ননীদা কিন্তু আপত্তি করলেন না
ননীদা কিন্তু আপত্তি করলেন না তন্ময়কে দেখে। রবিবার আমাদের মাঠেই ভ্রাতৃসঙ্ঘের সঙ্গে খেলা। সাতজন মাত্র আমাদের প্লেয়ার হাজির হয়েছে। শুকনো মুখে আমি আর ননীদা তাঁবুর মধ্যে যাচ্ছি আর ফিরে আসছি। খেলার কুড়ি মিনিট মাত্র তখন বাকি। এমন সময় তন্ময় এসে পৌঁছল। ননীদা কপাল এবং ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন।
বললাম, তন্ময় আজ খেলবে।
আমি তো জানতাম না! টিমে তো ওর নাম দেখছি না?
আপনাকে বলতে ভুলে গেছি আজ তন্ময় খেলছে। টিমের কাউকে বসিয়ে দিয়ে ওকে খেলালেই হবে। আসলে আমি ইচ্ছে করেই আগে বলিনি। ননীদা যদি বাগড়া দেন এই ভয়ে।
টিমে যে আছে তাকে বিনা দোষে বসানো উচিত নয়। এই বলে ননীদা আবার তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তন্ময়কে না খেলিয়ে উপায় ছিল না। চারজন খেলোয়াড় আর এলই না। লিগের শেষ দিকে এই রকমই অবস্থা হয় আমাদের ক্লাবে।
ননীদাকে বাইরে এসে ধরলাম। তন্ময়কে আজ খেলাতে চাই কেন জানেন, শুধু আমাদের দরকারেই নয়, ওরও দরকার! একটা চাকরি পাবার কথা হচ্ছে। সেক্রেটারি আজ খেলা দেখতে আসবে ওর। যদি শো করাতে পারে তা হলে চাকরিটা হয়েও যেতে পারে।
কাউকে চাকরি করে দেবার জন্য তো আমরা লিগ খেলি না।
কিন্তু খেলে যদি কেউ চাকরি পায়ই তাকে আমাদের সাহায্য করা উচিত নয় কি? ননীদা, আপনি বউদির গহনা বিক্রি করেও ওকে ব্যাটের টাকা দিয়েছিলেন কেন?
ক্লাবকে অপমান থেকে বাঁচাতে।
মোটেই নয়, আপনি বলেছিলেন ছেলেটা আর্টিস্ট। ওর ক্রিকেট আর্টে মুগ্ধ হয়ে পুরস্কার দিয়েছিলেন।
সেজন্য আমি দুঃখিত। বিনা পরিশ্রমে আর্টিস্ট হওয়া যায় না। এ ছেলেটা ফাঁকিবাজ। ননীদা আর কথা না বলে যথারীতি দুর্যোধনের খোঁজে চলে গেলেন।
তন্ময়কে নিয়ে আটজন। অবশেষে ননীদাকেও নামতে হল। একটা বাড়তি ট্রাউজার্স আমার ব্যাগে থাকেই। সেটা পরলেন। ঝুলে বড়, কোমরে ছোট, ঘের অর্ধেক। কেডস্ জোগাড় হল। সাদা পাঞ্জাবিটা ট্রাউজার্সে গুঁজে নিলেন। আমরা টসে জিতে নজনে ফিল্ড করতে নামলাম।
ননীদা স্লিপে প্রথম দুওভারে তিনটি ক্যাচ ফেললেন। তা সত্বেও ভ্রাতৃসঙ্ঘ সুবিধা করতে পারল না, আমাদের নতুন মিডিয়াম পেসার ছেলেটির বলে। তিন উইকেটে ৭৪ থেকে সবাই আউট হল ৯৬ এ।
ননীদা বললে, আনাবে উপরদিকে ব্যাট করতে পাঠিও না, মাঝামাঝি রেখো।
তন্ময়ু একটি লোকের সঙ্গে কথা বলছিলা। সে আমার দিকে হাত তুলে ছুটে এল। মতিদা, ওরা এসেছে।
তা হলে ওয়ান ডাউন যাও।
না না, আর একটু তলায় দিন।
তন্ময়কে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে। নিজের উপর যেন আস্থা রাখতে পারছে না। এলাম, খেলা যদি দেখাতে চাও তা হলে তলার দিকে ব্যাট করে লাভ কী হবে। যদি সবাই আউট হয়ে যায়, তুমি শুধু নট আউটই থাকবে। কিন্তু ওরা এসেছে। তোমার স্কোর দেখতে।
আমাদের দুটি উইকেটে ২২, তন্ময় নামল। নেমেই প্রথম বলে এক্সট্রা কভারে চার। হাঁফ ছাড়লাম আমি অপর উইকেটে দাঁড়িয়ে। এরকম কতকগুলো মার মারতে পারলে কনফিডেন্স পাবে। ৩২ রানের মাথায় আমি স্ট্যাম্পড হলাম ভ্রাতৃসঙ্ঘের অফস্পিনারের বল হাঁকড়াতে গিয়ে। এরপরই তন্ময়ের খেলা কেমন যেন গুটিয়ে গেল। ১১ রান করে ও আর ব্যাট তুলতেই চায় না। আধ ঘণ্টা কোনও রান করল না।
ননীদা হঠাৎ আমায় বললেন, ব্যাটিং অর্ডারটা একটু বদলাও, এরপর আমি ব্যাট করতে যাব।
আমার মনে একটা খারাপ চিন্তা এল।
তন্ময় যে অপমান করেছে তার চমৎকার শোধ ননীদা এখন নিতে পারেন। ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনার দফা রফা হয়ে যাবে, ঠিক যে ভাবে আমি ওর ব্যাট পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট করেছিলাম। ননীদা এখন মাঠে নেমে যদি তন্ময়কে রান আউট করে দেন? বললাম, ননীদা, আমাদের তো দুজন কম। আপনি যদি ফাইভ কি সিক্স ডাউন যান তা হলে ভাল হয়। শেষদিকে আটকাবার কেউ নেই।
কী ভেবে ননীদা বললেন, আচ্ছা।
পরপর আমাদের দুটো উইকেট পড়ল ৪৬ ও ৪৯ রানে। ননীদা খুব মন দিয়ে খেলা দেখছেন। একবার আমাকে বললেন, অফস্পিনারটা ভাল ফ্লাইট করাচ্ছে। তন্ময়টা বোকার মতো খেলছে, এখুনি শর্ট লেগে ক্যাচ দেবে।
হঠাৎ চিতুকে দেখি আমাদের স্কোরারের পিছনে দাঁড়িয়ে স্কোর বুকে উঁকি দিচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, পাঁচ উইকেটে উনপঞ্চাশ, পারবি না তোরা। হাতে আছে তিন উইকেট। সাতচল্লিশ তুললে তবেই জিত। পারবি না, হেরে যাবি। বলে চিতু হাসতে লাগল।
তোর খেলা নেই আজ?
হচ্ছে, গ্রিয়ার মাঠে। আমরা ব্যাট করছি। আমি আউট। ভাবলাম, দেখে আসি এ মাঠে কী হচ্ছে ! আমরা প্রায় জিতে গেছি। তোদের তো শোচনীয় ব্যাপার।
মাঠে একটা হায় হায় শব্দ উঠল। তন্ময়ের সহজ ক্যাচ শর্ট লেগ ফেলে দিয়েছে। তন্ময়ের মুখ পাংশু। পঞ্চাশ মিনিট খেলে করেছে ১৮ রান।
ব্যাপার কী? তন্ময় যে আজ এমন করে খেলছে? ননীদা প্যাড পরতে পরতে আমায় বললেন।
যাদের আসার কথা তারা খেলা দেখতে এসে গেছে। তাই নার্ভাস হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে।
সেলফিশ! নিজের জন্য খেলছে, টিমের জন্য খেলছে না! গম্ভীর হয়ে ননীদা বললেন আর তখনি ৫৭ রানের মাথায় আউট হল ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান। অফস্পিনারের পঞ্চম শিকার।
তোদের হয়ে গেল! চিতু চেঁচিয়ে বলল, ননীদা মাথা নিচু করে গ্লাভস পরছিলেন। চিতুর দিকে তাকালেন।
কী হয়ে গেল? ননীদা গম্ভীর স্বরে চিতুকে প্রশ্ন করলেন।
ম্যাচ হয়ে গেল।
আজও তুমি ক্রিকেটের ক বুঝলে না। একটা কুলিই রয়ে গেলে।
চিতুর রাগী মুখটা দেখার জন্য ননীদা আর অপেক্ষা করলেন না।
উইকেটে পৌঁছে তন্ময়কে ননীদা কী যেন বললেন, অফস্পিনারটি বল করছে। ননীদা প্রত্যেকটা বলে পা বাড়িয়ে ব্যাটটা শেষ মুহূর্তে তুলে নিয়ে প্যাডে লাগাতে লাগলেন। ওদিকে হঠাৎ তন্ময় পরপর দুটো স্ট্রেট ড্রাইভ থেকে আট রান নিল।
ননীদার দিকে রয়েছে অফস্পিন বোলারটি। ওকে একটার পর একটা মেডেন দিয়ে যেতে লাগলেন ননীদা। কিন্তু তন্ময়কে এদিকের উইকেটে খেলতে দিচ্ছেন না। দু-একবার রান নেবার জন্য তন্ময় ছুটে এসেছে, ননীদা চিৎকার করে বারণ করেছেন।
নিজের ৪৮ রানে পৌঁছে তন্ময় গ্লান্স করেই দৌড়ল দুটি রান নিয়ে হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করবে বলে। দৌড়বার আগে লক্ষই করেনি শর্ট স্কোয়ার লেগ বল থেকে কতটা দূরে। তন্ময় যখন পিচের মাঝামাঝি, ননীদা ওকে ফেরত যাবার জন্য চিৎকার করছেন। তন্ময় ফিরে তাকিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর কিছু করার নেই তার। স্কোয়ার লেগের ছোড়া বল উইকেটকিপার ধরেছে। তন্ময় চোখ বন্ধ করে ফেলল।
হাউজ্যাট? চিৎকারে অন্য মাঠের লোকও ফিরে তাকাল। তন্ময় আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখল ননীদা হাসছেন। তারপর মাথাটা কাত করে রওনা হলেন। তন্ময় চোখ বুজিয়ে থাকায় দেখতে পায়নি, ননীদা কখন যেন ছুটে তাকে অতিক্রম করে নিজে রান আউট হলেন।
ননীদা প্যাড খুলছেন। বললাম, কী ব্যাপার? বললেন, ক্রিকেটে অসাবধান হলেও যেমন মৃত্যু আছে, তেমনি আত্মহত্যাও আছে। সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করে এখন আমার হবেটা কী? তার থেকে যার ভবিষ্যৎ আছে, সে খেলুক।
পরের ওভারে তন্ময় দুটি ওভার বাউন্ডারি মারল। আমরা জিতে গেলাম। ওকে কাঁধে তুলে আনার জন্য আমরা মাঠে ছুটে গেলাম।
বহুক্ষণ পর, তাঁবু তখন প্রায় ফাঁকা। দুর্যোধন এসে আমায় বলল, বাবু দেখিবারে আসো।
ওর সঙ্গে তাঁবুর পিছনে গিয়ে দেখি, ফেন্সের ধারে তন্ময় ব্যাট নিয়ে একটা কাল্পনিক বলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে স্ট্যাচুর মতো হয়ে আছে। আর ননীদা পিছনে দাঁড়িয়ে।
দ্যাখো, পা-টা কোথায়? বলের লাইনের কত বাইরে? কাল থেকে দুশোবার রোজ স্যাডো প্র্যাকটিস করবে। দুশোবার!