Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দিদিমাসির জিন || Bani Basu » Page 4

দিদিমাসির জিন || Bani Basu

হা-হা বালির মধ্যে ওদের নামিয়ে দিয়ে বাসটা ঝড়ঝড় করতে করতে চলে গেল। —এটা কী বল তো?— গোপাল জিজ্ঞেস করল।

রাংতা বলল—কী আবার? অজয় নদীর চড়া।

গোপাল বলল— অজয় টেকনিক্যালি নদী নয়, নদ। সিন্ধু অজয় ভৈরব এ সব হল নদ। তা সে যাক, এটা আসলে তাকলামাকান মরুভূমি এক্সটেন্ডিং ওভার থাউজ্যান্ডস অফ স্কোয়্যার মাইলস।

রাংতা বলল— দেখেছিস তীর্ণা, ছেলেদের কেমন একটা অভ্যেস আছে, মেয়ে দেখলেই জ্ঞান দেয়, জ্ঞান দেখায়।

তীর্ণা বলল— যা বলেছিস!

গোপাল হো-হো করে হেসে উঠল— হায় হায়, আমার রসিকতা, কবিত্ব দুটো প্রচেষ্টাই মাঠে মারা গেল। অনেকেই বলে মেয়েদের সেন্স অফ হিউমার নেই। বিশ্বাস করছি এখন সেটা। মেয়েদের কবিত্ববোধ নেই।

— যা ইচ্ছে বলে যা— তীর্ণা বলল বেপরোয়াভাবে।

গোপাল বলল— তোরা তো দুর্গম স্থানে টানে যাবার সুযোগ পাসনি! তোদের কল্পনাশক্তিটাকে একটু উসকে দেবার চেষ্টা করছিলুম। তা দেখছি বৃথা।

তারপর সে যশজিতের দিকে ফিরে চুপিচুপি বলল— কী রে যাশ, মেয়ে দুটোকে সঙ্গে এনেছি বলে কোনও অসুবিধে হবে না তো?

যশ গভীর চিন্তামগ্ন। সে মাথা নেড়ে অসুবিধে নেই জানাল। তারপর বলল— ডিকয়ডাক জানিস?

তখন পরিষ্কার আকাশ দিয়ে বক উড়ে যাচ্ছে। বালির ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে অনেক রকম, অনেক-পা। কাঁধে পুঁটলি, মাথায় পুঁটলি, লাঠির আগায় পুঁটলি, খালি গায়ে পুঁথির মালা ঝাঁক ঝাঁক মেয়ে-বউ, বুড়ি-সুড়িও আছে। তাদের সঙ্গে ঘরের হাট্টাকাট্টা পুরুষরাও। হাঁড়ি বইছে বাঁকে, মাথায়। মেয়েরাও। মেলার বেসাতি।

অনীক তীর্ণার কোনও প্রশ্নের উত্তরে বলল— তা তুই কি ভেবেছিলি এটা শুধু আধ্যাত্মিক মেলা?

রাংতা জলে নামল। সে-ই সবচেয়ে আগে আগে যাচ্ছিল। অন্যরা পিছিয়ে পড়েছে লক্ষ্য করেনি। গাঁওয়ালিদের জিজ্ঞেস করে করে সে তার সালোয়ার ক্রমশ হাঁটু অবধি তুলে অজয়ের রোগা, অগভীর জলে পা ডুবিয়ে আহ্লাদে হি হি করছিল। এ রকম অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি।

যশজিৎ গোপালকে বলল— দিস ইজ দা থার্ড টাইম। তিনবার হতে যাচ্ছে। জানি না আমাদের জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে।

গোপাল বলল— তুই তো আমাকে আগে একবারও বলিসনি।

—ভেবেছিলাম একাই ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবো।

যশজিতের পাগড়ি-পরা দাড়ি-অলা মুখে বিশুদ্ধ বাংলা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগে। বিশেষ করে গ্রামবাসীদের। কিন্তু যশজিৎ ভবানীপুরের শিখ। তার বাংলার টান-টোনও বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয়। সে যখন বঙ্কিম বাংলা বলে, ইচ্ছে করেই বলে।

এই সময়ে জি.জি. বা গোপালগোবিন্দ তাদের পাশে এসে গেল।

সে গলার সুর তুলে বলল— আপনাদের অসুবিধে করলুম না তো!

গোপাল বলল— যাচ্ছি আউল বাউলের মেলা দেখতে, এর মধ্যে অসুবিধের কথা এলে চলবে কেন?

—না, মেলাই দেখুন আর পর্যটনই করুন, সঙ্গী একটা মস্ত ব্যাপার। সঙ্গী না পছন্দ হলে …

আপাদমস্তক তাকে দেখে নিয়ে গোপাল বলল— এ রকম ঘটনা কি প্রায়ই ঘটে?

—কী রকম ঘটনা।

—না, লোকে আপনাকে অপছন্দ করছে … এরকম ঘটনা।

তীর্ণা অনীককে বলল—তুই ক্রমাগত রাংতার দিকে যেতে চাইছিস কেন? হতে পারে মেয়েটা অ্যাট্রাকটিভ। কিন্তু আমিও তো তোর বোন। দেখতে পাচ্ছিস না গরম বালিতে পা চলছে না, কী রকম হাঁসফাঁস করছি!

—সেটা বোকার মতো শাড়ি পরেছিস বলে। কোনও ভ্রমণে কখনও শাড়ি পরে বেরোতে হয় না—এই সহজ সত্যটাই যে জানে না তার আর বেড়াতে আসা কেন!

—আমি থাকাতে তোর খুব অসুবিধে হচ্ছে, না রে দাদা? সব কিছুর একটা সাক্ষী থেকে যাচ্ছে!

অনীক বলল—ও! অলরেডি আমি অপরাধ করে ফেলেছি? সেটা কী? রাংতার দিকে ধাবিত হওয়া? ফর ইয়োর ইনফর্মেশন রাংতা অলরেডি মাঝনদীতে, এবং আমার সাহায্য ছাড়াই।

—মাঝনদীতেই যে ভরাডুবি হয় রে! —ছদ্ম-করুণ স্বরে তীর্ণা বলল।

—হোক, আমি এখন এই মালটিকে টেনে সামনে এগোবার বৈধ চেষ্টা করে যাই। বলে অনীক তীর্ণার হাতে একটি হিসেবি হ্যাঁচকা দিল। এবং সে হ্যাঁচকায় বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তীর্ণা বলল—আমাকে মাল বললি?

—বললুম, এখন চ’, আর দ্যাখ ওই সাঁওতালিরা তোকে কী বোঝাচ্ছে, কয়েকটি সাঁওতালি বৌ-ঝি কাপড় পরেছে হাঁটুর ওপরে। মাথায় ঝুড়ি পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে স্বছন্দে চলেছে। তারা ইঙ্গিতে তীর্ণাকে নিজেদের শাড়ি পরার ভঙ্গি দেখাল। তীর্ণা করুণ চোখে চারদিকে তাকায়, কোথাও একটা কাঁটাঝোপ পর্যন্ত নেই।

অনীক বলল—খুব হয়েছে দে দে, নিজের ব্যাগটা আমাকে দে। ভার বওয়াতে ওস্তাদ।

অজয়ের জলে পায়ের পাতা ডুবিয়েই তীর্ণা এমন চিৎকার করে উঠল যে সামনে থেকে যশ, গোপাল, জি.জি সবাই ফিরে তাকাল।

পেছন থেকে কে বলল—ওটা আর্তনাদ নয় দাদা হর্ষধ্বনি। গরম বালির পর নদীর জলের ছোঁয়া আর কি! তারপর শহুরে মেয়ে …

গাল কাত করে একবার চেয়ে দেখল তীর্ণা, মুখে বিরক্তি। সেই অশোক সাঁতরা না কী! তার পরেই আবার হেসে ফেলল।

গোপাল পেছন ফিরে বলল—ওই গাঁওয়ালিরা যে পথ ধরে যাচ্ছে, সেই পথ ধরে এসো। ওরা ঠিক জানে। তারপর খুব নিচু গলায় বলল—আগের দুবারে পেয়েছিলি?

—পাবো না কেন? লেকিন ধরতে পারিনি ভাই।

—এবারে পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা আছে?

—না এসে যাবে কোথায়? আর ধরবার জন্যেই তো এবার তোদের …

অশোক সাঁতরা সবার পেছন থেকে সবার সামনে এসে, ডাঙায় উঠল একলাফে, তারপর বলল—মহাশয়রা যাচ্ছেন কোথায়? জয়দেব-পদ্মাবতীর কুটির না দেখেই চলে যাবেন?

