Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নবাবগঞ্জের নরখাদক (২০০৮) || Samaresh Majumdar » Page 2

নবাবগঞ্জের নরখাদক (২০০৮) || Samaresh Majumdar

খবরের কাগজের অফিসের বাইরে এসে অর্জুন কয়েক সেকেন্ড ভাবল। ডক্টর নীলমোহন বকসির বাড়ি নবাবগঞ্জ পক্ষীনিবাসের কাছে। জায়গাটা লখনউ শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে যেতে হলে ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রচুর টাকা চাইবে। অপেক্ষা করতে হলে যা ভাড়া দিতে হবে, তা অনুমান করা মুশকিল। পাশেই হাইওয়ে, বাস যায়, কিন্তু সেই বাস কোথায় গেলে পাবে, তা জিজ্ঞেস করার জন্য অর্জুন একটা পানের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মাথায় গাঁধীটুপি, চোখে সুরমা দেওয়া পানওয়ালা হেসে বলল, বলিয়ে সাব! আমার কাছে সেই পান আছে, যা একদিন নবাব বাহাদুর শাহ পছন্দ করতেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, ধন্যবাদ। আমি আপনার কাছে জানতে চাই নবাবগঞ্জের বাস কোথায় গেলে পাওয়া যাবে?

লোকটা হাত ঘুরিয়ে বলল, বাবু, আমি পান বিক্রি করি, এর বাইরে কোনও খবর রাখি না। আপনি কিছু মনে করবেন না, কোনও বাসওয়ালাকে জিজ্ঞেস করুন।

এরকম অভিনব উত্তর শুনে অর্জুন হেসে ফেলল। ঘুরিয়ে চমৎকার কথা বলে লোকটা বুঝিয়ে দিল ও সাহায্য করবে না।

খানিকটা হাঁটতেই একটা বাস চোখে পড়ল। লোকে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে। এরকম বাসে চেপে তাকে নবাবগঞ্জে যেতে হবে নাকি? গেস্ট হাউসের কর্মচারী বলেছিল, ওর ভাই ট্যাক্সি চালায়। লোকটা যদি ওর ভাইকে কম টাকায় ব্যবস্থা করে দেয়, তা হলে আর ঝামেলা থাকে না।

দুপুরে গেস্ট হাউসে ফিরে এসে খোঁজ নিয়ে অর্জুন জানতে পারল, আবদুলের এখন ছুটি। বিকেলে সে ফিরবে। তার সমস্যার কথা শুনে ম্যানেজার বললেন, আপনি নতুন লোক। অত দূরে একা না যাওয়াই উচিত। ওই সব এলাকা তো ভাল নয়। গাড়ি নিয়ে গেলে সমস্যা অনেক কমে যাবে। অমিতাভজিকে বলুন, উনি নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করবেন। ওঁর ফোন নম্বর আপনার কাছে আছে?

পকেট থেকে অমিতাভবাবুর দেওয়া কার্ড বের করল অর্জুন। ম্যানেজার ফোন এগিয়ে দিলে সে ডায়াল করল মেবাইলে। অমিতাভ হ্যালো বলতেই সে সাড়া দিল, হ্যালো, আমি অর্জুন। চিনতে পারছেন?

বিলক্ষণ।

আমি একটা গাড়ি খুব কম ভাড়ায় পেতে পারি? নবাবগঞ্জে যাব।

কখন?

এখন।

এখন তো হবে না ভাই, সাড়ে চারটে নাগাদ পেলে চলবে?

বেশ, অর্জুন বলল, ভাড়াটা আন্দাজ কীরকম হবে?

গাড়ি আর ড্রাইভার ফ্রি, তেলের দাম খুব ইচ্ছে হলে দিতে পারো, ফোন রেখে দিলেন অমিতাভ।

রিসিভার নামিয়ে রেখে অর্জুন ম্যানেজারকে ধন্যবাদ দিতেই তিনি বললেন, ওহহ! মিস্টার গাঙ্গুলি একটু আগে ফিরেছেন। উনি আপনার খোঁজ করছিলেন।

কেন কিছু বলেছেন?

না, ম্যানেজার একটি বেয়ারাকে ডেকে বললেন, মিস্টার গাঙ্গুলির ঘর অর্জুনকে দেখিয়ে দিতে। একটু ইতস্তত করে অনুসরণ করল অর্জুন।

দরজায় দ্বিতীয়বার টোকা দিতে গলা ভেসে এল, আইয়ে জি।

অর্জুন দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। ঘরের মাঝখানে টেবিলের একপাশের চেয়ারে ফতুয়া পরে বসে আছেন বৃদ্ধ। সামনে দাবার বোর্ড। ওকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, জিভের দোষ ভাই। আজন্ম প্রবাসে থেকে জিভ প্রথমে হিন্দি বলা অভ্যেস করে ফেলেছে। বোসো, বোসো।

অর্জুন উলটো দিকে বসলে মিস্টার গাঙ্গুলি বললেন, অভ্যেস আছে?

অল্পস্বল্প।

বাঃ। এসো, এক হাত হয়ে যাক। সবে সাজিয়েছি।

আপনি একা-একাই দাবা খেলেন?

হ্যাঁ, নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। নিজেই জিতি, নিজেই হারি। নাও, চাল দিলাম, দুটো বোড়ে এগিয়ে দিলেন মিস্টার গাঙ্গুলি।

অনেক দিনের অনভ্যেস। অর্জুন ঠিক করল আক্রমণাত্মক খেলবে। সে ঘোড়া তুলে আনল বোড়ের সামনে। বোর্ডের দিকে তাকিয়ে মিস্টার গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করলেন, অক্ষয়ের সঙ্গে দেখা হল?

হ্যাঁ। আপনার রেফারেন্স না থাকলে ঠিকানা পেতাম না গজের মুখ খুলল অর্জুন, উনি আপনাকে খুঁজছিলেন।

কথা বলে নেব। ঠিকানা কি লখনউয়ের?

একটু বাইরে। নবাবগঞ্জে।

মিস্টার গাঙ্গুলি সোজা হয়ে বসলেন, সে তো বেশ দূরে। তুমি তো প্রথমবার এই শহরে এলে। যদি কিছু মনে না করো, যাঁর কাছে যাবে তিনি কি বাঙালি?

নাম দেখে বাঙালি বলেই মনে হয়।

উঁহু। না ভায়া। ধরো, হরিহর রায়। তোমার কাছে বাঙালি বলে মনে হবে তো?

নিশ্চয়ই।

আলাপ করলে বুঝবে তিনি হয়তো গোড়া ইউপিবাসী ব্রাহ্মণসন্তান। কিস্তি সামলাও হে, গজ গিলে ঘোড়া বসালেন মিস্টার গাঙ্গুলি। অর্জুন দেখল, রাজাকে না সরিয়ে উপায় নেই।

প্রথম গেমে হেরে গেল অর্জুন। দ্বিতীয়টি যখন বেশ জমে উঠেছে, মিস্টার গাঙ্গুলির রাজা প্রায় কোণঠাসা, আর দুই কি তিন চালেই মাত করবে অর্জুন, ওই সময় দরজায় শব্দ হল। মিস্টার গাঙ্গুলি মুখ তুলে বললেন, আইয়ে জি।

দরজা খুলল। মিস্টার গাঙ্গুলি চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে অমিতাভ! তুমি এখানে কী করে?

অমিতাভ ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে নিলেন, রিসেপশনিস্ট বলল অর্জুন আপনার ঘরে। জানতে পারলাম আপনি এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন। আজকাল লখনউ এলে তো আমাদের স্মরণে রাখেন না। তাই সটান চলে এলাম।

তুমি এই শ্রীমানকে চেনো? মিস্টার গাঙ্গুলি হাসলেন।

আজ সকালেই আলাপ হয়েছে। তারপর দুপুরে অফিসে মিসেস দত্তকে সে কথা বলতে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছে, অমিতাভ হাসলেন।

কীরকম?

মিসেস দত্ত বাংলা বইয়ের পোকা। আমাদের বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন লাইব্রেরির সব বই উনি গিলে খেয়েছেন। বললেন, জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে, নাম বলেছে অর্জুন? কত বয়স বলুন তো?’ আমি আন্দাজে বলতে মিসেস দত্ত বললেন, জিজ্ঞেস করবেন তো জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার অমল সোম ওঁর গুরু কিনা!’ আমি ব্যাপারটা জানতে চাইলে বাবুর পরিচয় বেরিয়ে পড়ল।মিসেস দত্তর অনুমান যদি ঠিক হয়, তাহলে ইনি সত্যসন্ধানী। বেশ জোর দিয়ে বললেন অমিতাভ।

সত্যসন্ধানী! মিস্টার গাঙ্গুলি মাথা নাড়লেন, ইন্টারেস্টিং।

অর্জুন বলল, আপনার চাল কিন্তু পেন্ডিং আছে।

অমিতাভ বললেন, আরে রাখো চাল। আগে বলো যা শুনেছি, তা কি ঠিক?

অর্জুন হাসল, মিসেস দত্ত আপনাকে সঠিক তথ্য দিয়েছেন।

তুমি লখনউয়ে এসেছ কোনও রহস্যের সমাধান করতে?

মাথা নাড়ল অর্জুন, না, সত্যসন্ধান করতে।

ব্যাপারটা কী, তা আমাদের খুলে বলতে অসুবিধে আছে? চাঁদুদা, মানে এই মিস্টার গাঙ্গুলি যদিও ইলাহাবাদে থাকেন, কিন্তু লখনউয়ের বাঙালিদের সঙ্গে এঁর প্রায় অর্ধশতাব্দীর ঘনিষ্ঠতা। আগে অতুলপ্রসাদের গান গাইতেন খুব ভাল। এখনও মুখ খুললে সেটা বোঝা যায়, অমিতাভ বললেন।

চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলি বললেন, দ্যাখো অমিতাভ, যারা বেশি কথা বলে, তারা কথা খোঁজে। না পেলে তাদের বাজে কথা বলতেই হয়। তুমি সেই দলে ভিড় বাড়াচ্ছ কেন?

অমিতাভ অর্জুনকে বলল, এই হল চাঁদুদা। এমন চমৎকারভাবে বকুনি আর কেউ দিতে পারে না। কী বলো! নবাবগঞ্জে গিয়ে কার সঙ্গে দেখা করতে চাইছ?

ডক্টর নীলমোহন বকসির সঙ্গে।

অমিতাভ মিস্টার গাঙ্গুলির দিকে তাকালেন। তিনি মাথা নেড়ে জানালেন যে, চিনতে পারছেন না। অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী?

অর্জুন পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলতেই অমিতাভ চিৎকার করলেন, ফ্রড! এই বিজ্ঞাপন ডেলি নিউজ ছাপল কী করে?

মিস্টার গাঙ্গুলি অমিতাভর দিকে তাকালেন, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে প্রশ্ন করছি, ওই বিজ্ঞাপন দেখে অর্জুনবাবু এত দূরে আসার পরিশ্রম কেন করলেন? তার ক্লায়েন্টকে তো বলেই দিতে পারতেন এটা বুজরুকি!

অমিতাভ অর্জুনের দিকে তাকালেন, তুমি কি এই বিজ্ঞাপন বিশ্বাস করছ?

না। কিন্তু একজন যখন খবরের কাগজে এরকম বিজ্ঞাপন ছাপাতে পারে তখন ধরেই নিতে হবে, তার কোনও উদ্দেশ্য আছে। আমি সেটাই জানতে এসেছি।

উদ্দেশ্য তো বোঝাই যাচ্ছে। ভড়ংটড়ং দিয়ে টাকা রোজগার করা।

ভেবে দেখুন, প্রথম ক্লায়েন্টকে ঠকানোমাত্র সে চুপ করে বসে থাকবে । হইহই করবে, পুলিশের কাছে যাবে। কাগজ বা মিডিয়া এটাকে একটা ইসু করবে। তা হলে আর ব্যাবসা করবে কী করে লোকটা। না, আমার মনে হয় না, এই ডক্টর নীলমোহন বকসি এরকম নির্বোধ মানুষ। তিনি যে ঠিক কী, তা জানতে চাই। অর্জুন ভেবেচিন্তে কথাগুলো বলল।

মিস্টার গাঙ্গুলি বললেন, অর্জুনের কথায় যুক্তি আছে।

তা হলে চলুন, তিনজনেই ঘুরে আসি ওখান থেকে, অমিতাভ বললেন।

এই বুড়ো মানুষটাকে ছেড়ে দাও মিস্টার গাঙ্গুলি বললেন, মেয়েকে কথা দিয়েছি বিকেলে দেখা করতে যাব। বেচারা আশা করে থাকবে।

অমিতাভ বললেন, শুনেছিলাম ও অসুস্থ?

হ্যাঁ। রোগটা ঠিক কী, তা নাকি ডাক্তার ধরতে পারছেন না। আজ আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলব। তেমন হলে দিল্লি বা মুম্বইয়ে ওকে নিয়ে যেতে হবে। মিস্টার সান্যাল দাবার খুঁটি কৌটোয় ভরতে লাগলেন।

সেটা দেখে অর্জুন বলল, এবার আপনার হার অবধারিত ছিল।

হারলাম না। বৃষ্টির জন্য যেমন ক্রিকেট খেলা বাতিল হয়ে যায়, তেমনই অমিতাভর আগমনে খেলাটার মীমাংসা হল না। যাক গে, আমি অপেক্ষা করব। তোমাদের ফিরে না আসা পর্যন্ত ঘুমোব না। মিস্টার সান্যাল উঠে টেবিলে রাখা পার্স থেকে কার্ড বের করে এগিয়ে ধরলেন অর্জুনের সামনে, এতে আমার মোবাইল নম্বর আছে। দরকার বুঝলে ফোন করবে।

.

গাড়ি চালাতে চালাতে অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, অর্জুন, আমাদের এই প্রবাসী বাঙালিদের তোমার কেমন লাগে? আমার মেয়েরা বাংলা ভালই বলে। কিন্তু বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে হিন্দি বা ইংরেজিতেই কথা বলা পছন্দ করে। এই আমার বাংলাতেই কুছ কুছ হিন্দু-উর্দু শব্দ এসে গিয়েছে। কিন্তু ইলাহাবাদে জন্মেও চাঁদুদার বাংলা এখনও এক নম্বরে।

চন্দ্রশেখর নামকে ছোট করে দুদা বলছেন যখন, তখন আপনি ওঁর খুব ঘনিষ্ঠ। অনেক দিন দেখছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

সেই ছেলেবেলা থেকে। লখনউয়ে আসতেন গানের দল নিয়ে। বছরে অন্তত চারবার। একবার নাটকও করেছিলেন। মাইডিয়ার লোক। মেয়ে এখানকার ছেলেকেবিয়ে করেছিল। বিয়েটা বউদিমানতে পারেননি। নিজে তো কখনও মেয়ের বাড়িতে আসেননি, চাঁদুদাকে দিয়েও প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, যাতে তিনি মেয়ের বাড়িতে না আসেন। অমিতাভ বললেন।

ওঁর মেয়ে খুব অসুস্থ।

হুঁ, যাক গে! আমাদের তোমার বাঙালি বলে মনে হচ্ছে তো?

অর্জুন হেসে ফেলল, বাঃ। কেন হবে না? আপনি কলকাতায় অনেক বাঙালির চেয়েও বেশি বাঙালি। আগে একশো-দেড়শো বছর ধরে কোনও পরিবার প্রবাসে থাকলে সেখানকার মানুষ হয়ে যেত। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক বাঙালি আছেন, যাঁর পূর্বপুরুষ অবাঙালি ছিলেন। আপনারা তবু বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছেন।

মাথা নাড়লেন অমিতাভ।

এখনও রোদ আছে। লখনউ শহর ছাড়তেই রুক্ষ মাঠ, মাঝে মাঝে তার ভিতর কারখানার গেট দেখা যাচ্ছিল। অমিতাভ বললেন, এখন এসেছ বলে তুমি বুঝতে পারবে না, শীতকালে যেরকম ভয়ংকর শীত এখানে পড়ে, তেমনই গরমকালের দুপুরে পাখি তো দূরের কথা, কুকুরও রাস্তায় দেখা যায় না।

এদিকে লোকবসতিও নেই নাকি? আছে। ভিতরে দূরে দূরে গ্রাম ছড়িয়ে আছে। হাইওয়ে চওড়া এবং মসৃণ। গাড়ি ছুটছিল দ্রুত গতিতে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি নবাবগঞ্জে নিশ্চয়ই গিয়েছেন?

একবার, শীতকালে। ওখানকার লেকে সাইবেরিয়া থেকে পাখি এসেছে শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রচুর পাখি তখন আসত। আচ্ছা, পাখিরা আকাশে ওড়ার সময় কী করে বুঝতে পারত ভারতের লখনউ শহরের নবাবগঞ্জ কোথায়? শুনেছি একই পাখি প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে। কোথায় সাইবেরিয়া, বলো! অমিতাভ তাকালেন।

অর্জুন বলল, ব্যাপারটা বিস্ময়কর। তবে কোথায় যেন পড়েছিলাম ঠান্ডা বাড়লেই যে পাখিরা ভারতের বিভিন্ন লেকে উড়ে এসে বসে, তাদের বাড়ি হিমালয়ে, সাইবেরিয়ায় নয়। হিমালয়ে মানস সরোবরের মতো অনেক লেক রয়েছে। এখানে গরম পড়লেই ওরা সেখানে ফিরে যায়।

আচ্ছা! তা হলে পথটা তো ছোট হয়ে গেল।

পাখির তুলনায় ছোট নয়। কয়েকবার হল্ট নিতে হয় নিশ্চয়ই। বলতে বলতে কয়েকটা ময়ূর দেখতে পেয়ে অর্জুন মুগ্ধ হল। এরকম নীরস প্রকৃতি হঠাৎ বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠল ময়ূরগুলোর জন্য।

আমরা নবাবগঞ্জের কাছাকাছি এসে গিয়েছি, অমিতাভ ঘোষণা করলেন।

এবার কিছু বাড়িঘর চোখে পড়ছে। কিন্তু সেগুলো বেশ ছাড়া ছাড়া। একটা পেট্রল পাম্পে অমিতাভ গাড়ি রেখে দিলেন। বিশ লিটার তেল দিতে বলে অর্জুনের দিকে তাকালেন, তোমার ওই ডক্টর বকসির খোঁজখবর নেব নাকি?

এরা বলতে পারবে?

না বলার কোনও কারণ নেই। নবাবগঞ্জ শুরু হয়ে গিয়েছে। তিনি যদি বিখ্যাত আয়ুর্বেদ হন, তা হলে অপরিচিত কেন হবেন?

পেট্রলের দাম দেওয়ার সময় অমিতাভ লখনউয়ের হিন্দিতে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ভাই, নবাবগঞ্জে একজন বিখ্যাত আয়ুর্বেদ আছেন, ডক্টর নীলমোহন বকসি, তাঁর বাড়িটা কোথায়?

আয়ুর্বেদ! ওটা কী ব্যাপার? ছেলেটি বুঝতে পারল না।

যাচ্চলে! কোনও ডাক্তার বকসি এখানে থাকেন?

আমি জানি না।

হাইওয়েতে গাড়ি তুলে অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে খবরের কাগজ থেকে কী ঠিকানা দিয়েছে?

অর্জুন পকেট থেকে কাগজটা বের করল। ডক্টর নীলমোহন বকসি, নিয়ার নবাবগঞ্জ বার্ড স্যাংচুয়ারি, আয়ুর্বেদ লজ, লখনউ, ইউ পি।

নবাবগঞ্জের পাখিদের আস্তানার সামনে গাড়ি থামালেন অমিতাভ। বললেন, এর আশপাশেই ওঁর বাড়ি হওয়া উচিত। বাড়িটা খুঁজে পেলে আমি কি গাড়িতে অপেক্ষা করব?

তা কেন? আপনিও আমার সঙ্গে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে যেতে পারেন!

খুশি হলেন অমিতাভ, আমি তো জানি না, তুমি কীভাবে ওই প্রসঙ্গে যাবে?

মানে?

খবরের কাগজ থেকে ঠিকানা জোগাড় করেছ একথা বলবে?

সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে। রোদ পড়ে গিয়েছে। চলুন, আগে ওঁর বাড়িটা খুঁজে বের করি।

বার্ড স্যাংচুয়ারির দরোয়ানকে বলতেই সে মাথা নাড়ল, আমাদের বাউন্ডারির পাশ দিয়ে চলে যান। রাস্তাটা যেখানে বাঁ দিকে বাঁক নিচ্ছে, তার গায়েই ওঁর বাংলো। গেটে নাম লেখা আছে।

স্যাংচুয়ারির পাশের রাস্তা ধরলেন অমিতাভ। দু’পাশে গাছগাছালি। আর কোনও বাড়িঘর নেই। রাস্তাটা যেখানে বাঁ দিকে বাঁক নিচ্ছে, সেখানেই বন্ধ গেট দেখা গেল। গেটের গায়ে লেখা, আয়ুর্বেদ লজ, ডক্টর এন এম বকসি।

গেটের ওপাশে ঘাসের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে ভিতর দিকে। চট করে দেখলে মনে হয় গাছগাছালির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে রাস্তাটা।

অর্জুন বলল, ভদ্রলোকের বাড়িটা মনে হচ্ছে অনেকখানি জায়গা নিয়ে। যদি অনেক দিনের লোক হন, তা হলে আপনার চেনা উচিত ছিল।

ছিল, যদি উনি বাঙালি হন এবং লখনউয়ের বাঙালিদের সঙ্গে মিশতেন। আমি হলফ করে বলতে পারি এরকম নামের কোনও মানুষকে আমাদের বেঙ্গলি ক্লাবে কখনও দেখিনি। গাড়িটাকে ঘুরিয়ে বাইরেই রেখে দেওয়া যাক, অমিতাভ বললেন।

গেট খুলে ওরা ভিতরে ঢুকল। সন্ধে হতে দেরি নেই। গাছে গাছে পাখিরা চিৎকার শুরু করেছে। রাস্তাটা বাঁ দিকে ঘুরতেই ওরা প্রথমে ঝিল, পরে বাড়িটাকে দেখতে পেল। ঝিলের ধারে বাড়ি। বাড়িটা দোতলা এবং বেশ বড়। সবকটা জানলা এবং ঢোকার দরজা বন্ধ। বাড়ির দু’দিকে জঙ্গল একদিকে ঝিল, সামনে একটা ছোট্ট লন।

অমিতাভ বললেন, ইস! এই অবধি গাড়ি নিয়ে আসা যেত।

অর্জুন বাড়িটাকে দেখছিল। প্রায় দুর্গের মতো দেখাচ্ছে। সে বলল, ভিতরে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। চলুন, নক করা যাক।

সে এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশে ঝোলা একটা পিতলের চেন ধরে টানতেই ঘণ্টা বাজতে লাগল। অনেকটা চার্চের ঘণ্টার মতো আওয়াজ।

অমিতাভ বললেন, বেশ শৌখিন লোক তো!

আওয়াজ থামল কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। অর্জুন চারপাশে তাকাল। দরজার ওপাশে বাড়ির গায়ে একটা লেটার বক্স। কাছে গিয়ে দেখল বাক্স চিঠিতে ভরতি হয়ে আছে। পরিষ্কার হল, ডক্টর বকসি বা তার বাড়ির লোকজন বাড়িতে থাকলে লেটার বক্স ভরতি থাকত না।

ঝিলের উপর সন্ধে নেমেছে। এখনও শীত নামেনি কিন্তু ঝিলের জলে প্রচুর পাখি প্রায় বাজার বসিয়ে দিয়েছে। অমিতাভ বললেন, এরা কিন্তু এ বছরের পাখি নয়।

মানে?

এখনও সাইবেরিয়া অথবা তোমার কথামতো হিমালয় থেকে পাখিদের আসার সময় হয়নি। গতবার যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে যারা ডিম পেড়েছিল, তারা দলের সঙ্গে না ফিরে গিয়ে এখানেই থেকে গিয়েছিল। এই এক বছর ধরে সেই ডিম থেকে পাওয়া বাচ্চাদের বড় করেছে। এবার যে পাখিরা আসবে, তাদের দলে ভিড়ে ওরা ফিরে যাবে, অমিতাভ বুঝিয়ে বললেন।

অর্জুন পাখিদের দেখল। জলপাইগুড়িতে বড়সড় ডাহুক দেখা যেত করলা নদীতে। এগুলো সেই চেহারার।

অর্জুন বলল, কিন্তু কী করা যায় বলুন তো!

উনি বাড়িতে না থাকলে আমরা কী করতে পারি?

ওরকম একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর কেউ বাড়ি থেকে উধাও হয়?

দেওয়ার পর ভেবেছেন, ওঁর বুজরুকি পুলিশ ধরে ফেলতে পারে, তাই গা-ঢাকা দিয়েছেন। এই জন্য বলা হয়, ভাবিয়া করিয়ে কাজ করিয়া ভাবিয়ো না।

হঠাৎ বাড়িটার কোথাও অ্যালার্ম ক্লকের শব্দ শোনা গেল। কয়েক সেকেন্ড। তারপর থেমে গেল। অমিতাভ বললেন, ব্যাপারটা কী হল?

অর্জুন বাড়িটা দেখল। শব্দটা এসেছে বাড়ির যে দিকটা জঙ্গলের গায়ে, সেখান থেকে। সে এগিয়ে গেল। অন্ধকারে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এই সময় একটি লোক সাইকেলে সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল পপাস্ট অফিসের কর্মী। বেশ জোরে চেপে লেটার বক্সে চিঠি ঢুকিয়ে দিয়ে লোকটা হিন্দিতে বলল, আগে চিঠি আসত না বলা চলে। এখন দু’বেলা আসছে, অথচ বাক্স থেকে নেওয়ার লোক বাড়িতে নেই। আপনারা কি এই বাড়িতে থাকেন?

অমিতাভ বললেন, না ভাই!

লোকটি আবার সাইকেলে চেপে চলে গেল।

অমিতাভ বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে কোনও কাজ হবে বলে মনে হয় না।

হ্যাঁ, চলুন। ওরা যখন ফিরে যাচ্ছে, তখন আবার অ্যালার্ম ক্লক বেজে উঠল। অর্জুন দৌড়ে গেল বাঁকটার কাছে। দূরে পোস্টম্যান তখন গেট বন্ধ করছে। গেট বন্ধ হয়ে যেতেই অ্যালার্ম ক্লক থেমে গেল। অর্জুন ঘুরে বাড়িটাকে দেখল। অন্ধকারের ছায়া বাড়িটাকে ভুতুড়ে করে তুলেছে।

কাছে এসে অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

চলুন। গেটটাকে একটু দেখা যাক, অর্জুন হাঁটতে লাগল।

গেটের মধ্যে কি কোনও বিশেষত্ব আছে? অমিতাভ সঙ্গী হলেন।

কথা না বলে অর্জুন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখতে লাগল। এখন আলো নেই বললেই হয়। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার উপায় নেই। সে গেট খুলতেই কানে অ্যালার্ম ক্লকের আওয়াজ ভেসে এল। সেটা এখান থেকে এত মৃদু শোনাচ্ছে যে, ঢোকার সময় খেয়ালই করেনি।

শুনতে পাচ্ছেন?

চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড শোনার পর অমিতাভ বললেন, হ্যাঁ। অ্যালার্ম ক্লক বাজছে। মাই গড! ডক্টর বকসি বাড়ির গেটে নিশ্চয়ই যন্ত্র বসিয়েছেন। কেউ গেট খুললেই উনি টের পেয়ে যান।

গেট বন্ধ করলেন অমিতাভ। আবার শুনে বললেন, থেমে গিয়েছে। কী ব্যাপার?

সতর্কমূলক ব্যবস্থা। নির্জনে থাকেন তাই… অর্জুন কথা শেষ করল না।

গাড়িতে চেপে ওরা আবার বার্ড স্যাংচুয়ারির গেটে চলে এল। গেট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যে লোকটা তাদের ডক্টর বকসির হদিশ দিয়েছিল, সে এখন ইউনিফর্ম ছেড়ে নিজের পোশাক পরে বাড়ি ফিরছে। অমিতাভ তাকেই ডাকলেন, ছুটি হয়ে গেল?

হ্যাঁ সাহেব।

আমরা গিয়েছিলাম ডাক্তারসাহেবের বাড়িতে। বাড়িতে কেউ নেই বলে মনে হল।

একটা দাড়িওয়ালা লোককে দ্যাখেননি?

না তো!

আজ দুপুরে দেখেছিলাম ওকে ঝিলের ধারের দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। খুব লম্বা, ভারী চেহারা। ও হল ডাক্তারসাহেবের কাজের লোক। ডাক্তারসাহেব কখন থাকেন, কখন যান, তাই আমরা টের পাই না, লোকটি চলে গেল উলটো দিকে। অমিতাভ তাকালেন অর্জুনের দিকে।

অর্জুন বলল, চলুন। আপনার অনেক সময় নষ্ট হল।

মোটেই না। এতক্ষণে ব্যাপারটাকে বেশ ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। দাড়িওয়ালা লোকটাকে যদি দুপুরে ওই বাড়িতে দেখা গিয়ে থাকে, তা হলে সে এখন কোথায়? অমিতাভ চোখ বন্ধ করলেন।

দুটোর মধ্যে যে-কোনও একটা জায়গায় থাকা উচিত।

কীরকম, কীরকম?

হয় বাড়ির বাইরে, নয়তো বাড়ির ভিতরে।

ওঃ! তুমি ব্যাপারটাকে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছ না।

দিলে কোনও লাভ হবে না। ও যদি বাড়ির ভিতর থাকে, তা হলে ডক্টর বকসি চাইছেন না বলেই বাইরে বেরোবে না। দরজার তালা তো তাই বলছে। শুধু শুধু ভেবে ভেবে ব্রেনকে নিরর্থক খাটানো। চলুন! অর্জুন বলল।

.

লখনউয়ের বেঙ্গলি ক্লাবে অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। সন্ধে সাড়ে সাতটায় অর্জুন আর চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলিকে নিয়ে অমিতাভ ক্লাবে গেলেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করে জেনেছে মিস্টার গাঙ্গুলির মেয়ে আজ অনেকটা ভাল আছেন।

চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলিকে দেখে বেঙ্গলি ক্লাবে হইচই পড়ে গেল। দীর্ঘদিন পর তাকে পেয়ে সকলে পরম সমাদরে সেক্রেটারির ঘরে নিয়ে গেল। সেক্রেটারি অরুণবাবু নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বললেন, চাঁদুদা, আপনি এখানে বসুন।

মিস্টার গাঙ্গুলি বললেন, তা হয় না। ওই চেয়ারের সম্মানহানি করতে আমি আদৌ রাজি নই। তারপর বলল তোমাদের খবর কী?

ভাল। আপনি এতদিন লখনউ আসেননি কেন? অরুণবাবু জানতে চাইলেন।

বয়স হয়েছে ভায়া। এখন জায়গা বদল করতে আলস্য লাগে। ওহো, তোমরা এঁকে চিনতে পারছ না। অমিতাভ, তোমার উচিত ছিল প্রথমেই ওঁর সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দেওয়া। এই ভায়ার নাম অর্জুন। জলপাইগুড়িতে থাকেন।

এক ভদ্রমহিলা চুপচাপ বসে শুনছিলেন। এবার সোজা হয়ে বললেন, আমি আপনাকে নিয়ে লেখা প্রতিটি অভিযানের গল্প পড়েছি।

সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অমিতাভ বললেন, আচ্ছা, তোমরা কেউ ডক্টর নীলমোহন বকসির নাম শুনেছ?

সকলে চুপ করে রইল। মিস্টার গাঙ্গুলি বললেন, তোমরা বিকেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ভাবলাম। ভেবে দেখলাম, বকসি পদবির একজনকে আমি জানতাম। ইলাহাবাদ মর্গের ডাক্তার ছিলেন তিনি। বছরপঁচিশেক আগে হঠাৎ তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।

সকলে হেসে উঠল রসিকতা ভেবে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কীরকম দেখতে ছিলেন ভদ্রলোক?

রোগা, খাটো চেহারা। এর বেশি মনে নেই।

অমিতাভ ঘোষণা করলেন, অর্জুন এসেছে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। আজ বিকেলে আমরা ওঁর নবাবগঞ্জের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। কিন্তু ভদ্রলোক বাড়িতে তালা দিয়ে কোথায় যেন গিয়েছেন। বলেই মাথা নাড়লেন অমিতাভ, একজন মর্গের ডাক্তার অত বড় সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না।

কিছুক্ষণ পর অর্জুন একাই বাইরের মাঠে এসে দাঁড়াল। পিনাকীরঞ্জন মিত্রের সুটকেস তার ঘরে পড়ে আছে। অন্যের জিনিস, তার উপর সেটা তালাবন্ধ, ভিতরে কী আছে, জানা নেই, ঘরে রাখা খুব বিপজ্জনক। পিনাকীরঞ্জন বলেছিলেন তার বাড়ি লখনউ বেঙ্গলি ক্লাবের পাশে। অমিতাভ ওঁকে চিনতে পারেননি। কিন্তু এখানে অন্য যেসব সদস্য আছেন, তারা নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।

মোটাসোটা চেহারার এক ভদ্রলোক ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন, আপনি একা এখানে দাঁড়িয়ে? ভিতরে আসুন।

যাচ্ছি। আপনি এই শহরে কত দিন?

জন্মেছি এখানে। বাবা এসেছিলেন পাঁচ বছর বয়সে ঠাকুরদার সঙ্গে।

ও! এখানে আর কোনও বেঙ্গলি ক্লাব আছে?

না, সবেধন নীলমণি এই একটিই।

এই ক্লাবের কাছাকাছি পিনাকীরঞ্জন মিত্র নামে এক ভদ্রলোক থাকেন। তাকে চেনেন?

পিনাকীরঞ্জন মিত্র!

একটু ভেবে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, সরি! খেয়াল করতে পারছি না। কী করেন ভদ্রলোক?

স্কুলটিচার বলে শুনেছিলাম।

না। ওহো, দাঁড়ান দাঁড়ান! আপনি কি পি কে মিত্তিরের কথা বলছেন?

পি কে মিত্তির! কী করেন তিনি?

বছরদশেক আগে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও চাকরি নিয়ে গিয়েছেন বলে শুনেছি। এখানে ওঁর একটা বাড়ি আছে। ওঁর পরিবার এখানেই থাকেন। এখানে সকলে ওঁকে ‘পি কে’ বলেই চেনে। দশ বছর ওঁকে দেখিনি। লখনউ এলেও বেশি দিন থাকেন না বলে মনে হয়। ইনি আর আপনার পিনাকীরঞ্জন মিত্র একই লোক হলেও হতে পারেন, ভদ্রলোক আর-একজনকে ডাকলেন, এই ছোটু, তোর পি কে-কে কি মনে আছে?

ছোটু যাঁর নাম, তিনি বেশ সুদর্শন যুবক, হাসলেন, পি কে মানে নার্ভাস পি কে? তিনি তো এখানে থাকেন না।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, নার্ভাস পি কে মানে?

ছোটু বললেন, ভদ্রলোক অকারণেই নার্ভাস হয়ে পড়তেন। আমরা যখন ফুটবল খেলতাম, উনি তখন চিৎকার করতেন, বল লেগে ওঁর বাড়ির কাঁচের জানলা ভেঙে যেতে পারে বলে ওঁর মনে হত। অথচ ওঁর বাড়ির অনেক দূরে আমরা খেলতাম।

বাড়িটা চেনেন?

অবশ্যই।

একটু নিয়ে যাবেন?

ছোটু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মোটরবাইক নিয়ে এলেন। অর্জুন বাইকের পিছনে বসতেই ছোটু বেরিয়ে এলেন ক্লাবের গেট দিয়ে। পি কে মিত্তিরের বাড়িতে পৌঁছোতে মিনিট আড়াই লাগল। এলাকাটা ঘিঞ্জি, গায়ে গায়ে বাড়ি। বেঙ্গলি ক্লাবের পাড়া হলেও বাসিন্দারা অবাঙালি বলাই ভাল।

দোতলা বাড়ির সামনে বাইক থামিয়ে ওরা দেখল, দরজা খোলা। একটি ছেলে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। অর্জুন বাইক থেকে নেমে এগিয়ে গেল, আচ্ছা, পি কে মিত্রর বাড়ি এটা?

ছেলেটা নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

ওঁর ভাল নাম কি পিনাকীরঞ্জন মিত্র?

কেন বলুন তো? ছেলেটি এবার সন্ধিগ্ধ।

বলছি।

হ্যাঁ।

ওঁর কি আজ বাড়িতে ফেরার কথা ছিল?

হ্যাঁ। আপনি কে?।

আমার সঙ্গে ট্রেনে ওঁর আলাপ হয়। উনি নেমে যান মাঝপথে। নামার আগে একটা সুটকেস আমাকে দিয়ে বলেন, সেটা এই বাড়িতে পৌঁছে দিতে। আমি লখনউ আসছি জেনেই উনি অনুরোধ করেন। অর্জুন বলল।

হঠাৎ ছেলেটি চিৎকার করল, মাম্মি, মাম্মি! জলদি এসো! চিৎকার শুনে এক মধ্যবয়সিনী মহিলা ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন, কী হল?

ইনি বলছেন বাবা ওঁর সঙ্গে ট্রেনে আসছিলেন, মাঝরাস্তায় পালটি করে নেমে যান। ওঁকে সুটকেস দিয়ে বলেছেন আমাদের পৌঁছে দিতে। ছেলেটি বলল।

ওমা! ও নেমে গেল কেন? কোনও বিপদ হয়নি তো? ওর মতো মানুষ ট্রেন থেকে নেমে পড়বে কোনও কারণ ছাড়া একথা আমি বিশ্বাসই করি না। ভদ্রমহিলা বেশ জোরে জোরে কথাগুলো বলতে রাস্তার কিছু লোক এদিকে তাকাল।

অর্জুন বলল, দেখুন, আপনি চেঁচিয়ে কথা বলবেন না। তাতে পিনাকীবাবুই বিপদে পড়বেন। পুলিশ ওঁকে খুঁজছে।

সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর নেমে গেল ভদ্রমহিলার, পুলিশ! কী করেছে ও?

উনি ভয় পেয়ে বলেছিলেন ট্রেনে বিস্ফোরক আছে। অন্য যাত্রীদের উত্তেজিত করে ট্রেন থামিয়েছিলেন চেন টেনে। পরে জানা গিয়েছে ট্রেনে কোনও বিস্ফোরক নেই। অহেতুক ভয় দেখিয়ে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগ ওঁর বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার হবেন বুঝে উনি ট্রেন থামতেই নেমে পড়েন। নামার আগে আমায় অনুরোধ করেন সুটকেসটা পৌঁছে দিতে। অর্জুন বলল।

মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা, হ্যাঁ এরকম ওর পক্ষেই করা সম্ভব। যখন এখানে ছিল, জ্বলেপুড়ে মরতাম। চাকরি করতে গেল যখন, তখন ভাবলাম স্বস্তিতে থাকব। এখন কী হবে? কোথায় গেল সে! ধরা পড়ল নাকি! কিন্তু কই, পুলিশ তো এখনও এখানে আসেনি।

উনি রেলের পুলিশকে নিজের ঠিক পরিচয় দেননি।

ও! সুটকেস কোথায়?

আমি যে গেস্ট হাউসে উঠেছি, সেখানে। আমার নাম অর্জুন। অর্জুন গেস্ট হাউসের নাম-ঠিকানা জানিয়ে দিয়ে বলল, ব্যাপারটা জানাজানি হলে পিনাকীবাবুকে ধরতে পুলিশের সুবিধে হবে। আচ্ছা নমস্কার।

ছোটুর বাইকে চেপে ক্লাবে ফিরে এল অর্জুন।

ছোটু বললেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

বলুন।

আপনি তো অপরাধীদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন। কিন্তু দেখলাম, আপনি পি কে-কে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, পুলিশে দিচ্ছেন না। ছোটু বললেন।

দেখুন, উনি অন্যায় করেছেন ঠিকই। কিন্তু ইচ্ছে করে তো করেননি। এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন যে, বুঝতেই পারেননি অন্যায় করেছেন। যখন করলেন, তখন বাঁচার তাগিদে নিজের পরিচয় গোপন করে ট্রেন থেকে নেমে গেলেন। ওঁর কাজের জন্য কারও তেমন ক্ষতি হয়নি। পুলিশ ধরলে কয়েক মাস জেলে পুরে দিত। উনি চাকরি করেন। এটুকু উপেক্ষা করলে তো কোনও ক্ষতি হবে না! অর্জুন বলল।

.

রাত দশটায় গেস্ট হাউসে ফিরে চমকে উঠল অর্জুন। স্বয়ং পিনাকীরঞ্জন মিত্র বসে আছেন তার অপেক্ষায়। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন।

আপনি?

বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। আপনি আমার বাড়িতে খবর দেওয়ার পরই ফিরেছি। খুব বকুনি শুনতে হল স্ত্রীর কাছে। দিন সুটকেসটা।

পিনাকীরঞ্জনকে ঘরে নিয়ে এল অর্জুন। বলল, বসুন। আপনার অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা আগে বলুন।

পিনাকীরঞ্জন ঘরে এসে বললেন, আমি একগ্লাস জল খাব।

গ্লাসে জল ঢেলে এগিয়ে দিল অর্জুন। কয়েক ঢোকে জল শেষ করে দিলেন তিনি।

অর্জুন বলল, ওই আপনার সুটকেস।

আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব!

তার দরকার নেই। কিন্তু আপনি আমাকে ঝুঁকি নিতে বাধ্য করেছিলেন। ওই সুটকেসে যদি চোরাই মাল, মাদক অথবা পিস্তল টিস্তল থাকে, তা হলে আমার কী হত ভেবে দেখুন। আশা করি সেসব কিছু নেই। অর্জুন বলল।

না না। বিশ্বাস করুন ভাই, আমি সত্যি নিরীহ লোক।

একেবারে নিরীহ নন, তা হলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেতেন।

আমি জানি না কেন ধরা পড়লাম না। হয়তো পুলিশ আমাকে তেমনভাবে খোঁজাখুঁজি করেনি। আচ্ছা, যে জলটা দিলেন, সেটা ফোঁটানো তো? ভদ্রলোকের চোখে-মুখে হঠাৎ অস্বস্তি ফুটে উঠল।

নিশ্চিন্ত থাকুন। এবার বলুন, ট্রেন থেকে নেমে কী করলেন?

সোজা মেন গেট দিয়ে বাইরে চলে এলাম। কোনও চেকার ছিল না, তাই টিকিট দেখাতে হয়নি। বেরিয়ে একটা রিকশায় চেপে শহরের বাস টার্মিনাসে পৌঁছে বাস বদলে বদলে কানপুরে পৌঁছাতে সন্ধে হয়ে গেল। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল এই বুঝি পুলিশ ধরল! কিন্তু ধরেনি। পিনাকীরঞ্জন বললেন।

ধরলে আপনি আমার সামনে বসে থাকতেন না, অর্জুন মাথা নেড়ে বলল, কানপুর থেকে ট্যাক্সি নিলেন?

না। একা ট্যাক্সিতে উঠতে কীরকম নার্ভাস লাগে।

কেন?

ভয় হয় যদি অ্যাক্সিডেন্ট করে, তা হলে আমি মরে যাব। আর বাড়ির লোকজন জানতেও পারবে না আমি কোথায় পড়ে আছি। তার উপর কানপুর লখনউ হাইওয়েতে ড্রাইভাররা খুব জোরে গাড়ি চালায়।

তা হলে এলেন কী করে?

হাইওয়ের মুখ পর্যন্ত রিকশায় এলাম। ট্রেনে আসতে পারতাম, কিন্তু রেলওয়ে পুলিশকে এড়াতে স্টেশনে যাইনি। হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাত তুলে গাড়ি থামাতে চাইলাম। বড় ট্রাকে জায়গা পেলে ভয় কমে যায়। অ্যাক্সিডেন্ট হলে ছোট গাড়ির ক্ষতি হবে, কিন্তু ট্রাক ঠিক থাকবে। কিন্তু ট্রাকগুলো থামছিল না। শেষপর্যন্ত একটা বড় গাড়ি থামতেই আমি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম লখনউ যাবে কিনা। গাড়ি চালাচ্ছিলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। মাথা নেড়ে ইশারায় জানালেন, যাচ্ছে।

আমি উঠে পড়তেই গাড়ি চলতে শুরু করল। ঘণ্টাখানেক কোনও কথাবার্তা নেই। অন্ধকারে হেডলাইট জ্বেলে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। একঘণ্টা ধৈর্য ধরার পর বললাম, কিছু মনে করবেন না, বেশিক্ষণ চুপ করে থাকলে আমার কীরকম লাগে। আপনি লখনউয়ের কোথায় যাচ্ছেন?

হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে নবাবগঞ্জে নামিয়ে দিলে অসুবিধে হবে?

একেবারে লখনউয়ের হিন্দি! বললাম, স্যার, এত রাতে ওখানে কি বাস পাব?

আমি নিশ্চয়ই আপনাকে আপনার বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিতে পারি না।

না স্যার, তার কোনও দরকার নেই।

আপনি কানপুর থেকে ট্রেনে এলেন না কেন?

আমি স্যার কানপুর থেকে আসিনি, বললাম, কোচবিহার থেকে আসছি।

খালি হাতে? ভদ্রলোক অবাক হলেন।

বুঝলাম কোচবিহারের কথা বলে ভুল করে ফেলেছি।

আমার মনে হচ্ছে আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। মিথ্যেবাদীদের আমি লিফট দিই না। ভদ্রলোক গাড়ির গতি কমালেন।

ওই খাঁ-খাঁ প্রান্তরের অন্ধকারে যদি গাড়ি থেকে নেমে যেতে হয়, তা হলে আর সকাল দেখতে হবে না। তাড়াতাড়ি বললাম, বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যে বলছি না। আমি কোচবিহার থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। মাঝরাস্তায় প্ল্যাটফর্মে নেমে আর ট্রেনে উঠতে পারিনি। তারপর থেকে বাস বদলে কানপুরে পৌঁছেছি। আমার জিনিসপত্র ট্রেনে পড়ে আছে।

আপনার নাম?

পিনাকী, বলেই খেয়াল হল, পিনাকেশ মিত্র।

বাঙালি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গাড়ি আবার চলা শুরু করল, কী করেন?

আজ্ঞে, একটা ছোটখাটো চাকরি করি।

আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য আছে?

আজ্ঞে?

সকালে পেট পরিষ্কার হয় কি?

না। কয়েকবার যেতে হয়।

আগের রাতে জলে ত্রিফলা ভিজিয়ে রাখবেন, ভোরবেলায় খাবেন। কোনও ফোন নম্বর আছে?

না।

তারপর চুপচাপ। নবাবগঞ্জ আসতেই দেখলাম, একটা বাস লখনউ যাচ্ছে। ভদ্রলোক সেটা ধরিয়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বললেন, দু’দিন ত্রিফলা খেয়ে আমাকে ফোনে জানাবেন উপকার হল কিনা।

ধন্যবাদ জানিয়ে সেই বাসে চেপে ফিরে এসেছি। ওঃ! এরকম জানি আমি এর আগে কখনও করিনি, পিনাকীরঞ্জন মিত্র বললেন।

নিজের নামটা ভদ্রলোককে ঠিক বললেন না কেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

লোকটাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যদি পুলিশ হয়!

ইউ পি-র লোক?

মনে হল। হিন্দিতে উর্দু শব্দ মেশানো। খুব পার্সোনালিটি আছে। আচ্ছা, আমি এবার যাব। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আর সারাদিন যা গেল, এখন বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে পারলে বাঁচি।

পিনাকীরঞ্জন এগিয়ে গিয়ে সুটকেস তুলে নিলেন, খুব ভারী না? তবু তো আপনি বয়ে এনেছেন। আচ্ছা, আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি।

অর্জুন। জলপাইগুড়িতে থাকি। তা হলে আজ থেকে আপনি ত্রিফলা খাচ্ছেন?

আজ আর কেনা হবে না। সত্যি কি উপকার হয়?

অবশ্যই হয়। শুধু কোষ্ঠকাঠিন্য কেন, আরও অনেক কিছুতে কাজে লাগে।

দেখুন, কার জন্য কোথায় কী অপেক্ষা করছে, তা কেউ জানে না। যদি কাজ হয় ভদ্রলোককে ফোন করে ধন্যবাদ জানাব। সুটকেস তুলে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন পিনাকীরঞ্জন। অর্জুনের হঠাৎ খেয়াল হল, এক মিনিট।

ভদ্রলোক তাকালেন।

আপনার কাছে ওঁর কার্ডটা এখন আছে?

না। বাড়িতে রেখে এসেছি। জামাপ্যান্ট চেঞ্জ করেছি তো?

আশপাশে টেলিফোন বুথ আছে?

একেবারে উলটো দিকে।

গেস্ট হাউসের টেলিফোনের তলায় ছাপা নির্দেশাবলি থেকে নম্বর দেখে একটা কাগজে সেটা লিখে পিনাকীরঞ্জনকে দিল অর্জুন, যদি একটু কষ্ট করেন, ভদ্রলোকের নাম আর টেলিফোন নম্বরটা যদি আমাকে ফোন করে বলেন!

কষ্ট কী! নিশ্চয়ই করব। মনে হচ্ছে আপনারও কোষ্ঠকাঠিন্য আছে! পিনাকীরঞ্জন চলে গেলেন।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress