের দিকে চাইল। এসব কথা নিয়ে মাঝে-মধ্যে তাদের মধ্যে লড়াই হয়েছে বটে, কিন্তু পুপু এতো আগ্রহ নিয়ে সেসব শুনেছে এবং এইভাবে গুছিয়ে সে বিতর্কের সারবস্তুকে অনায়াসে সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারবে এ কথা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।
মহানাম খুব অবাক হলেন। তাঁর চোখ কেন জানি আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। তিনি বললেন—‘তুমি নিজে রিলিজন নিয়ে কি ভাবে? তোমার নিজের কোনও রিলিজন আছে পুপু?’
‘আছে ডক্টর রয়। ধরুন আমি কনসেনট্রেশন করি বইয়ে, বা ড্রয়িং-এ। রিচ্যুয়ালসও আছে কিছু যার মধ্যে দিয়ে আমি মানসিক স্বাস্থ্য উদ্ধার করি যেমন ব্যায়াম, গান শোনা, পিকচার গ্যালারি, আর্ট এগজিবিশনে যাওয়া, ডক্টর রয়, আমি রোজ নিয়ম করে কাউকে না কাউকে কিছু-না-কিছু দিই। ভেতরটা কিরকম একটা হয়ে যায় বোঝাতে পারব না, ইট মাস্ট বী আ রিচ্যুয়্যাল।’
পুপুর বাবা মা ভীষণ অবাক হয়েছে। পুপু আজকে যা বলছে তা তার অন্তৰ্জীবনের কথা। কখনও বলেনি। কখনও আলোচনা করেনি। কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি। অরিত্র অনুভব করছে তার ভেতরে অভিমান জমছে। নীলমের কেন খুশি লাগছে সে জানে না। এষার পুপ্কে খুব কষে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে কেন জানে না। স্নেহ যেন শতধারায় ছুটে যেতে চায় আঠার বছরের ওই তরুণ মুখটির দিকে।
মহানাম হেসে বললেন—‘খ্রীষ্টজন্মের পাঁচশ বছর আগে আথেন্সে যখন পেরিক্লিস, সেই সময়ে ফিডো বা জেনোফোন নামে কোনও ভদ্রলোকের বাগানবাড়িতে সান্ধ্য মজলিশ বসেছে ধর। সমিদ্ধা, সেখানে তোমার বয়সের কিশোররা উপস্থিত রয়েছে অনেক। কিশোরী অবশ্য নেই একটিও। চলো সেই মজলিশে একমাত্র তরুণী সভ্য বলে তোমাকে আমরা নিয়ে যাই।’
পুপু বলল—‘সক্রেটিস থাকতেন, না? আর প্লেটো? ডক্টর রয়, আপনি সেই মজলিশে কার ভূমিকা নেবেন? প্লেটোর?’
মহানাম বললেন-‘একেবারেই না, আমিও একটি জিজ্ঞাসু তরুণ, আমার নাম যা খুশি হতে পারে, ইউরিপিদিস টিস যা হোক।’
নীলম হঠাৎ বলল—‘অতবড় একজন মানুষকে কি তখন থেকে ডক্টর রয়, ডক্টর রয় করছিস পুপু। কি তোদের জেনারেশনের কালচার আমি কিছুই বুঝি না।’
‘বাঃ। কি বলব তাহলে বলে দাও—।’ পুপু বালিকার মতোই মায়ের তিরস্কার মেনে নিল—‘জেঠু, না, কাকু, না, মামু? কি?’
মহানাম অট্টহাস্য হেসে বললেন—‘জেঠু, কাকু, মামু ডাকার চেয়ে আমাকে ও বরং না-ই ডাকলো নীলম। হোয়াটস রং উইথ ডক্টর রয়?