ট্রেকার্স (Trekkers) : 09
ডক্টর পঞ্চানন ঘোষাল আজ হসপিটাল যাচ্ছেন। রুগির দায়িত্ব কত কাল ফেলে রাখা যায়। স্ত্রী মুকুল রান্নাঘরের দিক থেকে এসে কেমন অবসন্নভাবে দালানে রাখা একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়লেন। একবার তাকালেন ডাক্তার, তারপর মলিন গলায় বললেন, “ভাল থাকার চেষ্টা করো, আমি গেলাম।” আর একটু এগিয়ে গিয়ে বললেন, “পুলিশ তো খুব চেষ্টা করছে।”
“কোনও তো ফল দেখতে পাচ্ছি না, সতেরো দিন হয়ে গেল।”
“ওরা অনেক সূত্র বলেও না, চেপে রাখে। তার থেকেই বোঝা যাচ্ছে হাল ছাড়েনি।”
স্বামী বেরিয়ে গেলে মুকুল তাঁকে বললেন, “আপনি কী বুঝছেন?”
ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “বোঝবার চেষ্টা করছি, আশা হারাবেন না। আচ্ছা মিসেস ঘোষাল, আপনার মেয়েটির ভাবনাচিন্তা, তার অ্যাটিচুড এসব নিয়ে কিছু বলতে পারেন?”
মুকুল চোখে আঁচল চেপে ধরলেন।
ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “অবশ্যই আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা। যদি কষ্ট করে একটু বলতেন, আমার সুবিধে হত। মানে, আপনার মেয়ের ব্যাপারটারই একটা সমাধান করবার চেষ্টা করতে পারতাম।”
“আমার মেয়ে খুব প্র্যাক্টিক্যাল ছিল। আমি যতদূর জানি, ঠান্ডা মাথার মেয়ে। জীবনটাকে সহজভাবে নেয়। একটা কেরিয়ার করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা ছিল ওর প্রথম লক্ষ্য। বাবা-মা’র সঙ্গে ওর সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ।”
“কিন্তু এভাবে আপনাদের কিছু না বলে ওর কোথাও যাওয়াটা…”
“সেটাই তো আমাদের ভাবাচ্ছে, এ পর্যন্ত কখনও এরকম করেনি। হাতে সেলফোন রয়েছে, না বলার কী আছে? যা যুগ পড়েছে কেউ তুলে নিয়ে গেল কিনা…” বলতে বলতে ভদ্রমহিলা শিউরে উঠলেন।
“তা হলে আপনার ধারণা, মেয়ে আপনাদের না বলে কিছু করতে পারে না।”
“সেটা আমাদের ধারণা। আমরা তো ওর থেকে অনেকটাই বড়, আমাদের শেষ বয়সের সন্তান। জানি না, ওর এখন যে বয়স, ও কতটা বদলেছে। আমরা এটা মেনে নিতে পারছি না।”
ধ্রুবজ্যোতি ভাবলেন, শেষ যে ঘটনাটা বাবাইয়ের জীবনে ঘটেছে সেটাও সে মা-বাবাকে বলেনি। তার মানে ওর কোনও-কোনও লজ্জা বা অপমানের জায়গা আছে সেগুলো ও বাবা-মাকে জানাতে চায় না। কারণ কী? লজ্জা, ভয়? হয়তো বাবা-মা আর তার শহরে হস্টেলে থাকা অনুমোদন করবেন না। এ-ও হতে পারে বাবাই এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। নিজেই ব্যাপারটা হ্যান্ড্ল করতে চায়। কিন্তু একজনকে ও বলেছে, সে হল উজ্জ্বল। উজ্জ্বলের কাছে ওর লজ্জা নেই, ভরসা আছে প্রচুর।
বাবাইয়ের এসব ভাবার অবস্থা ছিল না। সে এবং দিয়া দু’জনেই শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর ছিল। উপরন্তু দিয়ার শক ফিভার। নার্স নির্মলাদি আর রান্নার বাসুদি তাদের দেখাশোনা করছিলেন। নির্মলাদি সবটাই জানেন, কিন্তু বাসুদি অতশত জানে না। তার ধারণা, একটা জোরালো দুর্ঘটনা থেকে ভাগ্যের জোরে বেঁচে গিয়েছে তারা। দু’জনকে খাবার দিতে আসে আর বাবাইকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট হল বাবুই?”
বাবাই কী বলবে, সে বলে, “সে অনেক দূরে। তুমি চিনবে না বাসুদি।” বাবাইকে ভীষণ পছন্দ হয়ে গিয়েছে বাসুদির। মেয়েটা দিয়ার মতো গোমড়ামুখো নয়। কথা বলে, তার রান্নার প্রশংসা করে এবং দিয়ার খুব খেয়াল রাখে। এরই মধ্যে একদিন কী করে কে জানে, দিয়া বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিল। সকালে ঘুম আর ভাঙেই না, ভাঙেই না। বাবাইয়ের হঠাৎ কী মনে হল নির্মলাদিকে বলল, “দেখুন তো দিদি, ট্যাবলেটগুলো সব আছে কি না।” ট্যাবলেট দেখতে গিয়েই বোঝা গেল, ছ’-সাতটা ছিল, সব খেয়ে নিয়েছে দিয়া।
নির্মলাদি বললেন, “আরও কিছুক্ষণ ঘুমোবে ও, হয়তো বিকেলের দিকে উঠবে। স্টম্যাক ওয়াশ করার দরকার হবে না। তবু একবার ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করি।” ডক্টর সেন এসে স্টম্যাক ওয়াশ করলেন সঙ্গে-সঙ্গে। কোনও ওষুধই আর দিয়ার পাশের টেবিলে রাখা হল না। কেরোসিন, পেস্ট কিলিং সলিউশন সবই লুকিয়ে ফেলা হল।
বাবাই সেরে উঠছিল তাড়াতাড়ি। ‘আমি ধর্ষিত হয়েছি, কী লজ্জা। ইস্স আমি সমাজের বাইরের হয়ে গেলাম’, এই রকম কোনও চিন্তা বা আত্মগ্লানি তার একেবারেই হয়নি। বিশেষত অজ্ঞান অবস্থায় ঘটনাটা ঘটেছে বলে কোনও অনুভূতি নেই তার। কিন্তু কেউ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাকে বোকা বানিয়েছে এবং সে বা তারা তারই কাছাকাছি বয়সের ছেলে, এই ধাক্কাটা সে কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। সে স্বভাবে রাগী নয়, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল এই অপমানের উপযুক্ত জবাব যদি সে দিতে না পারে, তার নাম বাবাই নয়। স্থির সংকল্প একটা। দাউদাউ রাগ নয়।
একটু সেরে উঠতেই সে যখন হস্টেলে ফিরতে চাইল, ডক্টর সেন এবং বাসুদি উভয়েই তাকে অনুরোধ করলেন দিয়ার মা ফিরে না আসা পর্যন্ত থেকে যেতে। দিয়ার কখন কী মতি হয়, কেউই ভরসা পাচ্ছেন না।
আজই ডাক্তার দেখে গিয়েছেন। নাইট নার্স এখন কেউ থাকছে না। খাওয়াদাওয়ার পর রাতে বারান্দায় বসে দু’জন।
“তুই হঠাৎ অতগুলো বড়ি খেয়ে ফেললি কী করে?” বাবাই আস্তে-আস্তে জিজ্ঞেস করল।
দিয়া বলল, “আরও থাকলে আরও খেতাম।”
“আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয় দিয়া।”
“সমাধান নয়? আস্তে-আস্তে অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যাবে, বাঁচা যাবে।”
“আমি শুনেছি, অস্তিত্ব বিলোপ হয় না। অতৃপ্ত আধখানা অস্তিত্ব আরও ভয়ানক কষ্ট পায়।”
“কে বলল, বিজ্ঞান তো নয়?”
“বিজ্ঞান তো এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। সেক্ষেত্রে চিরকাল যাঁরা আত্মা আর পুনর্জন্মের কথা বলে এসেছেন, তাঁদের অবিশ্বাস করি কী করে? আর তা ছাড়া তুই আত্মহত্যা করবিই বা কেন, জঘন্য একটা অপরাধের শিকার হয়েছিস তুই, তাই তোকেই শাস্তি পেতে হবে? এ তো ভারী অদ্ভুত রিজনিং!”
“কে বলল তোকে ওই কারণে আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছি?” দিয়া উদাস গলায় বলল।
“ওই কারণে নয়, তবে?” অকৃত্রিম বিস্ময় বাবাইয়ের গলায়।
“আমি কে বল, কে আমি? একটা একলা প্রাণ যাকে কেউ ভালবাসেনি। বাবা না, মা না। বন্ধু বলে কিছু নেই, সবাই আমায় ভুল বোঝে। তা ছাড়া সত্যিই বলছি সবাই এত শ্যালো যে, আমার মিশতে ভাল লাগে না। তারপরে দেখ কেউ অর্থাৎ কোনও যুবক যদি আমাকে ভালবাসত, সে আমার সঙ্গে আলাপ করে আস্তে-আস্তে একটা অন্তরঙ্গতায় পৌঁছোতে চাইত। তা কেউ করল না। দিয়াটা একটা ফালতু, একটা ক্র্যাঙ্ক, ওর শরীরটাকে নিয়ে একটু মজা করা যাক, বোকা বানানো যাক, এই তো সেদিনের ঘটনার সাইকোলজি। তুই-ই বল, আই অ্যাম এক্সপেন্ডেবল। তাই আমাকে ড্রিঙ্কের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে ছিঁড়েফুঁড়ে অপমান করা যায়, আর চূড়ান্ত অবহেলায় একটা ভুতুড়ে বাড়িতে এঁটোকাঁটার মাঝখানে ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায়! নো বডি কেয়ার্স ফর মি।”
বাবাই আস্তে-আস্তে বলল, “আমাকেও তো তাই-ই করেছে।”
“সেটাই তো আমার আশ্চর্য লাগছে,” দিয়া বলল, “ইউ আর লাভ্ড বাই সো মেনি পিপল। তোর বাবা-মা, দিদি, বন্ধুরা, উজ্জ্বল, তা ছাড়া তুই একেবারেই আমার মতো লোনার নোস। যথেষ্ট সোশ্যালাইজ করিস। সবচেয়ে বড় কথা, তোর কিন্তু খুব কনসপিকুয়াস একটা পার্সনালিটি আছে। আমি তো আগে ভাবতাম, বাপ্ রে এই মেয়েটা অ্যাথলিট, চ্যাম্পিয়ন নিজের জেলায়। তারপরে আবার ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়েছে, চলাফেরায় কী কনফিডেন্স। কাউকেই কেয়ার করে না। আমার সঙ্গে তো কোনওদিনও বন্ধুত্ব করবে না। অথচ সামহাউ আমার তোকে ভাল লাগত। তোর সঙ্গে ভাব করতে ইচ্ছে করত।”
বাবাই একটু অবাক হয়ে তাকায়। এটা যদি সত্যি কথা হয়, তা হলে সে এটা কোনওদিন আন্দাজ করতে পারেনি। সে যেটা অনুভব করে, বেশ একটা শ্রেণি-সচেতনতা, এমনকী বৈষম্য আছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও। মফস্সলের ছাত্রী বলে একটা ঠোঁট বাঁকানো আছে। ভাগ্যে সে ইংলিশ মিডিয়মে পড়েছে, তা নয়তো সেখানেও একটা ঠোঁট বাঁকানো খেত। এরপর টাকাপয়সার প্রশ্ন। সে হ্যারিসন রোডের যাচ্ছেতাই হস্টেলে না থেকে গোলপার্কের পাঁচমিশালি কিন্তু অনেক ভাল বন্দোবস্তের হস্টেলে থাকছে। তার বাবা ডাক্তার, সুতরাং সে মফস্সল হলেও উচ্চ-ঘেঁষে মধ্যবিত্ত অন্তত। এরপর আছে কী সূত্রে টাকা! সে আবার আর একটা ক্লাস। মফস্সলি ডাক্তার না হয়ে সে যদি আইটি প্রফেশনাল বা বিজনেসম্যানের মেয়ে হত, আর একটু উপরের স্তরে উঠতে পারত। দিয়া সেই স্তরের। দিয়াকে বরাবর একটু নাক উঁচু মনে হয়েছে তার। চারপাশে কাউকে যেন লক্ষই করে না। হাওয়া দিয়ে হাঁটছে। এখন দেখা যাচ্ছে, দিয়া সেরকম নয়। এবং দিয়া তাকে যা ভেবেছে, সে-ও মোটেই তা নয়। অদ্ভুত তো! ফার্স্ট ইম্প্রেশন নিয়ে এত যে বড়-বড় কথা, মিলল না তা হলে। সে দিয়ার ভুল ভাঙাবার চেষ্টা করল না। নিজের ইম্প্রেশনের কথাও বলল না। বলল, “দিয়া, আই লভ ইউ।”
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর দিয়া বলল, “আই ডোন্ট বিলিভ ইউ, সরি বাবাই।”
“কেন?”
“নিশ্চয় ডাক্তার আঙ্কল তোকে এরকম বলতে শিখিয়ে দিয়েছেন।”
“একথা তোর মনে হচ্ছে কেন, আশ্চর্য তো! ডাক্তার আঙ্কল শিখিয়ে দেবেন তোকে ‘লাভ ইউ’ বলতে, আর অত বড় কথাটা যেটা কাউকে কখনও বলিনি, সেটা আমি তোকে বলে ফেলব?”
“কেন উজ্জ্বল, উজ্জ্বলকেও বলিসনি?”
“উজ্জ্বল? তুই ভুল করেছিস দিয়া। উজ্জ্বল আমার বয়-ফ্রেন্ড নয়, ও আমার বন্ধু। আমরা দু’জনেই এক অঞ্চলের। দু’জনেই খেলাধুলো করতাম। সেই থেকে একটা জানাশোনা হয়ে গিয়েছে। এখানে যখন বিপদে পড়লাম, ওর কথাই আমার সর্বাগ্রে মনে পড়ল। কেননা ও আমার অনেক আগের, আমার বাড়ির চেনা, যে কাছাকাছি আছে।”
“তা বেশ তো…বয়ফ্রেন্ড হতেই বা ক্ষতি কী?”
“ক্ষতি কিছু নেই, কিন্তু নয়। একেবারেই না। কতকটা পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতো আমরা।”
“পিঠোপিঠি ভাইবোন! কী অদ্ভুত ফ্রেজটা। কতদিন পর ব্যবহার হতে শুনলাম। ইস্স আমার যদি একটা পিঠোপিঠি থাকত, ভাইবোন যা হোক! থাকত, থাকত! কিন্তু আমার মা-বাবা তাকে নষ্ট করে ফেলেছে,” দম আটকান গলায় সে বলল, “ভাবতে পারিস বাবাই, ফাইভ মান্থস গন, মাই মাদার ওয়াজ ফোর্সড টু অ্যাবর্ট হিম।
“হিম? লোকে তো মেল ভ্রূণ অ্যাবর্ট করে না।”
“দে নেভার টোল্ড মি। কিন্তু আমি জানি, ওটা মেল ছিল।”
“মা-বাবা তখনও এত উপরে ওঠেনি। দারুণ কম্পিটিশন। মা তো সবে প্রোগ্রামার, বাবা বলল, ‘উই ডোন্ট হ্যাভ টাইম টু রেজ অ্যানাদার চাইল্ড নাও।’ আর মায়ের অ্যাপেনডিসাইটিস হয়েছিল। তখন ডাক্তারের সঙ্গে যোগসাজস করে ব্যাপারটা মায়ের অজান্তে করে ফেলেছিল বাবা।”
“ও রকম করা যায়?”
“স্বামীদের সবরকম রাইট আছে বাবাই। সেই থেকে মা ক্রমশ কোল্ড হয়ে গেল বাবার প্রতি, পুরুষ জাতটার প্রতি, আমি একটু বড় হওয়া অবধি অপেক্ষা করেছে। তারপর দু’জনে মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে নিয়েছে। মাঝখান থেকে আমাকে নিয়ে টানাটানি। দেখ, আমার ভাইটাকে আসতে দিল না বলে বা মাকে না জানিয়ে চোট্টার মতো অ্যাবরশন করাল বলে বাবার ওপর আমার রাগ হতেই পারে। কিন্তু সমস্তটাই তো ঘটেছে আমার অজ্ঞাতে। আমি তো বাবার প্রতি কোল্ড হয়ে যেতে পারি না। আমার ইচ্ছে করে দু’জনকে নিয়ে একটা নর্মাল ফ্যামিলিতে থাকতে। কিন্তু ওরা থাকতে পারবে না। বাবা আবার এখন ইংল্যান্ডে পোস্টেড কিছুদিনের জন্যে। আমাকে মোটা টাকা হাতখরচ দেয়। বোঝে না টাকা আমার আছে। আমার চাওয়ার জিনিসটা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। মা-ও এখন কাজে ইংল্যান্ডেই গিয়েছে। দেখ, আমার বিপদের সময়ে কেউ রইল না। ওটা যদি আরও মারাত্মক কিছু হত? একটা অনাথ মেয়ের মতো আমি বেপাত্তা বা খুন হয়ে যেতাম?”
বাবাই বলল, “আমার তো বাবা-মা সবাই আছে, তা-ও আমারও একই দশা হয়ে যেতে পারত। ভাইবোন না থাকা বা বাবা-মা’র অমিলের ওপর এসব নির্ভর করে নাকি? আমি জীবনে আর এদের বিশ্বাস করতে পারব না দিয়া। ঈপ্সার সঙ্গেও আমার কিছু দরকারি কথা আছে।”
শেষের দিকে তার কথাগুলো খুব গম্ভীর, কঠোর হয়ে গেল। রাত বাড়ছে। দিয়ার শুতে যাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। বাবাই বলল, “দিয়া, আর নয়। এবার চল শুয়ে পড়ি।”
দিয়া হঠাৎ বলল, “একটা কথা বলব বাবাই, আমার খাটটা তো বেশ বড়, তুই আমার পাশে শো না রে, গল্প করতে করতে ঘুমোই।”
“বেশ তো,” বাবাই বলল বটে কিন্তু তার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল।
ভোর রাতে একবার বাবাইয়ের ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখল, দিয়া শুয়ে আছে প্রায় গোল হয়ে। বুড়ো আঙুলটা মুখের মধ্যে। মাথাটা বাবাইয়ের কোলের মধ্যে ঢুকে এসেছে। নাকের পাশে শুকিয়ে যাওয়া জলের চিহ্ন। কখন কেঁদেছে দিয়া? সুখে কেঁদেছে না দুঃখে? কী ভীষণ অসহায়, করুণ মুখটা। আর সে নাকি একেই ভাবত গুমুরে!
বাকি রাতটুকু বাবাইয়ের ঘুম হল না আর। থেকে থেকেই মা-বাবার মুখ মনে পড়তে লাগল। সে মোটের উপর নিয়মিত মা-বাবাকে ফোন করে গিয়েছে। তার ওপর দিয়ে কী গিয়েছে না গিয়েছে, বিন্দুমাত্র বুঝতে দেয়নি। কত আলাদা। সত্যিই, এই এক জায়গায় তারা পড়তে এসেছে, অথচ প্রত্যেকেই যেন একটা দ্বীপ। ফার্স্ট ইমপ্রেশন কিছু বুঝতে দেয় না। সে দিয়াকে বুঝতে পারেনি, দিয়া তাকে বুঝতে পারেনি। সে ঈপ্সাকে বুঝতে পারেনি। অথচ এই ঈপ্সাই সবচেয়ে বেশি কথা বলে তার সঙ্গে। পিএনপিসিও বাদ যায় না। তার যে ঈপ্সাকে খুব পছন্দ, তা নয়। কিন্তু সে যখন যেচে-যেচে এসে আলাপ করে, অত কথা বিশ্বাস করে বলে, তখন…অগত্যা। আর কে-কে গিয়েছিল তার চেনাজানার মধ্যে? শুকতারা, শুকতারার সঙ্গে তার আগেও অনেকবার মোলাকাত হয়েছে। ও নিজেও স্পোর্টস ভালবাসে, টেনিস খেলে। শুকতারার সঙ্গে টেনিস খেলেছে সে, ওদের বাড়ির কোর্টে। খারাপ না। কিন্তু খুব সীমাবদ্ধ আলাপ। বড্ড ধনী এবং বড্ড লাউড। আরিয়ান গিয়েছিল। আরিয়ানের সঙ্গেও শুকতারার বাড়িতে আলাপ, উজ্জ্বলও ওকে চেনে বন্ধুর মাধ্যমে। ও-ও প্রচুর লাউড। জামাকাপড় নিয়ে ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের, বিশেষত ছেলেদের তার একটুও পছন্দ হয় না। তার নিজের এক ক্লাস সিনিয়র রয়েছে। রূপরাজ আর রিনা, দু’জনেই বেশ। তা হলে বদমাশটা কে, বা কারা? আরও রাশি-রাশি ছেলে আসছিল, যাচ্ছিল। ভীষণ সব কায়দাবাজ ছেলে। কী কাপুরুষ! ছিঃ। অপমানটা সে কিছুতেই হজম করতে পারছে না। দিয়ার কী ধারণা, জিজ্ঞেস করলে হয়। ওর নিশ্চয় আরও অনেক মক্কেলের সঙ্গে জানাশোনা আছে, কিন্তু সাহস হয় না। দিয়া কেমন ভঙ্গুর ধরনের মেয়ে। যদি কোনও খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়!
সকাল দশটা নাগাত এক প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট পরা লম্বা ভদ্রমহিলা তাদের ঘরে নক করলেন, “আসতে পারি?”
দরজা খোলা, পর্দাটা শুধু টানা রয়েছে। তা-ও, বাব্বাঃ! সাদা রং, উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ভোরের আলোর মতো। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। গোটা চেহারাটাই খুব উজ্জ্বল, যেন বিদেশি-বিদেশি। অনেকদিন বিলেত-আমেরিকায় থাকলে যেমন হয়। দিয়ার সঙ্গে খুব মিল। অথচ এফেক্টটা একেবারে আলাদা। ইনি ঘরে ঢুকলেন, যেন আত্মবিশ্বাস স্বয়ং হেঁটে-হেঁটে এল। অনেক ভার বইতে পারেন। এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবেন, এইরকম একটা ভরসাও হয়। করবেন কিনা, সেটা কিন্তু এঁর মর্জির ওপর নির্ভর করছে। বাবাইয়ের সবে চান হয়েছে, সে একটা টেক্সট নিয়ে মন বসাবার চেষ্টা করছিল। দিয়া চানঘরে।
ঢুকেই উনি খানিকটা গোঁত্তা খেলেন, “তুমি? ও সরি, দিয়ার বন্ধু, না? ডক্টর সেন আমাকে বলেছেন তোমার কথা। সরি আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কী নাম তোমার?”
“বিভাবরী। সবাই বাবাই বলে ডাকে।”
“হোয়ট আ নাইস নেম। বিভাবরী, নাইটস। শর্ট করে যে ওকে বিভা বা বিভু করা হয়নি, দ্যাটস আ গ্রেট ফেস সেভার। বাবাই ইজ ওয়ান্ডারফুল। বাবাই, কী অ্যাক্সিডেন্ট তোমাদের হয়েছিল?”
“ডাক্তার আঙ্কল আপনাকে বলেননি?”
“না। শুধু বললেন, হি উইল বি এবল টু হ্যান্ডল ইট। বাইক চালাও তুমি, না? দু’জনেই পড়েছ তো?”
বাবাই ওঁর দিকে তাকিয়ে আস্তে-আস্তে বলল, “উই হ্যাভ বিন রেপড।”
ভদ্রমহিলা চোখ বড়-বড় করে বাবাইয়ের পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তারপর বললেন, “মাই গড। এটাকে মাইনর অ্যাক্সিডেন্ট বলে চালাচ্ছিলেন ডাক্তার। হাউ ডিড ইট হ্যাপন?”
বাবাই সংক্ষেপে বলল।
“গড! দিস ইজ ক্রাইম, কেউ স্টেপ নিল না? ইউ শুড হ্যাভ গন স্ট্রেট টু দ্য পোলিস।”
“আমাদের তখন সে অবস্থা ছিল না মাসি। আমার একমাত্র চেনা বন্ধুকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। ও-ও তাই-ই বলছিল। কিন্তু দিয়া বা আমি কেউই চাইনি, আমাদের স্বাভাবিক জীবন হ্যাম্পার্ড হোক। ডাক্তার আঙ্কলও তাই বললেন। বিশেষত দিয়া, দিয়ার কথা ভেবে…”
“দিদ্দিয়া কি…” ভদ্রমহিলা কথা শেষ করতে পারলেন না।
সেই মুহূর্তে দিয়া চানঘর থেকে বেরোল একটা বাথরোব গলিয়ে। এবং নিমেষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের উপর, “মা ম্মা, ওম্মা, মা-ম্মা-ম্মা।” উনিও ওকে চুমু খাচ্ছেন, শান্ত করার চেষ্টা করছেন, চোখে জল।
দিয়া মা-মা করছে আর ছোট-ছোট দুর্বল মুঠি দুটো নিয়ে ঘুঁষি মারছে মায়ের বুকে।
“আমি চেঞ্জ করে আসি দিউ?”
“ন্ না!”
“সে কী? এক্ষুনি চান করেই এসে যাচ্ছি।”
“আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। আমি বাবাইকেও কোথাও যেতে দেব না।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে, বাবাই, তুমি কোথায় থাকো?”
বাবাই বলল, “আমি গোলপার্কে একটা হস্টেলে থাকি, রানাঘাটে বাড়ি।”
“বলো কী? তোমারও বাবা-মা এখানে নেই, ওঁদের জানিয়েছ তো?”
“নাহ্। শুধু-শুধু ভাবিয়ে তো কোনও লাভ নেই। আপনি এসে গিয়েছেন। এবার আমি হস্টেলে ফিরে যাব।”
“না না,” দিয়া বলল, “মা যদি প্রতিজ্ঞা করে রোজ রাত ন’টার মধ্যে ফিরে আসবে, মাসে একটার বেশি ট্যুর নেবে না, তা-ও দু’-তিন দিনের, মা যদি প্রতিজ্ঞা করে ব্রেকফাস্ট-ডিনার আমরা একসঙ্গে খাব, তা হলে…না, তা হলেও বাবাইকে এখানে থাকতে হবে। ইফ বাবাই কেয়ার্স ফর মি।”
দিয়ার মুখ তার মায়ের বুকের মধ্যে, উনি দিয়ার চেয়েও লম্বা। দিয়ার মা বাবাইয়ের দিকে চেয়ে একটা মিনতির ভঙ্গি করলেন। তারপর বললেন, “ইটস অবভিয়াস দ্যাট বাবাই কেয়ার্স ফর ইউ। বাজে কথা বলো কেন দিউ? ও তো থাকবেই।”
দিয়া মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “লেট বাবাই সে ইট, তুমি কেন ওর হয়ে কথা বলছ?”
বাবাই বলল, “দিয়া, কী ছেলেমানুষি হচ্ছে? মোটেই আমি বলব না, মাসিকে যেতে দে।”
দিয়া এবার মাকে ছেড়ে দিল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “কতদিন তোমাকে দেখিনি মা! মনে হচ্ছে এক জন্ম পরে দেখলাম। বাপি কবে ফিরছে?
“কী জানি, বোধহয় আরও মাস ছয়েক।”
“তোমরা মিট করোনি?”
“হ্যাঁ, একদিন করলাম তো। স্প্যানিশ খেলাম সোহোতে বারাফিনায়। তোমাকে খুব মিস করছে!”
একটা নিশ্বাস ফেলল দিয়া, “যাও, আমরা কিন্তু একসঙ্গে খাব।” বলেটলে দিয়া একটা মস্ত টেডিবেয়ার তুলে নিল নিচু ক্যাবিনেটের ওপর থেকে। তারপর একটা সোফায় সেটা বুকে জড়িয়ে বসে বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে দিল।
বাবাই তার বইয়ে মন দেবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এই টেডিবেয়ার কোলে, মুখে আঙুল দিয়া তাকে ভাবাচ্ছে। এটা কি নতুন? না আগেও ছিল? যতই দিয়া চাক, ওদের বাড়িতে সে কতদিন থাকবে? বাড়িতে তো শুধু দিয়া নেই, তার মা-ও রয়েছেন। অতিরিক্ত আলট্রা মডার্ন, হাই-ক্লাস, আত্মসচেতন মা। তিনি কী মনে করবেন? দিয়ার আবদারে রাজি হচ্ছেন, কিন্তু মনে-মনে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না। বা করবেন না। এভাবে কারও বাড়ি থেকে যাওয়া! না, বাবাই কিছুতেই মানতে পারছে না।
দিয়া আবার ঘুমিয়ে পড়েছে সোফার মধ্যে ওইরকম কুণ্ডলী পাকিয়েই। মুখ থেকে বুড়ো আঙুলটা একটু খসে গিয়েছে। সোনালি টেডিবেয়ার বুকের ভেতর আটকানো। ঘুমোলে এমনিতেই মানুষকে ভীষণ ছেলেমানুষ দেখায়। এখন ওই টেডিবেয়ার আর মুখে আঙুলের দৌলতে তাকে দেখাচ্ছে শিশুর মতো। ওর ভিতরে কোথাও একটা অস্বাভাবিকতা থেকে গিয়েছে। যেন পুরোপুরি বড় হয়নি। অথচ ভাবনা-চিন্তা, বুদ্ধি ইত্যাদিতে কোনও গোলমাল নেই। তবু তো ওর বাবা-মা’র মধ্যে বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্কই মনে হল। ঝগড়াঝাঁটি, অসভ্যতা, চিৎকার, মারামারি যেসব জিনিস বিবাহবিচ্ছেদের সঙ্গে বিশ্রীভাবে লেগে থাকে, সেসব নেই। উপরন্তু বাবা-মা দু’জনেই তাকে কত ভালবাসে।
উজ্জ্বলের সঙ্গে মিস সোনা ঘোষালের দেখা হল রবিবার, সকালবেলা। উনি ওকে ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন করেছিলেন, সেটা গড়াল লাঞ্চ অবধি।
দিয়া বলে, “বাবাই তো বটেই, উজ্জ্বল না থাকলে পরদিন আরও বিপদ হতে পারত। এবং এ ক’দিন তো যা কিছু দরকার সব উজ্জ্বল করেছে। মা, তুমি ওকে ডাকো, খাওয়াও, আলাপ করো, প্লিজ।”
সোনা নিভৃতে বাবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এই উজ্জ্বল ছেলেটি কেমন? তোমার সঙ্গে কি খুব আলাপ, ভাল করে জানো ওকে?”
ভাল করে কাকেই বা জানা যায়, বাবাই মনে-মনে হাসল। সে আর কারও সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না যে, সে ভাল। ভাল কথাটার মানেই তো নানা রকম। কী হিসেবে ভাল? ভাল পরিবারের ছেলে, লেখাপড়ায় ভাল, স্বভাব-চরিত্রে ভাল, স্পর্ধায়, সাহসে ভাল? সোনা সম্ভবত সবগুলোই জানতে চাইছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দিয়া কার-কার সঙ্গে মিশছে খুঁটিনাটি তাঁর জানা দরকার। বাবাই যেহেতু হাতের কাছে, তিনি তার সম্পর্কে অনেক কিছুই কথাচ্ছলে জেনে নিয়েছেন। চোখের সামনে দেখছেন, কথাবার্তা বলছেন, তিনি হয়তো তার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত। হয়তো স্বাভাবিকই। তবু বাবাইয়ের কোথায় একটা লাগে। উজ্জ্বল মোটেই খুব বিনয়ী, নম্র ছেলে নয়। সে যদি টের পায়, সমাদর জানানোর সঙ্গে-সঙ্গে তাকে যাচাই করা হচ্ছে, এমন একটা ট্যারাব্যাঁকা কিছু করে বসবে, সোনামাসি বরদাস্ত করতে পারবেন না। সে কি উজ্জ্বলকে সাবধান করে দেবে? নাঃ, অনেক ভেবে সে ঠিক করে, না।
মুখে সে বলে, “মাসি, আমার সঙ্গে খেলাধুলোর সূত্রে আলাপ। এখানে ধরুন আমরা দু’জন প্রায় একই পাড়ার লোক। ও নো-ননসেন্স টাইপের ছেলে। যেটা করা উচিত মনে করে, করবেই।”
হঠাৎ সোনা বললেন, “অনেক-অনেক দিন পর কেউ আমায় মাসি বলল। এত ভাল লাগবে, আমি বুঝিনি। আজকাল সবাই একাধার থেকে আন্টি, আন্টি, আন্টি। কান ঝালাপালা হয়ে যায়। এই দিউর বন্ধুগুলো সব যেন হুক্কা হুয়া শেয়াল ডাকছে। বলে না, সব শেয়ালের এক রা!”
উজ্জ্বল এল সাড়ে ন’টা নাগাদ। একটা অফ-হোয়াইট স্পঞ্জি-স্পঞ্জি মতো কলার-অলা টি-শার্ট আর খাকি জিন্স পরে। খুব একটা নাটকীয় এফেক্ট হল উজ্জ্বলের আবির্ভাবে। সোনামাসি ওর সম্পর্কে আগাম কিছু জানতেন না বোধহয়। বাবাই তো বলেইনি। বোঝা যাচ্ছে, দিয়াও বলেনি। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি, অত্যন্ত সুঠাম, শক্তিমান ছেলেটিকে দেখে কেন কে জানে সোনা ঘোষাল একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
“তুমি-ই উজ্জ্বল?” ওরা কিছু বলবার আগেই একেবারে সমস্ত নিয়ম ভেঙে উনি বলে উঠলেন।
উত্তরে পাপোশে পা ঘষে উজ্জ্বল ঢুকতে-ঢুকতে বলল, “আমার কি অন্য কেউ হওয়া উচিত ছিল?” তার মুখে মৃদু হাসি।
“না, মানে তুমি তো ব্যায়ামবীর দেখছি। সেই সিক্স প্যাক অ্যাবস না কি আজকাল উঠেছে?”
উজ্জ্বল নমস্কার করল, “গাঁয়ের ছেলে, শরীরটাকেও যদি শক্ত করতে না পারি, বাঁচতে পারব?”
সোনা বললেন, “আমি দেখি কত দূর কী করল। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে ডাকব,” তিনি যেন এক রকম পালিয়ে গেলেন।
দিয়া সোফায় দু’বার বসে-বসে নেচে নিয়ে বললে, “উজ্জ্বল তুই যে এত হ্যান্ডসাম, মা এক্সপেক্টটই করেনি। হি হি হি হি। আচ্ছা সারপ্রাইজ বল বাবাই!”
উজ্জ্বল বলল, “হ্যান্ডসাম বলছিস! তা হলে এঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে মডেলিংয়ে চান্স নেওয়া যায়?”
বাবাই বলল, “তা কেন, দুটোই করতে পারিস। তোর পড়াশোনার খরচটা উঠে আসবে।”
দিয়া বললে, “এই খবরদার, মডেলিং-এর নাম করবি না।”
“কেন, তোর আপত্তি কীসের?”
“তারপরেই তো বোকা-বোকা সিরিয়াল, তারপরেই ছ্যাতা-পড়া ফিল্ম, তারপর স্বগ্গে উঠে যাবি। বোম্বাই সে আয়া মেরা দোস্ত।”
“হলেই বা, সত্যিই যদি তেমন কিছু লেগে যায়, তা হলে টাকাপয়সার ভাবনাটা আর ভাবতে হবে না।”
“নো।” দিয়া রীতিমতো মিলিটারি গলায় বলল, “দিবারাত্র গার্লফ্রেন্ড বদলানো, রোজ-রোজ পাতায়-পাতায় ছবি, একগাদা ফ্যান মেল, ইয়ার্কি, না?”
উজ্জ্বল বলল, “তুই অত শিয়োর হচ্ছিস কী করে, ফিল্মে না নামলেও এবেলা-ওবেলা গার্লফ্রেন্ড বদলানো যায় না বা ফ্যান মেল আসে না?”
দিয়া কেমন মিইয়ে গিয়ে বললে, “তাই বুঝি?”
বাসুদি এসে ডাকল, “খেতে এসো।”
টেবিল জুড়ে লুচি, আলুরদম, স্যান্ডউইচ, ঘুগনি, নানারকম ফল, ফ্রেশ ক্রিম, মাখন, ফ্রুট জুস, দুধ, কফি, চা, কেক, সন্দেশ। উজ্জ্বল দুটো স্যান্ডউইচ, দুটো লুচি আর কালো কফি নিল। ফুট জুস ছুঁল না। আপেল, কলা, আঙুর, শশা, লেবু দিয়ে একটা স্যালাড মতো করে নিল, বাসুদিই করে দিল। তাতে একটু নুন-মরিচ ছড়িয়ে খেয়ে নিল।
“এ কী, কিছুই তো খেলে না? তোমার তো সেই যাকে বলে, লোহা হজম করে ফেলা উচিত।”
“আমাকে স্ট্রিক্ট রেজিমেন মেনটেন করতে হয় মাসিমা। দারুণ খেয়েছি, একদম রাইট কম্বিনেশন।”
দিয়া বলল, “আমিই তো তোর চেয়ে বেশি খেলাম। লুচি আই লাভ, স্যান্ডউইচটা বাসুদি করে ফ্লুরিজের চেয়েও ভাল। দুধ না খেলে আমার চলে না। আর স্ট্রবেরি দিয়ে ক্রিম তো আমি খাবই। বাবাই খেয়ে দেখ।”
সোনা বললেন, “চলো আমরা উপরের বারান্দায় গিয়ে বসি। চমৎকার গাছপালা দেখা যায়।” তিনি এতক্ষণে উজ্জলের ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছেন।