এর পর তিনদিন কেটে গেছে
এর পর তিনদিন কেটে গেছে।
কাকাবাবু আর সন্তুর কলকাতায় ফেরা হচ্ছে না। কক্সবাজারে তাদের খাতিরযত্নের অন্ত নেই। যে ছেলেগুলোকে উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে নজনই বাংলাদেশের। বিভিন্ন জেলা থেকে এদের চুরি করা হয়েছিল। তাদের আনন্দের শেষ নেই। নিপু নামে ছেলেটির বাবা নিজে ছুটে এসেছেন এখানে, কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, রায়চৌধুরীদাদা, আপনি শুধু আমার ছেলেকে বাঁচাননি, আমার স্ত্রীকেও বাঁচিয়েছেন, ছেলের শোকে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে খাওয়াদাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে আমাদের বাসায় আপনাদের কিছুদিন থাকতেই হবে।
প্রতিদিন দু বেলাই খুব খাওয়াদাওয়া চলছে। দলে-দলে লোক আসছে কাকাবাবুকে দেখার জন্য। টুরিস্ট লজ ছেড়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোতে কাকাবাবু চলে এসেছেন আজ, সেখানে সহজে কেউ ঢুকতে পারে না।
মাস্টার নামে সেই লোকটিকে আর শেষপর্যন্ত সমুদ্রে ডোবানো হয়নি। তাকে ভয় দেখাবার জন্য একটা স্পিড বোটে চাপিয়ে মাঝসমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর চ্যাংদোলা করতে যেতেই সে শেষ মুহূর্তে ভেঙে পড়ল। হাউহাউ করে কেঁদে কাকাবাবুর পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমাকে বাঁচান, আমাকে দয়া করুন, আমি সাঁতার জানি না!
এখন তাকে রাখা হয়েছে জেলে। তার বিচার বাংলাদেশে হবে, না ভারতে হবে, তা নিয়ে তর্ক শুরু হয়ে গেছে। তবে জেলের প্রহরীদের যাতে সে সম্মোহিত না করতে পারে, সেই জন্য চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে তার।
জোজো প্রায় টানা ঘুমিয়েছে দুদিন। কিছু খেতেও চায়নি। আজ সকাল থেকে সে পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ফিরে এসেছে তার খিদে। সকালে লুচি, কিমার তরকারি ও ডাবল ডিমের ওমলেট খেয়েছে। আবার এগারোটার সময় তার খিদে-খিদে পাওয়ায় সে খেয়েছে চারটে রসগোল্লা, দুপুরে ভাতের সঙ্গে দুরকম মাংস আর তিনরকম মাছ, আর বিকেলে চায়ের সঙ্গে একটা পদ্মফুল সাইজের কেক।
সন্ধেবেলা বাংলোর দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করছে সবাই। এখান থেকেও সমুদ্র দেখা যায়। আস্তে-আস্তে রং পালটাচ্ছে আকাশের। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট জাহাজ, তার সারা গায়ে ঝলমল করছে আলো।
জোজো একটা সিল্কের পাজামা ও সিল্কের পাঞ্জাবি পরে একটা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে রয়েছে। ওই পোশাক সে উপহার পেয়েছে নিপুর বাবার কাছ থেকে, সন্তুও পেয়েছে অবশ্য। কাকাবাবু কারও কাছ থেকে কিছু নেন না। জোজো একটা ইংরিজি বই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আলমারি থেকে এনে পড়ছে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, রে জোজো, এই যে এতসব কাণ্ড ঘটে গেল, তোর মনে আছে কিছু?
জোজো বলল, মনে থাকবে না কেন, সব মনে আছে?
সন্তু বলল, তোকে কী করে ওই দ্বীপটায় নিয়ে গেল, তুই জানিস?
কামাল বলল, না, না, আর একটু আগে থেকে শুরু করো।
কাকাবাবু বললেন,। কাকদ্বীপে সেই তাঁবুতে আমরা সার্কাস দেখতে গেলাম–
সন্তু বলল, তার মধ্যে মানুষ অদৃশ্য হওয়ার খেলা, তুই উঠে গেলি, তারপর কী হল?
জোজো বলল, আমি অদৃশ্য হয়ে গেলাম! সন্তু, যাঃ, তা কখনও হয় নাকি?
জোজো বলল, তোরা বিশ্বাস করিস না। বলবি, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু পৃথিবীতে এখনও কত কী ঘটে যাচ্ছে, যার কোনও ব্যাখ্যাই পাওয়া যায় না। আমি সত্যি সত্যি অদৃশ্য হয়ে হাওয়ায় উড়তে লাগলাম।
সন্তু বলল, উড়তে লাগলি, মানে ঘুড়ির মতন?
জোজো বলল, ঘুড়ি কেন হবে? আমায় কেউ সুতো বেঁধে রাখেনি। পাখির মতন আমি যেদিকে খুশি উড়ে বেড়াচ্ছিলাম।
সন্তু বলল, তারপর আমরা যে তোর কত খোঁজ করেছিলাম, তুই সব দেখতে পেয়েছিলি?
জোজো বলল, হ্যাঁ। সব দেখতে পাচ্ছিলাম।
সন্তু বলল, দেখতে পেয়েও তুই আমাদের সঙ্গে কথা বলিসনি কেন?
জোজো বলল, বাঃ, অদৃশ্য হলে তো শরীরটাই থাকে না। মুখও থাকে। মুখ না থাকলে কথা বলব কী করে?
সন্তু বলল, মুখ না থাকলে তো চোখও থাকবে না। তা বলে তুই দেখতে পেলি কী করে?
কামাল হেসে ফেলতেই কাকাবাবু বললেন, এই সন্তু, তুই বাধা দিচ্ছিস কেন, ওকে সবটা বলতে দে! হা জোজো, বলো, তারপর কী হল?
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, অদৃশ্য হলে শরীর থাকে না, শুধু প্রাণটা থাকে। তাতে সব শোনা যায়, দেখা যায়, কিন্তু কথা বলা যায় না। সেইরকম উড়তে-উড়তে হঠাৎ একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম। মাঠের মধ্যে একটা বেশ বড় আর উঁচু রথ দাঁড়িয়ে আছে, সেটাও অদৃশ্য!
কামাল জিজ্ঞেস করল, রথ অদৃশ্য মানে?
জোজো বলল, অদৃশ্য মানে অদৃশ্য! অন্য কেউ সেটা দেখতে পাচ্ছে না। কেউ পাশ দিয়ে গেলে সেটার সঙ্গে ধাক্কাও লাগছে না। তখন আমি বুঝলাম, ওটা রথ নয়, একটা মহাকাশ রকেট, অন্য গ্রহ থেকে এসেছে। তার মানে বাইরে থেকে এরকম অনেক রকেট পৃথিবীতে আসে, অদৃশ্য হয়ে থাকে বলে আমরা কেউ টের পাই না। ওই ম্যাজিশিয়ানটা তো অন্য গ্রহের প্রাণী, মানুষ নয়, ইচ্ছেমতন মানুষের রূপ ধরতে পারে। রাত্তিরবেলা সেই ম্যাজিশিয়ান আর তার সহকারীও অদৃশ্য হয়ে গিয়ে সেই রকেটে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে আমিও।
সন্তু আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু বললেন, চুপ! বলো জোজো, দারুণ ইন্টারেস্টিং লাগছে।
জোজো বলল, তারপর অন্য একটা গ্রহে পৌঁছে গেলাম।
এবার কাকাবাবু নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, কতদিন লাগল?
জোজো বলল, অদৃশ্য রকেটের যে কী দারুণ স্পিড হয়, আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। এই যে আমেরিকানরা পাথফাইন্ডার নামে একটা রকেট পাঠিয়েছে মঙ্গল গ্রহের দিকে, সেটা পৌঁছতে সাত মাস সময় লাগবে। এই রকেটটা পৌঁছে গেল সাত ঘণ্টায়। কিংবা আট ঘণ্টাও হতে পারে, আমার হাতে তো ঘড়ি ছিল না। মাঝখানে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের চাঁদের পাশ দিয়ে সাত করে চলে গেল, এটা বেশ মনে আছে।
কামাল জিজ্ঞেস করল, সেটা কোন গ্রহ?
জোজো বলল, তা ঠিক বলতে পারছি না। হয়তো মঙ্গল গ্রহ হবে, সেটাই তো সবচেয়ে কাছে। আসলে ব্যাপার কী, এই যে মঙ্গল গ্রহ, বৃহস্পতি বা শনি, এই গ্রহদের আমরা নাম দিয়েছি, আমাদের দেওয়া এই নাম তো ওরা জানে না। ওরা অন্য নাম দিয়েছে। ওটা যদি মঙ্গল গ্রহ হয়, সেটার নাম ওরা দিয়েছে ককেটু।
হেসে ফেলতে গিয়েও চেপে গিয়ে সন্তু বলল, ককেটু? বেশ নাম।
জোজো বলল, এই যে আমরা আমাদের গ্রহের নাম দিয়েছি পৃথিবী, সেটা তো ওরা জানে না। ওরা পৃথিবীকে বলে গিংগিল!
কাকাবাবু নিজেই হাসতে-হাসতে বললেন, গিংগিল, বাঃ এটাও বেশ ভাল নাম। তারপর তোমার ককেটু কেমন লাগল?
জোজো বলল, যেই ওখানে পৌঁছলাম, অমনই অদৃশ্য থেকে দৃশ্য হয়ে গেলাম। মানে শরীরটা ফিরে এল। আর শরীরটা ফিরে আসামাত্র খিদে পেয়ে গেল।
কাকাবাবু বললেন, প্লেনে যাওয়ার সময় যেমন কিছু খেতে দেয়, তেমনই রকেটে কিছু খাবারদাবার দেয়নি?
জোজো বিজ্ঞের মতন মাথা নেড়ে বলল, আবার ভুল করছেন, কাকাবাবু। অদৃশ্য অবস্থায় মুখই তো থাকে না, তখন খিদে পেলেও কিছু খাওয়ার উপায় নেই।
কাকাবাবু বললেন, তাই তো, ঠিকই! আমারই ভুল। ওরা খেতে দিল? কী খেতে দিল?
জোজো বলল, ভাত খায় না। ভাত কাকে বলে জানেই না। রুটিও চেনে। চাওমিন খায়, অনেকটা চাওমিনের মতন আর কী! তার সঙ্গে একটা মাংস মিশিয়ে দেয়, সেটা কীসের মাংস ঠিক বুঝতে পারিনি। ইমপোর্ট করে আনে। মানে, অন্য গ্রহ থেকে নিয়ে আসে। চমৎকার খেতে, মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। ওদের সব শহর মাটির নীচে। ওপরটা তো খুব গরম। মাটির নীচে বেশ ঠাণ্ডা। ওখানকার প্রাণীরা খুব উন্নত, সায়েন্সের আবিষ্কারে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছে। যাতায়াতের অনেক সুবিধে। আমাদের এই যে মোটরগাড়ি, বাস, ট্রেন, এসব কিছু নেই। প্রত্যেকে হাতের সঙ্গে দুটো ডানা লাগিয়ে নেয়, তাতে যন্ত্র ফিট করা আছে, সাঁ করে উড়ে যাওয়া যায়। সবাই উড়ে বেড়ায়, কোনও অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার চান্স নেই, কী সুন্দর দেখায়, মনে হয়, সবাই যেন দেবদূত। আমি যখন উড়তাম, আমাকেও নিশ্চয়ই দেবদূত বলেই মনে হত!
সন্তু বলল, ছবি তুলে আনিসনি? ইস!
জোজো বলল, ওখানে আমার বেশ ভাল লাগছিল। প্রাণীগুলো খুব ভদ্র। কেউ খারাপ ব্যবহার করে না। তাই আমি ওখানে থেকে গেলাম!
সন্তু বলল, থেকে গেলি কী রে? আমরা তো তোকে পেলাম এখানকার একটা দ্বীপে।
জোজো বলল, হ্যাঁ, বলছি, বলছি। থেকেই গেলাম, মানে কয়েকটা দিন। তারপর একটু একঘেয়ে লাগতে লাগল। ওরা তো তরকারি, শাকসবজি খায় না। আমার বেগুনভাজার জন্য মন কেমন করত। খালি মনে হত, কতদিন বেগুনভাজা খাইনি। আর একটা মুশকিল, ওরা নুন খেতে জানে না। সব খাবার আলুনি। সে কি বেশিদিন খাওয়া যায়? আমাকে পৃথিবী থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললে কিন্তু ওরা রাজি হয় না। একটা ভূমিকম্পে ওদের অনেক লোক মারা গেছে বলে ওরা অন্য গ্রহ থেকে তোক ধরে নিয়ে যায়। তখন আর আমি কী করি, একদিন চুপিচুপি ওদের একটি রকেট হাইজ্যাক করলাম। তা ছাড়া ওদের কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করেছিলাম যে, ওরা গিংগিল গ্রহ থেকে কয়েক লক্ষ মানুষকে ধরে নিয়ে যাবে। তা ওরা পারে। ওদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত, ওরা লড়াই করতে চাইলে পৃথিবীর লোক পারবে না, হেরে যাবে। তাই আমার মনে হল, তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে সাবধান করে দেওয়া দরকার। দুটো লোক একটা রকেটের মধ্যে বসে কীসব করছিল, আমি ক্যারাটের পাচে তাদের কাবু করে ফেলে দিলাম নীচে। তারপর রকেটটা নিয়ে সোজা একেবারে আকাশে। ওই রকেট চালানো খুব সোজা, সব প্রোগ্রাম করা থাকে, পরদায় ফুটে ওঠে মহাকাশের ম্যাপ, তাই পৃথিবী খুঁজে পেতে দেরি হল না। জানিস সন্তু, মহাকাশ থেকে পৃথিবীর চাইনিজ ওয়াল দেখা যায়, আইফেল টাওয়ার দেখা যায়, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, আমাদের তাজমহলও দেখা যায়। মুশকিল হল, ল্যান্ড করব কোথায়, কীভাবে ল্যান্ড করব, সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। রকেটের মধ্যে ঢোকামাত্র আমি আবার অদৃশ্য, তার মানে শরীরটা নেই। এটা ওরা ভাল বুদ্ধি বার করেছে, অদৃশ্য হয়ে থাকলে জবরজং পোশাক পরতে হয় না, অক্সিজেনেরও সমস্যা নেই।
পৃথিবীতে ফিরে শরীরটা আবার ফিরে পাব কি না সেটাও ভাবছিলাম। ল্যান্ড করার উপায় না পেয়ে পড়লাম এসে সমুদ্রে। রকেটটা চুরমার হয়ে গেল, আমি একটু আগে লাফিয়ে পড়েছিলাম বলে আমার লাগেনি। জলে ভাসতে-ভাসতে হাতে চিমটি কেটে দেখলাম লাগছে কি না। এত জোর চিমটি কেটেছি যে, নিজেই উঃ করে উঠেছি। তার মানে শরীরটা ফিরে এসেছে। ব্যস, তারপর আর কী, সমুদ্রে সাঁতার কেটে, থুড়ি, ঠিক সাঁতরে নয়, রকেটের একটা ভাঙা টুকরোয় চেপে পৌঁছে গেলাম একটা দ্বীপে। সেখানে একটা সাদা বাড়ি ছিল, ঢুকে পড়লাম তার মধ্যে। সেখানে তোদের সঙ্গে দেখা হল!
