পর্ব – ৯
পয়সা রোজগার করার জন্য ছেলেটা তখন নিয়মিত চুরি করত, পকেট মারত, আর কখনও-কখনও ভিক্ষে করত। একইসঙ্গে ও বুঝত, এইভাবে চললে এককোটি বছর পরেও ওর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। ততদিনে ওর লোভের জিভ কয়েকশো মাইল লম্বা হয়ে যাবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না।
অন্য কেউ হলে হয়তো হতাশ হয়ে পড়ত, হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু পিলটু অন্য ধাতুতে গড়া। ও প্রতি মুহূর্তে একটা সুযোগ খুঁজছিল। আর লড়াই করে বাঁচছিল।
আয়নার দিকে তাকিয়ে যেন পিলটুকে দেখতে পেলেন শ্রীধর। সেইসঙ্গে ভাগ্যফেরানো সেই দিনটাকেও দেখতে পেলেন। দিনটা ছিল মেঘলা। কিন্তু তারই আড়ালে চোদ্দোবছরের ছেলেটার জীবনে মোড় ঘোরানো একটা সূর্য লুকিয়েছিল।
তখন দুপুর হলেও আকাশে জমে থাকা গাঢ় ছাইরঙের মেঘ দুপুরটাকে সন্ধে করে দিয়েছিল। তারই মধ্যে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। একটা মাঝারি রাস্তার ধারে তিনটে প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িগুলোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল পরিত্যক্ত গাড়ির কবরখানা থেকে ওগুলোকে তুলে আনা হয়েছে। রং চটা, তোবড়ানো, বডির নানান জায়গায় চকোলেট কিংবা সাদা রঙের পুডিং ঘষা।
গাড়ি তিনটেয় কোনও লোক ছিল না—ড্রাইভারও না। তাই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে এই তিনটে গাড়িকেই টার্গেট করেছিল পিলটু। ওর ঢোলা প্যান্টের পকেটে লুকোনো ছিল একটা বড় স্ক্রু-ড্রাইভার আর একটা হাতুড়ি। এই দুটো সাধারণ যন্ত্র দিয়েই ও গাড়ির হেডলাইট, টেললাইট, ড্যাশবোর্ডের মিটার, আরও অনেক কিছু খুলে নিতে পারে। গত কয়েক বছরে ও এই কাজটায় বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। পকেট মারার চেয়ে এই কাজটা অনেক নিরাপদ। তাই গাড়ির পার্টস চুরি করে বিক্রি করাটাই পিলটুর আসল পেশা। যখন পার্টস চুরি করার মতো কোনও গাড়ি কপালে জোটে না তখন ও ঝুঁকি নিয়ে পকেট মারার কাজে হাত দেয়। সেখানেও কিছু না জুটলে তখন নিরুপায় হয়ে ভিক্ষা। শেষের কাজটায় গায়ের রংটা ওকে সাহায্য করে। কারণ ওর মতন টকটকে ফরসা ভিখারি ওল্ড সিটিতে বিলুপ্ত প্রজাতি।
মাঝের গাড়িটার লক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ড্যাশবোর্ডের নীচে উবু হয়ে বসে চোরাশিকারির মতন কাজ সারছিল। আর মাঝে-মাঝে মাথা উঁচু করে জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখে নিচ্ছিল গাড়ির মালিক হতে পারে এমন কেউ গাড়ির দিকে আসছে কি না।
রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। কখনও-কখনও দু-একটা গাড়ি ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ তুলে ছুটে যাচ্ছে। পিলটুর গাড়ির চালে বৃষ্টির ফোঁটা একঘেয়ে শব্দ করে নাচানাচি করছে। ও একমনে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে ড্যাশবোর্ডটা খুলছিল আর ভাবছিল ড্যাশবোর্ডে লাগানো তিনটে মিটার খুলে বেচে দিতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। সেই টাকায় ও টোস্ট আর কষা মাংস খেতে পারবে। কতদিন যে ও মাংস খায়নি!
জিভে জল এসে গেল। খিদে চাগাড় দিয়ে উঠল।
আর ঠিক তখনই বেপরোয়া গতির কালো গাড়িটা মাতালের মতো এলোমেলো পথে ছুটে এল। চাকা আর ব্রেকের আর্তনাদ তুলে পার্ক করা তিনটে গাড়িকে নেহাতই ভাগ্যের জোরে এড়িয়ে রাস্তার ধারের একটা ল্যাম্পপোস্টে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল। ল্যাম্পপোস্টটা কাত হয়ে গেল। হেলে পড়তে গিয়েও কীভাবে যেন আটকে গেল।
গাড়ির ভেতর থেকে অ্যাক্সিডেন্টের দৃশ্যটা দেখতে পেল পিলটু।
রাস্তায় লোকজন প্রায় ছিল না। কালো মেঘ আর বৃষ্টি বহু মানুষকেই বাড়িতে বন্দি করে রেখেছে। তা ছাড়া পিলটু আগেই খেয়াল করেছিল, এ রাস্তায় বেশ কয়েকটা ভাঙাচোরা বাড়ি। চেহারা দেখে মনে হয় বাড়িগুলো সাপখোপ বাদুড় চামচিকের পারমানেন্ট অ্যাড্রেস। সাধারণত এরকম নিরাপদ অঞ্চল দেখেই পিলটু রাস্তার ধারে পার্ক করা ‘নিরাপদ’ গাড়ি বেছে নেয়—তারপর কাজে হাত দেয়। সুতরাং অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা পিলটু ছাড়া আর কেউ খেয়াল করেছে বলে মনে হল না।
ড্যাশবোর্ডের ওপরে চোখ তুলে পিলটু উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সতর্ক নজরে অ্যাকসিডেন্ট করা গাড়িটাকে দেখছিল।
যেটা ওর সবচেয়ে অবাক লাগল সেটা হল, গাড়িটা ঝাঁ-চকচকে। কালো বডির ওপরে নানান জায়গায় স্টেইনলেস স্টিল। এরকম ফ্যানট্যাসটিক মডেলের গাড়ি ছেলেটা আগে কখনও ওল্ড সিটিতে দেখেনি। গাড়িটার সারা শরীর থেকে বিলাসিতা আর অহঙ্কার ফুটে বেরোচ্ছে। গাড়ির ছাদে গোল প্লেটের মতো কী একটা জিনিস খাড়া করে বসানো রয়েছে। প্লেট টিভিতে নিউ সিটির নানান প্রাোগ্রাম দেখে পোড় খাওয়া ছেলেটার মনে হল, ওই প্লেটটা বোধহয় ডিশ অ্যানটেনা।
সবমিলিয়ে ছেলেটা সিদ্ধান্ত নিল, এই কালো গাড়িটা নিউ সিটির গাড়ি।
চাকা আর ব্রেকের শব্দ পেয়ে চমকে মাথা তুলে জানলা দিয়ে তাকিয়েছিল। তারপর অ্যাক্সিডেন্টটা বলতে গেলে ওর চোখের সামনেই ঘটে গেছে। তখনই খেয়াল করেছে, গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই।
তা হলে কি ড্রাইভার মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল? নইলে এভাবে আঁকাবাঁকা পথে ছুটে এসে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মারার কারণ কী?
নতুন ঝকঝকে গাড়িটা এভাবে অ্যাক্সিডেন্ট করায় ছেলেটার খুব খারাপ লাগল। আবার একইসঙ্গে ওর আনন্দও হল। কারণ, ড্রাইভারটা যদি এই ধাক্কার চোটে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে ওর কপাল খুলে যাবে। এই গাড়িটার কিছু পার্টস ও ঝটপট হাতিয়ে নিতে পারবে। আর ড্রাইভারের পকেটে কিছু মালকড়ি থাকলে তাও চেটেপুটে সাফ করতে পারবে।
হাতের কাজ ফেলে রেখে ছেলেটা গাড়ি থেকে বাইরে বেরোল। তখনই ও দেখল, অ্যাক্সিডেন্ট করা গাড়িটা থেকে নেমে এল সুট-বুট পরা একজন মাঝবয়েসি মানুষ। তার হাতে একটা চওড়া ফোন—বোধহয় স্যাটেলাইট ফোন।
লোকটার কপাল গাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। গায়ের ছাই-রঙা সুটে রক্তের দাগ। লোকটা বাঁ-হাতে রুমাল চেপে ধরেছে কপালে, আর পাগলের মতো ফোনের বোতাম টিপে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছে। উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
এমনসময় বিকট গর্জন তুলে একটা হাই-পাওয়ার মোটরবাইক ছুটে এল। বাইকটা ধুলো-কাদা মাখা। তার সামনে-পিছনে অনেকগুলো লাইট লাগানো। বাইকে বসে আছে দুজন লোক। মাথায় কালো হেলমেট, চোখে কালো সানগ্লাস। গায়ে কালো টি-শার্ট, পায়ে ফেডেড জিনস। পিছনে বসে থাকা লোকটার হাতে একটা লম্বা নলওয়ালা পিস্তল।
সুট-বুট পরা লোকটা টলতে-টলতে ছুটে গেল একটা ধসে পড়া বাড়ির দিকে। ততক্ষণে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে দুজন লোক রাস্তায় নেমে পড়েছে এবং ছুটে পালানো লোকটাকে তাক করে পিস্তলওয়ালা পরপর দুবার ট্রিগার টিপেছে।
‘সুঁই—’ করে দুবার শব্দ হল। পিলটু বুঝল পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো আছে।
ছুটে পালানো লোকটার কপাল ভালো—ওর গায়ে গুলি লাগল না। ও কপালে রুমাল চেপে ভাঙাচোরা বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেল। আর বাইকের পাবলিক দুজন সানগ্লাস হেলমেট সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে শিকারকে তাড়া করল।
পিলটু তখন নিজের মতো করে অঙ্ক কষতে শুরু করল।
যদি ওই পোড়ো বাড়িটার ভেতরে গোলাগুলি চলে তা হলে দু-একটা লাশ পড়ার সম্ভাবনা আছে। তারপর সব গন্ডগোল মিটে গেলে, আততায়ীরা চলে গেলে, লাশ অথবা লাশগুলো চলে আসবে পিলটুর দখলে। তখন তাদের পকেট সাফ করা যাবে। আর শরীরে আংটি, তাবিজ, লকেট যা কিছু পাবে সেগুলোও হাতিয়ে নেওয়া যাবে।
সুতরাং তিনজন মানুষ বাড়িটায় ঢুকে পড়ার পর ছেলেটাও চোরের মতো পা টিপে-টিপে ঢুকে পড়ল।
ভেতরটা অন্ধকার। দেওয়ালের ধসে পড়া ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু দিনের আলো ঠিকরে আসছে সেটাই একমাত্র আলো। মেঝেতে রাজ্যের ধুলো আর রাবিশ। তারই ওপরে ছড়িয়ে পড়ে আছে লোহার রড, কাঠের টুকরো। সিলিং-এর কাছাকাছি একটা বড় মাপের মাকড়সার জালও চোখে পড়ল।
