Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডবল দক্ষিণা || Sanjib Chattopadhyay

ডবল দক্ষিণা || Sanjib Chattopadhyay

ডবল দক্ষিণা

প্রাণের বন্ধুর বিয়ে। শুধু বরযাত্রী নয়, একেবারে ঘনিষ্ঠ বরযাত্রী। বরের গাড়িতে। বরের পাশে। টোপর কোলে। ফুল-পাতা দিয়ে সাজানো গাড়ি। রজনীগন্ধার প্রেম ছেটানো গন্ধ। এই এক ফুল। গন্ধে প্রেম উসকে দেয়। এক ঝটকায় ব্যাবিলনে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আরব সুন্দরীদের ছুরির ফলার মতো চোখ। যে রূপ দেখলে পুরুষ পাগল হতে বাধ্য।

সাংঘাতিক মাস। ফাগুন। দখিনা বাতাস ছেড়েছে। ডেকে ডেকে কোকিলদের গলা বসে গেল। কোকিলের তবু প্রেম জাগল না। এদিকে আকাশে থালার মতো চাঁদ। দুধের মতো আলোয়। চরাচর ভাসছে। কোন্নগরের একেবারে গঙ্গার ধারে একটা বাগানবাড়ি। গঙ্গার দিকে বিশাল বাগান। যত্নের বাগানে টুপুর-টাপুর আলোর মালা। রাতের স্বপ্নজাল বুনছে। সাবেক কালের বনেদি পরিবার। ধনী পরিবার। গ্যারেজে পালিশ করা ভক্সহল গাড়ি। সুখের দিনের কথা কইছে।

প্যাঁ প্যাঁ করে সানাই বাজছে। ইমনের বিরহী সুরে। মোচড়ে মোচড়ে সখি প্রাণ যায় যায়। তিনতলা বাড়ি। সদ্য রং করা হয়েছে। আগাপাশতলা আলোর ছড় দুলছে। যেন আলোর মিছরি চুরচুর করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গাড়ি ঢোকা মাত্রই পোঁ-পোঁ করে কয়েক জোড়া শাঁখ বেজে উঠল। দরজা খুলে পট করে নামতে যাচ্ছিলুম। বাইরে থেকে ভারী গলায় আদেশ, ‘ওয়েট’। থতমত খেয়ে বন্ধুর মাথায় টোপরটা বসিয়ে বাইরে মেয়েদের দঙ্গল থেকে ভেসে এল—খিক খিক—বন থেকে বেরোবে টিয়ে শোলার টোপর মাথায় দিয়ে। বন্ধু আমার ডান হাতটা চেপে ধরে বললে, ‘ডেনজারাস জায়গা। আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যাবি না। একটা মেয়ে দেখলেই আমার বুক ধড়ফড় করে, এ তো এক দঙ্গল! মনে হচ্ছে পালিয়ে যাই।’

সাহস দেবার জন্য বললুম, ‘ভাবিস না, ভগবান রক্ষা করবেন। মাকে ডাক।’

গাড়ির চাকায় জল ঢালা হল। ভারিক্কি চেহারার দুই মহিলা দরজা খুলে, ‘এসো বাবা, এসো’ বলে বন্ধুর হাত ধরে নামাচ্ছেন। এমন ক্যাবলা, বাঁ-পায়ের নিউকাট পা থেকে খুলে গাড়িতেই রয়ে। গেল। খেয়াল নেই। এমন ঘাবড়ে গেছে। এক পায়ের জুতো পরে মেয়েদের পাল নিয়ে ভেতরে

ঢুকে গেল। এদিকে শাঁখ, ওদিকে সানাইয়ের কপচানি। আমার এক হাতে টোপর, এক হাতে এক পাটি জুতো। কোঁচাটা ধরার জন্যে তৃতীয় একটা হাত নেই বলে মাটিতে ঝুলছে। লুটোচ্ছে। চাকা ধোয়া জলে ভিজে সপসপে।

গাড়ির চালক বললেন, ‘জুতোটা পরে ফেলুন না, ইলিশমাছের মতো ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন? এ তো মন্দির নয়।’

নানা পোশাকের, নানা চেহারার মেয়েদের উৎপাতে পথ করে সামনে এগোনোই এক মহা সমস্যা। কেউ ভারী নিতম্ব মেরে চলে যাচ্ছে। কেউ কনুইয়ে বুক ঠেকিয়ে দিচ্ছে। কারও কোনও হুঁশ নেই। হরেক রকম সেন্ট একসঙ্গে মিশে বাতাস ভারী করে তুলেছে। হঠাৎ হাঁচি পেয়ে গেল। হাঁচি সব সময় কামানের গোলার মতো সামনে যেতে চায়। সামনে তিনখানা তিনরকম খোঁপা। মালা দুলছে। হচিটাকে ছাড়ি কোন দিকে। অনেকক্ষণ চেপে আছি। শেষে ফেটে গেল। কেউ। শুনতে পায়নি। সানাই সপ্তগ্রামে বাজছে। লাউড স্পিকারও নিজের গান গাইছে। নিঃশব্দে দুটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সামনের একটা খোঁপা থেকে মালাটা খুলে একপাশে ঝুলে গেল। আর আমার আন্ডারওয়ারের দড়িটা পটাং করে ছিঁড়ে গেল। অন্তর্বাস ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামছে।

কার্পেট পাতা বেশ বড়সড় ঘর। তিনটে ঝাড়লণ্ঠন। সর্বত্র মালা। সিংহাসনে যুবরাজ। দুটো শালি দখল নিয়ে নিয়েছে। পেছন থেকে ঘাড়ের কাছে কিছু একটা দুষ্টুমি করছে। যুবরাজ মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমাকে দেখেই সব ভুলে চিৎকার করে উঠল, ‘জুতো’।

জুতো আর টোপর দুটোই তুলে দেখালুম। আমার কোঁচাটার অবস্থা নর্দমায় পড়ে যাওয়া বেড়ালের মতো। আন্ডারওয়্যার নেমে গেছে। কাছার দুপাশে মরে যাওয়া পাখির মতো ঝুলছে।

বন্ধু বিকাশের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি মেয়ের মধ্যে একটি আমার দিকে বারে বারে তাকাচ্ছে। চোরা চোখে। চোরা চোখে নয়। চোখে চোখে সংঘর্ষ হলেও চোখ সরাচ্ছি না। আমি কার্পেটে থেবড়ে বসে আছি। চোরা চোখে ওই ধারালো চেরা চোখ দেখলেই কার্পেটে ফুল খুঁজছি। মেয়েটা ইরানি নাকি! ইরানি রক্ত বইছে শরীরে। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার লাইন ভেসে আসছে। মনে।

‘কত বেদুইন পার করে মরু
দীপ্ত অগ্নি ঢালা,
নামায় আমার হৃদয়ের হাটে
তরুণী ইরানী বালা।’

বন্ধুর নাম বিকাশ, আমার নাম বিভাস। আমরা সমবয়সি। বিকাশকে বিবাহবাসরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেন ফাঁসির আসামী। লটরপটর কোঁচা। সেই মেয়েটি ইচ্ছে করে আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আঁচলের ঝাপটায় চুল সব উশকোখুশকো করে দিল। সুন্দর আতরের গন্ধ। ব্যাপারটা কী? এর নামই কি প্রেম কার প্রেম? ছেলেরাই তো মেয়েদের প্রেম-নদীতে পড়ে হাবুডুবু খায়। নদী নদীতে পড়ে নাকি? ইতিমধ্যে আমারও একটু প্রেম-প্রেম পাচ্ছে। চাবুকের মতো মেয়েটা তখন থেকে চাবুক হাঁকড়াচ্ছে।

ভেতরের বিশাল উঠোনে বিরাট বিবাহসভা। ছাঁদনাতলা। ভরা চাঁদের আলোয় উঠোনটা কুলকুল করছে। সব যেন ভেসে যাচ্ছে। চারপাশে উঁচু দালান। দুর্গামণ্ডপ। সার সার চেয়ারে বিশিষ্ট মানুষেরা বসে আছেন। হঠাৎ মনে হল গঙ্গা দেখে আসি।

চাঁদের আলো, ভল ভল বাতাস। উত্তর পশ্চিম কোণে মিষ্টি একটা মন্দির। দেখেই মনে হল শিবমন্দির। তাজমহলের মতো সাদা। চারপাশে উঁচু রক। ঘাসে ঢাকা জমি থেকে পাথর বাঁধানো সিঁড়ি উঠে গেছে গর্ভমন্দিরে। পেছনে গঙ্গা। স্নানঘাট। সিঁড়িতে বসেছি। দু-ধাপ নীচে দিয়ে গঙ্গার জল ছলছল করে বয়ে চলেছে। চাঁদের আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে। বিয়েবাড়ির হট্টগোল। শাঁখ বাজছে। উলু উলু। সানাই ধরেছে বাগেশ্রী।

হঠাৎ পেছন দিক থেকে কে আমার চুল খামচে দিয়ে বললে, ‘ছাগলটা এখানে ভেড়ার মতো একা একা বসে আছে। বিড়ি খাওয়া হচ্ছে?

‘কই না তো?’

‘একটু সরে বোসো।’

সে আমার পাশে ঠেসে বসে পড়ল। গরম-গরম নরম-নরম। শীতের বিছানার মতো। আমার কোলের ওপর একটা হাত ফেলে বললে, ‘কী জড়ো হয়ে আছে এই জায়গাটায়?’

একটু ইতস্তত করে বললুম, ‘দড়ি ছিঁড়ে নেমে এসেছে।’

‘কী নেমে এসেছে?’

‘আন্ডারওয়্যার।’

‘কী হবে এখন?’

‘জানি না।’

‘ও তো খুলে দড়ি পরাতে হবে। ছি-ছি, কী লজ্জা!

‘আমার খুব ভয় করছে। গলা শুকিয়ে আসছে।’

‘কারণ?’

‘কেউ যদি আমাদের এখানে দেখে ফেলে?’

‘গাধা।’

‘কে?’

‘একটাই তো পুরুষ এখানে। সে তুমি। তখন থেকে চোখে চোখে কথা বলছি, বুঝতেই পারছে না। আজ রাতে একটা কাণ্ড হবে।’

‘কী কাণ্ড?

‘লম্বা লগ্ন, তোমাতে-আমাতে বিয়ে হবে। ওঠ, ওঠ।’

‘আমার তিনকুলে কেউ নেই।’

‘আমারও কেউ নেই। এটা আমার মামার বাড়ি।’

বড়মামা খুব হাসিখুশি লোক। জিগ্যেস করলেন, ‘তুই একে বিয়ে করবি এখুনি? এর বাড়ির লোক?

‘কেউ নেই। ও একা আর ওর একটা বাড়ি, আর একটা চাকরি।’

‘ব্যাপারটা খুব জমে যাবে, কী বল?’

‘ইতিহাস হয়ে থাকবে।’

‘তা হলে চল। মালাও আছে, পুরোহিতও আছে।’

আমি বললুম, ‘অনেক কিছুই তো হল না। আইবুড়ো ভাত, গায়ে হলুদ।’

বড়মামা বললেন, ‘বিয়েটাই তো আসল। পাত্রী পছন্দ তো?’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম।

‘আর একটা বিয়ে এখনি। আপনারা নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করুন। আমার একমাত্র ভাগনি সুনয়নার সঙ্গে বিভাসের।’ বড়মামার এই ঘোষণায় আসরের সবাই হইহই করে উঠলেন। বিকাশ বললে, ‘এক টোপরেই ম্যানেজ হয়ে যাবে।’

খুব জোরে জোরে সানাই বাজছে। একই বাড়িতে, একই লগ্নে এক জোড়া বিয়ে। পাশাপাশি দুটো বাসর।

বিকাশ বললে, ‘বিশ্বাস কর, তোকে ছাড়া একা একা কোনওদিন তো কিছু করিনি, তাই খুব খারাপ লাগছিল। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছিল।’

বিকাশের বউ সুতপা বললে, ‘কী করে কী হল?’

সুনয়না বললে, ‘নজরের তির মেরে এই প্রাণীটিকে বধ করেছি।’

সুতপা বললে, ‘বিশ্বাস কর, কেবলই ভাবছিলুম, তোকে ছাড়া আমি থাকব কী করে।’

বিকাশ বললে, ‘আমাদের বাড়ি গায়ে গায়ে। আমার দিদিই ওকে মানুষ করেছে।’

বিয়ে করতে এসেছিল একটা বর, ফিরে চলেছে দুটো বর। টোপর একটা।

দিদি হাঁ হয়ে গেছে কেবল বলছে—’দুটো বউ সামলাব কী করে।‘

পুরোহিত মশাই বললেন—’ডবল দক্ষিণা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *