টর্চলাইট
একদা নিশীথকালে দু’জন বিখ্যাত গুলিখোর একটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। ঘনঘোর অন্ধকারে একজন গুলিখোরের হাতে একটি টর্চলাইট ছিল। সেই টর্চলাইটে আলো জ্বালিয়ে পথ দেখতে দেখতে দু’জনে হাঁটছিল। যেমন হয়ে থাকে দু’জন গুলিখোর পাশাপাশি হাঁটলে যা হওয়া উচিত, দু’জনে মিলে উলটোপালটা আজগুবি সব গল্প করছিল। তাদের গন্তব্য স্থান বেশ দুরে ছিল, হয়তো নেশার ঘোরে তারা ঘুরপথেই যাচ্ছিল। অনেক অনেক হাঁটার পর এক গুলিখোর বলল, ‘এ যে কিছুতেই পৌঁছাচ্ছি না, এর থেকে স্বর্গে যাওয়া তো সোজা। আর কত হাঁটব রে বাবা ?’ দ্বিতীয় গুলিখোর যার হাতে টর্চলাইট ছিল সে আকাশের দিকে লম্বালম্বি টর্চলাইটটার আলো ফেলে বলল, ‘ওই তো স্বর্গ, সোজা পথ। আমাদের বাড়ির পথের মতো অত ঘোরা রাস্তা নয়। যাবি ?’ প্রথম ব্যক্তি এই প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল, সে বলল, ‘এ আর বেশি কথা কী ? সোজা এই আলো বেয়ে উঠে যাব।’ সুড়ঙ্গের মতো টর্চলাইটের আলোটা সরাসরি অন্ধকার আকাশ ভেদ করে উঠে গেছে, সেই ঊর্ধবপানে সে তাকিয়ে নিয়ে মালকোছা দিল তার ধুতিতে আলো বেয়ে স্বর্গে উঠে যাওয়ার জন্যে। তার পরেই কী যেন চিন্তা করে সে থমকে দাঁড়াল। টর্চলাইটধারী তাগাদা দিল, ‘কী রে, কী হল দেরি করছিস কেন ? লাইট টিপে টিপে আমার আঙুল ব্যথা হয়ে গেল।’ দ্বিতীয় ব্যক্তি তখন বলল, ‘না ভাই তোকে বিশ্বাস নেই। আমি উঠব না।’ প্রথম গুলিখোর বন্ধুর অবিশ্বাসে আহত হয়ে বলল, ‘আমাকে ভয় পাচ্ছিস কেন ? আমি কী করব ?’ দ্বিতীয়জন বলল, ‘আমি ওঠার সময় তুই যদি মাঝপথে আলো নিবিয়ে দিস, তা হলে তো আমি ঝপাং করে পড়ে মরে যাব।’
টর্চলাইটের এই পৌরাণিক মোটাদাগের হাসির গল্পটি যাঁরা জানেন তাদের জন্য আমি অন্য এক টর্চলাইটের করুণ কাহিনী শোনাতে চাই, সে কাহিনী এ রকম কাল্পনিক, গুলিখোর বা হাস্যকর নয়।
আমার টর্চলাইটটা খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের বাড়িতে কোনও জিনিস হারিয়ে গেলে সবসুদ্ধ একশো আট জায়গায় খুঁজতে হয়। জায়গাগুলো এইরকম, আলমারির নীচে, আলনার পিছনে, তরকারির ঝুড়ির আড়ালে, আমাদের কুকুর গণেশের বিছানায়, ছোট জিনিস হলে আমার পাঞ্জাবির পকেটে, বড় জিনিস হলে মিনতির হাতব্যাগে অথবা আমাদের ডাকবাক্সে।
আমাদের হারিয়ে যাওয়া জিনিস ডাকবাক্সে কী করে প্রবেশ করে সে প্রশ্নে অন্য একদিন যাব।
আমাদের টর্চলাইটটা ঠিক আমাদের নয়। বহুকাল আগে, সে প্রায় পঁচিশ বছর হল এই লাইটটা আমাদের কালীঘাট বাড়িতে একটা চোর ভুল করে ফেলে যায়। চোর যখন দোতলার পাইপ বেয়ে আমাদের বাড়িতে চুরি করার যোগ্য কোনও জিনিস না পেয়ে বিফলমনোরথ হয়ে নেমে যাচ্ছিল তখন ভুল করে ছাদের কার্নিশের ধারে সে তার টর্চলাইটটা ফেলে যায়। আমার অগ্রজ বহুক্ষণ আগেই গৃহে চোরের প্রবেশ টের পেয়েছিলেন এবং তিনি নীরবে চোরটিকে লক্ষ রাখছিলেন শুধু এই কৌতূহলবশত যে আমাদের বাড়িতে এমন কী জিনিস আছে যা চোর নিতে পারে !
শেষ পর্যন্ত দাদা দেখলেন যে হতভাগ্য চোরের সম্পূর্ণ পরিশ্রম শুধু বৃথা হয়েছে তাই নয়, উপরন্তু সে তার নিজের সম্পত্তি কার্নিশের একধারে ফেলে যাচ্ছে। কানির্শেরই অন্য প্রান্তে অন্ধকারের মধ্যে গুটি মেরে বসে দাদা এতক্ষণ পর্যন্ত চোরের কার্যকলাপ নজর রাখছিলেন, এবার তাঁর মায়া হল।
পাইপ বেয়ে চোর তখন প্রায় আধাআধি নেমে গেছে। দাদা কার্নিশের উপর থেকে মাথা বাড়িয়ে ডাকলেন, ‘এই যে ভাই, আপনার টর্চটা।’ সঙ্গে সঙ্গে চোর বেচারি একটা মোক্ষম লাফ দিয়ে নীচে নেমে ছুট দিল। দাদাও টর্চলাইট হাতে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে চোরের পিছনে দুর্ভাগার আলোটা ফেরত দেওয়ার জন্য দৌড়তে লাগলেন।
সে দৌড় দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। আমাদের মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে কালীঘাটের বাজার ধরে আদিগঙ্গার খাল পেরিয়ে চেতলার মধ্য দিয়ে একেবারে নিউ আলিপুরের সীমানায় দুর্গাপুর ব্রিজের নীচ পর্যন্ত। পুলের নীচের গোলকধাঁধায় লোকটা হারিয়ে যায়, দাদাও রণে ভঙ্গ দিয়ে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসেন।
এরপর থেকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ওই চোরের টর্চটি আমাদের সম্পত্তি হয়। আমার সেই স্মরণীয় অগ্রজ বহুদিন বিগত হয়েছেন। বাউন্ডুলে, অস্থির চিত্ত, খ্যাপা দাদা তাঁর স্নেহাস্পদ ভাই, এই আমার জন্যে, ইহপৃথিবীতে স্মৃতি এবং ওই চোরের টর্চলাইটটি ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। ওই টর্চলাইট আমার অতিপবিত্র উত্তরাধিকার সুতরাং এরপর থেকে ওই আলোটিকে চোরের টর্চলাইট না বলে শুধু টর্চলাইট বলব।
টর্চলাইটটি পাওয়া যাচ্ছে না। এ রকম মাঝেমধ্যে হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই বেরিয়ে পড়ে। দ্রব্যটি এত বেশি হারায় যে ওটি খুঁজে বার করার জন্যে আমার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে একটি সরল পন্থা বার করেছি।
লাইটটি হারিয়ে গেলে আর যত্রতত্র, একশো আট জায়গায় খুঁজি না। বাড়ির সবাই মিলে একত্র হয়ে একটা টেবিলের চারপাশে বসি। তারপর আলোচনা শুরু হয় লোডশেডিং নিয়ে। কারণ এর মধ্যেই রয়েছে গুপ্তধনের চাবিকাঠি। লোডশেডিংয়ের সময় ছাড়া টর্চলাইট কাজে লাগে না। সুতরাং আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, শেষ কখন বা কবে লোডশেডিং হয়েছিল। যখন ঘনঘন লোডশেডিং হয় তখন এ ব্যাপারটা নিয়ে খুব মতভেদ হয় না।
তারপরে প্রশ্ন, গত লোডশেডিংয়ের সময়ে কে টর্চ ব্যবহার করেছিল এবং সর্বশেষ মোক্ষম জিজ্ঞাসা, লোডশেডিংয়ের পরে যখন আলো ফিরে এল সেই মুহূর্তে যার কাছে টর্চলাইট ছিল, সে কোথায় দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে ছিল ? বলা বাহুল্য, এই শেষ প্রশ্নটি নিয়ে বহু বাদবিসম্বাদ হয় এবং যেভাবেই হোক টর্চলাইটের হদিশ মিলে যায়।
যাঁরা এ পর্যন্ত পড়ে ভাবছেন টর্চলাইটটি খুবই দামি মডেলের, সোনা, রুপো অন্তত তামার, কিংবা অন্য কোনও রহস্য আছে এর মধ্যে, তাঁরা কিন্তু ভুল ভাবছেন।
এবার টর্চটির রহস্য প্রসঙ্গে আসছি। প্রসঙ্গত ওই টর্চটি আমরা বাড়ির কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জ্বালাতে পারে না, সুতরাং কারও ওটা চুরি করে লাভ হবে না। টর্চটি জ্বালানোর আগে সেটার পিছনে এক সেকেন্ড ব্যবধানে পরপর তিনবার আলতো করে এবং তারপরে অতর্কিতে একবার একটু জোরে চড় দিতে হবে। এই শেষ চড়টা খুব জোরে হলে চলবে না, আবার খুব আস্তে হলেও চলবে না। চড় মারার সময় খুব সূক্ষ্মভাবে কান পেতে থাকতে হয়, টেলিফোনের লাইন কেটে যাওয়ার মতো একটা মৃদু কট করে শব্দ হওয়া মাত্র টর্চটাকে হাতের মধ্যে বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে হবে এবং ভাগ্যপ্রসন্ন থাকলে ওই ঘুরতে ঘুরতে আলো জ্বলে উঠবে।
আলো জ্বলে উঠলেই সে সমস্যার সমাধান হল তা নয়। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে টর্চের মুখটা নীচের দিকে করলেই আলো নিবে যায়, ফলে গুলিখোরের টর্চলাইটের মতো এটাকে স্বর্গপানে ধরে রাখতে হয়। অন্ধকারের মধ্যে চলাফেরার জন্যে পনেরো থেকে বিশ ডিগ্রি পর্যন্ত বাঁয়ে বা ডাইনে কাত করা যেতে পারে, কিন্তু খুব সাবধানে, কারণ নিবেও যেতে পারে।
তবে নিবে গেলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, কারণ অনেক সময় একা একাই স্বেচ্ছায় জ্বলে ওঠে। শুধু তাই নয়, বহু সময়েই সে কমে-বাড়ে নিজের খুশিমতো; এই নিবু নিবু হয়ে এসেছে হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল, আবার ধীরে ধীরে কমতে লাগল, এ রকম হামেশাই হয়।
টর্চটা সম্বন্ধে আরেকটা তথ্যও জানানো দরকার। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে টেবিল বা তাকের পাশে টর্চটি পড়ে থাকতে দেখে কেউ দয়া করে ধরতে যাবেন না। পিছনে স্প্রিংটা আজ কিছুদিন হল বিপজ্জনকভাবে শক্তিশালী হয়ে পড়েছে। হঠাৎ হঠাৎ পিছন দিক দিয়ে স্প্রিংটা ছিটকে বেরিয়ে আসে, তার পিছে পিছে বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসে দুটি বড় ব্যাটারি, বুকে লাগলে দিশি পাইপগানের গুলির চেয়ে সে কম মারাত্মক নয়।
আজ কিন্তু এই অপূর্ব টর্চটিকে হাজার চেষ্টা করে উদ্ধার করা গেল না। মন খারাপ করে অবশেষে তার এই অবিচুয়ারি লিখতে বসেছি। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং। আলো নিবতেই কী আশ্চর্য, টর্চলাইটটা নিজেই ফিরে এল। দেখি বইয়ের তাকের পিছনে অন্ধকারে সে একা একাই জ্বলে উঠেছে। বুক থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল। দাদা মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছিলেন, ‘গরিব মানুষের ফেলে যাওয়া জিনিস, হারাবি না, যত্ন করে রাখবি, লোকটাকে পেলে ফেরত দিবি।’