নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে (Neelkantho Pakhir Khoje) – দ্বিতীয় খণ্ড : 01
তখন ভালোবাসার যৌবন হরণ কইরা নেয় আকালুদ্দিন। আন্নু ঘরের ভিতর। ফেলু বাছুর নিয়ে মাঠে গেছে।
ফেলু মাঠে নেমেই দেখল দুটো ঘোড়া পুকুরপাড়ে গোলাপজাম গাছটায় কারা বেঁধে রেখেছে। অনেক লোকজন ছুটে যাচ্ছে ঠাকুরবাড়ি। বুড়োকর্তার শরীর খারাপ হতে পারে। ঘোড়া তারিণী কবিরাজের হবে। ঘোড়ায় চড়ে শ্বাসকষ্ট নিরাময় করতে এসেছেন তারিণী কবিরাজ। অন্য ঘোড়া মতি রায়ের হবে। ওরা বুড়োকর্তার বড় যজমান। কিন্তু তখনই ফেলু দেখল ক’জন পুলিশ পুকুরপাড়ে কি খুঁজছে। নীল পাগড়ি মাথায় দুজন মানুষ ঘোড়া দুটোকে কি খেতে দিচ্ছে। বুঝি থলের ভিতর চানা দিয়ে মুখ বেঁধে দিয়েছে। সে দূর থেকে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। হাতে চানা খাওয়াচ্ছে, না থলের ভিতর চানা। দফাদারের হাত চেটে দিচ্ছে না পিঠ চেটে দিচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। শুধু দুই ঘোড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে বোঝা যাচ্ছে।
আকালুদ্দিন বাঁশঝাড়ের নিচে টেনে এনেছে বিবিকে। লোকজন ছুটছে হিন্দু পাড়াতে, ছোটঠাকুরকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটা শোরগোল শুনেই আন্নু শাড়ি পরে বের হতে যাবে তখন আকালুদ্দিন সামনে। দাড়িতে আতর মেখে হাজির। সারারাত আজকাল আর আন্নু ঘর থেকে বের হতে পারে না। ফেলু মটকা মেরে পড়ে থাকে। ঘুমোয় না। হাতের কষ্টে সে সারারাত ছটফট করে। কিন্তু আন্নুর মনে হয় ওটা হাতের কষ্ট নয়—য্যান ভিতরে সেই সন্দেহের কোড়া পাখিটা কুরে কুরে খায়। ঘুম আসে না মিঞার চোখে। আকালুদ্দিন মিঞা তার ঘুম হরণ কইরা নিছে। আকালুদ্দিন সামুর পরই এ-অঞ্চলে লীগের বড় নেতা।
সামু গাঁয়ে বড় আসে না। এলেও দু’একদিন থাকে তারপরই চলে যায়। আকালুদ্দিনের উপর সব ভার এখন। সে মুসলমান গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে মানুষজনকে তার দলে টানছে। কারণ আবার নির্বাচন আসছে, যা শোনা যাচ্ছে এবারে পৃথক নির্বাচন হবে, কোন্ মাসে হবে কে জানে। ফজলুল হক সাহেবের তেমন আর রবরবা নেই। আকালুদ্দিন মাঠে নেমে যাবার সময় খালি বাড়ি পেয়ে এক লাফে ঘরের ভিতর। বিবিকে টানতে টানতে একেবারে বাঁশবনের ভিতর।—আরে মিঞা, কর কি! কর কি! সময় অসময় নাই!
—তুই চুপ কর দিহি! ঐ দ্যাখ, মরদ তর মাঠে। খোঁড়া মুরগের মত হাইটা যায়।
আন্নু কাপড় তুলে উঁকি দিয়ে দেখল, সত্যি ফেলু মিঞা মোরগ ব’নে গেছে।
আকালু তখন আন্নুকে একটা জবরদস্ত মুরগি বানিয়ে ফেলল। মুরগি বানিয়ে আকালু আনুকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। সে সেই আবছা মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে হেসে উঠল, আমার মরদ লাথি মারে মিঞা। নালিশ দিতে দিতে সে আরামে বার বার পুষ্ট মুরগি বনে যাচ্ছে। আকালু দাড়ি ঘষে দিচ্ছিল ঘাড়ে। বড় আরাম বোধ হচ্ছে দু’জনার।
সামান্য এক বাছুরও নাস্তানাবুদ বানিয়ে দিচ্ছে ফেলুকে। বাছুর লেজ তুলে ছুটছে ফেলুকে নিয়ে।
আকালু দাড়ির আতর তখন বিবির মুখে ঘষে দিচ্ছে। পিঠে হাত রেখে ঘাড় চেটে দিচ্ছিল। তারপর যা হয়, পরের বিবিকে বিসমিল্লা রহমানে রহিম বলে বনে জঙ্গলে ভোগ করে একেবরে তাজা মানুষ আকালু। অথবা যেন সে মোল্লা ব’নে যায়। পান খায়, গুয়া খায় এবং বারে বারে নদীর পাড় দিয়া হাইটা যায়।
আকালু পরের বিবিকে মুরগি বানিয়ে হাঁটছে নদীর পাড়ে। সেও দেখতে পেল দুটো ঘোড়া গাছের নিচে বাঁধা। সে মনে মনে কপট হাসল। কারণ তখন ফেলুর বাছুরটা লেজ তুলে মাঠের দিকে না নেমে বাড়িমুখো উঠে যাচ্ছে।
কে যেন বলে, ফেলু তর মরণ! তর বিবির শরীরে আতরের গন্ধ। তুই আতরের গন্ধ টের পাবি বলে, তোকে বাড়িমুখো উঠে যেতে দেখলে বিবি তর ঝাঁপ দিব পুকুরে। আর আছে যণ্ড হাজি সাহেবের। সে তরে কেবল ভয় দেখায় চষা মাঠের উপর দাঁড়িয়ে। তোর যে কী হবে ফেলু! তুই তালাক দিবি বিবিকে। ফেলু মনে মনে হাসে। সে আজকাল একা থাকলেই মনে মনে কথা বলে। ওর এটা ক্রমে স্বভাব জন্মে গেছে। তখনই তার মাইজলা বিবির জন্য মনটা টনটন করতে থাকে।—আমার আছেড়া কি আল্লা! সে এক হাত উপরে তুলে নসিবের কথা আল্লাকে জানাতে চাইলে দেখতে পায় আকালুদ্দিন মিঞা নদীর পাড়ে হাইটা যায়। মিঞা যাবে বক্তৃতা দিতে। পরাপরদির হাটে লীগের সভা—সকাল সকাল দলবল নিয়ে চলে যাবে। এখন গাঁয়ে গাঁয়ে সে চাষী মানুষ যোগাড় করতে যাচ্ছে। তারও ইচ্ছা হাটে সে যাবে একবার। তার এই লীগের মিঞাদের লম্বা কথা শুনতে ভালো লাগে। গায়ে কাঁটা দেয় যখন আকালুদ্দিন বলে, দ্যাখেন মিঞারা চক্ষু তুইলা দ্যাখেন! কি আছেডা আপনেগ! খানা নাই, পিনা নাই, জানে নাই খুন, হিন্দুরা সব চুরি কইরা নিছে। তখন মনেই হয় না—অ-হালা হারামজাদা তার বিবির তালাকের জন্য বসে আছে। দশ কুড়ি টাকার লোভ দেখাচ্ছে। তালাকনামা করে দিলেই সে তার মজুরা পেয়ে যাবে। তালাকনামা পেলে বিবি মল বাজিয়ে উঠে আসবে আকালুর উঠানে।
ফেলু তখন হাসে। সেই এক নিষ্ঠুর হাসি!—আরে মিঞা, এডা কি কও! বিবির দাম মিঞা খাবলা খাবলা জমির মতন। তারে কম মূল্যে বিচা লাভডা কি কও দ্যাহি! যতদিন আছে তাইন, আমি আছি ততদিন! আমার মূল্যাডা তোমার কাছে আছে। দশ কুড়ি দশ ট্যাহা একডা ট্যাহা! টাকা পয়সা সব জলে, বিবি যদি চলে যায় তবে ফেলুর থাকে কি! আমি যে মিঞা ফেলু শেখ, আমার হাত ভাইঙা দিছে পাগল ঠাকুর। ঠাকুর তুমি আছ আর এক যণ্ড। তিন যণ্ডের মোকাবিলা করতে পারি আমি একা ফেলু! এক ষণ্ড হাজি সাহেবের খোদাই ষাঁড়, অন্য ষণ্ড মিঞা আকালুদ্দিন আর এক হাত ভেঙে দিয়ে পাগল ঠাকুর হয়ে গেছে তিন যণ্ডের এক ষণ্ড। সে ফাঁক পেলেই এখন কোরবানীর চাকুতে ধার দিচ্ছে। কার গলা ফাঁক করবে তার আল্লা জানে।
তা যা আছে কপালে! দেবে পাড়ি একদিন মুড়াপাড়া। হাতের এই বাগি বাছুর কোরবানী দিয়ে আসবে ভাঙা মসজিদের মাজারে। মুড়াপাড়ার বাবুরা সাতটা মসজিদের খরচ দেয়, কাছারিবাড়ি থেকে খরচ যায়, তবু তোমরা মিঞারা মা আনন্দময়ীর পাশে যে ভাঙা এক মসজিদ আছে, বন-জঙ্গল আছে, সেখানে নামাজ পড়তে পাবে না। মিঞা আকালুদ্দিন এই নিয়ে এ অঞ্চলে বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছে। মৌলবীসাব যার মুড়াপাড়ার বাজারে সূতার কারবার আছে সে এসেছিল একবার, সে এসে বলে গেছে, আল্লার দুনিয়ায় কাফের থাকুক, আল্লা তা চান না! বিধর্মী নিধন হউক। ইনসা আল্লা—পরবে পরবে, জিগির দ্যাও, দেশ চাই পাকিস্তান। হিন্দুর দেবী দুই ঠ্যাঙ ফাঁক কইরা কি যে কাণ্ড একখানা – সোনার মুণ্ডমালা গলায় ট্যারচা চোখে চাইয়া থাকে। পারেন না মিঞা কোরবানী দিতে আল্লার নামে নিজের জান? নামাজ পড়তে পারেন না মিঞা ভাঙা মসজিদে? আপনারা যদি আল্লার দরবারে জেরার মুখে পড়েন, কি জবাবড়া দিবেন কন দিহি। আপনেরা আবার কন আল্লার বান্দা।
ফেলু মনে মনে কবুল করল, সত্যি আল্লার এই নামে তবে কাম কি! তা তুমি মিঞা আকালুদ্দিন এত কথা কও, মঞ্চে উইঠা নাচন কোদন কর, তুমি মিঞা তবে জিগির দ্যাও না ধর্মযুদ্ধের—কে আছরে মিঞা, কোন গাঁয়ে কারা আছে, আল্লার বান্দা দুনিয়ায় আইসা তবে কামডা কি, চল যুদ্ধে, ধর্মযুদ্ধে, হাতে বল্লম সড়কি, বাঁশের লাঠি এবং তোমার যা আছে। যদি না থাকে তবে সুপারির শলা। দ্যাও ইবারে আল্লা-হু-আকবর বলে ধ্বনি একখানা!
কিন্তু তখনই মনে হল ধ্বনি উঠছে ঠাকুরবাড়ি। সবাই মিলে ধ্বনি দিচ্ছে—বন্দেমাতরম্! কী কারণ এ-ধ্বনির! কারণ সন্তোষ দারোগা ছোট ঠাকুরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এসেছিল রঞ্জিতকে ধরতে, কিন্তু তাকে পেল না। নিজ বলে দারোগা সাহেব সমন খাড়া করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ছোট ঠাকুরকে। শশীভূষণ ধ্বনি দিচ্ছে, বন্দেমাতরম্। ধ্বনি দিচ্ছে, শচীন্দ্রনাথ কি জয়! ধ্বনি দিচ্ছে ভারতমাতা কি জয়! দেশের কাজে মানুষ জেলে যায়। ফেলু দুবার জেল খেটেছে। খুনের দায়ে জেল খেটেছে। আর শচী ঠাকুর খাটবে স্বদেশীর জন্য। সেও একবার এ-ভাবে জেলে যেতে চায়। ওদের দেখাদেখি সেও মাঠের এ-পাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, আল্লা-হু-আকবর। হিন্দুরা কিছুতেই ওদের জন্য দেশটা আলাদা করে দিচ্ছে না। পায়ের তলায় রেখে কেবল মজা দেখতে চায়। হালার হালা কাওয়া। হালার হালা কাফের।
কিন্তু ফেলুর হাঁক এত আস্তে হল যে সে নিজেই শুনতে পেল না। তবে কি ওর গলা বসে গেছে। গতকাল সে চিল্লাচিল্লি করেছে বিবির সঙ্গে। বিবি তার দুই কাঠা ধান এনেছে। ধান এনেছে গতর খেটে সে একবার বিল থেকে বড় মাছ ধরে এনেছিল—কারণ বিবি তার সব পারে, সব চুরি করে আনতে পারে, এই চুরি করার নামে বিবি তার মাঠে যায়—আর কতদিন পাহারা দিয়ে রাখবে! মাঝে মাঝে তার মনে হয়, বিবির খাইস মিটে না, পাল খাওয়া গরুর মতো লাফায়, চোখ সাদা করে রাখে। তখন ওর ইচ্ছা হয় মাজায় একটা দুম করে লাথি মারে। লাথি মারলেই পাল থেকে যাবে, থেকে গেলেই গরু তার গাভিন, আর লাফাতে পারবে না। এতে আর শরীরে মোহব্বত থাকবে না। চোখ মুখ সাদা ফ্যাকাসে-আন্নু একটা উরাট জমির মতো খালি পড়ে থাকবে। আবাদ করতে কেউ আসবে না।
তখন হালার বাছুর একেবারে উঠানে। বাছুরটার পিছনে ফেলু ঠিক ছুটে আসবে। গালে মুখে আনুর আতরের গন্ধ। সে তাড়াতাড়ি বাছুর উঠানে দেখে মুখ ধুয়ে ফেলল। কিন্তু পিঠে, ঘাড়ে গন্ধটা লেগে আছে। ফেলু কাছে এলেই টের পাবে। বাছুরটা যত নষ্টের গোড়া। সে ভাবল উঠানে নেমে ফেলু উঠে আসতে না আসতে আবার মাঠে তাড়িয়ে দেবে কি-না। এখন বাছুরটা না এলে মানুষটা আসত দুপুরে। যখন মাথার উপর সূর্য তখন ফেলু উঠে আসে। ঘাড়ে গলায় সামান্য পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ মেখে রাখল আন্নু। ফেলু যেন টের না পায় আকালু বিবিকে ভোগ করে গেছে।
এখন আন্নু তাড়াতাড়ি কী যে করে। আর তখনই হিন্দুপাড়াতে আবার সেই ধ্বনি। সে যেন অনেকদিন পর এমন ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। সে এতক্ষণ আকালুর সঙ্গে ঝোপে-জঙ্গলে পীরিত করছিল বলে খেয়াল করেনি। কিন্তু আকালু চলে যেতেই একে একে হুঁশ ফিরে আসার মতো সে শুনতে পাচ্ছে—হিন্দুপাড়াতে জয়ধ্বনি উঠছে। দলে দলে লোক যাচ্ছে হিন্দুপাড়ার দিকে। সে ঈশম এবং মনজুরকে চিনতে পারছে। মনে হল ছোট ঠাকুরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কারা। পুলিশের লোক! ওর বুকটা ধড়াস করে উঠল। ফেলুটা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। ওর য্যান পরাণে ভয়ডর নাই। ছোট ঠাকুর মাঝখানে। সামনে পিছনে পুলিশ। সোনা, লালটু, পলটু অর্জুনগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পাগল মানুষ তরমুজের জমিতে দাঁড়িয়ে আছেন। নরেন দাস আভারানী মাঠে এসে নেমেছে। গৌর সরকার, বেনেপাড়ার সব লোক নেমে এসেছে।
একটা ফড়িঙ এ-সময় আন্নুর মাথার উপর এসে বসল। সে ফড়িঙটা উড়িয়ে দেবার সময় দেখল, ফেলু উঠে আসছে। একেবারে কাছে এসে গেছে। এবার সে আতরের গন্ধ পেয়ে যাবে। মনেই নেই গায়ে পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ মেখে বসে আছে! কী করে! কী করে! সামনে ছিল হাজিদের পুকুর। সে পুকুরে ঝাঁপ দিল এবং জলে ডুবে গেল। ফড়িঙটা আন্নুর মাথার ওপর বসার জন্য জল পর্যন্ত উড়ে এসেছিল, জলের উপর ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল। কিন্তু আন্নু জলের নিচে ডুবে গেলে কোথায় পাবে তারে! ফড়িঙটা আন্নুকে খুঁজে পেল না বলে আবার মাঠে উড়ে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফেলু পাড়ে দাঁড়িয়ে ফড়িঙের মজা দেখবে না বিবিকে ডাকবে—কী যে করবে ভেবে পেল না। এতটা হাবা মানুষের মতো পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে বিবি কখন জল থেকে ভেসে উঠবে সে আশায় দাঁড়িয়ে থাকল ফেলু।
হঠাৎ আন্নু মাঝপুকুরে একটা চিতল মাছের মতো ভেসে উঠল।
ফেলু হাঁকল, আমার বিবি রে!
বিবি ফের ডুব দিল জলে।
—বিবি রে, পানির নিচে তর কি হারাইছে?
জলের নিচ থেকে তখন বুড়বুড়ি উঠছে।
পানির নিচে কার কী যে হারায়। আন্নু ডুবসাঁতারে এখন পুকুর পার হয়ে যাচ্ছে। ফেলু বিবির ডুবসাঁতার দেখছে। ওর জলের উপর ভেসে ওঠা দেখছে। আন্নুর শরীর জলে ভিজে থাকলে ফেলুর বড় কষ্ট হয়। টানা টানা চোখ। বোরখার অন্তরালে সে এমন খুবসুরত বিবিকে রাখতে পারল না। ওর হাত না ভাঙলে বিবির কপালে কত সুখ ছিল। সে বিবির জন্য বাবুরহাটের শাড়ি কিনে আনতে পারত এবং একটা ময়না পাখি কিনে দিতে পারত। পায়ে মল, হাতে বাজু এবং কপালে টিকলি আর গলায় বিছা হার কোমরে রুপোর পইছি রোদে চকচক করত। এমন পুষ্ট শরীরে এসব থাকলে বিবি তার বেগম বনে যেত। হায়, তার নসিবে এত দুঃখ। সে বলল, হালার কাওয়া! হালার পাগল ঠাকুর।
হুঁপ! আবার চিতল মাছটা জলে শরীর ভাসিয়ে দিল। এবং পাখনা খেলিয়ে, চিৎ হয়ে অথবা কাত হয়ে সাঁতার কাটলে আন্নু য্যান এক রূপালী মাছ! এই পুকুরের জলে একটা রূপালী-মোহ চোখের সামনে নাচছে। ওরও সাঁতার কাটতে ইচ্ছা হচ্ছে, জলের নিচে মাছ হয়ে আন্নুকে ছুঁতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু সে পারছে না। তার হাত ভাঙা। হালার কাওয়া। সে ডাকল, আন্নু তুই উঠ দিনি। বাছুরটা ছুইটা গ্যাছে। ধরতে পারতেছি না।
আর কোনও কোনও দিন যখন সাঁজ নামে, যখন কুয়াশায় এই অঞ্চল ঢেকে যায়, যখন শীতের ঠাণ্ডায় পুকুরের মাছ, বিলের মাছ, নদীনালার মাছ এবং জলের তাবৎ জীব চুপ হয়ে থাকে তখন আন্নু যায় চুপি চুপি, পিছনে যায় ফেলু। সামনে শুধু মাঠ, মাঠে নাড়া এবং সর্ষে ফুল থাকে। সর্ষে ফুল, বোঝা বোঝা নাড়া এবং ধনেপাতা—এইসব মাঠময় পড়ে থাকলে বিবি তার সে রাতে চুপি চুপি সব তুলে আনে। এমনভাবে আনে যেন সে বেছে আনছে। এক জায়গা থেকে সব তুলে নেয় না। ফাঁকে ফাঁকে তুলে আনে। জমি যার, সে আলে দাঁড়ালে টেরই পাবে না ফাঁকে ফাঁকে কেউ ফসল চুরি করে নিয়ে গেছে।
অথচ এই অসময়ে জলে সাঁতার আন্নুর—ফেলুর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। বাছুরটা যণ্ড দেখে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। কার জমিতে গিয়ে মুখ দেবে এখন কে জানে। একমাত্র আন্নু সম্বল। সে বাছুরটা ধরে আনতে পারে। আর বাছুর যখন মাঠের উপর দিয়ে দৌড়ায়, পিছনে আন্নু কাপড় সামলাতে পারে না- বলিহারি যাই, আন্নু একেবারে তখন বনদেবী। সে হাঁকল, হালার কাওয়া। তর গরম বাইর কইরা দিমু।
আন্নু যেন টের পেল জলের নিচে, ফেলু হাঁকপাঁক করছে পাড়ে। সে উঠে বলল, কোনখানে?
ফেলু হাত তুলে দিলে আন্নু ছুটল। বাছুরটা অনেক দূরে। আন্নু দ্রুত ছুটছে। ভিজে কাপড়ে ছুটছে। চুল ভিজা, কাপড় ভিজা, সব লেপ্টে আছে গায়ে। শাড়িটা হাঁটুর ওপর উঠে গেছে—সামনে সেই এক ধানের মাঠ, আন্নু ছুটছে সেই মাঠের উপর দিয়ে। বিবিকে দেখে বাছুরটাও ছুটছে আর দূরে ছুটছে আকালুদ্দিন। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। নামাজের আগে পরাপরদির মসজিদে পৌঁছাতে হবে। নামাজ শেষে সে তার সব জাত-ভাইদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলবে, আল্লা-হু-আকবর।
কিছুদিন আগে এই দেশে ছোট ঠাকুর বড় এক সভা করেছিলেন। নেতা মানুষটির মাথায় গান্ধী টুপি। কালো বেঁটে মানুষ। আগুনের মতো তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তিনি এমন সব কথা বলছিলেন যে ক্ষণে ক্ষণে হাততালি পড়েছে। বক্তৃতার শেষে নেতা মানুষটি বললেন, আমরা এক অখণ্ড দেশ চাই। সে দেশের নাম ভারতবর্ষ। এক দেশ, এক জাতি, হিন্দু-মুসলমানের এক পরিচয়, আমরা ভারতবাসী। আকালুদ্দিন গিয়েছিল সভাতে। কত লোক! কী আগুন বক্তৃতায়! সে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনতে শুনতে মনে মনে হেসেছিল—এক জাতি, এক পরিচয়—আমরা ভারতবাসী।
আর তখন ঈশম গোপাট পর্যন্ত নেমে এল। কারণ সে বেশীদূর যেতে পারছে না। সে গেলে বাড়িঘর কে দেখাশুনা করবে। পাওনাগণ্ডা কে বুঝে নেবে। সে না থাকলে, এই যে এক পরিবার থাকল, পাগল মানুষ থাকলেন, এবং বুড়ো মানুষটি—যিনি যে-কোনওদিন আপন নিবাস থেকে ঈশ্বরের নিবাসে গমন করতে পারেন, তাঁদের এখন দেখেশুনে রাখার সব দায় এই মানুষের। সোনা, লালটু, পলটু অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বড়বৌ ধনবৌ পুবের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। শশীমাস্টার অর্জুন গাছটার নিচে ওদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এবং নানারকম বোঝ প্রবোধ দিচ্ছেন—দূর বোকা, কাঁদে নাকি! কত বড় সম্মান। দেশের কাজ করছে বলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ স্বাধীন হবে। আমদের কোনও দুঃখ থাকবে না। কত সম্পদ আমদের। সব ইংরেজরা এখন সাগরপারে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদের তাড়িয়ে দিলে কোনও মানুষ না খেয়ে থাকবে না। দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যাবে না। আমাদের দেশ কত বড়, আর কী মহান এই দেশ। আমরা এই মহান দেশের মানুষ। আমাদের গর্বের শেষ নেই।
সোনা শশীমাস্টারের এমন সব কথা শুনে কান্না থামিয়ে দিল। সে চোখ মুছে বলল, কবে স্বাধীন হইব?
—তা আর দেরি নেই মনে হয়।
সোনার মনে হল স্বাধীন হলেই সব হয়ে যাবে। যেমন জালালি, যে খেতে পেত না, স্বাধীন হলে খেতে পেত। জলে ডুবে মরতে হতো না। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল জালালির জন্য। সে আর দুটো দিন দেরি করতে পারল না! স্বাধীন দেশের মানুষ সে হতে পারত। তার মনে হল এখন ঠাকুরদাও একদিন মরে যাবেন। তিনি স্বাধীন হবার আগে মরবেন, না পরে মরবেন, পরে মরলে সে একদিন ঠাকুরদাকে তরমুজ খেত পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে। বলবে, ঠাকুরদা আপনি তো সারা জীবন পরাধীন দেশের উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন, এবার স্বাধীন দেশের মাটির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আপনার ভালো লাগছে না! বাতাসটা পাতালা মনে হচ্ছে না! বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছেন না! মনে হচ্ছে না এবার আপনি আরও বেশীদিন বাঁচবেন!
ঠাকুরদা নিশ্চয়ই সোনার মাথায় হাত রেখে বলবেন তখন, তোরা কত ভাগ্যবান। তোরা স্বাধীন দেশের মানুষ। কত সংগ্রামের পর এ স্বাধীনতা, জালিয়ানওয়ালাবাগ, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, দেশবন্ধু ওদের কথা সব সময় মনে রাখবি। ওদের জন্য এই স্বাধীনতা। ওদের ভুলে যাবি না। তোরা কতকাল বাঁচবি রে! আহা স্বাধীন, স্বাধীনতা এই শব্দ কি এক আশ্চর্য সুষমামণ্ডিত কথা! সোনার চোখ বুজে আসছিল।
তখন শশীমাস্টার দেখলেন, ধানের জমির উপর দিয়ে এক যুবতী মেয়ে ছুটছে। কে যায়! ওঃ, সেই ফেলুর ডানাকাটা পরী যায়। কার গলা হ্যাত করে কেটে ধরে আনা বিবি। বাছুরটাকে ধরে ফেলেছে। ফেলু দাঁড়িয়ে আছে জালালির কবরের পাশে। কবরের সাদা কাশফুল দুলছে বাতাসে। কবরটার উপর সবুজ ঘাস। বৃষ্টিতে বর্ষায় কবরটা আর কবর নেই। মসৃণ মাঠ হয়ে গেছে। সেখানে আবার নতুন জীবনের উন্মেষ হচ্ছে।
আকালুদ্দিনের পরাপরদি পৌঁছাতে বেলা হয়ে গেছে। সে ফজরের নামাজে হাজির হতে পারেনি। জোহরের নামাজ সে সকলের সঙ্গে পড়তে পারবে। দূর দেশ থেকে লীগের নোতারা এসেছে। মসজিদের পাশে মাদ্রাসা। মাদ্রাসার সামনে বড় মাঠ, মাঠে শামিয়ানা টাঙানো। নিশান উড়ছে। সেই কবে একবার তার গাঁয়ের পাশে সামুভাই জাল্সা করেছিল, শিন্নির জন্য তামার বড় ডেগ, আর তখন মুড়াপাড়ার হাতি এসে সব তছনছ করে দিয়েছিল—জাল্সা হতে পারেনি, কিন্তু এখানে কার হিম্মৎ আছে জাল্সা ভেঙে দেয়। সাহাদের ঘাট নদীর অপর পাড়ে— নদীর নাম ব্রহ্মপুত্র, তার পাশে পুরানো ভাঙা সব বাড়ি, এক সময় এ-গঞ্জের মতো জায়গায় সাহাদের প্রতিপত্তি ছিল কত! এখন সাহারা নারায়ণগঞ্জে তেজারতির কারবার করে বড় ব্যবসা ফেঁদেছে। গাঁয়ের পুরানো ভাঙা বাড়ি ফেলে চলে গেছে তারা। বড় বড় অশ্বত্থ গাছ জন্মেছে পাঁচিলে। আর শুধু চারপাশে মুসলমান গ্রাম এবং নদী পার হলে এই মাদ্রাসা মৌলানাসাবের প্রাণ। এখানে কলকাতা থেকে জনাব আলি সাহেব এসেছেন। তিনি যখন বক্তৃতা করেন, কাচের গ্লাসে ফুৎ ফুৎ জল খান। আকালু ভাবল সেও জল খাবে কাচের গ্লাসে। তা’হলে গলা শুকাবে না। কারণ এইসব নামী মানুষের সঙ্গে আকালুদ্দিন আজ মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথম বক্তৃতা করবে। জল খেলে মাথায় বুদ্ধি আসে বুঝি! সামুভাইও জল খান বারে বারে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে জল খাওয়া বড় নেতার স্বভাব। সে এইসব নামী মানুষের সামনে কী আর বলবে! ভাবল, কী আর বলা যায়, শুধু প্রথমে বলা ইনসা আল্লা, তারপর কিছু হিন্দু বিদ্বেষের কথা বলে মঞ্চ থেকে নেমে পড়া
সে চারদিকে দেখল নিশান উড়ছে। কোথাও ইস্তাহারে লেখা আছে নারায়ে তকদির অথবা লাল নীল সবুজ রঙের ফেস্টুন, ধর্মাধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, হিন্দু বিধবা রমণীর মুসলমান দর্শনে ঘৃণ্য মুখ, অস্পৃশ্যতার কঠিন দৃশ্য এবং কার কত জমি, হিন্দু শতকরা কতজন, হিন্দু কত আয় করে, সেখানে অঞ্চল বিশেষে কত মুসলমান, তার আয় কত—এসব পরিসংখ্যান। সহসা দেখলে মনে হবে—শ্রেণীসংগ্রামের ডাক দিয়েছে তারা।
এবং কবে প্রথম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যাঁরা করেছন তাঁদের ছবি। বিখ্যাত সব মসজিদের ফোটো থামের লাল-নীল মোড়া কাগজের উপর সাঁটা। এবং হজে গেলে যেসব ছবি সংগ্রহ করে এনেছেন হাজিসাবেরা সেইসব ছবি ঝুলিয়ে পবিত্র ইসলামের বাণী বহন করছে এই সভা। শামিয়ানার নিচে এইসব দৃশ্যের ভিতর দিয়ে আকালুদ্দিন মোড়লের মতো হেঁটে যাচ্ছিল। সে মানীজনদের আদাব দিল। শামিয়ানার দক্ষিণ দিকে বড় বড় উনুনে তামার ডেগ। যাঁরা মানী-গুণীজন তাঁদের খাবার ব্যবস্থা। সে এখানে এসেই প্রথম খোঁজ করল সামসুদ্দিনের। সামুভাই থাকলে সে গলা ছেড়ে বলতে পারবে। সে মনে বল পাবে। সামুভাই যে কোন্ দিকে! কেউ বলল, তাইন গোসল করতে গ্যাছেন। কেউ বলল, তিনি আলি সাহেবকে নিয়ে মাঠে নেমে গেছেন। এবং এইসব গ্রামদেশের কী অসহায় দারিদ্র্য তাই দেখাতে নিয়ে গেছেন।
ওরা এবার সকলে রান্না হলেই আহার করতে বসবে। তারপর জোহরের নামাজ। নামাজে কে ইমাম হবে আজ! আকালুদ্দিনের কতকালের খোয়াব সে এমন এক বড় মাঠের জমায়েতে ইমাম হবে। সামুভাই থাকলে সে একবার মনের ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে পারত।
সে হন্যে হয়ে সামুভাইকে খুঁজছিল। আর খুঁজতে খুঁজতেই পেয়ে গেল। সামুভাই সেই লম্বা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি, মাথায় ফেজটুপি পরে মাঠ থেকে উঠে আসছে। পায়ে বুট জুতো। মোজা নেই। সঙ্গে এক দঙ্গল লোক। রোদে ওদের সকলের মুখ পুড়ে গেছে। জল তেষ্টা পেতে পারে বলে বদনা হাতে পাঁচ-সাতজন লোক সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে। ওরা এবার সকলে খেতে বসে গেল। পাটির উপর পাঁচ-সাতজন করে গোল হয়ে বসে গেল। বড় থালায় ভাত। ছ’সাতজন করে একটা থালার চারপাশে বসেছে। থালার মাঝে মঠের মতো ভাত সাজানো। কিনার থেকে যে যার মতো ভাত ভেঙে ডাল নিয়ে চেটে চেটে ভাত-ডাল-গোস্ত খাচ্ছে। সামু আকালু এক গাঁয়ের লোক। এবং যারা কাছাকাছি তারা পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। যে যার মতো একই থালায় ভাত ভেঙে মেখে খেয়ে উঠে মুখ ধুল। নদীর ঘাটে অজু করে এল। একসঙ্গে সার বেঁধে নামাজ পড়ল। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে আকালুদ্দিনের। সে ইমামের কাজ করছে। তারপর মঞ্চে উঠে যে যার মতো বলে গেল। সবাই প্রায় কথায় কথায় হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের কথা বলল। মাঠের দিকে হাত তুলে দেখাল। বলল, দু’চার বিঘা জমি বাদে, সব জমি কার?
— হিন্দুর।
—ভূমিহীন কারা?
—আমরা।
—উকিল বলুন ডাক্তার বলুন কারা?
—হিন্দুরা।
—শিক্ষা-দীক্ষা কাদের জন্য?
—হিন্দুর জন্য।
—ওদের জমিতে খাটলে আপনি খান, আপনার নাম মুসলমান এবারে হাততালি পড়ল।
সামসুদ্দিন কিন্তু খুব যুক্তি এবং তথ্যের সাহায্যে—এই যে আমরা, মুসলমানেরা আলাদা একটা দেশ চাই—তার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা রাখল। সে একটা সালের উল্লেখ করে বাংলাদেশে হকসাহেবের পরিণতির কথা বলল। হিন্দু মুসলমান একই রাষ্ট্রে একই পতাকার নিচে বসবাস করতে পারে না, তার কারণ ব্যাখ্যা করল। সে বলল, আপনেরা জানেন মিঞাভাইরা আমার দিলের চাইতে আপন পীরিতের মানুষেরা, আপনেরা জানেন, ১৯৩৭ সালের কথা। হকসাহেবের কৃষক প্রজা দল যেহেতু মুসলিম প্রধান দল,তাকে নিয়ে কংগ্রেস যৌথ সরকার গঠন করলেন না। আপনেরা জানেন, উত্তরপ্রদেশের মুসলিম লীগ দাবি করেছিল যৌথ সরকারের-নেহেরুজী তা বানচাল করে দিলেন। আপনেরা জানেন, হকসাহেবের দল কোন সাম্প্রদায়িক দল নয়, সাধারণ মেহনতী মানুষ নিয়ে এই দল, কৃষক প্রজা নিয়ে এই আন্দোলন, অথচ হিন্দুদের এমন মুসলিম বিদ্বেষ যে, তাঁরা কিছুতেই যৌথ সরকার গঠন করলেন না। বরং কংগ্রেস হকসাহেবের সব প্রগতিশীল কাজের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকল। হকসাহেব তখন বুঝতে পারলেন তাঁর তখৎ-ই-তাউস পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গায় ভেঙ্গে পড়েছে। বলে সামসুদ্দিন একটু থামল। এক গ্লাস জল খেল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কেমন ভিড় হয়েছে। তারপর ফের বলতে থাকল, আপনাদের কাছে আমি এখন পীরপুরের রিপোর্ট তুলে ধরব। কী প্রকট এই মুসলিম বিদ্বেষ! কী অমানুষিক অত্যাচার! তাজা খুনের হোলি খেলেছে তারা। আপনার আমার খুনে ওরা গোসল করেছে। সে এসব বলে আবার জল খাবার সময় কী যেন এক ছবি, ছবিতে মালতীর মুখ, সেই করুণ মুখ, তুই সামু এডা কি কস, সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন গলা শুকিয়ে গেল। কোনওরকমে তারপর বলল, আপনাদের ভিন্ন দেশ বাদে গতি নাই। সে নিজেকে বলল, হে আল্লা, এ ছাড়া এ-জাতির উদ্ধার নাই।
কী ভাবল সামান্য সময় ফের সামু। এমন ভিড়ে সে যে কেন বার বার সেই করুণ মুখ দেখতে পাচ্ছে বুঝতে পারছে না। যেন কেবল বর্ষায় মালতী তার হারানো হাঁসটা খুঁজছে। এবং সে মালতীকে নিয়ে ধানখেতের আলে আলে লগি বাইছে। মালতীর হাঁসটা খুঁজে পেলেই সে তাকে দিয়ে আসবে বাড়িতে।
এসব সাময়িক দুর্বলতা। এতগুলি মানুষ তার মুখ থেকে আরও কী শুনতে চাইছে। সে এত কম বললে নিজের জাতির প্রতি বেইমানী করবে। সে গলা সাফ করে বলল, উত্তরপ্রদেশের খালিকুজ্জমান সাহেবের কী অনুনয় বিনয়, আমাদের সরকার পরিচালনায় সামান্য স্থান দিন। কে কার কথা শোনে। বল্লভভাই প্যাটেল সব অনুনয় যমুনার জলে ভাসিয়ে দিলেন! সে এবার ঘড়ি দেখল। পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে সময় দেখে বলল, আমার পরবর্তী বক্তা আছেন। তাঁরাও তাঁদের বক্তব্য রাখবেন, আপনাদের কাছে। কেবল মেহেরবানী করে আপনারা যাবার আগে মোতাহার সাহেবের কাছ থেকে একটা করে বই নিয়ে যাবেন। তারপর সাঁজে যখন আজান শুনতে পাবেন, কুপির আলোতে পড়বেন এই রিপোর্ট। মুসলিম নিপীড়নের খুঁটিনাটি তথ্য পড়লে আপনাদের খুন টগবগ করে ফুটবে। সে বড় সহজ ভঙ্গিতে কথাগুলি বলল এবং হাতটা মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিল।
আকালুদ্দিন বড় নিবিষ্ট মনে শুনছে এবং সামুর অবয়বে কী কী রেখা ফুটে উঠছে সে লক্ষ রাখছে। সেও এমনভাবে মুখের রেখার দ্বারা তার ক্রোধ উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা সকলের ভিতর ছড়িয়ে দেবে। শেষে সামু যেভাবে কথা শেষ করে হাত ঘুরিয়ে এনেছে দৃপ্ত ভঙ্গিতে, সেও অন্যমনস্কভাবে নকল করতে গিয়ে কেমন সকলের কাছে ধরা পড়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি বক্তৃতা শেষ হতেই সহসা হেঁকে উঠল, আল্লা-হু-আকবর।
জনাব আলি সাহেব বললেন, দেশটা ইংরেজরা আমাদের হাত থেকে নিয়েছিল। আশা করব যাবার সময় ইংরেজ শাসনভার আমাদের হাতে দিয়ে যাবেন। গোলামের জাত দেশ শাসনের বোঝে কি!
সবাই হাততালি দিচ্ছে একসঙ্গে।
বড় মজার কথা বলেছেন সাহেব। ওরা খুব খুশি এমন কথায়।
বিকেলবেলা আকালু মসজিদের নিচু জমিটাতে দাঁড়িয়েছিল। ক্রমে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। এক এক করে এবার বিদায় নিচ্ছে সবাই। গয়না নৌকায় আজই সামুভাই নারায়ণগঞ্জে যাবে। কাল ঢাকা চলে যাবে। সে একটু সুবিধা মতো সামসুদ্দিনকে একা পাবার ইচ্ছাতে আছে। আলি সাহেব দু’দিন থাকবেন মৌলানাসাবের বাড়িতে। এখন সবাই চলে গেলে কেবল থাকে সামুভাই। সামুর অঞ্চল এটা। সে-ই সবাইকে বিদায় দিচ্ছে। বিদায় দিয়ে সামু এদিকে উঠে আসছে। দু’জন লোক পিছনে। ওরা সামসুদ্দিনকে শামিয়ানার নিচে পৌঁছে দিয়ে চলে যাচ্ছে। এ-ই সময়। সে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বলল, দ্যাশে যখন আইলেন, বাড়ি একবার ঘুইরা যাইবেন না?
—সময় খুব কম। কাইল আবার বন্দরে সভা আছে।
আকালু এবার সামুকে চুপি চুপি বলল, ছোট ঠাকুরকে ধইরা নিয়া গ্যাছে।
কেমন বিস্ময়ের গলায় বলল, ছোটকর্তারে!
—হা ছোটকর্তারে।
—কবে?
—আইজ। আইছিল ধরতে রঞ্জিতরে। পাইল না। ধইরা নিয়া গেল ছোটকর্তারে।
—রঞ্জিত কই গ্যাছে?
—রঞ্জিত মালতীরে নিয়া পালাইছে।
সামসুদ্দিনের মুখটা বিষণ্ন দেখাচ্ছে। সে আর কিছু বলতে পারল না।
আকালু কত কাজের, লীগেব জন্য সে কতটা জীবন পাত করেছে এমন দেখানোর জন্য বলল, দিলাম খবর থানায়। কইলাম, একজন রাজনৈতিক কর্মী আত্মগোপন কইরা আছে।
—তর কী দরকার ছিল আকালু। তুই এমন করতে গেলি ক্যান?
—কাফের যত বিনষ্ট হয় তত ভাল না?
—না।
এমন চোখমুখ দেখবে সামসুদ্দিনের, সে আশাই করতে পারেনি। সামু আবার চুপ হয়ে গেল। শামিয়ানার নিচে হ্যাজাকের আলো। সে এক দরগার যুবক, অথবা এক ফকির যায়, তার হাতে লণ্ঠন, কতদূর যে সে এভাবে যাবে কেউ যেন বলতে পারে না। সামু শেষে বলল, আর কিছু কইবি?
সে কেমন থতমত খেয়ে গেল। সে আরও যা বলবে ভেবেছিল সামসুদ্দিনের মুখ দেখে সেসব ভুলে গেল।
পীরের মাজারে জোটন তখন সব করবী ফুল পরিষ্কার করছে। সে সাঁজ লাগলেই মোমবাতি জ্বালায়। এবং মাজারের ওপর গত সন্ধ্যা থেকে যেসব ফুল ঝরে পড়েছে সেসব ফেলে দিচ্ছে। তকতকে মাজার চারপাশে সবুজ ঘাস। নিচে ফকিরসাব শুয়ে আছেন। আর উপরে এই করবী ফুলের গাছ। নিশিদিন ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে। সে মোমবাতি জ্বালিয়ে তার ঘরটার দিকে উঠে যাবে এবার। এখনও ভালো করে অন্ধকার হয়নি। কিসের শব্দে সে শরবনের দিকে তাকাতেই দেখল, বাতাসে শরবন কাঁপছে। এবং শরবন ফাঁক করে কেউ এদিকে উঠে আসছে।
এই অসময়ে মানুষ! এক মিঞা মানুষ। কিন্তু একি! পিছনে বোরখা পরে এক বিবি। এমন একটা অঞ্চলে এক মিঞা বিবি! সে কেমন বিস্মিত চোখে মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছে।
রঞ্জিত কাছে গেলেও জোটন কোনও কথা বলতে পারল না। অপরিচিত মানুষজন আসে, সকালের দিকে আসে, পীরের মাজারে বাতাসা অথবা ফুল দিয়ে যায় কেউ। কেউ আসে জড়িবুটি নিতে। সন্তান-সন্ততি না হলে কেউ আসে। আর আসে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগলে। কেউ তার গাছের প্রথম লাউ, কুমড়ো মাজারে দিতে আসে। ফকিরসাবের সব জড়িবুটির গুণাগুণ জোটন জেনে নিয়েছে। এই করেই জোটনের সংসার। সেও ক্রমে এই অঞ্চলের পীরানি হয়ে যাচ্ছে। এমন একটা বিবর্জিত জায়গায় থাকলেই সে আর মানুষ থাকতে পারে না, জীন পরী হয়ে যেতে পারে অথবা পীর পয়গম্বর। ফলে জোটনের কিছু জমি হয়েছে। কেউ ফসল দিয়ে যায়। কেউ মুরগি দিয়ে যায়। মুরগি বেচে, ফসল বেচে তেল নুন নিয়ে আসে তিন ক্রোশ দূর থেকে। এক হাট আছে। হাটবারে এই দরগা ভেঙে মাইলখানেক হেঁটে গেলে হাটের পথ, হাটের মানুষেরা সে পথে যায়। যারা যায় তাদের হাতে সে মুরগি দিয়ে দেয়, ফসল দিয়ে দেয়। ওরা এসব বিক্রি করে তেল নুন ডাল এসব দিয়ে যায়। আজ হাটবার নয়। সে কাউকে মুরগি দেয়নি। যে, বেচে তাকে তেল নুন দিয়ে যাবে। এই সূর্যাস্তের সময় কেউ এমন নেই এ অঞ্চলে বিবি নিয়ে এখানে চলে আসে। সুতরাং জোটন কী যে বলবে এই অপরিচিত মিঞাসাবকে বুঝতে পারল না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
রঞ্জিত দাড়ি-গোঁফ তুলে বলল, আমাকে চিনতে পারছিস না জোটন!
চিনতে পারছে না জোটন। যে মানুষ খুদকুঁড়া পেলেই কী খুশি, সে যে এখন পীরানি তা রঞ্জিত জানবে কী করে! কেবল জোটন বুঝতে পারল, এই মানুষ এসেছে তার বাপের দেশ থেকে। নতুবা তার নাম ধরে কে ডাকতে সাহস পাবে! বোরখার নিচে বিবি মুখ লুকিয়ে রেখেছে। বয়সে কত ছোট এই মানুষ, তার হাঁটুর সমান বয়সী! সে বলল, কোন গাঁ তোমার?
আমি রঞ্জিত! গ্রাম রাইনাদী।
—আপনে রঞ্জিত ঠাকুর। অমা, এডা কি কয় তাইন! বোরখার নিচে কারে আনছেন? আপনে কত বড় হইয়া গ্যাছেন।
—মালতীরে।
—আরে এডা কি কন! মালতীরে! কই দ্যাখি!
মালতী বোরখা খুলে ফেলল।
জোটন মালতীর মুখচোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল। কী শীর্ণ চেহারা! চোখ কোটরাগত। কঙ্কালসার! কী যুবতী কী হয়ে গেছে! জোটন বলল, ভিতরে আয় মালতী। কর্তা, আসেন।
রঞ্জিত কি বলতে গেলে জোটন বাধা দিল। বলল, ব্যাখ্যা লাগব না। পীরের থানে যখন আইসা পড়ছেন আর ডর নাই।
এই জোটন, নিবাসী এই বনে, এবং বনের ভিতর এক রহস্য আছে। সেই রহস্যে সে ডুবে গেছে। এই দরগার ঝোপ-জঙ্গল, কড়ুই গাছ, রসুন গোটার গাছ ফেলে সে আর এখন কোথাও যেতে চায় না। বনবাদাড়ে অন্ধকারে একটা করবী গাছের নিচে কবরের পাশে বসে থাকলে মনেই হয় না মাটি কার? মাটি হিন্দু না মুসলমানের? সে এতদিন পর দু’জন বাপের দেশের মানুষ দেখে খুশিতে ঝলমল করে উঠল, বলল, অ পীরসাহেব, দ্যাখেন আপনার দরগায় কেডা আইছে! বলে সে দুই অতিথি নিয়ে হাঁটতে থাকল।