মনসুর
বিলকিসের গলায় নিষ্কম্প ঋজু উচ্চারণ শুনে সিরাজ ভীত হয়ে পড়ে।
যাবে কি যাবে না?
এ একেবারে অসম্ভব কথা আপা।
তুমি না যাও, আমি একাই যাব।
সিরাজ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আমার কথা নয়। আমার জন্যে বলছি না। যাওয়াই সম্ভব হবে না। খোলা জায়গা। বিহারীদের চোখে পড়ে যাবেন।
তাই বলে, আমার মায়ের পেটের ভাই, তার দাফন হবে না, আমি চুপ করে থাকব?
আপনি শুধু শুধু পাগলামি করছেন।
আমি যাব, সিরাজ।
ওরা দেখামাত্র গুলি করে। করুক।
আমার লাশও পড়ে থাকবে।
এতক্ষণ যে বিলকিসকে সিরাজ জানত, এখন অন্য কেউ মনে হয়। এমন কেউ যে একটা প্রবল ঝড়ের ভেতর স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
সিরাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করে। সন্ধের সময় বিলকিসকে রেখে যখন খবর নিতে বেরিয়েছিল, তখন কেবল আলেফ মোক্তার নয়, মিষ্টি দোকমানের মকবুলদার কাছেও শুনেছিল, লাশ যেখানে আছে সেখানে পড়ে থাকবে, কেউ ছোঁয়া দূরে থাক, কাছে গেলে পর্যন্ত গুলি করা হবে। কৌশলটা আতঙ্ক সৃষ্টি করবার জন্যে, না লাশের নিকটজন কারা আসে তাদের ধরবার জন্য, স্পষ্ট নয়।
তোমার যদি ভয় করে, সিরাজ তুমি না হয় থাক, আমি একাই যাব। ঢাকা থেকে ভাইয়ের মরবার খবর শোনার জন্য যদি এসে থাকি তো তার মরা মুখও আমি দেখে যাব, নিজের হাতে মাটি দেব।
বেশ দেবেন। আপনার ভয় না করলে আমার কী? কথাটা বেপরোয়া শোনাতে পারত। শোনাল কিন্তু অভিমানকম্পিত।
বিলকিস তার হাত ধরে জলচৌকির ওপর বসায়। তারপর বলে, মোক্তার সাহেব কী করছেন, দেখা দরকার।
উঠে ভেতরে যায় সে।
কাটা একটা গাছের মতো পড়ে আছেন তিনি। মুখের ওপর ঝাঁকে দেখে, ঘুমিয়ে গেছেন। মরে যান নি তো? বুকের পরে আলতো করে হাত রাখে বিলকিস। খুব ধীরে শ্বাস বইছে। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন বিক্ষোভ অত্যন্ত নিচু পর্দায় চলছে। তাঁর মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সে। বাবার কথা মুহূর্তের জন্যে মনের ভেতরে নড়ে ওঠে। আবার শান্ত হয়ে যায়।
বিলকিস বাইরে এসে সিরাজের পাশে বসে।
কখন বেরুলে ভালো?
আরো কিছু পরে। দুপুররাতের দিকে।
তখন ওরা টহল দেয় না? রাতদুপুরের পরে বড় একটা না। বিহারী হোক, আর মিলিটারির যত চেলাই হোক, ওদেরও তো ভয় আছে।
কীসের ভয়?
বারে, দেখছেন না চোখের সামনে পুলে ডিনামাইট মেরে গেল? রাতেই ওরা আসে। অন্ধকারের সঙ্গে মিশে থাকে। ছায়ার মতো চলাফেরা করে। হামলা করে কোথায় মিশে যায়। কেউ বলতে পারে না।
খোদ ঢাকাতেই তার প্রমাণ পেয়েছে বিলকিস। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে খবরে শুনেছে।
সিরাজ বলে, সেই রাগেই তো আজ এতগুলো খুন করল। এর প্রতিশোধ দেখবেন ওরা নেবে।
ছেলেটির ভয় অনেকটা কমে গেছে। তার কথা শুনলে মনে হয়, পারলে সে এক্ষুণি প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিলকিস বলে, আচ্ছা সিরাজ, একটা কথার উত্তর দেবে? এত ঝুঁকি নিয়ে আমার সঙ্গে জুটে গেলে কেন? আমি সত্যি চাই না, আমার জন্যে তোমার কোনো বিপদ হোক। অনেক করেছ তুমি।
বিলকিস সমোহে তার হাতে কয়েকবার চাপড় দেয়। আসলে সে বুঝে দেখতে চায়, কাঁচা বয়সে মেয়েদের জন্য মোহ থেকেই সিরাজ এত বড় ঝুঁকি নিতে চাইছে কিনা। তা যদি হয় তার উচিত হবে না। তাকে প্রশ্ৰয় দেয়া।
বল। সেই নবগ্রাম থেকে এতদূর এলে, এত ঝুঁকি নিলে কেন? খোকার মতো তুমিও যদি ধরা পড়তে? তোমাকেও যদি মেরে ফেলত?
সিরাজ চুপ করে ভাবে। ক্রমশ মাথাটা তার বন্ধুকে আসে সমুখের দিকে। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ মাথা তুলে বলে, হাঁ, ধরা পড়তে পারতাম।
তবু এলে কেন?
আমি যে কাজ করছি।
তার মানে?
কাজ করছি।
সিরাজ অপ্রস্তুতভাবে একটুখানি হাসে। তারপর গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, বাবা-মা-বোন সবাই চলে যাবার পর, আপনাকে বলেছি তো, ইন্ডিয়ায় চলে যেতে চেয়েছিলাম। সাহস হয় নি। কয়েক সপ্তাহ পালিয়ে বেড়িয়েছি। একদিন কী একটা সোর উঠল, রাতদুপুরে উঠে পালাতে হলো। জানেন দিদি, এমন জায়গা দিয়ে ঘোর অন্ধকারের ভেতরে আমাকে পালাতে হয়েছিল, যেখানে গোক্ষুর সাপের আস্তানা! সবাই জানে। দিনের বেলাতেই আমরা কেউ ওদিকের ধারে কাছে যেতাম না। সেখান দিয়েই আমাকে পালাতে হয়, আপা।
সিরাজের মুখে একবার আপা একবার দিদি এই প্রথম কানে লাগে বিলকিসের। জলেশ্বরী হিন্দুপ্ৰধান জায়গা ছিল এক সময়। এখনো এখানে অনেক মুসলমান পরিবার দাদা-দিদি ব্যবহার করে। আপা চল হয়েছে পাকিস্তান হবার পর। তার আগে বুবু চলত। বুবু ডাক আশা করে নি বিলকিস, কিন্তু আপা আর দিদি এর কোনো একটা হলে তার কানে লাগত। না। সম্বোধনের দুটোই ব্যবহার করাতে সিরাজকে তার বয়সের চেয়েও ছোট মনে হয়, বেড়ে ওঠা একটা কিশোর মনে হয়, যে এখনো ঠিক অভ্যস্ত নয় অচেনা কোনো মহিলার সঙ্গে দীর্ঘকাল কথা বলতে।
সিরাজ বলে চলে, প্রতি মুহূর্তে ভাবছিলাম, এই সাপের কামড়ে মরব, এই সাপ ছোবল দেবে। জানেন তো রংপুর গোন্ধুর সাপের জন্যে কেমন বিখ্যাত? কিন্তু কী আশ্চর্য কী করে বেঁচে গেলাম! পরদিন মনে হলো, কেন যাব। ইন্ডিয়ায়? যাব না। এখানেই থাকব। আমার বাবা-মা-ভাই-বোন যেখানে গেছে, সেখানেই থাকিব, শেষ দেখব।
তুমি খুব সাহসী।
না, সাহস নয়, আপা। সাহস ওদের, আমার কয়েকজন বন্ধু ওরা গোড়াতেই ইন্ডিয়া গেছে। কুসুকুম দিয়েছে, দেশের ভেতরে ঢুকে মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করছে সাহস ওদের। ওরা সাহসী।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সিরাজ যেন বন্ধুদের কল্পনায় দেখে নেয়। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে তার। কী হলো?
কিছু না।
তুমি সাহসী। নইলে ডিনামাইটের ঘটনা শুনেও তুমি আমার সঙ্গে জলেশ্বরী চলে আসতে পারলে?
মনসুরদা বলেছেন বলেই তো এলাম।
মনসুরদা?
আপনাকে বলা হয় নি। এই কথাটাই আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম। খেই হারিয়ে ফেললাম। মনসুরদার সঙ্গে কাজ করছি। ওপার থেকে যারা আসে তাদের সাহায্য করি। মনসুরদা করেন। আজ ডিনামাইট হয়ে যাবার পর এক ট্রেন সৈন্য আসে। তারপর আমার ওপর ডিউটি পড়েছিল, ইস্টিশানের দিকে চোখ রাখার। বিকেলের ট্রেনে আপনি এলেন।
আমি লক্ষ করেছিলাম, তুমি আমাকে প্লাটফরমে দেখেই ঝোঁপের আড়ালে চলে গেলে।
আপনি তো আর দশজন যাত্রীর মতো নন। আপনাকে দেখেই চেনা যায় ঢাকা এসেছেন।
তাই?
হাঁ। আমি তো এক নজরেই বুঝেছি। মনসুরদাকে বলতেই তিনি ভালো করে দেখলেন। আপুনি তুখন ইন্টিশনের ঘরের ভেতরে। জানালা দিয়ে দেখেই মনসুরদা আমাকে বললেন, কে চিনেছিস? কাদের মাস্টার, আমার স্যারের মেয়ে।
তোমার মনসুরদা আমার বাবার ছাত্ৰ? কে বল তো?
আপনি কি চিনবেন? পরাণ হকারের নাতি। বৃটিশ আমলে ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে যে মেডেল পেয়েছিল। সে মেডেল আমি দেখেছি। এখনো ওদের ঘরে আছে। মনসুরদা। আমাকে বললেন, বোধহয় জলেশ্বরীতে যেতে চায়, কিছুতেই যেতে দিবি না। আর যদি যেতেই চায়, পৌঁছে দিয়ে আসবি।
তোমার মনসুরদা এল না কেন সামনে?
তার অনেক কাজ। তাছাড়া ভোরবেলার ঐ হামলাটার পরে মনসুরদা তো কিছুতেই জলেশ্বরীতে যেতে পারেন না। আপনি যদি জলেশ্বরীতে যেতে চাইতেন? কী করতেন তিনি? তাই আমাকে পাঠালেন। আমি তো আপনাকে অনেকবার নিষেধ করলাম। আপনি শুনলেন না।
তোমার মনসুরদা তো বলেই ছিল, আমি যদি যেতে চাই, আমাকে পৌঁছে দেবে।
তাই তো দিলাম।
উনি তো বলেন নি, আমার সঙ্গে বাজারে যাবে খোকার লাশ দাফন করতে।
সিরাজ চিন্তা করে।
ধর, উনি মানা করলেন, তাও তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
সিরাজকে দ্বিধাগ্ৰস্ত মনে হয়। অবশেষে বলে, আমার মনে হয়, মনসুরদাও আপনার সঙ্গে যেতেন।
কেন বলছ?
আপনি যে একটা কথা বললেন তা আমার মনে গেঁথে গেছে।
কোন কথা?
ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে শুনেও থাকতে পারেন না।
সিরাজের কণ্ঠস্বরে গাঢ় বিষণ্ণতা এবং খেদ ফুটে বেরোয়।
জানেন আপা, আমার মনে হয়, আমি খুব নিচু ধরনের ভীতু।
আবার ও কথা কেন?
বিহারীরা যখন এল, আমি বাবা-মাকে ফেলে পালিয়ে গেলাম কেন? আমি তো জানতাম ওরা কিছুতেই প্ৰাণে বাঁচিয়ে রাখবে না। কাউকে। সবাইকে ফেলে আমি একা পালিয়ে গেলাম, ভীতু নাই তো কী? আপনার মতো আমার সাহস নেই কেন? ভাইয়ের জন্যে আপনার যে রকম টান, আমার ছিল না কেন?
সিরাজ মুখ ঢাকে।
কাঁদছ? বিলকিস তার পিঠে হাত রাখে। বলে, সিরাজ, মার্চ মাসের চব্বিশ তারিখেও কেউ যদি আমাকে বলত, বেশি কিছু না, মাঝরাতে নির্জন একটা রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে যেতে পারবে? বিশ্বাস কর, আমি কল্পনা করেও ভয়ে মরে যেতাম। পঁচিশ তারিখে এত লোক মারা গেছে শুনেছি, আলতাফ যদি বেঁচে থাকত, মৃত্যুকে আমার ভয় করত। এতগুলো লোকের মৃত্যু আমার কাছে কাহিনী হয়ে থাকত। আলতাফ নেই, আমার মৃত্য-ভয় নেই, মৃত্যুর জন্য আমার শোকও নেই। খোকাকে গুলি করে মেরেছে, খোকার লাশ গড়ে আছে খোকার লাশ কেউ ছুঁতে পারবে না, কই, আমার চোখে তো পানি আসছে না, পানি এল না। ছ মাস আগেও কেউ যদি খোকার মৃত্যু-সংবাদ আমাকে দিত, পৃথিবীটা চৌচির হয়ে যেত না? এখন তো আমি ঠিক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। খোকাকে কবর দেওয়ার কথা ভাবছি। কেউ ভীত নয় সিরাজ। কেউ ভেঙ্গে পড়ে না, শোক কখনও এত বড় নয় যে, মানুষ মাঙ্খা তুলে দাঁড়াতে পারে না। একটু চুপ থেকে বিলকিস যোগ করে, কখন বেরুব?
সচকিত হয়ে ওঠে সিরাজ। এতক্ষণ সে যেন অন্য একটা জগতে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, বেরুবার আগে আমি বরং একবার ঘুরে দেখে আসি।
কদূর যাচ্ছ?
বেশি দূর না। মোড় পর্যন্ত। তখন পায়ের আওয়াজ পেলেন না? শান্তি কমিটির ছোকরাগুলো টহল দিচ্ছিল। ওরা যতক্ষণ আছে, মোড় পেরুনো মুশকিল। তবে, বেশিক্ষণ থাকে না, এই যা। আমি দেখে আসি।
আবার বেড়ালের মতো আঙ্গিনাটি মুহূর্তে পার হয়ে সিরাজ বেড়ার আড়ালে হারিয়ে যায়।
একবার ধক করে ওঠে বিলকিসের বুক। একবার খোকার মুখ মনে পড়ে। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, নিজের জমাট বাধা রক্তের ভেতরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে খোকা।
বিলকিসের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।