নীলবসনা সুন্দরী : চতুর্থ খণ্ড – প্রথম পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে না বিপক্ষে?
মজিদ খাঁ এইরূপ বিপদ্গ্রস্ত হওয়ায় তাঁহার বন্ধুবর্গের মধ্যে মোবারক উদ্দীনকেই সর্ব্বপেক্ষা অধিক দুঃখিত বোধ হয়। কেবল দুঃখিত কেন, তিনি যে মজিদ খাঁর বন্দিত্বে যথেষ্ট অনুতপ্ত, তাহা তাঁহার ভাবগতিকে এখন অনেকেই অনুমান করিতেছেন। তাঁহার একটিমাত্র কথার জন্য আজ মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ। যেখানে কত অসংখ্য দস্যু, নরহন্তা, তস্কর তাহাদের পদচিহ্ণ রাখিয়া গিয়াছে, সেইখানে আজ তাঁহারই দোষে নিরপরাধ মজিদ খাঁ লুণ্ঠিত হইতেছেন; ইহাতে কাহার না হৃদয় ব্যথিত হয়? সেদিন খুনের রাত্রে মজিদ খাঁর সহিত যে, তেমন সময়ে মেহেদী-বাগানে তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, এ কথা যদি তিনি নিজের এজাহারে পূর্ব্বে প্রকাশ না করিতেন, তাহা হইলে ত মজিদ খাঁকে আজ হত্যাপরাধে অভিযুক্ত হইয়া অকারণ কারাকূপে নিক্ষিপ্ত হইতে হইত না।
অদ্য অপরাহ্ণে কলিঙ্গা-বাজারে রাজাব-আলির বহির্ব্বাটীর নিম্নতলস্থ প্রশস্ত বৈঠকখানায় বসিয়া তাঁহার পুত্র সুজাত-আলির সহিত মোবারক-উদ্দীনের নিভৃতে এইরূপ কথোপকথন হইতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মদ্যপানও চলিতেছিল। বাল্যে উভয়ে এক ক্লাসের ফ্রেণ্ড ছিল, যৌবনে এখন এক গ্লাসের ফ্রেণ্ডে পরিণত হইয়াছে-এইটুকু পরিবর্ত্তন।
মোবারক বলিল, “আমার দোষেই বৈ কি; কে জানে যে এমন হইবে? তাহা হইলে কি আমার মুখ দিয়া একটা কথাও প্রকাশ পায়! প্রকাশ করিবার ইচ্ছাটাও আমার ছিল না; কথায় কথায়- ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয় লোকটা বড় ধড়ীবাজ-আমার কাছ থেকে এমনভাবে কথাটা বাহির করিয়া লইল যে, কাজটা ভাল করিতেছি, কি মন্দ করিতেছি-আমি তখন তাহা বিবেচনা করিয়া দেখিবারও অবসর পাইলাম না। লোকটা ভয়ানক বদলোক-আমার সেই কুকুরটাকেও নিকেশ করিয়াছে।”
সুজাত বলিল, “এখন শুনিতে পাই, সে ছুরিতে যে দিলজান খুন হইয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহা এখন ঠিক প্রমাণ করিতে পারিতেছে না। মজিদকে দোষী বলিয়া আমার একবারও মনে হয় না।”
মুখের কথা লুফিয়া লইয়া মোবারক বলিল, “কেনই বা হইবে? মজিদ খাঁকে যে জানে, সে কখনই ইহা বিশ্বাস করিবে না। আরও ভাবিয়া দেখা উচিত, কেনই বা সে দিলজানকে খুন করিতে যাইবে? কারণ কি? এমন একটা ভয়ানক খুন-অবশ্যই ইহার একটা কারণ থাকা চাই। মজিদের সঙ্গে দিলজানের কোন সম্বন্ধই নাই। দেবেন্দ্রবিজয় লোকটা পাকা ডিটেক্টিভ হইলেও কাজটা বড়ই অন্যায় করিয়াছে। কেবলমাত্র সেই ছুরির উপর নির্ভর করিয়া, একজন নির্ব্বিরোধ ভদ্রলোককে অকারণ টানাটানি করা কাজটা তাহার নিতান্ত গর্হিত হইয়াছে। মজিদ কোন্ উদ্দেশ্যে দিলজানকে খুন করিবে? তাহাকে ধরিয়া পুলিস অনর্থক পীড়াপীড়ি করিতেছে; বরং মনিরুদ্দীনকে-“বলিতে বলিতে মোবারক মধ্যপথে সহসা চুপ করিয়া গেল।
সুজাত বলিল, “মনিরুদ্দীনও বড় বাদ যাইবে না। আমার বোধ হয়, তাহাকেই শেষে বেশি জড়াইয়া পড়িতে হইবে। দেবেন্দ্রবিজয় যখন ইহাতে হাত দিয়াছে, তখন একটা-না-একটা কিছু না করিয়া ছাড়িতেছে না। এদিকে মনিরুদ্দীনেরও সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। তাহার সঙ্গে দেখা করিতে আজ মুন্সী সাহেব, দেবেন্দ্রবিজয় ও উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু সকলে একসঙ্গে রওনা হয়েছেন।”
সুজাত বলিল, “হাঁ, সৃজান বিবিও সেখানে আছে।”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায়-এই শহরে না কি?”
সুজাত বলিল, “সহরে না-ফরিদপুরে মনিরুদ্দীনের নিজের যে একটা বাগান-বাড়ী আছে, দুজনে মিলিয়া সেখানে সুখে-স্বচ্ছন্দে নিরিবিলি বাস করিতেছে। এইবার যত গোলযোগ আরম্ভ হইল, আর কি।”
মোবারক বলিল, “খুব গোলযোগ-মনিরুদ্দীনের একটা খুবই দুর্নাম রটিয়া গেল। এদিকে জোহেরার সঙ্গে তাহার বিবাহের কথা হইতেছিল, তা’ আর ঘটিতেছে না, দেখিতেছি। জোহেরা যদিও সম্মত হইত, এখন সে কিছুতেই মনিরুদ্দীনকে বিবাহ করিবে না। মনিরুদ্দীন নিতান্ত নির্ব্বোধ-সৃজানের লোভে এমন একটা স্বর্ণসুযোগ ছাড়িয়া দিল।”
সুজাত বলিল, “মনিরুদ্দীনের আর স্বর্ণসুযোগ কি? স্বর্ণসুযোগ মজিদ খাঁর। মনিরুদ্দীনের এ দুর্নামটা না রটিলেও জোহেরা তাহাকে বিবাহ করিত না। তাহা হইলে কি বিবাহ এতদিন বাকী থাকে! মুন্সী সাহেব অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন; জোহেরা কিছুতেই স্বীকার করে নাই। কেনই বা করিবে, অগাধ ঐশ্বর্য্য-নিজেই সর্ব্বেসর্ব্বা-তার উপরে আবার সে লেখাপড়া-জানা মেয়েমানুষ-পরের মতে মত দিবার মেয়েই নয়! এ রত্ন মজিদ খাঁর ভাগ্যেই আছে!”
মোবারক বলিল, “আমার ত আর তাহা মনে হয় না। যদিও মজিদ মুক্তি পায়-এ দুর্নাম কি তাহার সহজে যাইবে, মনে করিয়াছ? আমার বিশ্বাস, জোহেরা এখন আর মজিদকেও বিবাহ করিতে রাজী হইবে না। আমার কথাটা ঠিক কি না, পরে দেখিতে পাইবে।”
সুজাত জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, কিসে তুমি জানিলে?”
মোবারক বলিল, “আমি এখন নিজেই মজিদ খাঁর পদপ্রার্থী।”
সুজাত চমকিত হইয়া বলিল, “দূর-মিথ্যাকথা!”
মোবারক বলিল, “মিথ্যা নয়; অতি সত্যকথা। আমি এতদিন জোহেরাকে দেখি নাই-সেদিন তাহাকে দেখিয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়াছি। আমি কিছুতেই আর তাহার আশা ত্যাগ করিতে পারিব না।”
সুজাত হাসিয়া বলিল, “তুমি না আশা ত্যাগ করিলেই যে , তোমার আশা নিশ্চয় পূর্ণ হইতেই হইবে, এমন কি কথা? মজিদ মধ্যে থাকিতে তুমি কিছুতেই জোহেরাকে লাভ করিতে পারিবে না।”
মোবারক বলিল, “একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি আছে?”
সুজাত বলিল, “সহস্র চেষ্টাতেও তুমি কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিবে না। জোহেরা কখনই তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইবে না। সে যদি তোমাকে বিবাহ করে, আমার নাম সুজাত-আলি নয়।”
মোবারক দৃঢ়স্বরে বলিল, “যদি আমি জোহেরাকে বিবাহ করিতে না পারি-আমার নামও মোবারক-উদ্দীন নয়।”