ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 14
একটা চমৎকার শান্তি আজ! তাঁর হৃদয়টা এবার স্থির হয়ে এসেছে। আত্মবিশ্বাস বরাবরই আছে। মাঝে মাঝে ধাক্কা খায়। মানুষ জীবন কাটাতে কাটাতে কোথাও না কোথাও তো ভুল করে ফেলে। অন্যায় করে ফেলে, ফেলতেই পারে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই সে একটা কৈফিয়ৎ খাড়া করে। সেই অন্যায়ই প্রকৃত অন্যায় যার জন্য নিজের মনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। পার পাওয়া যায় না। খুব ভাল করে মনের আঁতিপাঁতি খুঁজে দেখেন তিনি অনেক সময়ে। তেমন কিছু করেছেন কিনা। ভুল তো অনেক করেছেন। ভুল করেছেন খেলা ছেড়ে দিয়ে বা বলা ভাল খেলার সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়ে দিয়ে। কেননা খেলা তো তিরিশের পরে ছাড়তেই হয়। দম নিচ্ছেন, দম নিচ্ছেন, মাটিতে হাত। হুইস্ল বাজল, মুহূর্তে বন্দুকের ভেতর থেকে গুলির মতো ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে সবাই। পাশে পাশে দৌড়োতে থাকছে খড়ির রেখা। কী আরাম! আহ! পৌঁছে গেছেন! দৌড়োতে দৌড়োতে দৌড়োতে দৌড়াতে লম্বা লাফ, বালিতে কোলে করে নিয়েছে এখন। পর্যাপ্ত, পর্যাপ্ত আহ্লাদ। লেখাপড়ায় যদি আর একটু খারাপ থাকতেন তা হলে বোধহয় স্পোর্টস-কেরিয়ারটা চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটা তো ভালই হচ্ছিল। আরও মনোযোগ দাবি করছিল। দিতে ভালও লাগত। তা ছাড়া রোখ ছিল। দাদা বলেছিল— তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না, ওই হনুমানের মতো লম্ফঝম্প করেই জীবন কাটবে। এখন সেই দাদা কোথায়? তাদের আদরের বনির যখন বিয়ে দিয়েছিল বিশাল অঙ্কের ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে, তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেটা আরেকটা ভুল। পাঁচ বছর, মাত্র পাঁচ বছর, চেনাশোনা হতে-না-হতেই কী অজ্ঞাত রোগে সাগরেই চলে গেল। তারপর তিনি বি. এড. করলেন। এক মারোয়াড়ি বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা নার্সারি স্কুল করলেন। দু’-এক বছরের মধ্যেই স্কুল যখন রমরম করে দাঁড়িয়ে গেল, তখন একদিন স্কুলের টয়লেটে যেতে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। এ কার মুখ? একজন গম্ভীর গম্ভীর, খুব ফ্যাশনদুরস্ত হেডমিস্ট্রেস। প্রিন্সিপ্যাল। চোখে ভাবনা, ঠোঁট চাপা, ফরসা রং উজ্জ্বলতর, কেননা এখন আর মাঠে যান না। সন্ধেবেলায় সাউথ ক্লাবে টেনিস। ব্যস, এইটুকু। তাতে শরীরটা ফিট থাকে, কিন্তু কোথায় সেই প্রাণোচ্ছ্বল, হাসিতে ফেটে পড়া টেবল-চাপড়ানো অ্যাথলিট মেয়ে!
কিন্তু শ্রীলার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া? এটা কি তাঁর ভুল, না অন্যায়? তিনি পাশে পাশে না থাকলে শ্রীলা যেটুকু পেরেছে সেটুকুও কি পারত? দু’জনেরই ভাল ভাল বিয়ে হবে কী খুশি দু’বন্ধু! গলাগলি করে হাসছে। আদতে দেখা গেল সর্বাণী চিরবিরহের জালে বন্দিনী। আর শ্রীলা যেন তেমন মধুর হাসে না আর। চেহারাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, হাসিটা কেমন ধরা-পড়ে-যাওয়া ছিঁচকে চোরের মতো। চোখ খরগোশের মতো চকিত কখনও, কখনও নিবে-যাওয়া প্রদীপের মতো ম্রিয়মাণ। কী হয়েছে রে শ্রী? কিছু তো হয়নি! তুই তো… তোর বর তো দিনের পর দিন জলে। তুই আমার কাছে ছুটির দিনে সারা দুপুর, সারা সন্ধে থাক সর্বাণী।
থাকতে থাকতে বুঝতে পারলেন কী এক অনির্দেশ্য গরমিল এদের দু’জনের মধ্যে। কিছুতেই যেন একটা বিন্দুতে এসে মিলতে পারে না। তাঁর শৈবাল অমন ছিল না। যখন বাড়ি আসত, কতটা প্রতীক্ষা নিয়ে আসত। আর যখন তিনি ওর সঙ্গে ভাসতেন, তখনও কী আনন্দ! কোথাও কোনও খিঁচ ছিল না। একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছিল, তাঁর যদি বাইশ তো তার ছত্রিশ, সাঁইত্রিশ। চমৎকার স্বাস্থ্য, টেনিসে তো ও-ই স্থিত করাল তাঁকে। বলত, আর তেরোটা বছর চাকরি করব ব্যস। তারপর একটা ছোটখাটো কিছু ব্যবসা করব, আর লাইফ এনজয় করব। সে সুযোগ হল না। তাঁকে ‘ধনী বিধবা’ করে রেখে সে পাঁচ বছরের মধ্যে চলে গেল। নবগোপালকে শ্রীর যত খারাপ লাগত তাঁর কোনওদিনই তত খারাপ লাগেনি কিন্তু। আসল কথা নবগোপালের একটা স্পোর্টস ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। ক্রিকেট খেলত, পরে টেনিসে বেশি ঝোঁক এসে যায়। অনেক স্পোর্টসম্যানের একটা স্থূল একরোখা সব উড়িয়ে দেওয়া স্মার্টনেস থাকে। সূক্ষ্ণ ভাবনা-চিন্তা, পড়াশোনা, এসবের ধার ধারে না। কাঠখোট্টা। নবগোপাল ছিল ওই রকম। একত্রে টেনিস খেলতে খেলতে বোধহয় তাঁদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়ে যায়। তাই অসুখী শ্ৰীলা আর অশান্ত নবগোপালের মধ্যে হাইফেনের মতো তিনি বিরাজ করতেন। শ্রীলার সব সুখে দুঃখে তিনি তার পাশে থেকেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন, ওদের দাম্পত্য-সংকটে মধ্যস্থতা করেছেন কতবার। মিমি যতটা শ্রীর হাতে ততটা তাঁর হাতেও মানুষ হয়েছে। মাঝখানে বাবার অনুপস্থিতির বড় বড় ফাঁক আর সেই ফাঁক আদরে প্রশ্রয়ে ভরিয়ে দেওয়া। দু’জনেরই। কী যে আঁকড়ে ধরেছিল শ্রী মিমিকে! ফুটফুটে মেয়ে-বাচ্চা সারা বাড়ি যেন ভরে রাখত, কোথায় উধাও তখন অশান্তি, ভয়, অস্থিরতার সেই চাপা হাওয়া। ঝলমল করছে সমস্ত বাড়ি। যত বড় হল, তত অন্য রকম হয়ে গেল। স্কুলে যখন ঝগড়া করত, এর চুলের ঝুটি ধরে, ওকে ভেঙিয়ে, তিনি শুধু সামনে এসে দাঁড়ালেই শান্ত। কত ভালবাসত তাঁকে?
নবগোপাল যেদিন বিয়ের প্রস্তাব করল সেদিনই তাঁর খুব বিভ্রান্ত একটা অবস্থা হয়েছিল। তবে কি নিজের অজান্তে তিনি এই পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছিলেন? শ্রীর স্বামীকে কি তিনি ভেতরে ভেতরে কেড়ে নিচ্ছিলেন? তাঁর নিজের না হলেও নবগোপালের কি তাঁর ওপর আসক্তি জন্মাচ্ছিল? খুব গোপনে! কখনও প্রকাশ পায়নি। কক্ষনও না! শ্রী কি কিছু ভেবেছিল? আন্দাজ করেছিল? একদিন যখন শ্রীর সামনেই ওই পাগলি মেয়েটা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল— তুমি কেন আমার মা হলে না আন্টিমাসি? ওর মুখের অবস্থা তক্ষুনি কী হয়েছিল তা তো তিনি দেখতে পাননি। তিনি তখন হালকা করে বকলেন ওকে—আমি মা? তা হলে আর তোমাকে এত আবদার আর শয়তানি করতে হত না মিমি!
পরে কিন্তু শ্রী বলেছিল— ও ঠিকই বলেছে। আমি কারও মা হবার যোগ্য নই সর্বাণী।
—ও-ই কি মেয়ে হবার যোগ্য? —মেয়েরও কিছু দায়িত্ব থাকে।
—আমি যেমন মানুষ করেছি। দুর্বল হাত দুর্বল মন।
—ছোট বয়সটা কেটে গেলে কিন্তু এসব চলে যায় রে শ্রী! ওর যাচ্ছে না। এটা ওর নিজের স্বভাবের ব্যাপার।
এই পর্যন্তই। আর সেই ও.টি-তে নিয়ে যাবার আগে— আমার কেউ নেই, মেয়ে, স্বামী… শুধু তুই-ই আছিস। কিন্তু আমাকে কেউ না চাইলেও আমি তো ভাবনা এড়াতে পারি না। মানুষটা অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছে, মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে— তুই বাঁচা।
অপারেশন টেবলেই চলে গেল। কী বিবর্ণ সন্ধে! তিনি অপেক্ষা করে বসে আছেন। একা। বন্ডে সই করে চলে গেছে নবগোপাল। থাকত, কিন্তু জরুরি কল, যেতেই হবে— লন্ডন। বলে গেল— তুমি তো আছ!
মিমি এসে আবদার ধরল—এক্সকার্শন, সুন্দরবন অঞ্চলে তিনদিন। সব নাকি ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
—যাই আন্টি?
—মায়ের যে অপারেশন রে!
—ও তো কিছুই না। আর তুমি তো আছ! জাস্ট দু’দিন।
গিয়ে মুখ দেখলেন। শান্ত, করুণ, মধুর, যেমন কলেজের দিনগুলোতে, হোস্টেলের দিনগুলোতে ছিল। এই সূক্ষ্ম অতিভঙ্গুর মোমের মানুষটাকে কেউ বুঝল না? তাঁর শৈবাল বলত— মেয়েরা সাধারণত এমন হয় যে তাদের রক্ষা করা একটা খুব সুন্দর দায় হয়ে থাকে আমাদের। বেশিরভাগ ছেলেই এমনি বউ চায়। আমি চাইনি। কেননা আমার সে দায় নেবার উপায় নেই। তোমাকে খুব ভাল লেগেছিল, আকর্ষণীয়। কিন্তু একটু কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলাম— ইউ ক্যান টেক কেয়ার অব ইয়োরসেল্ফ। এইটেই আমার কাছে তোমার সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট। তা শ্রী তো সেই রকম মেয়েই ছিল যাকে রক্ষা করতে আগলাতে ভাল লাগে নবগোপালদের। তা হলে? লন্ডনে ফোন গেল। শব রইল ঠান্ডাঘরে। বিপর্যস্ত নবগোপাল এসে প্রথম কথাই বলল— পারলে না? পারলে না বাঁচাতে! —তার গলাতে তখন আকুল খেদ। অনুশোচনা।
কিন্তু এ কী কথা! তিনি বাঁচাবার কে? সবাই মিলে যাকে তিলে তিলে মেরেছ, তার মৃত্যু আমি আটকাব কী করে নবগোপাল?
কথাটা তিনি বলেছিলেন নবগোপালকে।
মাথা ঝুলিয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ।
যাক তবু পোস্ট-মৃত্যু অনুশোচনাটুকু পেল শ্রী।
আর মেয়ে? —কী হিস্টিরিয়া! কী হিস্টিরিয়া! —মা তুমি ফিরে এসো আর তোমাকে বকব না। মা তুমি ফিরে এসো তোমার সব কথা শুনব। হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।
শ্রীর আলমারির চাবি তো তাঁর কাছে ছিল না। কত শাড়ি সেখানে না-পরা পড়ে রয়েছে। তিনি নতুন কালো নকশা পাড় টাঙাইল কিনে পরিয়ে দ্যান। লাল মোটে পছন্দ করত না শ্রী!
—ওঠো মিমি, এবার ওঠো!
—পারলে না! তোমার কাছে রেখে গেলাম! কত নিশ্চিন্তে গিয়েছিলাম!
শ্রী মারা গেল, তার শেষ সময়ে স্বামী কন্যা কেউ ছিল না, সুতরাং তিনি অপরাধী। কী অদ্ভুত এদের প্রতিক্রিয়া!
তারপর প্রতিদিন স্কুলে যাবার পথে, স্কুল থেকে ফেরবার সময়ে একবার করে ওদের সংসার গুছিয়ে দিয়ে আসা। তখন আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এসেছে মিমি। বাচ্চা মেয়ের মতো তাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত এক এক দিন কলেজ থেকে ফিরে এসে। কী নিশ্চিন্ত নির্ভর! ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা তাঁর বড় প্রিয় ছিল। যদিও তার ধরনধারণ পছন্দ করতে পারছিলেন না। একটু একটু করে কঠিন হচ্ছিলেন। খুব একটু একটু। বাগেও আসছিল কিন্তু।
—অ্যাডভার্টাইজিং পড়লি, এবার একটা চাকরিটাকরি কর, দেখবি খুব ভাল লাগবে। আর বিয়ের ব্যবস্থা তো তুই বললেই করতে পারি।
—খবরদার আন্টিমাসি। বিয়ে আমি নিজে করব, যাকে ইচ্ছে, পছন্দ না হলে ছুড়ে ফেলে দেব। আবার করব, না-ও করতে পারি। এই জায়গায় কেউ হাত দিতে আসবে না।
—তা বেশ। কিন্তু একটা কাজ নিয়ে তো থাকবি। তনিকা যেমন দ্যাখ ছবি নিয়ে মজে আছে!
—সে তনির ট্যালেন্ট আছে। আমার যদি না থাকে তো আমি কী করতে পারি!
—তা হলে তোর এখন প্ল্যান কী!
—দেখি, ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সটা করব ভাবছি।
মনে মনে বললেন— কবে তোমার কোর্স শেষ হবে মিমি! যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু কোনওটা ভাল করে করবে না। এক একটা পড়তে যাবে, আলাদা আলাদা বন্ধু জোটাবে আর হি-হি হা-হা। আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছে দশটা। এগারোটা একদিন। সেটা দেখেন বিয়ের পর।
বাবার বিয়ের পরই খেপে গেল একেবারে। দু’জনে রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেন বিছানা লন্ডভন্ড। চতুর্দিকে ভাঙা বাসন পড়ে আছে, রক্তাক্ত পায়ে মিমি বসে আছে।
—এ কী! পঞ্চমী! মিমি এতটা পা কেটেছে! কী করে?
পঞ্চমী বলল— কী জানি, যেই তোমরা বেরিয়ে গেলে মাসি, অমনি সব ভাঙচুর শুরু করল। আমি তো নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম ভয়ে।
ডাক্তার ডাকা হল, পা থেকে টুকরো টুকরো কাচ বার হল, ওষুধ হল, ব্যান্ডেজ হল। ক’দিন ঘরবন্দি। বেরোতে পারছে না। তিনি খাবার দিতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিল।
বলল— পঞ্চমী দেবে।
তিনি নবগোপালকে বললেন— সামলাও এবার।
—এ রকম করবে তো বুঝতে পারিনি! তুমি পেরেছিলে!
—একটুও না।
নবগোপাল গিয়ে রাগ রাগ গলায় ডাকলেন— মিমি!
উত্তর নেই।
—এ রকম করেছ কেন? ভাঙচুর, চুরমার, নিজের পা-ফা কেটে একসা।
—যাও যাও, নতুন বউয়ের কাছে যাও।
—মারব এক থাবড়া। অসভ্যতা করবে না একদম। আমার নতুন বউ হতে পারে কিন্তু ও তোমার অনেক পুরনো মা, মনে রেখো। ও করতে চায়নি। আমিই জোর করেছি। আমার সংসার ভেসে যাবে, তুমি ভেসে যাবে বলে।
—আমার কথা কাউকে ভাবতে হবে না— ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।
নবগোপাল মাথায় গিয়ে হাতটা রাখলেন, নরম গলায় বললেন— তোমার মা তো কিছুতেই আর ফিরে আসবে না। আমাদের স্বার্থে আর তুমি ভালবাসো বলে তোমার মাসিকেই এনেছি। এ নিয়ে কোনও কম্প্লিকেশন আমি কিন্তু সহ্য করব না। তুমি ছেলেমানুষ নও। উইটনেস হিসেবে তোমাকেও আমরা ডাকতে পারতাম। তোমার ওপর এত কনফিডেন্স ছিল আমাদের। তুমি সবই জানো, বলে রেখেছি, এমনকী কাউকে খাওয়াইনি পর্যন্ত। তোমাকে নিয়েই আমরা আজ খেতে যেতাম। এ কী? এ রকম করবে তাই বলে?
মুখ গুঁজে ছিল, মুখ তোলেনি, খায়ওনি।
—আনপ্রেডিক্টেবল— নবগোপাল বলেছিলেন।
সকালে অবশ্য ফ্রিজ দেখে সর্বাণী বুঝেছিলেন ও খেয়েছে ঠিকই। পাউরুটির প্যাকেট খোলা, মাখন পড়ে আছে টেবিলে। দুধের গ্লাস সিঙ্কে নামানো, আইসক্রিমের থেকে স্ল্যাব কাটা, আপেল মনে হল একটা কম।
যাক। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হচ্ছিল না। তার ওপর ভাস্কর চক্রবর্তীর ব্যাপারটা বোধহয় বহুদিনের। শ্রীই প্রথম বলেছিল— খুব মিমি মিমি করে আদর করে, চকলেট আনছে, খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে, আমার ভাল লাগে না সর্বাণী।
—বলিস কী রে? বাবা অর্ধেক সময়ে থাকে না, মেয়েটা বাবাকে পায় না, একটা কাকু পেয়েছে বলে তো খুব খুশি ছিলি।
—তখন বুঝতে পারিনি। এখন কেমন সন্দেহ হয়। তখন মিমি ছোট ছিল। এখন বড় হয়ে গেছে, ওর বাবার বন্ধু ওর কাছে আসবে কেন। বল তো? আর আর্টিস্ট মানুষ ওর অত কী গল্প ওই একটুকরো মেয়ের সঙ্গে!
এমন নয় যে সবাই একসঙ্গে কোনও গল্পগাছা হত না। হয়তো শ্ৰী তিনি ভাস্কর সবাই আছেন, পঞ্চমী চা-টা দিয়ে গেল। মিমি ঢুকল একটা র্যাপ অন পরে, অক্সিডাইজ্ড্ দুল ঝুলছে কান থেকে—কাকু উ-উ—ব্যাগটা একদিকে চটি দুটো আরেক দিকে ছুড়ে ছুড়ে দিল। দুই গালে চকাস চকাস করে চুমু। ব্যস তারপরেই সে একা কথা বলবে কাকুর সঙ্গে। মা বা মাসি কথা বলতে চেষ্টা করলেই—দূর চলো তো আমার ঘরে কাকু। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাবে।
—আহ্, আহ্— কী হচ্ছে মিমি… এখানে তো বেশ সবাই গল্প হচ্ছিল।
—দূর যত বুড়োটে বুড়োটে গল্প।
—আমাদের বুড়ো বানিয়ে দিলি?
আহ্, আহ্, করলে কী হবে, ভাস্কর চলে ঠিকই যেতেন।
—ওপরে গিয়ে একবার দেখে আসব? শ্রী?
—শ্ শ্ শ্— শ্রী মুখে আঙুল রেখেছে। বলবে আমার ওপরে স্পাইগিরি করছ?
তখন সর্বাণী পঞ্চমীকে ডেকে মিমির খাবার, আর তার কাকুর জন্যে আরও এক কাপ চা ওপরে পাঠিয়ে দিতেন।
—পঞ্চমী, পায়ের শব্দ করতে করতে যাবি না। ভাল লাগে না।
পঞ্চমী নেমে এল, কাগজ দেখতে দেখতে খুব সহজ গলায় সর্বাণী বলতেন—কী করছে রে মিমি?
—ওহ, মিমির কথা আর বোলো না, বক বক বক বক। যত বকবকানি কাকুর সঙ্গে।
—শুয়ে পড়েছে বোধহয় মিমি।
—না তো! খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে বক্ বক্…।
দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসতেন। শ্রী বলত— ওহ্ মিমিটা না!
সর্বাণী বলতেন— খাবার পছন্দ মিমির? ভাস্করবাবুকে চা-টা কোথায় দিলি?
—কোথায় আবার? পড়ার টেবিলে। ওখানেই তো বসে আছেন উনি। খাবার আবার পছন্দ হবে না, তুমি নিজের হাতে করেছ না? পুডিং তো আগে এক চামচ কাকুকে খাইয়ে দিল।
—ওঁকে তো এখানে সবই দিয়েছি।
—দিলে হবে কী! সে তো উনিও বলছেন। ও আহ্লাদি কি শুনবে?
এই রকম। শ্রী চলে যাবার পর বাড়াবাড়িটা নবগোপাল নিজের চোখে দেখলেন।
—আচ্ছা ভাস্কর তুই এখনও সেই রকম ইয়ে রয়ে গেলি? মিমিটা পাগলি বলে তুইও কি ওর সঙ্গে পাগল হলি৷ কোলে বসবে কী রে তোর? একুশ-বাইশ বছরের মেয়ে।
—একুশ-বাইশ? তোর মেয়ে দশ-এগারোর পর আর বাড়েনি।
—ঠিকই— চিন্তিত মুখে বললেন নবগোপাল। সিগারেট ধরালেন, তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন— বলেছিস ঠিকই। কিন্তু তুই তো আর নব কার্তিকটি নোস। বি কেয়ারফুল ভাস্কর। আই ডোন্ট লাইক হোয়াট আই সি।
সবটা মিমির সামনেই হচ্ছিল। মিমিকে শুনিয়েই।
ভাস্কর মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে হেলাফেলার সঙ্গে বলেছিলেন— দেখছিস মিমি। আর এসব মানায় না। বড় হয়ে গেছিস। বোঝ একটু!
তারপর একদিন নবগোপালের পুনর্লন্ডনযাত্রা। প্রতিদিন অবাধ্যতা, উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়ে যাচ্ছে যেন সর্বাণীকে দেখিয়ে দেখিয়ে। তিনটে ছেলে এল। ঘর বন্ধ করে তিনঘণ্টা কী করল কে জানে। দরজা খুলতে ভক ভক করে বিশ্রী সিগারেটের গন্ধ। আর তো সহ্য করা যায় না।
—মিমি! —ছেলে তিনটে চলে গেছে। তিনি ডাকলেন— মিমি!
চোখ তুলে তাকাল।
—কে ওরা?
—কে আবার? বন্ধু! তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল।
—দরজা বন্ধ করে রেখেছিলে কেন?
—বেশ করেছি।
—এখন বড় হয়ে গেছ, ছোটবেলার শাস্তিগুলো কিন্তু ভুলো না। আর একদিনও যেন না দেখি!
—কে? কে তুমি এসব বলবার? আমাকে!
—আমি কেউ হই বা না হই কথাগুলো শোনো। শুনে রাখো।
—আমার মায়ের জায়গা কেড়ে নিতে লজ্জা করেনি?
—মায়ের সঙ্গে দিনের পর দিন চূড়ান্ত অসভ্যতা করতে তোমার লজ্জা করেনি? মায়ের কথা তুমি বোলো না। তোমার এ সমস্ত নাটুকেপনা আমি বুঝি।
—লাগাবে? লাগাবে বোধহয় এবার বাবাকে! সৎ-মা গিরি শুরু হয়ে গেল। আমি এখানে থাকব না।
পরদিন সকালে দেখলেন নেই। সর্বনাশ!
তিনি হতভম্ব। চেনাশোনা যত বন্ধুর নম্বর ছিল তাদের ফোন করলেন, তনিকার কাছে যায়নি, রমিতার কাছে যায়নি, অর্ণব, সৌকান্ত, অনীশ কেউ জানে না, তিনি ভাবছেন— এবার পুলিশে খবর দেবেন নাকি। ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠল।
—আপনি কে আমি জানি না জানতে চাই না। আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর স্ত্রী। আপনাদের বাড়ির একটা শয়তান মেয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে থাকছে তার স্টুডিয়োতে। মিস্ট্রেস। জানালাম। যা বিবেকে বলে— করবেন।
যাক। এতদিনে ধাক্কা খেয়ে সেই ঘৃণ্য অধ্যায়টা শেষ হল।