ট্রেকার্স (Trekkers) : 22
সংযুক্তা আস্তে বারান্দা থেকে ঘরে এলেন। ধ্রুবজ্যোতি কাগজ পড়ছিলেন, সংযুক্তা তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন। “রিঅ্যাক্ট কোরো না, পুলিশ আসছে।”
চমকে মুখ তুললেন ধ্রুব। তৃতীয় ঘর থেকে মিলুর এবং তার মাস্টারমশাইয়ের মিলিত গান ভেসে আসছে। দেশ রাগ শেখাচ্ছেন। হার্মোনিয়াম ও তানপুরার সংগতসুদ্ধ কর্কশ পুরুষ গলা ও ভাবগম্ভীর মেয়ে গলার গান রীতিমতো শুদ্ধ করে তুলেছে রবিবারের সকালটাকে। আকাশে পুঞ্জ-পুঞ্জ মেঘ।
ধ্রুব বললেন, “মাথার ঠিক রাখবে।”
সংযুক্তা বললেন, “আনএক্সপেক্টেড, ওকে কী করে সাবধান করব বুঝতে পারছি না।”
ধ্রুব বললেন, “পারবে, ঘাবড়িয়ো না।”
নীচে বেলটা বেজে উঠল, একবার, দু’বার। ধ্রুব চশমার কাচ মুছতে-মুছতে নীচে নামলেন। সংযুক্তা উপরের ঘরে বসে। হাতে খবরের কাগজ, হাতের কাঁপুনি থামাবার চেষ্টা করছেন।
দরজা খুলে, সামনে দু’জনকে দেখলেন ধ্রুব। একজন ইউনিফর্ম পরা, অন্যজন সাধারণ শার্ট-প্যান্ট।
“কী ব্যাপার, ভেতরে আসুন।”
ওঁরা পরিচয় দিলেন। একজন স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টর, অন্যজন সি আই ডি থেকে।
“সরি আপনাদের বিরক্ত করছি। কয়েকটা প্রশ্ন ছিল। আপনাদের বাড়ির কোনও মেয়ে কি কমলিনী গার্লস স্কুলে পড়ে?”
“পড়ে না, পড়ত। এখন তো পাশ করে গিয়েছে। কেন বলুন তো?”
পলিথিনে মোড়া একটা শাড়ির ছেঁড়া কোণ ব্যাগ থেকে বের করলেন ইন্সপেক্টর, “এটা চিনতে পারেন?”
“একটা শাড়ির অংশ।”
“না, এটা ওই গার্লস স্কুলের ইউনিফর্ম।”
ধ্রুব বললেন, “হ্যাঁ, ওদেরও তো এই রঙেরই বোধহয় বর্ডার শাড়ির। একেবারে সেম কালার কি? আমার অত খেয়াল নেই, কেন বলুন তো?”
“এটা একটা মার্ডারের অকুস্থলে পাওয়া গিয়েছে। আমরা কমলিনী গার্লস স্কুলের মেয়েদের মধ্যে খোঁজ করছি।”
“বলেন কী মশাই, ওই অত মেয়ে প্রত্যেককে…সে তো বিশাল।”
সিআইডি বললেন, “না, ওই সময়ে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা চলছিল। আমাদের অনুসন্ধান, ওই ক’টি মেয়ের মধ্যেই। লেক গার্লস-এ সিট পড়েছিল।”
“আপনাদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। বলুন, কী করতে পারি।”
“ফার্স্ট অফ অল, মেয়েটিকে একটু ডাকুন। ও কোথায়?”
“গান শিখছে, ওর গুরু এসেছেন।”
সেই মুহূর্তেই রাগ দেশের একটি তানতোড়া ঘুরতে-ঘুরতে বারান্দার পথে এবং সিঁড়ির পথে নেমে এল। গুরু গাইছেন, মাঝে-মাঝে ছাত্রীর গলা শোনা যাচ্ছে।
“কাইন্ডলি একটু ডাকুন।”
“শিয়োর।”
ধ্রুবজ্যোতি সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। সংযুক্তা এগিয়ে এলেন, “কী?”
“ওকে ডাকছে, তেমন কিছু নয়।”
“সত্যি বলছ?”
“যদি না ও নার্ভাস হয়ে যায়, তুমি নীচে নেমো না। বেশি-বেশি কৌতূহল দেখানো ঠিক না।”
“প্রফুল্লবাবু, ছাত্রীকে একটু ছাড়বেন? দরকার আছে। ধরুন দশ মিনিট।” দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “মিলি আয়।”
বেরোলে বললেন, “পুলিশ এসেছে। শাড়ির টুকরো পেয়েছে, তোদের ইউনিফর্ম। তাই সব কমলিনী গার্লদের খোঁজ নিচ্ছে। আগে-আগে তোকে পুলিশের সামনে প্রশ্নোত্তর যা শিখিয়েছি, সেইমতো কথা বলবি। ঘাবড়াবি না।”
সি আই ডি বললেন, “তুমি? ও, কী নাম? তিনি যেন ঠিক এই রকম একটি মেয়েকে আশা করেননি।”
“মিলি।”
“কী পড়ছ এখন?”
“বিএ, বাংলা অনার্স।”
“কোথায়?”
“যাদবপুর ইউনিভার্সিটি।”
“এপ্রিলের সতেরো-আঠারো কোথায় ছিলে মা, একটু মনে করে বলবে?
“সতেরো-আঠারো, এপ্রিলের? একটু ভাবি। তেরোয় পরীক্ষা শেষ হল, তা হলে সতেরো-আঠারো বাড়িতেই। আর কোথায় থাকব? কেন, কী হয়েছে সার?” উদ্বিগ্ন মুখে বলল সে।
“সি আই ডি ভদ্রলোকটি ভালমানুষের মতো মিলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা একটা খুনের কিনারা করতে এসেছি, এইটা চেনো?” ফোল্ডারে শাড়ির টুকরোটা বের করলেন ইন্সপেক্টর। হাত বাড়িয়ে দিলেন তাকে। হাত পেতে নিল সে।
“উলটেপালটে দেখে বলল, “আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম এই রকমের শাড়ি। সার, আমাদের স্কুলের কোনও মেয়ের?”
“কোনও মেয়ে…কী?” সিআইডি বললেন।
“আপনি বললেন, খ্খুন, খুন হয়েছে, কোনও মেয়ে?”
“না, না, খুন হয়েছে দু’জন গুন্ডা। এই শাড়ির টুকরোটা ঘরের চৌকাঠের ফাঁকে আটকে ছিল।”
“ওহ।”
“দু’জনেই ঠিক গুন্ডা নয়, বুঝলে! একজন শিক্ষানবিশ গুন্ডা বলা যায়। দেখো তো, এই ছবিটা চিনতে পারো কি না?”
পটকার একটা পরিষ্কার ছবি তার নাকের সামনে তুলে ধরলেন ইন্সপেক্টর।
“হ্যাঁ-হ্যাঁ, একে চিনি তো। যে-সব ছেলে ছুটির সময়ে স্কুলের কাছে ঘুরঘুর করে তাদের মধ্যে একে দেখেছি।”
“তোমার পিছনেও লেগেছে?”
“ওই ঘুরঘুর করল, কী একটা কমেন্ট করল, ইস্স এই ছেলেটাই…”
আর একটা ছবি বের করলেন ইন্সপেক্টর, “একে চেনো?”
“নাঃ, একে দেখেছি বলে… নাঃ। এ তো অনেক বড়, একে ওদের সঙ্গে দেখিনি তো।”
“তোমার স্কুলের শাড়ি আছে না কি?”
“থাকতে পারে, মা সাধারণত কাজের লোকেদের দিয়ে দেয়।”
“তুমি নিজেই তো একটি কাজের লোক,” ইন্সপেক্টর দুম করে বলে উঠলেন।
মিলু একদম চুপ করে গেল। একটু পরে, ধ্রুবজ্যোতির দিকে চেয়ে বলল, “বাবা, তুমি এঁদের সঙ্গে কথা বলো, আমি যাচ্ছি।”
চোখের জল চাপতে-চাপতে সে একরকম দৌড়েই বেরিয়ে গেল।
ধ্রুবজ্যোতি অত্যন্ত আহত গলায় বলে উঠলেন, “এটা আপনারা কী করলেন? এসব কথা…”
“আপনার প্রতিবেশী বিজয় সুর আমাদের ইনফর্মেশনটা দিয়েছেন, ভুল নাকি?”
“ও, বিজয়বাবু? বাঃ! দেখুন, কথাটা ভুল। কাজের মেয়ে বলতে যা বোঝায়, সে রকম কিছু ও নয়। আমরা ওকে পালন করছি। ও আমাদের মেয়ে। পুলিশ বলে কী আপনাদের মায়া-মমতা থাকতে নেই? এভাবে আঘাত দেওয়া… ছি! ছি! আমি বৃদ্ধ মানুষ। নিঃসন্তান। কাউকে পালন করছি, মানুষ করছি, এটা আমার আনন্দ।”
“সরি! বুঝতেই তো পারছেন, খুনের কেস। আপনার স্ত্রীকে দেখছি না?”
“দেখতে চান?”
“নাঃ থাক, উনি তো প্রোফেসর। না?”
“প্রোফেসর কথাটা ঠিক না, উনি রিডার এখন। আমিও তাই ছিলাম, রিটায়ার করেছি। আর কিছু?”
“নাঃ, সরি প্রোফেসর মজুমদার, মেয়েটিকে সত্যিই খুব ভাল মানুষ করেছেন। বিজয় সুর মশাই না বললে আমাদের সাধ্য ছিল না বুঝি। ওঁর মেয়ের সঙ্গেই পড়ত?”