বাড়িটার ভেতরে পুরোনো দুর্গন্ধ। ওরা চারজন ঢুকে পড়ায় যে-শব্দ-টব্দ হয়েছে তাতে লুকিয়ে থাকা বাদুড় আর চামচিকের দল ওড়াওড়ি শুরু করে দিয়েছে। দেখতে না পেলেও ওদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।
যে-জায়গাটায় ওরা ঢুকেছে সেটা এককালে বোধহয় ঘর-টর কিছু ছিল। এখন ঘরের দেওয়ালগুলো প্রায় না থাকায় জায়গাটাকে বড়মাপের গোডাউন বা ফ্যাক্টরির শেড বলে মনে হচ্ছিল।
পিলটু খুব সাবধানে পা ফেলে অন্ধকারের আড়ালে-আড়ালে এগোচ্ছিল। তারপর একটা ভাঙা দেওয়ালের পিছনে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল। চোরা নজরে উঁকি মেরে বাকি তিনজনকে খুঁজতে লাগল।
আধো-অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই ওদের দেখতে পেল।
কাছাকাছি আর-একটা ভাঙা দেওয়ালের আড়ালে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে প্রৌঢ় মানুষটি। ওর মুখে যে-সামান্য আলোর আভা দেখা যাচ্ছে তাতে পিলটু বুঝল লোকটা এখনও ফোনের বোতাম টিপে কাউকে ধরার চেষ্টা করছে. আর একইসঙ্গে হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।
কিলার দুজন খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। নিজেদের মধ্যে ইশারা করছে, পা টিপে-টিপে জায়গা বদল করছে, ইট-কাঠ-লোহা কিছু পায়ে ঠেকলেই সেদিকে না তাকিয়ে লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। তাতে যে শব্দ হচ্ছে তা নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা নেই।
পিলটুর চোখের সামনে ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলতে লাগল।
হঠাৎই একটা আলো জ্বলে উঠল। আলোছায়ামাখা পোড়ো ঘরের এখানে-সেখানে একটা হলদে আলোর বৃত্ত ঘুরে বেড়াতে লাগল।
কিলারদের কেউ টর্চ জ্বেলেছে।
দেওয়াল থেকে ঠিকরে আসা আলোর আভায় দুজন কিলারকেই দেখতে পেল পিলটু।
প্রথমজন পিস্তল উঁচিয়ে সাবধানে পা ফেলে উঁকিঝুঁকি মেরে শিকারকে খুঁজছে। আর দ্বিতীয়জন বাঁ-হাতে একটা টর্চ ধরে রয়েছে।
পিলটু নিজেকে অন্ধকার খাঁজে আরও মিশিয়ে দিতে চাইল। ওর একটু-একটু যে ভয় করছিল না তা নয়। ও টের পাচ্ছিল, ওর হাত-পায়ের পেশি দপদপ করছে, কাঁপছে। কিন্তু এখন তো পালিয়ে যাওয়া যাবে না! ওকে দেখামাত্রই ওরা গুলি করবে। কারণ, খুনের সাক্ষী না রাখাটাই দস্তুর।
আচমকা মোবাইল ফোনের সুরেলা রিং টোন শোনা গেল।
একটা ধসে পড়া দেওয়ালের পিছনে আলোর আভা চোখে পড়ল। জ্বলছে-নিভছে। সেই আভায় শূন্যে ভেসে থাকা একটা মুখের আদলও দেখা গেল।
প্রথম লোকটার স্যাটেলাইট ফোন।
লোকটা বোধহয় বোতাম টিপে ফোন কেটে দিল। কারণ, রিং টোনটা হঠাৎ থেমে গেল। আর ফোনের আলোটাও হারিয়ে গেল। হয়তো ফোনের আলো চাপা দিতে ফোনটাকে পোশাকের আড়ালে কোথাও চটপট লুকিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু ততক্ষণে শব্দ এবং আলো লক্ষ্য করে পিস্তলের গুলি ছুটে গেছে। একবার নয়—অন্তত চারবার। চাপা ‘সুঁই-সুঁই—’ শব্দ হিসেব করে পিলটুর অন্তত তাই মনে হল।
একইসঙ্গে যন্ত্রণার আর্তনাদ শোনা গেল।
শিকারের গায়ে গুলি লেগেছে।
কিলার দুজন নিজেদের মধ্যে আঙুল তুলে ইশারা করল। পিস্তল হাতে লোকটা লম্বা-লম্বা পা ফেলে রাবিশ, লোহা, কাঠ ডিঙিয়ে আহত শিকারের দিকে ছুটে গেল। ভাঙা দেওয়ালের পিছনে গিয়ে শিকারের ওপরে ঝুঁকে পড়ল।
ঠিক তখনই রিভলভারের গুলির শব্দে গোটা বাড়িটা থরথর করে কেঁপে উঠল। পরপর দুবার।
সঙ্গে-সঙ্গে বাড়িটায় যেন হইচই শুরু হয়ে গেল।
অন্ধকারে আস্তানা গেড়ে থাকা চামচিকের ঝাঁক মিহি কিচকিচ শব্দ করে উড়তে শুরু করল। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। টর্চের আলোয় বেশ কয়েকটা ছটফটে উড়ন্ত শরীর দেখা গেল। একবার যাচ্ছে, একবার আসছে।
দ্বিতীয় কিলারের টর্চের আলো গিয়ে পড়েছিল তার সঙ্গীর ওপরে। সে দেখতে পেল দুটো শরীর জট পাকিয়ে পড়ে আছে। ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে একটা ছোটমাপের রিভলভার বের করে নিল। তারপর এক-পা-এক-পা করে দুটো শিথিল শরীরের দিকে এগোতে লাগল।
পিলটু সবকিছুই লক্ষ করেছে। ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বুকের ভেতরে যেন হাতুড়ি পড়ছিল। কী এক অজানা ভয়ে ও পকেট থেকে স্ক্রু-ড্রাইভারটা বের করে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল। তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে লাগল।
হঠাৎই উড়ন্ত দুটো চামচিকে ওর মুখে এসে ধাক্কা মারল। নিজের অজান্তেই ও হাতের ঝটকা দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে লাফিয়ে উঠল। মুখ দিয়ে ছোট্ট একটুকরো চিৎকারও বেরিয়ে গেল।
সঙ্গে-সঙ্গে টর্চের আলো নিভে গেছে। দ্বিতীয় খুনিকে ছেলেটা আর দেখতে পাচ্ছিল না। হয়তো ওর চিৎকার শুনে অন্ধকারের ভাঁজে গা-ঢাকা দিয়েছে।
পিলটু এখন কী করবে? এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? টর্চ নিভিয়ে লোকটা গেল কোথায়? কোথায় গেল?
দ্বিতীয় খুনির সঙ্গে পিলটুর দূরত্ব ছিল মাত্র দশ-বারো ফুট। সুতরাং পিলটুর চিৎকার ও স্পষ্টই শুনতে পেয়েছে। আর সেইজন্যই আলো নিভিয়ে দিয়েছে। যাতে অন্ধকারে অচেনা শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলাটা বেশ জটিল এবং কঠিন হয়ে ওঠে।
পিলটুর বুকের ভেতরে বিগ ড্রাম বাজাচ্ছিল কেউ। নিশাচর প্রাণীর মতো অন্ধকারে চোখ মেলে ও প্রাণপণে দেখতে চেষ্টা করছিল। বাড়িটার বোটকা দুর্গন্ধ ওর নাকে একেবারে চেপে বসছিল। চঞ্চল চামচিকেগুলো ওদের ওড়াউড়ি এখনও থামায়নি।
বাড়িটার সদরের দিকে নজর দিল পিলটু। সেদিকে তাকালে দরজার হাঁ করা ফ্রেমের মাপে দিনের মেঘলা আলো দেখা যাচ্ছে। পিলটু কি এখন সেদিক লক্ষ্য করে দৌড় দেবে? পকেট বা লকেট হাতানোর মতলব এখন মুলতুবি থাক। আগে নিজের প্রাণটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত করা দরকার।
পিলটু খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল। এবারে শুরু হবে ওর বিপজ্জনক মরণছুট। ওয়ান—টু—থ্রি—।
কিন্তু ছুট শুরু হওয়ার আগেই ওর মুখে আচমকা টর্চের আলো এসে পড়ল। টর্চ হাতে দ্বিতীয় খুনি ওর খুব কাছেই দাঁড়িয়ে। সিগারেট আর মদের গন্ধ পেল পিলটু।
‘কে তুই?’ জড়ানো গলায় খুনি ওকে জিগ্যেস করল।
সঙ্গে-সঙ্গে পিলটু স্ক্রু-ড্রাইভারটা খুনির পেটে ঢুকিয়ে দিল।
পিলটু কখনও মাখন খায়নি। মাখনের মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দিলে ঠিক কীরকম অনুভূতি হয় ও জানে না। কিন্তু তবুও ওর মনে হল, ব্যাপারটা যেন অনেকটা সেইরকম।
একইসঙ্গে পিলটু ভয়ার্ত পশুর মতো তীব্র চিৎকার করে উঠেছে এবং লোকটাকে প্রচণ্ড জোরে এক ধাক্কা মেরেছে।
অন্ধকারে ইট-কাঠের ওপরে উলটে পড়েছে খুনি। হাত থেকে টর্চ ছিটকে গেছে। ছোট পিস্তল থেকে ‘গুড়ুম’ শব্দ করে একটা গুলি ছুটে গেছে ঘরের ভাঙাচোরা সিলিং-এর দিকে।
প্রচণ্ড ভয় থেকে মানুষের মধ্যে একটা কোণঠাসা বেপরোয়া ব্যাপার জেগে ওঠে। চোদ্দোবছরের ছেলেটারও তাই হল। ও হুড়মুড় করে পৌঁছে গেল মেঝেতে পড়ে থাকা টর্চটার কাছে। ওটা তুলে নিয়ে হাতুড়ির মতো বসিয়ে দিল খুনির মাথায়। সংঘর্ষের ঝটকায় টর্চ নিভে গেল।
স্ক্রু-ড্রাইভার পেটে বেঁধা অবস্থাতেই লোকটা উঠে বসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু টর্চের দ্বিতীয় আঘাত ওকে আবার মাটিতে পেড়ে ফেলল। একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে এল লোকটার মুখ দিয়ে।
পিলটু বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছিল। ওর এবার মনে হল পালানো দরকার। কারণ, এতবার গুলির শব্দ হয়েছে, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়েছে যে, লোকজন এসে পড়তে পারে। বরং একটু পরে ও ঘুরেফিরে এখানে আবার আসবে। তখনও যদি বডিগুলো বেওয়ারিশভাবে পড়ে থাকে তা হলে চটপট ওর কাজ সেরে নেবে।
হাতের চর্চটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে পা বাড়াল। পনেরো-কুড়ি ফুট দূরেই হাঁ-করা সদর দরজা। সেই ফাঁক দিয়ে আলো আর বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে।
মেঝেতে পড়ে থাকা ইট-পাথর আর কাঠ ডিঙিয়ে ছেলেটা চার-ছ’পা এগোতেই মোবাইল ফোনের সুরেলা বাজনা শোনা গেল।
বাজনার সুরটা ছেলেটার চেনা। প্রথম লোকটার স্যাটেলাইট ফোন।
পিছন ফিরে তাকাল। দূরে অন্ধকারে রঙিন আলো জ্বলছে-নিভছে। কেউ ফোন করেছে লোকটাকে।
বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা লোভ ঝলসে উঠল মাথায়। পরে যখন কাজ সারতে আসবে, আসবে। এখন স্যাটেলাইট ফোনটা নিয়ে চম্পট দিলে কেমন হয়?
লোভ আর আশঙ্কার লড়াইয়ে লোভ জিতে গেল।
পিলটু ঘুরে দাঁড়াল। পায়ে-পায়ে ফিরে চলল স্যাটেলাইট ফোনটার দিকে।
যখন ও ফোনের খুব কাছে পৌঁছে গেল তখনও ফোনটা বাজছিল। ফোনের আলোয় দেখল দুটো কাহিল শরীর এখনও জট পাকিয়ে পড়ে আছে। তারই একটার হাতের মুঠোয় ফোনটা ধরা।
ঝুঁকে পড়ে ফোনটার দিকে হাত বাড়াতে যাবে অমনি বোতাম টিপে কলটা রিসিভ করল কেউ। গোঙানির স্বরে কেউ ‘হ্যালো! হ্যালো!’ বলতে লাগল।
আবছা আঁধারে দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত লাগছিল। জটপাকানো শরীর দুটোর দিকে তাকিয়ে পিলটু ‘হ্যালো’ বলা মুখটাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। অথচ জটের বাইরে বেরিয়ে থাকা একটা হাত কলটা রিসিভ করেছে।
ফোন থেকেও যে কেউ ‘হ্যালো! হ্যালো!’ বলছে সেটাও ক্ষীণভাবে পিলটুর কানে আসছিল। ও কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
কয়েকসেকেন্ডের দ্বিধা কাটিয়ে ও ফোনটা দুর্বল হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিল।
ওর মুখে ফোনের রঙিন আলো পড়ায় ফোনের আহত মালিক বোধহয় ওকে দেখতে পেল।
ভাঙাচোরা কাতর গলায় অন্ধকার মেঝের দিক থেকে কেউ বলে উঠল, ‘খোকা, আমাকে বাঁচাও…।’
লোকটা এখনও বেঁচে আছে!
পিলটু অবাক হল। কলটা কেটে দেওয়ার জন্য ও আন্দাজে ফোনের নানান বোতাম টিপতে লাগল। ফোনের ‘হ্যালো! হ্যালো!’টা হঠাৎই থেমে গেল।
ফোনটা এবার কণ্ঠস্বরের দিকে ফেরাল পিলটু। দেখল, গাড়ি থেকে নেমে আসা সেই সুট পরা মানুষটা। ওর কপাল মুখ সব রক্তে মাখামাখি। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। ওর বুকের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে কালো টি-শার্ট পরা একটা দেহ। সেইজন্যই সুট পরা মানুষটা ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতে পারছিল না।
‘আমাকে বাঁচাও! তুমি…তুমি যা চাও তাই দেব…তাই দেব।’ কাতর অনুনয়ের সুরে প্রৌঢ় বলল।
পিলটু কী করবে ভেবে না পেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
‘তোমার…নাম কী?’
কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ‘পিলটু…।’
‘পিলটু, প্লিজ…আমাকে…আমাকে বাঁচাও। আমি নিউ সিটির পিস ফোর্সের…মার্শাল। ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের মার্শাল… বলধর পাট্টা। বলধর পাট্টা। আ-আমাকে বাঁচাও। আমার…আমার…গায়ে গুলি লেগেছে। অনেকগুলো। আমাকে…বাঁচাও। প্লিজ। এখানে ফেলে…যেয়ো না। তুমি যা চাও…সব দেব। প্লিজ…।’ যন্ত্রণায় মোচড় খাওয়া কথাগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে মানুষটা প্রবল হাঁপাচ্ছিল। ফোনের আবছা আলোয় ওর চোখদুটো মরা মানুষের চোখের মতো লাগছিল।
কিন্তু এ কী শুনছে ছেলেটা!
বলধর পাট্টা! পিস ফোর্সের মার্শাল! চিফ! নিউ সিটিতে বলতে গেলে যার কথাই শেষ কথা! যার নামে বুকের ভেতরটা ভয়ে কেঁপে ওঠে! শিরদাঁড়া দিয়ে বরফের স্রোত নেমে যায়। গলা শুকিয়ে যায়! যার ধমকে অনেকেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফ্যালে!
রাস্তায়-রাস্তায় বসানো অসংখ্য প্লেট টিভির দৌলতে বলধর পাট্টার কুখ্যাতির কথা পিলটুর অজানা ছিল না। ওল্ড সিটিতে সবাই বলে, বলধরের ডাকনাম হল ‘শয়তান’। বলধর হিংস্রতায় এম. এ., পিএইচ. ডি. আর নিষ্ঠুরতায় ডি. এসসি.।
সেই ‘সাক্ষাৎ যম’ অমানুষটা কাতর অসহায়ভাবে পড়ে আছে ছেলেটার পায়ের কাছে! হদ্দ ভিখারির মতো প্রাণভিক্ষা চাইছে এই কিশোরের কাছে! বলছে, ‘তুমি যা চাও তাই দেব…।’
পিলটুর শরীরে রোমাঞ্চ খেলে গেল। ও পলকে সিদ্ধান্ত নিল। ফোনটা পকেটে রাখল। তারপর ঝুঁকে পড়ে কালো টি শার্ট পরা বডিটাকে টেনে সরাতে লাগল।
কয়েকবারের চেষ্টাতেই বডিটা বলধরের শরীরের ওপর থেকে নামিয়ে দিল পিলটু। ওর দু-বগলে হাত ঢুকিয়ে টেনে ওকে সোজা করল। তারপর পিঠটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে কোনওরকমে বসাল।
বলধর যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিল। ‘আ:! লাগছে…আস্তে…’ এসব বলছিল।
পিলটুর হাত চটচটে কীসে যেন ভিজে গেল। আঁশটে গন্ধ নাকে এল।
‘ফোনটা…ফোনটা…আমাকে দাও…।’
বলধরের মিনমিনে দুর্বল স্বর যেন বহুদূর থেকে পিলটুর কানে ভেসে এল।
ও কোনও কথা না বলে স্যাটেলাইট ফোনটা পকেট থেকে বের করে বলধরের ডানহাতে ধরিয়ে দিল।
কাঁপা আঙুলে ফোনের বোতাম টিপল বলধর। তারপর ফোনটা কানে চেপে ধরল।
মেঘ বোধহয় কিছুটা পরিষ্কার হয়েছিল। কারণ, হঠাৎই পিলটু খেয়াল করল, দিনের আলো খানিকটা বেড়ে গেছে। চামচিকে কিংবা বাদুড়ের ওড়াউড়ির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। শব্দ বলতে শুধু বলধর আর পিলটুর শ্বাস -প্রশ্বাসের শব্দ।
ও-প্রান্তে ফোনটা কেউ ধরতেই বলধর ক্লান্ত গলায় বলল, ‘মার্শাল পাট্টা। পিস ফোর্স। এস. ও. এস। জলদি এসো। ইমার্জেন্সি—লেভেল থ্রি। জি. পি. এস. কো-অর্ডিনেট সেভেন পয়েন্ট টু থ্রি বাই ফোর পয়েন্ট জিরো ওয়ান। ওল্ড সিটি, ব্লক নাইন। ইমার্জেন্সি—লেভেল থ্রি। এস. ও. এস.। কাম রাইট নাউ। এখানে…আমি আর পিলটু আছি। পিলটু…ওল্ড সিটির ইয়াং বয়। কাম। মেক…ইট…কুইক। সেভ মি। সেভ মি…।’
স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে ফোনে একটানা কথা বলছিল বলধর। তারপর হঠাৎই চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো ওর কথা থেমে গেল। হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ল। শরীরটা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি কাত হয়ে গেল মেঝের দিকে।
পিলটু তাড়াতাড়ি বসে পড়ল ওর হেলে পড়া শরীরের কাছে। ওকে আরও হেলিয়ে দিয়ে ওর রক্তাক্ত মাথাটা প্রায় কোলে নিয়ে নিল। বেশ বুঝতে পারল ওর জামা-প্যান্টে রক্ত মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হোক। মার্শালের মাথা কোলে নিতে পারে ক’জন? মার্শাল ওকে বলেছে, ও যা চায় সব দেবে। সব।
বলধরের মাথা কোলে নিয়ে সেই ‘সব’-এর আশায় বসে রইল পিলটু। ওল্ড সিটিতে অনেক হয়েছে। এবার নিউ সিটির স্বপ্নকে ছুঁতে চায় ও।
পিলটু বলধরকে ডাকল, ‘স্যার! স্যার!’
কিন্তু কোনও সাড়া পেল না।
বলধরকে নাড়া দিল পিলটু। তাতে বলধরের শরীরটা যেভাবে নড়ল পিলটু আন্দাজ করল মার্শাল বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।
এমনসময় মেঝেতে পড়ে থাকা ফোনটা আবার বাজতে শুরু করল।
ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ছেলেটা। কে ফোন করছে মার্শালকে?
ফোনটা তুলে নিল। আন্দাজ করে কল রিসিভ করার বোতামটা টিপল। তারপর ফোনে ‘হ্যালো’ বলল।
ওপাশ থেকে একটা ভারি গলা শোনা গেল : ‘কে, পিলটু?’
থতমত খেয়ে ছেলেটা বলল, ‘হ্যাঁ—।’
‘স্যার তোমার কাছে?’
‘হ্যাঁ।’ কথা বলতে গিয়ে পিলটুর গলা কেঁপে গেল। ও বুঝতে পারল পিস ফোর্সের কেউ ওর সঙ্গে কথা বলছে।
‘তোমার কোনও ভয় নেই। আমাদের অ্যাকশন ফোর্স এক্ষুনি ওখানে পৌঁছে যাচ্ছে। ডোন্ট উয়ারি, ব্রেভ বয়! ওভার অ্যান্ড আউট।’
ফোন কেটে গেল। সব কথার মানে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও ছেলেটা বুঝল পিস ফোর্স সামরিক পরিস্থিতির ঢঙে কাজে নেমে পড়েছে।
হলও ঠিক তাই। পিস ফোর্স সেই জরাজীর্ণ বাড়িটায় পৌঁছে গেল দশমিনিটের মধ্যেই।
আকাশ থেকে নীল-সাদা চারটে শুটার রাস্তায় নেমে এল। একইসঙ্গে কালো রঙের চারটে গাড়ি শব্দ করে ছুটে এসে তীব্রভাবে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল বৃষ্টিভেজা রাস্তায়। ডিশ অ্যানটেনা লাগানো একটা সাদা ভ্যান তার পাশাপাশি এসে থামল। তার গায়ে লেখা ‘ইমার্জেন্সি মেডিকেল ইউনিট’। সেই ভ্যানের দরজা খুলে ছ’জন মেডিক নেমে পড়ল রাস্তায়। তাদের হাতে অক্সিজেন মাস্ক, ফাইবারের স্ট্রেচার আর ‘এস. ও. এস.’ মেডিকেল কিট। তারা ব্যস্তভাবে ছুটে গেল ভাঙা বাড়িটার দিকে। কেউ একজন চিৎকার করে সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিল।
তারপরই অনেকগুলো হ্যালোজেন টর্চের আলোয় পিলটুদের ‘যুদ্ধক্ষেত্র’টা ভেসে গেল। মেঝেতে, দেওয়ালে, সিলিং-এ সেই উজ্জ্বল সাদা আলো অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় চলে বেড়াতে লাগল। ভারী বুটের শব্দে বাদুড় চামচিকেরা আবার সচকিত হয়ে উঠল। উড়ে বেড়াতে লাগল।
আলোর কাটাকুটি খেলার আড়াল থেকে কেউ একজন ডাকল : ‘পিলটু—।’
‘এই যে। আমি এখানে।’
কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই সবক’টা দেহ আর মৃতদেহ পিস ফোর্সের দখলে চলে গেল।
এরপর যা হল তা পিলটু স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি।
শুটারে চড়ে ও আকাশপথে উড়ে চলল নিউ সিটির দিকে। নীচে, বহু নীচে, দেখা যাচ্ছে ওল্ড সিটির জরাজীর্ণ রুগ্ন চেহারা। একটা পুরোনো ঘা-এর মতো ছড়িয়ে রয়েছে শহরটা। আয়ু ফুরিয়ে আসা, বিছানায় মিশে থাকা, একটা রুগির মতো ধুকপুক করছে শহরটার হৃৎপিণ্ড। শ্রান্ত-ক্লান্ত শহরটা হাঁপাচ্ছে।
এই শহরে যদি আর ফিরতে না হয় তা হলে দারুণ হবে। সেই আশায় মনে-মনে প্রার্থনা করতে লাগল পিলটু। আর একইসঙ্গে চাপা উত্তেজনায় ওর বুকের ভেতরটা ধকধক করতে লাগল। ছলনাময়ী ভাগ্যশ্রী এখন ওর জন্য কী উপহার সাজিয়ে রেখেছে কে জানে!
শিসের শব্দ তুলে নীল সাদা রঙের শুটার আকাশপথে ছুটছিল। ছেলেটার পাশে একজন পিস ফোর্সের লোক। ঝকঝকে পোশাক দেখে মনে হয় ফোর্সের কেউকেটা একজন হবেন। আর সামনের সিটে দুজন—তার মধ্যে একজন শুটারের পাইলট।
শুটারটা স্বচ্ছ ডোমে ঢাকা। ভেতরটা এয়ারকন্ডিশনড। সিটে বসে নিউ সিটির মিনিয়েচার ছবি দেখতে পাচ্ছিল ছেলেটা। ঠিক যেন আর্কিটেক্টের তৈরি একটা ঝিনচাক শহরের মডেল। মডেল তো নয়—স্বপ্ন। যেন সেই জীবন্ত স্বপ্নকে কেউ পরম যত্নে মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে।
সেই স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ছেলেটা বিলাসিতার কল্পনা করছিল। আর ওর চোখের সামনে স্বপ্নটা খুব ধীরে-ধীরে বড় হচ্ছিল, সাকার হচ্ছিল। কারণ শুটার নামতে শুরু করেছিল।
স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ক্লান্তিতে ছেলেটা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ল্যান্ডিং জোনে শুটার ল্যান্ড করতেই ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর পিস ফোর্সের লোকজন ওকে নিয়ে যা শুরু করল তাতে ছেলেটার মনে হল ও কোনও দেশের রাষ্ট্রপতি—অতিথি হয়ে নিউ সিটিতে এসেছে। এখানকার কর্মকর্তারা ওকে কোলে বসাবেন না মাথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছেন না।
পিস ফোর্সের লোকজন আর কর্মকর্তাদের কথাবার্তা শুনে ছেলেটা বুঝতে পারল, ওকে টপমোস্ট সিকিওরিটি জোনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে একটা গোল্ডেন পেন্টহাউসে টপমোস্ট কমফোর্ট লেভেলে ওকে রাখা হবে। পিস ফোর্সের ছ’জন স্টাফ চব্বিশঘণ্টা ওর তদারকিতে থাকবে।
ছেলেটার মনে হল, স্বপ্ন যখন সত্যি হয় বোধহয় এরকম হঠাৎ করেই হয়। আর সেইজন্যই ও ব্যাপারটাকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না।
ঝকঝকে নতুন জামাকাপড় পরে পেন্টহাউসের বেডরুমে বিছানায় বসে ছিল ছেলেটা। ঘিয়ে রঙের সিল্কের চাদরে ঢাকা নরম বিছানা। তার ওপরে ধীরে-ধীরে হাত বুলিয়ে ও বুঝতে চাইছিল ব্যাপারটা স্বপ্ন, না বাস্তব।
বাস্তব হয়ে ওঠা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ছেলেটার দিন কাটতে লাগল। আর তারই মধ্যে চলতে লাগল জিজ্ঞাসাবাদ।
পিস ফোর্সের নানান স্তরের লোকজন ওর ঘরে আসতে লাগল। তারা পালা করে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ওকে প্রশ্ন করতে লাগল। সেদিন দুপুরে বলধর পাট্টাকে দেখা থেকে শুরু করে পিস ফোর্সের অফিসাররা অকুস্থলে এসে পৌঁছনো পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা ওকে বারবার বলতে হচ্ছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, পিলটুর কথা শুনে-শুনে ওরা ওর স্টেটমেন্টের রিয়েল টাইম ভিডিয়ো সিমুলেশান তৈরি করছিল। ওর ঘরের মধ্যে কমপিউটার এবং আরও কীসব যন্ত্রপাতি এনে তিনজন লোক সিমুলেশানের কাজে ব্যস্ত ছিল। আর দুজন অফিসার পিলটুকে একের পর এক প্রশ্ন করছিল।
পিলটুর উত্তর শুনে-শুনে ওরা সিমুলেশান তৈরি করছিল, কারেকশান করছিল, পিলটুকে বারবার ওটা দেখাচ্ছিল। এইভাবে চারদিন কেটে যাওয়ার পর অডিয়ো-ভিশুয়াল সিমুলেশানটা ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে বলে ওদের মনে হল।
পিলটু যখন ফাইনাল সিমুলেশানটা দেখল তখন ও অবাক হয়ে গেল। সেইদিনকার ঘটনাগুলো নিয়ে কেউ যেন একটা সিনেমা তৈরি করেছে।
সেই সিনেমা শুরু হল। কমপিউটারের পরদার এককোণে সময় দেখা যাচ্ছে। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে-সঙ্গে একসেকেন্ড-একসেকেন্ড করে সময় পালটে যাচ্ছে। পরদায় ঘটনা শুরু হল। ঝাঁ-চকচকে কালো গাড়িটা মাতালের মতো ছুটে এসে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল।
সিনেমাটা দেখে অবাক হয়ে গেল পিলটু। কোথাও কোনও ভুল নেই। ও যেমন-যেমন স্টেটমেন্ট দিয়েছে, নানান প্রশ্নের উত্তরে যা-যা বলেছে, ঠিক সেই-সেই ঘটনাগুলোর চলমান ছবি এঁকে ওরা ওর চোখের সামনে সাজিয়ে দিয়েছে।
একটা আশ্চর্য ভিডিয়ো গেম দেখছিল পিলটু। মানুষগুলো একটু পুতুলের মতো লাগছিল ঠিকই, তবে বাকি সবকিছু যেন আসলের মতো। গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ, মোটরবাইকের শব্দ, গুলির আওয়াজ—এমনকী বাদুড় আর চামচিকের ডানা ঝাপটানোর শব্দটাও ওরা আসলের মতো তৈরি করে ঠিকমতো জুড়ে দিয়েছে।
পিলটুকে নিয়ে এসব যখন চলছিল তখন বলধর পাট্টা নিউ সিটির এক্সট্রিম মেডিকেল কেয়ার ইউনিটে সেরে উঠেছিল। তার সেরে ওঠার খবর পিস ফোর্সের অফিসারদের কাছেই শুনছিল পিলটু। বলধরের গায়ে চারটে গুলি লেগেছে, কিন্তু এখন সে বিপদের আওতার বাইরে। চিফ মেডিক অন্তত তাই বলেছেন।
পিস ফোর্সের অফিসাররা বলধরের স্টেটমেন্টও নিয়েছেন। সেই স্টেটমেন্ট পিলটুর স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে তবেই ফাইনাল ভিডিয়ো সিমুলেশানটা তৈরি করা হয়েছে। সেটা দেখে বলধর অ্যাপ্রুভ করেছে। সুতরাং এই ফাইনাল সিমুলেশানটাই এভিডেন্স আরকাইভে রাখা হবে।
মার্শাল বলধর পিলটুর সাহসের খুব প্রশংসা করেছে। বলেছে, ‘ও আমার স্পেশাল গেস্ট। ওর আদর যত্নে যেন কোনও ফাঁক না থাকে।’
না, কোনও ফাঁক নেই। কিন্তু সে তো মাত্র ক’দিন! তারপর, বলধরের এই রোমাঞ্চকর মামলার আঁচ মিটে গেলে, পিলটুকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেওয়া হবে ওল্ড সিটিতে—ওর আগের জায়গায়, ছেঁড়া-ফাটা পলিথিনে ছাওয়া ঝুপড়ির নীচে। তখন একদিনের জন্য সত্যি হওয়া স্বপ্নটা আবার শুধু স্বপ্ন হয়ে যাবে। আবার ওকে ভিক্ষে করতে হবে, পকেট মারতে হবে, গাড়ির পার্টস চুরি করে বিক্রি করতে হবে।
স্ক্রু-ড্রাইভারটার কথা মনে পড়ল পিলটুর। পিস ফোর্সের অফিসাররা ওটা ওকে আর ফেরত দেননি। বলেছেন, ওটা নাকি ওঁদের এভিডেন্স আরকাইভে রেখে দেওয়া হবে। সুতরাং, হাতুড়িটা সঙ্গে থাকলেও পিলটুকে নতুন একটা স্ক্রু-ডাইভার কিনতে হবে। গাড়ির ‘কাজ’ শুরু করতে গেলে ওটা কেনা দরকার।
গোল্ডেন পেন্টহাউসে বসে পিলটু যখন এসব কথা ভাবছে তখনই ও খবর পেল, বলধর পাট্টা পুরোপুরি সেরে উঠে ওর বাড়িতে ফিরে গেছে। এর সঙ্গে আরও যে-খবরটা ওকে দেওয়া হল সেটা শুনে ওর বুকের ধুকপুকুনি আচমকা বেড়ে গেল। হাতুড়ি পেটার শব্দ হতে লাগল বুকের ভেতরে।
বলধর পাট্টা ওকে ডেকে পাঠিয়েছে নিজের বাড়িতে।
আস্তানা বদলে গেল ছেলেটার।
এক একর সবুজ জমির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিক বিমূর্ত ছাঁদে তৈরি একটা তিনতলা ছোট বাড়ি। তাকে ঘিরে পার্ক, দিঘি, গাছপালা—আরও কত কী! এই বাড়িতে থাকে একজনমাত্র মানুষ। তাকে ঘিরে হুকুম তামিল করার জন্য আছে আরও বারোজন পুরুষ।
বলধর পাট্টা আর একডজন পুরুষ। পিলটু সেখানে গিয়ে মোট পুরুষের সংখ্যা চোদ্দোয় নিয়ে গেল।
আভিজাত্য আর অহঙ্কারে সাজানো একটা বিশাল মাপের ড্রইংরুমে বলধরের মুখোমুখি হল ছেলেটা। বলধরকে ভালো করে দেখল।
মেরুন রঙের ড্রেসিং গাউন পরা প্রৌঢ় কাঠামোটা টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে। মাথার সামনের দিকে শতকরা প্রায় চল্লিশভাগ টাক পড়ে গেছে। বাকিটা কাঁচা-পাকা পাতলা চুলে ঢাকা। চোয়াল চওড়া। দাড়ি-গোঁফ কামানো পরিষ্কার মুখে বয়েসের ভাঁজ। তবে সেইসঙ্গে রুক্ষতার ছাপও আছে। ঠোঁটজোড়া বড় বেশিরকম লালচে। ড্রেসিং গাউনের হাতার বাইরে বেরিয়ে থাকা হাতের শিরা ফুলে আছে। হাতের আঙুলগুলো যে শক্তিশালী সেটা চওড়া গাঁট আর খসখসে চামড়া থেকে আঁচ করা যায়।
পিলটু অবাক চোখে বসবার ঘরের জাঁকজমক দেখছিল। সেইসঙ্গে বিস্ময়ভরা চোখে বলধরকে দেখছিল। অগাধ ক্ষমতা এই মানুষটার। ক্ষমতার সাগরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা এক লাইটহাউস। সেই লাইটহাউসের চূড়া থেকে ক্ষমতার অবিরাম বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।
ভারী গলায় বলধর বলল, ‘পিলটু—তাই তো নাম তোমার?’
বোবা পিলটু মাথা নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ।’
‘পিলটু, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।’ বলধর ধীরে-ধীরে বলল, ‘তা ছাড়া তোমার সাহসও কম নয়। কারণ, সেইদিনকার ঘটনার ভিডিয়ো সিমুলেশানটা আমি দেখেছি। য়ু আর রিয়েলি ব্রেভ, পিলটু। আই অ্যাম রিয়েলি প্রাউড অফ য়ু।’
শেষের ইংরেজি কথাগুলোর অর্থ ছেলেটা কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তবুও ও আন্দাজ করতে পারল যে, কথাগুলো প্রশংসার।
একটু থেমে বলধর পাট্টা আবার বলল, ‘তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ, পিলটু। ওই বিপদের সময় আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি যা চাও সব দেব। আজ সে-কথা আমি ভুলে যাইনি। বলধর পাট্টা একবার যা বলে তার কখনও নড়চড় হয় না।’ একটু থামল, পিলটুর কাছে এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ল : ‘বলো, তুমি কী চাও। কোনওরকম সঙ্কোচ বা লজ্জা করবে না। বলো…।’
কয়েকমুহূর্ত বলধরের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। ওর গলা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিল। চারপাশে তাকিয়ে ও ঘরের দেওয়ালের কারুকাজ দেখছিল, বিচিত্র আলোকসজ্জা দেখছিল, বাতাসে নাক টেনে কেমন এক সুগন্ধ টের পাচ্ছিল। আর বিস্ময়ে স্থবির হয়ে ভাবছিল, এটা পৃথিবী, না স্বর্গ?
‘বলো, বলো—লজ্জা কোরো না।’
‘আমি স্যার আপনার কাছে থাকতে চাই।’
তুবড়ির আগুনের ফুলকির মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাগুলো। কথাগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পরই পিলটু ভয় পেল। বলধর রাগ করবে না তো! এক্ষুনি পিলটুকে গলা ধাক্কা দিয়ে ওর নরকে পাঠিয়ে দেবে না তো!
কিন্তু বলধর রাগ করল না—বরং হাসল।
‘তোমার বাড়িতে আর কে-কে আছে?’
‘কেউ নেই—।’
‘কেউ নেই?’ বলধর পাট্টার ভুরু কুঁচকে গেল।
‘কেউ নেই। মা, বাবা, ভাই-বোন—কেউ নেই।’ সাহসী স্পষ্ট গলায় বলল ছেলেটা।
বলধর সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাথা পিছনে হেলিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল। বিশাল ঘরের দেওয়ালে-দেওয়ালে সেই হাসির প্রতিধ্বনি শোনা গেল।
হাসির দমক থামলে চোখের কোণ থেকে জল মুছে নিল বলধর। বড়-বড় চোখে পিলটুর দিকে তাকিয়ে মজার সুরে বলল, ‘আমারও কেউ নেই। মা, বাবা, ভাই-বোন—কেউ নেই।’
পিলটু আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তাই চুপ করে রইল।
ওকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখল বলধর। তারপর খুব ধীরে-ধীরে ওপর-নীচে মাথা নাড়ল।
ছেলেটার সাহস আছে। একটা স্ক্রু-ড্রাইভার কেমন অনায়াসে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা জোয়ানের তলপেটে! যেখানে বলধরের কপালে নিশ্চিত মৃত্যু লেখা ছিল সেখানে এই ছেলেটা সেই কপাল-লিখন মুছে বলধরকে নতুন জীবন দিয়েছে। দ্বিতীয় ইনিংস খেলার সুযোগ করে দিয়েছে।
না:, কোনও সন্দেহ নেই, ছেলেটা একটা তেজিয়ান কুঁড়ি। ওর গায়ে হয়তো রুক্ষ অভাবী জীবনের ধুলো-ঝড়-বৃষ্টির নোংরা মলিন প্রলেপ পড়েছে, কিন্তু কুঁড়িটাকে চেনা যাচ্ছে। অন্তত বলধর চিনতে পারছে। এর ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে আগামীদিনের ক্ষমতার ফুলের পাপড়ি। ছেলেটা বাচ্চা হলেও সিংহের বাচ্চা।
ঠোঁটের কোনা কামড়ে বলধর ভাবছিল। ক্ষমতার যে-শীর্ষে বসে সে ক্ষমতার সতেজ তরঙ্গ প্রতিমুহূর্তে বিকিরণ করে চলেছে সেই শীর্ষাসন সে কাকে দিয়ে যাবে? এ-কথা ভেবে-ভেবে কয়েকবছর ধরে রাতে ঘুমোতে পারে না বলধর। তার চারপাশে যারা আছে তাদের মধ্যেও সে খুঁজেছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখেছে বারবার। কিন্তু সমাধান মেলেনি। যোগ্য কোনও উত্তরাধিকারীকে খুঁজে পায়নি বলধর। এদিকে ওল্ড সিটির গোপন ঘাতকদল বহুদিন ধরেই তাকে খুন করার জন্য ছক কষছে, সুযোগ খুঁজছে। দ্বিমুখী এই চিন্তার চাপ এতদিন বলধরের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
বোধহয় আজকের দিনটার জন্যই। সমাধানের এই মুহূর্তটার জন্য। গোপন ঘাতকরা ওকে গুলি করেছিল বলেই আগামীদিনের বলধর পাট্টাকে খুঁজে পেয়েছে বলধর। এই কুঁড়িটাকে অত্যন্ত যত্নে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
পিলটুর চিবুকে আঙুল ছোঁয়াল। হেসে বলল, ‘তুমি আমার কাছে থাকবে। আমি তোমাকে নতুন নাম দেব। নতুন জীবন দেব। লেখাপড়া শেখাব। পিস্তল চালানো শেখাব। তোমাকে চ্যাম্পিয়ান তৈরি করব। লোকে জানবে তুমি আমার বহুবছর আগে হারিয়ে যাওয়া ভাই। হঠাৎ করে ওল্ড সিটিতে তোমাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। বুঝেছ?’
ছেলেটা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও বলধরকে জড়িয়ে ধরল, আবেগে কেঁদে ফেলল। আর তারই মধ্যে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, ‘স্যার, স্যার…। আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না, স্যার…।’
‘স্যার নয়—দাদা, দাদা—।’ ছেলেটার মাথায় আদরের হাত বোলাতে-বোলাতে বলধর বলল, ‘পিলটু নামটা ভুলে যাও। এখন থেকে তোমার নাম শ্রীধর—শ্রীধর পাট্টা।’
শ্রীধর…শ্রীধর পাট্টা। নতুন নামটা ছেলেটা নি:শব্দে উচ্চারণ করতে লাগল বারবার।
সেই মুহূর্তে পিস ফোর্সের আগামীদিনের মার্শালের জন্ম হয়েছিল। নতুন এক বলধর পাট্টার জীবনরেখা শুরু হল।
জন্মদিনটা আজও মনে আছে শ্রীধরের। ১৯ মে, বুধবার, ২৩৩২ সাল। এক সিংহের আস্তানায় নতুন এক সিংহের জন্ম হয়েছিল।
আজ, এখন, এই সিংহটা ন্যানোমিরারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পল্টনের কথা ভাবছে। আর ভাবতে গিয়ে বারবার মনে হয়, ওটা যেন কোনও প্রাচীন যুগের এক আবছায়া স্বপ্ন। অথবা বড়জোর মনে-মনে কোনও কাল্পনিক কমপিউটারের মনিটরে কোনও আজব সিমুলেশান দেখছেন।
শ্রীধরকে গড়ে তোলার ব্যাপারে বলধর কোনওরকম খামতি রাখেনি। ওকে দিয়ে জিমে ব্যায়াম করিয়েছে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার শিখিয়েছে। শিখিয়েছে রাজনৈতিক কূটকৌশল—তার সঙ্গে হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা।
হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতায় বলধর যদি ছিল পিএইচ. ডি. আর ডি. এসসি., তা হলে শ্রীধর একেবারে নোবেল লরিয়েট।
বলধরকে ‘দাদা’ ডেকে বড় হতে লাগলেন শ্রীধর—আর সেইসঙ্গে ‘দাদাগিরি’-তেও প্রশিক্ষণ নিতে লাগলেন। মানুষের শরীরকে কতরকমভাবে যন্ত্রণা দেওয়া যায় আজ শ্রীধর তা জানেন। তিনি জানেন কীভাবে ভয়কে ব্যবহার করতে হয়। জানেন আরও বহু গোপন কৌশল।
লড়াইয়ের শ্যাডো প্র্যাকটিস শেষ করলেন। এয়ারকন্ডিশনড জিম হওয়া সত্বেও শ্রীধরের শরীরে ঘামের একটা পাতলা স্তর তৈরি হয়েছিল। একটু দূরে দেওয়ালে রুপোর তৈরি একটা ডিজাইনার হ্যাঙার লাগানো ছিল। তাতে ঝুলছে খরগোশের লোমের মতো মোলায়েম একটা ঘিয়ে রঙের টাওয়েল। সেই টাওয়েলটা তুলে নিয়ে শরীর মুছলেন শ্রীধর। আয়নায় নিজেকে বারবার দেখলেন। প্রতিবিম্বের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রায় ভুলে-যাওয়া নামটা কয়েকবার আলতো করে ডেকে উঠলেন : ‘পিলটু! পিলটু!…পল্টন…।’
নিজের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কুড়িটা বছর বড় দীর্ঘ সময়। সেদিনের চোদ্দোবছরের কিশোর আজ চৌতিরিশ বছরের পোড়খাওয়া এক কুখ্যাত মার্শাল। নিউ সিটির লোকজন শ্রীধরের ভয়াবহতা বোঝাতে রসিকতা করে বলে, শ্রীধর যদি কোনও ফুলের বাগানে পা রাখেন তা হলে বাগানের সব ফুল পলকে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে যাবে।
আজ বলধর নেই। সে মারা গেছে প্রায় আটবছর। প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার হয়ে খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। কিন্তু তার আগে বলধর তার কাজ সম্পূর্ণ করে গেছে। পুরোপুরি নিজের ছাঁচে শ্রীধর পাট্টাকে তৈরি করে গেছে। নিউ সিটিকে এক পূর্ণাঙ্গ মার্শাল উপহার দিয়ে গেছে। বলধরের ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলিয়ে দিয়েছেন শ্রীধর। বলধরের প্রাসাদে তিনি এখন একা থাকেন। তাঁর সঙ্গে থাকে তদারকির বারোজন পুরুষ।
বলধরের চিকিৎসায় চূড়ান্ত আন্তরিক ছিলেন শ্রীধর। কোনও মানুষের পক্ষে যা-যা করা সম্ভব তার সবটাই করেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের খাতায় বলধরের সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই ‘বলধর যুগ’ শেষ হল। শুরু হল ‘শ্রীধর যুগ’। নিউ সিটির মানুষের চোখে শ্রীধর পাট্টা হলেন শহরের শৃঙ্খলা আর শাসনের দেবতা।
শ্রীধর নামে হয়তো পিস ফোর্সের মার্শাল। কিন্তু কীভাবে-কীভাবে যেন সুপারগেমস কর্পোরেশন আর সিন্ডিকেটের ওপরেও তাঁর ক্ষমতা কায়েম হয়ে গেছে। শহরের ক্ষমতা-সাম্রাজ্যের যে-অঞ্চলেই কোনও পুতুলনাচ দেখা যাক না কেন, তার সুতো আসলে বাঁধা রয়েছে শ্রীধরের আঙুলে।
গায়ের ঘাম মুছে তোয়ালেটা আবার হ্যাঙারে রেখে দিলেন। পায়ে-পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলেন একটা স্টেইনলেস স্টিলের কাবার্ডের কাছে। কম্বিনেশান লকের বোতাম টিপে-টিপে কাবার্ডের পাল্লা খুললেন। ভেতরে কয়েকটা তাকে নানান টুকিটাকি জিনিস।
তারই মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট শিশি তুলে নিলেন শ্রীধর। শিশিটা চোখের সামনে তুলে ধরে চকচকে নজরে তাকালেন ওটার দিকে। শিশির ভেতরে গাঢ় স্বচ্ছ তরল। ঢাকনা খুলে শিশিটা শূন্যে উঁচু করে ধরলেন। মুখ হাঁ করে তাকালেন ওপরদিকে। কয়েক ফোঁটা তরল ঢেলে দিলেন হাঁ-এর ভেতরে। মুখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকালেন এপাশ-ওপাশ। জিভ দিয়ে টাকরায় তৃপ্তির শব্দ করলেন কয়েকবার। শ্রীধরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল—সিংহের চোখের মতো। ঢাকনা এঁটে শিশিটা আবার তাকে ফিরিয়ে দিলেন।
এই ওষুধটা এক অদ্ভুত এনার্জি সল। বিদেশ থেকে এই তরল আমদানি করেন শ্রীধর। শুধুমাত্র নিজের জন্য। নিউ সিটির আর কেউ জানে না এই তরলের রহস্য। সারাদিনে কয়েকবার এই ওষুধটা নেন শ্রীধর। এটা ওঁর শরীরে নতুন শক্তি তৈরি করে। এটা খাওয়ার পরই মনে হয় শরীরের ভেতরে অফুরান শক্তি বাজপাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে।
এই আশ্চর্য ওষুধের গোপন রহস্য শ্রীধরকে জানিয়ে গেছে বলধর। নিজের অভ্যাসের উত্তরাধিকার দিয়ে গেছে ‘ছোট ভাই’-কে। এ ছাড়া বলধর আরও একটা ‘অভ্যাস’ শ্রীধরকে ধরিয়ে গেছে। লিপস্টিক। ফ্লুওরেসেন্ট লিপস্টিক। তবে ছড়া কেটে কথা বলার ব্যাপারটা শ্রীধরের নিজস্ব।
কাবার্ডের দরজা বন্ধ করলেন। তোয়ালে দিয়ে আর একবার গা মুছে জিমের লাগোয়া ড্রেসিংরুমে চলে এলেন।
নিজের শত্রুদের কথা ভাবতে লাগলেন শ্রীধর।
বলধরের শত্রু ছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক। ক্ষমতায় যদি কেউ থাকে তার শত্রু থাকবেই। সেই কারণেই বলধর নিজের জন্য বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। নিজের বিশ্বস্ত গুপ্তচর সে ছড়িয়ে রেখেছিল নিউ সিটির মানুষজনের মধ্যে আর সিন্ডিকেটের নানান স্তরে—এমনকী সিন্ডিকেটের সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও মিশে ছিল বলধরের অনুচরের দল। তাদের সবাইকে বলধর নিয়মিত টাকা দিত। বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে বলধর সবাইকে টাকা চিনতে শিখিয়েছে। বোঝাতে চেয়েছে, টাকাই সব। বোঝাতে চেয়েছে, ‘মূল্যবোধ’ শব্দটার আসল অর্থ ‘মূল্যের বোধ’—অর্থাৎ, অর্থমূল্যের বোধ। ‘মূল্য’ আর ‘দাম’ শব্দ দুটোর মধ্যে কোনও তফাত নেই। ঠিক যেমন ইংরেজি ‘ভ্যালু’ আর ‘প্রাইস’ শব্দ দুটোর মধ্যে কোনও তফাত নেই।
সেই পথেই পা ফেলে এগিয়ে চলেছেন শ্রীধর। গুপ্তচর, টাকা ইত্যাদির বিনিময়ে নিজেকে সুরক্ষিত করার বন্দোবস্ত যেমন করেছেন তেমনই ইমার্জেন্সি সিচুয়েশানের জন্য নিজের আওতায় রেখেছেন স্পেশাল শুটার। তিনটে ইঞ্জিন লাগানো এই শক্তিশালী শুটার শ্রীধর নিজেই চালাতে পারেন। এই শুটারের মধ্যে লুকোনো রয়েছে অ্যান্টি-ডেসট্রাকশন স্টিল বক্স। থার্মাল ইনসুলেশান দেওয়া এয়ারটাইট এবং ওয়াটারপ্রুফ সেই বাক্সের ভেতরে রয়েছে শ্রীধরের ইমার্জেন্সি ফান্ড—কয়েক লক্ষ মার্কিন ডলার।
যদি কখনও প্রয়োজন হয় শ্রীধর এই স্পেশাল শুটারে করে নিউ সিটি ছেড়ে উড়ে যাবেন পৃথিবীর যে-কোনও দেশে। সেখানে নিরাপদে জীবন কাটাবেন। একইসঙ্গে ক্ষমতায়নের পুনর্বাসনের অপেক্ষায় থাকবেন। তারপর প্রথম সুযোগেই ফিরে আসবেন নিউ সিটিতে।
কাবার্ডের পাল্লা বন্ধ করে আপনমনে মাথা নাড়লেন শ্রীধর। হাসলেন। যতই এসব ব্যবস্থা থাকুক না কেন শ্রীধর জানেন, এসবের কোনও প্রয়োজন হবে না। শ্রীধর পাট্টা আছেন, এবং থাকবেন। কখনও-কখনও নিজেকে সত্যি অমর বলে মনে হয় শ্রীধরের। তিনি কখনও চান না নিউ সিটিতে তিনি ছাড়া আর কোনও ‘হিরো’ তৈরি হোক। যখনই শ্রীধর এরকম সম্ভাবনা দেখেছেন তখনই ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন। দ্বিতীয় আর কোনও ব্যক্তিত্বকে মাথা তুলতে দেননি। জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিউ সিটির ‘মালিক’ কে।
কিন্তু জিশান? এই জিশান পালচৌধুরী ছেলেটা? ওল্ড সিটি থেকে কিল গেম-এর পার্টিসিপ্যান্ট খুঁজতে গিয়ে ওকে বেছে নিয়েছিলেন শ্রীধর। ভেবেছিলেন, নানান খেলায় ছেলেটা জিতবে, কিন্তু কিল গেম পর্যন্ত পৌঁছবে না। বড় জোর পিট ফাইট পর্যন্ত যাবে। তারপর…।
অথচ জাব্বার মতো বর্ন কিলারের হাতে ছেলেটা শেষ হয়নি। উলটে জাব্বাকে চুরচুর করেও ওকে খতম করেনি। ওকে জীবনভিক্ষা দিয়েছে।
সারা শহর এখন জিশান বলতে পাগল।
একের-পর-এক খেলায় জিতে ছেলেটা ধীরে-ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পিট ফাইটে ও জাব্বাকে বাগে পেয়েও খতম না করে ছেড়ে দেওয়ায় শহরবাসীরা অনেকে খুশি হয়েছে। তারা জিশানকে নিয়ে দিন-রাত চর্চা করছে।
নিউ সিটিতে ছড়ানো গুপ্তচরের মারফত সব খবরই পাচ্ছেন শ্রীধর।
টিভির নানান চ্যানেলে জিশানের নানান গেম-এর পারফরম্যান্স নিয়মিত রিপিট টেলিকাস্ট হচ্ছে। ওকে নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের প্রাোডাক্ট প্রাোমোট করছে। দিন-রাত টেলিভিশানে শুধু জিশান আর জিশান।
শ্রীধর বুঝতে পারছিলেন, এই ছেলেটাকে নিয়ে শহরে ‘হিরো ওয়রশিপ’ শুরু হয়ে গেছে। জনগণ চাইছে কিল গেম-এ জিশান জিতুক। অসম্ভবকে সম্ভব করুক। জিশান পালচৌধুরী ওদের চোখে সুপারহিরো।
কিন্তু কিল গেম-এ তো আজ পর্যন্ত কেউ বাঁচেনি!
এই গেম-এর আইডিয়াটা প্রথম শ্রীধরের মাথায় আসে। তারপর সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম ডিজাইনাররা গেমটাকে ফাইনাল শেপ দেয়। যদিও মিডিয়ার মাধ্যমে সবসময় প্রচার করা হয় কিল গেম-এর সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.07, শ্রীধর জানেন আসলে ওটা 0.0। ননজিরো ইনডেক্সটা দেওয়া আছে শুধু ইনটারন্যাশনাল গেম কোডকে বুড়ো আঙুল দেখানোর জন্য।
জিশানের সুপারহিরো হয়ে ওঠার ব্যাপারটা শ্রীধরের মনে কাঁটার মতো খচখচ করতে লাগল।
না। না। কিল গেম-এ জিশানকে হারতে হবে।
হারতেই হবে।
ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে জিশানের মনটা উদাস হয়ে গেল।
এখন ক’টা বাজে? খুব বেশি হলে সাড়ে পাঁচটা। টিভির মেয়েটি ভোর ছ’টায় মিষ্টি গলায় ওকে ডেকে ওঠার অনেক আগেই জিশান ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এসেছে এলিভেটরের কাছে। ওর ভীষণ ছাদে যেতে ইচ্ছে করছিল। ওখানে আকাশ অনেক বড়।
এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই পিস ফোর্সের একজন গার্ডকে দেখা গেল। কোমরে ঝুলছে শকার।
জিশানকে দেখে গার্ডের চোয়ালের রেখা নরম হল। মুখের রুক্ষ ভাব মিলিয়ে গেল।
গার্ড জিগ্যেস করল, ‘এখন কেমন আছ?’
‘আগের চেয়ে অনেক ভালো।’
জাব্বার সঙ্গে লড়াই শেষ হওয়ার পর জিশানকে লেভেল ওয়ান ফিজিক্যাল রিড্রেসাল ইউনিটের এক্সট্রিম কেয়ার সেল-এ রাখা হয়েছিল। সেখানে আধুনিক চিকিৎসার চূড়ান্ত ম্যাজিক দেখেছিল জিশান। মেডিকদের মুখে শুনেছিল, ওর পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছে, বাঁ-পায়ের ঊরুর একটা পেশি মারাত্মক চোট পেয়েছে, ডান হাঁটুর মালাইচাকি সরে গেছে, ডানহাতের তর্জনি আর মধ্যমার হাড়ে চিড় ধরেছে। এসব সমস্যা ছাড়াও সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা আর যন্ত্রণা তো ছিলই!
জিশানকে জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করতে ডাক্তারবাবুদের প্রায় কুড়ি দিন লেগে গেল। যখন ও ফিজিক্যাল রিড্রেসাল ইউনিট থেকে ছাড়া পেল তখনও ওর পাঁজরে আর ডানহাতের আঙুলে স্টিকিং পলিমার ড্রেসিং। এই ড্রেসিং ওয়াটারপ্রুফ—জল লাগলেও কোনও ক্ষতি হয় না।
রিড্রেসাল ইউনিটের বেডে শুয়েই অনেক অভিনন্দন পেয়েছিল জিশান। ডক্টররা, নার্সরা ওকে ‘কনগ্র্যাটস’ জানিয়েছিল—এবং সেটা শুধু জাব্বাকে হারিয়ে জেতার জন্য নয়, জাব্বাকে প্রাণভিক্ষা দেওয়ার জন্যও। রিমিয়াও ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ছোট্ট করে ওকে বলেছিল, ‘জিশান, আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। য়ু ক্যান ডু ইট।’
জিশানের অবাক লেগেছিল। ওর মনে পড়ছিল পিট ফাইটের স্টেডিয়ামের কথা। সেই ভয়ংকর রাতে গ্যালারির মানুষগুলো রক্তের জন্য বীভৎস পিপাসায় গর্জন করছিল, হাত-পা ছুড়ছিল। তখন জিশান বুঝতে পারেনি সেখানে অন্যরকম মানুষও রয়েছে। এখন ও নতুন করে বুঝতে পারছিল বৈচিত্র মানুষের প্রধান ধর্ম। পয়সার অন্য পিঠটা ও অল্প-অল্প দেখতে পাচ্ছিল।
রিড্রেসাল ইউনিট থেকে জিশান যখন গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাস-এ ফিরে এসেছিল তখন পিস ফোর্সের বেশ কয়েকজন গার্ড ওকে দেখামাত্রই ওকে ঘিরে ধরে হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল।
‘ওয়েলকাম, জিশানভাইয়া। ফাইটার নাম্বার ওয়ান।’ একজন অচেনা গার্ড বলেছিল।
তারপরই চেনা দুজন গার্ডকে দেখতে পেয়েছিল জিশান। লম্বা এবং বেঁটে। জিশান আর ফকিরচাঁদকে নেকরোসিটি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া স্নেক লেক কমপিটিশানের আগে বেঁটে গার্ডটি সকলকে লুকিয়ে জিশানকে স্নেক রিপেলান্ট অয়েল দিয়েছিল। সোজা কথায় বলতে গেলে জিশানের প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
বেঁটে গার্ড ওর কাছে এগিয়ে এল। সন্ধের শুরুতেই লোকটার মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। জিশানের বুকে দুটো চাপড় মেরে জড়ানো গলায় বলল, ‘তুমি সত্যিকারের হিরো, জিশান। তুমি ইচ্ছে করলে জাব্বার গর্দানটা মটাস করে ভেঙে দিতে পারতে—কিন্তু দাওনি। তোমার দিল আছে। বুদ্ধিও। তুমি ভালো করেই জানো, জাব্বাকে মেরে এই খতমের খেলা বন্ধ করা যাবে না। তুমি শুধু হিরো না, ভাই, তুমি একেবারে হিরো নাম্বার ওয়ান।’
কথা শেষ করে জিশানকে জড়িয়ে ধরল। ওর বুকের কাছে একটা চুমু খেল। তারপর হাত তুলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে শুরু করল। অন্য গার্ডরা সঙ্গীর এই কাণ্ড হাততালি দিয়ে উপভোগ করতে লাগল।
লম্বা গার্ড কোথা থেকে যেন ছিটকে চলে এল জিশানের সামনে। চাপা গলায় বলল, ‘শাবাশ, জিশান, শাবাশ। তোমার জবাব নেই। তুমি বেঁচে থাকলে সবার ভালো হবে। কিন্তু…।’
জিশান বিষণ্ণ হাসল। সামনে কিল গেম। সুতরাং ওই ‘কিন্তু’টাই আসল কথা।
লম্বা গার্ড চটপট জিশানের কাছ থেকে সরে গিয়ে ওর বেঁটে সঙ্গীর হাত চেপে ধরল: ‘অ্যাই, কী করছিস কী! কেউ দেখে রিপোর্ট করলে কী হবে? চল, চল—শিগগির চল।’
এক ঝটকায় লম্বা বন্ধুর হাত ছাড়িয়ে নিল বেঁটে : ‘কোন সালা রিপোর্ট করবে? কোন সালা?’ টলোমলোভাবে মাথার ওপরে হাত ঘুরিয়ে বলল, ‘এখানে তো শুধু আমরাই আছি, নাকি? কী ভাই, তোমরা কি কেউ ওই শ্রীধরের বাচ্চাকে রিপোর্ট করবে? হ্যাঁ?’
আশ্চর্য! বাকি গার্ডরা এলোমেলো গুঞ্জন তুলে বলল, ‘না, না—কীসের রিপোর্ট! জিশান আমাদের হিরো নাম্বার ওয়ান। শুরু থেকে তো আমরা ওর গেম দেখছি। ও একেবারে লা-জবাব।’
বেঁটে গার্ড উত্তেজিতভাবে লম্বা সঙ্গীর ইউনিফর্ম খামচে ধরল : ‘দেখলি, সবাই কী বলছে! দেখলি!’
সবমিলিয়ে হইহট্টগোল বেড়ে উঠছে দেখে শেষ পর্যন্ত জিশানই সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করতে লাগল। তারপর কথা না বাড়িয়ে ও এগিয়ে গিয়েছিল এলিভেটরের দিকে।
জিশানের অদ্ভুত লাগছিল। এই সাধারণ মানুষগুলো, যারা এখানে স্রেফ দু-পয়সা আয়ের জন্য সিকিওরিটি গার্ডের চাকরি নিয়েছে, জিশানের জেতায় এতটা খুশি হয়েছে! এর একটা কারণ বোধহয় সিন্ডিকেট এবং শ্রীধর পাট্টার প্রতি ওদের ঘৃণা। থমথমে আতঙ্কের নিয়মিত শাসন আর মৃত্যু দেখতে-দেখতে ওদের ভেতর থেকে বমির ভাব উথলে উঠেছে। মুখের ভেতরে যে-থুতু আর জল টের পাচ্ছে তার স্বাদ টক।
নাহাইতলা গ্রামে থাকা গার্ডের কথা মনে পড়ল জিশানের। শান্ত, নরম, ছবির মতো ওর সেই গ্রাম। আর বছরপাঁচেক চাকরি করেই ও গ্রামে ফিরে যাবে। এখানে একটা মুহূর্তও ছেলেটার ভালো লাগছে না।
জিশান ক্রমশই যেন বুঝতে পারছিল, আসলে অনেকেই এখানে ভালো নেই।
জিপিসি-তে ফিরে আসার পর আরও দশদিন জিশানকে ডাক্তারদের নির্দেশ মতো চলতে হয়েছে। ওকে এখন সফট এক্সারসাইজ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে চলছে ফিজিয়োথেরাপি মেশিনের ট্রিটমেন্ট। আর সপ্তাহখানেক পর থেকেই ওর কিল গেম ওয়ার্ম-আপ ট্রেনিং শুরু হবে। তারপর…।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিশান। অবাক হয়ে খেয়াল করল, ওর মধ্যে এখন উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা, আশঙ্কার তেমন কোনও ছায়াপাত নেই। নিউ সিটিতে আসার শুরুর দিকটায় এই আবেগগুলোই জিশানকে শাসন করত। তারপর কয়েকমাস ধরে নানান খেলায় অংশ নিয়ে জীবন-মরণের ওঠা-পড়া দেখতে-দেখতে এইসব আবেগ কবে জমাট বেঁধে বরফ হয়ে গেছে! জিশান এখন অনেক ধীর, স্থির, শান্ত।
এলিভেটরের ভেতরে ঢুকল জিশান। নি:শব্দে দরজা বন্ধ হল।
‘কোথায় যাবে?’ গার্ড জিগ্যেস করল।
‘ছাদে যাব। ঘরের মধ্যে কেমন যেন দম আটকে আসছে।’
‘হবেই তো! এতদিন ধরে ফ্যামিলি ছেড়ে এখানে একা-একা থাকা…।’
‘তুমিও তো এখানে একা-একা আছ—।’
এলিভেটর উঠতে শুরু করেছিল। ডিসপ্লে প্যানেলের দিকে একপলক তাকিয়ে জিশানের দিকে মুখ ফেরাল গার্ড। হেসে বলল, ‘ফারাকটা বুঝতে পারলে না, ভাই! আমি এখানে একা আছি নিজের ইচ্ছেয়—চাকরি করছি, তাই। আর তুমি এখানে আছ শ্রীধর পাট্টার ইচ্ছেয়। মানে, বন্দি।’
মানুষটার এই সহজ ব্যাখ্যায় জিশান বেশ অবাক হয়ে গেল। ও গার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
অন্যান্য গার্ডের তুলনায় এর বয়েস কিছুটা বেশি। সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ হবে। ফরসা সুন্দর চেহারা। তবে মুখে যেন একটা আবছা লড়াইয়ের ছাপ রয়েছে।
গার্ড জিগ্যেস করল, ‘তোমার সামনে তো কিল গেম?’
জিশান কোনও কথা বলল না—শুধু ওপর-নীচে মাথা নাড়াল।
‘তোমাকে সবসময় টিভিতে দেখায়। তোমার গেমগুলো দেখায়—ট্রেনিং দেখায়। নিউ সিটির প্রায় সবাই তোমাকে চিনে গেছে।’
জিশান চুপ করে রইল। গার্ডকে দেখতে লাগল।
‘মনোহর সিং তোমার দোস্ত ছিল?’
সঙ্গে-সঙ্গে জিশানের মনখারাপ হয়ে গেল। বুক ঠেলে একটা শ্বাস বেরিয়ে এল।
গার্ড বলে চলল, ‘হ্যাঁ…তোমাকে আমি টিভিতে কাঁদতে দেখেছি। পিট ফাইটে মনোহর সিং-এর সঙ্গে লড়াইয়ের অ্যানাউন্সমেন্টের সময়। তারপরে মনোহরকে যখন কুকুরগুলো ছিঁড়ে খেল, তখনও।’
জিশানের বুকের ভেতরে কষ্ট হচ্ছিল। মনোহর নামের হাসিখুশি অশিক্ষিত উদার মানুষটার স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর চোখের সামনে।
এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। সামনে বিশাল ছাদ। ভোরের কোমল আলোয় স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। এই স্নিগ্ধ শূন্যতা জিশানকে আরও বিষণ্ণ করে তুলল।
গার্ড বলল, ‘এখানে দশবছর চাকরি হয়ে গেল। অন্য কারও জন্যে কোনও ক্যান্ডিডেটকে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। তোমার ভেতরে এখনও মানুষ আছে, ভাই। কিল গেম-এ তুমি জিতলে আমার খুব ভালো লাগবে।’
জিশান এবার বলল, ‘কিন্তু শুনেছি কিল গেম-এ আগে কেউ জেতেনি—।’
‘ঠিকই শুনেছ।’ আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখাল গার্ড : ‘ওপরের ওই অদৃশ্য লোকটার কাছে অনেকেই তো অসম্ভব উদ্ভট অনেক কিছু চায়। কোনওদিন পাবে না জানে, তবু চায় তো!’ হাসল। অনাবিল হাসি : ‘তো আমিও তাই চাইছি।’ একটু থেমে তারপর : ‘আমি একা নয়—অনেকেই চাইছে তুমি কিল গেম-এ জেতো।’
জিশান হাসল। সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, ‘লড়ব—জান কবুল করে লড়ব।’
গার্ড জিশানের দিকে হাত বাড়াল। জিশানও।
হ্যান্ডশেক করে গার্ড বলল, ‘গুড লাক, জিশান।’
‘থ্যাংক য়ু।’
এলিভেটরের দরজা বন্ধ হল। জিপিসি-র গেস্ট হাউসের ছাদে জিশান একা। ওকে ঘিরে সুবিশাল ভোরের আকাশ।
জিশানের মনে হল, আকাশের এই বিশাল ক্ষমতা আর মমতা ওকে আগলে রেখেছে। কিল গেম-এর আঁচ থেকে আকাশ ওকে বাঁচাবে।
ছাদে দুজন গার্ড পাহারায় ছিল। জিশানকে দেখে ওরা তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এল। ওদের একজন ভুরু উঁচিয়ে ইশারায় জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার?’
জিশান বলল, ‘কিছু না। ঘুম আসছে না। ঘরের ভেতরে ভাল্লাগছে না। তাই ছাদে পায়চারি করতে এলাম।’
‘কী করে ভালো লাগবে! তোমার ওপরে যা ধকল গেছে।’
আর-একজন বলল, ‘তোমার কথা পান্ডা আর মূর্তির কাছে শুনেছি। ওরা তোমার কথা খুব বলছিল।’
জিশানের ভুরু কুঁচকে গেল : ‘কে পান্ডা আর মূর্তি?’
‘ওই যে—বেঁটে আর লম্বু মানিকজোড়। আমাদের মতো সিকিওরিটি গার্ড। বেঁটেটা পান্ডা। আর লম্বুর নাম মূর্তি।’
জিশান চুপ করে রইল।
প্রথমজন বলল, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে তোমার কথা বলাবলি করি। তুমি খুব হিম্মতওয়ালা।’
ওর সঙ্গী নীচু গলায় বলল, ‘তোমার সামনে কিল গেম। তোমাকে হেলপ করা উচিত। যদি মনখারাপ না করো একটা কথা বলব?’
জিশান মনে-মনে মনখারাপ না করার জন্য তৈরি হল। জিগ্যেস করল, ‘কী?’
‘কিল গেম-এর সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.07 বলে সিন্ডিকেট যেটা ঢেঁড়া পিটিয়ে প্রচার করে সেটা ফলস। ওটা আসলে 0.0। কিল গেম-এ, কেউ বাঁচে না। ওই গেম সিটি থেকে কেউ বেঁচে ফিরে আসে না।’
জিশান মলিন হাসল : ‘জানি…।’
‘তোমাকে আমরা যতরকমভাবে পারি হেলপ করব। কারণ, আমরা চাই তুমি জেতো। তবে কী করে জিতবে জানি না।’
জিশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর কিছু সমর্থক আছে জেনে ওর ভালো লাগছে। তবে সেই সমর্থন ওকে কোথাও পৌঁছে দেবে না।
‘না—তোমাকে আর ডিসটার্ব করব না।’ বলে গার্ড দুজন সরে গেল। যার-যার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পজিশন নিল।
জিশান ছাদের কিনারার দিকে হেঁটে গিয়ে পুব আকাশের দিকে তাকাল। ভোরের আলো ফুটে গেছে—এবার সূর্য ফোটার পালা।
রিড্রেসাল ইউনিট থেকে জিপিসি-র গেস্টহাউসে ফেরার দিন গার্ডদের খুশির হইচই জিশানকে অবাক করেছিল। আজও গার্ড তিনজনের প্রতিক্রিয়া ওকে অবাক করল। ওরাও জানে, কিল গেম-এর সারভ্যাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.0। খাঁচার ভেতরে ইঁদুর-বেড়াল খেলা। বেড়ালের হাতে ইঁদুর মরবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ছাদের সাঁইতিরিশ তলার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে নিউ সিটির ‘ছবি’ দেখছিল জিশান। নানান বাড়ির আকাশছোঁয়া কাঠামোগুলোয় অতি-আধুনিক স্থাপত্যের চিহ্ন। জিশানের বারো বছর বয়েসে নিউ সিটি যা ছিল এখন তা নেই। সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানকার নাগরিক জীবনে বহুরকম নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তারই একটা হচ্ছে বিনোদন—পুরুষালি বিনোদন। কে জানে, আগামী আট-দশবছরে সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম ইনভেন্টরসরা হয়তো শুধু মেয়েদের নিয়ে নানান ধরনের রোমাঞ্চকর খেলা আবিষ্কার করবেন। তারপর আসবে পুরুষ এবং মহিলাদের মিশিয়ে আরও নতুন ধরনের গেম-এর পরিকল্পনা। তারপর… তারপর…।
তার পরের ব্যাপারটা ভাবতেই জিশানের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যদি শ্রীধর পাট্টা আর তাঁর গেম ইনভেন্টর সাঙ্গপাঙ্গরা তাঁদের বিকৃত স্যাডিস্ট মনোভাব নিয়ে শিশু আর কিশোরদের জন্য আরও নোংরা চরিত্রের, আরও বেপরোয়া, সব মরণপণ ‘খেলা’ আবিষ্কার করেন? যদি ম্যানিম্যাল রেসে ক্ষুধার্ত ব্লাডহাউন্ডের সঙ্গে কিশোর প্রতিযোগীরা দৌড়য়? যদি অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় ভয়ংকর কোমোডো ড্রাগন? যদি স্নেক লেক কমপিটিশানের কনটেস্ট্যান্ট হয় আট-ন’ বছরের বালক-বালিকার দল?
জিশান আর ভাবতে পারছিল না। ওর বমি পাচ্ছিল। এ কয়েকমাসের অভিজ্ঞতায় ওর মনে হচ্ছিল, এরকমটা হতেই পারে—যদি না কেউ সময়মতো বাধা দেয়।
কিন্তু কখন সেই সময়?
ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে জিশানের মনে হল, ওর বুকের ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিল : ‘এখন! এখন! এখন!’
ততক্ষণে দিগন্তের ক্যানভাসে সূর্য উঠে পড়েছে।
বেশ কয়েকদিন ধরে একটা চিন্তা জিশানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। চিন্তাটাকে অনেকবার তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল ও, কিন্তু চিন্তাটা যায়নি। বারবার ও নিজেকে বোঝাচ্ছিল যে, এটা একটা অবাস্তব আকাঙক্ষা, কিন্তু ওর ছেলেমানুষ মন মানতে চায়নি।
শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে ও পান্ডা আর মূর্তির শরণাপন্ন হল।
ওদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে নিয়েই জিশান গেস্টহাউসের একতলার ফোয়ারার কাছে কয়েকদিন ধরে ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু ওদের দেখা পাচ্ছিল না। কে জানে, হয়তো ওদের জিপিসি থেকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে!
পরপর তিনদিন জিশানের উসখুসুনি দেখে একদিন রাতে একজন গার্ড জিশানকে কাছে ডাকল। জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার বলো তো! ক’দিন ধরে তুমি এখানটায় ঘুরঘুর করছ কেন?’
জিশান ইতস্তত করতে লাগল।
তখন গার্ডটি বলল, ‘আরে ইয়ার, তুমি কিল গেম-এ কোয়ালিফাই করেছ। তোমার জন্যে রুল-টুল আর অত স্ট্রিক্ট নেই। বলো, কী বলবে?’
‘আমি…আমি পান্ডা আর মূর্তির সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। খুব জরুরি ব্যাপার…।’
পিট ফাইটের আগে হলে এই গার্ডই হয়তো জিশানকে পাঁচটা প্রশ্ন করত। কিন্তু এখন কোনও কথা জিগ্যেস করল না। শুধু বলল, ‘কোনও চিন্তা কোরো না। কাল সন্ধেবেলা সাতটা নাগাদ ঘুরতে-ঘুরতে এখানে চলে এসো। পান্ডা আর মূর্তি থাকবে। আমি খবর দিয়ে দেব।’
সেটাই হয়েছিল। পরদিন সন্ধেবেলা সেই দুজন গার্ডের সঙ্গে দেখা হল জিশানের। ওদের একপাশে ডেকে নিয়ে গোপন আকাঙক্ষার কথা বলল জিশান।
শুনে মূর্তি একেবারে আঁতকে উঠল। বলল, ‘কীসব আজেবাজে বকছ! এ কী করে হয়! ধরা পড়লে বা জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হবে। অবশ্য সেই কেলেঙ্কারি দেখার জন্যে আমি বা পান্ডা কেউই আর বেঁচে থাকব না। শ্রীধর পাট্টা আমাদের বটিচচ্চড়ি করে খেয়ে নেবে।’
মূর্তির আতঙ্ক দেখে পান্ডা হাসল। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেশা করা জড়ানো গলায় সঙ্গীকে বলল, ‘ওসব ফালতু কথা ছাড় তো! শ্রীধর পাট্টার চেয়ে আমার কি আই. কিউ. কিছু কম আছে? আমি এমন টেকনিকে কাজ হাসিল করব যে, পাট্টার বাপ-ঠাকুরদাও টের পাবে না।’ জিশানের দিকে ফিরে বলল, ‘কোনও ভয় নেই, জিশানভাইয়া—সব হয়ে যাবে…।’
জিশান চাপা গলায় বলল, ‘আমি দশহাজার টাকা দেব।’
পান্ডা লাল চোখ বড়-বড় করে জিশানের দিকে তাকাল। যেন মঙ্গলগ্রহের প্রাণী দেখছে।
‘টাকা? তোমার কাছ থেকে টাকা নেব?’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আপনমনেই কীসব বিড়বিড় করল পান্ডা। তারপর : ‘যদি নিতেই হয় তা হলে নেব কিল গেম-এর পর। তুমি তখন একশো কোটি টাকার প্রাইজ মানি জিতবে। তার থেকে কিছু আমাদের দিয়ো…এই গরিব ভাই দুটোকে দিয়ো।’
জিশান বুঝল, পান্ডা আসলে কী বলতে চাইছে। ও কিল গেম-এ জিতলে তবে না পান্ডা আর মূর্তিকে টাকা দেবে! আসলে ওরা জিশানকে উইশ করছে।
জিশান কোনও কথা বলল না। মলিনভাবে হাসল। ফোয়ারার জলটাকে হঠাৎই ওর চোখের জল বলে মনে হল। ও চারপাশে তাকাল। রাতের আকাশ দেখল। বাতাসের ঘ্রাণ নিল। গেস্ট হাউসের উঁচুতলার দিকে তাকাল। তারপর পান্ডা আর মূর্তিকে দেখল।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার মুখ খুলল : ‘ছোটবেলায় আমি এই শহরে থাকতাম। তারপর…তারপর…এই শহর ছেড়ে ওল্ড সিটিতে চলে গেছি। বহুবছর এই শহরটাকে দেখিনি। তাই কিল গেম-এর আগে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে…ভীষণ ইচ্ছে করছে। সেইজন্যেই তোমাদের হেলপ চেয়েছি।’
পান্ডা অবাক হয়ে বলল, ‘ও, তাই! তুমি এই শহরে ছিলে! যাকগে, কোনও প্রবলেম নেই। কাল সাড়ে সাতটায় তুমি এখানটায় চলে এসো—আমরা থাকব। তারপর তোমায় গোটা শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব…।’
জিশান ফোয়ারার জলের ধারার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর মনে পড়ছিল মিনির কথা, শানুর কথা। মা-বাবার কথাও। এই শহরটা ছেড়ে যাওয়ার দিনে বাবার চোখের জলের কথা মনে পড়ে গেল জিশানের।
ও পান্ডার হাত চেপে ধরল। ছেলেমানুষের মতো অনুনয় করে বলল, ‘আমার হাতে আর সময় নেই। কিল গেম-এ শেষ হয়ে যাওয়ার আগে শহরটাকে একবার দেখতে চাই।’
পান্ডা চোখ বড়-বড় করে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকাল জিশানের দিকে : ‘কিল গেম-এ শেষ? তুমি?’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল পান্ডা। তারপর হাসি থামলে বলল, ‘জিশানের শেষ নেই।’
জিপিসি-র সিকিওরিটি কন্ট্রোল রুমে জিশানকে নিয়ে এল পান্ডা আর মূর্তি।
এরকম আধুনিক ঝকঝকে কন্ট্রোল রুম ফিউচারিস্টিক সিনেমাতেও দেখা যায় না। চারদিকে শুধু কাচ আর স্টেইনলেস স্টিল। এ ছাড়া ওয়াল মাউন্টেড কম্পিউটার আর অসংখ্য টাচ-স্ক্রিন ডিসপ্লে। বাঁ-দিকের বিশাল দেওয়ালের পুরোটাই একটা গ্রাফিক ডিসপ্লে স্ক্রিন। সেখানে জিপিসি-র নানান মনিটরড জোন দেখা যাচ্ছে। ছবির সঙ্গে-সঙ্গে জোনগুলোর নম্বর আর নাম চোখে পড়ছে। পাঁচ কি ছ’সেকেন্ড পরপর ছবিগুলো পালটে যাচ্ছে—ঠিক যেমন কম্পিউটার কার্ড গেমে তাস পালটে যায়।