ডান দিকে নদীর পাড়ে অর্ধেক বসে-যাওয়া একটা কুটির। রাংতা অবাক হয়ে বলল—এইখানে জয়দেব থাকতেন?

তীর্ণা বলল—এইখানেই সেই দেহি পদপল্লবমুদারম?

গোপাল বলল—গীতগোবিন্দের এই পার্টটা তোদের মেয়েদের বড্ড পছন্দ না রে? পায়ে ধরে সাধা, আহা, রা নাহি দেয় রাধা।

তীর্ণা বলল—তোর কাব্যবোধের একটা পরীক্ষা হয়ে গেল।

—অত সহজ নয়! দেহি পদপল্লবম-এর সঙ্গে তোমাদের আবিশ্ব ফেমিনিস্ট কমপ্লেক্স জুড়ে রয়েছে। বললেই তো হবে না! জয়দেব থেকে ফেভারিট লাইনস যাতে হিউমারও আছে, কবিত্বও আছে—এমন একটা বল দিকিনি!

—হিউমার আর কবিত্ব কক্ষনও একসঙ্গে যায় না।

গোপাল বলল—

বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী

হরতি দর তিমিরমতি ঘোরম্‌।

স্ফুরদধরসীধবে তব বদনচন্দ্রমা

রোচয়তি লোচন চকোরম।

পুরো মানেটা না বুঝিস ‘দন্তরুচিকৌমুদী’টুকু অন্তত শরদিন্দুর কল্যাণে ফ্যামিলিয়ার নিশ্চয়ই!

তীর্ণা হঠাৎ রাগ না করে বলল—সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল, না?

গোপালও তার তর্কের জাল অপ্রত্যাশিতভাবে গুটিয়ে ফেলে বলল—অদ্ভুত তো! আমারও। দাঁতের জ্যোৎস্না। তা আবার দূর করছে মুখগহ্বরের অন্ধকার! এবং তা আমার চকোরের মতো লোচনগুলির বড় ভালো লাগছে। জয়দেব রাধাকে ভেবে তো নয়ই, পদ্মাবতীকে দেখেও নয়, কাজলমাসিকে দেখেই লাইনগুলো লিখেছিলেন। আর তোরা যদি জানতিস ওই দন্তরুচিকৌমুদী দেখবার আশায় আমার লোচনচকোর কী পরিমাণ উদগ্রীব হয়ে তোদের বাড়ি যায়! কিন্তু হায় দেখতে পায় না! কথা বললেই একটু ঝিকিয়ে উঠবে, কিন্তু কথা বলবেন না, বলবেন না, গোপালের সঙ্গে কাজলমাসির আড়ি।

যশজিৎ বলে উঠল—তুই চানস দিস তো?

গোপাল একটু ভেবে নিয়ে গম্ভীর চালে বলে—ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট দেয়ার।

—এই ভাই অশোক না সাঁতরা, আমাদের আর একটু গাইডগিরি করো না ভাই!

—আমি অশোক এবং সাঁতরা দুইই। কেন দাদা, আগে দুটোর কম্বিনেশন কি দেখেননি? আর গাইডগিরি আর কি করবো? কাল মানে সময় এবং বোধহয় বাংলাদেশের আবহাওয়া আমার জন্যে কিছু রাখেনি। নদীর ধারে বাড়ি নিয়ে এক আমাদের পাঁচালির বিভূতিদাই আদিখ্যেতা করতে পারেন, বাস্তবে নদীর ধারে বাড়ি মানে এই। সামান্য যে অজয় আর অসামান্য যে পদ্মা উভয়েই একই প্রকার কীর্তিনাশা। এই ঘরের আদ্যোপান্ত দেখলে আপনাদের লক্ষ্মণ সেনের ওপর আরও রাগ ধরে যাবে। আর জয়দেবের কবি অ্যাসপেক্টের কথা যদি ধরেন, আপনারা যেটুকু জানেন আমি সেটুকুও জানি না। মোহমুদগরের সঙ্গে গীতগোবিন্দর শ্লোক বড্ড গুলিয়ে ফেলি। খালি আমার অল্পতর বয়সের একটা বিস্ময়ের কথা বলতে পারি মেয়েরা মাইন্ড না করলে …

—কেন, মেয়েদের মাইন্ড করার কী আছে?—যশ বলল।

গোপাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল—অনেক কিছু আছে, মানে বাইরে বাইরে মাইন্ড করবার আর ভেতরে ভেতরে ডগোমগো হবার। তবে সাঁতরা কোথায় সাঁতরাবে তা বলতে পারছি না।

রাংতা খুব সপ্রতিভভাবে বলল—মাইন্ড করার কী আছে!

সাঁতরা বলল—আসলে ছোটবেলায় ভাবতুম শ্লোক মানেই নীতিকথা জাতীয় কিছু। শ্লোক মানে যে কবিতা, তা তো জানতাম না। যেমন সুক্তো শুধু তেতোই হয় জানতুম। সূক্ত আবার টক টক ঝাল ঝাল হয় এ আবিষ্কার করে তো আমি আবেগে প্রায় মারা পড়ি।

—হ্যাঁ আপনার আবেগটা বরাবরই একটু বেশি। —অনীক বলল। বিনীতভাবে সায় দিয়ে সাঁতরা হঠাৎ এক ঝটকায় মাথাটা অনীকের দিকে ফিরিয়ে বলল—আপনি কী করে জানলেন? আপনি কি আমার বাল্যবন্ধু, না এক গেলাসের ইয়ার?

অনীক বলল—সেই বাস থেকেই দেখতে দেখতে আসছি কি না! অদেখা রিপোর্টারদের উদ্দেশে আপনি খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।

—আপনার জানা জয়দেবের লাইনটা কিন্তু শোনা হচ্ছে না—গোপাল খুবই উৎকণ্ঠিত।

অশোক সাঁতরা যথাসম্ভব জোর গলায় বলল—রচয়তি শয়নং সচকিত নয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্।

যশজিৎ বলল—ধুস। এ শালাকে বায়রনের মেময়ার্সটা একবার পড়িয়ে দিলে হয়।

দলটি মেলার সঙ্গে সঙ্গে চলল। দুধারে পেঁয়াজি বেগুনির দোকানে দোকানে জটলা। দিন যে এবার মধ্যদিন হয়ে উঠছে প্রায়, সেদিকে গ্রামবাসীদের কারও খেয়াল নেই দেখা গেল।

অশোক সাঁতরা বলল—কাছাকাছি বহু গাঁ থেকে লোকে এই মেলায় কেনাকাটা করতে আসে। ঘর গেরস্থালির জিনিস, চাষের জিনিস। আর বাউল গানটা এরা সকলেই ঠিক গান হিসেবে শোনে না, বুঝলেন দাদা—একটা ধর্ম করছি ধর্ম করছি ভাব … কীর্তনের বেলা যেমন, শ্রীকৃষ্ণ অথবা গৌরাঙ্গের লীলার নাম করে বাঘা বাঘা প্রেমের গানও শুনে সব ধর্মের কান্না কাঁদে এ-ও কতকটা তাই। দাঁড়ান দাঁড়ান এইখানে একটা ফটো তুল নিই। অশোক সাঁতরা পাঁই পাঁই করে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে একেবারে এক্সপার্ট কায়দায় ব্যাগের ভেতর থেকে ক্যামেরা বার করলে। লেনসের ওপর কীসব ফিট-টিট করে নিল তারপর ঘুরে ঘুরে ফটো নিতে লাগল।

ক্যামেরা মুড়ে রেখে বলল—আপনাদেরও নিয়েছি।

—এক দফাতেই তো দশ বারোখানা নিয়ে নিলেন দাদা—ক’ রিল খরচ করবেন। ক্যামেরাটা তো দেখছি জব্বর!

—আরে, তা তো হবেই রিল যা খরচ হবে ওরা দেবে। আমি প্রেস ফটোগ্রাফার কি না! রিপোর্টারও বলতে পারেন।

রাংতা আর তীর্ণা প্রাণপণে হাসি চাপতে লাগল। এতক্ষণে তীর্ণার শাড়ি-টাড়ি শুকিয়ে গেছে। হাঁটতে আর অসুবিধে হচ্ছে না। শনশন করে হাওয়া দিচ্ছে, খালি রোদ চড়া রয়েছে বলে তার ধার ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গোপাল বলল—আগে একটা ঘর খুঁজি বুঝলি, মেয়েগুলো সঙ্গে রয়েছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress