Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীলবসনা সুন্দরী || Panchkari Dey » Page 64

নীলবসনা সুন্দরী || Panchkari Dey

মোবারক গৃহতলে পড়িয়া, অর্দ্ধমুদিতনেত্রে ক্ষীণকণ্ঠে নিজের পাপকাহিনী বলিতে লাগিল,- “ইদানীং আমি অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় নেপালে থাকিতাম। কিছুদিনের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছিলাম। নেপালের দক্ষিণপ্রান্তস্থ পর্ব্বতমালায় কাওয়াল জাতি বাস করে। কাওয়াল জাতির স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত সুন্দরী; কিন্তু তাহাদিগের স্বভাব অত্যন্ত কলুষিত-সকলেই স্বেচ্ছাচারিণী-সতীত্ব বলিয়া যে কিছু আছে, তাহা তাহারা জানে না। আমি একটু অবসর পাইলেই তাহাদের সঙ্গে গিয়া মিশিতাম। তাহাদের মধ্যে মানিয়া নাম্নী কোন রমণীর সহিত আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়। কিছুদিন পরেই মনিয়ার মৃত্যু হয়- সেই মানিয়ার কাছেই আমি এই তীরের ফলাটা পাইয়াছিলাম। তাহার মুখে শুনিয়াছি, কাওয়াল জতিরা এই তীরের ফলা তৈয়ারী করিয়া পক্ষাধিক কাল কোন একটা বিষাক্ত গাছে বিদ্ধ করিয়া রাখিয়া দেয়। তাহাতে সেই তীরের ফলা এমনই বিষাক্ত হয় যে, তাহার একটু আঁচড়ে দেহস্থ সমুদয় রক্ত বিষাক্ত হইয়া উঠে; অতি অল্পক্ষণে প্রাণ বহির হইয়া যায়। কাওয়াল জাতিরা হিংস্র প্রাণী শিকারে এই তীরের ফলা ব্যবহার করিয়া থাকে। নেপাল হইতে আসিবার সময়ে এই তীরের ফলা আমিই সঙ্গে আনিয়াছিলাম। নেপালে আমি অনেকদিন ছিলাম। তাহার পূর্ব্বে আমি খিদিরপুরে থাকিতাম। খিদিরপুরে সৃজান বিবির পিত্রালয়। আমি সৃজানকে প্রাণের অধিক ভালবাসিতাম। সৃজানও আমাকে ভালবাসিত-তখন মুন্সী সাহেবের সহিত তাহার বিবাহ হয় নাই। আমার মনে ধারণা ছিল, পরে আমার সহিত নিশ্চয়ই সৃজানের বিবাহ হইবে। কিছুদিন পরে সহসা সৃজানের মনের পরিবর্ত্তন ঘটিল-সৃজানের ভালবাসা ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতে লাগিল। বিষয়-ঐশ্বর্য্যে, ধন-দৌলতের উপরেই তাহার অনুরাগটা বেশি প্রকাশ পাইতে লাগিল। সে আমাকে বিবাহ করিতে চাহিল না-উপেক্ষাও করিল না-প্রকারান্তরে আমাকে হাতে রাখিল। ইচ্ছা, যদি একান্তই কোন ধনবান্ জমিদার, আমীর-ওম্রাও না জুটে, তখন সে আমাকে বিবাহ করিবে। এই সময়ে আমাকে অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় নেপাল যাইতে হয়। কিছুকাল পরে সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম, মুন্সী সাহেবের সহিত সৃজানের বিবাহ হইয়া গিয়াছে। আমি একদিন সৃজানের সহিত গোপনে দেখা করিলাম। এই প্রবঞ্চনার জন্য আমি তাহাকে অনেক কটূক্তি করিলাম-সে সকলই হাসিয়া উড়াইয়া দিতে লাগিল। ক্রমেজানিতে পারিলাম, সে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগের চেষ্টায় আছে। আমাকে ছাড়িয়া সৃজান মনিরুদ্দীনের অঙ্কশোভিনী হইবে, ইহা আমার একান্ত অসহ্য হইল; মনে মনে স্থির করিলাম, প্রাণ থাকিতে কখনই তাহা ঘটিতে দিব না। আমাকে এতদিন আশা দিয়া আজ যে, সে হঠাৎ এরূপভাবে নিরাশ করিবে, এতদিন ভালবাসা জানাইয়া আজ যে সে হঠাৎ এরূপভাবে আমাকে উপেক্ষা করিবে, ইহা আমার পক্ষে একান্তই অসহ্য! আমাকে ঘৃণা করিয়া, মনিরুদ্দীনকে লইয়া সে সুখী হইবে, আর আমি দীননেত্রে তাহার সুখ-সৌভাগ্যের দিকে চাহিয়া থাকিব-তাহা কখনই হইতে দিব না। মনে মনে স্থির করিলাম, গোপনে সৃজানের সহিত একবার দেখা করিয়া যাহাতে সে এ সঙ্কল্প ত্যাগ করে, সেজন্য বুঝাইয়া বলিব। যদি সে তাহাতে অন্যমত করে, তাহা হইলে তাহাকে এই বিষাক্ত তীরের ফলাটা সাহায্যে খুন করিতেও কুণ্ঠিত হইব না। তাহার পর হঠাৎ একদিন জানিতে পারিলাম যে, সেদিন রাত্রিতেই সে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিবে। আমিও রাত্রি দশটার পর বাসা হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। প্রথমে মুন্সী সাহেবের বাড়ীতে গিয়া গোপনে সন্ধান লইলাম যে, সৃজান রাজাব-আলির বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছে। সেখান হইতে ফিরিয়া আমি মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে আসিলাম। সেখান গোপনে সন্ধান লইয়া জানিতে পারিলাম, মনিরুদ্দীনও বাড়ীতে নাই। মনে বড় সন্দেহ হইল, সৃজান নিমন্ত্রণ রাখিতে যাইবার অজুহাতে বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছে-মনিরুদ্দীনও বাড়ীতে নাই; অবশ্যই ভিতরে ভিতরে উভয়ে পলাইবার একটা কিছু বন্দোবস্ত করিয়াছে। রাগে দ্বেষে আমার সর্ব্বঙ্গ জ্বলিয়া যাইতে লাগিল।স্থির করিলাম, যদি সহজ উপায়ে কার্য্যসিদ্ধ না হয়, দুইজনকেই খুন করিব। পুনরায় বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। বিষাক্ত তীরের ফলাটা পকেট লইয়া আবার মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে ছুটিলাম। মনিরুদ্দীনের বাড়ীর নিকটে আসিয়া দূর হইতে মুন্সী সাহেবকে সেখানে দেখিতে পাইলাম। কি আশ্চর্য্য! এমন সময়ে মুন্সী সাহেব এরূপভাবে এখানে দাঁড়াইয়া কেন? কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। তাঁহাকে দেখিয়া বোধ হইল, তিনি যেন কাহার অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি আমাকে দেখিতে পান্ নাই; আমিও তাঁহার সহিত তখন দেখা করা যুক্তিযুক্ত বোধ করিলাম না। মনে অত্যন্ত কৌতূহল উপস্থিত হইল; কি ঘটে দেখিবার জন্য আমি কিছু দূরে একটা গাছের আড়ালে লুকাইয়া রহিলাম। এমন সময় মনিরুদ্দীনের বাড়ীর ভিতর হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে একটি স্ত্রীলোক ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। দ্বারের উপরে লণ্ঠন জ্বলিতেছিল, তাহারই আলোক চকিতে একবারমাত্র আমি তাহার মুখখানি দেখিতে পাইলাম-দেখিয়াই চিনিতে পারিলাম-সে সুন্দরী সৃজান। সৃজানকে বাহির হইতে দেখিয়াই মুন্সী সাহেব ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিল। এবং তাহাকে টানিয়া একটু তফাতে পথিপার্শ্বস্থ একটা অলোকস্তম্ভের নিম্নে গিয়া দাঁড়াইল। মুন্সী সাহেব তাহাকে হাত মুখ নাড়িয়া কি বলিতে লাগিলেন। দুই-একটা কথা আমি শুনিতে পাইলাম, ভাল বুঝিতে পারিলাম না; কিন্তু ভাবভঙ্গিতে খুব রাগের লক্ষণ দেখা গেল। সৃজান একবার মাত্র চীৎকার করিয়া উঠিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া চলিয়া গেল। মুন্সী সাহেবও তাহার পশ্চাতে ছুটিয়া গেলেন। পরে আরও কি ঘটে দেখিবার জন্য আমি দ্রুতপদে মেহেদী-বাগানের দিকে চলিলাম। মেহেদী-বাগানে আসিয়া প্রথমে তাহাদের দুইজনের কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। পরে একটা গলির ভিতর হইতে সৃজানকে বাহির হইতে দেখিলাম। আমি তখনই ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিলাম। সে অন্ধকারে প্রথমে আমাকে চিনিতে না পারিয়া, চমকিত হইয়া হাত ছাড়াইয়া লইবার চেষ্টা করিল। তাহার পর চিনিতে পারিয়াও সে আমাকে অনেক কটূক্তি করিতে লাগিল। আমি ধীরভাবে তাহা শুনিয়া গেলাম-তাহার কথায় রাগ করিলাম না। মনিরুদ্দীনকে ছাড়িয়া সে যাহাতে আবার আমার হয়, সেজন্য তাহাকে অনেক বুঝাইতে লাগিলাম। আমি তাহাকে তখনই বালিগঞ্জে আমার বাসায় লইয়া যাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলাম। বলিলাম, ‘দেখ সৃজান, তুমি কিছুতেই আমার হাত হইতে অব্যাহতি পাইবে না। আমার সঙ্গে তোমাকে আমার বাসায় যাইতে হইবে। তাহার পর রাত্রিশেষে তোমায় আমায় একদিকে চলিয়া যাইব। এখন তোমার আর গৃহে ফিরিবার কোন উপায়ই নাই; মুন্সী সাহেব স্বচক্ষে তোমাকে মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইতে দেখিয়াছেন-তিনি নিশ্চয়ই এখন তোমাকে হত্যা করিবেন। আমি এতদিন তোমার আশাপথ চাহিয়া আছি-আর আজ যে তুমি এমন কঠিনভাবে আমাকে একেবারে নিরাশ করিবে, কিছুতেই তাহা হইবে না।’ অনেক সাধ্য-সাধনার পর সৃজান আমার সহিত যাইতে সম্মত হইল। তখন সম্মত হইতে দেখিয়া আমি সেই প্রেম-পত্রগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। এই পত্রগুলি আমি অনেকদিন পূর্ব্বে-যখন সৃজানের বিবাহ হয় নাই-তখন লিখিয়াছিলাম। সৃজানকে বলিলাম, এই সকল পত্র যদি পরে কখনও কাহারও হাতে পড়ে, তাহা হইলে সকলই প্রকাশ হইয়া পড়িবে! সকলেই জানিতে পারিবে, তুমি আমার সহিত গিয়াছ; কিন্তু দুই-চারিদিনের মধ্যে কোন রকমে যদি এই পত্রগুলি বাহির করিয়া আনিতে পারা যায়-তাহা হইলে আমাদের আর সে ভয় থাকে না। তাহাতে সৃজান এই পত্রগুলি যেখানে যেরূপভাবে রাখিয়াছিল, বলিল। গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিবার কৌশল আমাকে বলিয়া দিল। আমি তাহাকে মেহেদী-বাগানের একটা গলিপথ দিয়া নিজের বাসার দিকে লইয়া চলিলাম। কিছুদূর গিয়াই সৃজানের মত আবার ফিরিয়া গেল-সে আমার সহিত আর যাইতে চাহিল ন। আমার মুখের উপরেই আমাকে সে ঘৃণার সহিত বলিল, আমি তাহার যোগ্য নই-সে সর্ব্বান্তঃকরণে মনিরুদ্দীনকেই ভালবাসে। শুনিয়া দারুণ ঈর্ষায় আমার আপাদমস্তক জ্বলিয়া গেল-মুখে রাগের ভাব কিছু প্রকাশ করিলাম না-তাহাকে খুন করিতে প্রস্তুত হইযা বলিলাম, ‘সৃজান, তুমি আমাকে ত্যাগ করিলেও আমি কিন্তু তোমাকে এ জীবনে ভুলিব না। যদি একান্তই আমি এখন তোমর অযোগ্য হইয়া থাকি, যদি একান্তই তুমি আমাকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করিবে, এরূপ কঠিনভাবে উপেক্ষার সহিত আমাকে ত্যাগ করিয়ো না, আমার মর্ম্মভেদ করিয়ো না; তাহা আমার অসহ্য হইবে। আজ একবার হাসিমুখে শেষবার তোমার ঐ মুখখানি চুম্বন করিতে দাও- বহুদিনের তৃষিত আমি, চিরবিদায়ের আজ শেষ প্রেমালিঙ্গন, সৃজান, আর আমি তোমাকে কখনও বিরক্ত করিতে আসিব না।’ বলিয়া তাহাকে বুকে লইয়া মুখচুম্বন করিলাম; সেই ব্যাকুলতার সময়ে আমি অলক্ষ্যে তাহার গলদেশে বিষাক্ত তীরের ফলা দিয়া একটা আঁচড় লাগাইয়া দিলাম। সে তাহার কিছুই জনিতে পারিল না। ক্রমে যখন তাহার সর্ব্বাঙ্গ একেবারে অবসন্ন হইয়া আসিল, তখন আমি তাহাকে প্রকৃত যাহা ঘটিয়াছে প্রকাশ করিলাম। বলিলাম, ‘সৃজান, এখনই তুমি মরিবে-আর তোমার রক্ষার উপায় নাই, বড় ভয়ানক বিষ। কি ভ্রম! মোবারক বাঁচিয়া থাকিতে তুমি অন্যের উপভোগ্য হইবে, মনে করিয়াছিলে!’ সৃজান কোন উত্তর করিল না- তখন তাহার কণ্ঠস্বরও অতি ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে-কি বলিতে চেষ্টা করিল, স্পষ্ট বলিতে পারিল না-অনতিবিলম্বে তাহার মৃত্যু হইল। আমিও তখন আত্মরক্ষার একটা উপায় উদ্ভাবন করিয়া ফেলিলাম। তাহার মৃতদেহ পথের উপর হইতে তুলিয়া লইয়া যাহাতে সহজে কহারও নজর না পড়ে, এরূপভাবে একটা গাছের আড়ালে রাখিয়া দিলাম। তখনই আমি রাজাব-আলির বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম; সেখানে সেদিন আমারও নিমন্ত্রণ ছিল। পরে কোন রকমে আমার উপরে সন্দেহের কোন কারণ উপস্থিত হইলেও নিজেকে নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন করিতে পারিব মনে করিয়া আমি সেখানে অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত রহিলাম। রাত দুইটার পর রাজাব-আলির বাড়ী হইতে বাহির হইলাম। মাথায় আর একটা মতলব আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি আবার মেহেদী-বাগানের দিকে গেলাম-সেখানে পথ দেখাইবার অজুহাতে একজন পাহারাওয়ালাকে সঙ্গে লইলাম; তাহাকে কিছুদূর গিয়া ছাড়িয়া দিলাম। যে গাছতলায় সৃজানের দেহ মৃতদেহ রাখিয়াছিলাম, সেখানে গিয়া দেখিলাম, যেমনভাবে সৃজানকে ফেলিয়া গিয়াছিলাম, তখনও ঠিক সেইভাবে পড়িয়া রহিয়াছে-হাত পা অত্যন্ত কঠিন হইয়া গিয়াছে। তখনও সেই মৃতদেহ কহারও নজরে পড়ে নাই। আমি তখনই মৃতদেহ সেখান হইতে