“হ্যাঁ, ওঁর নিজের মেয়ের চেয়ে আমার পালিত মেয়ে অনেক ভাল রেজাল্ট করত। কোথায় উৎসাহ দেবেন, তা নয় ঈর্ষা, ছিঃ।”
“ঠিক আছে, আমরা চলি। পরে কোনও প্রয়োজন হলে…”
ধ্রুবজ্যোতি বললেন, “ইটস অল রাইট। আচ্ছা, একটা কথা বলব?”
“বলুন।”
“আমি জাস্ট আমার কমন সেন্স থেকে বলছি, এই পাড়ের শাড়ি কি আর কেউ পরে না? খুবই তো অর্ডিনারি, চলতি জিনিস।”
“ঠিকই বলেছেন, কথাটা আমাদের মাথায় আছে। সরি, আর কিছু বলতে পারব না।”
“নাঃ আমার মনে হল তাই বললুম। ঠিক আছে, আসুন।”
উপরে উঠতে সংযুক্তা বললেন, “শেষ কথাটা আবার বলতে গেলে কেন? ওরা নির্ঘাত ভাববে, তুমি সাফাই গাইছ, কিংবা ভেতরের খবর বের করে নিতে চাইছ।”
“কথাটা যদি না বলতুম, তা হলেও কিন্তু ওদের সন্দেহ হতে পারত। কেন আমি এই সামান্য কথাটা বললুম না, কেন আমার কৌতূহল অত কম! ইট কাটস বোথ ওয়েজ সংযুক্তা। কী করা যাবে, আমি একটা বেছে নিলুম। মিলু কী করছে?”
“ওই তো, গানের ঘরে ফিরে গিয়েছে।”
“ভাল, তুমি পাঠালে না নিজেই গেল?”
“আমাকে সব বলল। বলে নিজেই চলে গেল।”
রাত্রের খাওয়ার সময়ে মিলু হঠাৎ বলল, “বাবা, আমি যদি ধরা দিই!” চমকে উঠলেন দু’জনেই।
“মানে?”
“এই টেনশন আমি সহ্য করতে পারছি না।”
“শুধু-শুধু একটা জেতা যুদ্ধে হার স্বীকার করবে কেন সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। এর চেয়ে অনেক বেশি বিপদের মধ্যে দিয়ে তুমি আগে গিয়েছ।”
“তখন আমার কিচ্ছু ছিল না বাবা, কিছু হারাবার ছিল না, তাই সব রিস্ক নিয়েছি। এখন তো তা নয়। তোমরা আছ, আমার কেরিয়ার আছে, পড়াশোনা, গান। আর বাবা, সত্যিই তো আমি একটা অন্যায় করেছি।”
ধ্রুবজ্যোতি রাগ করে বললেন, “উলটোপালটা বকছ কেন মিলু, বারবার যে বলছি, তুমি যেটা করেছ সেটা অন্যায় নয়। এখন আমি তোমাকে শান্ত করার জন্যে মোটেই গীতা আওড়াতে পারব না,” তিনি খাবার ফেলে উঠে গেলেন।
সংযুক্তা চুপচাপ রুটি ছিঁড়ে যাচ্ছেন, মুখ বিষণ্ণ।
একটু পরে মিলু উঠে পড়ল। বলল, “বাবাকে ডেকে আনছি, তুমি খাও মা।”
ধ্রুবজ্যোতি শোওয়ার ঘরের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
মিলু পিছন থেকে ডাকল, “বাবা।”
তৎক্ষণাৎ বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেলেন ধ্রুব। বললেন, “বলো।”
“খাবে এসো। আমি আর ওসব বলব না, ভাবব না।”
“কথা দিচ্ছ?”
“দিচ্ছি।”
ধ্রুব ফিরে এলেন। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রফুল্লবাবু যে তোকে ইমন শেখাচ্ছিলেন, আজকে অন্যরকম কি শুনছিলুম যেন?”
“দেশ বাবা। বর্ষা পড়ে গিয়েছে বলে মাস্টারমশাই আগের দিনই দেশ ধরলেন। কী অপূর্ব সুর বাবা। সমস্ত ভুলিয়ে দেয়। মনে হয়, গেয়েই যাই, গেয়েই যাই।”
“বেশ। খাওয়া-দাওয়ার পর তুই আবার তানপুরা নিয়ে বোস। গেয়েই যা, গেয়েই যা, আমরা শুনব।”
“তোমরা কিন্তু তোমাদের ঘর থেকে শুনবে। আমি আলো নিবিয়ে গাইব। কে জানে বাবা, কত ভুল হবে।”
মিলির চলাফেরায় আগেকার ছন্দটা ফিরে এসেছে মনে হল। তবু সাবধানের মার নেই। তিনি সংযুক্তাকে নির্দেশ দিলেন, আজ মিলির সঙ্গে শুতে। উপরন্তু যেন আজকে ওকে ট্রাঙ্কুইলাইজার দেওয়া হয়। ধ্রুবর কেমন মনে হল, মিলু তাঁদেরও পরীক্ষা নিচ্ছে। তাঁরা ওকে কতটা ভালবাসেন, সত্যি-সত্যি তার জন্যে বিব্রত বোধ করেন কি না, সত্যি-সত্যি তার জন্যে স্যাক্রিফাইস করতে রাজি কি না, এইসব সে জানতে চাইছে। হয়তো সচেতনভাবে নয়, কিন্তু তার হৃদয় চাইছে ভালবাসার নিরাপত্তা। সত্যিই তাঁরা মিলুকে কতটা ভালবাসেন, এটা একটা প্রশ্ন। নিজের সন্তানের মতো কি? নিজের সন্তান হয়নি, কী করে জানবেন, সে কী জিনিস? তাঁদের দুই বাড়িতে যে সামান্য ক’জন আত্মীয় আছেন, সংযুক্তার দাদা-বউদি, দিদি-জামাইবাবু, এঁদের ছেলেমেয়েদের কোনওরকম বাৎসল্য দেখাবার সুযোগ পাননি তাঁরা। সংযুক্তার দাদার একটিই ছেলে। ওঁর বদলির চাকরি বলে বরাবর বোর্ডিং স্কুলে মানুষ হয়েছে। দিদি-জামাইবাবু অনেক বড়। তাঁদের ছেলেমেয়েদের বাল্যাবস্থায় দেখেনইনি ধ্রুব। তিনি নিজে তো একমাত্র সন্তান। তাঁর বাবাও এক সন্তান। কাজেই মামাতো-মাসতুতো ছাড়া তাঁর গতি ছিল না। সে সব সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কবে চলে গিয়েছে। অপত্য স্নেহ খানিকটা ছাত্র-ছাত্রীদের উপর পড়ে ঠিকই। কিন্তু শিশুকাল থেকে দেখলে যে-মায়াটা হয়, সেটা সম্ভবত আলাদা। শীলুকে বড় করে, চরে খেতে শিখিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। টান আছে, কিন্তু সেটা এমন কিছু নয়। বিলুর বেলায় টানটা আরও কম। কিন্তু মিলু? মিলু কোথাও চলে যাবে, মিলুকে পাওয়া যাচ্ছে না এরকমটা ভাবতে গেলে তাঁর বুকের কোথায় একটা ব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। তবে কি মিলুই তাঁদের প্রকৃত সন্তান হয়ে উঠছে? তাঁরা কি মিলুর প্রকৃত বাবা-মা হয়ে উঠতে পারছেন? সংযুক্তা আজকাল অনায়াসে মিলুর পাশে শুচ্ছে। কিন্তু তিনি তো মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে আদর কোনও দিনই করতে পারবেন না!
ও ঘর থেকে দেশ-এর আলাপ ভেসে আসছে। কাঁচা গলার আলাপ, কিন্তু ভীষণ মিষ্টি লাগছে। চোখে জল ভরে আসছে। সংযুক্তা চুপচাপ আরামচেয়ারে বসে শুনছেন। তিনি বিছানায়, একটা হাত চোখের ওপর। সংযুক্তা ধীর গলায় বললেন, “এবার বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিই?”
তিনি আরও আস্তে বললেন, “একটা লোক এখনও পায়চারি করছে কিনা, খুব ক্যাজুয়্যালি দেখে নিয়ো।”
“দেখেছি। এখনও আছে, আমাদের বারান্দার নীচে এখন জলবিয়োগ করছে। এক বালতি জল ঢেলে দেব?”
“দিতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু তোমার মেয়ের কেস ঘেঁটে যেতে পারে, ছেড়ে দাও।”
সংযুক্তা বারান্দার দরজা বন্ধ করে আলো নিবিয়ে দিলেন।
“আমরা যে শীলু, বিলু এদের কাউকে এই বিপদের কথা বলিনি, সেটা এক পক্ষে ভাল বুঝলে।”
তিনি বললেন, “ফোনে এ নিয়ে কোনও কথা চালাচালি না হয় এটা মিলুকে বলে দিয়ো। বি অ্যাবসল্যুটলি নমার্ল।”
“কিন্তু ওরা আবার পিছনে লোক লাগাল কেন?” সংযুক্তা চিন্তিত গলায় বললেন।
মিলুর অতীতটা যদি জানতে পেরে থাকে তা হলে ওদের ধারণা হতে পারে এই সব লোকেদের সঙ্গে মিলুর সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। এটা আমার একটা ধারণা। প্লাস্টিকের খামটা মিলুর হাতে দিল, আমার হাতে কিন্তু দেয়নি। যদি কোনও আঙুলের ছাপ-টাপ পেয়ে থাকে মিলিয়ে দেখবে।”
আঁক করে একটা শব্দ করলেন সংযুক্তা, “সে কী?”
“মিলু যেভাবে নিল, তাতে আঙুলের ছাপ উঠবে না। তবে অকুস্থলে ছাপ পেয়ে থাকলে যেমন করে হোক, ছাপ ওরা নেবেই।”
সারারাত কারওই ঘুম হল না। মিলুই একমাত্র ট্রাঙ্কুইলাইজার খেয়ে ঘুমোল। সকালে তার ঘুম ভাঙলে সংযুক্তা সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলেন, “মিলু তোর কি মনে আছে ঘরটায় ছিটকিনি ছিল, না খিল?”
“কেন মা?”
“খুব মনে করে বল তো ঠিক কীভাবে পালালি? পাঁচদিন ছিলি কীভাবে?”
“কেন মা, কত পায়ের ছাপ পেয়েছে?” মিলু নিভন্ত গলায় বলল।
“সব সম্ভাবনাগুলো আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, মাথা পরিষ্কার করে ভাবতে হবে।”
সকালবেলার চা-বিস্কুট খেতে খেতে মিলু বলল, “নিয়ে গিয়ে ঘরটাতে ফেলে দিল। একটা তক্তাপোশে, পাতলা চিরকুটে ময়লা বিছানা। তারপর দু’জনে পরপর অত্যাচার করল। পটকাটাকে ফেলে দিয়েছিলাম, কিন্তু অন্যটার গায়ে ভীষণ জোর, ভীষণ নিষ্ঠুর। আমার হাত-পা বেঁধে আঁচড়ে-কামড়ে কী বলব শেষ করে দিয়েছে।
“রাত্তিরে খেতে দিল কিছু?”
“শুধু দুধ, আমি টাচ করিনি।”
“জল?”
“একটা কুঁজো ছিল তা থেকে কাগজের গেলাসে করে জল দিত। শুঁকেটুকে খেতাম। তারপর ওরা গেলাসগুলো দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিত।”
“সকালে চা?”
“সে-ও কাগজের গ্লাসে, আমার তো হাত বাঁধা। পটকাটা গলায় ঢেলে ঢেলে দিত। বলত, “চা না খেলে টানবি কী করে? পাঁচদিন আর কিচ্ছু খাইনি।”
“বাথরুম?”
“একটা বালতি রেখে দিয়েছিল। ওরা যে কী নোংরা মা ধারণা করতে পারবে না।”
“তা হলে বলছিস কিছু হাতে করে ধরার সুযোগই হয়নি?”
“না মা। তারপর শেষ দিনে যখন দেখলাম মদ খেয়ে একেবারে অজ্ঞান, দুটো ছুরি পড়ে আছে, পা খোলা ছিল, গিয়ে পা দিয়ে ছুরিগুলো জড়ো করলাম। হাত দুটোর দড়ি কামড়ে ছিঁড়ে মরিয়ার মতো টানাটানি করে খুলতে পেরেছি। তারপর ছুরিদুটো সোজা ওদের গলায় বসিয়ে দিয়েছি। কীরকম ঘড়ঘড় শব্দ হল, রক্ত ছিটকে লাগল আমার কাপড়ে। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়েছি দরজার দিকে। অনেক উঁচুতে খিল মাথার ধাক্কা দিয়ে খিল খুলেছি। তারপর দৌড়োতে-দৌড়োতে বেরিয়ে গিয়েছি।”
“হাত, পায়ে রক্ত ছিল না?”
“না, রক্তটা ছিটকে আমার কাপড়ে লেগেছিল। মেঝেতে বোধহয় পড়েনি। কাপড় থেকে কি রক্ত পড়তে পারে? আমি জানি না। মাথা দিয়ে ঢুঁ মেরে খিলটা খুলেছিলাম, তারপর ছুটেছি। কাপড়ের কোণ আটকে গিয়েছে এ খেয়ালও আমার হয়নি,” মিলু চুপ করল। তারপর তাঁর দিকে ফিরে শুল।
কলেজ গেল মিলু সঙ্গে ধ্রুব, যেমন যান। দু’জনেই চুপচাপ। ধ্রুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলবার চেষ্টা করছেন। মিলুও আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। নরক যন্ত্রণায় কাটল ক’দিন। মিলু ক্লাসে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। চন্দনা লক্ষ করেছে। বলল, “মিলি তোর কী হয়েছে রে?”
মিলু বলল, “ক’দিন মাথায় কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে।”
“তো চোখ দেখা, নিশ্চয়ই পাওয়ার বেড়েছে।”
“ভাবছি তাই, বাবাকে বলতে হবে।”
এখানে মিলুর একটা স্বস্তি যে, তার স্কুলের কেউ আসেনি। ফলে সে যে পালিতা মেয়ে, সে কথা কেউই জানে না। তার নতুন চেহারা তার একটা স্বস্তির কারণ। মিলু নিজেই নিজেকে আয়নায় দেখে চিনতে পারে না। কারণ, ভিতরে ভিতরে সে এখনও শাড়ি পরে একটা বিনুনি করে রুটির আটা মাখছে, চা করছে। ভিতরে তার একটা বদল আসে, একমাত্র যখন সে গান গায়, মাস্টারমশাই আসেন। রাগ-রাগিণীর অথৈ গভীরে সে তার আইডেন্টিটি ভুলে যায়। কে জাহিরা শেখ, কে মিলি মজুমদার, এ সমস্ত অবান্তর হয়ে যায়। বান্ধবীরা আজকাল কেউ কেউ বাড়ি আসতে শুরু করেছে।
“ইস্স মিলি তোর বাড়িটা কী ভাল, বাবা-মা কী ভাল।”
“কেন, তোদের বাড়ি ভাল নয়? বাবা-মা ভাল নয়?”
“বাড়ি তো নয় ফ্ল্যাট, এত স্পেস আছে নাকি? আর বাবা-মা দিন-রাত খিটির-খিটির।”
একজন বলল, “তুইও কী গুণী, কী সুন্দর খাবার করে খাওয়াস আমাদের, উপ্মাটা কী করে করেছিলি? দইবড়াটাও খুব ভাল করিস।”
“সব আমার মা শিখিয়েছেন।”
“আমাদের মা’রা তো সংসারের কোনও কাজই করতে দেয় না, এসব দেখতে হবে না, পড়াশোনা কর গিয়ে। জানিস, এখনও সেতার নিয়ে পড়ে আছে পিছনে। ভাল লাগে না, হবে না বুঝতে পেরে গিয়েছি। তবু কর। প্র্যাক্টিস কর।”
মিলির গান তার একটা অতিরিক্ত গুণ। বন্ধুরা খুব প্রশংসা করে। মিলি তার রেকর্ড থেকে তোলা রবীন্দ্রসংগীত, সারের কাছে শেখা ভজন শোনায়। বন্ধুরা খুশি হয়ে যায়।
এত সুখ কি তার সইবে, বিষণ্ণ মনে সে ভাবে। যতবারই গুছিয়ে বসতে গিয়েছে একটা না একটা বিপদ এসে বুঝিয়ে দিয়েছে, সুখ-শান্তি তার জন্য নয়।
সিআইডি অফিসারটি একদিন সংযুক্তার কলেজে হাজির। ভিজিটার্সরুমে কেউ তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে শুনে সংযুক্তা গিয়ে দেখেন মক্কেল বসে আছে।
“আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না, অ্যাডমিশন?”
“আজ্ঞে না, আমি আপনার মেয়ে সম্পর্কে একটাই ইনফর্মেশন চাই। বুঝতেই পারছেন কোথা থেকে আসছি।”
“আশ্চর্য! আপনারা তো বাড়িতে খোঁজ করে গিয়েছেন। আবার কী? এত উত্যক্ত করলে তো মুশকিল। আমার কলেজে ধাওয়া করেছেন!”
“সরি, আসলে আমরা জানতে চাইছিলাম ১৩ এপ্রিল মেয়ের জন্য বেশ কয়েকটি বাড়িতে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করেছিলেন আপনারা, কেন?”
“কী মুশকিল, সময়মতো বাড়ি না ফিরলে উদ্বিগ্ন হব না? আজকাল মেয়ের মা হওয়া কত জ্বালা তা জানেন না?”
“মেয়ে ফিরেছিল?”
“ন্যাচারালি। সেদিন শেষ পরীক্ষা, হয়তো একটু মেতে ছিল। আড্ডাটাড্ডা মেরেছে। ওর বায়োলজি ভাল লাগে না, পরীক্ষাটা নিয়ে আমরা একটু চিন্তিত ছিলুম আসলে।”
“আপনার মেয়ে কিন্তু অ্যাডিশন্যাল পেপার দেয়নি।”
“সে খোঁজও নিয়েছেন? নমস্কার আপনাদের ভাই,” সংযুক্তা একটু তেতো হাসি হাসলেন। “এই যে শুনি পুলিশ আজকাল কাউকে প্রোটেকশন দিতে পারে না, কোনও কম্মের নয়। কোন মেয়ে অ্যাডিশনাল পেপার দিল না সে নিয়েও আপনারা মাথা ঘামান?”
“ম্যাডাম, আপনার মেয়ে অ্যাডিশনালে অ্যাবসেন্ট কেন? পড়ুয়া মেয়ে, তাই না?”
“অ্যাডিশনালে ওর ম্যাথস ছিল, আমাদের জোরাজুরিতে নিয়েছিল। বলল কিছ্ছু পারবে না। পরীক্ষাটা দেওয়াও যা না দেওয়াও তা। আমরা আর জোর করিনি। দোষটা তো আমাদেরই, জোর করে চাপিয়েছি। আর কিছু?”
“না, ঠিক আছে। ম্যাডাম। আপনারা নমস্য ব্যক্তি, কিন্তু কী আর বলব, এই মন্ত্রীদের জ্বালায় আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি। কটাগোবিন্দ একটা দাগি খুনে গুন্ডা। বুঝতেই পারছেন কোনও মন্ত্রীর ডানহাত। উপর থেকে প্রেশার আসছে।”
সংযুক্তা চুপ করে রইলেন। কোনও মন্তব্য করা ঠিক নয়। লোকটি আবার ঘরের কথা বলতে শুরু করল, কী মতলবে কে জানে!
এতক্ষণে বোঝা গেল এঁরা কোন সূত্র ধরে মিলুকে টিপ করছেন। কমলিনী গার্লসের যে ক’টি মেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি দিচ্ছে, প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। চেকিং ও ক্রসচেকিং-এর মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তেরোই তাঁরা দু’তিনজন বন্ধুর বাড়িতে ফোন করেছিলেন। ভাগ্যে মিলুর বন্ধু বেশি নেই, জনা তিনেকের বাড়িতে ফোন করেছিলেন তাঁরা। যত দূর মনে পড়ছে সাত সাড়ে সাত নাগাদ। ভাগ্যিস, বেশি রাতে করেননি। করলে মিলু পরীক্ষা শেষে হই-হল্লা করে ফিরে এসেছিল এ গল্প টিকত না।
ধ্রুবজ্যোতি সমস্ত শুনে বললেন, “একেই বলে পুলিশের জাল। সংযুক্তা, আমি মলিনার কথা ভাবছি।” মলিনা তাঁদের কাজের লোক। সে যে ক’দিন মিলুকে নিঃসাড়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে, তার অসুখ শুনেছে, তাঁদেরও খুব ব্যস্ত থাকতে দেখেছে, এগুলো যদি পুলিশের কাছে বলে তা হলে?
আবার একদফা জ্বালাতন।
“সাবধান সংযুক্তা,” ধ্রুব বললেন। “মিলুর হারিয়ে যাওয়া আর পাঁচদিন পর ফিরে আসা ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে সত্য গোপন করবে না।”
“সে আমি জানি,” সংযুক্তা বললেন। “কিন্তু আগ বাড়িয়ে কোনও খবর দেওয়ার দরকারও নেই। এখন মনে হচ্ছে মিলুর অতীতটা ওরা জানে না। হাসনাবাদ থেকে ওকে পেয়েছি আমরা। আশা করা যায়, বিশেষ কোনও সূত্র ছাড়া…”
হঠাৎ সংযুক্তা বলে উঠলেন, “এই রে!” পড়িমরি করে ছুটে গেলেন তিনি।
“কী হল রে বাবা?”
ওঁদের রান্নাঘর নীচে হলেও ছোট একটা ব্যবস্থা উপরে আছে। চা-কফি, জল-খাবার, রাত্রে কিছু ভাজবার দরকার হলে সেখানেই হয়। ধ্রুব ভাবলেন, কিছু কি চাপিয়েছিল সংযুক্তা দুধ-টুধ? একটু এগিয়ে দেখলেন, দালানে মা ও মেয়ে দাঁড়িয়ে।
মিলু বলছে, “হ্যা, রাখি তো, কিন্তু এসব কথা কিছু লিখিনি এখনও।”
“আগেকার কথা তো লিখেছিস,” মা অধৈর্য হয়ে বলল।
“তাতে কী?”
“তাতে অনেক কিছু মিলু। ধর, বাড়ি সার্চ করল। ডায়েরিটা পেলে ওরা অনেক কিছু ভেবে নিতে পারে। ফাঁসাতে পারে।”
“কিন্তু ওটা আমি নষ্ট করব না মা, ওতে আমার সব কিছু আছে। আমি নিজে মরে গেলেও কেয়ার করি না-ডায়েরিটা থাকবে,” গোঁ ভরে মিলু বলল।
“কী ব্যাপার?” ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“শুনলে তো৷ ওর ডায়েরিটা একটা প্রবলেম হতে পারে,” সংযুক্তা কালো মুখ করে বললেন।
মিলু বলল, “ডায়েরিটা আমি নষ্ট করব না বাবা, কিছুতেই না।”
“ঠিক আছে, নষ্ট কেন করবি? আমাকে দিয়ে দে, আমি ওটা লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করছি।”
“কোথায় লুকোবে বাবা?” হঠাৎ মিলুর চোখদুটো জলে ভরে গেল। “আমার সমস্ত জীবন, কত ভাবনা-চিন্তা, সে-সব আমার কাছে খুব দামি, সব ওতে আছে।”
“আমাকে কি বিশ্বাস করতে পারছিস না?”
“কোথায় রাখবে?”
“ব্যাঙ্কের লকারে। গয়নাগাঁটি, দলিলপত্রের সঙ্গে।”
“ধরো ওরা তোমাকে ফলো করল কিংবা যদি সার্চ ওয়ারেন্ট বের করে, লকার কি তার বাইরে?”
সংযুক্তা বললেন, “ওটা সিল করে আমার কলেজের লকারে রেখে দিতে পারি।”
“সার্চ ওখানেও করতে পারে মা।”
ডায়েরি-ডায়েরি করে যখন তিনজনেরই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় তখন ধ্রুব বললেন, “দেখি তো, তোর ডায়েরিটা একবার।”
ডায়েরি মানে তিনটে একসারসাইজ বুক। এক, দুই, তিন… এইভাবে সাজানো। কিন্তু স্টেপল করাও নেই, নাম পর্যন্ত নেই।
ধ্রুব হেসে বললেন, “হার্ড বাউন্ড নয় কিছু নয়, এটা তো কোনও প্রবলেমই নয় রে। তোর মায়ের কোনও ছাত্রীদের খাতার সঙ্গে দিব্যি থাকবে। উপরে একটা কাল্পনিক নাম বসিয়ে দে ব্যস।
সংযুক্তা বললেন, “আমাদের সিস্টেম হল কেজের চাবির ডুপ্লিকেট পর্যন্ত আমাদের কাছে থাকে। রিটায়ার করার সময়ে কেজ খালি করে চাবিটা জমা দিয়ে আসতে হয়।”
পরদিন কাগজে একটি রাগী চিঠি বেরোল। লিখছেন, কমলিনী গার্লস-এর হেড মিসট্রেস, অন্যান্যদের সই আছে।
পুলিশ এক গুন্ডার হত্যায়, সামান্য একটা সাদা কমলাপাড় শাড়ির ছুটকো অংশ পেয়ে কীভাবে তাঁর স্কুলের মেয়েদের হয়রান করছে, জনগণকে জানিয়েছেন এবং তীব্র প্রতিবাদ করেছেন তিনি। এই শাড়ি কি আর কেউ পরে না? তাঁর ক্ষুব্ধ প্রশ্ন। কটাগোবিন্দ জাতীয় খুনে গুন্ডারা যদি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে, তবে কার ক্ষতি? সমাজ তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে! তবে কি উপরতলার কোনও পুলিশ, কি মন্ত্রীসান্ত্রীর পোষা খুনে লোকটি? ক্ষমতাবানরা কী ভাবেন নিজেদের? তাঁদের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থে খুনোখুনির চক্র গড়ে উঠেছে, তার সুরক্ষার জন্য স্কুলের মেয়েদের উত্যক্ত করবেন তাঁরা?
এর পরে চিঠির স্রোত বইতে লাগল। নীরব মশাল মিছিল দেখা গেল দু’দিন শহরের রাস্তায়। সাংবাদিকরা ডজনে-ডজনে কমলাপাড় শাড়ি পরা মহিলাদের ছবি বের করতে লাগলেন। একটি সাহসী দৈনিক কোনও রাজনৈতিক নেতার পেটোয়া গুন্ডা কে কে, নামধাম জানিয়ে এবং তাদের কীর্তিকাহিনি ছেপে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। বিক্রি তুঙ্গে। অনেক নেতা মানহানির মামলা করবেন জানালেন। কিন্তু করলেন না। অনেকে বিবৃতি দিলেন, পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়! সেই নিয়েও অনেক চিঠি বেরোল। পাগল মানে কি সাংবাদিকরা? জনগণকে কি নেতা ছাগল বললেন? তাঁরা নিজেরা তা হলে কী?
তারপরে শুরু হল প্রবল বর্ষা। টানা তিনদিন বৃষ্টির পর কলকাতাকে আর কলকাতা বলে চেনা গেল না। প্রায় সারা শহর জলবন্দি। বজ্রপাতে মৃত্যু, তড়িৎ-তারে মৃত্যু, ম্যানহোলে পড়ে মৃত্যু। জায়গায়-জায়গায় রাবারের নৌকো চলল। জল সাপ্লাই তো দিতে হলই। শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে হল অনেক জায়গায়। আপাতত শান্তি।
এই ডামাডোলে ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার, উজ্জ্বলদের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন। নিজের মেয়ে আর পরের ছেলের এই তফাত। তিনি ভাবলেন, মনে মনে। তাঁদের বাড়ির সামনে জল জমে না, কিন্তু আশপাশ একেবারে জলমগ্ন। চতুর্থদিন আকাশের মেজাজ ভাল হল। ষষ্ঠ দিনে আবার তুমুল বর্ষণ। বম্বেতে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। যানবাহন বলে কিছু নেই। মানুষ যেখানে-সেখানে আটকা পড়েছে। এর মধ্যে কটাগোবিন্দ, পটকা, বেঁটে গোপাল, খটকা সব ভেসে গেল।
এই রকমই হয়। জনগণের সেন্টিমেন্ট কিছু একটা উপলক্ষ করে ফেটে পড়ে। তারপর কোনও দুর্যোগ, এখানে-ওখানে, সবাই সব ভুলে যায়। খালি পুলিশ ভোলে না, অবশ্য যদি মনে করে। কাজেই সামান্য স্বস্তি পেলেও ধ্রুব পুরো স্বস্তি পেলেন না। সাবধানতার কথা নিজেও ভুললেন না, অন্যদেরও ভুলতে দিলেন না।
“প্রঃ মজুমদার, ও ধ্রুবজ্যোতিবাবু?” পিছন থেকে বিজয় সুর ডাকছেন। “কী মশাই শুনতে পাচ্ছেন না?”
ধ্রুব বললেন, “শুনতে পাব না কেন? শুনতে ইচ্ছে করছে না।” বলে হনহন করে চলে গেলেন। জীবনে কখনও কারও সঙ্গে এত কঠোর ব্যবহার তিনি করেননি। কোনও-কোনও ব্যাপারে ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে তাঁর। প্রচণ্ড রাগ হয়ে যাচ্ছে।