দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 09
গঙ্গাপ্রসাদের হয়েছে নানা দিকে মুশকিল। একে কাজল তাঁকে প্রতিদিন দশটা সাড়ে দশটায় বাড়ি থেকে বার করে দিচ্ছে। দিদিমাসির বাড়ি সে রোজ কী পাঁচালি শুনতে যায়, সেখানেই খাওয়া-দাওয়া। ছেলেমেয়ে বাড়ি নেই তার খুব মজা। অন্যত্র খাওয়া থাকলে, বাড়িতে রান্না করতে না হলে কাজলরেখা আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে দুদিন এক জিনিস রাঁধলে খাবে না। সুতরাং তারা থাকলে কাজলরেখার সমূহ মুশকিল। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদকে কী খেতে দেওয়া হচ্ছে না-হচ্ছে তাঁর খেয়ালও থাকে না। সুতরাং রোজ কাজল আলুকপি বড়ি মাছ দিয়ে একটা ঝোল রাঁধছে। ডাল আর গোটাকয়েক সবজি ভাতে ফেলে দিয়েছে। তারপর সাড়ে নটা বাজতে না-বাজতেই সে পড়ার ঘরে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দেয়। —কী গো তোমার হলো? কী গেঁতো কী গেঁতো? বাপরে বাপ।
—আমার অভিধানটা কে লিখবে? —গঙ্গাপ্রসাদ গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করেন।
—আর একটু সকাল-সকাল উঠলে পারো।
—আরও সকাল? সাড়ে চারটেয় উঠেছি। ওদিকে রাত্তিরে একটা দুটো পর্যন্ত নয়জি ফিল্ম দেখবে, ঘুমোবো কতটুকু?
—বয়সে ঘুম কমে যায়, তা জানো?
—আমার তা হলে তত বয়স হয়ে গেছে?
—তোমার সঙ্গে কথা বলাই আমার ঝকমারি হয়েছে। না তুমি খোকাবাবু তোমার বয়স হয়নি।
শীতকালের দিনে সকালে ব্রেকফাস্টে একটা করে ডিম বরাদ্দ গঙ্গাপ্রসাদের। কিন্তু পাছে তাঁর সাড়ে ন’টায় খিদে না পায় তাই এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট ছাড়া কদিনই তিনি কিছু পাচ্ছেন না। তবে কাজলরেখার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি নেই। ডিমটা সে ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ করে দিচ্ছে।
সাড়ে ন’টার সময়ে ভাত বেড়ে দিয়ে, সে বেশ মনোযোগী গৃহিণীর মতো সামনে বসে।
—সকালে আমার ডিমটা!
—এই নাও তোমার ডিম—ডিম থেকে ভাত ছাড়াতে ছাড়াতে কাজল বলে।
—এই নাও কাঁচকলা সেদ্ধ—আয়রন। ধুঁধুল সেদ্ধ—ফাইবার আছে। আর ঝোলে তো সব। সব।
তৃতীয় দিনে গঙ্গাপ্রসাদের কেমন সন্দেহ হয়। তিনি বলেন আচ্ছা— এই ঝোলটাই গত দুদিন ধরে দু বেলা খাচ্ছি, না?
—ইস্স্, তোমার কী সন্দেহ বাতিক! কাজল গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে।
—কেন, সন্দেহের এর মধ্যে কী হল?
—এক রকমের ঝোল বলতে পারো, ‘এই ঝোলটা’ বললে সন্দেহবাতিক বলব বইকি! আর এক রকমেরই বা কেন? একদিন পাঁচফোড়ন, একদিন জিরে, আর একদিন রাঁধুনি দিয়ে সাঁতলেছি। তফাত নেই! জিভের তোমার কোনও সুক্ষ্মতা নেই, পড়তে দিদিমাসির হাতে!
—আহা, তিনি স্বয়ং তো আগেই দাদামেসোর হাতে পড়ে গিয়েছিলেন— গঙ্গাপ্রসাদ সংক্ষেপে বলে।
—তা পড়েছিলেন— কাজল কী রকম অর্থপূর্ণভাবে বলে।
—মশলা খাবে না?
—খাওয়াটা আগে শেষ করি, তারপর তো মশলা! তুমি কি খাওয়ার মাঝ মধ্যেখানেই ভাতের দলার মধ্যেই মশলা ঢুকিয়ে দেবে?
এইবার কাজলের ধৈর্যচ্যুতি হয়। তার আবার একটু সাজগোজের বাহার আছে কি না! সে মশলার প্লেটে মশলা রেখে দিয়ে বলে—তুমি খেতে থাকো, আমি আসছি।
আর আসে না।
গঙ্গাপ্রসাদ তৈরি হয়ে হাতে তালা-চাবি নিয়ে রেডি। তখন কাজল ঘর থেকে বেরোয়। ফুলিয়ার খড়কে ডুরে শাড়ি, কালো ফুল-ছাপ ব্লাউজ। কপালে এত্ত বড় কালচে খয়েরি টিপ। ঝমঝম করছে গয়নার শব্দ।
—অত গয়না পরে রাস্তায় বেরোনটা ঠিক না।
গঙ্গাপ্রসাদের চোখের সামনে হাতটা নাচিয়ে নিয়ে কাজল বলে— সব নকল, নিক না কে কত নেবে! এয়োস্ত্রী মেয়ে গয়না না পরলে মানায়? গঙ্গাপ্রসাদ এয়োস্ত্রী কথাটা কাজলের মুখে যেন নতুন শুনলেন। শব্দটার ব্যুৎপত্তি ভাবতে ভাবতে তিনি দরজায় তালা লাগালেন, কাজল টেনে দেখল। তারপর দুজনে দুদিকে। ফেরবার সময়ে রোজ গঙ্গাপ্রসাদকে দিদিমাসির বাড়ি থেকে কাজলকে সংগ্রহ করে বাড়ি আসতে হয়। এই নতুন ডিউটিটা গঙ্গাপ্রসাদ মোটেই পছন্দ করছেন না, কলেজের পর তাঁকে রোজ কলেজ স্ট্রিটে যেতে হয় অভিধানের কাজ সংকলনের ব্যাপারে। সেখান থেকে ফিরতে আটটাও হতে পারে, নটাও হতে পারে, তারপরে এগিয়ে গিয়ে কাজলকে নিয়ে আসা— না, না সে তাঁর খুব বিরক্ত লাগে। তিনি হতাশের মতো দেখেন ওইয্ যাঃ, তাঁর নিজের গোয়াবাগানের গলি পেরিয়ে গেল। এখনও তিন চারটে স্টপ তাঁকে এগিয়ে যেতে হবে। তারপর গলির মধ্যে হাঁটো …। কিন্তু উপায়ই বা কী? কাজল নইলে আসবে না। বলে দিয়েছে। সে যে স্বামী-পরিত্যক্তা নয় এইটা বোঝাতে নাকি গঙ্গাপ্রসাদের নিয়ম করে রোজ রাত্তিরে দিদিমাসির বাড়ি থেকে তাকে এসকর্ট করে নিয়ে আসতে হবে। তারপর রোজ সেখানে কাজলের মামিমারা তাঁকে খেয়েদেয়ে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করবেন। তাঁদের খাওয়ানো মানে, রাত্তির দশটা কি এগায়োয় কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে খাগড়াই কাঁসার বাসনে ফুলকো ফুলকো সাদা লুচি গণ্ডা গণ্ডা বা বলা উচিত আগণ্ডা, কব্জি ডুবোনো কচি পাঁঠার মাংস, ভেটকি মাছ, কপি, বেগুন সে এক এলাহি কাণ্ড। প্রথম দিন অগত্যা রাজি হয়েছিলেন। ভজমামা বলে একটি মজাদার মামা আছে কাজলের, চোখ গোল গোল করে তাঁর সঙ্গে এতক্ষণ গল্প করছিলেন। জামাই খেতে রাজি হয়েছে শুনেই, হঠাৎ উঠে গোঁত্তা মেরে পেছন দিয়ে পালিয়ে গেলেন। পরে খেতে বসে বোঝা গেল— ভজমামার কেরামতি। গঙ্গাপ্রসাদ ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিলেন— কেন বাড়িতে যা হয়েছে তা কি খেতে দেওয়া যায় না!
ভজমামা বলল— ওরে বাবা, বাড়িতে যা হয়েছে সে একেবারে এলাকাঁড়ি। দেবে কী?
সামনে আবার পালঙ্কের ওপর দিদিমাসি বসা। তিনি বললেন— কেন দেওয়া যাবে না? তবে সে নাতজামাই যদি নাতজামাইয়ের মতনটি না হয় তবেই।
—লুচি মুখে গঙ্গাপ্রসাদ হাঁ। এ আবার কী ধাঁধা রে বাবা। নাতজামাই—নাতজামাইয়ের মতো হবে না?
ব্যাখ্যা করে বললেন দিদিমাসি— রোজ আসা-যাওয়া করো তো বুঝি, কুটুম-বাটুম নয়, আপনার লোক, তখন বাড়ির জিনিস ধরে দেওয়া যায়। তুমি আসবে বচ্ছরে একবার তো তোমাকে এমনিই খেতে হবে।
যাই হোক, কাজলকে আনতে না গেলে সে আসবে না। সুতরাং চলো শ্যামবাজার। সত্যি-সত্যি একদিন না আনতে গিয়ে দেখেছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ। সাড়ে ন’টায় বাড়ি ফিরলেন তালা খুলে। সব অন্ধকার। পাওয়ার কাট। কারণ সুইচ টিপতে জ্বলল না। নিজের ব্যাগে খুঁজে দেখলেন টর্চ নেই। তাঁর ব্যাগ সাধারণত তিনি নিজেই গুছিয়ে নেন। তবে কাজল এটা-ওটা মনে করিয়ে দেয়।
—কলম নিয়েছ?
—পড়ার চশমা? ‘সবুজ’ ডায়েরি? —টর্চ? —টিফিন বাক্স? —এই রকম। তা এ কদিন দিদিমাসির বাড়িতে যে কী মধুর সঞ্চার হয়েছে : কাজল একেবারে উন্মনা।
টর্চ ছাড়া দোতলায় উঠতে গিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ দু-তিনবার ঠোক্কর খেলেন। তারপর দোতলায় উঠে কোনও নরম জিনিসের ওপর ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলেন। নরম জিনিসটা ঘ্যাঁও করে আওয়াজ করে লাফিয়ে পালাল। কোনক্রমে উঠে গঙ্গাপ্রসাদ দেখলেন আশপাশের বাড়ি আলো ঝলমল করছে। তিনি দালানের চল্লিশ পাওয়ারের বালবটা জ্বেলে দেখতে লাগলেন কোথাও বেড়ালের আঁচড় আছে কি না। থাকলে তাঁকে এক্ষুনি টক্সয়েড নিতে যেতে হবে। হয়ত সেই বারোটা মারাত্মক অ্যান্টির্যাবিজও। হাঁটুটা ছড়ে গেছে। সেটা পড়ে না আঁচড়ে? গঙ্গাপ্রসাদ স্থির করতে পারলেন না। কোনক্রমে জিনিসপত্র যথাস্থানে রেখে খুঁজেপেতে ডেটল দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করলেন। তারপর ঢং ঢং করে দশটা বাজার আওয়াজে চমকে উঠে ফোন করলেন।
—কাজল আছে?
—বলছি।
—দশটা বাজল।
—তা বাজল।
—কাজল আমায় বোধ হয় বেড়ালে আঁচড়েছে।
—বেড়াল আবার কে? ফেণী? ও কাউকে আঁচড়ায় না।
—না ফেণী নয়, বোধ হয়, কোনও হুলো, অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি।
—তাহলে ও যে হুলো সে কংক্লুশনে আসছো কী করে?
—কী রকম ঘ্যাঁও মতো আওয়াজ ছাড়ল।
—তুমি তোমার দু মনি দেহ নিয়ে ওইটুকু তুলতুলির গায়ে দমাস করে পড়বে, তো ও ঘ্যাঁও করবে না তো কি আও আও করবে?
—কিন্তু হাঁটু ছড়েছে।
—ডেটল লাগাও। আশা করি পেয়েছ।
—পেয়েছি।
—পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য সম্ভব করেছ, এখন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো।
—কী খাবো? গঙ্গাপ্রসাদ কাঁদো-কাঁদো। তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছে।
—ফ্রিজটা খুলে দেখো, কিছুমিছু নিশ্চয় আছে, গরম করে নাও, নিয়ে টেবিলে বসো, খাও, বাসনগুলো সিঙ্কে নামিয়ে দাও, টেবিলটা পোঁছো। তারপর অভিধান লেখো গিয়ে— বোঝাই যাচ্ছে কাজল রেগে গুম হয়ে আছে।
ক্ষীণস্বরে গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— দশটার সময়ে কি আর তোমায় আনতে যাওয়া যায়? না তুমিই একা আসতে পারো? আচ্ছা ভজমামাকে বললে হয় না? যদি তোমায় পৌঁছে দেন!
ওদিকে ফোন রেখে দেওয়ার কটাং শব্দটা হল।
গঙ্গাপ্রসাদ ফ্রিজ খুলে দেখলেন। একটু ভাত আছে এবং আছে সেই ঝোল। একবাটি। তিনি বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ডিম রয়েছে যথেষ্ট, পাঁউরুটি রয়েছে, এক প্যাকেট দুধ রয়েছে। ফল-ফুলুরির মধ্যে ফ্রিজের মাথায় একছড়া কলা।
শীতের রাত, কী করেন গঙ্গাপ্রসাদ? ঠিকাছে, পাঁউরুটি সেঁকে নেওয়া যাবে, আর দুধ, সেই সঙ্গে একটা ডবল ডিমের ওমলেট।
হঠাৎ দুম করে মনে পড়ে গেল— গ্যাস জ্বালতে তো তিনি জানেন না? গ্যাস খুব গোলমেলে জিনিস। নিজের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে নিজে বেগুন পোড়ো হওয়ার চেয়ে উপবাস ভালো। সর্বনাশ! ফ্রিজ থেকে বার করা দুধের প্যাকেট পাঁউরুটি আর ডিমের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন গঙ্গাপ্রসাদ। কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে, অবশ্য একটা উপায় বার হল। পাঁউরুটি সেঁকার একটা ইলেকট্রিক টোস্টার রয়েছে অসুবিধে নেই। দুধটা গঙ্গাপ্রসাদ একটা বাটিতে ঢাললেন, ইস্ত্রিটা গরম করলেন। এবার সেটাকে উল্টো করে ধরে দুধের বাটি বসিয়ে গরম করে নিলেন, এবার ডিমের পালা, ইস্ত্রি যা গরম হয়েছে তাতে করে এবার সুইচ অফ করে দিলেই হয়। তারপর তিনি ইস্ত্রির ওপরটা এক-চামচ তেল মাখিয়ে নিলেন। ডিম দুটো বাটিতে ভেঙে রেখেছিলেন। গরম তেল মাখানো ইস্ত্রির ওপর চড়াৎ করে সেটা ফেলে দিলেন, মুহূর্তের মধ্যে ডিমের স্বচ্ছ অংশ সাদা হয়ে ফুটে উঠল, হলদে দুটো টিপি হয়ে রইল। তবে ইস্ত্রি থেকে ডিম ছাড়াতে গঙ্গাপ্রসাদকে বিস্তর বেগ পেতে হল। পুড়ে গেল, ডিমের হলদে গড়িয়ে গেল। যাই হোক, খাওয়াটা মোটামুটি হল। হয়ে গেল।
পরদিন ভোরবেলা গিয়েই কাজলকে নিয়ে এলেন। কাজল ফ্রিজ খুলে বলল— সবই তো রয়েছে দেখছি। কী খেলে?
—পাঁউরুটি টোস্ট, ডবল ডিম ভাজা, গরম দুধ।
—বলো কি? কে করে দিল?
—তুমি। তুমিই করে দিলে— রহস্যময় মুখ করে বললেন গঙ্গাপ্রসাদ।
—আমি? আমি করলুম? মানে?
—মানে আবার কি? তুমি যে আমার স্ত্রী সেটা স্বীকার করো তো? না, কী?
—না করে উপায়?
—ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন স্ত্রীকে তো ইস্ত্রিও বলা যায়? যায় না?
—কাজল বিমূঢ়ভাবে চেয়ে থেকে বললে— ইস্ত্রি? হ্যাঁ, মুখ্যুসুখ্যু গাঁয়ের লোকেরা বলতে পারে—
—যারাই বলুক, কাজে লাগে সবারই, ইতর-ভদ্র, মূর্খ-বিদ্বান। বড় কাজের .. যাই বলো।
কাজল বোকার মতো চাইতে চাইতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এর দশ মিনিট পরে কাজলের চিল-চিৎকার। এ কী? আয়রনটা এরকম করলে কে? এ কী? পোড়াপোড়া এসব কী? ডিমের গন্ধ বেরোচ্ছে! এর মানে! কে এমন করেছে?
—আমি, আমি, আমি।
কাজল গালে আঙুল দিয়ে বিস্মিত-চণ্ডী মূর্তিতে এসে দাঁড়ায়!
—আর কে-ই বা আছে আমি ছাড়া?
—এতক্ষণ বলোনি?
—বলিনি মানে? অবশ্য বলেছি। প্রথমেই। বললুম না ওই আয়রনই আমাকে খাইয়েছে দাইয়েছে, গতকাল!
—তার মানে? তুমি তো বলছিলে, আমিই নাকি ….
—তুমি আমার কে হও সেটা ভাবো একবার।
—বউ।
—আহা শুদ্ধ করে বলো!
—স্ত্রী।
—অ্যায়। ঠিকই বলেছ। স্ত্রীকে ইস্ত্রিও তো বলা চলে!
কাজল বাক্যহারা হয়ে যায়। তবে এইভাবেই তার দিদিমাসির পাঁচালি শুনতে নিত্য যাতায়াতের পথে কাঁটা পড়ে।
গঙ্গাপ্রসাদের একদিকে মুশকিল আসান হলেও আর একদিক থেকে মুশকিলের ফ্যাঁকড়া বেরোয়। তাঁর নাকি একটি ছাত্রী জুটছে। ছাত্র-ছাত্রী গঙ্গাপ্রসাদের স্বভাবতই আছে। কলেজের ছাড়াও প্রাইভেট কোচিং। দু-চারজন অনার্স ও এম-এর ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে বিশেষ তালিম নিতে যে আসা-যাওয়া করে না তা নয়। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ এটা প্রশ্রয় দেন না। তাঁর অভিধান আছে। নানা পত্রপত্রিকায় বুক-রিভিউ আছে। তিনি এসব নিয়েই বেশ সুখে আছেন। বেশ কয়েক বছর আগে ফাদার জেনকিন্স বলে এক অস্ট্রেলীয় সাধুকে তিনি বাংলা পড়িয়েছেন। এম.এ কোর্স। ফাদার জেনকিনস গ্রিক, লাতিন, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান, জার্মান, এগুলো সবই জানেন, বাংলা দিয়ে এশীয় ভাষা শেখা আরম্ভ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতটাও কোনও টোলের পণ্ডিতের কাছে শিখছিলেন। এঁকে পড়াতে গিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ একেবারে নাকের জলে চোখের জলে হয়েছিলেন। একটা বাংলা প্রবাদ শুনলে তিনি তার সুইডিশ আওড়াবেন, বাংলা শব্দের সঙ্গে জার্মান শব্দের মিল খুঁজবেন। এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠ্য কোনও জায়গা পছন্দ হলেই তৎক্ষণাৎ সেটা অন্য একটা ভাষায় অনুবাদ করতে আরম্ভ করে দেবেন। এর ফলে, যা এক ঘণ্টায় হয়ে যায় তা শেষ করতে সাত ঘণ্টা লাগছিল। তাঁর কোর্স শেষ হবার পর গঙ্গাপ্রসাদের সত্যিই মনে হয়েছিল গঙ্গাতে দুটো ডুব দিয়ে আসলে ভালো হত। বাব্বাঃ!
তা সেই ফাদার জেনকিনস কলেজে ফোন করেছিলেন একটি মার্কিন ছাত্রী গঙ্গাপ্রসাদকে পড়াতে হবে।
—ভয় নেই, ছাত্রীটি বেশ প্রাগ্রসর— ফাদার জেনকিনস বললেন।
গঙ্গাপ্রসাদ ক্ষীণকণ্ঠে বললেন— মানে অ্যাডভানস্ড? আপনার মতো?
—না না না, সে ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ বলতে পারলেও পারতে পারে কিন্তু তেমন কিছু জানছে না। বাংলার বাউল নিয়ে কাজ করছে। কিছু কিছু জায়গার ব্যাখ্যা হয়ত আপনার কাছে চাইবে।
—কেন? আপনার কাছে চাইলেও তো পারতো? আপনি যথেষ্ট কমপিটেন্ট।
—প্রোফেসর মিত্র আমি এখন বেশ কয়েকটি ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তা ছাড়া উর্দু, পার্সিয়ান শেখা শেষ করে এখন চাইনিজ ধরেছি। বড্ড কঠিন।
—কিন্তু আমার অভিধান?
—লক্ষ্মীটি, সোনাটি, মণিটি, আমার প্রিয়তম, মধুটি অধ্যাপক মিত্র, ছাত্রীটিকে সাহায্য করুন।
গঙ্গাপ্রসাদের সঙ্গে কথা বলবার সময়ে ফাদার জেনকিনস পারতপক্ষে ইংরেজি বলেননি। এবং সব ইংরেজি বাংলা করার সময়ে তিনি অত্যুৎসাহবশত এরকম উদ্ভট কিছু কিছু বলেন।
গঙ্গাপ্রসাদ বললেন— কিন্তু বাবা জেনকিনস।
—কী বললেন? অধ্যাপক মিত্র …
—কিছু না। আপনি সব প্রিয় সম্বোধনের বাংলা করেছেন দেখে আমার বড় লজ্জা হল, তাই আমি ফাদার না বলে বাবা বললুম।
—কিন্তু বাবাটা বাঙালিরা নিজ বাবা ব্যতীত আর কাউকে ডাকে?
—হ্যাঁ বাবা জেনকিনস। বাঙালি কেন আপামর ভারতীয় একজনকে বাবা আমতে বলে ডাকে। মহাত্মা গান্ধীকেও সব গান্ধীবাবা, বা গাঁধিবাবা বলত। তাতে আর হয়েছে কী?
ফাদার জেনকিনস কেমন মুষড়ে পড়লেন। বললেন— ঠিক আছে। সব কিচ্ছু উৎকৃষ্ট আছে। ছাত্রীটি শীঘ্রই এসে পৌছবে। নিয়ে যাবো আপনার কাছে। আপনার পদবীর অর্থ বন্ধু। নয় কী?
তাই বলে আমাকে আর অধ্যাপক গঙ্গাপ্রসাদ বন্ধু বলে লজ্জা দেবেন না বাবা জেনকিনস।
—না না, সে বড় উদ্ভট হবে।
ফাদার জেনকিনস ফোন রেখে দিলেন।
উদ্ভটত্বর একটা ধারণা তাঁর ছাত্রকে দিতে পেরেছেন ভেবে গঙ্গাপ্রসাদ কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন, কিন্তু মার্কিন ছাত্রীর কাঁটাটা রয়েই গেল।