১৬-২০. ব্রিটিশ কাউনসিল থেকে
১৬.
ব্রিটিশ কাউনসিল থেকে হেঁটেই ফিরছিল যিশু। সেকসপিয়ার সরণি থেকে ক্যামাক স্ট্রিট ধরে মনে পড়ল টাকা তুলতে হবে। পরশু বৈশাখী পূর্ণিমা, জেনে রেখেছে। কাল সকালে বেরিয়ে পড়বে। ক্যাশ টাকা দরকার। পার্স খুলে ইন্দুসিন্ধ ব্যাক আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের এটিএম কার্ড দেখে আশ্বস্ত হল।
ক্যামাক স্ট্রিট ভিড়াক্কার। রাস্তার দুপাশে পুলিশের জিপ। লরি, খাকি, লাঠি, রেব্যান, খইনি, এলাহি। আদিত্যকে দেখতে পেল।
আদিত্য যিশুকে আসতে দেখে, যিশুর সেরকমই মনে হল, রে ব্যান চশমা পরে নিল। হাতে বেটন। বুকে নামের তকমা। গটগটীয়ে রোয়াব। প্রোমোশান পেয়ে গেল নাকি, ওপরঅলাদের মোটা টাকা খাইয়ে। ওঃ, তুই তো একদম উত্তমকুমারের পাইরেটেড ভার্সান হয়ে গেলি রে।
আদিত্যর মনে হল, আরেকটু হলেই ওর মুখাবয়াবে ধরা পড়ে যেত অরিন্দমদার বীভৎস মৃত্যুর মর্মান্তিক খবর। সামলে নিয়েছে। যিশুদার কথা বলার ঢঙ থেকে পরিষ্কার যে অরিন্দমদার দুর্ঘটনার খবর জানে না। ভালোই। গাড়িতে সম্পূর্ণ দগ্ধ নারীর লাশ পাওয়া গেছে। পোড়া নোটের তাড়া। অরিন্দমদার বাড়িতে কেউ বলতে পারেনি, কার লাশ, মেয়েটি কে! শনাক্ত করা অসম্ভব, এমন পুড়েছে। কত লাশ যে এভাবে পুলিশের জিম্মায় এসে নামহীন পড়ে থাকে ; তারপর একদিন নামহীন ধোঁয়া হয়ে উবে যায়। যিশুদার কাছে চেপে যাওয়াই ভালো। নইলে কী মনে করবে অরিন্দমদা সম্পর্কে। কমবয়সী যুবতী, হয়তো, গুচ্ছের টাকা, গল্পের খেই আপাতত নেই। আর খেই না থাকলেই গল্প খুঁজতে থাকবে অন্ধকার চোরা রাস্তাগুলো। কত দেখলো তো পুলিশে ঢুকে। তুলি জোয়ারদার নয়, অন্য কেউ ছিল।
যিশু বলল, কীরে, এখানেও তোলা তুলছিস? এটা তো সম্ভ্রান্ত অফিসপাড়া। তোদের সত্যি, বলিহারি। তোদের সেই লিয়াকত আলি না কি নাম যেন, তিনটে গাড়ি খাটায় বেনামে, কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্রের কার্ড জাল করে হাওড়া আর ডায়মন্ড হারবারে ছেলেছোকরাদের চাকরির লোভ দেখিয়ে লাখ-লাখ কামিয়েছিল, সে ধরা পড়েছে? না কি লুকিয়ে রেখেছিস তোদের পুলিশ কলোনির কোয়ার্টারে? সে তো আবার ওসি। তোর চেয়ে উঁচুতে, মালদার পার্টি?
আদিত্য বলল, আঙুল করা স্বভাব আপনার গেল না।
যিশু বলল, তা এখানে কী?
আদিত্য বলল, আর-রে আর বলবেন না। বাঙালিগুলো তলে-তলে কলকাতাকে দিয়ে দিচ্ছে।এক-একখানা ভাম বসে আছে অ্যাসেসমেন্ট বিভাগে।
যিশু বলল, যা বলেছিস। ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের ওপর পুরোবাবুদের খুব রাগ। ওরা কলকাতার ঐতিহ্যকে টিকতেই দেবে না। দেখছিস না, টাউনহলের বাগানে বেঢপ বাড়ি তুলেছে।
আদিত্য বলল, এসব হল বাঙালদের কুকিত্তি।
যিশু বলল, বাঙাল, মুসলমান আর ব্রাহ্মণদের ওপর তোর দেখি যখন-তখন গোঁসা। তা পুরসভার বাবুরা ক্যামাক স্ট্রিটটাই বেচে দিয়েছে নাকি? বলা যায় না ; ভাঙা টেবিল-চেয়ার জুড়ে যা সব মাল বসে আছে ওদের অফিসটায়।
আদিত্য বলল, ওই মার্কেটটা সিল করে দেয়া হচ্ছে, ওই যে, ওইটা। বেআইনিভাবে একটা আংশ বাড়িয়েছিল, শালা ধসে পড়েছে। ভাগ্যি যে কেউ ট্যাঁসেনি। ভেতরে-ভেতরে একটা মেজানাইন ফ্লোর খাড়া করে ফেলেছিল, বুঝলেন। এ যেন পারমাণবিক অস্ত্র। কেউ টেরটি পায়নি। নকশা অনুমোদন হয়েছিল বসতবাড়ির, আর ওনাদের বিল্ডিং বিভাগের গ্যাঁড়াকলে রূপ পালটে হয়ে গেল মার্কেট। পার্কিঙের জায়গাতেও দোকানঘর। হ্যাহ হ্যাহ।
যিশু বলল, একেবারে সুপার কেলো দেখছি। তা ওটা দেখছি ভাঙা হচ্ছে আলপিন দিয়ে, আর বাঙালি হকার তোলার বেলায় পে-লোডার বুলডোজার। তা বেশ, তা বেশ।
আদিত্য বলল, কেলো বলে কেলো! আলিপুর রোডে একটা বহুতল বাড়ির একতলা দোতলা আর বেসমেন্ট নেই।
যিশু বলল, বলিস কী রে। দাঁড়িয়ে আছে কী করে? কেতাবি তত্ত্বের ওপর?
আদিত্য বলল, ম্যাজিক, ম্যাজিক, কমরেডদের ম্যাজিক, এখন অবশ্য অনেক কমরেড রাতারাতি জার্সি পালটে ফেলেছে। অ্যাসেসর কালেক্টর আর ইন্সপেক্টর ষড় করে নথি থেকে তিনটে ফ্লোর বেমালুম গায়েব করে দিয়েছে। পার্টির লোক, কারোর মুরোদ নেই মুখ খোলে। আপনি আর কী লুইফিলিপে আর পিয়ের কার্ডিন পরেন। অ্যাসেসমেন্ট ইন্সপেক্টারটাকে দেখলে ভিরমি খাবেন। সুট, সাফারি, সেলুলার, আই পড, বেনসন হেজেস। হিংসে হয়। রিঅ্যালি। কাসপারভের ডবল আই কিউ লোকটার। ভ্যালুয়েশানের আগেই মিউটেশান ফি জমা নিয়ে নিয়েছিল। ওফ শালা কী চিজ একখানা, যেন স্তালিনের বিচি থেকে একেবারে যুবক হয়ে বেরিয়েছে। ইন্সপেকশান বুক লেখা হবার আগেই হিয়ারিং নোটিসখানা পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেগুলো আর ফ্ল্যাট মালিকদের না পাঠিয়ে, পাঠিয়ে দিয়েছে বিল্ডারকে। বিল্ডিংটা দেখেছেন? কী নেই! পার্কিং লট, মার্কেট, এসকালেটর, হেল্থ ক্লাব, বিলিয়ার্ড রুম, রকেট লিফ্ট, পেল্লাই কম্যুনিটি হল, ছাতে খেলার মাঠ, আরেক ছাতে বাগান, কত কী! সোনার লিকুইড দুইছে পার্টির পাকাচুল-দাদারা। ইন্সপেক্টরটা বদ্দি বামুন, বরিশালের ফেকলু, শালা তিলে খচ্চর। খাল কেটে মারোয়াড়ি কুমির ঢোকাচ্ছে। দেবে একদিন দাদাদের পোঁদে কামড়, তখন টেরটি পাবে মজা।
যিশু বলল, আস্তে বল, আস্তে বল, শুনতে পেলে অবরোধ করিয়ে দেবে। তুই অবশ্য কম যাস না। লাইন তো ধরেই ফেলেছিস। শাসকবর্গের বশংবদ রোগপোকা।
আদিত্য বলল, কীইইই যে বলেন।
যিশু বলল, মেড়োগুলো এককাপড়ে এসে কোটিপতি হয়ে গেল। সেন্ট্রাল ক্যালকাটা, আলিপুর, সল্টলেক সব দখল করে নিয়েছে। আর শ্যালদায় একপাল লোক নাকে কাঁদছে, দেঁশ ভাঁগ চাঁইনি বলে। লাথি খেয়েও বাংলাদেশে কেড়ে-নেয়া ভিটে দেখতে যায় আর ফিরে এসে কাব্যি করে।
আদিত্য বলল, ম্যানহোলের লোহার ঢাকনি চুরির ব্যাবসা করছে।
যিশু বলল, তোরই তো মাসতুতো ভাই সব। দামি-দামি ট্যাংরা পারসে ইলিশ খাওয়া সর্বহারা।
আদিত্য বলল, আমরা তো নস্যি। খুচরোর জন্যে পুলিশের লোকে প্যান্টের পকেটে চামড়ার লাইনিং লাগায়। সত্যি। জোক করছি না।
যিশু বলল, যার যেমন মূল্যবোধ। কারোর খুচরো, কারোর করকরে। আমার ফ্ল্যাটটা মিউটেশানের সময়ে, এখনও পরিষ্কার মনে আছে আমার, অ্যাসেসমেন্ট ইন্সপেক্টারটা বাবার কাছে অশৌচের শোকপোশাকে এসে হাজির। একটু আগেই বোধহয় বাপকে পুড়িয়ে এসছে শ্মশানে। ভুঁসকো ভুঁড়িতে মোটা পৈতে ঝুলিয়ে, বুঝলি, পায়ে রবারের জুতো, হাতে ন্যাকড়াসন, এসেছে ঘুষ খেতে। আবার দাঁত বের করে হাসছিল, খ্যাক-খ্যাক খ্যাক-খ্যাক।
আদিত্য বলল, জিভ যৎসামান্য মুচড়ে, আজগাল লোকে নিজের বাপকেও খুন করে দিচ্ছে বাপের চাগরিটা পাবার জন্যে, দেখছেন।
যিশু বলল, সেটা বাঙালির চাকরি ওরিয়েন্টেশানের জন্যে। বাঙালির শালা জীবিকা মানেই চাকরি। কাজ দাও, মানেই চাকরি দাও। চাকরি ছাড়া আর ভাবতেই পারে না কিছু। বাপকে খুনের রিস্ক নেবে, কিন্তু নিজে কিছু করার রিস্ক নেবে না। বাঙালিরা এতো আড্ডা দ্যায় কেন বল তো? আড্ডাটা হল মায়ের কোল। চাকরিটাও মায়ের কোল। মায়ের কোলের আরাম চাই বাঁধা টাকার মাই খেয়ে। অন্য সব কাজকম্ম তো চলে যাচ্ছে অবাঙালিদের কবজা্য়। ওই তো, দ্যাখ, ট্যাক্সি ড্রাইভারগুলো সবকটা বিহারি, নয় ইউ পি সাইডার। ট্যাক্সি আর বাসের মালিকগুলো বেশিরভাগ পাঞ্জাবি। ধোপা, ছুতোর, নাপতে, মুচি, কামার, বাড়ি বানাবার মিসতিরি, পুরসভার ডোম, বড়োবাজারের মুটে, তুই দেখগিযা, হয় বিহারি, নয় ইউ পি সাইডার কিংবা ওড়িষার। হাওড়া-শ্যালদা স্টেশানের, ব্যাংকশাল আর শ্যালদা কোর্টের, রোড ট্রান্সপোর্ট অফিসের, সব দালালগুলো, সবকটা ক্রিমিনাল, তুই তো ভালো জানবি, সব ওদিকের। কলের জলের কাজ করছে উড়েরা। বাঙালিদের ব্যাবসার কথা তো ছেড়েই দে। কেউ দাঁড়াতে চেষ্টা করলেই দাদারা লাল ডাণ্ডা ঢোকাবে। বড়োবাজার থেকে ডাণ্ডার ফাইনানসিং হয়।
আদিত্য বলল, এতেও গবেষণা করছেন নাকি? কিচ্ছু ছাড়বেন না দেখচি।
যিশু বলল, আরও বলছি, শোন তাহলে। আমাদের বিলডিঙের লিফ্টটা রিনিউ হচ্ছে না দুবছর ধরে। ওদের অফিসে গিয়ে পাওয়াই যায় না কাউকে। একই বাড়ির জন্যে পুরসভাকে ট্যাক্স দাও, অট্টালিকা কর দাও, আবার বহুতল কর দাও। অথচ কোনও অফিসে পাবি না বাবুদের কাউকে। কোনও না কোনও রকম মায়ের কোলে ঢুকে বসে আছে। পঞ্চাশ বছরে স্বাধীনতা আমাদের খাঁটি জোচ্চোর করে দিয়েছে। পশ্চিমবাংলার বাঙালির বাকতালা আসলে মাইখাবার আরেকরকম ফর্ম।
আদিত্য বলল, তা এখন কোথায় চললেন? বাড়ি?
যিশু বলল, যাচ্ছি কাঁচা আম কিনতে। বিয়ারে দুচার টুকরো ফেলে খাবো। আমার অ্যাসিট্যান্টটা গ্রামে গেছে, এখনও ফেরেনি। চিন্তায় ফেললে। তুই জানিস তো? ভাঙাপাড়া?
আদিত্য বলল, আপনি বিদেশে কোন একটা কাজে যাবেন বলছিলেন, তার কী হল?
যিশু বলল, হ্যাঁ, সিয়েরা লিয়োন। নিত্যিদিন শালা সরকার পালটায়, মিলিটারিতে ঝগড়া বাধে। পয়সা-কড়ি পাওনা আছে অনেক।
আদিত্য বলল, ওব-বাবা, আফরিকা! আর জায়গা পেলেন না? আফরিকায় যা কনডোমের সাইজ! ইনডিয়ানরা গিয়ে পায়ে মোজা করে পরে শুনেছি। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
যিশু বলল, তোর তো ওই একটাই চিন্তা। না, একটা বলি কী করে। দুটো, রূপ আর রুপিয়া।
আদিত্য বলল, আরে আপনার তুলনায় আমি তো এখনও কচি। তা আপনি সেটল হচ্ছেন না কেন। ইন্সট্রুমেন্টটা লিগালাইজ করুন এবার।
যিশু বলল, একবার কোনও রোববার সেইন্ট পলস ক্যাথিড্রালে গেলে টের পাবি। যত দিন যাচ্ছে তত অবাঙালি আর কুচ্ছিত হয়ে যাচ্ছে বাঙালি খ্রিস্টানরা। কবর দেবার জায়গার অভাব তো মা-বাবার ফিউনারালের সময়ে দেখেছিলি। আমি হলুমগে বাঙালির রেনেসঁসের রেলিকস। বিশুদ্ধ বাঙালি খ্রিস্টান আর নেই। আমিই শেষ প্রতিভূ। মাইকেল মধুসূদনের নাতি-নাতনিরা শুনেছি অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। অন্তত কুচ্ছিত হওয়া থেকে তো বেঁচেছে।
আদিত্য বলল, আপনার সেই কেটলিউলির কী হল? তিলজলার কেটলি কুইন? সে তো আছে।
যিশু বলল, ধুৎ কীইইই যে বলিস বোকার মতন। অরিন্দমকে নিয়ে গিসলুম তো কেটলির বাসায়। গাড়ি নিয়ে অ্যাগবারে তৈরি হয়েই গিয়েছিলো ; মেয়েটাকে সেদিনকেই বিয়ে করবে বলে। প্রেম ছাড়া তো ও সাফোকেটেড ফিল করে। করে ফেলেছে বোধহয়, বিয়ে, দেখগি যা।
আদিত্য স্তম্ভিত। দ্রুত ছুটে গিয়ে মোটর সাইকেলে বসে। কিকস্টার্ট করে। নীলাভ ধোঁয়া তুলে মিডলটন স্ট্রিটে ঢুকে যায় মোটর সাইকেল।
আদিত্যর ব্যাখ্যাহীন আচরণে যিশু অবাক। কাজ ফেলে ছুটল নাকি অরিন্দমের বউ দেখতে! কিংবা কেটলির পরিবারের ফ্যাঁকড়া খুঁজতে পুলিশি ফলাতে ছুটল?
হাসপাতালে পরিচয়ের পর কেটলি আর ওর বন্ধু মেনকার বাড়ি তিলজলা-তপসিয়ায় বারকয়েক গেছে যিশু। প্রশংসনীয় ওদের স্বনির্ভর হবার উদ্যম। কেটলির সৎ ভাইটা মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টারে ঢুকেছিল। ওদিকে কোথায় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার জঙ্গলে মরেছে পুলিশের গুলিতে। ওর বাপ বারকয়েক বিয়ে করেছে ছেড়েছে। গ্রাম ছেড়ে এসে ওরা সরকারি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের রান্নাঘরে ঠিকেমজুর ছিল। তারপর ট্যাংরায় পাঁউরুটি কারখানায়। এখন দিনে একশোটা কেক বানাচ্ছে নিজেই। বিক্রিবাটাও মন্দ নয়।
ছেলেটা মাওবাদী হবার আগেই, বহু আগে, কলকাতায় চলে এসেছিল। গত নির্বাচনে মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার কিছু এলাকায় ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিল। পাতলা গোবর দিয়ে সাঁটা, হাতে লেখা পোস্টার পড়েছিল গাছের গুঁড়িতে, চালাবাড়ির মেটে দেয়ালে, হোগলায়। আমলাশোল, শিয়াড়বিনধা, চাকাডোবা, বাঁশপাহাড়ি, কেঁউদিশোল গ্রামে হ্যান্ডবিল বিলি হয়েছিল।
পুরুলিয়ার বান্দোয়ান ব্লকের ধাদকা আর কুমড়া পঞ্চায়েতে, বাঁকুড়া জেলার রাইপুর ব্লকের ছেঁদাপাথর এলাকায় ওদের প্রভাব যে সিপিয়েম আর ঝাড়খন্ডদলের তুলনায় যথেষ্ট তা যিশু টের পেয়েছিল খাদিবোর্ডের প্রকল্পের অ্যাসাইনমেন্টে। ঘনশ্যাম সিং সর্দার, যে পরে বন্দুক-কার্তুজসুদ্দু ধরা পড়েছিল, সেই মাওবাদী নেতার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যিশুর।
ওই এলাকার সংগঠক, মাওবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ লোক, অতনু চক্রবর্তীর সঙ্গেও যিশুর আলাপ হয়েছিল গালুডিতে। তেড়ে সাঁওতালি, ভোজপুরি, হিন্দুস্হানি বলতে পারে। পাইকা আর স্মল-পাইকা গুলে খেয়েছে। চাকরি-বাকরি ছেড়ে-ছুড়ে ঢুকেছে এইসবে। সবাই আছে ওর খোঁজে ; বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসন, জোতদার, জঙ্গলের ইজারাদার, সবাই। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গ্রামবাসীরা খবরাখবর দিয়ে যেমন ডাকাতদের বাঁচায়, ওইসব অঞ্চলের গ্রামবাসীরা বাঁচায় মাওবাদীদের। শত্রুপক্ষ-মিত্রপক্ষের তত্ত্বে ফারাক নেই। আছে কাজে।
এই অতনুর খোঁজেই অরিন্দমকে ভোটবাগানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আদিত্য।
যিশু দেখেছে, কুড়ি কিলোমিটার জুড়ে দুর্গম জংলি সবুজ। সাঁওতাল, মুন্ডা, ভুমিজ, খেড়ে, শবর, কৈবর্ত, তেঁতুলে বাগদির বাস। উঁচু জাতের বাঙালির ধাক্কায় শহরের প্রান্ত থেকে ঠেলে-ঠেলে পৌঁছে গেছে জঙ্গলের কিনারে, জঙ্গলে। এখন জঙ্গলের দেয়ালে পিঠ। কেন্দুপাতা, সাবাইঘাস, মহুয়াফুল, মহুয়াবীজ, শালবীজ, শালপাতা, কুসুম, নিম, বেল, কালমেঘ, কুড়চি, আমলকি, জ্বালানিকাঠ কুড়িয়ে আর বেচে যতটুকু চলে।
ময়ূর মেরে টাউনে মাংস নিয়ে গেলে ভালো দাম পাওয়া যায়। যা কিছু দেখতে ভালো, মেয়েমানুষ হলে তো কথাই নেই, তাকেই সাবড়ে ভুষ্টিনাশ করতে চায় শহরের মানুষ। জিনিসটার বা প্রাণীটার নয়, মানুষ আহ্লাদিত হয় ভুষ্টিনাশের স্বাদে। প্রতিটি সৌন্দর্যবস্তুর চর্বণপদ্ধতি আলাদা। চেবাবার, খাবার, গেলার, চাটার আওয়াজ আলাদা-আলাদা।
বাঁশপাহাড়ি এলাকার নিতাই মুড়া আর ভরত মুড়ার নামডাক আজ পঁচিশ বছর। বলছিল, তৃণমূল কংরেস বল্যেন, সিপিয়েম বল্যেন, ঝাড়খন্ড বল্যেন, বিজেপি বল্যেন, সঅঅব গর্মাগরম বইকবকম। ওই খাদি বোর্ডের প্রকল্পের কাজের সময়ে তো ঝিলিমিলির কাছে বারোঘাটির জঙ্গলে বন্দুক-পিস্তল ভাঁজার শিবির দেখেছিল যিশু। বোড়ো, উলফা, আল উমমা, আনন্দমার্গীদের চিন নানা অস্ত্রশস্ত্র দিলেও, মাওবাদি কমিউনিস্ট সেন্টারকে কেন দেয় না, ব্যাপারটা বুঝে ওঠা মুশকিল! অবাক লেগেছিল যিশুর যে অল্প সময়ের মধ্যে ওরা ওর সম্পর্কে অনেক-কিছু জানে। কেন্দুপাতার ব্যাবসা বন্ধ করতে ওরা ট্রাক লুঠ করেছিল। প্রশাসন তো ব্যবসাদারদের। ওদের মালকড়ি ছাড়া ভোটাভুটি অচল।
যাঃ, কী আবোল-তাবোল ভাবছিল হাঁটতে-হাঁটতে। ইন্দুসিন্ধ ব্যাংকটা পেরিয়ে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড় ছাড়িয়ে, রাসেল স্ট্রিটের কাছাকাছি এসে গিয়েছিল যিশু। ভাবল, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড থেকেই তুলে নেওয়া যাক টাকাটা।
কাজের ছেলেটা ফ্ল্যাটে ফিরল কিনা জানার জন্যে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে বাড়ির নাম্বার প্রেস করে কানে ধরেছিল। ধুতি-পাঞ্জাবি চশমাচোখে হাফটেকো মধ্যবয়স্ক জিগ্যেস করল, দাদা, সোচিন কত করেচে?
.
১৭.
পুকুরের জলে টলটলে রোদের গুঁড়ো মাখতে-মাখতে জলের মধ্যে মাথা গুঁজে পাক খৈয়ে কুচোপোনা তুলে আনছে পানকৌড়ি। মাথা ডুবিয়ে পাক খায় আর রুপোলি মাছ তোলে। উড়ে গিয়ে ঘনসবুজ চিকচিকে নারকোল পাতার ওপর বসে সূর্যের দিকে পিঠ করে। স্নানশেষে যুবতীদের মাথা ঝাঁকিয়ে এলোচুল ঝাড়ার মতন গা কাঁপায়। কালো-কালো পালকের নিখুঁত ছুরি শুকোবার জন্যে জাপানি হাতপাখার মতন ডানা খোলে।
পুকুরের এদিকটায় অপলক শালুকের আবরুর মধ্যে মাথা গুঁজে মিষ্টিমদ গিলছে তিরতিরে কাঠফড়িং। বাঁদিকের নারকোল গাছটার পাতার ওপর ভজনালয় খুলেছে দাঁড়কাকের দল। সমগ্র পুকুরটা উঠে এসেছে রাত্তিরের অবগাহন থেকে। তোলা উনুনের ধোঁয়াপাকানো তঞ্জেবকাশিদা মসলিনের মতন কুয়াশায় ঢাকা কলাগাছের ডানার পিছনে খোড়ো একচালা। গোলাপি পায়ে পুকুরের জলতলকে চিরে ধবধবে পাতিহাঁস কুলবধুরা গ্রীবা উঁচু করে বেরিয়েছে পাড়া বেড়াতে। ওই বড়ো গাছটায়, কী গাছ কে জানে, পনেরো-কুড়িটা ওড়নশেয়াল জাতের বাদুড় ঝুলছে।
কলকাতা থেকে টানা ভাড়াগাড়িতে, চাঁপাডাঙা-বলরামপুর রোডে, মুণ্ডেশ্বরী নদীর পোলটার মুখে, রাস্তার ওপর পুকুরের ধারের ছাপ্পর-ছাওয়া ভেটেরাখানায় দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে চা খাচ্ছিল যিশু আর ড্রাইভার। ট্র্যাভেল এজেন্সির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় যিশু ঘুরেছে ওদের গাড়িতে। চেনা। শেষপুকুর যাবার জন্যে যেখান থেকে কাঁচা রাস্তায় বাঁক নিতে হয়, সেই গোপের হাট জায়গাটা দেখিয়ে দেবে ড্রাইভারকে।
গাড়ি তো আর নজর বাঁচিয়ে দেড় দিন পার্ক করে রাখা যাবে না। অলসের অনুসন্ধিৎসা সর্বাধিক। কাল সন্ধ্যায় আবার আনবে গাড়িটা ড্রাইভার। মোচ্ছবতলা আর তালটিকুরির মদ্যিখান দিয়ে গ্রামে ঢোকার ঠিক মুখে বাবলাডাঙার ঢিপির গোড়ায় থাকবে গাড়িটা। আলের ওপর দিয়ে এলে তাড়াতাড়ি পৌঁছোনো যায় বাবলাডাঙায়। ওই গাড়িতেই ফিরবে যিশু। যিশু আর খুশিদি। বৈশাখী পূর্ণিমার মেলার জন্যে প্রচণ্ড ভিড় থাকবে সেদিন, চেঁচামেচি, নাগরদোলা, যাত্রাদল, হট্টগোল, চোঙার বাজনা, গুড়-বেসনের মেঠাই। হুকিং-করা জগমগে ঝিকিমিকি আলোর রোশনাই। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছেলের মতন হারিয়ে যাবে দুজনে কোথাও। এত বিশাল পৃথিবী।
ধুলোয় পড়া ভাঙা ভাঁড়ে সকালবেলাকার ভোমরালি মাছি। পচা আলুতে প্রতিপালিত স্বাস্হ্যবান মাছির রাজত্ব এই শুরু হল। বেলে মাছি, নীল মাছি, দিশি মাছি আর ডোরোসেফিলা মেলানোগ্যাসটার, যে মাছিগুনো আলুর পচাই খেয়ে দেবদাসের মতন মাতলামো করে।
চায়ের দোকানের হোগলা-বেড়ার পেছনে তেতো-নাজনের পাতাহীন গাছে শুকিয়ে আমসি তিন-গতরি ডাঁটা। কয়েকটা নাজে-খাড়া তিনফলা নোঙরের মতন তিন পাশ থেকে ওপরমুখো ঝুলছে। ধূসর ডালে তিড়িকনাচন খেলছে নালবুলবুলি আর ছাতারে পাখি। পিচপথ থেকে নেমে যাওয়া দুপাশের ঢালে কালবৈশাখীর বৃষ্টির প্রশ্রয়ে উৎফুল্ল মুজঘাস, চোরকাঁটকি, কাঁটাকারির হাঁটু-ঝোপ। তারপর কালচে-সবুজ হোগলাবন, একটা ঘোড়া নিমের গাছ। কোঁড়া-বেরোনো বাঁশঝাড়ের তলায় বাঁধা সৌম্যকান্তি রামছাগলটার বোটকা গন্ধ এতটা দূরে এসেও ভলক মারছে। তালকি তাড়ির হাঁড়ি আর মাটির ভাঁড় নিয়ে রাস্তার ধারে ধুলোয় উবু বসে খদ্দের সামলাচ্ছে, এই সক্কালবেলায়, শুঁড়িবাড়ির বুড়ি। আর কহপ্তা পরেই তো তালশাঁস। ঢাল থেকে নেমেই খেতের সবুজ প্রগলভতা। তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন। শ্যালো ঘিরে বোরো। ঠিকুলকাঠির টঙে চোখমুখ আঁকা রাজনীতিক-ঋষিতুল্য কালো হাঁড়ি।
টাট্টুটানা একটা ছক্করগাড়ি চলে গেল আলুর বস্তা নিয়ে। শিল পড়ে রয়ে-রয়ে মার খায়েচে গো, হিমঘরে জায়গা নেই, মহাজনও নেবেনে। যিশু জানতে না চাইলেও ওকে উদ্দেশ্য করে বলল বস্তার ওপর বসে-থাকা চাষি। তারপর লোকটার নিশপিশে স্বগতোক্তি, দেকি, চাঁপাডাঙায়, নইলে ফেলদোবো, উপায় নেই উপায় নেই, পচতে নেগেচে।
শিলাবৃষ্টি? আরে! ছাঁৎ করে ওঠে। লক্ষ করেনি এতক্ষণ। খেতের ফসল কি মাথা নত করে আছে? তার মানে পেঁয়াজ আর রসুনের গোড়ায় তো জল জমে গেছে। কী ভয়াবহ। একে আলু পচছে, তার ওপর এই। বিঘে প্রতি দেড় কুইন্টাল সুস্বাদু সুখসাগর পেঁয়াজ হয় এই জেলায়। আগেরবারেই তো হামজানপুর, বড়াল, জ্যামোর, ব্যাপসাগড়, চণ্ডীগাছা, দুয়ারপাড়া মৌজায় গিয়েছিল যিশু। পেঁয়াজ সংরক্ষণের সরকারি চাড়ও তথৈবচ।
সিজকামালপুরে পেঁয়াজ সংরক্ষণাগারের কথা চলছে তো আজ কয়েক বছর হয়ে গেল স্যার, পেঁয়াজের আড়তদার তীর্থ পৈতাণ্ডি বলেছিল।
শিলাবৃষ্টি হয়েছে পর পর গত তিন দিন। তাইজন্যেই আসার সময়ে কাঁচা বাড়িগুলোর গোলটালির ছাউনি আর মেটেঘরের দেয়াল অমন মনমরা লাগছিল। গোলপাতার আর শনের ঝুপড়ি ফর্দাফাঁই। সকালের নবোঢ়া বাতাসের শীতল আদরে খেয়াল করেনি কিছুই। ভালোলাগায় অতর্কিতে বিষণ্ণতার ছোঁয়াচ ধরে।
শেষপুকুরেও চাষিরা অসহায় স্নায়ুচাপে আর দুঃখে আক্রান্ত হয়েছে নিশ্চই, ভবেশকার রাজনৈতিক ওল উৎপাদন সত্ত্বেও।
দিন-খাওয়া চাষিবাড়ির ভেতরে পরিবেশটা কেমন? আগের বছর হিমঘরের আলু পচেছিল সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। চাষিরা ক্ষতিপূরণ পায়নি। পাবেও না। এবছর আলু রাখার জায়গা নেই হিমঘরে, গুদামে, আড়তে। বৈশাখী পূর্ণিমার মেলাও তাহলে হবে নির্জীব। চোদ্দ কাঠার বেশি খাস বিলি হয় না। বর্গাদার খাবে কী? কর্জ চোকাবে কোথ্থেকে? আর গাঁয়ে গাঁয়ে তেভাগা ফসল হয়ে এখন ফসলের এক ভাগ জমির মালিকের, দ্বিতীয়ভাগ নথিকরা বর্গাদারের, তৃতীয়ভাগ যে কামলাটা আসলে চাষ করে, তার।
পাঁচ সাক্ষ্যে মানুষ বর্গাদার হয়। কালীদাস গরাই বলেছিল, কেউ মরে বিল সেঁচে, কেউ খায় কই।
পুকুর-পাড়ের কলাগাছের আড়াল থেকে একটা ভিকিরিকে আসতে দেখে গাড়িতে গিয়ে বসল যিশু। কাছে এলে সানফিল্ম লাগানো কাচ তুলে দেবে। নিশ্চিন্দি। ভিকিরিরা হাত বাড়ালে বেশ বিব্রত বোধ করে ও। পার্স খুলে হয়তো দেখবে খুচরো নেই। নোট দেওয়া যায়, কিন্তু অন্য লোকেদের তাতে গোঁসা হয়। অ, বড়োলোকমি। ড্রাইভারের দ্বিতীয় ভাঁড় শেষ হয়নি। নয়তো ভিকিরিটা এসে পৌঁছোবার আগেই কেটে পড়া যেত।
লোকটা কাছে এলে, দেখল যিশু, বাউল আর ভিকিরি মেশানো এক তৃতীয় সম্প্রদায়। আধুনিকতা এদের এখনও নামকরণ করেনি। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা এদের চায় না। পৌষ মেলার জন্য পেডিগ্রি দরকার হয় কী? কে জানে! পশ্চিমবাংলায় এরা বোধহয় উত্তরাধুনিক প্রাণী। গৃহবধু পকেটমারিনীদের মতন। বাউলের পদাবনতি হলে জাতভিকিরি হয়। ভিকিরিরা নিজের পদোন্নতি ঘটিয়ে নিজেদের আধা বাউল কিংবা নববাউল করে ফেলেছে। ক্লাবঘরের ফেকলুরা যেমন আঁতেল।
কাছে এসে ঝুঁকে, জানালার কাছে মুণ্ডু এনে, না, ভিক্কে চায় না লোকটা, বলে, একটা চা খাওয়াও না কত্তা ; আর যিশুর দোনামনা শেষ হবার আগেই, দোকানদারকে বলে, নে রে মদনা, একটা চা আর লেড়ো দে দিকিনি, বড়ো সায়েব দিচ্চে, বড়ো সায়েবের সংসার ভরে উটুক নাতি-নাতজামায়ে।
যিশু খুঁটিয়ে দেখছিল বছর পঁয়তাল্লিশের কালোবরণ দাড়িপাকানো গড়নের লোকটাকে। গায়ের খসখসে চামড়ায় ছিৎরে পড়েছে বয়েস। দুরঙের হাওয়াই চপ্পল দুপায়ে। সবুজটা শনের ধাগায় বাঁধা। তাঁমাটে পায়ের দরানি-পড়া গোছে লাউডগা-সাপ শিরা। কাছা মেরে পরা ধুলোট হাফলুঙ্গি। বোতামহীন কমবয়েসি বুশশার্টের ফাঁকে চ্যাটালো পেটের ওপর পাঁজর দেখা যাচ্ছে। নানা রঙের তাপ্পি-মারা তেলচিটে ঝোলা কাঁধে। ওষুধ বা মনিহারি জিনিসের টিনের একতারা। তাঁমার টান-টান ইলেকট্রিক তার। দাড়িতে বিশেষ চুল নেই লোকটার। কিন্তু মাথার কনকজটা নেমেছে কাঁধ পর্যন্ত। জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা-নেঙড়ানো একদা-আদল আন্দাজ করতে পারে যিশু।
বড়ো সায়েবকে তোমার গান শোনাও না ক্যানে। ক্ষমা করে দেবার অপত্য কায়দায় হুকুম করে খালি-গা চা-দোকানি, ডেকচিতে চাপানো আলুর তরকারিতে খুন্তি নাড়তে-নাড়তে। তারপর মৃদু হেসে যিশুকে, ও অনেক গান জানে স্যার, হাফু গান। শুনেচেন নিকি, হাফু? বাপ-চোদ্দোপুরুষের গান আমাদের এই হুগলি জেলার, তা হাফু তো উটেই গেল।
হাফু? শুনিনি তো!
লোকে গাইতে-গাইতে হাঁপিয়ে যায় তো, তাই হাফু। এগবার ধল্লে আবনি না বললে আর থামবেনে। ওতোরপাড়ার মুকুজ্জে রাজারা ভালোবাসত।
না, শুনিনি কখনও।
সোনেন্নিকো? বাউল-ভিকিরির কন্ঠস্বরে ভর্ৎসনা। গলা কাঁপিয়ে, একতারায়, নাকি তোতারায়, ড়িং ড়াং বুগ বুগ। মাছ ভাজার তেল ছেটাবার শব্দ ওঠে গুপিযন্ত্রে। সোনেন কত্তা, মন দিয়া সোনেন,
ওগো কলিমালুর জোড়া
তোমার পচা বেগুনপোড়া
ল্যাং খেয়ে তোর চাগরি গেল
বুজলিরে মুকপোড়া…
ড্রাইভারটা সশব্দে হেসে ওঠে আচমকা। ভাঁড়ের চা ফুলপ্যান্টে পড়লে হাসি চুপসে যায়।
কিন্তু সে লোক তো কবেই পালটে গেছে। এখন তো ওন্নোলোক। তোমার হাফু পালটায়নি কেন? ঠোঁটে মুচকি এনে যিশুর প্রশ্রয়। গায়কের হাঁপানি রোগে ওর কন্ঠে সব গানই হাফু।
পরবর্তী ড়িং ড়াং বুগ বুগ ধরে লোকটা,
সুবাস বোসের নাম ডুবোলি অণ্ডকোষের জামাই
ঠেককেদারি তুরাই পেলি লেইকো চুরির কামাই
তুদের সমাজবদল হ্যাঁ লা, ন্যাড় ঝোলাবার খ্যালা
থালে কেনরে এতো জুলুস-মিছিল
কেনরে ধানাই পানাই
হায় রে তুদের গোডিম ভাঙে নাই,
তুদের গোডিম ভাঙে নাই…
গান বোধহয় শেষ হয়নি, হাফু গান যখন। বাউল-ভিকিরি থেমে গেল চা-দোকানির কথায়। আগে ও পার্টি করত স্যার। মাধ্যমিক ওব্দি পড়েছেল। সোনাওনে সেই গানটে, সেই যে…
বাউল ভিকিরির সুরহীন ড়িং ড়াং আরম্ভ হয় আবার। বলল, ম্যাট্রিক আর দেয়া হল কই। আলুর আর চালের আকাল করে দিলে পোফুল্লবাবু ; চলে গেলুম চাঁপাডাঙা ইসটিশান পোড়াতে। সে আগুন আর নিববেনে কত্তা। রাবণের মুকে আগুন বলে কতা।
গোটা পনেরো দশ-বারো বছরের খালি-গা বালক জড়ো হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ভরে গেছে এরকম লেখাপড়াহীন-কাজহীন কিশোর-কিশোরীতে। মাঠ আর পথ বেয়ে অমন আরও বালক-বালিকা আসছে। গ্রামে কিছু একটা হলেই এরা জড়ো হয়ে যায়।
সেই ইংরিজি গানটে সোনাও না বড়ো সায়েবকে।
ইংরিজি গান? তুমি বেঁধেছ? শোনাও দেখি।
সোনেন সোনেন:
দিনে মিটিং রাতে মেটিং
এই তো হোলো বাংলাদেস
আসে যায় মাইনে পায়
রাঁড়ের পো-রা রয়েচে বেস
কলঙ্কে গড়া রাজনীতিকদের গল্প আরও অশ্লীল হয়ে উঠতে পারে আঁচ করে, গাড়ি থেকে নেমে দোকানির পাওনা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে বাউল-ভিকিরিটাকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে, লোকটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে ড়িং ড়াং পাক খায়। বলে, শেষপুকুরের মেলায় যাবার ভাড়াটা দেলেন বড়ো সায়েব, তেনার নাতিপুতিরা সুখে থাকুক। তারপর গেয়ে ওঠে প্রকৃত হাফু গান,
মাছ ধরা হল না গো সই
দোটো পায়লা লেগেছে জালে
সই যে পাতালে
সব দেখে যা লে…
কী সবটা লে
যম না চিতিলে
যাকে খেলে লে…
ময়না ধানের খয় না
ছেলে কেন আমার হয় না
মক্কাশ্বর যাবি
তবে খোকা পাবি
তেঁতুল খেলে গা জ্বলে
আমড়া খেলে ব্যাং হলে
মাছ ধরা হল না গো সই…..
গানের মাঝেই ছেড়ে দিল গাড়ি। গাড়িতে জুত করে বসে, ঘন্টায় আশি কিলোমিটার বেগের আরামে, দুটো কাঠি নষ্ট করার পর, তৃতীয়টায় ধরাতে সফল হয় যিশু। হাফু গানের দুর্গতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওর মনে হচ্ছিল, কাউকে অপমান করলে, এমনকী গানের মাধ্যমেও, তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা বোধহয় দুটো ভালো-কথা বলা সম্পর্কের চেয়ে গাঢ়। গাঁয়ে-গাঁয়ে, পাড়ায়-পাড়ায়, এত যে আড়াআড়ি আর খাড়াখাড়ি বিভাজনের খেয়োখেয়ি আর দলাদলি, যার কোনো মাথা নেই মুন্ডু নেই, হয়তো সেকারণে।
গা-ছাড়া রাস্তার দুধারে, শনাক্তকরণ প্যারেডের মতন ভাটাম, চটকা, ইউক্যালিপটাস, বাবলা, শিরিষ। সবুজের ফাঁকে-ফাঁকে সকালের বলদর্পী আলোর ব্যাটন। উবড়ো-খাবড়া পথ, গতিকে গোরুর গাড়ির বেগে এনে ফেলেছে। পথের হাল স্হানীয় বিধায়কের ক্ষমতা বা জোচ্চুরি ফাঁস করে।
বেশ ভোর রাত্তিরে উঠতে হয়েছিল বলে তন্দ্রার আমেজ কাটাতে পারছিল না যিশু। চা-সিগারেট-হাফুর পরও। ওর খেয়াল হল গাড়ি থেমে রয়েছে আর চিৎকার চেঁচামেচির রেশ আসছে। কী ব্যাপার? ড্রাইভারকে জিগ্যেস করল ও।
অবরোধ করতাসে পাবলিক!
অবরোধ? সে কী? আচমকা উদ্বেগের রক্ত ছড়িয়ে পড়ল যিশুর মুখমণ্ডলে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়। পৌঁছোতে আমাকে হবেই। তুমি হর্ন না বাজিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাও।
গাইড়িরে ড্যামেজ কইরা দিবে স্যার!
না-না, তা করবার হলে লোকগুলো ছুটে আসত এতক্ষণে। ওদের তো আমাদের সম্পর্কে আগ্রহ দেখছি না। ওই তো, ওদিক থেকে গাড়ি আর বাস আসছে তো ভিড় কাটিয়ে।
জমায়েতের কাছাকাছি পৌঁছে যিশু দেখল রাস্তার পাশে রাখা কাঁচাবাঁশের মাচান বাঁধা দুটো মধ্যবয়স মৃতদেহ। পুরুষ আর চাষি বউয়ের। তুমুল চিৎকার করে কাঁদছে, বুক চাপড়াচ্ছে কয়েকজন।
এভাবে শোকপ্রকাশ কলকাতায় আর দেখা যায় না। ওফ, দ্যাখা যায় না এসব দৃশ্য। গলার কাছে শ্লেষ্মা এসে গেছে। একসঙ্গে দুজনের মৃত্যু। গ্রামবাসীদের মধ্যে মৃত্যুজনিত প্রাণচাঞ্চল্য। সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে ও, যিশু। অচলাবস্হা গড়ে উঠতে পারে এদের আবেগের চাপে। তার আগেই দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া দরকার। কী হয়েছে গো? একজনকে জিগ্যেস করল যিশু।
মাল তুলেছে আজ দুবচ্ছর অথচ তাঁতি সমবায়ের ট্যাকা দ্যায়নে পান্না মাঝি। তাঁতিরা তাই চাষের ওষুদ খেয়ে মরচে। মহাজন দিয়েছেল সুতো। তা কী আর করবে। আগে পেটটা ভরাতে হবে তো। সুতো বেচে খেয়ে ফেলেচে।
ওওওওহ। এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল যিশু। ড্রাইভারকে বলল, চলো চলো। উদ্বেগে রক্তচাপ বেড়েছে নির্ঘাত।
তন্তুজ আর কী করবে! তাঁতিদের শীর্ষ সংস্হা। নিজেই তো এর কাছে ধার করে ওকে শোধ দ্যায়। তাঁত সমবায়ের পাওনা মেটাবে কোথ্থেকে। টঙে-টঙে পার্টির লোক। দুবছর কেন, অনেক তাঁত সমবায়ের পাঁচ বছরের পাওনা মেটাতে পারেনি। যেখানেই বাঙালি আমলা সেখানেই রক্তচোষার দিগ্বিজয়। পার্টির প্রতি প্রভূভক্ত আমলা।
মুসলমান তাঁতি বউরা আজকাল বিড়ি বাঁধছে। মরদরা যাচ্ছে মাছ ধরতে। হিন্দু পরিবারের সদস্যরা হেস্তনেস্ত করে উঠতে পারছে না এখনও। শীর্ষ সমবায় যেসব গামছা লুঙ্গি ধুতি শাড়ি তুলেছে, তাঁত সমবায়গুলোর কাছ থেকে তা আদপে বিক্কিরি হবে কি না ঠিক নেই। ওদের দোকানগুলো সময়মতন খোলে না, আর বন্ধ হয়ে যায় সন্ধের আগেই। সরকারি কর্মী ওরা; ওদের দোষ দেয়া যায় না, দশটা-পাঁচটার চাকরি।তাঁতজিনিসটাই বোধয় দশ বছরে নিপাত্তা হয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গে।
দু-দুজন আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ পৌঁছোবে সৎকারের পর। সবাই তো আদিত্যর জাতভাই। কাঁচ তুলে এসি চালিয়ে দিতে বলল যিশু। ঘুম পাচ্ছে।
.
১৮.
বাবলাডাঙায় বাবলাগাছ আর নেই। রয়েছে অর্জুনগাছ, বয়োবৃদ্ধ। মোচ্ছবতলায় আর কোনও মহোৎসব হয় না। গোপের হাটে হাট আর বসে না, গোপরাও থাকে না। তালটিকুরিতে তালগাছ আর নেই। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর, নামের মধ্যে জিনিসটা বা ব্যাপারটা আর থাকে না, নেই, ফোঁপরা।
মানে একেবারে নিশ্চিহ্ণ। যেমন স্বাধীনতা, যেমন গণতন্ত্র, যেমন নাগরিকতা, যেমন ন্যায়, যেমন দায়দায়িত্ব, যেমন সত্য, যেমন কর্তব্য। ভাবছিল যিশু। বাবলাডাঙায় গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে অর্জুনগাছটা দেখিয়ে দিল যিশু, যার তলায় কাল, বৈশাখী পূর্ণিমার সন্ধ্যায়, চাঁদের আলো মেখে অপেক্ষা করবে এই গাড়িটা বা ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম আঁকা অন্য যে-কোনও গাড়ি।
পাঁচটা নাগাদ পোঁছে যেও কিন্তু।
হঅঅঅ। পাক্কা। আমাদের দ্যাখসেন নাকি ডিউটি ফেল করসি?
মোচ্ছবতলায় কদমগাছের নিচে দাঁত বেরোনো ইঁটের চবুতরার ওপরে বসে গ্যাঁজাচ্ছে হাফবুড়োরা। কয়েকজনকে চিনতে পারল ও, যিশু। হিরু পাকড়ে। মন্দিরে ওকে রামচাকি বাজাতে দেখেছে। সুনীল মালিক, বাদল কোঁড়া, মানিক সাঁতরা, বদরুদ্দি খোনকার, সবাই বর্গাদার ; গত বছর এদের সমস্ত আলু পচেছিল হিমঘরে। আর ওই লোকটা তো জগৎ বাইন। আলুতে সারের ব্যবহার সম্পর্কে জিগ্যেস করতে গেয়ে উঠেছিল, বেনফেডের সার দিলি কনফেডের জামা, ধুতির নামে গামছা দিলি, ত্রাণের নামে মামা। রসিক লোকেরা, সত্যি, অদম্য ; নিজের দুঃখকষ্টকেও অলঙ্কারে মুড়ে তোলে।
ওর, যিশুর, পদবি, বিশ্বাস, সেটাও কেউ ঠিকমতন উচ্চারণ করতে চায় না। কেউ বলে, বিসসেস, কেউ বিসাস, কেউ বিহহাহ, কেউ বিষশ্বাস ; যার যা ইচ্ছে। চব্বিশ পরগণার কাজের বউদের বিরাট দল প্রতিদিন কলকাতায় কাজ করতে আসে। সবাই মুসলমান। অনেকে বাংলাদেশি মুসলমান। আসল নামে কাজ পাওয়া অনেক সময়ে মুশকিল বলে বউগুলো সরস্বতী, আরতি, সন্ধ্যা, কামিনী, অর্চনা নাম দিয়ে রাখে। যারা কাজ দেয় তারাও জানে। হিন্দু কাজের বউ হলে হয়তো নাম হতো খেন্তি, পেঁচি, পুঁটি ধরণের।
আত্মপরিচয় ব্যাপারটা বায়বীয় বোধহয়। বাবলাডাঙায় বাবলাগাছ আর নেই। বাবলাগাছেদের নামও আর নেই। বনবিভাগ গাছে-গাছে সংখ্যাচিহ্ণ এঁকে রাখে। যিশু অন্য দিকে তাকাল।
বারবার ব্যাখ্যা করা সত্ত্বেও ওকে এই লোকগুলো সরকারি প্রতিনিধি মনে করে। অভিযোগের কান্না আরম্ভ করবে এক্ষুনি। যিশু বলে, আরে বাবা, আমি সে-লোক নই ; ওরা ভুরু কোঁচকাবে, থালে হাতবাকসো কেন, লাল কালি সবুজ কালির কলম কেন, ফাইল-কাগজ কেন, ইংরিজি লেকালিকি কেন!
মোচ্ছবতলার এই চবুতরায় কখনো নাকি শ্যামানন্দ শ্রীজীব গোস্বামী বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের জন্যে এসে বসেছিলেন। পাশবালিশের মতন গোল ভগ্নাবশেষটা হয়তো চাঁদনির ইমারতি থাম। অথচ কোনও বৈষ্ণবের দেখা পায়নি যিশু এ-তল্লাটে। অষ্টসাত্ত্বিকভাব বলতে নতুন চন্দ্রমুখী আলুর রাঙাপানা ত্বক।
তালটিকুরি আর মেলাতলা পেরোয় যিশু। দরমা, হোগলা, চ্যাঁচারি, চট, তেরপলের দোকানপাট। নাগরদোলা, ম্যাজিক, যাত্রা-অভিনয়ের মঞ্চ, সব জোগাড়যন্তর পুরো। হুকিংও। হুকিং করে বিদ্যুৎ না নিলে আর মেলা জমে না। রোশনাই-এর খরচ তো আর মেলা-দর্শকরা জোগাবে না। শনি, শেতলা, মনসা, শিব, ধর্মঠাকুর, সমস্ত মন্দিরের অধিষ্ঠাতারা হুকিং করে নিজেদের আলোকিত করে রাখেন পশ্চিমবঙ্গে। ইষ্টদেবতা বলে কিছু আর নেই। সব সার্বজনীন।
মন্দিরে লোকজন নেই। যিশু দেখেছিল ঢুকে আগেরবার এসে। কে আর টের পাচ্ছে যে ও খ্রিস্টান। কলকাতার কালীঘাটেও ঢুকেছে। পাকা তাল আর জবাফুল হাতে শাঁখারুলি বধুদের প্যাচপেচে কিউ। ঢুকেছে দক্ষিণেশ্বরেও। মুলো হাতে দর্শনার্থীদের ময়ালসাপ লাইন। বিহারের লোকেরা কবজা করে ফেলেছে মন্দিরগুলোর ব্যবসাপাতি। ইশকুলে পড়ার সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঢুঁ মেরেছিল। তাল আর মুলোর চল তখন ছিল না। এরকম সাংস্কৃতিক রদবদল বোধহয় উত্তরঔপনিবেশিকতার দরুন। চার্চগুলোও তো কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়কার প্রতিভা হারিয়ে ফেলেছে।
মন্দিরের দক্ষিণে বিশাল বটগাছ। বটগাছে যে এরকম গাদা-গাদা বুনো মৌমাছির চাক ঝুলে থাকে, শেষপুকুরে আসার আগে দেখেনি যিশু। কিসের মধু এরা জোগাড় করে কে জানে। আলুফুলের মধু হয়? মন্দিরের পেছনে তো বিরাট দামপুকুর, যার নামে এই গ্রাম। পুকুর খোঁড়ার সময়ে শেষনাগের প্রতিমা পেয়েছিল গোপেরা। বটতলার অজস্র ঝুরির সোঁদা অন্ধকারে আধা-অবহেলিত সেই পাথরটার নাম আজ বুড়োশিব। পূঞ্জীভূত সময়ের বিরামহীনতাকে ধরে রেখেছে দিনেমারের সময়কার এই বট গাছের সুকোমল অন্ধকার। মৌমাছিদের ডানাগুঞ্জনের ঝিরিঝিরি সুগন্ধ।
ভবেশকার বাড়ি যাবার কোনও নির্দিষ্ট পথ নেই। রাজনৈতিক দলাদলির মামলা আর পালটা মামলায় কাঁচা রাস্তাটা বছর দশেক থেকে আধখ্যাঁচড়া। আদালতের স্হগিতাদেশ উঠতে-উঠতে কোনোদিন এটুকুও ভেসে যাবে ঠিকেদারদের প্রার্থনায় প্রীত মুন্ডেশ্বরীর বদরাগি জলে। বাঁশঝাড়ের অধোবদন সবুজ বাতাসে জিরোবার জন্যে ঝরাপাতার ওপর ব্রিফকেস রেখে সিগারেট ধরাল যিশু। চারিদিকে নিস্পন্দ আলোড়নের ছায়াছন্ন তরিবাতময়তা।
এখন আগে বরং হিমঘরে গিয়ে এখানে আসার ন্যায্যতা প্রমাণ করা যাক, ভাবল ও, যিশু। হিমঘর আর বিদ্যুৎ-সাবস্টেশান তো দেখাই যাচ্ছে। বিদ্যুতের হুকিঙের লোড হিমঘরটা নিতে পারবে কিনা আঁচ করা কঠিন। আলুগুলো আবার হয়তো দমবন্ধ হয়ে মরবে। আলের ওপর দিয়ে হেঁটে, পরিত্যক্ত উপস্বাস্হ্যকেন্দ্রের পেছনের আমবাগানের পাশ দিয়ে, পিচ রাস্তার ওপর পোঁছল যিশু। এই উপস্বাস্হ্যকেন্দ্রটা যখন স্বাস্হ্যবান ছিল, তখন এখানে কাজ করত খুশিদির যুবক পাণিপ্রার্থী। দরোজা, জানলা, মায় ইঁটও উপড়ে নিয়ে গেছে স্বাবলম্বী মানুষ।
হিমঘরের ক্যাশিয়ার জয়দেব শাসমল আসছিল ক্যাঁচোর-ক্যাঁচোর সাইকেলে। যিশুকে দেখে নেবে পড়ে। কেঁদো থপথপে হাঁটুনি। এগিয়ে আসে মুচকি মুখে।
প্রথমদিন এই লোকটা ভেবেছিল যিশু বুঝি সরকারি আধিকারিক, চুরিচামারি ধরতে এয়েচে। তাই শুনিয়ে-শুনিয়ে জিভ-গোটানো মন্তব্য করেছিল, লিকতে দে, লিকতে দে, বাবারও বাবা আচে। গ্রামে গেলে, লোকে নিজের ভয় অনুযায়ী যিশুকে কিছু-একটা ভেবে নেয়। বিদ্যুৎ পর্ষদের লোক, হুকিং ধরবে। ব্যাঙ্কের লোক, ঋণখেলাপি উশুল করতে এয়েচে, পালাও। স্বাস্হ্য দপতরের লোক, টিকে দিতে, ওষুদ গেলাতে, এয়েচে। গ্রামীণ বিকাশের, মেলা বক্তিমে ঝাড়বে।
দেকেচেন নাকি? কাগোচে? ধুতির খুঁট পকেট থেকে টেনে মুখ পুঁছে জানতে চায় শাসমল। নিজেই খোলসা করে। বারাসাত হিমঘরের ইউনিট ম্যানেজার শান্তি চাটুজ্যে নাকি গা ঢাকা দিয়েচে, হেঁ হেঁ, বন্ডের বই ভুলে গিয়ে বাড়ি নে গেসলো। বলেচে জেলাশাসকের নির্দেশ মানিনে, হেঁ হেঁ।
ক্লান্ত যিশু চাইছিল কোথাও গিয়ে একটু বসে, এক গ্লাস জল খায়। আপাতত শাসমলের কথায় দেখনসই সায় দেয়া প্রয়োজন মনে করে হাঁসল কাঁধ নাচিয়ে।
শাসমল প্রশ্রয় পায়, আরেকবার মুখ পোঁছে চল্লিশোর্ধ ভুঁড়িদাস। বলে, আমডাঙা, বারাসাত, দেগঙ্গা ব্লকের চাষিদের আলু তো এই বোসেখ মাসেও হিমঘরের মাটে পড়ে আচে, হেঁ হেঁ।
মানুষ অন্যের অবমাননায় বা তাকে হেয় করার জন্যে যখন হাসে, মনে হল যিশুর, তখন হাসিতে ক্যারদানি ফলায়। এক-একজন এক-একরকম। ঠিঁউউউ। হ্যাঁহ হ্যাঁহ হ্যাঁহ। হা হা হা হা। ফিঃ ফিঃ ফিঃ ফিঃ। ইয়াহ ইয়াহ ইয়াহ। খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক। খিক খিক খিক। হুমফ হুমফ হুমফ। ওঃ হোঃ হোঃ।
শাসমলের কাঁধে হাত রেখে আরেকটু প্রশ্রয় দিলে যিশু। এই লোকটা বুঝতে পারে না কনসালট্যান্ট কাকে বলে। ভাবে উপদেষ্টার আবার কী দরকার। উপদেষ্টার উপদেশের দরদাম শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে এর। আলু, ক্যাশিয়ারকে জমিদারি দিয়েছে, নায়েবি ফলাবার জন্যে। চলুন না, আপনার হিমঘরেই যাই, একটু বসা যাক, আরও একাধটা ব্যাপার জানবার ছিল, আপনার মতো অভিজ্ঞ লোক তো বড়ো একটা দেখলুম না এলাইনে, বলল যিশু। তারপর শাসমলের ইতস্তত-ভাব দেখে স্তোক দেয়, আমি তো সরকারি লোক নই, জানেনই তো আপনি, জাপানি কোম্পানিতে কাজ করি, জাপানি মেশিন কত ভালো হয়, জানেন তো।
বারাসাতের আলু ঘোটালার কথা ভালোই জানে যিশু। এ আর নতুন কী। প্রথম ট্রাম-পোড়ানো ছাইমাখা সাধুসন্ত আজ সর্বত্র। সত্তর হাজার বস্তা রাখার জায়গায় রাখা হয়েছিল এক লাখ কুড়ি হাজার। পঁয়ত্রিশ হাজার বস্তার তবু জায়গা হয়নি, বাইরে পড়ে-পড়ে নষ্ট হয়েছিল। শিলাবৃষ্টির মার খেয়ে এলিয়ে পড়েছিল বস্তাগুলো। কালোবাজারে পাঁচগুণ দামে বন্ড কেটেছে ইউনিট ম্যানেজারের চোখের সামনে। পিওনটা গ্রুপ থিয়েটার করে। ওদের দলটার নাম প্রতিবাদী সভা। আকাদেমিতে নীলদর্পণ-এ ভালো অভিনয় করেছিল, ক্লাস।
ওই অঞ্চলে, বারাসাতের ওদিকটায়, হিমঘরের ভরসাতেই অত আলু চাষ হয়েছিল, অথচ ঠাঁই পেল মহাজনের আলু। সব বামপন্হী আর রামপন্হী দলে চেয়ার আছে মহাজনদের। তারা তো আর আজকের লোক নয়। মেহনতি চাষি যে সত্যি-সত্যি এমনতর মেহনত করে ফেলতে পারে, মাটির উমে ঘাপটি মেরে আলুগুলো নিজেরাই টের পায়নি, আমলা-গামলা তো কোন ছার। বর্গা আইন পাস করলেই যেন সব হয়ে গেল, ব্যাস, ভূমিসংস্কার শেষ! খেতে-মাঠে যা ফলছে তার কী হবে? তার তো হিল্লে করতে হবে। মেয়ের বিয়ে দিতে তো ট্যাকা চাই। চাষির বুক চাপড়াবার শব্দ পৌঁছোয়নি কোথাও।
মন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশান দিয়েছিল চাষিরা। ম্যানেজিং ডিরেক্টার বেংকটরমণ এক-খেপ পরিদর্শন করেছিল। জেলাশাসক অরুণ মিশ্র বিভাগীয় ব্যবস্হা নেবার জন্যে প্রতিবেদন দিয়েছিল সরকারকে। পঞ্চায়েত সমিতির পৃথ্বীশ দে আর ব্লক আধিকারিক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় যথেষ্ট দৌড়ঝাঁপ করেছিল। অচলায়তন ভেঙে মুক্তধারা বেরোয়নি। জমিদারি উঠে গেছে, জমিদার ওঠেনি। হয়ত কোনও দিন উঠবে না।
বুজলেন বিসসেসবাবু, হিমঘরের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে বলল শাসমল, আমাদের এখেনে ট্রান্সফরমারের পোরসিলিন চুরি হয়ে দুদিন লাইট আসেনে, হেঁ হেঁ।
রাজনৈতিক ঋণমেলার ঠেলায় গ্রামীণ ঋণ বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বব্যাঙ্ক। মেলার মজা লুটল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র। নয়তো ঠিক সময়ে আরও কটা হিমঘর দাঁড়িয়ে যেত পশ্চিমবঙ্গে। এখটা হিমঘর বসাতে তিন কোটির মতন টাকা দরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে।
হিমঘরে পৌঁছে যিশু দেখল, শেডে এখনও শ’দেড়েক বস্তা পড়ে আছে। গোটা দশেক হাফল্যাংটো মুটিয়া ঘুমোচ্ছে। ওদের ঠোঁট থেকে শেষ তাড়িটুকু শুষে নিচ্ছে বেলে মাছির দঙ্গল। এলা মাটির ডাঁই। বাতিল আলু ছড়ানো-ছিটোনো চাদ্দিকময়। তার ওপর দিয়েই হেঁটে অফিসঘরে যেতে হল যিশুকে। একটা থনঝোলা বুড়ি সাদাকালো ছাগলি শুঁকে বেড়াচ্ছে বাতিল আলু, খাচ্ছে না।
লোক লাগিয়ে নিজেরাই হয়ত ট্রান্সফরমার খারাপ করিয়ে রাখে। আলু পচলে বিদ্যুৎ পর্ষদের ঘাড়ে দোষ চাপাবার সুযোগ থাকবে। একশো বত্রিশের তেত্রিশ কেভির ক্ষমতাসম্পন্ন। সোজা কথা নয়।
আপনাদের তো জেনারেটর আছে? অনেক হিমঘরে দেখেছি বিদ্যুতের চেয়ে ডিজেল সস্তা বলে অষ্টপ্রহর জেনারেটর চলছে, বলল যিশু।
স্টোরকিপার কৃপাসিন্ধু আশ এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আঁগগে ডিজেল ছেল না। রসুলপুর থেকে নিয়েলুম। আআআর বলেন কেন। তা ওইটুকুন শীত হিমঘরে ধরা থাকে। খেতি হয় না।
শাসমল পৈতেতে বাঁধা চাবি দিয়ে ক্যাশিয়ারের ঘরের তালা খোলে। শাসমলরা কি বামুন যে পৈতে পরে আছে? কে জানে, হবেও-বা। আদিত্য ভালো বলতে পারত। পলিশহীন আমকাঠের চেয়ার-টেবিল এলা মাটির ধুলোয় গেরুয়া। দেয়ালে সত্য সাঁইবাবার হাসিমুখ ঝাঁকড়াচুল ছবি। কোণে, মেঝেতে, স্টোভ। চা ফোটানোর অ্যালুমিনিয়াম ডেকচি। তলানিপড়া তিনটে খুদে মাপের কাচের গেলাস। মাছি অধ্যুষিত। প্লাসটিক বয়ামে চিনি, চা, গুঁড়ো দুধ।
চা খাবেন নাকি?
নাঃ। মুন্ডেশ্বরী পোলের আগে খেয়েছিলুম আসার সময়ে। এখন বরং এক গেলাস জল খাওয়ান।
কুঁজোর ওপর ঢাকা দেওয়া স্টিলের গেলাসে জল গড়িয়ে শাসমল বলল, অঅঅঅঅ। হরেন পাইকের ছেলের দোকানে। ভালো চা করে। ময়দার পরোটা আর আলুর দমটাও ভালো করে। হরেন পাইকের হাফু গান শুনলেন নাকি? হেঁ হেঁ।
যিশু স্তম্ভিত। হরেন পাইক? বাউল ভিকিরিটা চা-দোকানির বাবা। বাবা-ছেলের সম্পর্ক এমন স্তরেও পৌঁছোয়। মাই গড। বলল, হ্যাঁ, হাফু কিনা জানি না, নিজেই গান বেঁধেছে মনে হয়। একতারাটাও হাফুছাপ।
ওওওই যখন যা খবর হয় আর কী। শেষপুকুরে মেলা বসলেই আসে ফিবছর। থাকচেন তো, কাল, মেলায়? মেলাটা এবার জমবে না বোধায়।
কেন?
মহাজনের সঙ্গে দেকাদেকির ভয়ে চাষিরা আবার আসে কিনা দেকুন। ব্যাঙ্কের বাবুরাও তো একটা ঘর নিয়েচে।
শেষপুকুরে আসবার ন্যায্যতা প্রমাণের জন্যে, শাসমলের আর কৃপাসিন্ধুর কাছে যিশু যখন আবোল-তাবোল আগডুম-বাগডুম ফাঁদছে, পিওন মুরারি প্রামাণিক, শালপ্রাংশু ষাঁড়ের মতন নজরকাড়া ছাতি, বলল, আবনার সেই আলোজ্বলা ল্যাপটু টাইপযন্তরটা আনেননি এবার?
ল্যাপটপ? ওটা তো কমপিউটার। না, আনিনি। বলল যিশু। ল্যাপটপে খুশিদির ফোটো লোড করেছে ; এদের সামনে খোলা যাবে না আপাতত।
লেকালিকি সব হয়ে গেচে? বই হয়ে বেরোবে তো, না?
এই সামান্য কিছু বাকি। তাই তো এলুম আপনাদের কাছে। তারপর প্রশ্নমালার লাটাই থেকে সুতো ঢিলে করতে থাকে যিশু। উত্তরদাতাদের ঋতুবন্ধ খুলে যাবার আহ্লাদ।
এবার সবাই রাধাপদ্ম চাষের কথা ভাবচে।
রাধাপদ্ম? জানা নেই বলে ক্ষুণ্ণ হয় যিশু।
ও ওই সুযযোমুখি ফুল, বলল কৃপাসিন্ধু। তারপর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে প্রায় স্বগতোক্তি, আলুর বুক এমন টাটিয়ে উডলো গেলোবছর। আবনি হলেন গে রায়রাঁয়া লোক, দেকুন যদি চাষিদের কিচু উবগার হয়। কৃপাসিন্ধুর মুখে গরম বালিতে চাল ভাজার গন্ধ।
শাসমল পান্তা ব্রেকফাস্টের হাঁইইইই হাঁইইইই হাঁ-মুখ খুলে সুরেলা হাই তুলে যাচ্ছে কিছুক্ষন অন্তর। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা আলুর মধ্যে মুটিয়াগুলো সম্পর্কে উদাসীন একটা ডেঁপো ইঁদুর চষে বেড়াচ্ছে। আমোদে উড়ছে দুচারটে শুকনো আমপাতা।
গোগ্রাসে ছুটন্ত একটা রাতকানা ট্রাক চলে গেল। হাম্প ডিঙিয়ে, ডিগুম ডিগুম তুলে।
সবশেষে, আদপে যেটা জানতে চায় যিশু, সেই প্রশ্ন করে। আচ্ছা ভবেশকা কি বাড়িতে আছেন?
অ্যাই দ্যাকো অ্যাগবারটি। আগে বাড়ি যাননি? ভবঠাকুর তো আরামবাগ গ্যাচে খড়ের ছাতু কিনতে। ওই যে মাশরুম চাষের বীজ, তাই আনতে। তারোপোর পার্টির কাজ তো আচেই। ফিরতে সেই সোনধে। মুরারি প্রামাণিকের মিছিল-চনমনে উত্তর।
জবাবের আঘাতে টলে যায় যিশু। ওফ। গাড়িটা না ছাড়লেই হত। আজই ফিরে যেতে পারত। অনুশোচনার সর্পাঘাতে আক্ষেপের বিষ ছড়িয়ে পড়ে অস্তিত্বে। হিমঘর অফিসের দোরগোড়ায় কূট প্রশ্নের মতন শেয়ালকাঁটা। গেটের বাইরে রাস্তার ওপারে দুলছে অর্কমন্দারের জংলি ডালপালা। বকুলপাখিদের উচ্চবাচ্যে মুখরিত।
এরকম একটা জায়গায় রাস্তার ওপর স্পিডব্রেকারের হাম্প! না আছে কাছে ইশকুল, না আছে জনবসতি। হয়তো বা তোলা আদায়ের নতুন ধাঁচের জমিদারি খাজনা আদায়। হয়তো ভবেশকাই প্রথম তোলা-আদায় শোষণ-পাঁয়তাড়া আবিষ্কার করেছিল। তোলা আদায়ের খরচ মেটাতে পরিবার পিছু এক পয়সা। তাঁমার পয়সা চালু ছিল তখন। আর এখন গতিকে স্তিমিত করা আর রুদ্ধ করার নাম প্রগতি।
আত্মপ্রসাদে ভেজা কন্ঠস্বরে শাসমল বলল, চলুন না পৌঁছে দিই ; সাইকেলের পেচনের সিটে বসতে পারেন তো? বাকসোটাকে কোলে ধরে নেবেন, যা আগুনশর্মা চড়চড়ে রোদ।
সন্ধিক্ষণ। এ-ই তো সন্ধিক্ষণ। ভবেশকা নেই। সময়ের সম্রাজ্ঞী এখন খুশিদি। ওর পক্ষে অত্যন্ত হাস্যকর, সিটে বসে যেতে তক্ষুনি রাজি হয়ে যায় যিশু। কন্ঠের গোড়ায় লুকিয়ে থাকা আওয়াজহীন ঢক্কানিনাদ ঢিপ-ঢিপ করে ধাপে-ধাপে নেমে যাচ্ছে বুকের মধ্যে। জ্ঞান তো ক্ষমতার বনেদ। যে আবাদ করবে, সে-ই জানবে কেবল।
প্রকাশ করা যায় না এমন তীব্র আবেগের ধাক্কায় সারাটা পথ প্যাঙপেঙে সাইকেলের পিছনের সিটে চুপচাপ বসে থাকে ও, যিশু। আগে এরকম কখনও হয়নি। যৌনতা নয়। যৌনতা তো তৃপ্তির বাজারে অঢেল। ওর মাথার কাছে সঙ্গী এক হলুদ বোলতার বুঁবুঁবুঁ বুঁবুঁবুঁ সত্ত্বেও বসে থাকে কথাহীন উদ্বেগে।
বুজলেন যিশুবাবু, আমার মতন টাকমাতা লোকের আপনার অমন একরাশ চুল দেকে হিংসে হচ্ছিল, সেইটেই জানান দিচ্চে বোলতাটা। যিশু বলল, বোলতাটা আমার চুলের গোপন তথ্য জানতে পেরেছে বোধহয়!
দুপুরের রোদ এপাশ-ওপাশ আরম্ভ করেছে। হাসাহাসি করতে-করতে ইশকুল যাচ্ছে একদল ছেলেমেয়ে, খাতাপত্তর হাতে, ইশকুলই হবে, প্রাইমারি। জলতেষ্টায় দীর্ঘশ্বাস গেলে যিশু।
পাতাঅলা ফণীমনসার ঝাড়ের কাছে, মাটিতে বাঁ আর প্যাডেলে ডান পা, রোদের উষ্মা বাঁচাতে মাথায় ধুতির খুঁট, শাসমল বলল, ওই কলাবাগানে, ওই যে, গোলাপি-গোলাপি করমচা হয়ে রয়েচে, ওর পাশ দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই ভবঠাকুরের নাচদুয়োর।
পথের ধারে কচুরিপানা গিজগিজে জলায়, সংসার চিন্তায় এক পায়ে ঠায়মগ্ন মেছোবক। গঙ্গাফড়িঙের ঝিমুনির খাতিরে হাতের পাতা মেলে আছে জলকলমি।
ঠিকাছে, কাল সকালে একবার আসব। ভুরুর ওপর বাঁহাতের ছায়া ফেলে,ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে মুক্ত হল যিশু। শর্টকাটের বদলে ঘুরপথের মুখে ছেড়ে দিয়ে গেল লোকটা। এর চেয়ে তো একা গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেত আলের ওপর দিয়ে।
হাঁটছিল যিশু। কলাবাগান। রকমারি কলা। তেউড়ের ব্যবসা নিশ্চই। বেহুলা, মন্দিরা, বাতিসা, জাঁতিকোল, মালভোগ, কানাইবাঁশি, চিনিচাঁপা, জাহাজি, মনুয়া, ডয়বাকলা।
একজন আইধোইরা তেউড় চাপাচ্ছিল ভ্যান রিকশায়, জানতে চাইল, কটা বেজেছে এখুন। যিশু বাঁহাত নাড়িয়ে দেখায় ঘড়ি নেই। কাজ আরম্ভ করার মুহূর্ত থেকেই অনেকে চায় তা তক্ষুনি শেষ হোক। করমচা গাছের পর বড়ো-বড়ো পাটিগাছ। কুচবিহারের মাথাভাঙায় এর শেতলপাটি হয়, দেখেছে যিশু, একটা পাকানো পাটি উপহার পেয়েছিল, সেটা দিয়ে কার্পেটের কাজ চালায় ।
পাটিগাছের লাগোয়া দরমার বেড়ার ওপর সার বেঁধে ছড়ানিটিকার সংলাপ বলছিল ফাকতা পায়রাদের ভ্রাম্যমাণ দল। ফটফটিয়ে উড়াল দিলে অচেনা লোক যিশুকে দেখে। দরমার বেড়ার ভয়াবহ স্মৃতি থেকে মুক্ত হতে পারেননি ভবেশকা। কী ভয়ংকর এলাকা ছিল দরমার অভিশপ্ত কলোনিগুলো। খাস কলকাতার লোকে যেতে চাইত না ভয়ে। সন্ধে হলেই ময়ূরভঞ্জের রানির বাড়ি থেকে গোড়ে ওব্দি ওৎপাতা আতঙ্ক। মুসলমান ফুলচাষিগুলো গোড়ে গ্রাম থেকে পালাবার সময়ে গ্রামের নামটা নিয়ে পালিয়েছিল, গোড়ের মালার সঙ্গে-সঙ্গে। সেই গোড়ে এখন নোংরা ঘিঞ্জি গড়িয়া। ভাবা যায় না।
পরপর তিনটে ধানের মরাই পেরোয় যিশু। অব্যবহৃত পোর্টেবল শৌচাগার। ছায়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাটির খয়াটে প্রতিমার ভিড়, কয়েক বছরের খড় বেরোনো, আঁচ করে যিশু, বোধয় শনি, শেতলা, বিশ্বকর্মার, রক্তাল্পতায় জ্ঞান হারিয়ে নিমতলায় অপেক্ষা করছে প্রকৃতির দাপটের জন্য। তাদের ঘিরে কংরেস ঘাস। বকফুলের গাছ। কত্তো ফিকে সবুজ বকফুল। আশশ্যাওড়া, হিমচাঁপা, কোকিলাক্ষ করবী, বেগনে রঙের কলকে। পায়ের কাছে ফুরফুরে সুশনি-শাক।
পুকুরে চান করতে নেমেছে খুশিরানি মন্ডল।
.
১৯.
কে রে ওদিকে? তিরস্কার-মাখানো কন্ঠস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে অপ্রস্তুত খুশিদি। তাড়াতাড়ি জলে নেমে কেবল মাথাটুকু জলের ওপর। চুল ভাসছে।
আমি যিশু। যিশকা।
যিশু! তবে? কালকেই তো বৈশাখী পূর্ণিমা। আমি ভাবলুম….
কী করে ভাবতে পারলে খুশিদি?
আমি ভাবলুম আমার বয়েস ফুরিয়ে গেছে বলে..। খুশিদির মুখমন্ডলে ফোঁপানির পূর্বাভাস। প্রতিবিম্ব দোল খায়।
তা ভুল। অমন ভেবো না। তুমি অপূর্বময়ী।
তুই ঘরে গিয়ে জিরো। আমি একটা ডুব দিয়েই আসচি।
না, তুমি চান করো। আমি দেখব। ঘাটের সিঁড়িতে ব্রিফকেস রেখে বসে যিশু। জুতো-মোজা খোলে। পায়ের পাতা জলে ডুবিয়ে বসেছে।
অনেক অনেক অনেক অনেক বছর পর সাঁতার কাটছে খুশিদি।
বুকের গামছা ভাসিয়ে দিয়েছে খুশিদি। শায়াও নামিয়ে দিয়েছে ফাঁস খুলে। জলের চাদর গায়ে জড়িয়ে জলেতে খেলতে থাকে ছিপছিপে ঢ্যাঙা পেশল-গড়ন, খুশিদির একরাশ চুল।
অনির্বচনীয় স্পন্দন ওঠে জলতলে। পুকুরটাকে জুড়ে সমগ্র ভূমণ্ডল চাষি-মেয়ের আনন্দিত নিরাভরণে অভিভূত। নারীর তরল রূপ পায় জলখন্ডের অমেয় কায়াকান্তি। আসক্ত করে তোলে দশাসই চিতল আর কাতলদের। মৎস্যকুমারী খুশিদি একজায়গায় কিছুক্ষণ তলিয়ে গিয়ে দেদীপ্যমান করে তুলছে আরেক দিকের জল। তলিয়ে ভেসে না-ওঠা ওব্দি যিশু রুদ্ধশ্বাস।
হিরের টুকরোয় রুপান্তরিত জলের প্রাঞ্জল ফোঁটারা লাফিয়ে উঠছে বিশাল প্রজাপতির ডানার ঝাপটায়, তারপর ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে জলের ওপর পড়ে। বাতাস আচমকা নিরুচ্চার। রোমহর্ষে আক্রান্ত হয়েছে ঘাটের পাশে আমলকি পাতারা, নিঃশব্দ জলতরঙ্গের রিনরিন পাতায় পাতায়।
এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে, ওইদিকে, এইদিকে, চারিদিকে, যিশু যেদিকে তাকায়, পুকুরের জলকে উদ্ভাসিত করে তুলছে ত্বকের আলো। রোখ চেপে গেছে প্রথম অনর্গল উৎসর্জনের, নিজেকে উজাড় করার কমনীয়তা। নমনীয়তায় ভর করেছে আজীবন জমানো ব্যথা বেদনা পুলক অভিমানের ভাঁড়ার।
স্বতঃপ্রবৃত্ত পুকুর সাঁতরাচ্ছে খুশিদিকে ঘিরে, সারা গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে আপ্যায়ন। নারীর জ্যোতির্ময়ী আদলে রূপান্তরিত হয়েছে জলে আটক তরল দুপুর। আর জলেতে ছড়িয়ে দিচ্ছে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে এসে-পড়া সূর্যরশ্মির গুঁড়ো।
মুক্তি পেয়ে গেছে শাড়ি শায়া ব্লাউজ ভিতরের জামায় এতকাল অন্তরীণ দেহলাবণ্য। মুক্তি পাচ্ছে খুশিদের মাথার মধ্যে জমা উদ্দেশ্যহীনতা, অবসাদ, দিনানুদৈনিক।
দুই হাঁটুর ওপর দু’কনুই রেখে, দু’হাতের পাতায় দুই গালের ভার ছেড়ে দিয়ে, পায়ের পাতা জলেতে, ট্রাউজারের কানাত ভিজছে, যিশু শুনতে পায় নিজের হৃৎপিণ্ডের ক্বণ, নিক্বন, শিঞ্জন, শিঞ্জিনী। মসিদখানি, রেজাখানি শুনতে পায়। ঝাঁজ, ঝাঁজর, দগড়, চিকারি, খমক শুনতে পায়। দেখতে থাকে খুশিদির বিভোর ভাসমান বুক, জানু, মুখশ্রী, এলোচুল, অনাবিল ব্যাকস্ট্রোক, প্লবমান চিৎসাঁতার, উড্ডীন বাটারফ্লাই, অনুসন্ধানী ডুবসাঁতার।
এক ঘন্টা, হয়তো দু’ঘণ্টা হয়ে গেল, হুঁশ নেই। জলের সঙ্গে খেলছে চাষিমেয়ে। বাড়িয়ে তুলছে জলের তাপমাত্রা।
যিশু আমূল সন্মোহিত। পৃথিবীতে ভ্রুক্ষেপ বলে কিছু নেই। লবনাম্বু উদ্ভিদের জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গমের মতন ও, যিশু, টের পায়, অনুরণনের দপদপে লয়ে নিজের উদগ্রীব, থমথমে, উপদ্রুত আহ্বান। খুশিদির বয়েস একটা স্হিতিতে স্হির হয়ে আছে। তারপর আর বাড়েনি। খুশিদির চেয়ে ইতিমধ্যে বয়েস বেড়ে গেছে যিশুর।
শুশুকের মতন জলের পোশাকসুদ্দু আচমকা উঠে, বাঁহাতে গামছা আর শায়া, জলের তৈরি সলমা-সিতারায় ঠিকরোচ্ছে রোদ্দুর, জলের তৈরি স্বচ্ছ পুঁতি বেজে উঠছে প্রতিটি চুলের প্রান্তে, যিশুর কাঁধে ডান হাতের ভর দিয়ে, খুশিদি একছুটে গিয়ে দাঁড়াল ভাঁড়ারঘরের ছেঁচতলায়। ডাকে হাতছানি দিয়ে। দরোজার আগড় ঠেলে চলে যায় ভিতরে।
একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে স্পর্শ করলে গড়ে ওঠে এক ব্যাখ্যাহীন দায়দায়িত্ব।
এক হাতে জুতো জোড়া, আরেক হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঘরে ঢুকে যিশু দেখল উদোম খুশিদি চুল ঝাপটাবার আগে গামছা নেঙড়াচ্ছে। ভিজে চুলের প্রান্ত থেকে শানের ওপর টুং টাং টিং টুং ঝরে পড়ে মিহিন বাজনা-তরঙ্গ তুলছে পোখরাজের খুদে-খুদে পুঁতি। প্রতিটি জলফোঁটার পতনে, আশ্চর্য হয় যিশু, বালক-বয়সে শোনা মায়ের কন্ঠ আবছা ভেসে আসছে :
টুং : যিশকা, দুপুর রোদে টো-টো করতে বেরিয়ো না, জ্বর হবে।
টাং : ওদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা কোরো না যিশকা, ওরা হিদেন।
টিং : আজকাল যিশকা তোমার কথাবাত্রায় রিফিউজিদের মতন টান এসে যাচ্ছে।
টাং : তুমি নাকি দক্ষিণেশ্বরে হিন্দু টেম্পলে গিয়েছিলে যিশকা?
টুং : খুশির সঙ্গে অমন হাসাহাসি কোরো না যিশকা। ওরা ইল ম্যানার্ড, চাষাভুষো।
টিং : চাদর নোংরা হলে কাচতে বের করে দাও না কেন যিশকা!
টিং : যিশকা, অত বাংলা স্টোরি বুকস পড়ে সময় নষ্ট কোরো না।
টাং : তোমার চুল সবসময়ে অত আনটাইডি থাকে কেন যিশকা।
টুং : অত-অত ভাত ছোটোলোকরা খায়।
টিং : স্কুলের খাতায় ওসব হিজিবিজি লিখেছ কেন?
খুশিদির স্মিতস্নিগ্ধ আভায় ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে টলটলে শীতলতা। ঝিকমিক করছে কেশকূপ। অবিনশ্বরতার সমারোহ মনে হয়। চোখের তারায় আত্মগোপনরত রূপাতীত বিষাদের শিশিরবিন্দু ঝরে পড়ছে মেঝেয়। চোখ দুটো আরোগ্যকামনার মতন আয়ত। জুতো আর বাকসো মাটিতে রেখে লুই ফিলিপে আর পিয়ের কার্ডিন থেকে দ্রুত মুক্ত হয় যিশু।
দু’বাহুতে নিয়েই, আঃ, কী শীতল। একেই হয়তো প্রাণ জুড়িয়ে-যাওয়া বলে। শামুকের মাংসের মতন ঠাণ্ডা কোমলস্বভাব বুক। অস্ফুটস্বরে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিশি-পাওয়া প্রাণীর মতন স্পর্শেন্দ্রিয়। হৃৎস্পন্দনে থিরথির কাঁপছে ত্বক, চ্যাটালো নিম্ননাভি।
প্রায়ান্ধকার বিশাল ঘরটা, এ বাড়ির সবচেয়ে বড়ো ঘর, যেন নিঃসঙ্গ শোকসন্তপ্ত অচলায়তন। খেতমজুরের, চাষির আর শ্রমিকের হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি আর কাজের জিনিসে ঠাসা ঘরখানা।
আষ্ঠেপৃষ্ঠে, চাউনির ওপর চাউনি মেলে, শুকনো স্পর্শের ওপর ভিজে স্পর্শ সামান্য তুলে খুশিদি বলল, হ্যারে যিশকা, সকাল থেকে কিচু খাসনি বুজি? মুখ থেকে খিদের গন্ধ বেরুচ্চে? সিগ্রেটের গন্ধও বেরুচ্চে। তোর গা কী গরুম!
হ্যাঅ্যা গো, খাইনি কিছু। সত্যি, তুমি আমার মা আমার দিদি আমার বউ আমার বন্ধু আমার গডেস, সবকিছু। ডেঁড়েমুশে আদর করছিল যিশু। গতরের মোহময় নিভৃতি জুড়ে চারিয়ে দিচ্ছিল এক্তিয়ার, যথেচ্ছ প্রবণতা। দু’গাল ভাত বসিয়ে দিই। আরেকবার নেয়েনে।
সৌজন্য জানাবার ভঙ্গীতে, ঘরের মেঝেতে ডাঁই-করা মাছ ধরবার জালের ওপর এলিয়ে পড়ে খুশিদি। দেয়ালে খুঁটিতে, কোণে, মেঝের ওপর, বেড়াজাল, বিনজাল, পাঁতিজাল, খেপলা জাল, কুঁড়ো জাল, ভাসা জাল, চুনো জাল, টানা জাল, শ্যাংলা জাল, উঁখা জাল, ধর্ম জাল, খেটে জাল, বেঁওতি জাল, ঘুরণ জাল, ওঃ, কতরকমের আঁশটে গন্ধের জাল!
অ্যাতো জাল কী হয় গো?
ভাড়া খাটে।
ভাড়া?
হ্যাঁ, মাঝি জেলে মালোরা নিয়ে গিয়ে মাছ ধরে। খালে বিলে পুকুরে দামোদরে যায় গঙ্গায় যায় সমুদ্দুরে যায়।
যিশু চুপসে যায়। সেই ভবেশকা। শ্রমিকদের আর শোষিতের নেতা ভবেশকা। আজকে তাদের হাতিয়ারকে ভাড়া খাটাচ্ছে। এই ঘরের সবই ভাড়ার, অবিশ্বাস্য। লাঙল, জোয়াল, ডিজেল-পাম্পসেট সব, সব, সব ভাড়া দেবার জন্যে।
ওই পেতলের ঘড়াগুলো? ওগুলোও ভাড়া দেবার?
না, ওগুলো বন্দকি। চাষি বউরা, মুনিশ বউরা বন্দক রেকেচে।
বন্ধক?
বন্দক জানিস না? বনদোওওওক বনদোওক। ঘড়া-বাসন বাঁধা দিয়ে ট্যাকা ধার নিয়েচে।
সুদে টাকা নেবার জন্যে?
হ্যাঁরে। একশো ট্যাকায় মাসে দশ ট্যাকা।
মাসে?
হ্যাঁ, মাসেই তো। কেন?
ঘড়াগুলোর ওপর, যেগুলো খুশিদির মাথার কাছে রাখা, দেখতে পাচ্ছিল যিশু, তাতে ছোটো-ছোটো কাগজ সাঁটা। কাগজের ওপর নাম আর তারিখ দেওয়া। লক্ষ্মী লোহার। পদ্ম মান্না। বিবিজান। রাধা পোড়েল। চম্পা সাঁপুই। কনকবালা দাস। আশা ঘরামি। আরও অনেক অনেক অনেক অনেক। পিতলের বাসন চিরকাল থেকে যাবে। মন খারাপ হয়ে যায় যিশুর।
তোমার পিঠে ফুটছে না তো? উষালগ্নের মতন বাহুমূলে ছোঁয়া বুলিয়ে জানতে চায় যিশু। দৃশ্যমান জগৎ থেকে এই ঘরের বস্তুপৃথিবীকে অস্বীকার করার জন্য ও চোখ বোজে।
খুশিদির চাউনি হিমায়িত, শ্বাস গনগনে, খিদের গন্ধের খোঁজে পুরুষের হাঁ-মুখে নারীর অনাস্বাদিতপূর্ব জিভ। গলা-কাটা মোরগের মতন কেঁপে ওঠে শরীর। সাপ যেভাবে জিভ দিয়ে গন্ধবস্তুর কণা বাতাস থেকে তুলে নিয়ে নিজের ঘ্রাণিকা ইন্দ্রিয়ের গ্রন্হিতে মাখিয়ে নেয়, ওরা দুজনে একে আরেকের ভারাতুর অনুভূতি মেখে নিচ্ছিল অসংলগ্ন কথাবার্তা দিয়ে। প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে ওদের হাত, ভক্তিনম্র স্পর্শ।
কাল, বৈশাখী পূর্ণিমার সন্ধ্যায়, শেষপুকুর ছেড়ে যাবার বিস্তারিত পরিকল্পনা শুনে খুশিদি বলল, আমার তো কেমন যেন ভয় করচে, আজগে এক্ষুনি চলে গেলে ভালো হতো। শুনে আবার অনুশোচনা হল যিশুর। গাড়িটা রেখে দিলেই হতো বরং। খুশিদির ভয়ের যে কী আছে এই বয়েসে।
তোমাকে তো জোর করেই নিয়ে যেতে পারি।
না না না না না না।
অদ্ভুত, সত্যি। ভাবল যিশু। পশ্চিমবাংলার গ্রাম মানেই ভয়ের চক্রব্যূহ।
এ-ঘরেই শুস তুই যিশকা। থালে দাদার সন্দেহ হবে না। মশারি টাঙিয়ে দেবোখন রাত্তিরে। তুই যদি পালটি ঘর হতিস কত ভালো হতো থালে।
পালটি তো। তুমি মেয়ে, আমি ছেলে।
খুশিদি ওঠে ওভাবেই, নিরাবরণ, খাটের ওপর রাখা জালগুলো নামায়। খাটের তলায় রাখা মরচে-পড়া হাতুড়ি দুরমুশ কাস্তে করাত কাটারি উকো নিড়ুনি হেঁসো টাঙি বল্লম খন্তা গাঁইতি দাউলি কোদাল ঠিক করে সাজায়। ঘরের মাঝে রাখা ডালা কুলো ডাবড়ি চারি সিউনি তসলা ধামি এক-এক করে এক পাশে সরিয়ে গুছিয়ে রাখে। কাজের দ্রুততায় যিশু অবাক, মুগ্ধ। ঘেমে গেছে।
ছাদ-পাখার সুইচ টিপে খুশিদি বলল, ঠিকাছে, চলছে, রোজই তো অ্যাগবার দুবার ঢোকে দাদা।
জিরিয়ে নাও একটু, ক্লান্ত হয়ে গেছো।
যাঃ দাঁড়া, চাদর তোশক বালিশ আনছি। তুই ততোক্ষণে পুকুরে একডুব দিয়ায়।
চান তো করেই বেরিয়েছি সকালে। আরেকবার তোমাতে ডুব দিই। দখলের অপ্রতিরোধ্য চাহিদায় যিশু বাহুবদ্ধ করে খুশিদিকে। বিচ্ছুরিত ঘামসুগন্ধের আ-আলজিভ ঘ্রাণ নিলে। ওর হাতের ঔৎসুক্য ফুরোয় না।
যাঃ, শরীর খারাপ হবে। খালি পেটে রইচিস না।
হলেই বা। নিষেধ থাকলেই ভাঙতে হয়।
আচ্ছা, সেবার যেসব মন্তর আমার জন্যে পড়েছিলি, সেগুলো আরেকবার বলবি? যিশকা?
যিশু কাঁধ কাঁপিয়ে হাসে। নতজানু, জড়িয়ে ধরে উতলা আগ্রহে। বলে, তুমি শান্ত, তুমি দাস্য, তুমি সখ্য, তুমি বাৎসল্য, তুমি মধুর। যিশু উঠে দাঁড়ায়।
দেহের হালকানো ভার যিশুর ওপর ছেড়ে দিয়েছে খুশিদি। আর খুশিদি, নিঃশব্দ কান্নায় কেঁপে-কেঁপে আপ্লুত করছে ওকে। খুশিদির চোখের জল নিজের গালে অনুভব করে যিশু। জিভ দিয়ে কান্নায় নুনের স্বাদ পায়। খুশিদির থুতনিতে টোল। কাঁপছে।
চুপ করলি কেন? আরও বল, যিশকা।
তুমি অনিমা, তুমি লঘিমা, তুমি গরিমা, তুমি প্রাপ্তি, তুমি প্রকাম্য, তুমি ঈশিত্ব, তুমি ঈশিত্ব। এসব মন্তর যিশুখ্রিস্টের মায়ের জন্যে।
সে কে?
আমার মা-বাবার ভগবান। যিশু কৈশোরের স্মৃতিতে যেতে চেষ্টা করে।
চুপ করে গেলি কেন? চুপ করিসনি। বল। বলতে থাক। যিশকা।
তোমার ডান কাঁধে পোকা কামড়াল বোধয়। লাল হয়ে গেছে।
ওটা জড়ুল। জন্মে ওব্দি আচে। তুই থামলি কেন? খুশিদির কন্ঠস্বরে ভাঙন।
তুমি মঙ্গলা, তুমি বিজয়া, তুমি ভদ্রা, তুমি জয়ন্তী, তুমি নন্দিনী, তুমি নারসিংহী, তুমি কৌমারী। কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর শেষতম নিদানের মতন যিশুর ফিসফিস, আর কত কষ্ট পেতে চাও খুশিদি? কেনই বা চাও?
খুশিদি সটান দাঁড়িয়ে আছে চোখ বুজে, ওপর দিকে মুখ, চাষি-মেয়ের শ্রমসোহাগী পেশল বাহু ঝুলে আছে দু’পাশে, কাঁধে এলিয়ে নামা ভিজেচুলে বুক ঢাকা, নাভির ঘাম শুকোয়নি এখনও, পায়ের গোছ আর পাতা জুড়ে অনুপম কৌলিন্য।
মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে যে সত্তা, তার দুর্নিবার ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে পরিচিত হয় যিশু।
.
২০.
বুকড়ি চালের ভাত আর আগাছা ট্যাংরার ঝোল খেয়ে, অবেলা ওব্দি ক্লান্ত ঘুম থেকে উঠে, দাওয়ায় বেরিয়ে যিশু দেখল, হাতল-আলা চেয়ারের পিছনের দু-পায়ায় ভর দিয়ে দোল খাচ্ছে ভবেশকা। কালো ভারিক্কি চশমা। বাঁ পায়ে ভয়ানক ঢেউ-খেলানো গোদ।
ভবেশকার পায়ে গোদ! ভাবা যায়? লাফিয়ে উঠে যেত পুলিশের ভ্যানে। মিছিলের নেতৃত্বে হেঁটে চলে যেত এসপ্ল্যানেড ইস্ট পর্যন্ত। একবার তো কলেজ স্ট্রিটে বাসের ছাদ থেকে রাস্তায় নেমেছিল লাফিয়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছেলেরা দেখেছিল, অ্যালবার্ট হল কফিহাউসে বসে গল্প করেছিল বহুকাল ওব্দি। গোদের জন্যই বোধয় গেরুয়া আলখাল্লা। আলখাল্লার জন্যে সত্য সাঁইবাবা।
জলেতে ভুরু ভাসিয়ে-রাখা কুমিরের মতন চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে চোখ তুলে নাকচ-করা দৃষ্টি মেলে, সর্দিগর্মিতে নাকবন্ধ গলায় ভবেশকা বলল, কী এখনো আলুর রিপোর্ট ফাইনাল কত্তে পাল্লে না? কী-ই বা আচে এতে? আমি তো অ্যাক দিনে লিকে দিতে পাত্তুম।
এরম অনেক মানুষ আছে। জানতে না চাইলেও নিজের বিষয়ে বলবে। গতবার তারকেশ্বর লোকালে, ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি ভিড়ে ওর, যিশুর, গায়ের ওপর দাঁড়িয়ে এনতার কথা বকছিল দুজন বউড়ি যুবতী। ছোট্টখাট্ট গোলগাল, অত্যধিক সিঁদুর।
যিশু বসেছিল, আর ওর দিকে মুখ করে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে, ওর কাঁধের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে জাল আঁকড়ে। ওদের নির্ভেজাল অতিমাংসল বুকে যিশুর নিশ্বাস পড়ছিল নিশ্চয়ই।
চানাচুর চিবোবার শব্দের মতন ওদের একজন বলে উঠেছিল, আমি তো অ্যাকদোম সেন্টটেন্ট মাকি না। যিশুর বিদেশি পারফিউমের প্রতি কটাক্ষ। দার্শনিক গাম্ভীর্যের আড়ালে যিশু বুঝতে পারছিল, এদের মাংসের ঘর্মাক্ত অকৃত্রিম গন্ধ যদিও ওর খারাপ লাগছে, তবু তা এক ঝটকায় বিপথগামী করে দিতে পারে। ওদের লাল ব্লাউজের আহ্বায়ক বাহুমূলের টানটান সাদা সুতোর সেলাই, যিশুকে চোখ বুজতে বাধ্য করেছিল।
বউ দুটির তক্কাতক্কি, কার জামাইবাবু শালির পেটে বাচ্চা এনে ফেলেছিল, দোষ তিনজনের মধ্যে কার, এখন কী করণীয়, তাই নিয়ে। কইকালার ঘরজামাই নিতাই সাহা। শালি, একমাত্র, কণা। বউয়ের নাম আলোচনায় আসেনি। ওদের গল্পের থুতুর ছিটে লাগছিল নিরুপায় যিশুর মুখে-হাতে-গলায়।
হাওড়ায় নামার সময়েও নিষ্পত্তি হয়নি কার আত্মহত্যা করা উচিত, তিন জনের মধ্যে কার। প্ল্যাটফর্মে পা দিয়ে, ওদের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে যিশু আলতো শুধিয়েছিল, দুজনকে দুপাশে নিয়ে শুক না নিতাই, ঘটেই যখন গেছে ব্যাপারটা।
এখন, এই মুহূর্তে, ভবেশকার কথার কী উত্তর দেবে? ভবেশকা বোধহয় দুর্ব্যাবহারের সম্ভাবনা গড়ে তোলার লোভে পড়েছে। কারণ, মনে হয়, আলু। একদা হুগলি জেলার কংরেসিরা বাজার থেকে আলু লোপাট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে আস্তিন গুটিয়ে বাসে-ট্রামে আগুন ধরিয়ে গুলিতে মরার জন্য রাজপথে নেমেছিল পরোয়াহীন যুবক ভবেশকা। আজ পায়ে গোদ, গেরুয়া, বাবরি চুল, আলখাল্লা, বুড়ো, মহাজন, ভূস্বামী, আঙুলে গ্রহরত্নের রুপোর আংটি, ধর্মগুরু, দলাদলি, ভবেশকার কিচ্ছু যায়-আসে না। হাজার-হাজার কুইন্টাল আলু পচলে, আলু-চাষি সর্বস্বান্ত হলে, আলুর দাম পাকা বাজারি-কাঁচাবাজারি দাঁওপ্যাঁচে নিম্নবিত্তের পক্ষে অসহনীয় হয়ে গেলেও কিচ্ছু যায়-আসে না।
পচা আলু আসা আরম্ভ হয়ে গেছে শহরগঞ্জের বাজারে। চাষিরা গোর দিচ্ছে।
নির্লিপ্ত নির্বিকার নৈর্ব্যক্তিক মহারাজ ভবেশকা বসে আছে প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবকত্বের জাদু-সিংহাসনে, নাক ফুলিয়ে, হাসি নেই। জিভের ভাষায় আড় পর্যন্ত পালটে, করে ফেলেছে স্হানীয়। পায়ের গোদে হাত দিয়ে হিন্দুয়ানি প্রণাম করে যিশু বলল, প্রান্তিক চাষিদের সার আর সেচের চাহিদা-জোগানের ব্যাপারটা দেখিনি তখন, আজকে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে নেব। তুমি ভালো আছ তো? কথাগুলো বলতে-বলতে যিশু দেখল বারান্দায় ঘটি আর জলভরা বালতি রাখা রয়েছে। গোদ-ছোঁয়া হাতটা ধুয়ে নিতে হবে।
আমি? হঁ। আরে আমরাই তো সব কল্লুম, নইলে কোতায় থাগতে তোমরা আজগে? তা ভেবে দেকেচো? এই যে ধরনা, ঘেরাও, বয়কট, অবরোধ, ধীরে চলো, কর্মবিরতি, র্যালি, সমাবেশ, হরতাল, পথসভা, গেটসভা, এইসব? এই সব গণতান্ত্রিক হাতিয়ার? এসব চাড্ডিখানি কতা নয় হে।
নদী যেভাবে নিজের ঘোলাস্রোতে গা এলিয়ে দেয় বর্ষার বাজে কথায়, ভবেশকা, দরবেশ-পোশাক ভবেশকা, বলে যায় নিজের অভ্যস্ত গল্প। নিমের দাঁতনের মতন অতীতকে চিবিয়ে-চিবিয়ে ছিবড়ে বার করে ভবেশকা। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, থামে হেলান দিয়ে শুনতে-শুনতে, খেই হারিয়ে ফেলে যিশু। ওর চারপাশে ওড়ে খোশমেজাজ বুদবুদ।
আচমকা একটা কোকিল ডাকতে আরম্ভ করে। উত্তেজনার পর্যায়ে উঠে যায় পাখিটার ডাক। ভবেশকাকে বাধ্য করে রোমন্হন পালটাতে। তোমার জন্যে কামারপুকুরের বোঁদে আর সিঙুরের দই আনিয়ে দিয়েচে কৃপাসিন্ধু, জলখাবারে খেয়ে দেকো। আর খানাকুল থেকে কালাকাঁদ আনতে বলেচি বিষ্ণু সাঁবুইকে।
যিশু ফিরে আসে সম্বিতে। মিষ্টিগুলোর নামের মধ্যে মিষ্টিগুলো আর নেই। শব্দের মানে ব্যাপারটা পশ্চিমবঙ্গে আজ মৃত্যুশয্যায়।
ও, যিশু, দেখল, আর্কাজাতের করলার জন্যে টাঙানো তারের মাচার তলায় ঢুকে, বেলে-দোআঁশ মাটিতে বসানো হলুদ চারার কেয়ারি বাঁচিয়ে করলা লতার শুকনো পাতা ছাঁটাই করছে খুশিদি, কুঁজো বুড়িদের মতন ঝুঁকে। খুশিরানি মন্ডল। পনেরো থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বয়সের স্হিতিস্হাপকতাকে ইচ্ছেমতন নিয়ন্ত্রণ করে খুশিদি। বিশুদ্ধ আকর্ষণ ছাড়া বিশুদ্ধ যৌনতা হয় না। কীভাবে, কোথায়, মুলতুবি ছিল এই আকর্ষণ? মস্তিষ্কে? হবেওবা।
আচ্ছা ভবেশকা, তুমি নিজেও বিয়ে করলে না, খুশিদিকেও আগলে-আগলে রাখলে, বিয়ে দিলে না। কেন বলো তো? যিশুর অযাচিত প্রশ্নে আপ্রস্তুত ভবেশকার চকিত চমক। যেন এই প্রশ্নের উত্তর আজীবন লুকোতে-লুকোতে নেশা ধরে গেছে কোনও গোলকধাঁধার আমোদে।
হরিণের উৎকর্ণ মাথা নাড়িয়ে খুশিদি রান্নাবাড়ির দিকে চলে যায়।
ভবেশকা দু-হাত সামান্য তুলে ঘোরায়। বলল, লোকে করলা, লাউ, কুমড়ো, চিচিঙে, ঝিঙে গাছে আজগাল ডিডিটি আর বিএচসি দিচ্চে, ভাবদে পারিস, অ্যাঁ? দেকগিজা, দেকগিজা, আমার মাটিতে লেদা, চুঙি, পাতামোড়া, কুরনি, গণ্ডারে, কাঁটুই কোনও পোকা পাবি না তুই। হাতের তালুতে আগুনে-বাত হয়ে চামড়া উঠছে ভবেশকার, বলল, পানের চাষও করেছিলুম, বুজলি, আংরা দাগ ধরে বড্ডো, নইলে…
জবাজবদিহি চেপে রাখত চাইল না যিশু। আত্মতৃপ্ত প্রশান্তি থেকে নাড়া দিয়ে ভবেশকাকে টেনে বের করার চেষ্টায় নাছোড়, অস্বাভাবিক প্রত্যয়ের সঙ্গে জানতে চায়, কই বললে না তো, সংসার পাতলে না কেন? সামান্য থেকে, সতর্কতা মিশিয়ে সন্তর্পণে যিশু বলল, খুশিদিরও বিয়ে দিলে না কেন?
যিশুর দিকে না তাকিয়েই হাসল ভবেশ মণ্ডল। পরস্পরকে বিব্রত করার মতন কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। থামে হেলান দিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় যিশু। হাসনুহানার নিরিবিলি গন্ধের বিচ্ছুরণে দুজনেই টের পায়, সন্ধে নেমেছে বহুক্ষণ। জুনিপোকার উড়ন্ত আলোয় ধুকপুক করছে অন্ধকার। নিষেকের পর করলা-ফুলের ডিম্বাশয় চুপচাপ রূপান্তরিত হচ্ছে ফলে।
চেয়ার থেকে তার ক্যাঁঅ্যঅ্যঅ্যচ শব্দটা নিজের পাছার সঙ্গে তুলে নিয়ে ভবেশকা বলল, ভবিতব্য হে ভবিতব্য। যেন ভবি আর তব্য আলাদা-আলাদা।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যিশু দেখতে পায় মশারির বাইরে খুশিদি। উঠে এসেছে নিজের ঘর থেকে। অনুচ্চস্বরে বলল, যিশকা, সরে শো, একটু জায়গা দে।
এত অস্ত্রশস্ত্রের ঘরে কেন শুতে দিলে খুশিদি? জিগ্যেস করেছিল যিশু, যখন যিশুকে করলা-ফুলের পরাগ মাখিয়ে আর নিজে কাকভোরের বাতাস মেখে চলে যাচ্ছে খুশিদি। আর খুশিদি বলেছিল, শিয়োরে লোহা নিয়ে শুলে ভুতপেত দূরে থাকে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল যিশু।
ঘুম ভাঙলে যিশু শুনতে পায় খুশিদির একটানা কন্ঠস্বর:-
কোতায় আচো গো মাতা লক্ষ্মী দয়াবতী
কাতরে তোমার পায়ে করিগো মিনতি অ্যাকেতো অবলা মোরা তাতে ভক্তিহীন বিদ্যেবুদ্ধি শক্তিহীন সদা অতি দীন
না জানি করিতে স্তুতি না জানি পুজোন কেমনে তোমারে মোরা করি আবাহন কেবলি ভরোসা মনে ইহা শূন্য আচে যে তোমাকে ডাকে তুমি যাও তার কাচে নিজ গুণে কিপা করি বসিয়ে আসনে কিপা দিষ্টি করো মাগো যতো ব্রতীজনে এই মাত্র বর তুমি দেও গো সবায় সতত ভকোতি যেন থাকে তব পায়
লক্ষ্মীর রেফারেন্স রয়েছে যখন, তার মানে এটা বোধহয় পাঁচালি, শুনে-শুনে মুখস্হ করে ফেলে থাকবে খুশিদি। এভাবে দিনের পর দিন মুখস্হ বলার কথাগুলোর কোনও মানে কি আর আছে খুশিদির কাছে? যিশুর মনে হল এ যেন খুশিদিরই বন্দনা। অজানা কোনও কিছুর প্রতি খুশিদির এই প্রগাঢ় আত্মসমর্পণ আর বিশ্বাসের ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তার জন্যে হিংসে হয় যিশুর।
কত লোক, হাজার-হাজার লোক, ইদের দিন নামাজ পড়ে। রবিবারের দিন চার্চে হাঁটু গেড়ে হাতজোড় করে বহুক্ষণ নিঃশব্দ প্রার্থনা জানায়। মন্দিরের সিঁড়িতে বহুক্ষণ যাবত মাথা ঠেকিয়ে থাকে। বিভোর হবার মতন ওই বীজ, খুশিদির সংস্পর্শে এসে, খুশিদির জন্যে, নিজের সত্তায় আবিষ্কার করে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল যিশুর।
বিছানা ছেড়ে জামাকাপড় পরে যিশু বেরিয়ে পড়ে গাঁয়ের আঁদুল-কাঁদুল ঘুরতে। ফেলে-ছড়িয়ে রোদ উঠেছে। রোদ্দুরের ভয়ে বটগাছটার ছায়াসঙ্গিনী তখনও ওর তলা থেকে বেরোয়নি। বুড়োশিব ঢাকা পড়ে আছে শুকনো বটপাতায়। কিংবা এখু পার্বনহীন অনাদরে শেষনাগ হয়ে আছে। পাতাগুলো ওপর থেকে কয়েকটা সরিয়ে দিল যিশু। পিঁপড়ের কাতার। সাতসকালে কেউ এসে চিনিগোলা দুধ ঢেলে থাকবে। গাছটার ডালে ডালে বুনো মউমাছির চাকগুলো থেকে একাধ কুইন্টাল মোম বেরোবে। কত লিটার মধু আছে কে জানে। বটগাছটা মধু চায় না।
মন্দিরে পুজুরিটা একা। দেবতার সাজগোজ চলছে। মেলার দোকানপাট অগাধ ঘুমে। তালটিকুরির দিকটায় দার্শনিক উদাসীনতায় হাগতে বসেছে বুড়ো আর জোয়ান। যাত্রাদল আসছে মেলায়। মুনমুন সেন আর তাপস পালের গালফোলা পোস্টার। যাক, ভালোই, বিকেল থাকতেই পুরো তল্লাট ছেয়ে যাবে অচেনা গাদাগাদি ভিড়ে। লাঙল আর জোয়ালের কাঠ কিনতে আসে মেলাটায় দূরদূর থেকে চাষিরা। বেগমপুর আর গুপ্তিপাড়া থেকে সং আসে। ঘন্টাকয়েক পর থেকেই লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়ে যাবে মেলায়।
ভোরের আলোর কুচিকুচি ঢেউ যিশুর চোখেমুখে ঠাণ্ডা হাওয়া মাখাচ্ছিল।
চারিদিকে মূষিক প্রসবকারী গর্ত। সারোতা, গোপের হাট, খেমাপাড়া, তেঘাট যাবার ছক্করগাড়ি আর ভ্যান-রিকশা এই ভোর থেকেই। রাস্তা পার হচ্ছিল একজন বুড়ো চাষি। হাতে ধরা দড়িতে রোগাটে দিশি গাই, পেট ঢোকা, পাঁজর জিরজিরে। যিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, গোরুটার আওয়া হয়েচে, গুয়াবুড়ি শাগ খাওয়াতে নে যাচ্চি। রোগ আর তার ওষুধ, দুটোর কিছুই জানে না যিশু। কী বলবে? রাস্তার পাশে হিলুয়ার ভূঁয়ে নেমে-পড়ে ফিতে-কৃমিতে ভোগা গতরের বৃদ্ধ আর তার গাই।
রাস্তার দু’ধারে আলুর বস্তা, একের ওপর আরেক, গোটা বিশেক করে, পড়ে আছে হিল্লে হবার অপেক্ষায়। কবে হবে কে জানে। পাহারা নেই। রাস্তার কিনার-বরাবর একের পেছনে আরেক চাষি বা খেতমজুর, লুঙ্গি-গেঞ্জিতে, সাইকেলে তিনটে বস্তা চাপিয়ে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে, ভারসাম্য বজায় রেখে। কে জানে কোথায় যাচ্ছে। মুখ খুলে কথা বললেই কাহিল হয়ে পড়বে লোকগুলো।
মোড়ের ঝুপড়িতে বসে চা আর ভাণ্ডারহাটির রসগোল্লা খায় যিশু। মহানাদের খাজাও ছিল। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে চমচম খেতে ভালোবাসত খুশিদি। ছবি বিশ্বাসের বাড়ির পাশেই ছিল ময়রার দোকানটা। খ্রিস্টান চরিত্রে অভিনয়ের খুঁটিনাটি জানার জন্যে ছবি বিশ্বাস বাবার কাছে এসেছিল কয়েকবার। এখানে ভবেশকার বাড়িতে চায়ের ব্যবস্হা নেই। এককালে চায়ের পর চা না হলে ভবেশকার গলায় বক্তৃতা আটকে যেত। ভবেশকাদের যুগের আগে এমন ছিল যে ফরসারা কালোদের, ঢ্যাঙারা বেঁটেদের, শহুরেরা গেঁয়োদের, সবর্ণরা অন্ত্যজদের, পয়সাঅলারা গরিবদের, ধোপদুরস্তরা নোংরাদের, টেরিকাটারা উস্কোখুস্কোদের, রাজনৈতিক বক্তৃতা দিত। এখনও আছে অনেকটা। অ্যাবং, অ্যাবং, অ্যাবঙের শিকলি জুড়ে-জুড়ে কজনই বা অবিরাম বকে যেতে পারে। বাংলাভাষাটা তো আর সব বাঙালির নয়। বেশিরভাগ লোক তো স্যাঙাত হয়ে ল্যাঙাত খায়।
চা খেয়ে, গোপের হাটের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে, একটা পেঁপে বাগান দেখতে পেয়ে, গাছে-গাছে কুর্গ-হানিডিউ জাতের সোমথ্থ পেঁপে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যখন মনে-মনে প্রশংসা করছিল যিশু, বাগানের ভেতর থেকে দোহারা যুবক, জিনস প্যান্টে গোঁজা হাতকাটা গেঞ্জি, শহুরে স্মার্ট চেহারা, ডাকে ওকে, আপনি তো স্যার ভবঠাকুরের আত্মীয়, শুনেছি, হিমঘর নিয়ে গবেষণা করছেন।
যিশুর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে ভয়। মাত্র ক’দিনে লোকে ওর গতিবিধির সঙ্গে পরিচিত। ভাগ্যিস মেলা আর যাত্রার ভিড় থাকবে, নইলে বিপদ অনিবার্য। গ্রামে আর ঘোরাঘুরি চলবে না। বহিরাগত সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা আর ঔৎসুক্য থাকবেই। যিশু বলল, দু-আড়াই কেজির ফল হয়, না?
যুবক তার গাছের অস্মিতা ধার করে। আজ্ঞে স্যার তিন কেজি ওব্দি হয়। যিশু এর পর মাটি আংলানো, বীজে সেরেসার ড্রাই মাখানো, মাটি চৌরস, নুভাক্রন স্প্রে, হাওয়া-পরাগি ফুল, কত মাদিগাছের জন্যে কটা নরগাছ, তরুক্ষীরের পেপেন, লালমাকড়, কুটে রোগ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত প্রশ্নের সিরিজ সহযোগে যুবকের মনে শ্রদ্ধা তৈরি করলে, যুবক ওকে তাদের বাড়ি যেতে বলে। ওই তো, দেখা যাচ্ছে, স্যার আসুন না।
আরেকদিন কখনো, জানিয়ে, ফেরার রাস্তা ধরে যিশু। জানা রইল বাড়িটা, দরকারে কাজে লাগবে। কিন্তু ও খ্রিস্টান জানলে পুরোটা শ্রদ্ধা কি বজায় থাকত? ভবেশকাই হয়তো সিংহাসনচ্যুত হয়ে যাবে, জানাজানি হলে। ভবেশকাও বলবে না কাউকে।
ফিরে, যিশু দেখল, জাবেদালি এঁড়ে বাছুরটার লাফঝাঁপ সামলে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। ভাগচাষিদের গ্রামীণ রাজনীতির বখরা দিয়ে বর্গা এড়াবার কায়দা করে ফেলেছে লোকে। ভবেশকার পরিবার বলতে কেবল ভাই-বোন। জাবেদালি ক্ষমতার বখরাটুকুতেই তৃপ্ত। অনেক জায়গায় তো ভাগচাষ এড়াতে লোকে এড়িয়ে যাচ্ছে চাষবাস, ইউকালিপটাস পুঁতে ফেলছে, অথচ এখানেই পোলবা থানার হালসুই গ্রামে প্রথম বর্গা ক্যাম্প বসেছিল। হিমঘরের আলু পচিয়ে সেই পোলবা আজ জগদবিখ্যাত, সত্যিই জগদবিখ্যাত। পচা আলু থেকে চামড়ায় রোগ ধরেছে চাষিবউদের ; সারছে না।
জাবেদালি জানালে, ভবঠাকুর হিমঘরে গেছে, যিশু যেতে পারে যাবার থাগলে।
হৃৎপিণ্ডে সমুদ্র চলকে ওঠে, শব্দ শোনা যায়। দাওয়ায় উঠে জুতো খুলে রেখে, তার পর নেমে হেঁসেলে ঢুকে যিশু দেখল, চাকা-চাকা আলু কাটছে খুশিদি। অত্যধিক ধেনো-টানা পথে পড়ে-থাকা মাতালের মতন একটা শোলমাছ বিলকিয়ে উঠছে থেকে-থেকে ঘরের কোণে। ধোঁয়াহীন চুলাটায় বোধহয় প্রথম দিনের পর আর রান্না হয়নি। বাসনকোসন সবই কাঁসা আর পিতলের। এ-গ্রামে এখনও স্টেনলেস স্টিল ঢোকেনি সম্ভবত। চালায়-ছাদে বুস্টার লাগানো অ্যান্টেনা দুতিনটে নেতাবাড়িতে নজরে পড়েছে গ্রামে। ভবেশকার নেই। কেবলটিভিও, পার্টির অনুমতি আর ট্যাক্স ছাড়া টানা যায় না।
মেঝেয় বসে যিশু বলল, আমি তো বেজাত, মদ মাংস গোরু শুয়োর সব খাই।
জানি তুই মেলেচ্ছো, ওই পিঁড়েটা নিয়ে বোস।
তোমাকেও ম্লেচ্ছ করে তুলব।
আমার কিন্তু বড্ডো ভয় করচে। আমি এমন অপয়া। অশথ্থগাছ তুলে পুঁতেছিলুম, তাই। অশথ্থগাছ ওপড়াতে নেই। নম্রতায় ঢাকা খুশিদির সত্যিকার আশঙ্কা।
কুটনো কোটা হয়ে গেলে, তোলা উনুনের পাশে যখন বঁটিটা মুড়ে রাখছে খুশিদি, যিশু বলল, ভবেশকাকে যদি বলি, আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি, বিয়ে করতে চাই, তাহলেও রাজি হবে না ভবেশকা ; কেন, আমি জানি।
না না না না না না। প্রায় আঁৎকে ওঠে খুশিদি। অ্যাকদোম পাড়িসনি ওসব কতা। খুশিদির আতঙ্কিত মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে কয়েক দশক যাবৎ জমানো অন্তরঙ্গ উচ্ছ্বাসের রক্তিমাভ আকুতি। পারবি তো? যিশকা?
তোমাকে এভাবেই আগলে রেখে দেবে ওনার হিমসংসারে। কেন, আমি জানি। তার পর পচা আলুর মতন……
তুই আজ বাইরে-বাইরেই থাক। আকাশের মুকও আজ যা দেকচি, বিকেলে হয়তো কালবোশেখি আসবে, ভালোই হবে একদিক থেকে। ভাঙা গলায় বলল খুশিদি। যেন নিজেই নিজেকে পাহারা দিচ্ছে। পোড়াবাড়ির ডাকবাক্সে বহুদিন পড়ে-থাকা চিঠির মতন কেমন এক প্রাপকহীনতা ভর করে আছে।
উঠে পড়ে যিশু। হিমঘর রওনা হয় মোজা-জুতো পরে।
সকালের উদার শীতবাতাসকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে অন্তরীক্ষ। রোদের কণায় ঘষটানি খেয়ে দিনের আলো ক্রমশ হয়ে উঠছে অনচ্ছ। অশোভন বৈশাখী গরম। কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করার আগে পাতাহীন মগডালে বসে আছে তরুণ শকুনেরা। নিজেরই অনন্যোপায়, আকাঙ্খার আক্ষেপ, খুশিদির জন্যে পুনর্জীবিত বয়ঃসন্ধি, হিমঘরের দিকে যেতে-যেতে, নিজেকে বোঝার চেষ্টা করছিল যিশু। আর কখনও তো এরকম হয়নি, কারোর জন্যে।
যিশুর যেন লাফিয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে নিজের ভেতর থেকে। ঢোলবাদকদের বাহুর দুপাশে বাঙ্ময় ডানা মেলে ছুটতে ইচ্ছে করছে আলের ওপর দিয়ে।
হিমঘরে ভবেশকার দরবার বসেছে। চিন্তান্বিত ভবেশকা প্রৌঢ় আই-এ-এস আমলার ঢঙে কালো ফ্রেমের চশমা খুলতে গিয়ে হাত নেড়ে বলতে চাইছিল কিছু। চা ভরতি গেলাস টেবিলের ওপর থেকে পড়ে চুরমার। অস্বাচ্ছন্দ্যের তাৎক্ষণিক ঘোর থেকে চকিতে নির্মিত প্রসন্নতায় যেতে দেরি হয় না। এসো, এসো, পুলিন তুই টুলটায় বোস, যিশুকে বসতে দে।
এক ডজন লোক হবে এখানে। একজন বিশাল-পাছা মহিলা, পঞ্চায়েত কি পার্টির উঠতি-নামতি কেউ। যিশু কেবল কৃপাসিন্ধু আর শাসমলকে চেনে। পুরুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে এরা কেউ চান করে না, চুল আঁচড়ায় না, নিয়মিত দাড়ি কামায় না। একত্রিত হলে গুজগুজ-ফিসফিস ।
বাঙালির রেনেসঁসের উত্তেজনায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী পূর্বপুরুষদের মাত্র চতুর্থ উত্তরপুরুষ ওব্দি পৌঁছে বাঙালি গ্রামসমাজে যিশু নিজেকে বেমানান পেল। এদের দেখে কথাটা স্পষ্ট যে ধুতি পরার রেওয়াজ গ্রামেও শেষ হয়ে এল।
শাসমল ঘড়াঞ্চি সিঁড়িতে বসে। কিছু বলার জন্যে হাঁ করেছিল। মুখ বন্ধ করে অক্ষরগুলোকে ফুসফুসে ফেরত পাঠিয়ে দিলে। ওর পাশে হাতলভাঙা চেয়ারে ময়লামতন বেঁটে, গালে দুদিনের নুন-গোলমরিচ দাড়ি, গেরুয়া পাঞ্জাবি, অভিব্যক্তিহীন অলস চাউনি মেলে বলল, সকালে পেঁপে দেখতে যেওয়া হয়েছিল? লোক ভালো নয় স্বপন সামন্ত। জেলাসদরে মিথ্যে চিটি লিকেচে আমাদের হিমঘর নিয়ে। যেন আমরা সবাই চোর আর উনি হরিসচন্দোর। ওর বাপটা তো অতুল্লো ঘোসের চাকর ছিল। ল্যাঙোট কাচত। আর গেঁটে বজ্জাত দাদুটা পোফুল্ল সেনের দয়ায় আলুর ট্যাকায় জমিজমা করে নিলে।
টেবিলের ওপর তবলাবাদকের আঙুল নকল করে একজন বৃহদায়তন নিতম্ব বলল, জহোর্লালের দ্যাকাদেকি যখুন সুবাস বোসকে হেয় করছিল ওই পোফুল্ল ঘোস, কিরনসংকর রায়, নলিন সর্কার, নিমল চন্দর, তখুন ওদের ল্যাংবোট ছিল ওর দাদু।
লোকটাকে দেখতে-দেখতে যিশুর মনে পড়ে গেল সেই অডিটারদের চেহারা, যাদের কিছুদিন আগে পুরুলিয়া জেলা সমবায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছিল। এই লোকগুলো বোধহয় অন্যের জীবনকাহিনীতে তালাবন্ধ। বিপুলবপু লোকটা গ্রামের কিংবা ব্লকের কিংবা আরও বড়ো ভূখন্ডের সমসাময়িক রাজনীতিতে ভবেশকার চেয়ে উঁচুতে। চিৎকার করে মুণ্ডেশ্বরী নদীতে ঢেউ তোলে। নিজের কথাবার্তাকে বাকচাতুরীর আড়ালে কী উদ্দেশ্য দিতে চাইছে আঁচ করতে না পেরে, যিশুর মনে হল, এরা সবাই পার্টিমণ্ডুক, ছদ্মবেশী বেকার, আর ও এদের একটা ওয়াক-ইন ইনটারভিউ দিচ্ছে।
ও, যিশু, বিবৃতির ঢঙে বলল, পেঁপেগুলো কিন্তু বিরাট-বিরাট।
তা হবে না কেন? ব্যাংকের লোন নিয়ে মহাজনি করা হয়। মহিলার মন্তব্য।
তাই বুঝি? যিশুর মনে হল, জগৎটা মিটমাটপন্হীদের। প্রত্যয়ও চাই আবার মিটমাটও চাই।
আমাদের চাষিদের আতান্তরে ফ্যালেনি? এই এনাদের জিগ্যেস করে দেকুন। রোগা, কালো, ময়লা-জামাকাপড় বৃদ্ধের উক্তি।
আলু রপ্তানির নিষেধনামা তো উঠে গ্যাচে। আফরিকায় দেশে-দেশে লোকে আলু খায় ভাতরুটির বদলে।
টুলে-বসা পুলিন জ্ঞান দিলে ভবেশকা অবস্হা সামাল দ্যায়, আরে ওকে কী বোঝাচ্ছিস, ও নানা দেশ ঘুরেচে।
এবার আমরা ওননো রাজ্যেও পাটাতে পারবো, বলল পাশের লোকটা, যার গা থেকে তিতকুটে গন্ধ বেরুচ্ছিল।
পশ্চিমবঙ্গে শিষ্টভাষার নামে কলকাতায় যা আজ বাজারচালু, সেই লোকগুলোর কথা শুনে যিশুর মনে হচ্ছিল, দেশভাগ না হলে তা এক্কেবারে আলাদা হতো। জব চার্ণক চাটগাঁয় নামলেও আলাদা হতো।
আমাদের দোষে আলু পচেনি, আর বাড়তি আলু রাখিও না আমরা। গেরুয়া পাঞ্জাবি বক্তব্য পেশ করে। স্বপন সামন্ত যেসব চুগলি করেচে, সব মিথ্যে।
ওফ, এরা এখনও ভাবচে ও একজন আলুগোয়েন্দা। কেলেংকারি জড়ো করে-করে প্রতিবেদন লিখে কোনও অজানা ওপরঅলাকে পাঠিয়ে এদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ক্ষমতা সব নষ্ট করে দেবে। পশ্চিমবঙ্গে কেউ কি কোথাও সত্যিই আছে, যাকে ধরলে দুর্ভোগের প্রতিকার হয়?
কাঁধ কাঁপিয়ে স্বাভাবিক হাসি হেসে ফ্যালে যিশু। বাইরে মুটিয়াগুলো এখনও পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে, আর শেডের তলায় রাখা আলুর বস্তার সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে। যিশু বেফাঁস বলে ফেলল, ওগুলো কী হবে?
ওসব আড়তদার, ফড়ে, মহাজনদের মাল, নিয়ে যাবে। ভবেশকার খোলসা।
স্বপন সামন্তের অভিযোগের কপি দেয়া হয়েচে নাকি আবনাকে?
দেয়া হয়েচে, করা হয়েচে, শুনে আদিত্যর কথা মনে পড়ে গেল যিশুর। ওর জেরা করার কায়দা। ইংরেজ পুলিশ অফিসারদের কাছ থেকে অনুবাদ করে পেয়েছিল বাঙালি ঊর্ধ্বতনরা। দিয়ে গেছে অধস্তনদের, আদিত্যকে। সেদিন মোটরবাইকে উধাও হয়ে গেল আচমকা, অদ্ভুত। উপস্হিত লোকগুলোর মুখের ওপর চাউনি ঘোরাল যিশু, আর দেখতে-দেখতে মনে হল, মানহানি ব্যাপারটা সম্ভবত আর্থিক। আত্মিক নয়।
না, তা হিমঘর নিয়ে ওনার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি আমার। উনি যে চিঠি-ফিটি লিখে কমপ্লেন করেছেন, তা-ই জানতুম না। কপিটা পেলে মন্দ হতো না। অবশ্য ওসব কমপ্লেন-ফমপ্লেনে কারুর কিছু হয় না আজকাল। গাজোয়ারি ছাড়া কিচ্ছু আর কাজে দ্যায় না। দলদাসদের আড়ং ধোলাই, ব্যাস।
হুঁ।
সকালে বেড়াতে-বেড়াতে দেখলুম অত বড়ো-বড়ো পেঁপে, তাই দাঁড়িয়ে পড়েছিলুম। মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল হতভম্ব যিশু, কেউ বিশ্বাস করছে না ওকে। কী বিপজ্জনক। বাড়িতে থাকলে সন্দেহ হতে পারে, আবার গ্রামে বেড়ানোটাও উদ্রেক করছে সন্দেহ। গত দশ-বিশ বছরে গ্রামে-গ্রামে, এমনকী কলকাতার সনাতন পাড়ায়-পাড়ায়, নতুন এক সন্দেহভিত্তিক বর্ণাশ্রম উদ্ভব হয়ে্ছে। নতুন তত্ত্বটার নাম শত্রুশিবির। তা থেকেই নতুন বর্ণ-বিভাজন। বাইরের লোক আর কোনও গ্রামে গিয়ে জমিজমা কিনে টিকতে পারবে না।
চৌকাঠের কোণের গর্ত থেকে একটা গোবরিয়া বিছে বেরিয়ে বিবাদী বাগের রাস্তা পেরোবার মতন শুঁড় দিয়ে এদিক-ওদিক দেখে ঢুকে গেল বাইরে ছড়ানো-ছেটানো বাতিল আলুর ভেতর। রাস্তার ওপারে, আকন্দ গাছটার কাছে, খুলে কথা বলায় মগ্ন শালিকদল। পশু-পাখি ছাড়া আর কেউ খুলে কথা বলে না পশ্চিমবাংলায়। পুঁটলি থেকে রামরোট রুটি, কাঁচা পেঁয়াজ, আলুমশলা নিয়ে, গামছা পেতে বসেছে চারজন মুটিয়া। বোধহয় ব্রেকফাস্ট।
টেবিলের ওদিকে কন্দর্প-ক্যাবলা ফরসা একজন কাগজ পড়ছিল, কালকের, হাঁইইইইহ আওয়াজ সহযোগে হাই তুলল। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পূর্বতন মালিকের ইঁটজিরজিরে নোনা কবরের ওপর কাকেদের ভরা সংসার। গোড়ায় আপনা থেকে গজিয়েছে বুনো কনকনটে। কন্দর্প-ক্যাবলা জানায়, ডাবল সার্কিট লাইনের তার চুরি হয়ে কোলাঘাটের একটা ইউনিট বন্ধ, পুলিনদা।
অ।
সবাই চুপচাপ। ইন্টারভিউ নেবার প্রশ্ন বোধহয় ফুরিয়ে গেছে।
হঠাৎ জাবেদালি অফিসঘরে প্রবেশ করে। লুঙ্গি আর খালি গায়ে। ঘর্মাক্ত। দৌড়ে এসেছে। চোখমুখ থমথমে। হাঁপাচ্ছিল। উদবিগ্ন ঘোষণা করে, হালিক ধাড়া গলায় দড়ি দিয়েচে, পুলিশ এয়েচে লাশ নাবাতে।
অন্ধকারের বিস্ফোরণ হয়, আর গুঁড়ো-গুঁড়ো কালো অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে দরবারিদের চেহারায়। সবাই এমন কনকনে তাকায় যেন যিশুই খুনি। ওকে একা ফেলে রেখে সবাই ছিটকে বেরোয় অফিসঘর থেকে, আর মাঠ ভেঙে গ্রামের দিকে দৌড়োয় । মহিলা সবার শেষে, পাছায় চেয়ারের হাতল আটকে গিয়েছিল বলে।
তালা দিয়ে দি থালে। জাবেদালির ইশারায় উঠে পড়ে যিশু। ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন তোলে।
ধারদেনা করে সাড়ে তিন বিঘে বুনেছিল। অবোসথা তো নিজের চোকেই দেকেচেন। বোরো বোনা আবার বারণ।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া সত্ত্বেও, পঞ্চাশ লক্ষ টন আলুর হিল্লে হবে না। হিমঘরেও জায়গা নেই। বিহার, উত্তরপ্রদেশে, অন্ধ্র, উড়িষ্যায় অনেক আলু হয়েছে। লুকিয়ে পাচার হবে নেপাল বাংলাদেশ বর্মায়। তার কিছু টাকা যাবে সুইস ব্যাংকে। গুজরাতের জমিতে তো জো নেই, তবু হয়েছে আলু। দুধ সমবায়ের জোরে সেখানে গোরু-মোষকে আলু খাওয়ানো যায়।
যিশু জিগ্যেস করল, হালিক ধাড়া বন্ড পায়নি?
জাবেদালি উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি এগোন।
যিশু একটা সিগারেট ধরায়।
জনশ্রুতির মতন বাতাস বইছে। মন্দিরের পাঁচিলের ওপর কয়েকটা চটুল কাক। মসজিদ বলতে এ-গ্রামে সবুজ-সবুজ চুড়ো-দেয়া মাঠের মাঝে একটা দেয়াল, ধবধবে সাদা। সুলতানি চারচালা বাঙালি মসজিদ আর হবে না। আরবদেশের মসজিদের নকল হবে কেবল, তাদেরই দিনার-দিরহামে।
মন্দিরের বাইরে পুজোর উপাচার বিক্রির খাট পাতা। আকন্দফুলের মালা ঝোলানো খদ্দেরহীন দোকানে বুড়িটা ঢুলছে। একটা আলাপি কুকুর ল্যাজ নাড়ে। মদগর্বিত ষাঁড়। মদিরেক্ষণা মৌমাছি। ভিজে চিলের মতন ডানা ঝুলিয়ে রয়েছে ঝিমন্ত কলাগাছগুলোর ছেঁড়া পাতা। কঞ্জুস হাওয়ার তাপে বাবলাগাছগুলোর গায়ে কাঁটা দিয়েছে। পথিপার্শ্বে উইপোকাদের বিজয়স্তম্ভ। মার্জিত চেহারার খেজুরগাছ, গলায় খেজুরছড়ার মালা।
দুপুর টাটিয়ে উঠেছে ক্রমশ, অথচ মেঘেদের ধূসর আনাগোনাও চলছে। বৃষ্টির ওপর আধিপত্য, দুঋতু আগে খর্ব হবার ফলে, নেতিয়ে পড়েছে ভেষজ সবুজ। মোরামপথ ধুলোয় জেরবার। প্রমেথিউসের নাট্যাভিনয়ে গুবরেপোকা। সকৌতুকে ফুটে আছে শেয়ালকাঁটার নরম ফুরফুরে হলুদ। কাঁঠালগাছে অজস্র এঁচোড়ের সঙ্গে ঝুলে আছে সুরাসক্ত মৌমাছিদের মোমভিত্তিক ক্ষুদ্রশিল্প। নীরবতা পালন করছে শোকমগ্ন শ্মশান। মেলার তোড়জোড় জানান দিচ্ছে বাচাল-প্রকৃতির লাউডস্পিকার। গাছের ছায়া থেকে কিশোর হিমসাগর বেরিয়ে লাফ দিয়েছে আলোয়।
সারাটা দুপুর ফ্যা-ফ্যা কাটিয়ে, চুল না-ভিজিয়ে পুকুরে ক্লান্ত চান সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিল যিশু। ঘুম ভাঙে ভবেশকার চ্যাঁচামেচিতে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, খুশিদিকে বকছে। এই বয়সেও বকুনি!
কাছে গিয়ে ভবেশকাকে, কী হয়েছে গো, জিগ্যেস করায়, উলটে বকুনি খায় যিশু, তুমি মাঝখানে কতা বলতে এসো না।
ক্ষুব্ধ যিশু বলল, আরে, এই বয়সে এমন বকা-ঝকা করছ কেন? শুধু নিজের স্বার্থটাই দেখবে? বিষয়ী হওয়ার এতই দরকার নাকি তোমার? আমি…। কথা সম্পূর্ণ করা উচিত হবে না মনে করে যিশু চুপ করে যায়।
ভবেশকা বাঁপাশে হেলে, থপথপিয়ে দাওয়া থেকে নেমে বেড়ার আগল খুলে ক্রুদ্ধ বেরিয়ে গেলে খুশিদি স্কুলবালিকার মতন চোখ মুছে বলল, তুই খেয়ে নে। বাকসো গুচিয়ে রেকেচিস তো? আমি এককাপড়ে চলে যাব একদোম ভাল্লাগে না আর।
হ্যাঁ। সন্ধে হলেই তুমি চলে যেও। মেলার ভিড় তো থাকবেই। কদম গাছতলায় অপেক্ষা কোরো, নইলে সোজা বাবলাডাঙায় গাড়িটার কাছে চলে যেও। ড্রাইভারটাকে বলা আছে। ভবেশকা একেবারে আউটডোর জীব হয়ে গেছে। কী হয়েছিল কী? যে এত বকছিল তোমায়?
মোদকের বউকে জলপড়া দেবে। জলপড়ার কাঁসার জামবাটিটা পাওয়া যাচ্চে না। বাবা তারকেশ্বরের ছোঁয়ানো বাটি। কোতায় রেকেচে নিজেই। গুষ্টির তো জিনিস। ভাল্লাগে না।
জলপড়া? ভবেশকা জলপড়া দেবে? যিশুর মাথার ভেতরে শম্ভূ মিত্রের কন্ঠস্বরের অনুকরণে ডলবি ডিজিটাল বজ্রপাত হয়। জলপড়া!
হ্যাঁ। সেরে যায় তো। কানচোন মোদকের বউ বাচ্চা বিয়োবার আনজা রাকতে পারচে না।
ভবেশকা সেই যে রেগেমেগে বেরিয়েছে, ফেরেনি। সন্ধে হয়ে গেল। লাইট চলে গেছে, সম্ভবত মেলার হুকিঙের অকথ্য শোষণে। যাত্রাদলের জেনারেটারের ক্ষীণ নিরবয়ব একটানা শব্দ। শুরু হয়ে গেছে ঝিঁঝিদের দেয়ালা-পারঙ্গম কানাঘুষা। কাতর আবেদনের মতন অন্ধকার। মাঝে-মাঝে স্পন্দিত হয়ে উঠছে শব্দহীন বিদ্যুচ্চমকের উদ্বেগ।
আমি থালে এগুচ্চি, অন্ধকারে অনুচ্চ গলায় বলল খুশিদি, চাপা উত্তেজনায় কন্ঠস্বর রুদ্ধ। মুখে-মাখা স্নোক্রমের গ্রামীণ সুগন্ধকে ছাপিয়ে যাচ্ছে হাঁ-মুখের শঙ্কিত উৎকন্ঠার ভাপের গন্ধ। একপলক বিদ্যুচ্চমকে দেখা গেল থুতনির নিটোল টোল। পাটভাঙা, কাসুন্দি রঙের, ফুলফুল শাড়ি। হাত কাঁপছে। হাঁটার ধরনে স্পষ্ট যে ভয় আর উৎকন্ঠা নিয়ন্ত্রণ করছে খুশিদির শরীরকে, খনিগর্ভে আটকে-পড়া শ্রমিকের মতন।
অ্যাতো ভয় কিসের খুশিদি। বুকে জড়িয়ে ধরে ভয় স্তিমিত করার চেষ্টা করে যিশু।
জানি না কেন যিশকা, আমার খুব ভয় করচে। দাওয়া থেকে নেমে দ্রুত অন্ধকার বাগান পেরিয়ে চলে গেল খুশিদি।
পেনটর্চ জ্বেলে যিশু নিজের বাকসো আরেকবার দেখে নিলে। খুশিদিকে ভরসা দিচ্ছিল অথচ ছোঁয়াচে উদ্বেগে চাবি লাগাতে ভুলে যায় ব্রিফকেসে। নৈঃশব্দে বসে থাকে কিছুক্ষণ। পা টিপে বেরোয়। আলতো খোলে বাঁশের বেড়া। চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে কালবৈশাখীর ছেতরানো মেঘে, কিন্তু পূর্ণিমার আগাম আভায় নির্জন বধির অন্ধকারকে মনে হচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল। নেশাগ্রস্তের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে আছে গাছগুলো। বুনো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সিসলকাঁটার গুঁড়িসুড়ি ঝোপ।
ভবেশকার বাড়িটা যেন গাছে-ঘেরা দুর্গ। এখান থেকে মোচ্ছবতলার কদমগাছ অনেকটা পথ। ট্রান্সফরমার লোড নিতে পারেনি হয়তো, কখন আলো আসবে অনিশ্চিত। এই ভেষজ অন্ধকারে সেঁদোতে আলোরও গা ছমছম করবে। বুড়ো শিবতলার বয়োবৃদ্ধ বটগাছের একগাদা স্তম্ভমূল ঝুরিতে অন্ধকারকে এখানে ছোঁয়া যায়। টর্চটা ব্যবহার করা উচিত হবে না। সাপ বা শেয়াল একটা গেল বোধহয়।
যিশু দ্রুত হাঁটে শুকনো পাতার ওপর। শ্মশানের বিয়োগান্ত গন্ধ আসছে ওদিক থেকে। হালিক ধাড়ার নশ্বরতার প্রতি শেষ সম্ভাষণ হয়তো। মেঘ না থাকলে সন্ধ্যাতারার ঘনবসতিপূর্ণ আকাশভূমি দেখা যেত। আলো ফোটাতে তলবিসভা ডাকছে ঝিঁঝিপোকারা। শুকনো পাতার ওপর সম্ভবত সাপ বা তক্ষকের বুকে হাঁটার আওয়াজ।
উদ্বেগ কাটাতে সিগারেট ধরাবার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল যিশু। হঠাৎ শুনতে পায় অনেকগুনো লোকের কন্ঠে ডাকাত ডাকাত ডাকাত চিৎকার। পেছন দিক থেকেই তো ছুটে আসছে। এরা ডাকাত? টাকাকড়ি তো বিশেষ নেই ওর কাছে। কাদের বাড়ি ডাকাতি করেই বা পালাচ্ছে? ছোটাছুটির পদধ্বনি কাছাকাছি কোথাও। গাছের ডাল থেকে লাফাবার ধুপধাপ। ওর দিকেই আসছে মনে হয় ডাকাতের দলটা।
যিশু দৌড়োয়।
যিশুর মাথার ওপরে সজোরে বাড়ি পড়তে, হাতছাড়া ব্রিফকেস ছিটকে গিয়ে লাগে বটগাছের ঝুরিস্তম্ভে আর ডালা খুলে শুকনো পাতার ওপর ছড়িয়ে পড়ে শার্ট-প্যান্ট, কাগজপত্তর, টর্চ, টাকাকড়ি, ডটপেন, ক্যালকুলেটর, মোবাইল ফোন, ক্রেডিট কার্ড, চেকবই, পাসপোর্ট, টাই, ঘড়ি, ডাকটিকিট, তুষলাব্রতর সরষে আর শুকনো মুলোফুল।
টাল সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে, যিশুর পিঠের ওপর বারকয়েক লাঠির শব্দ ওঠে। তারপর পায়ে আর কাঁধে। তবু দাঁড়াবার চেষ্টা করে যিশু। মাথার ওপর আবার আঘাত। যিশুর পরিপাটি আঁচড়ানো দামি পরচুলা মাথা থেকে খুলে বেরিয়ে গেলে, আবার আঘাত। সেই মুহূর্তে, যিশু দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে তখনও, অন্তরীক্ষ থেকে পতনরত চকচকে রুপোলি কিলবিলে সাপটার ল্যাজ ধরে হ্যাঁচকা টান দ্যায় বুড়োশিব। প্রচণ্ড আওয়াজ তুলে কাছেই বজ্রপাত হল কোথাও। বজ্রপাতের কাঁপুনিতে, মৌমাছির চাক থেকে কয়েক ফোঁটা মধু ঝরে পড়ে যিশুর চুলহীন রক্তাক্ত মাথায়।
শ্বাস দ্রুত আর হৃৎস্পন্দন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে যিশুর। ফুসফুসে ভাসমান রক্তের হেমোগ্লোবিনে অক্সিজেনের স্হান সংকুলানে ব্যাঘাত ঘটছে বলে মস্তিষ্কে পৌঁছোতে অসুবিধা হচ্ছে। কপালে, হাতের চেটোয়, ঘাম জমছে আর জুতোর মধ্যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুলো। আলজিভের চারিপাশ শুকিয়ে যাচ্ছে। ক্রমক্ষীয়মান অশরীরী হলুদ ও বেগুনি অন্ধকার-কণার অজস্র খুদে-খুদে ফুল ভাসছে অস্পষ্ট চরাচর জুড়ে।
ব্রিফকেস থেকে পড়ে বহুকালের পুরোনো হলদে খড়খড়ে কাগজের পাতা উড়তে থাকে ইতিউতি। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজ। প্রথম পৃষ্ঠায় তলার দিকে ডানকোণে ফুটফুটে আড়াই বছরের নাতনির ফোটোর তলায় তার হারিয়ে যাবার বিজ্ঞাপন দিয়েছে দাদু মিনহাজুদ্দিন খান। মেয়েটির ডান কাঁধে জড়ুল। ডান চোখে তিল আছে। কাঁদলে থুতনিতে টোল পড়ে। মেয়েটির নাম খুশবু। ডাক নাম খুশি।