Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট || Anish Deb » Page 9

তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট || Anish Deb

শুয়ে থাকা জিশানের মনে একটা আক্ষেপ তৈরি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ও খুব ক্লান্ত—আর পারবে না। মিনি-শানুর কাছে ফিরতে পারবে না। মনোহরকে দেওয়া কথা রাখতে পারবে না।

ঠিক তখনই জাব্বা দেওয়ালের এক কোণ থেকে ব্ল্যাক মাম্বা সাপটা মুঠো করে তুলে নিয়েছে। ছুড়ে দিয়েছে জিশানের বুকের ওপরে।

কয়েক লহমা সাপটা ল্যাকপ্যাকে কালো পাইপের মতো জিশানের বুকের ওপরে পড়ে রইল। ওর কালো রঙের জিম ভেস্টের সঙ্গে সাপটা মিশে গেল। পরমুহূর্তেই ওটা ক্ষিপ্রগতিতে ছোবল মারল জিশানের গলায়।

জিশান যন্ত্রণায় ঝাঁকুনি খেল। সাপটার বিষ যে বের করে নেওয়া হয়েছে সে-কথা ভুলে গেল। চেতন আর অচেতন জগতের সীমারেখায় একটা ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে জিশান মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মনে হতে লাগল, ও আর পারবে না। প্রতি মুহূর্তে ও শেষ মুহূর্তের দিকে এগোচ্ছে।

এমন সময় এক তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল জিশান।

‘জিশান! জিশা—ন!’

না, জায়ান্ট টিভি থেকে নয়—এই ডাক শোনা যাচ্ছে দর্শকদের গ্যালারি থেকে। একটা তীব্র মেয়েলি চিৎকার। সব হারানোর মুহূর্তে কেউ যেন জিশানের কাছে সাহায্য চেয়ে পাগলের মতো মরিয়া চিৎকার করছে।

ঝাপসা চোখে জিশান মেয়েটিকে খুঁজে চলল। কোথায়? কোথায়?

একটা লাল ঝলক দেখতে পেল। গ্যালারি থেকে ছুটে নেমে আসছে লাল জামা পরা একটা মেয়ে। ওর বয়কাট চুল পিছনদিকে উড়ছে। ও সিঁড়ির ধাপে পা ফেলে ছুটে নামার তালে-তালে সেই চুল লাফাচ্ছে।

রূপকথা!

কথা রেখেছে ও। সত্যি ও লাল ড্রেস পরে এসেছে। কোমর পর্যন্ত ফুলহাতা শার্ট একটা। তার সঙ্গে প্যান্ট। সেটার রং কালো বা নীল একটা কিছু।

মেয়েটা পলকে চলে এল গর্তের কিনারায়। জিশানের দিকে তাকিয়ে গর্তের কিনারা বরাবর দৌড়ে পাক খেতে লাগল। আর জিশানের নাম ধরে উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করতে লাগল।

কোনও সিকিওরিটি গার্ড রিমিয়াকে বাধা দেয়নি। বরং এই গেম শো-র জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য টিভি ক্যামেরা রিমিয়াকে ধরে ফেলল। জায়ান্ট টিভির পরদায় ওর ছবি ধরা পড়ল। ওর চিৎকার শোনা গেল লাউডস্পিকারে।

‘জিশান! জিশান! ওঠো! উঠে পড়ো! তোমাকে জিততে হবে, জিশান—উঠে পড়ো! তুমি বলেছিলে আমি এই খেলা দেখতে এলে তোমার খুব জিততে ইচ্ছে করবে। মনে নেই সে-কথা? আমি তো খেলা দেখতে এসেছি। এবার তুমি তোমার কথা রাখো। ট্রাই হার্ড টু উইন! কাম অন, জিশান! বি আ ম্যান—।’

রিমিয়া চিৎকার করে কথাগুলো বলছিল আর গর্তের পাড়ে পাগলের মতো পাক খাচ্ছিল। ওর লাল জামাটার ওপরে জিশান নজর রাখতে চেষ্টা করছিল। ওর মনে হচ্ছিল, ওটা ম্যাটাডরের লাল রেশমি রুমাল। আর বুল ফাইটের রিং-এর ভেতরে জিশান রক্তাক্ত আহত জেদি ষাঁড়।

রিমিয়াকে দেখতে-দেখতে—অথবা, ওর লাল জামাটা দেখতে-দেখতে—জিশানের ভেতরে একটা গোঁ মাথাচাড়া দিল। ওর না শপথ ছিল মরার আগে ও মরবে না! মালিক আর মনোহরকে ও কথা দিয়েছে না!

আচমকা ব্ল্যাক মাম্বার ছোবল এসে পড়ল জিশানের গালে। গালটা যেন জ্বলে গেল। রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়ল ফরসা গাল বেয়ে।

কোন এক অলৌকিক শক্তিতে জিশান উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে গর্তের কিনারায় বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকা রিমিয়া থমকে দাঁড়াল। বাচ্চা মেয়ের মতো আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগল। ‘জিশান! জিশান!’ বলে খুশিতে চিৎকার করতে লাগল।

জিশানের গা থেকে সাপটা খসে পড়েছিল মাটিতে। ওটার দিকে তাকাল জিশান। হিংস্রতার ঢেউ হঠাৎই উথলে উঠল ওর শরীরে। চোখের পলকে সাপটাকে পা দিয়ে চেপে ধরল। তারপর ঝুঁকে পড়ে দু-হাতের আঙুল বাঁকিয়ে কয়েক খাবলা মাটি তুলে সাপটার মাথা লক্ষ্য করে সজোরে চাপড় মেরে বসিয়ে দিল। একবার—দুবার—বারবার।

আঠালো মাটির নীচে সাপটা জ্যান্ত কবরে চলে গেল। সেই কবরের ওপরে জিশান পা দিয়ে দুরমুশ করতে লাগল। সাপটাকে দম আটকে মরতেই হবে—মরতেই হবে।

এবার জাব্বা।

জাব্বার দিকে তাকাল জিশান। ও তখনও দর্শকদের দিকে তাকিয়ে উল্লাসের অঙ্গভঙ্গি করছে। রিমিয়ার কাছাকাছি গিয়ে জাব্বা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। মুখ উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় নিজের গলায় ছুরি চালানোর ভঙ্গি করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোর জিশান…খতম!’

এতক্ষণ জাব্বা জিশানকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি। এমন ভাব দেখাচ্ছিল যেন পিট ফাইট শেষ হয়ে গেছে। জিশানের শক্তির শেষ বিন্দুটাও ও ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছে। তাই ও অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিল। আর সেটাই ওর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল।

জাব্বাকে লক্ষ্য করে আচমকা দৌড় শুরু করল জিশান।

চোখের কোণ দিয়ে আক্রমণটা খেয়াল করে জাব্বা যখন জিশানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল ততক্ষণে কয়েক মুহূর্ত দেরি হয়ে গেছে।

দুটো বলবান শরীরের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হল। শরীরে শরীর জট পাকিয়ে গর্তের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ওরা ঠিকরে পড়ল মাটিতে। তারপর দু-দিকে ছিটকে গেল।

জিশান বুঝতে পারছিল, যা কিছু করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। কারণ, ওর ক্ষমতা চুঁইয়ে-চুঁইয়ে প্রায় শেষের দিকে। সুতরাং, এখনই—এখনই।

জাব্বা নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল, জিশান সেই মুহূর্তে তিনপাক গড়িয়ে পৌঁছে গেল ওর কাছে। চিত হওয়া অবস্থায় শরীরের নীচের অংশটাকে একঝটকায় শূন্যে তুলে লাথি বসিয়ে দিল জাব্বার মুখে। আর প্রায় একইসঙ্গে ওর পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল।

জাব্বা আবার পড়ে গেল, কিন্তু তারই মধ্যে জিশানের বাঁ-চোখে একটা মারাত্মক ঘুসি বসিয়ে দিল।

জিশান উঠে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর চোখের সামনে পলকে সবকিছু মুছে গিয়ে অসংখ্য তারা ঝিলমিল করে উঠল আবার।

কিন্তু জিশান থামল না। ওই ‘অন্ধ’ অবস্থাতেই প্রতিরক্ষার পদক্ষেপ নিল। ক্ষিপ্রগতিতে জোরালো ঘুসি ছুড়ে দিল সামনে। এবং জাব্বার মুখ ঘুসির নাগালে পেয়ে গেল।

নজর পরিষ্কার করতে জিশান বারদুয়েক ঝটকা মেরে মাথা ঝাঁকাল। তারপর চোখ খুলতেই বুঝতে পারল, ও এখন একটা চোখে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ওর অন্য চোখটা গেল কোথায়? এখন কোনদিকে তাকিয়ে আছে সেটা? চোখটা কোটরে আছে তো, নাকি বাইরে বেরিয়ে এসেছে?

প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় নেই। এখন শুধু প্রতিরক্ষা। মারের বদলা মার।

জিশান ঝাপসা নজরে তাকাল জাব্বার দিকে। এবং তাকিয়েই অবাক হল।

জাব্বা কোথায়? ওর সামনে শ্রীধর পাট্টার মুখ। সে-মুখে কাদা-মাটি লেগে রয়েছে। রয়েছে রক্তের ছাপ।

জিশান হুমড়ি খেয়ে পড়ল শ্রীধরের শরীরের ওপরে। পাগলের মতো ঘুসি মেরে চলল। ঘুসির পর ঘুসি। শ্রীধরের মুখটা আরও লাল হয়ে যেতে লাগল। হামানদিস্তের ভেতরে রসুনের কোয়া ছেঁচার মতো জিশানের লোহার হাত শ্রীধরের মুখ ছেঁচতে লাগল।

চোখের সামনে জাব্বার মুখটা ফিরে এল আবার। ও চিৎকার করছিল। ওর শরীরটা মাথা ছেঁচে দেওয়া মাগুরমাছের মতো ছটফট করতে লাগল। ওর হাতের আঙুল কখনও জিশানের বাহু, কখনও বাতাস আঁকড়ে ধরছিল।

জিশানের ডানহাতের আঙুলের গাঁট ছড়ে গিয়ে মাংস বেরিয়ে পড়েছে. হাতের মুঠো রক্তে মাখামাখি। বেশিরভাগটাই ওর রক্ত—বাকিটা জাব্বার। কিন্তু ওর শরীর এতটাই অসাড় হয়ে গেছে যে, কোনও যন্ত্রণা ও আর টের পাচ্ছিল না।

জাব্বা হঠাৎই জিশানের গলার নাগাল পেয়ে গেল। ওর সাঁড়াশির মতো আঙুল চেপে বসল গলার নরম মাংসে। জিশানের মাথার ভেতরে একটা শিরা দপদপ করতে লাগল। ওদের যুযুধান শরীর দুটো আহত কেন্নোর মতো পাকাতে লাগল, পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে এপাশ-ওপাশ মোচড় দিয়ে লড়াই করে চলল।

জিশান বুঝতে পারছিল ওর ব্যাটারি ফুরিয়ে আসছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওকে লড়াই শেষ করতে হবে—অথবা, নিজে শেষ হয়ে যাবে। একটু আগে কবর দেওয়া সাপটার কথা মনে পড়ল ওর। জাব্বা সাপের চেয়ে কম কী!

মুহূর্তের মধ্যে স্যাঁতসেঁতে জমি থেকে একখাবলা মাটি তুলে নিল জিশান। এক প্রচণ্ড হুঙ্কার তুলে সেই মাটিসমেত হাত দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়ার ঢঙে আছড়ে দিল জাব্বার রক্তাক্ত মুখের ওপরে।

দম আটকে আসায় জাব্বার শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে গেল। জিশানের গলায় ওর হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেল। মুখে ঢুকে যাওয়া মাটি থু-থু করে ছুড়ে দিল শূন্যে। তারপর সবে ও যখন বড় করে একটা শ্বাস টানতে শুরু করেছে অমনি জিশানের মাটিসমেত হাতের থাবা ওর মুখে আছড়ে পড়ল দ্বিতীয়বার। তৃতীয়বার। এবং আরও অনেকবার।

জিশান যেন পাগল হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ‘সাপ’টাকে কবর দিতে চাইছে প্রাণপণে।

জাব্বার গলা দিয়ে চাপা ঘড়ঘড় শব্দ বেরিয়ে এল। একটানে ওর কাহিল শরীরটাকে উপুড় করে দিল জিশান। ভাঁজ করা হাঁটু নিয়ে শরীরের সমস্ত ওজন আছড়ে দিল ওর শিরদাঁড়ার ওপরে। তারপর ঘোড়ায় চড়ার মতো ওর পিঠে চেপে বসল। মাথাটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল পিছনদিকে।

জাব্বার ঘাড় ক্রমশ ভাঁজ হয়ে যেতে লাগল। মনে হচ্ছিল, জিশান ওকে জোর করে আকাশ দেখাতে চাইছে, আকাশের তারা দেখাতে চাইছে।

একটা ‘মট’ শব্দ হল। হয়তো জাব্বার ঘাড়ের হাড়ের ঠোকাঠুকির শব্দ। একটু আগেই মুখের মাটি থু-থু করে ফেলে দিয়ে জাব্বা হাঁ করে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল। সেটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ওর মুখ থেকে কোনও চাপা ঘড়ঘড় শব্দও বেরোচ্ছে না। ও হয়তো অক্ষম শরীরে শেষ মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছে।

জিশানও বুঝতে পারছিল আর মাত্র দু-এক ডিগ্রি। ঘাড়টাকে আর দু-এক ডিগ্রি পিছনদিকে বাঁকাতে পারলেই লড়াই খতম—জাব্বাও খতম।

কিন্তু হঠাৎই ওর সামনে ঝড়-বৃষ্টির সেই রাতটা ভেসে উঠল। পাহাড়ের মতো সেই ভয়াবহ মানুষটা সেদিন অনেক কিছুই করতে পারত—কিন্তু করেনি। করেনি বলেই আজ জিশান এখানে মিনি আর শানুর জন্য মরণপণ লড়াই করছে। পাহাড়ের মতো সেই মানুষটার শুধু শরীরটাই পাহাড় ছিল না, একপলকে ওর মনটাও হয়ে গিয়েছিল অনেক বড়—পাহাড়ের মতো। এখন জিশান কি সেরকম কিছু একটা…।

জাব্বার মাথাটা আচমকা ছেড়ে দিল জিশান।

গ্যালারি থেকে উন্মত্ত দর্শকের দল এতক্ষণ ‘খতম! খতম!’ বলে রণডঙ্কা বাজাচ্ছিল। জিশান জাব্বার মাথাটা ছেড়ে দিতেই সব চেঁচামেচি একলহমার জন্য থেমে গেল। গ্যালারি থেকে একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাসের ‘ফোঁস’ শব্দ শোনা গেল যেন। তারপরই জিশানের নামে গ্যালারির প্রতিটি বিন্দু কেঁপে উঠল।

জাব্বার শরীর ছেড়ে টলতে-টলতে উঠে দাঁড়াল জিশান। ও হাপরের শব্দ করে হাঁপাচ্ছিল। জাব্বা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীর স্থির হলেও শ্বাসপ্রশ্বাসের সামান্য ওঠা-নামা চোখে পড়ছে। সেদিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকার পর প্রতিদ্বন্দ্বীর গায়ে থুতু ছুড়ে দিল জিশান। টকটকে লাল রঙের থুতু দেখে ও নিজেই অবাক হয়ে গেল।

জায়ান্ট টিভির পরদায় সুন্দরী রেফারিকে দেখা গেল এবার। মিষ্টি গলায় ছত্রিশরকম উল্লাস ফুটিয়ে রেফারি চিৎকার করে বলল, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, দ্য উইনার ইজ জিশা—ন। জিশান পালচৌধুরী।’

সঙ্গে-সঙ্গে গ্যালারিতে চিৎকারের নতুন ঢেউ ফেটে পড়ল। রিমিয়া গর্তের কিনারায় পাগলের মতো নাচতে শুরু করল। গ্যালারির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল প্রতিটি দর্শক এখন শুধু জিশানেরই সাপোর্টার।

লাউডস্পিকারে ব্যান্ডের বাজনা বেজে উঠল। গ্যালারিতে রঙিন বেলুন উড়তে লাগল, পটকা ফাটতে লাগল, হরেকরকম বাজির লাল-নীল-সবুজ আলোর রোশনাই ছড়িয়ে গেল রাতের আকাশে।

টিভিতে জিশানের কৃতিত্বের অডিয়োভিশুয়াল শুরু হয়ে গেল। ধারাভাষ্যকাররা বলতে লাগল, কিল গেম-এর জন্য এরকম হাই পোটেনশিয়াল ফাইটার সত্যিই আগে কখনও আসেনি।

জয়ীর অভিনন্দন কুড়োতে জিশান ওর রক্তাক্ত ডানহাতটা কোনওরকমে একবার ওপরে তুলল। তারপরই বাঁধভাঙা জলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া ক্লান্তির চাপে ও সটান খসে পড়ল মাটিতে।

সঙ্গে-সঙ্গে শ্রীধর পাট্টার নির্দেশে ইমার্জেন্সি মেডিকেল ইউনিট কাজে নেমে পড়ল। লুকোনো ক্রেন দুটোর ধাতব বাহু এগিয়ে এল গর্তের কেন্দ্রের দিকে। তার দুটো কেবিনে ছ’জন করে মেডিক। দক্ষ পরিচালনায় কেবিন দুটো গর্তের ভেতরে নামতে শুরু করল।

জায়ান্ট স্ক্রিনে একবার জিশানের ক্লোজ-আপ আর একবার জাব্বার ক্লোজ-আপ দেখানো হচ্ছিল। দেখানো হচ্ছিল ওদের পিট ফাইটের নানা অংশের স্লো মোশান ক্লিপিং। তারই মধ্যে ইনসেটে মেডিকদের তৎপরতা আর তদারকির লাইভ টেলিকাস্ট চলছিল।

জিশান অসাড় হয়ে মাটিতে পড়েছিল বটে কিন্তু ও অজ্ঞান হয়ে যায়নি। ওর চোখের পাতা এতটাই ভারি ঠেকছিল যে, শত চেষ্টা করেও ও চোখ খুলতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল দুটো লোহার বাটখারা কেউ ওর চোখের পাতার ওপরে বসিয়ে দিয়েছে। ওর ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল কিন্তু ঘুম আসছিল না। কেমন একটা তন্দ্রার ঘোরের মধ্যে সাবানজলের রঙিন বুদবুদের মতো ও যেন আলতোভাবে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

ওর কানে নানান আওয়াজ ঢুকছিল। দর্শকদের চিৎকার, পটকার শব্দ, টিভির ধারাবিবরণী…সবই যেন স্বপ্নের মধ্যে শোনা শব্দের মতো ওর কানে আসছিল।

চোখ বুজেই জিশান শানুকে দেখতে পেল। বাচ্চাটা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক নতুন-নতুন কথা শিখে গেছে। ওর হাসিটা এখন আরও শক্তিশালী চুম্বক হয়ে উঠেছে।

শানু ডাকল জিশানকে। যেন স্পষ্ট গলায় বলল, ‘বাপি, চলে এসো।’

‘যাই, সোনা। আর একটু—মাত্র একটা গেম। ব্যস, তারপরই আমি ফিরে যাব।’

‘ওটা তো কিল গেম, বাপি?’

‘হ্যাঁ, বাবা। ওটা কিল গেম। ওটা শেষ করেই আমি তোর কাছে ফিরে যাব…।’

‘তাড়াতাড়ি এসো, বাপি। তোমাকে ছেড়ে আর ভালো লাগছে না।’

‘আমারও…।’

তন্দ্রার মধ্যেই জিশান কেঁদে ফেলল। কতদিন ওর ছোট্ট সোনাকে ও দেখেনি!

লাউড স্পিকারে তখন মণীশের গলা শুনতে পাচ্ছিল জিশান।

‘…এখন জিশান আর জাব্বাকে লেভেল ওয়ান ফিজিক্যাল রিড্রেসাল ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হবে। এক্সট্রিম কেয়ার ট্রিটমেন্ট করা হবে ওদের। সুপার চ্যাম্পিয়ান জিশান সেরে উঠলে ওকে আবার কিল গেম ট্রেনিং-এ ফেলা হবে। পালা করে রেস্ট আর ট্রেনিং দিয়ে দু-মাসের মধ্যে ওকে সুপারফিট করে তোলা হবে। তারপর…।’

জিশান জানে তারপর কী। তারপর ছোট্ট দুটো শব্দ : কিল গেম।

স্মার্ট জিমের ন্যানোমিরারের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্রীধর পাট্টা। ন্যানোস্ট্রাকচারের রিফ্লেকটিং পার্টিকল দিয়ে তৈরি বিশাল আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন। আধুনিক প্রযুক্তির এই আয়নায় শ্রীধরের শরীরের প্রতিটি রোমকূপ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

আয়নায় যা দেখলেন তাতে খুশি হলেন শ্রীধর।

ফরসা ছিপছিপে শরীর। মেয়েলি ঢঙে কথা বললেও শরীরটা মরদের মতো। পটল কিংবা কচি শশার মতো ছোট-ছোট পেশি দিয়ে তৈরি। ফরসা গায়ে লোমের কোনও চিহ্ন নেই। জিমে ব্যায়াম শুরু করার আগে মালটিভাইটালাইজার তেল মেখেছেন বলে চামড়া চকচক করছে। একইসঙ্গে চকচক করছে গলার খাটো চেনটা। অনেকটা ডগ চেনের মতো—প্লাটিনাম আর হিরের ‘পুঁতি’ দিয়ে তৈরি। শ্রীধরের শরীরের একমাত্র অলঙ্কার।

শ্রীধরের চুল তেল মাখানো—টান-টান করে পিছনদিকে আঁচড়ানো। বটগাছের ঝুরির মতো সেই চুল কাঁধ ছুঁয়ে ঝালর হয়ে ঝুলছে।

ডানহাত তুলে চুলের ঝালরে আঙুল বোলালেন শ্রীধর। মনে-মনে ভাবলেন, চুল নয়—সিংহের কেশর। আর লোমহীন এই শরীরটা সিংহ।

ঠোঁটের লাল টুকটুকে লিপস্টিকের দিকে তাকালেন। ফ্লুওরেসেন্ট রং দিয়ে তৈরি বলে তা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। কয়েকসেকেন্ডের জন্য ঠোঁট ছুঁচলো করলেন। খুঁটিয়ে দেখে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে গেলেন। সিংহের ঠোঁট। যার আড়ালে রয়েছে ধারালো দাঁত।

শ্রীধরের পায়ে কালো রঙের স্কিন-টাইট পলিট্রাউজার। কোমরে দেড়ইঞ্চি চওড়া মেটাল সেগমেন্টেড বেল্ট। মনে হচ্ছিল, শ্রীধর যেন কোনও কমপিটিশান বা গেমের জন্য তৈরি।

আয়নায় নিজের ছবির দিকে স্থির চোখে তাকালেন। তারপর পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে কাল্পনিক শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের মূকাভিনয় শুরু করলেন।

কার সঙ্গে লড়ছেন শ্রীধর? ওঁর তো কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই! তাই সবসময় ওঁর লড়াই নিজের সঙ্গে। শ্রীধর নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। আর সেই চেষ্টা করেন বলেই নিউ সিটিতে শ্রীধর পাট্টাই শেষ কথা।

এই ‘শেষ কথা’ মানুষটার শুরুটা হয়েছিল ওল্ড সিটির নোংরা আবর্জনাময় ফুটপাথে। ছোটবেলা থেকেই এই লোকটা নিষ্ঠুর হিংস্র পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য লড়ছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরাটা ওর কাছে ছিল রোজকার ব্যাপার। তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধে হয়নি—কারণ, ওর বাড়ি বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু ছিল না। অন্যান্য বাড়িতে সাধারণত আর যারা থাকে—মানে, মা, বাবা, ভাই, বোন—ছেলেটার সেরকমও কেউ ছিল না।

আসলে জন্ম থেকেই ছেলেটা দেখছে ওর মা-বাবা নেই। ওর চারপাশে সব অচেনা মুখ আর অচেনা মানুষ। ওকে সবাই ডাকত পল্টন বলে। সেখান থেকে কীভাবে যেন নামটা ‘পিলটু’ হয়ে গিয়েছিল। দরমা আর পলিথিন শিটের আড়ালে ছেলেটা ‘মানুষ’ হচ্ছিল। ফুটবল খেলায় বাইশটা মানুষ মিলে একটা বলকে যেমন লাথি মারে, ঠিক সেইভাবে বাইশ কিংবা চুয়াল্লিশ পায়ের লাথি খেতে-খেতে ছেলেটা বড় হচ্ছিল। কখনও এ-বাড়িতে ঠাঁই হয় তো কখনও ও-বাড়ি। যদিও ‘বাড়ি’ মানে ছেঁড়া-ফাটা তালিমারা ঝুপড়ি।

ছেলেটার একটাই সম্পদ ছিল : গায়ের রং। ওইরকম টকটকে ফরসা হাতির দাঁতের মতো গায়ের রং ওর সঙ্গী-সাথী আর কারও ছিল না। ওকে সামনে রেখে বড়রা আলোচনা করত, নিশ্চয়ই ও খুব বড় ঘরের ছেলে—বাবা-মায়ের কোল থেকে ছোটবেলায় হারিয়ে গেছে। সেসব শুনে একটা অলীক আকাঙ্ক্ষা ছেলেটার ভেতরে লকলক করে উঠত। ও তখন থেকেই বুঝত ‘বড় ঘর’ মানে বড়লোক। আর বড়লোক মানে বড় ক্ষমতা। সেই বড় ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য ছেলেটা ভেতরে-ভেতরে নেড়ি কুকুরের মতো জিভ বের করে লোভে হাঁপাত।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *