জলকেলি
বান্ধবীরা জোর সুপারিশ করে চলেছে। মার্সি কর সেঁজুতি! বেচারা নাফিসের হৃদয়খানি যে তোরই তরে অহর্নিশ অতীব অধীর। সেমিস্টারের শুরুটা হতে না হতেই প্রথম দর্শনেই প্রেমাহত। ভর্তি হয়েই কোন সুন্দরী সহপাঠিনীর প্রেমে গড়াগড়ি যেতে হবে এমনি প্রতিজ্ঞা হৃদয়ে বহন করেই বুঝি ভার্সিটি চত্বরে পা রেখেছে এই প্রেমিক প্রবর। জানা গেছে অনেক বড়লোকের ছেলে। নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে ক্লাসে আসে। সুদর্শন স্মার্ট চৌকস। মেধাবীতো বটেই। নইলে এই নামী দামী ডিপাটমেন্টে ভর্তি জুটলো কেমন করে ? আজকাল অবশ্য যদিও নিয়ম কানুন পাল্টে গেছে। মেধা-টেধার বালাই না থাকলেও চলে। নব্য ধনীদের বখে যাওয়া নন্দন হওয়াও এক ধরনের প্রিকোয়ালিফিকেশন। ভর্তি জুটে যায়।
ঘটনাক্রমে কোর্স সিলেকশনের হেরফেরে শেষ বর্ষের এই সেমিষ্টারে নাফিস আর সেঁজুতি একই ক্লাসে।
তো এই মজনুকে নিয়েই শুরু হোক তবে সেঁজুতি বিনতে রাহমানের ভার্সিটির শেষ বর্ষের জলকেলির ইনিংস! সেঁজুতির এই মৎস্য হরণ ক্রীড়া শৈলীর শুরুটা হয় সেমিস্টারের গোড়ার দিকটায়। নতুন ক্লাসের এক দঙ্গল ছেলের মাঝ থেকে একটা দু’টো জেনুইন মজনু বেছে নিতে খুব একটা সময় লাগে না সেঁজুতির। কয়েশ সপ্তাহ ধরে চলে আন্ডার কাভার রিক্রুটমেন্ট প্রসেস। এ বছর অবশ্য নাফিস মিঞা যেন মেঘ না চাইতেই অঝোর বরিষণ। ভালো কেস। খেলাটা জমবে ভালো। এ খেলার ইন্টেনসিটিটা ম্যাদা গোছের হলে বেশি যুৎ লাগে না সেঁজুতির। অভিজ্ঞতা তো কম হলো না। কলেজের প্রথম বছর থেকেই প্রতি বছর একটি মৎস্য হরণ সেঁজুতির প্রিয় স্পোর্টস। ভার্সিটিতে এটা শেষ বর্ষের শেষ ইনিংস । দরকার একটা যুৎসই গেম প্ল্যান। মনে মনে স্ট্রাটেজির জাল বোনে সেঁজুতি। এই নাফিস জাতীয় মজনুদের বড়শি গাঁথা করে ফেলতে আয়াস প্রয়াস তেমন বেশি লাগে না। একটুখানি আয় আয় তু তু। কিঞ্চিত ইনিবিনি সংলাপ। চকিতে বাঁকা চোখের ঠারঠোর। প্রসাধিত ঠোঁটের আঁকেবাঁকে এক আধটু ঢেউ খেলানো হাসি। ব্যাস। দেখতে দেখতেই ঘটে যায় মজনু মিঞাদের সটান ভূপতন।
হাফ ডজন চ্যাংড়া বান্ধবী নিয়ে একটা মোর্চা গড়ে নিতে হয়। প্রথম দিকে ফ্রন্ট লাইনে নিজে বড় একটা থাকেনা। সেঁজুতি আসরে নামে মিডিল অর্ডারে। ছিপটা থাকে সখীদের হাতে। সে শুধু আড়ালে বসে খেলে যায় অঙ্গুলি হেলনের নিঠুর খেলা। তাতে অসুবিধেও যে নেই এমন নয়। শালীদের কেউ কেউ আবার জলকেলির মাঝ পথেই ধুম করে সাবজেক্টের প্রেমে পড়ে যায়। ডাবল ক্রসিং করে। ডুবে ডুবে জল খায়। ধরা পড়ে কেঁদে ভাসায় । আর হবে না সেঁজুতি আপু! এবারের মতো মাফ করে দাও!
খেলার শুরুতে মৎস্যকুলের হত্যে দিয়ে পড়ার মতো সুস্বাদু সুগন্ধি টোপ থাকে। বড়শি থাকে রেজর শার্প। ওয়েইটিং টাইম নেই বললেই চলে। দেখা মাত্র প্রেমিক মৎস্য বিশাল হা করে পুরোটা টোপই গিলে ফেলে। বড়শিটা বেশ আঁটোসাটো গাঁথে একেবারে হৃদপিন্ডের মধ্যিখানে। বড়শি গাঁথা মৎস্য প্রবরকে সহসাই ডাঙায় তোলা হয় না। জলের তলে খেলানো হয় সূতা ছাড়া সূতা টানার দীর্ঘ খেলা। হয়রান হয়ে যায় প্রেমিক মাছ। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে ধরে টান। প্রাণ হয়ে ওষ্ঠাগত। পুলকিত সেঁজুতি সম্রাজ্ঞী সম্মুখে হাঁটু গেড়ে নতজানু হয় মৎস্য নাবিক। আর যে পারিনে রূপসী। এবার দয়া কর দয়াবতী। তুলে নাও প্রসারিত প্রশস্ত ডাঙায়। আশ্রিত কর তোমার ঐ নিটোল নিভাঁজ চড়াই উৎরাইয়ের খাদে খন্দরে। নইলে যে প্রাণে বাঁচিনে প্রিয়ে! এখানে পৌছে কিঞ্চিৎ দম থাকলে কোনও কোনও মৎস্য কানসা ছিঁড়ে দৌড়ে পালায়। দম ফুরিয়ে যাওয়ায় চিৎ কাত চিৎ কাত হয়ে ডুবে যায় জলের অতল তলায়।
সিমি সিরহান এসে অভিযোগ করে।
-তুই এমন নিষ্ঠুর কেন লো সেঁজুতি? নাফিসটা যে নিশিদিন হাসফাস করে মরছে। আর তুই কিনা একটুও রেসপন্ড করছিস না। আহা! কি অবস্থা বেচারীর! ধরাতলে গড়াগড়ি। মার্সি কর সেঁজুতি!
সেঁজুতির ভালো লাগে। পদপ্রান্তে পতিত পুরুষের আকুলি বিকুলি কোন রমণীর ভালো না লাগে? পুলকে ভরে ওঠে সে। সিমি বলে- নাফিস নাকি এখন অহোরাত্রি সেঁজুতি সিনড্রোমে কাতর। সেঁজুতি খুশি হয়। ভাবে নাফিস মিঞার শ্বাস কষ্ঠের ব্যারোমিটারের পারদ নাভিশ্বাস পর্যন্ত যাক। তারপর দু’হাতে চটকানো যাবে বেশ। পুরুষের নাকে মূলো ঝুলিয়ে দেওয়ার কৌশলটা ভালই জানে সেঁজুতি। সিমিকে ভরসা দিয়ে বলে,
– আই শিউর লাইক হিম সিমি। নাফিসকে বলিস আমি তো আছিই। সবই হবে। সময় আসুক না।
মনে মনে ভাবে সময়তো আসবেই । আহ! বহুত মজাদার হবে মৎস্য নিধনের শেষ রজনী। পুলকিত বোধে খিলখিলিয়ে ওঠে নিপুন শিকারী সেঁজুতি বিনতে রাহমান।
এমনি করেই ভার্সিটির বর্ষ শেষের ক্লাসটি শেষ হয়ে গেল সেদিন। জন্মদিনের পার্টি দিয়েছে নাফিস। শহরের সেরা ভেন্যু শৈবাল পান্থশালায়। বন্ধু বান্ধবী নিয়ে সমারোহে পালিত হবে নাফিসের জন্মদিন। সেঁজুতি অবশ্যই আমন্ত্রিত। সিমি বলে তুইইতো ঐ সন্ধ্যার মক্ষীরাণী, সেজু। সেঁজুতি ভাবে নাফিসের এই আয়োজনে নির্ঘাত ওর নিবিড় নৈকট্য লাভের কৌশল বই আর কিছু নয় । শৈবাল পান্থশালার আলো আঁধারি করিডোরে কিংবা নির্জনে আড়াল খুঁজবে নাফিস? লুকিয়ে ছুঁয়ে দেবে নাকি দু‘একবার ? ছুঁক ছুঁক করবে বিগলিত স্ত্রৈণের মত ? নাকি পান্থশালার অপেরা হাউসে সেঁজুতি সম্রাজ্ঞীর সন্মুখে নতজানু হবে অনুগত নাবিক কলম্বাস, নাফিস ?
এই সুন্দরী! প্রসাধনী টেবিলের আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেওয়া প্রিয় নামে ডাকতে ভালো লাগে সেঁজুতির। মাল তুই মন্দ নোস ছেমড়ি! এখানটায় আরেকটু মাংশের পোঁচ। এখানে একটু খাঁজ। এই ঢালুতে একটা বাঁক। এই জায়গাটা আরেকটু খাড়া। এই বাঁকে আরেকটু টান। ব্যাস। সাক্ষাৎ ঐশ্বর্য রাই! মন খারাপ করিসনে বালিকে। বাকী ফাঁকটুকু ম্যানেজ হয়ে যাবে চতুর মেক আপের ক্যামোফ্লেজে। মৎস্য হরণের অস্ত্র ভাণ্ডার কি তোর কম কিছু ? দ্যাখ দ্যাখ সেঁজুতি! এই হলো তোর বড়শির বাঁক। কী সুঁচালো দেখেছিস? এইটা ছিপ। এইটা সুতো। এইটা ফাতনা। আর এই যে এইসব এরা হলো নানা মাপের সুস্বাদু সুপেয় টোপ। ইশ! নিজেরই লোভ হয়। মৎস্যকুলের কী দোষ ?
মোবাইল বেজে চলেছে অনেকক্ষণ। মাঝে একবার থেমে গিয়ে আবার বাজতে শুরু করেছে। সেঁজুতি দেখেছে। মোবাইলের লাল দোপাট্টার সুশ্রাব্য রিংটোনে নাফিস মিঞার আকুতি। বেজে যাক আরও কিছু কাল। প্রতীক্ষা নাকি মৃত্যুর চেয়েও দুর্বহ। নাকি জীবনের মত মধুর? শৈবল পান্থশালার প্রবেশ দ্বারে এক দুঃসহ দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রিলিউডই হোক নাফিস নওয়াজের স্বেচ্ছা মরণের সুপেয় এ্যাপিটাইজার। বাসা চিনেনা নাফিস। লোকেশন জানতে চাইবে নিশ্চয়ই। সেঁজুতির প্রসাধিত ঠোঁটের বাঁকে বিজয়িনীর ক্রুর হাসি। সেঁজুতি নিশ্চিত নিজের গাড়িতে পাশে বসিয়ে ড্রাইভ করে আজকের পার্টিতে নিয়ে যাওয়ার দুর্লভ সুখ চাইবে নাফিস। বেচারার এত দীর্ঘ প্রত্যাশার মিশন সেঁজুতি। এইটুকু ছাড় তো দেওয়াই যায়। মোবাইলের রিসিভ বোতামে আঙুল ছোঁয়ায় সেঁজুতি।
-হ্যালো
-হ্যালো সেঁজুতি!
-বলছি। বলুন নাফিস।
-আজকের পার্টির কথা মনে আছে তো?
অবশ্যই! তৈরি হয়েই আছি। নিতে আসছেন কখন?
নাফিস কিছুক্ষন চুপ করে থাকে।
– একটা প্রবলেম হয়ে গেছে সেঁজুতি।
– প্রব্লেম?
– হ্যা। হঠাৎই কোলকাতা থেকে আমার এক বন্ধু এসেছে আজ বিকেলে।
– আপনি বিজি থাকলে অসুবিধে নেই। আমি উবার নিয়ে চলে আসছি।
– শৈবালের আসন সংখ্যা যে সীমিত সেঁজুতি! ওনলি ফিফটি। ওরা কোনও এক্সট্রা সীটিং এ্যালাউ করে না!
– তার মানে?
– আপনি নাহয় এক কাজ করুন সেঁজুতি। আরেক দিন আসুন। একসাথে লাঞ্চ কিংবা ডিনার করা যাবে?
নাফিসের টেলিফোনে এক ঝাঁক মেয়েলি হাসির হল্লা ভেসে আসে। সিমির কন্ঠ সে স্পষ্ট শুনতে পায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সেঁজুতি। বুঝে ফেলেছে এটা নাফিসের ঠাট্টা নয়। বরফ শীতল নিষ্ঠুর হেলাফেলা। শী হ্যাজ বিন ডাম্পড্! সেঁজুতি আর কোনও কথা না বলে মোবাইল অফ করে দেয়।
শেষ বর্ষের রেজাল্টের এই বেরোই এই বেরোচ্ছি সময় এটা। প্রতিদ্বন্দীদের অবস্থান খুব কাছাকাছি হলেও আগের সবগুলো পরীক্ষায়ই টপ পারফরম্যান্স সেঁজুতির। টার্মিনাল কম্প্রিহেনসিভগুলোও অনেক ভালো হয়েছে। সেঁজুতি নিশ্চিত প্রথম স্থানটি যথারীতি ওর জন্যেই বাঁধা থাকছে। বেরিয়েও গেল রেজাল্ট একদিন। নাফিস নওয়াজ প্রথম। সিমি সিরহান দ্বিতীয়। আর তৃতীয় স্থান নামক উচ্ছিষ্ট বোন প্লেটটি পড়ে আছে সেঁজুতি বিনতে রাহমানের জন্যে! অবিশ্বাস্য লাগছিল সেঁজুতির। অর্থনীতি ডিপার্টন্টের নোটিস বোর্ডের অক্ষরগুলো চোখের সামনে ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছিল । নাফিস সিমিরা তখন করিডোর মাতিয়ে সেলিব্রেট করছে। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে চোরের মতো বাসায় ফিরে এলো সেঁজুতি। ডিপার্টমেন্টে এ বছর দুটোই মাত্র স্কলারশীপ। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেসে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স প্রোগ্রাম লিডিং টু পিএইচডি। স্বভাবতই পারফরম্যান্সের ক্রমানুসারে একটা নাফিসের আরেকটা সিমির।
সেঁজুতির পিএইচডির স্বপ্ন গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশে গেছে। জলকেলির শেষ ইনিংসে সেঁজুতি বিনতে রাহমানের কোনও রান নেই। ক্লিন বোল্ড! রূপের অহম আর মেধার গর্ব মাথা গুলিয়ে দিয়েছিল। আত্মবিশ্বাসের সীমা আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছিল। অন্য কাউকে দোষ দিও না সেঁজুতি। ইউ ডিজার্ভড ইট অল! কী সেঁজুতি, মনটা বুঝি কাদার মত নরম আজ ? অভিমানী আষাঢ়ের আকাশের মতো ক্রন্দসী ? একটুখানি ঠোকা ঠোক্করেই মুহূর্তে অঝোর বর্ষণের মতো ? জীবনে এই প্রথমবার নিজেকে নির্দ্বিধায় আসামির কাঠগড়ায় তুললে, তাই না ? পুরুষকুলের সাথে এই মৎস্য নিধন ক্রীড়ার নেশা কবে মিশে গিয়েছিল মনস্তত্ত্? সেই ছোটবেলায় কি ? সঙ্গী সাথীদের কারণে অকারনে ঠকানোর সুখবোধ। পুরুষ অবজ্ঞায় পরম পুলক। নিষ্ঠুরতায় আনন্দ। এই দুর্বিনীত অহমের উৎস কি এই উর্বশী রূপ ?
নিজের ঘরে একাকী বসেছিল সেঁজুতি। আব্দুলের মা এসে চা দিয়ে গেল। বলে গেল বাবা ডেকেছেন। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ডক্টর মোস্তফা আব্বুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিশ্চয়ই আব্বু এতক্ষণে রেজাল্টের খবরটা পেয়ে গেছেন। বাবার স্টাডি রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায় সেঁজুতি।
– ডেকেছ আব্বু ?
চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে তাকিয়ে ওখান থেকেই ভারী গলায় বাবা বললেন,
– মাস্টার্সের রেজাল্ট তো তোর আজ সকালেই বেরিয়ে গেছে। আমাকে এখনো বলিসনি যে!
সেঁজুতি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও কথা বলে না। কীইবা আছে বলার!
– শেষ পর্যন্ত থার্ড প্লেস পেলি সেঁজুতি!
আব্বুর কন্ঠটা কি দুঃখে ভরা? নাকি একটা প্রচ্ছন্ন কটাক্ষ মেশানো? বাবার সামনে সতত মুখরা সপ্রতিভ সেঁজুতির এই প্রথম নিজেকে ভীষণ আনস্টেবল লাগছে। সব শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। বাবাকে এখন অনেক দূরের মানুষ মনে হচ্ছে। হঠাৎই সেঁজুতির ভেতর একটা বিদ্রোহ মোচড় দিয়ে ওঠে। অজান্তে সে ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে। বাবার দিকে চেয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
– আমার র্থাড প্লেসে তুমি খুশি হতে পারনি আব্বু তাই না ? অনেকের আব্বুরা তো ফিফথ প্লেস টেনথ প্লেস পেতেই কত খুশি। সবাই কি ফার্স্ট প্লেস পায় আব্বু ? আমিতো সর্বকালের সর্বজয়ী কেউ নই। আমাকে নিয়ে তুমি অত বেশি এক্সপেক্ট করতে গিয়েছিল কেন ?
বাবা বুঝলেন মেয়েকে আঘাত দিয়ে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন,
-স্যরি। আমি ঐরকম কিছু ভেবেতো কথাটা বলিনি! আদরে হাত বাড়ালেন মেয়ের দিকে।
-আয় আমার কাছে, আয় মা!
পায়ে পায়ে বাবার কাছে এগিয়ে যায় সেঁজুতি। বাবা মেয়েকে বুকে টেনে নেন। বাবার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে সেঁজুতি। নিবিড় স্নেহে মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেন বাবা। বাবার বুকটা হু হু করে ওঠে। মা মরা এই মেয়েটা এমন করে তো কখনো কাঁদেনা!
ক্রাইসিসটা পেরিয়ে একটু একটু করে থিতু হয়ে আসছে সেঁজুতি। ক্রাই বেবি হয়ে বসে থাকা তো তোমার ধর্ম নয় সেঁজুতি বিনতে রাহমান। সৌরভ গাঙ্গুলির জেদ আর প্রত্যয়তো তোমারও আছে। একটা ইনিংসের পরাজয়ই তো আর পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া নয়। এমন তো নয় যে হার্ভার্ডের মাস্টার্সই ছিল তোমার পর্যটনের শেষ ট্রেন। দীর্ঘজীবি হও নাফিস। সামনে আছে আরও একটা সিরিজ। অসাবধানে লাইনের বাইরে গিয়ে তোমার একটি চতুর বোলিংয়ে আউট হয়ে গেছি। পতনের সেই ধ্বংসাবশেষ থেকেই রিবিল্ড করবো আমি। দ্রুত ফিরে যাবো ফর্মে। পরের ইনিংসে কী বল নিয়ে মাঠে নামবে, নাফিস ? স্পিন পেইস দোসরা গুগলি ? তোমার ফিল্ডার্সদের তৈরী করে এনো নাফিস নওয়াজ। মুহুর্মুহু ছক্কার মারে মাথায় দেব ভিরমির খেল!
মাথাটা একটু হালকা করা দরকার। বেশ ক’দিন বাইরে যাওয়া হয়নি। মিল্কি মুনকে ফোন করলে কেমন হয় ? ফোন পেয়ে হই হই করে উঠলো মিল্কি।
– এই যে মাল! একেবারে যে হাপিস মেরে আছিস! এত ভালো রেজাল্ট করলি! আমার মিষ্টি কই ? তোর জলকেলির উপাখ্যান কোথায় গড়ালো রে ?
– টোটাল ডিজ্যাস্টার মিল্কি! তোকে বলছি সব। বাসায় আছিস ?
– হ্যা, আসবি? আয় আয়। এক্ষুনি চলে আয়!
দুই বান্ধবী বিছানায় বসে গল্প জুড়ে দেয়।
– আমার বড় দুর্দিনরে সেঁজু! ছাত্র জীবনটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল! এম এ পাশ করা হয়ে গেছে। জনক জননী আমার মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কাল ক্ষয় না করে আইবুড়ো কন্যাকে এখনি পাত্রস্থ করা জরুরী। কী যে একেকটা ক্ষেত খামার ধরে নিয়ে আসে! ভার্সিটিতে পড়ার সময় কেন যে প্রেমে পড়লাম না। তোর কাছে প্রেম করার মতো কোন পোলা আছে সেঁজু ? আমি প্রেম করমু!
মিল্কির মুখে কৃত্রিম দুঃখের ছায়া । হেসে গড়িয়ে পড়ে দুই বান্ধবী।
– নাফিসকে নে না! ও তো মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়তে মুখিয়ে থাকে।
সুপারিশ করে সেঁজুতি।
– যাহ! নাফিসতো তোর হবু বর। ওকে নেব কেমন করে ?
– কী বলিস যা তা !
-কেন এই একটু আগেই তো সিমি ফোন করে বললো তোর আর নাফিসের নাকি খুব শিঘ্রিই এনগেজমেন্ট হচ্ছে ? নাফিসকেও তো ফোন করলাম আমি।
– কি বলল নাফিস?
– হ্যা না কিছুই স্পষ্ট বলল না। তোর এনগেজমেন্টের কথা আমাকে এখনো জানাসনি কেন সেঁজু?
সেঁজুতির মাথায় রক্ত চড়ে গেল। বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে! কি পেয়েছে এই নাফিস সিমিরা! একটা কিছু আজই করতে হবে। এখন নয়। বাসায় গিয়েই নাফিসকে ফোন করবে সে। আর ঐ সিমি মাগীটাকেও দেখে নেবে আজ।
বাসায় ফিরে দেখে সেঁজুতিদের লিভিং রুমে বসে আব্বুর সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে নাফিস। সেঁজুতিকে দেখে দুজনেই হেসে ফিরে তাকায়।
– হাই সেঁজুতি! নাফিস হাত তুলল।
– হাই!
সংক্ষেপে জবাব দিল সেঁজুতি। গৃহে আগত অতিথি। জবাব না দেওয়াটা হবে এটিকেট বহির্ভূত। নিষ্ঠুরতাও বটে। গা জ্বলে যাচ্ছে সেঁজুতির। বিশেষ করে আব্বুর আদিখ্যেতাটা অসহ্য!
– সেঁজু মামনি। নাফিস এসে বসে আছে অনেকক্ষণ । তোকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে চায়। ঘুরে আয়না কোথাও থেকে। কোথাও তো তেমন বেরোসনা আজকাল।
আশ্চর্য! আব্বুর কন্ঠে কিনা পরিপূর্ণ অনুমোদন। প্রচ্ছন্ন অনুনয়ও বুঝি কিছুটা। ঠিক আছে যাবো। মনে মনে ভাবে সেঁজুতি। বিশেষ করে টম ক্যাট সাহেব যেখানে একেবারে জেরী মাউসের দোরে উপস্থিত। নাফিসের সাথে একটা শঠে শাঠ্যং অধিবেশন আজকেই দরকার!
– আপনি একটু বসুন নাফিস। আমি তৈরী হয়ে আসছি।
ভেতরের ঘরে চলে যায় সেঁজুতি।
– কোথায় যাবেন? গাড়িতে বসেই জানতে চাইল নাফিস।
– কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিল সেঁজুতি। কিছুটা বেহায়াপনাই হবে। তবু নাফিস এপিসোডের সবচেয়ে সেনসিটিভ স্পটটাই নির্বাচন করা যাক।
– হাউ এ্যাবাউট শৈবাল ?
– শৈবাল কেন ?
– আপনার জন্মদিনে তো যাওয়া হয়নি। ওখানেই চলুন।
সেঁজুতির কথায় প্রচ্ছন্ন খোঁচা। হেসে ফেলল নাফিস।
– হাসছেন যে খুব ?
– শৈবালে তো সেদিন আমার জন্মদিনের কোন অনুষ্ঠানই হয়নি! ফিচফিচিয়ে হাসতে থাকে নাফিস।
– তার মানে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সেঁজুতি।
– তার মানে জন্মদিনের ঐ গল্পটা ছির পুরোটাই বানোয়াট। আমার জন্মদিন তো আজ!
এই মুহূর্তে রেগে যাওয়া হবে নিছক ছেলেমানুষি। তাছাড়া বছর ভর অতখানি অবহেলিত থাকার পর ঐটুকু রসিকতা করতেই পারে নাফিস। মনে মনে র্যাছশনাল হওয়ার চেষ্টা করলো সেঁজুতি। কিছু না বলে চুপ করে রইল সে।
– মিল্কির সাথে কথা হয়েছে আপনার, তাই না ? মিল্কি আমাকেও ফোন করেছিলো। এনগেজমেন্টের গুজবটা পুরোটাই সিমির তৈরী। আমি এর কিছুই জানি না সেঁজুতি! মাঝে মাঝে সিমিটা কী যে বাড়াবাড়ি করে বসে!
সেঁজুতি আর কোন কথা বললো না। নাফিস এবার কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল-
-থাক এখন এসব কথা। তার চেয়ে চলুন আশুলিয়া থেকে বেড়িয়ে আসি।
সেঁজুতির পুষে রাখা জেদের আগুনে জল ঢেলে দিয়েছে নাফিস। মনে মনে সাজিয়ে রাখা সব আক্রমণ পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে! নিশ্চুপ হয়ে গেলো সেঁজুতি। মাথা কাত করে সায় দিল নাফিসের প্রস্তাবে।
আশুলিয়া সড়কের পাশে একটি সুন্দর জায়গা বেছে গাড়ি পার্ক করলো নাফিস।
দুপাশের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মাঝ দিয়ে চলে গেছে দীর্ঘ আশুলিয়া সড়ক। সড়কের ঢালুতে ঘন দুর্বার গালিচায় পাশাপাশি গিয়ে বসলো ওরা। অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলছিল না। হঠাৎ চোখাচোখি হতেই হেসে ফেলল দু’জনেই।
– হ্যাপি বার্থডে নাফিস! আন্তরিকতা মিশিয়ে বলল সেঁজুতি।
– দেরী হয়ে গেল না একটু ? ঠাট্টা করতে ছাড়লো না নাফিস।
– বেটার দ্যান নেভার!
– এরপর কিন্তু প্রতিটি জন্মদিনে উইশ করতে হবে উইদাউট বিইং লেট!
– চেষ্টা করবো। বাট নো প্রমিস!
দু’জনেই হেসে ফেলল। সেঁজুতির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল নাফিস।
– আই এ্যাম স্যরি সেঁজুতি! আপনাকে অনেক হার্ট করেছি সেদিন।
সেঁজুতির হাতটা নাফিসের হাতের মুঠোয় মধ্যেই পড়ে রইল। ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা সে করলো না একবারও। নিজের ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পেলো সেঁজুতি। একটা প্রচণ্ড ভাংচুর হয়ে যাচ্ছে সেখানে। সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে খুব দ্রুত। শেষ ইনিংসটা কি নিশ্চিত ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছে ?
– তার চেয়েও অনেক বেশি হার্ট করেছি আমি আপনাকে।
– চলুন ফিরে যাই। তাড়া দিল নাফিস।
– চলুন। উঠে দাঁড়ালো সেঁজুতি
বাসার গেটে সেঁজুতিকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল নাফিস।
বারান্দায় হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বাবা। সেঁজুতির জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। সেঁজুতি সামনে আসতেই দুখানি খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
– নাফিস রেখে গেছে তোকে দেওয়ার জন্যে।
চিঠি দুটো হাতে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো সেঁজুতি। দ্রুত পড়তে শুরু করলো। প্রথম চিঠিটি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানের লেখা। প্রিয় মিস সেঁজুতি বিনতে রাহমান। আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্র বিভাগের জন্য মঞ্জুরকৃত দুটো পিএইচডি স্কলারশীপের একজন ভাগীদারের স্বেচ্ছায় দাবী প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে মেধা তালিকার ক্রমানুসারে পরবর্তী দাবীদার হওয়া আপনার ওপরই বর্তায়। অত্র অবস্থার আলোকে এই স্কলারশীপটির ব্যাপারে আপনি যদি উৎসাহিত বোধ করেন তাবে সত্বর বিভাগীয় প্রশাসন দফতরের সাথে যোগাযোগ করুন। দ্বিতীয় খামের চিঠিটা নাফিসের নিজের।
সেঁজুতি, মাস্টার্সের রেজাল্টের আগেই বোস্টনের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভাসির্টি আমাকে পিএইচডির জন্য একটা স্কলারশীপ কনফার্ম করে রেখেছিল। ভেবে দেখলাম আমি ডিক্লাইন করলেইতো হার্ভার্ডের স্কলারশীপটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার হয়ে যায়। চেয়ারম্যান স্যারকে গিয়ে বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। চিঠিটা ইস্যু করিয়ে আমার হাতে দিয়ে মোস্তাফা স্যার বললেন,
– বিই মাই পোস্টম্যান!
আব্বুর স্টাডি রুমের দরজাটা খোলা। সেঁজুতির পড়ার টেবিল থেকে আব্বুর স্টাডি রুমের ভেতরের অনেকটাই দেখা যায়। দুষ্টু ছেলের মতো একটা চোখ সরু করে চাপ দাড়ি ভরা গালে বিটকেলে হাসি ঝুলিয়ে সেঁজুতির চিঠি পড়া দেখছিলেন আব্বু। এখন বুঝলো সেঁজুতি। বিকেলেই তাহলে আব্বু আর নাফিস চিঠি নিয়ে এই ষড়যন্ত্রের জাল তেরী করে রেখেছিল! একটি হাত মুঠি করে এখান থেকেই আব্বুকে কিল দেখালো সেঁজুতি।
সেঁজুতির মোবাইলে বাজছে এসএমএস-এর ব্যাগ্র রিংটোন। মেসেজ পাঠাচ্ছে কেউ। ওপেন বোতামে তর্জনীর আলতো প্রশ্রয়ে সেঁজুতির চোখের সামনে ভেসে উঠে বার্তা,
ওয়েলকাম টু হার্ভার্ড!
লভ ইউ সেঁজুতি!
অলওয়েজ ইয়োর্স, নাফিস।
(এর আগে প্রকাশিত “সেঁজুতি সিনড্রোম” গল্পটি ছিল “জলকেলি” এর সিকুয়েল।)