তুলিয়া আনিয়া গলিপথের মাঝখানে ফেলিয়া সেই পাহারাওয়ালাকে ডাকিতে লাগিলাম। সে আবার ছুটিয়া আসিল-পরে আরও দুই-তিনজন পাহারাওয়ালা আসিয়া জুটিল-আমি তাহাদের হাতে সৃজানের মৃতদেহ তুলিয়া নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। তাহার পর যাহা, ঘটিয়াছে, সকলই আপনার জানেন। পরে এই সকল চিঠি হইতে এই খুনের সম্বন্ধে আমার উপরে কোন কারণ উপস্থিত না হয়, সেজন্য একদিন আমি এই চিঠিগুলার সন্ধানে মুন্সী সাহেবের সঙ্গে সেখা করিতে আসি। মুন্সী সাহেব তখন বাড়ীতে ছিলেন না; আমি এই ঘরে একাকী বসিয়া তাঁহার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম; সেই সুযোগে গুপ্ত-ড্রয়ারটা খুলিয়া ফেলিলাম; কিন্তু তাহার ভিতরে চিঠিগুলা দেখিতে পাইলাম না; কেবলমাত্র একছড়া কণ্ঠহার ছিল। খুনের রাতে মুন্সী সাহেব যাহা করিয়াছিলেন, আমি সমস্তই জানিতাম; ইহাতে সহজেই তাঁহার ঘাড়ে দোষ চাপাইতে পারা যাইবে মনে করিয়া, আমি সেই বিষাক্ত তীরের ফলাটা সেই কণ্ঠহারের সঙ্গে রাখিয়া গুপ্ত-ড্রয়ারটা পূর্ব্ববৎ বন্ধ করিলাম।” এই পর্য্যন্ত বলিয়া মোবারক চুপ্ করিল। তাহার কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ ভগ্ন হইয়া আসিয়াছিল-বলিতে বলিতে কথা অনেকবার জড়াইয়া যাইতেছিল। মোবারক যাহা বলিল, হরিপ্রসন্ন বাবু একখানি কাগজে তাহা লিখিয়া লইয়াছিলেন। মোবারকের মৃত্যু সন্নিকটবর্ত্তী দেখিয়া তিনি তাড়াতড়ি উঠিয়া এক কলম কালি লইয়া, মোবারকের হাতে দিয়া সেই কাগজখানায় একটা নাম সহি করিতে বলিলেন। অতি কষ্টে মোবারক নিজের নাম সহি করিল। তাহার ইসাদীর স্থলে দেবেন্দ্রবিজয়, হরিপ্রসন্ন বাবু এবং জোহেরা নিজ নিজ নাম সহি করিলেন। এবং দেবেন্দ্রবিজয় একটা লম্বা খামের মধ্যে সেই কাগজখানা ভাঁজ করিয়া পুরিয়া ফেলিলেন। এদিকে মোবারকের দেহ ক্রমশঃ অবসন্ন ও অবশ হইয়া আসিতে লাগিল। ঘন ঘন শ্বাস বহিতে আরম্ভ হইল। স্বপ্নাবিষ্টের জড়িত ভগ্নকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “পাপের পরিণাম কি ভয়ানক! কি মনে-করে এখানে-আসিলাম, কি হইল? কোথায়-জোহেরাকে-বিবাহ-করিব, না-নিজের-বিষে-নিজে-মরি-লা-ম। বিষ-বিষ-বড়-জ্বালা-অসহ্য-স-র্ব্বাঙ্গ-জ্ব’-লে-গে-ল-পুড়ে-গেল। এই-বিষে-এক-দিন-সৃজান-জ্বলিয়া-পুড়িয়া-মরি-য়াছে। কোথায়-যাই-তেছি-কত-দূরে, জা-হা-ন্নমে-না-না-ঐ-যে-জোহেরা,-না-জোহে-রা-নয়-সৃজান-পিশাচী-সৃ-জা-ন-আর-না-আ-মি-আ-র-উঃ- ”
মোবারকের মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না। ধীরে ধীরে তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হইয়া আসিল; যেন হতভাগ্য নিদ্রিত হইল। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এ জগতে ইহা শেষ নিদ্রা-এ নিদ্রা যখন ভাঙিবে, তখন সে আর এক নূতন জগতে গিয়া উপস্থিত হইবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *