দিদিমাসির জিন (Didimasir Jin) : 10
ফুটফুটে সকাল। বা বলা ভালো ফটফটে সকাল। মেলা প্রাঙ্গণের চেহারা এখন সম্পূর্ণ অন্য রকম। দোকানপাটের ঝাঁপ খুলছে, সওদা নিয়ে পথের ধারে ধারে বসে গেছে লোক। কেনাকাটি শুরু হয়ে গেছে। লোক আসছে আরও। চানের যাত্রীও বহু। চান করে সব পটাপট জামাকাপড় বদলে ফেলছে। মায়ামি বীচ-টীচ দেখা থাকলে কোনও অসুবিধে হয় না। এরা স্টার প্লাস-এ দেখেনি যে এমন নয়, তবু তীর্ণা মন্তব্য করল— উঃ নদীর ধারে দাঁড়ানো যায় না, এই দাদা, লজ্জা করে না? চ’ অন্য দিকে!
অনীক বলল— আই টেক অবজেকশন তীর্ণা, তখন থেকে আমি নদীর দিকে পেছন ফিরে আছি।
গোপাল বললে— সাইকলজিটা বুঝছিস না? সব পাপ ধুয়ে যাচ্ছে, কেঁদুলির মেলাস্থানে যাবতীয় পাপ ত্যাগ করে শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সব এক বছরের মতো। সেই কারণেই একটা দিলখোলা, ডেভিল মে কেয়ার অ্যাটিচুড। মানে কাঁচা বাংলায় কাছা খোলা।
তীর্ণারা ততক্ষণে এগিয়ে গেছে। হোগলার বেড়া দিয়ে মাথায় গোল পাতার ছাউনি দিয়ে দিব্যি বিল্বদাজ রেস্টোরান্ট খুলেছে। তীর্ণা রাংতাকে নিয়ে শনশন করে সেখানে ঢুকে গেল। অগত্যা বাকি তিনজনও। এবং এইখানেই অনীক পেছন থেকে গিয়ে খপ করে ধরল জি.জি-কে।
—এই যে গোপালগোবিন্দ ডবল ভগবান, মামলেট খাচ্ছো? অত দামি শালটা বেচে মোটে মামলেট হল?
জি.জি— তার হাতের চামচ-সুদ্ধ শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল। অন্যরা কেউই কিছু জানে না। অনীক এদিকে জি.জি-র কলার ধরে ফেলেছে। বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে দৃশ্যটা।
গোপাল শান্তভাবে বলল— মুকদ্দর কা সিকন্দর।
অনীক কলারটা চেপে রেখে পাশ ফিরে বলল— এই লোকটি আসলে একটি …
গোপালগোবিন্দ হাউমাউ করে উঠল—গণধোলাইয়ে মারা যাবো দাদা, উচ্চারণ করবেন না কথাটা। আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি, চাদর আপনার ঘরে রেখে এসেছি।
—মানে?
—আমাকে আগে খাওয়াটা, নাঃ খাওয়া মাথায় উঠে গেছে খিদে নেই।
দোকানের অন্যান্য লোকজনও সব খাওয়া-দাওয়া ফেলে এদিকে ফিরে তাকিয়েছে। একজন মস্তান গোছের ছোকরা এগিয়ে এসে মোটা গলায় বলল—কী দাদা, কাউকে ধোলাই দিতে হবে?
যশ বলল— দরকার হলে আমরাই পেরে যাবো। — সে তার বালাটা খানিকটা নাচিয়ে নিল।
গোপাল বলল— ওরা তো তোর হেডড্রেসটা দেখতে পাচ্ছেই, আবার বালা নাচাচ্ছিস কেন?
যশ বলল— হেডড্রেসটার কথা মনে ছিল না ইয়ার।
রাংতা বলল— আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি অর্ডার দিচ্ছি, তোমাদের ইচ্ছে হয় মারামারি করো। এই খোকা শোনো—দুটো মোগলাই পরোটা, চারটে আলুর দম, তীর্ণা আলু খাস তো? দুটো করে অমৃতি, গজা আছে? জিবে গজা,—হ্যাঁ দুটো। আর কি আছে? এক পট চা।
খোকা বলল— পটের চা নেই, আমরা খালি টসের চা করি।
রাংতা বলল— শাববাস! তো তাই আনো।
অনীক পাশ ফিরে বলল— বা বা বা। দুজনের মতো অর্ডার! আমাদের আর খাওয়ার দরকার নেই!
তীর্ণা বলল— কেন? তোর তো মারামারি করেই পেট ভরে গেছে বলে আমাদের ধারণা।
গোপাল বলল— ঘাবড়াচ্ছিস কেন সিকন্দর, আমাদের কি মুখ নেই? আমরা কি অর্ডার দিতে জানি না? এই খোকা, তিন-চারে বারোটা ডালপুরী, তিন চারে বারোটা আলুর দম, তিন চারে বারোটা জিবে গজা। মাংসের চপ আছে?
—না ওগুলো ভিজিবিল চপ।
—হাঁ বাবা ইনভিজিবল যে নয়, তা দেখতেই পাচ্ছি, আচ্ছা ওগুলোও কি তিন চারে।
—না ওগুলো একই রেটে খেলে খুব সম্ভব টেঁসে যাবো। ওগুলো তিনটে।
গোপালগোবিন্দ বলল— আপনি তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, হঠাৎ দেখি একটা চেনা-চেনা গুণ্ডা প্রকৃতির লোক— অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমার দিকে কটকট করে চেয়ে আছে। স্রেফ প্রাণের ভয়ে আপনার শালটা নিয়ে আমি মাথা মুড়ি দিয়ে কেটে পড়েছি। চাদরটা আপনাদের ঘরেই রেখে এসেছি আবার।
অনীক বলল— এ তো দেখছি অসম্ভব সন্দেহজনক? চেনা গুণ্ডা প্রকৃতির লোক? শুনছিস গোপলা, গুণ্ডা প্রকৃতির লোকেরা এর পেছনে ঘুরে বেড়ায়। তারা আবার চেনা এর। স্মাগলার, ডেফিনিট।
জি.জি ককিয়ে উঠল— চেঁচাবেন না, অত চেঁচাবেন না প্লিজ। আমি একটু আধটু পলিটিকস করি কিনা, তাই ওই ধরনের লোকেদের এড়াতে পারি না।
—ডেঞ্জারাস! যশ বলল।
অনীক বলল— চাদর আমাদের ঘরে রেখে এসেছেন মানে! ঘর আইদার ভেতর থেকে অর বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আপনি কি সিঁদ কেটেছেন?
—না। কাঁদো-কাঁদো গলায় গোপালগোবিন্দ বলল— তখন আপনাদের ওই বোন দুটি দরজা খুলে বেরোচ্ছিল— আমি ওদের হাতে দিয়ে এসেছি।
—এ কথা সত্যি?— অনীক তীর্ণার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল।
—হ্যাঁ।
—তা এতক্ষণ সেটা বলিসনি কেন?
—কিসের জন্য ও ভদ্রলোক মার খাচ্ছে, আমি জানবো কী করে?
—যাক গে এখনকার মতো ছেড়ে দেওয়া হল আপনাকে, ওমলেটটা শেষ করতে পারেন।
জি.জি কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল— আর ওমলেট! ও অনেকক্ষণ গুবলেট হয়ে গেছে।
সে বেরিয়ে গেল।
তীর্ণা বলল— তুই একটা লোককে শুধু শুধু কলার ধরলি, যা-তা বললি, একটা ক্ষমাপ্রার্থনা পর্যন্ত করলি না?
রাংতা বলল— রাইট। ভোর চার-সাড়ে চার নাগাদ আমরা সব গুছিয়ে নিয়ে বেরোচ্ছি, ও এসে বললে আপনার দাদা আসরে ঘুমিয়ে পড়েছেন শালটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল, নির্ঘাত চুরি হয়ে যাবে তাই নিয়ে এলুম। সো গুড অফ হিম আর তোম … বলতে বলতে রাংতা চোখ বড় বড় করে থেমে গেল।
—কী ব্যাপার, কী হল?— তীর্ণা জিজ্ঞেস করল।
—কিন্তু ও তো অনীকের শালটা আত্মগোপন করার জন্য ঠিক চুরি না বলেও ধারই নিয়েছিল! আমাদের তো কই সে কথা …
তীর্ণাও চোখ বড় বড় করে বলল— আমাদের ঘরটাও তত ওর চেনবার কথা নয়? যশ এতক্ষণে ইন নিল, সে আঙুলে আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে বলল— তার মানে ইদার ও চুপিচুপি আমাদের ঘরটা জেনে নিয়েছে। লক্ষ্য রেখেছে। কথা হচ্ছে টু হোয়াট এন্ড? উদ্দেশ্যটা কী, অর, চাদরটা ওর দেবার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। রাংতাদের ঘরের সামনে জাস্ট অ্যাকাসিডেন্টালি দেখে ফেলে উর্বর মস্তিষ্ক থেকে ও সবটা বানায়। শালটা হজম করা ওর হয় না।
গোপাল বলল— সন্দেহজনক চরিত্র। অনীক যদি ওকে খামকা অপমান করে থাকে, তাহলে ও ক্ষমাপ্রার্থনাটা দাবি করতেও তো পারতো।
চারদিকে প্রচুর লোকে খাচ্ছে। মেলায় শহর-টহর থেকে ভালো ভালো জামাকাপড় পরা সব অতিথি এসেছে প্রচুর। উচ্চৈঃস্বরে ট্রানজিস্টর বেজে উঠল, একজন আবার গত রাত্তিরে বাউল গান টেপ করেছে, সেই টেপ চালাচ্ছে।
—ফ্যানটাসটিক!
—আসলে অ্যাটমসফিয়ার বুঝলি? বাতাবরণ। বন্যেরা বনে সুন্দর, বাউলরা কেন্দুলিতে।
—রেডিও টিভির বাউল গানের সঙ্গে কী তফাত।
—তা ছাড়া একটা আধ্যাত্মিক …
—মারো গোলি, আধ্যাত্মিক না আরও কিছু। দিব্যি লিভিং টুগেদার হচ্ছে ভাই, আজ এ বাউলনী, কাল ও বাউলনী, একটা বুড়ো আবার মেম জুটিয়েছে দেখেছিস?
যশ-গোপাল-অনীকের কান খাড়া।
ওদিকে কথা চলছে— মেম! কী রকম?
—হ্যাঁ রে শালা, মেম বাউলি— ওই বটতলায় মনোহরদাস বাউলের গান শুনছিলুম না! ওর বাউলনী, মেম। মাথায় সাদা চুল দেখে লোকে অন্ধকারে বুড়ি ভাবে। আসলে কিন্তু বুড়ি নয়। বাউলরা অত বোকা নয়। এ হল মেমদের সাদা চুল। ওদের মধ্যে অনেক রঙের চুল হয় না!
—তুই কী করে বুঝলি, মেম?
—আমার চোখকে ফাঁকি দেবে এমন মেম আজও জন্মায়নি, বুঝলি?
—তুই কি মেম-স্পেশালিস্ট?
—সে তুই যা বলেই মজা করিস, কপালে রসকলি কেটে, ঘোমটা দিয়ে আমায় ফাঁকি দিতে পারবে না।
—তা এর মধ্যে এতো লুকো ছাপারই বা কী আছে? সেই হিপিদের সময় থেকেই তো ওরা এ চত্বরে ঢুকছে, কে কৃষ্ণভক্ত, কে রজনীশ-ভক্ত, বাউল হতেই বা বাধা কিসের?
—এ একরকম ভালো, বুঝলি? এইভাবে হিন্দুধর্ম প্রচার হয়ে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে আলোচনাটা অন্যদিকে ঘুরে গেল।
যশ খুব গম্ভীর মুখ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল— তোরা খাওয়া শেষ কর। আমি চললুম। কাজ আছে।
গোপাল বলল— হয়ে গেছে, আমারও হয়ে গেছে।
অনীক ফিসফিস করে বলল— কাল আমি বটতলায় এই মেম বাউলনীকে দেখেছি বোধহয়।
—সে কী? এতক্ষণ তো বলিসনি?
—বুঝতে পারিনি। একটু কেমন-কেমন লেগেছিল, কিন্তু বুঝতে পারিনি।
গোপাল বলল— মনোহরদাস যদি আমার চেনা মনোহারদাসই হন তাহলে কিন্তু টেকনিক্যালি বাউল নয়, বৈষ্ণব।
যশ বলল— মারো গোলি। উই আর ইন্টরেস্টেড ইন মনোহরদাস অ্যাজ লঙ অ্যাজ হি হ্যাজ এ মেম লিভিং উইথ হিম।
তিনজনে গটমট করে বেরিয়ে গেল।
রাংতা বলল— কী ব্যাপার বল তো! এরা তো মনে হচ্ছে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরছে, আমরা যার কিছুই জানি না।
তীর্ণা রেগে আগুন হয়ে বলল— ওদের সঙ্গে আমি অন্তত আর কোনও সম্পর্কই রাখছি না। আমি ফিরে যাচ্ছি। তুই যাবি?
রাংতা বলল— সেটাই ঠিক হবে। দিস ইজ টু মাচ।
শীতের দিনের দুপুরের রোদ গায়ে খুব মিঠে লাগে। যথেষ্ট ক্রুদ্ধ থাকলেও ওরা মেলায় ঘুরে ঘুরে লোকেদের জিনিস কেনা দেখতে লাগল।
—এগুলো কী রে? তীর্ণা জিজ্ঞেস করল।
পেছন থেকে কেউ জবাব দিল— লাঙলের পার্টস। কিনবেন?— অশোক সাঁতরা
—আমরা কিনব? লাঙলের পার্টস— রাংতা অত্যন্ত বিরক্ত।
অশোক সাঁতরা বলল— আহা। কিনবেন কেন কেনবার ভান করবেন।
—ভানই বা করতে যাবো কেন— তীর্ণা প্রায় তেড়ে উঠল।
—রাগছেন কেন? সব কিছুরই একটা কারণ আছে। আমি রিপোর্টার, এতক্ষণে জেনে গেছেন নিশ্চয়, আপনাদের লাঙল- কিনতে-রত অবস্থায় একটা ছবি নিতাম। স্টোরি হত। টু বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল ফার্মিং এন্টারপ্রেনার্স।
—তার চাইতে আমরা আপনার একটা ছবি তুলি না কেন? আ ড্র্যাব বাট ডিউটিফুল ফেক রিপোর্টার।
—ফেক? আপনারা বিশ্বাস করছেন না?
—কেউই বিশ্বাস করবে না। রিপোর্টারদের এ রকম অ্যামেচারিশ হাবভাব হয় না। অভিনয় শেখার ছোটখাটো স্কুল এখন কলকাতায় অনেক হয়েছে। শিখে নেবেন।
—প্রেস কার্ড দেখবেন?
—দেখি
—অশোক সাঁতরা তার জিনসের পকেট, শার্টের পকেট, কার্ডিগ্যানের পকেট হাতড়ালো— এইয্ যাঃ। বোধহয় ঘরে ফেলে এসেছি। সব্বোনাশ। আচ্ছা, আপনাদের ওই দাদারা কোথায় গেলেন?
তীর্ণা বলতে যাচ্ছিল, ‘মেম খুঁজতে।’ কিন্তু ‘মে’টুকু বলার পরই রাংতা তাকে এমন চিমটি কেটে ধরল যে, সে কথাটা পাল্টে নিয়ে বলল— মে-মেসোপটেমিয়ায়।
—ঠাট্টা করছেন? অশোক বিগলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
—বুঝতে পেরেছেন তাহলে? বলে ওরা মেলাচত্বরের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অশোক সাঁতরার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
—তা যদি বলিস, সব ছেলেই ফেক। —রাংতা মন্তব্য করল।
তীর্ণা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বলল— অনীককে তো আমি এই প্রথম দেখছি। কিন্তু গোপাল আর যশকে তো চিনি। মানে ভাবতুম চিনি। এখন দেখছি, মোটেই চিনি না। এই মেম-সন্ধানী যশ আর গোপালকে আমি চিনি না জানি না, বলতে বলতে রাংতা রুমাল বার করল। সেটাকে মুখের ওপর থাবড়ে থুবড়ে আবার পকেটে পুরে ফেলল।
তীর্ণা সন্দিগ্ধ সুরে বলল— তুই কি রুমালের মধ্যে খানিকটা কেঁদে নিলি নাকি।
—কেঁদে নেবো? হোয়াট ননসেন্স!
হাঁটতে হাঁটতে ওরা ততক্ষণে নিজেদের সেই অদ্ভুত ঘরের সামনে এসে পড়েছে। তালা খুলে ঘরটায় ঢুকে ওরা নিজেদের জিনিসপত্র নিতে লাগল।
তীর্ণা হঠাৎ গোছানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করল— রাংতা একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবি না?
—মনে করার মতো হলে …
—এই দলে তুই কী হিসেবে ..
—তোর কী মনে হয়?
কিছু মনে করিস না, আমার মনে হয়েছিল, আমার দাদা তোর অনেক দিনের চেনা। ও-ই তোকে ঢুকিয়েছে।
রাংতা হাসল— সবাই তাই ভাবে।
—মানে?
—আমার লোকেদের সঙ্গে খুব সহজে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। হয়তো জীবনেও কখনও দেখিনি, দেখব না, লোকে বলবে বাবা কতদিনের বন্ধুত্ব।
—সত্যিই তুই দাদার ইয়ে নোস?
আজ্ঞে না। তবে তুমি যে গোপালের ইয়ে সেটা…
—খবর্দার রাংতা, ঝগড়া হয়ে যাবে। গোপাল ইজ জাস্ট এ ফ্রেন্ড। এই একবিংশ শতকের দোরগোড়াতেও একটা দাড়ি-ঝুলপিঅলা ছেলের সঙ্গে ইয়ার্কি মারলে যদি সবাই মিলে বলতে শুরু করে
যেয়োনাক অই যুবকের সাথে …
মা থেকে, বন্ধুরা থেকে— সব্বাই, তখন কিন্তু জেদ চেপে যায় সাঙ্ঘাতিক।
—আচ্ছা আচ্ছা, ও কথা আর বলব না। তোকে তোর দাদা অনীক মিত্তির ঢুকিয়েছে। অল রাইট?
—আর তোকে?
—আমি মানে ইয়ে…
—কোথায় যেন থাকিস! গোপাল বলছিল, ভোলা ময়রা লেনে।
রাংতা চোখ বড় বড় করে বলল— বলেছে বুঝি? তাহলে ওই ভোলা ময়রাতেই থাকি।
—তার মানে? তুইও কি একটা সন্দেহজনক চরিত্র?
—দ্যাখ গোপাল যখন বলেছে— আমি ভোলা ময়রা লেনে থাকি তখন গোপালের মন রাখবার জন্যেও অন্তত আমার ওই লেনটায় স্টিক করে থাকা দরকার। কোথায় রে লেনটা? চিনিস?
—নিজের গলি আমাকে চেনাতে বলছিস? উঃ, সত্যি আমি এবার পাগল হয়ে যাবো।
তীর্ণা চুপ করে গেল। গম্ভীরও। কেউ যদি নিজের বাসস্থানের কথা বলতে না চায় তাহলে তাকে জোর করে বলবে, এমন মেয়েই তীর্ণা নয়। কৌতূহল আছে বটে তার মায়ের।
গোপাল যেদিন প্রথম তাদের বাড়িতে এলো!
—গোপাল হালদার? এই নাম তো একজন বিখ্যাত লোকের।
—আমার মতো অবিখ্যাত লোকেরও ওই একই নাম, বিশ্বাস করুন?
—বিশ্বাস করার কথা বলছো কেন? তাহলে নিশ্চয় অবিশ্বাসের কিছু আছে? তারপর— অনীকের বন্ধু তুমি তো তীর্ণার নাম ধরে ডাকলে কেন?
—এ সময়ে অনীক থাকবে না আমি জানি।
—তীর্ণা থাকবে, কী করে জানলে? টেলিফোনে অ্যাপো করে নিয়েছিলে?
—মাসিমা চান্স নিয়েছিলুম।
—কী চান্স? যে মাসিমা বাড়ি থাকবে না!
এরপর কার কী বলবার থাকতে পারে?
—তারপর —তীর্ণার সঙ্গে কোথায় আলাপ হল?
—ট্র্যামে।
—ইস্স, দারুণ ফিলমি ব্যাপার, কিন্তু চিনলে কী করে অনীকের বোন বলে?
—অনীক সঙ্গে ছিল।
—এতো জমল কী করে?
—তীর্ণা খুব জমাট মেয়ে মাসিমা!
—কই আমি তো বুঝি না! আমার সঙ্গে তো কই জমে না!
এর পরেই বা কার কী বলার থাকবে?
এত সত্ত্বেও মার নালিশ গোপাল নাকি এত কথা বলে যে, মাকে কথা বলতেই দেয় না।
ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। হঠাৎ তীর্ণা লক্ষ্য করল রাংতা গুম হয়ে বসে আছে।
—কী হল তোর?
—আমার সঙ্গে যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তা কখনও বুঝিনি!
—কে?
রাংতা কোনও জবাব দিল না।
—কি রে, আমরা যে চলে যাবো ঠিক হল?
এবারেও রাংতা কোনও জবাব দিল না।
সে কিছু ভাবছে।
তীর্ণার এইবারে রাগ হয়ে গেল। এমনিতে সে যথেষ্ট মাথা-ঠাণ্ডা মেয়ে। কিন্তু ঘটনা যা ঘটছে, তাতে করে মাথার ঠিক রাখা শক্ত। সে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়াল,— আমি যাচ্ছি রাংতা।
রাংতা নিজের ভাবনায় মগ্ন। — বলল— ও যাচ্ছিস?
তীর্ণা দরজাটাকে নিজের পেছনে দুম করে বন্ধ করল। মানে করার চেষ্টা করল। এমন বিদঘুটে দরজা যে কোনও আওয়াজই হল না।
আগেই সে ঠিক করেছিল, দুর্গাপুরের দিকে আর ফিরবে না। বোলপুরের দিক দিয়ে চলে যাবে। মনটা একটু খুঁতখুঁত করছে। আরেক দিন বাউল গান শোনা হল না। ওরা নাকি অনেকে মিলে আসর বসায়। গানের মধ্যে দিয়ে কী সব গূঢ় তত্ত্বের আলোচনা করে। গূঢ় তত্ত্বের ওপর তার বাবার লোভ থাকতে পারে, তার নেই। কিন্তু আলোচনাটা যদি গানের ভেতর দিয়ে হয়। এবং সে গান এমন সুশ্রাব্য, তাহলে তাতে তার যথেষ্ট লোভ আছে। দাদার জন্যে, স্রেফ দাদার জন্যে সে আশ মিটিয়ে বাউল গান শুনতে পেল না। প্রথমটা তো আসার পথে রাংতার সঙ্গে সেঁটে রইল। এখন দেখা যাচ্ছে রাংতা তাকে পাত্তা দেয় না।
সে গটগট করে হাঁটে। রাস্তায় কারো সঙ্গে দেখা হয় না। শুধু মেলার কেনাবেচার হট্টগোল, সেই রেস্টোরান্টের খোকাটা ‘এদিক আসুন দুপুরে বিড়িয়ানি হচ্ছে, দুপুরে বিড়িয়ানি’ বলে আপ্রাণ চেঁচাচ্ছে, কয়েকজন বলতে বলতে গেল—আজ মনোহরদাসের ওখানে মোচ্ছব। তিন রকমের ডাল, সাত রকমের তরকারি। শীর্ষা সম্প্রদায়ও— অতিথি সেবা করছে। … ওদের ওখানে বড্ড কুঠেরা যায়, ওদিকে যাচ্ছি না। যদিও শুনছি তিন রকমের চাটনি করেছে। যা খাবি সব হজম হয়ে যাবে … আজ রাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মঞ্চে … বুঝলি? পতিতদাস বলে এক ছোকরা দারুণ গাইছে। বুড়োদের ওই খ্যানখেনে গলার গান আমায় তেমন অ্যাপিল করে না …
তীর্ণা পা চালাল। একটা বিরাট এপার-ওপার শালুতে একটা চানাচুরের বিজ্ঞাপন। সেটা পেরোলেই বোলপুরের রাস্তা।
এইবারে তীর্ণার একটা সুবিধে হয়ে গেল।
—কোথা থেকে কে ডাকছে— টিনা টিনা, হাললো টিনা।
কিছুক্ষণ শুনতে শুনতে তার মনে হল, এখানে কোনও টিনা নেই। তাকেই ডাকছে কেউ। ভালো করে এদিক ওদিক চাইতে একটা কালো মারুতি ভ্যান থেকে সকালে দেখা সেই মেয়েটি বেরিয়ে এলো। এখন তার পরনে জিনস আর একটা ফতুয়া মতো টপ, শীতে কোনও বিকার নেই।
—হাললোলা টিনা, কোথায় যাচ্ছে?
—শান্তিনিকেতন যাবো।
—কী মধুর! আমিও তো যাবো! তা তোমার সঙ্গিনী সেই কী যেন নাম … রুংটা? ও? কোথায়?
—ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে। উই হ্যাভ কোয়ারলর্ড।
মেয়েটি খুব বুঝদারের মতো বলল— লুদের মধ্যে ওর্কোম হোয়।
—লু? লু আবার কী?
—লু? লেসবিয়ানদের আমরা লু বলি।
তীর্ণার মুখ গনগনে লাল। সে তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরিয়ে চলতে লাগল।
—হাই টিনা। কুথায় চললে। হোয়াঁটস রং? লু তো কী হয়েছে? তীর্ণা লাল মুখ ফিরিয়ে বলল।
—ও সব লু ফু আমরা নই। শী ইজ জাস্ট এ ফ্রেণ্ড। আমি চললুম।
—দুঃখিত দুঃখিত। টিনা, আমি জানি না তুমি এর্কম রাগ কর্বে। শুনো শুনো। আমিও শাণ্টিনিকেটন যাচ্ছি। সঙ্গে কার আছে। লক্ষ্মীটি, সোনাটি আমার সঙ্গে চলো।
এমন অনুনয় করতে লাগল মেয়েটি যে, টিনা বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারল না। বিশেষত কালো গাড়ির দরজা ঠেলে আবার এক ফর্সা ফাদার নেমে এলেন।
—সাক্ষাৎ করো টিনা, ইনি ফাদার জেনকিনস। আমি এঁর কাছে বাংলা শিখেছি। ইনি আমার গুরু, তোমাদের যেমন টাকুর তেমনি।
তীর্ণার খুব হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। ফাদার জেনকিনস দেখা গেল তাঁকে গুরু বলায় এবং টাকুরের সঙ্গে তুলিত হওয়ায় ভীষণ খুশি। প্রায় ফুলে উঠেছেন।
তীর্ণা বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।
ফাদার জেনকিনস বললেন— এডিথ, তুমার তোথ্য কোতো সংগ্রহ হল?
তীর্ণা চমকে বলল— এডিথ? তোমার নাম এডিথ?
—ইয়া। এডিথ সিং কাপুর
—তুমি আমেরিকান বললে না?
—ইয়া। তবে আমি ভার্তের সিটিজেনশিপের জন্য দরখাস্ত্ করছি।
—তুমি কি মনোহরদাসের আখড়ায় বাউলনী সেজে ছিলে?
—ইয়া। মনোহরদাসই তো আমায় কোতো তোথ তোথ্ তোত্থ দিলে।
—তুমি কি কাল রাতে মনোহরদাসের সঙ্গে গান গাইছিলে?
—গান গাইনি। অতিশয় কোঠিন। আমি বাজা বাজাচ্ছিলুম।
—তোমার চুল শাদা ছিল?
এবার এডিথ ফিক করে হেসে দিল।
বলল— মাথায় সাদা উইগ ছিল, কপালে চিমটার মতো কলি ছিল। —ছাই-ভসস ছিল। গলায় তুলসি কাঠের কণ্ঠী ছিল। ওকার কালার্ড শাড়ি ছিল। তুমি আমাকে দেখলে চিনটেই পারছে না।
—এরকম ড্রেস করেছিলে কেন?
—শিকবার জন্যে। বাউল-ওম্যান কী পরে, কী খায়, কেমন ঘোরে। অ্যাণ্ড দেয়ার ওয়াজ অ্যানাদার রীজন।
—সেটা কী?
—কিচু খারাপ লোক আমার পিছু ঘুরছে।
তীর্ণার মুখ কালো হয়ে গেল। চোখের সামনে তিনটি মূর্তি ভেসে উঠল।
ফাদার জেনকিন্স্ বললেন— এডিথ এখন তুমি নিরাপদ তো?
—আই থিংক সো।
তীর্ণা ফিসফিস করে বলল— এই খারাপ লোকেদের তুমি চেনো? নাম জানো?
—চিনছি সবাইকে না। নাম জানি খালি একজনের। যশজিৎ সিং।
তীর্ণা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। যাক্ অন্তত…।