সবাই কয়েক মুহূর্ত চুপ। কামাল এরকম গল্প বলতে কাউকে আগে দেখেনি, জোজোকেও সে চেনে না। সে আর কথা বলতেও ভুলে গিয়ে হাঁ করে শুনছিল। সন্তু জোজোর কোল থেকে বইটা নিয়ে নাম দেখল। এইচ জি ওয়েল্স-এর লেখা ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস। সন্তু জোজোর চোখের দিকে চেয়ে দুবার মাথা নাড়ল। তারপর বলল, জোজো, তুই আমাকে আর কাকাবাবুকে কী যে বিপদে ফেলেছিলি, সেসব তোর মনে নেই?
এই প্রথম জোজো হকচকিয়ে গিয়ে বলল, তোদের বিপদে ফেলেছি? সে কী! তোর কথা আলাদা। কিন্তু কাকাবাবুকে আমি ইচ্ছে করে বিপদে ফেলব, তা কখনও হতে পারে? অসম্ভব! কী হয়েছিল বল তো?
কাকাবাবু বললেন, আহা, ওসব কথা এখন থাক। এতক্ষণ জোজোর ব্রেন ওভারটাইম খেটেছে, ওকে এখন একটু বিশ্রাম করতে দে।
কামাল এবার ধাতস্থ হয়ে বলল, যা বলেছেন! সমস্ত ব্যাপারটাই এখন ধাঁধার মতন। আচ্ছা কাকাবাবু, আপনার ব্যাপারটাও পুরোটা শোনা হয়নি। আপনাকে সমুদ্রে ফেলে দিল, সেখান থেকে বাঁচলেন কী করে? সেটাও কি মিরাল?
কাকাবাবু হেসে মাথা দোলাতে-দোলাতে বললেন, সেসব কিছু নয়। একটা ভাগ্যের ব্যাপার আছে বোধ হয়। আমার বাঁচার কথা ছিল না। খোঁড়া। মানুষ, প্যান্ট-কোট-জুতো-মোজা পরা। তার ওপর আবার অন্ধকার, কোনদিকে যাচ্ছি বোঝার উপায় নেই, এই অবস্থায় কতক্ষণ সাঁতরে বাঁচা যায়? একটা লঞ্চ আমার কাছ দিয়ে চলে গেল, আমাকে দেখতে পেল না। তখনই বুঝলাম আর আমার বাঁচার আশা নেই। তার একটু পরেই সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল, আর পারছি না, সমুদ্রের নীচে গিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে, চিরঘুম যাকে বলে। আমি চিত হয়ে ভাসছিলাম তো, হাত-পা চালানো বন্ধ করে দিতেই শরীরটা সোজা হয়ে ড়ুবতে লাগল…
থেমে গিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী হল বলো তো?
কামাল বলল, কোনও ফেরেশতা এসে আপনাকে বাঁচাল?
কাকাবাবু বললেন, বিপদের সময় যে বাঁচায়, তাকেই দেবদূত মনে হয়। তখনও সেরকম কেউ আসেনি। এর পর যা হল, সেটাই মিরাল বলতে পারো। শরীরটা সোজা হওয়ার পরই পায়ে কী যেন ঠেকল। প্রথমে মনে হল, হাঙর কিংবা তিমি নাকি? তা হলেই তো গেছি। তারপর বুঝলাম, মাটি। আমার পায়ের নীচে মাটি! সেখানে পানি বেশি না। সমুদ্রের মাঝে-মাঝে এরকম চড়া পড়ে। আস্তে-আস্তে সেখানে একটা দ্বীপ হয়ে যায়। জোয়ারের টানে আমি একটা চড়ায় এসে ঠেকেছি। সেখানে আমার বুকজল মাত্র। দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর ঘুমোনো হল না, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কেটে গেল সারারাত। ভেবে দ্যাখ দৃশ্যটা, চারপাশে সমুদ্র, তার মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সকালের দিকে ভাটা শুরু হতে পানি আরও কমে গেল। একটু বেশি বেলা হওয়ার পর একটা ভটভটি নৌকো তুলে নিল আমায়।
কামাল জিজ্ঞেস করল, অদ্ভুত আপনার ভাগ্য। তারপর কী করলেন?
কাকাবাবু বললেন, ভাবলাম, একা-একা ওই দ্বীপে ফিরে গিয়ে কী করব? রিভলভারটাও তো নেই। ওখানে অনেক লোক, আমাকেও লোকজন সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। ভটভটিটা আমাকে কক্সবাজার পৌঁছে দিল। সেখানে থানায় গিয়ে সাহায্য চাইলাম, তারা তো আমার কথা বিশ্বাসই করতে চায় না। প্রথমে আমাকে পাগল ভেবে হাসছিল। আমার ক্রাচ নেই, লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল, তাতে হাস্যকর দেখায় ঠিকই। সেদিনটা আবার শুক্রবার, শুক্রবার ছুটির দিন এ-দেশের সব দোকানপাট বন্ধ থাকে। ক্রাচ পাব কোথায়? একটা লোককে ধরে বাঁশ দিয়ে কোনওরকমে একটা ক্রাচ বানিয়ে নিলাম। তারপর ঢাকায় সিরাজুল চৌধুরীকে ফোন করলাম, তিনি সব শুনে থানাকে নির্দেশ দিলেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। তাও থানার অফিসার বলে যে একজন মন্ত্রী এসেছেন শহরে, পুলিশরা সবাই ব্যস্ত। ব্যাপারটার গুরুত্বই বুঝতে পারছে না। এত মানুষের জীবন বিপন্ন! যাই হোক, অনেক বুঝিয়ে চারজন পুলিশ পেয়েছিলাম, আর একটা ভাঙা লঞ্চ!
কামাল বলল, আপনি যে ওদের বলেছিলেন, আর একটা আর্মির জাহাজ পঞ্চাশজন সৈন্য নিয়ে একটু পরেই আসছে, সেটা গুল?
কাকাবাবু সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, মাঝে-মাঝে ওরকম গুল মারতেই হয়! কোথায় আর্মি? তারা আমার কথা শুনবে কেন? আমি বিদেশি না? যাই হোক, কাজ তো উদ্ধার হয়ে গেল! ওই মাস্টার লোকটা পাগল হলেও অন্যদিকে বুদ্ধি আছে। কীরকম একটা বোমা বানিয়েছে, যা দিয়ে মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান করে রাখা যায়! ওটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
তারপর জোজোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, জোজো, তোমাদের উদ্ধার করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে কে জানো? অনেকেই সাহায্য করেছে, যেমন ধরো কামাল, সে যদি আমাদের নিয়ে না যেত, আমরা নিজেরা অতদূরে যেতে পারতাম না। সে যথেষ্ট সাহসও দেখিয়েছে। তারপর স্পিডবোট চালক আলি, সে আমাদের দ্বীপটা চিনিয়েছে। আমাদের জন্য সে বিপদেও পড়েছিল। এবারে আমি বিশেষ কিছু করিনি, কিন্তু সন্তু, সন্তু যদি ঠিক সময় গুলি না করত, তা হলে ওই লোকটা তলোয়ারের এক কোপে আমার মুণ্ডুটা কেটে দিত। মুণ্ডু না থাকলে কতরকম অসুবিধে বলো তোর আমার মুণ্ডুটা না থাকলে ওই মাস্টারটার ঘোরও কেটে যেত, সে তখন আবার নিজ মূর্তি ধারণ করত। সন্তু খুব জোর বাঁচিয়েছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে একটি মেয়ে। তার নাম অলি। ভালনাম রূপকথা। সেরকম মেয়ে দেখা যায় না, অপূর্ব মেয়ে। কলকাতায় গিয়ে আলাপ করিয়ে দেব।
কাকাবাবুর চোখে ভেসে উঠল অলির কান্না-ভেজা মুখ। এর পরে একবার তাকে কোথাও নিয়ে যেতে হবে, তিনি কথা দিয়েছেন।