Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জল-জঙ্গলের কাব্য || Sunil Gangopadhyay

জল-জঙ্গলের কাব্য || Sunil Gangopadhyay

এ কী অদ্ভুত হাসি

ব্যাপারটা হল কী, মনোরঞ্জন তার বউয়ের কাছে একটা মিথ্যে কথা বলে ফেলল।

তা পুরুষ মানুষ, বিয়ের পর আট মাস পার হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে বউয়ের কাছে দু-একটা মিথ্যে কথা তো বলবেই। হাটখোলায় কোনও কাজ না থাকলেও সাতজেলিয়া চলে যায়। মোহনবাগানের নামে পাঁচ টাকা বাজি ধরে, বঙ্গেবর্গী পালায় ভাস্কর পণ্ডিত হিসেবে যার খুব নামডাক, সে-রকম মানুষের প্রতি দিন অন্তত গোটা তিনেক মিথ্যে কথা না বললে চলবে কেন? তবে এই বিশেষ মিথ্যেটি বলার সময় তারও বুক কেঁপেছিল।

নদীর ধারে একলা মনোরঞ্জন দাঁড়িয়ে ছিল বিকেলবেলা। এই সেই বিশেষ ধরনের বিকেল, যে বিকেলে পৃথিবী প্রত্যেক দিনের মতো আটপৌরে নয়। পৃথিবীরানি যেন আজ বেনারসি শাড়ি পরে, যত্ন করে সেজেগুঁজে আজ কোথাও বেড়াতে যাবেন। নদীর ওপরের আকাশ খুনখারাবি লাল। নদীর জলে লম্বা লম্বা লকলকে লাল শিখা, কিছু দূরের একটি পালতোলা নৌকো এখন ক্যালেন্ডারের ছবি হয়ে গেছে, লালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশের বাকি অংশ প্রগাঢ় নীল, এক ঝাঁক বেলেহাঁস চন্দ্রহার হয়ে উড়ে আসে লাল থেকে নীলের দিকে।

মনোরঞ্জন পরে আছে সাদা থানের লুঙ্গি, খালি গা, ডান বাহুতে কালো কার দিয়ে বাঁধা একটা তামার কবচ, তার সরু কোমর থেকে ত্রিভুজ হয়ে উঠেছে বুক, লোহার মতো গায়ের রঙ, সরু চিবুক, ধারালো নাক, চোখ দুটি মুখের তুলনায় ছোট, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। মনোরঞ্জন আকাশে সূর্য-বিদায়ের দৃশ্য দেখছে না, সে চেয়ে আছে পালতোলা নৌকোটির দিকে। শীত সদ্য শেষ হয়েছে, বাতাস এখনও মন্থর, বঙ্গোপসাগরের অনেক দূরে মেঘ, এদিকে আসতে দেরি আছে।

এই যে মনোরঞ্জন, এমন সুঠাম চেহারার যুবা, আজ বিকেলে তার মন ভাল নেই।

দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করতে করতেই যেন মনোরঞ্জন নৌকাটিকে টেনে আনল নিজের কাছে। নৌকোটি জেটি ঘাটের পাশে এসে ভিড়ল। এক জন মাঝি ছাড়া নৌকোর আর কোনও যাত্রী নেই।

বাঁধের ওপর থেকে নেমে গিয়ে নৌকোটির কাছে এসে মনোরঞ্জন জিজ্ঞেস করল, কী মাধবদা, কেমন উঠল আজ?

মাধব মাঝি জেটির থামের সঙ্গে দড়ি বাঁধতে বাঁধতে সংক্ষেপে উত্তর দিল, কিছু না।

মনোরঞ্জন নৌকার ওপর নেমে গিয়ে মাধব মাঝিকে পাল গুটোতে সাহায্য করতে লাগল। সেকাজ সমাপ্ত হলে সে তার লুঙ্গির ট্যাঁক থেকে বার করল একটি ছোট জার্মান সিলভারের কৌটো। তার থেকে আবার বিড়ি এবং কেরোসিন লাইটার বার করে বলল, নাও মাধবদা, বিড়ি খাও।

দু’জনে দু’টি বিড়ি ধরাল।

নৌকার খোলে অনেকখানি জল উঠেছে। সেঁচে ফেলা দরকার। মনোরঞ্জন জিজ্ঞেস করল, জল ছেঁচে দেব নাকি?

এবারও মাধব সংক্ষিপ্ত ভাবে বলল, ছাঁচ!

মনোরঞ্জন নারকোল মালা নিয়ে জল সেঁচতে লাগল আর মাধব বিড়ি টানতে টানতে সরু চোখে চেয়ে রইল সে-দিকে। মাধবের জলে ভেজা, রোদে পোড়া শরীরটা দেখলে বয়েস বোঝা যায় না। তার মেদহীন শরীরটা এমনইটনকে যে মনে হয় তার চাতালো বুকটায় টোকা মারলে টংটং শব্দ হবে। তার মুখে তিন-চার দিনের রুখু দাড়ি, মাথায় একটা গামছা জড়ানো। মাধবের চোখ দুটি এমনই। উজ্জ্বল যে একনজর দেখলেই বোঝা যায়, সে সাধারণ পাঁচ-পেঁচি ধরনের মানুষ নয়।

মনোরঞ্জনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মাধব জিজ্ঞেস করল, এত খাতির কীসের জন্য রে? সাধুদা তোমাকে একবার ডেকেছে।

মাধব চিক করে জলে থুতু ফেলে বলল, যা যা, এখন ভাগ তো, তোগো ওই সব মতলোবের মধ্যে আমি নাই।

মনোরঞ্জন পাটাতনের ওপরে বসে বলল, এক কাপ চা তো খাবে, সারা দিন খেটে খুটে এলে?

আমার অত চায়ের শখ নাই।

অত রাগ করছ কেন? এখন তোমার কী কাজ আছে আর? একটু না হয় বসলেই আমাদের সঙ্গে। তাস খেলবে না?

না।

পাটাতনের নিচে হাত ঢুকিয়ে মাধব একটা খালুই টেনে বার করল। তাতে রয়েছে সাড়ে তিনশো চারশো ওজনের একটা ভাঙর, আর দুতিন মুঠো মৌরলা মাছ। বেচলে বড় জোর পাঁচ-ছ’টাকা পাওয়া যাবে, তার মধ্যে দু’টাকা দিতে হবে মহাদেব মিস্তিরিকে নৌকো ভাড়া হিসেবে, বাকিটা মাধবের আজ সারা দিনের উপার্জন। শীতের শেষের নদীতে মাছ পাওয়াই দুষ্কর।

খালুইটা হাতে নিয়ে মাধব জেটিতে উঠে গেল। মনোরঞ্জন বুঝল, মাধবের মেজাজ এখন নরম করা যাবেনা।

সপ্তাহে এক দিন হাট, তবে বিষ্টুর চায়ের দোকান রোজই ভোলা থাকে। একটা বার্লির কৌটোর তলা কেটে, তারের হাতল লাগানোতার চায়ের ছাঁকনি। কেটলিতে গুঁড়ো চা সবসময় ফুটছে। উনুনে কাঠের আগুনের আঁচ। একটা আস্ত বানীগাছের গুঁড়ির দু’পাশে দু’টি খুঁটি লাগিয়ে দোকানের সামনে বসান। সেটাই খদ্দেরদের বেঞ্চি।

বিষ্টুর গোঁফ খুব বিখ্যাত, শিয়ালের ল্যাজের মতো পুরুষ্ট, সেই জন্যই হাটুরে লোকেরা তার নাম দিয়েছে মোচা বিষ্টু। তার দোকানের চায়ের ডাকনাম, মোচা বিষ্টুর পেচ্ছাপ। তবু হাটবারে কিংবা বিকেল চারটের লঞ্চ এসে যখন ভেড়ে, তখন অনেকেই সেই চা খেতে আসে।

বানীকাঠের গুঁড়ির বেঞ্চিতে বিষ্টুর দোকানের দিকে পিছন ফিরে বসে বিকেলের দিকে মনোরঞ্জনদের আড্ডা বসে। সে ছাড়া আর সুভাষ, বিদ্যুৎ, নিরাপদ আর সুশীল। আর সাধুচরণ, সে আগে আসে হঠাৎ হঠাৎ। যতক্ষণ না সন্ধে হয়। ঠিক সন্ধের সময় কোথা থেকে এক ঝাঁক পোকা উড়ে আসে, কান নাকের ফুটোর, আর কথা বললেই মুখের মধ্যে ঢুকে যায়। তখন আর এক জায়গায় বসে থাকা যায় না।

এই কয়েক জনের মধ্যে বিদ্যুৎ বরাবরই রোগা প্যাংলা, সুভাষ একটু মোটা ধাঁচের, বাকি তিন জনের গড়াপেটা চেহারা, অবশ্য মনোরঞ্জনের মতো কেউ না। এবার ওদের চেহারা ক্ষয় হতে শুরু করবে। এখন তো ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি, বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে কেউ এসে মনোরঞ্জনকে দেখুক তখন তার কণ্ঠার হাড় জেগে যাবে, গোনা যাবে বুকের পাঁজরা ক’খানা, চক্ষু ঢুকে যাবে কোটরে, শরীরটাকে মনে হবে খাঁচা।

সেই অঘ্রাণের শেষ থেকেই ওদের হাতে কোনও কাজ নেই। কাজ না থাকলে আলস্যে ওদের শরীর ভাঙে। ওদের জন্য আবার কাজ আসবে, আকাশ থেকে, যদি বৈশাখে ঠিকঠাক সময়ে বৃষ্টি নামে। ভূমির মতোই, এই সব ভূমিজ মানুষেরও শরীর পুষ্ট হয় বৃষ্টির জলে।

কথাটা প্রথম তুলেছিল নিরাপদ। একবার জঙ্গলে গেলে হয় না?

অন্যরা প্রথমে উড়িয়ে দিযেছিল কথাটা। দিনকাল পালটে গেছে। বাপ-ঠাকুদারমুখে যেসব গল্প শুনেছে, তা আর আজকাল চলে না। এখন আইন-কানুনের হাত অনেক লম্বা হয়েছে। যখন তখন খপ খপ করে ধরে।

তবু ঘুষঘুষে জ্বরের মতো, খিদের মতে, রাতচরা পাখির ডাকের মতো কথাটা ফিরে ফিরে আসে। মনে মনে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে। অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ, কিছু করার নেই, শুধু তাস পাশা খেলা আর বিড়ি টানা। যদিবা দু’এক দিনের ফুরনের কাজ জোটে, কিন্তু এই সময়টা তাল বুঝে কেউ পুরো মজুরি দিতে চায় না। পরিমল মাস্টারের পরামর্শে দুটো শীতে মনোরঞ্জন রাশিয়ান বীটের চাষ দিয়েছিল, শালগমের মতো রাশিয়ান বীটের চারাগুলো তরতরিয়ে বাড়ে, দামও মন্দ পাওয়া যায় না। কিন্তু গত বছর অসময়ের ঝড়-বৃষ্টিতে সবনষ্ট হয়ে গেছে। মূলধন পর্যন্ত বরবাদ। তাই এ বছর কেউ ওই চাষে যায়নি।

হাটখোলার একটি খালি আটচালায় ওদের যাত্রার রিহার্সাল হয়, কিন্তু এ বছর কারুরই যেন রিহার্সালে মন নেই। গত মাসে কলকাতার এক পার্টি এসে জয়মণিপুরে তিন দিন তিনটে পালা করে গেল চুটিয়ে, আশপাশের দশখানা গাঁ থেকে লোক গিয়েছিল ঝেটিয়ে। এরপর আর নাজনেখালির জয়হিন্দক্লাবের যাত্রা কে দেখবে? গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। তাছাড়া অশ্বিনীকে সাপে কাটবার পর থেকেই জয়হিন্দ ক্লাবটা একেবারে ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে। অশ্বিনীই ছিল এই ক্লাবের প্রাণ, প্রমটার, ড্রেসার থেকে পরিচালক পর্যন্ত।

যদি অশ্বিনী ফিরে আসে। অশ্বিনী মারা গেছে, তবু অশ্বিনী ফিরে আসতে পারে। মনোরঞ্জন বিশ্বাস করে না, সুভাষ, বিদ্যুৎরা কেউ-ই বিশ্বাস করে না, তবু অশ্বিনীর দাদা হরিপদ যখন বলে যে লখিন্দর ফিরেছিল, অশ্বিনী কেন ফিরতে পারবে না তখন প্রতিবাদ করে না ওরা। কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে অশ্বিনীকে, সঙ্গে নাম-ঠিকানা লেখা কাগজ। এমন কাজের মানুষ ছিল অশ্বিনী, তাকে ফিরিয়ে দিলে ভগবানের সুনাম হত।

নিরাপদর কথাটা উস্কে দেয় সাধুচরণ। যদি বাপের ব্যাটা হোস, যদি হিম্মত থাকে, তবে চল জঙ্গলে যাই।

জেল থেকে ফিরে এসে সাধুচরণ খুব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চুরি-ডাকাতি নয়, জয়মণিপুরে জমি দখলের দাঙ্গায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল সাধুচরণ, দেড়টি বছর ঘানি ঘুরিয়ে গ্রামে ফিরেছে। এ গ্রামে সেই একমাত্র জেল-ফেরত মানুষ। জেল-ফেরত তো নয়, যেন বিলেত-ফেরত। জেলে থাকলে স্বাস্থ্য ভাল হয়, আগে ছিল দোহারা গড়ন, এখন চেহারায় কী চেকনাই!

পরিমল মাস্টার সাধুচরণকে একটা কাজ দেবেন বলেছেন। তা-ও বৈশাখ মাসে। এমন নিশ্চিন্ত আশ্বাস পেয়েও সাধুচরণ জঙ্গলে যেতে চায় শুনে অন্যরা লজ্জা পায়।

হাটখোলার আটচালায় হোগলা পেতে শুয়ে, বসে আছে ওরা রিহার্সাল বন্ধ বলে হ্যাজাক জ্বালানো হয়নি, অবশ্য আজ বেশ চাঁদের আলোর ফিনকি দিয়েছে। বিষ্টুর দোকানও বন্ধ হয়ে গেছে, চারদিক নিস্তব্ধ। একসময় নদীর বুকে ঘ্যাসঘেসে আওয়াজ আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ হর্নের শব্দ শুনে ওরা বুঝতে পারে পুলিশের লঞ্চ যাচ্ছে। প্যাসেঞ্জার লঞ্চ তো দিনে মাত্র সেই একবার।

বিদ্যুৎ মাটি থাবড়ে বলল, আমি রাজি।

সাধুচরণ খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসেবিড়ি টানছিল, সে বলল, অন্তত ছ’জন তো লাগবেই।

মনোরঞ্জন বলল, আমি রাজি।

বিদ্যুৎ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আরে দুর দুর তুই রাজি হলেই বা তোকে নেবে কে? তুই বাদ।

সাধুচরণ বলল, মনোরঞ্জনকে বাদ দিয়ে এই আমরা পাঁচ জন। আর যদি মাধবদা যায়– ।

বিদ্যুৎ বলল, মাধবদাই তো আসল লোক।

মনোরঞ্জন দুর্বল ভাবে বলল, কেন, আমি বাদ কেন?

কারণটা তো মনোরঞ্জন নিজেই জানে, তাই তার গলার আওয়াজে জোর নেই। তার বিয়ের এখনও বছর পেরোয়নি, তার এখন জঙ্গলে যাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই ওঠেনা।

সাধুচরণ বলল, তুই যা তো মনা, তুই এখন বাড়ি যা। আমাদের এখন অনেক কথা রইয়েছে।

সুভাষ উদারতা দেখিয়ে বলল, আমার টর্চলাইটটা নিয়ে যা।

কিন্তু মনোরঞ্জন তক্ষুনি বাড়ি যায় না, আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে। গুম হয়ে বসে থেকে ওদের আলোচনা শোনে আর উদাসীন ভাবে বিড়ি টানে।

ওরা আলোচনাই চালিয়ে যায় শুধু, শেষ পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। জঙ্গলে যাওয়ার অনেক হ্যাপা। এ তো আর বেড়াতে যাওয়া নয়। সব বন্দোবস্ত করতে গেলে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে। কোনও আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নিয়ে যাওয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু ওরা তা চায় না। ওরা চায় স্বাধীন ভাবে যেতে।

বাড়ি ফিরে মনোরঞ্জন প্রথমেই উঠোনে গোলার গায়ে হাত বুলোয়। ইঁদূরে গর্ত করেছে কি না দেখে নেয়। এঁটেল মাটিতে গোবর মিশিয়ে এমন ভাবে লেপে দেওয়া আছে, যেন সিমেন্ট করা। গোলার গায়ে দু’বার থাবড়া মারে মনোরঞ্জন। কত আর হবে, বড় জোর দু’বস্তা ধান। বাড়িতে পাঁচটি প্রাণী দু’বেলা খাবারের জন্য হাঁ করে আছে, এতে কটা দিন চলবে?

মনোরঞ্জনের বাপ-মা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কেরোসিনের খরচা বাঁচাবার জন্য ওরা সন্ধে সন্ধেতেই ভাত খেয়ে নেয়। মনোরঞ্জনের বাপের নাম বিপদ, মায়ের নাম ডলি। চাষির বাড়ির বউয়ের নাম ডলি? এতে অবিশ্বাসের কী আছে, এ-দিকে হ্যামিল্টন সাহেবের জমিদারি ছিল না? যখন আচ্ছা আচ্ছা গ্রামে ইস্কুল বসেনি, তখন থেকেই পাকাবাড়ির ইস্কুল আছে জয়মণিপুরে। দেখবার মতো ইস্কুল! বিষ্টুপদ এবং মনোরঞ্জন দু’জনেই মাঠে হাল ধরে বটে, দু’জনেই কিন্তু ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছে। মনোরঞ্জনের ছোট ঠাকুদ্দা, অর্থাৎ ঠাকুর্দার ছোট ভাইয়ের নাম জেমস সন্তোষ খাঁড়া, তিনি অবশ্য খ্রিস্টানই হয়েছিলেন।

সরু লাল-পেড়ে শাড়ি পরা মাঝবয়সি মনোরঞ্জনের মা যখন পাছ-পুকুরে বাস মাজতে যায়, তখন তাকে কেউ ডলি বলে ডাকলে তা শুনে নতুন কোনও লোক চমকে উঠতে পারে, কিন্তু এখানকার কেউ চমকাবেনা। হ্যামিল্টন সাহেবনরেনের পিসিমাকে আদর করে ডাকতেন বেবি। বুড়ি বয়েস পর্যন্ত তাঁর সেই বেবি নামই থেকে গিয়েছিল।

মনোরঞ্জনের দুই দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। বড়দা নিজের শ্বশুরবাড়ির গ্রামে জমি পেয়ে সেখানেই বসতি নিয়েছে, মেজদা গোসাবায় ডাবের ব্যবসা করে। ছ’ভাই-বোনের মধ্যে দুটি টুপটাপ মারা গেছে অকালে, ছোট বোনটি ক্লাস নাইনে দু’বার ফেল করে বিয়ের দিন গুনছে মনে মনে।

মনোরঞ্জন বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত তার ছোট বোন কবিতা তার বউ বাসনার সঙ্গে গল্প করে। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক কাহিনির বদলে যাত্রায় আজকাল সামাজিক বিষয়বস্তু থাকে বলে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের নামও পাল্টে যাচ্ছে। তাছাড়া সিনেমার নায়ক-নায়িকার নাম ইলেকট্রিসিটি নেই, তবু এই গ্রামেও মাসে একবার সিনেমা আসে।

কবিতার ডাকনাম কুঁচি। গায়ের রঙ একটু ফর্সা-ফর্সা, মুখটা একেবারে লেপাপোঁছা।

ঘরে জ্বলছে হ্যারিকেন আর বাজছে রেডিয়ো। রেডিয়োতে এ-রকম একটা গান শোনা যাচ্ছে; অশ্রুনদীর…ঘ্যাটো ঘ্যাটো ঘ্যাটো ঘ্যাটো…সুদূর..ঘ্যাটো ঘ্যাটো…ঘাট দেখা যায়…ঘ্যাট ঘ্যাটো ঘ্যাটো। খুবই দুর্বল হয়ে গেছে ব্যাটারিগুলো, না পালটালে আর চলে না। রেডিয়োটা বিয়ের সময় পাওয়া, মাঝখানে দু’বার মাত্র চারখানা করে ব্যাটারি কিনেছে মনোরঞ্জন।

গানটা শুনেই মনোরঞ্জন বুঝতে পারে এখন পৌনে দশটা বাজে। এমন কিছু রাত নয়। তাস খেলা জমলে এক-এক দিন বারোটা-একটা বেজে যায়।

বারান্দায় বালতিতে জল রাখা আছে, মনোরঞ্জন হাত-পা ধুয়ে ঘরে এসে বোনকে বলল, আমার ভাত বেড়ে দে বুঁচি। তোরা খেয়েছিস?

কবিতা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মনোরঞ্জন তার বউয়ের থুতনি ধরে বলল, বাসনা আমার বাসনা, একবারটি হাসো না!

বাসনা ফোঁস করে উঠল, এই কী হচ্ছে!

মনোরঞ্জন তবু বাসনার ডান গাল টিপে ধরে বলল, পুটু পুটু পুটু পুটু পুটু।

বাসনা ক্রুদ্ধ বিড়ালির মতো ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে, মনোরঞ্জন ততই খুনসুটি করতে থাকে। তারপর বুঁচি এসে ঘরে ঢুকতেই সে চট করে হাতটা সরিয়ে নেয়। এক দিন সে বাসনাকে চুমো খেতে গিয়ে বোনের সামনে ধরা পড়ে গিয়েছিল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে দিনের শেষ বিড়িটি ধরিয়ে মনোরঞ্জন একটু বারান্দায় বসে। উঠোনের মাঝখানে তুলসী মঞ্চ, বাঁ-পাশে গোয়াল ঘর, ডান পাশে রান্নাঘর, তার পাশে মাচা বাঁধা, সেখানে উচ্ছে গাছ দুলছে। বাড়িটি বেশ ঝকঝকে তকতকে, চালে নতুন খড় ছাওয়া হয়েছে এ বছরই। গোয়ালঘরটি অবশ্য এখন ফাঁকা, গত গ্রীষ্মে গো-মড়কে একটি হেলে বলদ মারা যাওয়ায় ঝটিতি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল অন্যটাকে।

শয়নঘর দু’টি, কবিতা বাপ-মায়ের ঘরেই মেঝেতে শোয়। ওর ভয়ের অসুখ আছে, মাঝে মাঝে ওকে ওলায় ধরে, ঘুমের ঘোরে গোঁ গোঁ করে চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ। কটরাখালির সাধুবাবার কাছে ওকে নিয়ে যাব যাব করেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। তিনি এইসব রোগের একেবারে ধন্বন্তরি। বিয়ের আগে কবিতার এই অসুখ তো সারিয়ে ফেলতেই হবে।

সুখটান দেবার পর বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে চলে আসে মনোরঞ্জন। তক্তপোশের ওপর উঠে বসে বলল, ওঃ হো, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি। তোমার বাপের বাড়িতে তো কাল ডাকাত পড়েছিল।

বাসনা ভেতরের জামা খুলছিল পেছন ফিরে, চমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, অ্যাঁ?

মনোরঞ্জন বলল, চারটের লঞ্চে লারানদা এল, তার মুখেই শুনলাম মামুদপুরে কাল বড় ডাকাতি হয়ে গিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কার বাড়ি? কার বাড়ি? লারানদা বললে, যে নিতাইচাঁদ হরিণের মাংস বেচতে গিয়ে ধরা পইড়েছিল বসিরহাটে, সেই নিতাইচাঁদের বাড়ি। নিতাইচাঁদ তোমার কাকার নাম না?

বাসনার ছেলেমানুষি মুখখানি আতঙ্কে কালো হয়ে যায়। সে চোখ কপালে তুলে বলল, এ খবর শুনেও তুমি চুপ করে বসে রইলে?

তা কী করব, ল্যাজ তুলে দৌড়োব? লারানদা যখন কথাটা বললে, ততক্ষণে লঞ্চ ছেড়ে গিয়েছে। তা ডাকাতি যখন হইয়েই গিয়েছে, এখন আমার যাওয়া না-যাওয়া সমান।

ডাকাতরা আমাদের বাড়ি থেকে কী নেবে?

তোমার কাকাটা তো একনম্বরের চোর। চোরাই মাল কত লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে।

মানুষ মেরেছে?

দু’জনের তো মাথা ফেটেছে শুনলাম।

অ্যাঁ? কার? কার মাথাটা ফেটেছে?

তা আমি কী করে জানব। লারানা তো আর নিজের চক্ষে দেখেনি।

এসব ইয়াকির কথা। প্রতি রাত্রেই মনোরঞ্জন এই ধরনের উদ্ভট কোনও গল্প বানিয়ে চমকে দেয় বউকে। বাসনার চোখে জল এসে গেলে সে হো-হো করে হেসে ওঠে। তখন বাসনা এসে তার বুকে গুম গুম করে কিল মারতে থাকে আর বলে, আমার কাকা মোটেই চোর নয়।

তখনও মনোরঞ্জন তার বউকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করে আর খেপায়, চোরই তো, নিশ্চয়ই চোর। তোমরা একেবারে চোরের বংশ, তুমি নিজেও তো একটু চুর্নী।

পাশের ঘর থেকে কবিতা এসবকিছুই শুনতে পায়। এমনকী নিয়মিত ছন্দে এ ঘরের তক্তপোষের মচমচানির শব্দ পর্যন্ত।

তবে এই আসল মিথ্যে কথাটা অবশ্য মনোরঞ্জন সেই রাত্রে বাসনাকে বলেনি। সেটা অন্য রাতের কথা।

সারা দিন মনোরঞ্জন তক্কে থাকে মাধবকে ধরার জন্য। তার নিজের কোনও স্বার্থ নেই, তবু বন্ধুদের রোমাঞ্চকর অভিযানটা যাতে পণ্ড না হয়ে যায়, সেই জন্য সে মাধবকে ভোলাবার চেষ্টা করে। মাধবকে আগ বাড়িয়ে বিড়ি দেয়, মাধবের বাড়ির উঠোনের আগাছা সাফ করে দিয়ে আসে, মাধবের ছোট ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে লোপালুপি খেলে। তবু মাধব তাকে পাত্তাই দেয় না।

দিন তিনেক এড়িয়ে এড়িয়ে থাকার পর মাধব শেষ পর্যন্ত নিজে থেকেই ধরা দেয়।

দুপুরবেলা আটচালায় তাস খেলা জমে উঠছে, কখন যে মাধব পেছনে এসে বসেছে ওরা টেরও পায়নি। মাধব তাসের পোকা। হঠাৎ মাধব এক সময় বলে উঠল, আরে ও মনা, কী কল্লি! আরে এডা দেখি একটা রামছাগল। হাতে রঙ রইছে, তুরুপ মারতে পাল্লি না।

মনোরঞ্জন ফিরে তাকাতেই মাধবতার অত্যুজ্জ্বল চোখদুটি ঝকমকিয়ে বলল, তোরা দাইরাবান্দা খ্যাল, তাস খেলা তোগো মগজে কুলাবেনা।

চার খেলুড়িই ফেলে দিল হাতের তাস। সাধুচরণ বলল, মাধবদা, তোমার সঙ্গে একটা প্রাইভেট কথা আছে।

মাধব বলল, জানি, জানি, তোমাগো কী কথা। ওসব আমার দ্বারা হবে না। আমার পিঠে এখনও দাগ রইছে।

দুজনই একসঙ্গে বিড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও মাধবদা, খাও।

দুজনের থেকেই বিড়ি নিয়ে একটা ট্যাঁকে গুঁজে আর একটির পেছনে ফুঁ দিতে দিতে মাধব বলল, যতই খাতির করো, ও লাইনে আমি আর যেতে পারব না। আজকাল ও লাইন খারাপ হয়ে গিয়েছে।

মাধবের মতো কর্মিষ্ঠ-পুরুষ সচরাচর দেখা যায় না। তাকে মাঝি বলা যায়, জেলে বা যায়, চাষি বা কাঠুরে বা ঘরামিও বলা যায়, সবকাজে সে সেরা। তার কাজের ক্ষমতা এবং বুদ্ধি দুটোই আছে, সেই জন্য অনেকে তাকে সমীহ করে। যারা হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পতাকা ওড়ায়, যারা অকুল সমুদ্রে নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য বেরিয়েছে এককালে, যারা যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে শত্রুর দেশে দাঁড়িয়ে চওড়া কাঁধ আরও চওড়া করে গর্বের হাসি দেয়, তাদের মুখের সঙ্গে মিল আছে মাধবের।

তবু মাধব সংসারের ব্যাপারে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। একটা ছোট চৌহদ্দির বাইরে সে কোথাও যায়নি কখনও। বেঁচে থাকাটাই তার একমাত্র অভিযান। তার জমিও নেই, মূলধনও নেই। শুধু গায়ে খেটে আর কতখানি সমৃদ্ধি হবে। বাড়িতে তার সাতটা পেট। তার নিজের নৌকোটি চলে যাওয়ায় সে আরও বিপাকে পড়েছে।

সাধুচরণ বলল, যদি পারমিট জোগাড় কবি মাধবদা?

মাধব সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, পারমিট জোগাড় করবি, তুই? হেঃ! তোকে পারমিট দেবে? হেঃ!

ধরো না, যদি জোগাড় করিই?

ধর না, আমি লাটের ব্যাটা বড়লাট আর আমার মেয়ে ইন্দিরে গান্ধী! ধরতে আর ঠ্যাকাটা কী, তাতে তো পয়সা লাগে না!

তুমি বিশ্বাস পাচ্ছ না, মাধবদা, পারমিটের ব্যবস্থা আমি সত্যিই করতে পারি। এখন তুমি রাজি হলেই হয়।

দেখ সাধু। আমার সঙ্গে ফোর টুইন্টি করিসনি! আমি তিন-তিনবার ধরা পড়িছি, মেরে আমার তক্তা খিচে দিয়েছে, আমার লৌকোটা পর্যন্ত সুমুদ্ধির পুতরা বাজেয়াপ্ত কইরা নিছে। আবার আমি তোগো কথায় নাইচ্যা আবার ও লাইনে যামু?

মাধবদা, সবাই বলে তোমার ভয়-ডর কিছু নেই, এখন দেখছি তুমিই ভয় পাচ্ছ।

ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, ভয় পাব না? আমি মলে তুই আমার বউরে বিয়া করবি? আমার পোলাপানগো খাওয়াবি? যমরে ভয় করি না, কিন্তু পুলিশ আর ফরেস্টের লোক আমারে ছিবড়া কইরা দিছে।

সবাই বুঝতে পারে যে মাধব গরম হয়ে এসেছে। মাধব দুঃসাহসী। শুধু দৈহিক পরিশ্রম করে কোনওক্রমে টেনেটুনে সংসার চালানোয় সে বিশ্বাসী নয়। হঠাৎ কোনও ঝুঁকি নিয়ে ভাগ্য ফেরাতে চায়। ভাগ্য ফেরেনি বটে, তবে এ-রকম ঝুঁকি সে বার বার নিয়েছে। অন্তত তিনবার সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। একবার ডাকাতরা তার নৌকো থেকে সব কিছু কেড়েকুড়ে তার পরনের কাপড়ও খুলে নিয়ে ন্যাংটো করে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল চামটা ব্লকে। সেখান থেকেও প্রাণে বেঁচে সে ফিরতে পেরেছে।

এ-রকম ঝুঁকি যারা নেয়, তাদের স্বভাব সারা জীবনে বদলায় না।

সাধুচরণ সত্যিই অনেকটা এগিয়ে এনেছে কাজ। জয়মণিপুরের আকবর মণ্ডলের পারমিট আছে, এক ভাগ বখরা দিলেই সে পারমিট ব্যবহার করতে দিতে রাজি আছে। এর মধ্যে বে-আইনি কিছু নেই।

সকলের দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকিয়ে মাধব বলল, সঙ্গে আর কে যাবে, এই সব চ্যাংড়ারা? এরা তো একটা হাঁক শোনলেই পাছার কাপড় নষ্ট কইরা ফ্যালাবে।

মূল প্রস্তাবকারী নিরাপদ এবার বলল, ও-কথা বোলো না মাধবদা! জঙ্গলে তুমি একাই যাওনি, আমরাও গেছি। আমি তো তিনবার গেছি।

মাধব বলল, হ্যাঁ, গেছিলি। গত সালে ফুলমালা লঞ্চে টুরিস্টবাবুদের রান্নার জোগাড়ে হয়ে গেছিলি না?

মাধবের গলার আওয়াজে রাজ্যের অবজ্ঞা ঝরে পড়ে।

সাধুচরণ বলল, শোনো আমরা কে কে যাব। তুমি, আমি, নিরা–।

মাঝখানে বাধা দিয়ে সুশীল বলে ওঠে, আমি কিন্তু যেতে পারব না। জয়নগরে আমার মামার মেয়ের বিয়ে আছে–।

মাধবআর সাধুচরণদু’জনেই জ্বলন্ত চোখে তাকাল সুশীলের দিকে। মাধব পিচ করে থুতু ফেলল পাশে।

সাধুচরণ বলল, তোকে নিতামও না আমরা।

মাধব শুধু বলল, হেঃ।

সাধুচরণ আবার বলল, সুভাষ, বিদ্যুৎ, নিরাপদ, তুমি আর আমি।

মনোরঞ্জন বাদ। যদিও সে সামনে ঠায় বসা। সবার চেয়ে বলশালী চেহারা তার, এবং সে ভিতু এমন অপবাদ ঘোর নিন্দুকেও দিতে পারবে না।

সাধুচরণ বলল, আকবর মণ্ডলের পারমিট, তাকে নিয়ে মোট ছয় ভাগ।

মাধব বলল, নৌকোর এক ভাগ লাগবে না? নৌকো তোরে মাগনায় কে দেবে?

নিরাপদ বলল, ঠিক, নৌকোর ভাগ ধরা হয়নি। তা হলে সাত ভাগ। মহাদেবদার নৌকো।

মাধব বলল, আট ভাগ হবে, আমার দুই ভাগ। গুণিনের ভাগ নাই?

সাধুচরণ অন্যদের মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, রাজি।

এবার জোগাড়যন্তরের পালা। শুধু পারমিটের দোহাই দিলেই তো হবে না। খোরাকি জোগাড় করতে হবে, যাওয়া-আসা অন্তত এক মাসের ধাক্কা। এই এক মাস বাড়ির লোকজন কী খেয়ে থাকবে তা ভাবতে হবে, নিজেদেরও রান্না করে খেতে হবে। আর আছে বনবিবির পুজো।

আগে যারা ধার-দেনা করে জঙ্গলে যেত, ফিরে এসে দেখত লাভের ধন সব পিঁপড়েয় খেয়ে গেছে। এখন আর মহাজনদের অতটা সুদিন নেই, অন্তত এ-দিককার পিঠোপিঠি কয়েকটা গ্রামে।

মনোরঞ্জন দল-ছাড়া হয়ে গেছে, তবু সে-ই আগ বাড়িয়ে বলল, পারমিট যখন আছে, তখন পরিমল মাস্টারের কাছে চলো না!

পরিমল মাস্টারের নামে সাধুচরণ একটা গা মোচড়া-মুচড়ি করে। কথাটা ঘোরাবার জন্য সে বলল, ক’বস্তা ধান লাগবে আগে হিসেব করো না।

মাধব এসবকথার মধ্যে থাকতে চায় না। ভাড়াটে সৈন্যের মতো সে শুধু নিজেরটা বোঝে। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, আমার বাড়ির জন্য দু’বস্তা ধান আর অন্তত নগদা একশোটি টাকা রাইখ্যা যাইতে হবে। সে-ব্যবস্থা তোমরা করো।

ঘুরেফিরে আবার পরিমল মাস্টারের নাম আসে। সাধুচরণ বলল, মহাদেবদা যদি তিনশোমণি নৌকোটা দেয়, আর বিনা সুদে কিছু টাকা–।

মহাদেব মিস্তিরি সম্পর্কে কাকা হয় বিদ্যুতের। সেই বিদ্যুৎই বলল, ও দেবে বিনা সুদে টাকা? তুমি পেঁপেগাছে কাঁঠাল ফলতে দেখেছ বুঝি?

সাধুচরণ পরিমল মাস্টারের প্রিয়পাত্র, তবু সে কেন ওঁকে এড়িয়ে যেতে চাইছে, তা অন্যরা বুঝতে পারে না।

সাধুচরণ আবার ওদের প্রস্তাবে বাধা দেবার জন্য বলল, মাস্টারমশাই কলকাতায় গেছেন, কবে ফিরবেন, তার ঠিক নেই।

মনোরঞ্জন টপ করে জানিয়ে দিল, না না, মাস্টারমশাই কালই ফিরেছেন আমি দেখেছি। জলপরি লঞ্চে এলেন।

দুদিন পরে খুব ভাল খবর পাওয়া যায়।

নিরাপদ আর বিদ্যুৎ দেখা করেছিল পরিমল মাস্টারের সঙ্গে। নিজের কোনও স্বার্থনা থাকলেও মনোরঞ্জনও গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। পরিমল মাস্টার দারণ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। টাকা-পয়সার আর কোনও প্রশ্নই নেই। চাল-ডাল-তেল-নুন যখন যা লাগবে, ওদের পরিবারের লোকেরা তা সময় মতো নিয়ে আসতে পারবে জয়মণিপুরের কো-অপারেটিভের দোকান থেকে। ওরা নিজেরাও প্রয়োজন মতো সেই সব জিনিস নিয়ে যেতে পারবে নৌকোয়। শর্ত হল, ফিরে এসে মাল বেচে আগে শোধ করে দিতে হবে ওই সব জিনিসের দাম। সুদ লাগবে না এক পয়সাও।

এরপর সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আর কোনও বাধাই রইল না। সামনের বানেই যাত্রা শুরু।

মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে উঠে মনোরঞ্জন চেঁচিয়ে উঠল, ওঃ মা, মা, মা মা!

ভয় পেয়ে কী হল, কী হল, বলে চেঁচিয়ে উঠল বাসনা। স্বামীকে জড়িয়ে ধরল।

মনোরঞ্জন হাত জোড় করে শিবনেত্র হয়ে বলতে লাগল, মা, মা, রক্ষা করা, মা! আমি আসছি মা!

বাসনা কেঁদে ফেলতেই পাশের ঘর থেকে ছুটে এল কবিতা। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বিষ্টুপদ, তারপর ডলি।

বিষ্টুপদ বলল, মাথায় থাবড়া দাও তো বউমা। স্বপ্ন আইটকে গিয়েছে! এক-এক সময় অমন আইটকে যায়।

কবিতা ভাবল, তারই নাকি ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে ওঠার রোগ আছে, সেজদার আবার হল কবে থেকে?

মনোরঞ্জন হাত জোড় করে বলে, যাচ্ছি, মা, মা, আমার অপরাধ নিয়ো না, মা! তোমার পায়ে আমার শত কোটি প্রণাম মা! তোমার পায়ে আমার শত কোটি প্রণাম মা! আমি আসছি মা।

একগাদা চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে। তাতে দেখা যায় মনোরঞ্জনের দু’চোখ জলে ভাসছে।

ডলি ঘরে ঢুকে বলল, ও মনন, কী হয়েছে, অ্যাঁ? চক্ষু খোল, এই তো আমি! বালাই ষাট, তুই কেন অপরাধ করবি।

ডলি ভুল করে ভেবেছিল, ছেলে বুঝি কোনও কারণে তার কাছে ক্ষমা চাইছে। কিন্তু মনোরঞ্জন যাকে ডাকছে সেই এই মা নয়, আরও অনেক বড় ধরনের মা।

মনোরঞ্জন বিহ্বল ভাবে বলল, আমি বনবিবিকে দেখলাম গো, মা।

ও, স্বপ্ন দেইখেছিস। একবার উঠে দাঁড়া।

স্বপ্ন নয়-গো, একেবারে চোখের সামনে। গাছতলা আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন মা বনবিবি, পাশে দুখে, মা আমাকে বললেন, বাদার সমস্ত জোয়ান মরদ আমাকে একবার পুজো দেয়, তুই বিয়ে করলি, আজও আমাকে পুজো দিসনি!

বলতে বলতেই বিছানায় দু’হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে, যেন প্রবল যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বুক ফাটা গলায় সে বলতে থাকে, আমি আসছি মা, আমার ভুল হয়ে গেছে মা, আমার অপরাধ নিয়ো না মা।

আবার সে হঠাৎ উঠে বসে বাসনার হাত চেপে ধরে বলে, মা বনবিবি আমাকে ডেকেছেন!

পরদিন সকালেই রটে গেল যে মনোরঞ্জন মা বনবিবিকে স্বপ্নে পেয়েছে।

সারা সকাল সে বিছানা থেকে উঠলই না, এমনই অবসন্ন হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে সে কাঁদে, মাঝে মাঝে শূন্যভাবে চেয়ে থাকে।

বিকেলে সাধুচরণ আর তার দলবল দেখতে এল তাকে। বারান্দায় উবু হয়ে চুপ করে বসে আছে মনোরঞ্জন, বিদ্যুৎ তাকে একটা বিড়ি এগিয়ে দিতেও সে খেল না। মায়ের পুজো না-দেওয়া পর্যন্ত সে আর বিড়ি খাবে না। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা বলারও কোনও উৎসাহ নেই তার।

সে-রকম জঙ্গল এখান থেকে এক জোয়ারের পথ। যখন তখন যাওয়া হয় না। নিরাপদ- বিদ্যুৎরা যখন পারমিট নিয়ে কাঠ কাটতে যাচ্ছেই, তখন মনোরঞ্জনও ওদের সঙ্গে ঘুরে আসুক। পুজো দেওয়াও হবে, দুটো পয়সার সাশ্রয়ও হবে। স্বয়ং বিষ্টুচরণই দিল এই প্রস্তাব।

গোলা থেকে আরও এক বস্তা ধান এর মধ্যে বার করা হয়েছে। গোলাটায় এখন টোকা দিলে ঢ্যাপ ঢ্যাপ করে। সেই দিকে তাকিয়ে ডলিও আর কোনও আপত্তি করতে পারল না। তবু সে বার বার বাসনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। একরত্তি কচি বউটা, তাকে ফেলে চলে যাবে! প্রথম সন্তান জন্মাবার আগে স্বামী-স্ত্রীর বেশি দিন ছাড়াছাড়ি থাকা ভাল নয়। এতে পুরুষ মানুষরা বার-মুখো হয়ে যায়।

সন্ধের সময় সে বাসনাকে জিজ্ঞেস করল, অ বউ, মনা তা হলে যাবে ওদের সঙ্গে? বাসনা সম্মতি সূচক ঘাড় হেলায়। ডলি তখন বলল, যাক তবে, ঘুরে আসুক, মা বনবিবি যখন ডেইকেছেন, এখন ঝড়-বৃষ্টি নেই, নদীতে ঢেউও তেমন তেজি নয়…।

বাসনাকে সে বলল, বউ, তোর সিঁদূরের কৌটোটা মনোকে দিয়ে দিস। মায়ের পাইয়ে ছুঁইয়ে নিয়ে আসবে।

সব ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর যাত্রার আগের দিন রাত্রে মনোরঞ্জন বাসনার থুতনি ধরে বলল, বাসনা, আমার বাসনা, একবারটি হাসোনা!

বাসনা ফোঁস করেও উঠল না, হাসলও না। গম্ভীর হয়ে রইল।

মনোরঞ্জন বলল, মায়ের পুজো দিতে যাচ্ছি, এ-সময় কেউ অসৈরন করে? জঙ্গলে ভাল কাঠ পেলে আমাদের পার হেড শ’পাঁচেক টাকা উপরি রোজগার হবেই। তখন তোমার জন্য এটা শাড়ি…এখানে নয়। একেবারে কলকাতার দোকান থেকে..বুঝলে…।

অত বড় নৌকোতে পাঁচ জন বসলেও যেন খালি খালি দেখায়। মনোরঞ্জন উঠে বসায় তবু যেন খানিকটা মানানসই হল। হালে বসেছে মাধব, শালবাহু নিয়ে মনোরঞ্জন ধরল একটা দাড়। মনোরঞ্জনকে নিতে মাধব আপত্তি করেনি, কারণ এ ছেলেটাকে দিয়ে কাজ হবে সে জানে। যেবার কালীবচকের কাছে ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিল মাধব, সেবার যদি এই মনোরঞ্জনের মতো আর একটা মানুষও থাকত তার পাশে তাই হলে লগি পিটিয়ে ডাকাতদের ঠাণ্ডা করে দিতে পারত।

সব সরঞ্জাম তোলা হয়েছে, ওদের বিদায় দিতে এসেছে অনেকে। একমাত্র বিদ্যুৎ শুধু জামা গায় দিয়েছে, আর সবাই খালি গায়ে তৈরি, গণ লেগেছে, এই তো যাত্রার পক্ষে শুভ সময়। নৌকো ছাড়তেই ডলি চেঁচিয়ে বলল, মামুদপুরের পাশ দিয়েই তো যাবি, একবার বউমার বাপের বাড়িতে দেখা করে যাস।

আচ্ছা!

সিঁদূরের কৌটোটা…মনে থাকে যেন।

বাঁধের ওপর অন্যদের জটলা থেকে একটু দূরে একটা নিমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাসনা। মনোরঞ্জন সে-দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসি দেখে ধক করে উঠল বাসনার মুখটা। কী অদ্ভুত হাসি। মন-খোলা মানুষ মনোরঞ্জনকে সে অনেক রকম ভাবে হাসতে দেখেছে, ভাস্কর পণ্ডিত কিংবা খিঁজির খাঁ রূপী মনোরঞ্জনের অট্টহাসিও সে শুনেছে, কিন্তু এরকম হাসি তো সে কখনও দেখেনি। চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে মনোরঞ্জনের, কেমন যেন স্থির দৃষ্টি, ঠোঁট অল্প একটু ফাঁক করা।

কাল রাতে বেশি কথা হয়নি, খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল মানুষটা। আজ সকাল থেকেও নানা কাজে ব্যস্ত। একটুখানির জন্যও বাসনা তার স্বামীকে আড়ালে পায়নি। তাই কি মনোরঞ্জন ওই রকম হাসি দিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে চায়? কোনও মানুষ একেবারে নতুন ভাবে হাসতে পারে!

একটু পরেই নৌকোটা সামনের ট্যাঁক ঘুরে চোখের আড়ালে চলে গেল।

.

তিন বন্ধুর উপাখ্যান

জয়মণিপুরে টেলিফোন আছে।

বিদ্যুতের আলো নেই, নদী পেরিয়ে মোটরগাড়ি আসার কথা তো দূরে থাক, ঠিকঠাক গোরুর গাড়িরও রাস্তা নেই। ফুড ফর ওয়ার্কও এই জলা-অঞ্চল চেনে না, তবু এখানে টেলিফোন থাকে কী করে? আছে, আছে। বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞানের মন ভাল থাকলে টেলিফোন ঝিলিনিং ঝিলিনিং করে বাজে, আবার বিজ্ঞান ভুলে গেলে, দু-তিন মাস টেলিফোনের ঘুম।

রাত পৌনে এগারোটায় কো-অপ অফিসে টেলিফোন বেজে উঠল।

এই দো-তলা মাঠকোঠাখানির একটা ঘরে বদন দাস শোয়। তার মানে এই নয় যে বদন দাস এই অফিসের দিন-রাতের কর্মী। সেরকম কেউ নেই। বদন দাসের বাড়িতে লোক অনেক, জায়গা কম, তাই সে রাত্রে এখানেই থাকে। তারও শোওয়া হল আর অফিস ঘরটা পাহারা দেওয়া হল।

ঘুম থেকে উঠে টেলিফোন ধরে বদন দাস ও-পারের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। সে-ও হ্যালো হ্যালো বলে, ও-পার থেকেও হ্যালো হ্যালো। তখন সে বলল, আপনি ধরেন স্যার, আপনি ধরে থাকেন, আমি মাস্টারমশাইকে ডেকে আনতেছি।

মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি পাঁচ-সাত মিনিটের পথ। বদন দাস প্রথমে টর্চ খুঁজে পায় না। এমনই অভ্যেস যে টর্চ ছাড়া রাত্রে বাইরে বেরুতেই পারে না। বালিশের পাশে রাখা ছিল, টর্চটা কখন গড়িয়ে পড়ে গেছে খাটের নিচে।

সারা দিন গরম, কিন্তু রাতের হাওয়ায় এখনও সিরসিরে ভাব। প্রথম বর্ষণের আগে সাপগুলো সাধারণত গর্ত থেকে বেরোয় না। তবে অভ্যেসবশত পায়ে ধপ ধপশব্দ করে বদন দাস। আর আপন মনে একটা গান গুনগুনোয়, কথা কয়ো না। শব্দ করো না। ভগমান নিদ্রা গিয়েছেন, ভগমান নিদ্রা গিয়েছেন, ভগমান নিদ্রা গিয়েছেন…।

মাস্টারমশাইয়ের কোয়ার্টারে আলো জ্বলছে দেখে বদনের অস্বস্তি চলে যায়। উনি অনেক রাত জেগে বই পড়েন। পড়াশুনা শেষ করে মানুষ চাকরি করতে যায়। তার পরও কারুর রাত জেগে পড়াশুনো করার মন থাকে? বিচিত্র! ভগমান নিদ্রা গিয়েছেন, ভগমান নিদ্রা গিয়েছেন, কথা কয়োনা। গোসাবায় এসেছিল কলকাতার থিয়েটার পার্টি। একবার শুনলেই গানের সুর মনে থাকে বদনের।

মাস্টারমশাই, মাস্টারমশাই।

কো-অপারেটিভের মেয়েদের তাঁতে বোনা লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এসে পরিমল মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, কী রে?

বদন দাসের মুখে টেলিফোনের বৃত্তান্ত শুনেই পরিমলমাস্টারের বুকের মধ্যে দু-চার লহমার জন্য ঢাকের শব্দ। প্রথম প্রতিক্রিয়াটা ভয়ের। তারপর প্রত্যাশার।

পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপাবার কথা ভুলে গিয়ে শুধু হাওয়াই চটি পায়ে গলিয়ে তিনি বললেন, চল।

কোয়ার্টারের সামনের কঞ্চির গেটে হাত দিয়ে তিনি আবার থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, একটু দাঁড়া।

ফিরে গিয়ে চার্লি চ্যাপলিনের মতো দ্রুততম ভঙ্গিতে খাটের তলা থেকে টেনে বের করলেন একটা লোহার তোরঙ্গ। তার ডালাটা খুলে ভেতরের অনেক কাগজপত্রের মধ্যে হাত চালাতে লাগলেন অন্ধের মতো। সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই।

বাক্সটা বন্ধ করে খাটের তলায় আবার ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখলেন, মাঝখানের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর স্ত্রী সুলেখা।

সব কিছু ব্যাখ্যা করে বোঝাবার সময় নেই বলে তিনি, টেলিফোন এসেছে, বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন।

পাঁচ দিন আগে কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সিগারেট ছেড়ে দেবেন। তখন প্যাকেটে ছ’টা সিগারেট। প্রথমে ভেবেছিলেন প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেবেন খালের জলে, তারপর ভাবলেন পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস নষ্ট না করে ভূগোলের টিচার বিনোদবাবুকে দিয়ে দিলেই তো হয়। তা-ও দেননি। বাড়িতে সিগারেট নেই, পকেটে সিগারেট কেনার পয়সা রাখবেন না বলেই সিগারেট খাওয়া হবে না। এর মধ্যে বীরত্বের কিছু নেই। সিগারেট আছে তবু খাচ্ছেন না, এটাই আসল পরীক্ষা। সেই জন্যই টিনের তোরঙ্গের মধ্যে।

কিন্তু এই সব সংকটের সময় একটা সিগারেট না থাকলে বড় অসহায় লাগে।

মেয়ে থাকে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের হস্টেলে। ছেলে ডাক্তারিতে ভর্তি হবার জন্য পরীক্ষা দেবে, তাই আছে মামাবাড়িতে। ওদের কারুর কোনও বিপদ হয়নি তো? প্রথমেই মনে আসে এই কথা।

কে টেলিফোন করেছে নাম বলেনি?

বুঝলাম না মাস্টারমশাই। খালি একনাগাড়ে হ্যালো হ্যালো, আর বললে এক্ষুনি মাস্টারমশাইকে ডেকে আনো, ঘুমিয়ে পড়লেও ডেকে তুলবে। সেই জন্যই তো এত রাতে আমি ছুটে এলুম। কটা বাজে এখন মাস্টারমশাই!

এগারোটা হবে।

এত জরুরি ডাক শুনেই আশা-নিরাশার ধন্ধ। এক লাখ সত্তর হাজার টাকার একটা স্কিম দিয়েছিলেন সরকারকে, সেটা পাশ হয়ে গেছে? গত মাসে রাত সাড়েন’টার সময় এক জন টেলিফোন করে জানিয়েছিল যে চিফ সেক্রেটারি তার পরদিন এ-দিকে আসবেন। সেই রকম কেউ? জেনিভাতে কো-অপারেটিভ মুভমেন্টের ওপর একটা সম্মেলন হচ্ছে, কে যেন বলছিল, জয়মণিপুরে এত ভাল কাজ হচ্ছে পরিমল মাস্টারের যাওয়া উচিত…টেলিগ্রাম অফিস থেকে অনেক সময় টেলিফোনে খবর জানায়…ছোট শ্যালিকা মিতুন রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছে। খোকন বা মিতুর হঠাৎ কোনও অসুখ…।

তুই কী গান গাইছেস রে বদন? ভাল করে কর তো।

কথা কয়ো না, শব্দ করো না, ভগমান নিদ্রা গিয়েছেন, ভগমান নিদ্রা গিয়েছেন..আর কথাগুলো মনে নেই মাস্টারমশাই।

বেশ ভাল গান তো! পুরোটা শিখলি না? তুই আর একটা কী যেন গান গাস, সোনার বরণী মেয়ে –।

সোনার বরণী মেয়ে, বলো কার পথো চেয়ে, আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া-আ-আ-আ।

কাঠের সিঁড়িতে ধুপ ধুপ শব্দকরে দু‘জনে উঠে এল ওপরে। পরিমল মাস্টার সবরকম উত্তেজনা দমন করে যত দূর সম্ভব শান্ত ভাবে বললেন, হ্যালো।

কোনও উত্তর নেই। লাইনও কাটেনি। ও-পাশে ঝন ঝন ঝ্যাঁকে ঝ্যাঁকো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বিলিতি বাজনা।

পরিষ্কার বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠল তাঁর কপালে।

তিনি হ্যালো হ্যালো বলে যেতে লাগলেন। নিজের উপস্থিত বুদ্ধি সম্পর্কে ঈষৎ গর্বের ভাব আছে পরিমল মাস্টারের। তিনিও ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না। দেরি দেখে, যে টেলিফোন করছিল সে রিসিভারটা রেখে অন্য কোথাও গেছে। কিন্তু কে এবং কোথা থেকে? সুন্দরবনের এই নিশুতি পাড়াগাঁয়ে যন্ত্র মারফত ওই বাজনার শব্দ যেন মনে হয় অন্য কোনও গ্রহ থেকে আসছে।

এবার ও-দিক থেকে কেউ রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো, কাকে চান?

এবার রাগ হল পরিমল মাস্টারের। তিনি কড়া গলায় বললেন, আমি কারুকে চাই না। আমাকে কেউ একজন টেলিফোনে ডেকেছে? আপনি কোথা থেকে ।

ধরুন!

আরও একটু পরে ও-পার থেকে কেউ এক জন প্রচণ্ড চিৎকার করে বলতে লাগল, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো।

আপনি কাকে চাইছেন?

কে, পরিমল? বাপ রে বাপ, এতক্ষণ লাগে? আমি অরুণাংশু বলছি…।

পরিমল মাস্টারের বুক খালি করা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

কলকাতা শহরতলির একই স্কুলে, একই ক্লাসে, একই বেঞ্চিতে বসে পড়ত তিন বন্ধু। ক্লাস সেভেন থেকে এক সঙ্গে। সুশোভন, অরুণাংশু আর পরিমল। অরুণাংশু অত্যন্ত লাজুক, সুশোভন জেদি আর দলপতি ধরনের, পরিমল টিপিক্যাল ভাল ছাত্র। সে কত কাল আগেকার কথা। ত্রিশ বত্রিশ বছর তো হবেই। স্বভাবে আলাদা আলাদা হলেও ওই তিনটি স্কুলের বন্ধু ছিল একেবারেহরিহর আত্মা। স্কুলে সিরাজদ্দৌল্লা নাটকের অভিনয় হল, সুশোভনই তার নায়ক এবং পরিচালক। পরিমল লর্ড ক্লাইভ, কারণ তার রঙ ফরসা আর ইংরেজি উচ্চারণ ভাল। অরুণাংশুকে দেওয়া হয়েছিল সামান্য দূতের পাঠ, তা-ও সে পারেনি, রিহার্সালেই নাকচ।

সময় মানুষকে কত বদলে দেয়? সেইসুশোভন, অরুণাংশু আর পরিমল এখন কোথায়। ম্যাট্রিকে স্টার এবং স্কলারশিপ পেয়েছিল পরিমল, সুশোভন কোনওক্রমে ফার্স্ট ডিভিশন আর অরুণাংশু সেকেন্ড ডিভিশন। কলেছে এসে তিন বন্ধুর ছাড়াছাড়ি। অরুণাংশু মণীন্দ্র কলেজে পড়তে গেল সায়েন্স নিয়ে। সুশোভনও সায়েন্স, কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে। আর যে-সব কলেজে ছেলে আর মেয়ে এক সঙ্গে পড়ে, সে-রকম কোনও কলেজে পরিমলের পড়া হল না, তার বাবার আপত্তি। তাই স্কলারশিপ পেয়েও সেস্কটিশ বা প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হল না, সে আর্টস পড়তে গেল সুরেন্দ্রনাথে।

যার যেখানেই কলেজ হোক, প্রত্যেকদিন বিকেলবেলা তিন বন্ধুর দেখা হবেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে।

ইন্টারমিডিয়েটের পর সুশোভন গেল শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে, অরুণাংশু কেমিস্ত্রি প্র্যাকটিকালে ফেল করে আত্মহত্যা করতে গেল। তাতেও ব্যর্থ হয়ে এবং কোনও রকমে কম্পার্টমেন্টালে পাশ করে অরুণাংশু কলেজ বদলে সেন্ট পলসে এল, বি.এসসি পড়তে। আই এ-তে বাংলা ও ইংরেজি দুটোতেই ফার্স্ট হয়ে পরিমল সিটি কলেজে ফ্রি ছাত্র হিসেবে বি.এ.-তে ইকনমিকসে অনার্স নিল।

এই তিন ছাত্রের জীবনের গতি কোন দিকে যাবে, তা এই সময়েও ঠিক করে বলা, কোনও জ্যোতিষী কেন, বিধাতারও অসাধ্য ছিল।

যেবার অরুণাংশু আত্মহত্যা করতে যায় সেবারই অরুণাংশুর প্রথম কবিতা ছাপা হয়, পরিচয় পত্রিকায়। পরিমল তখন থেকেই রাজনীতির দিকে ঝোঁকে। আর প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢোকার পর থেকে সুশোভন বড়লোকের মেয়েদের পেছনে ঘোরাঘুরি অভ্যেস করে এবং নিজের সাজপোশাকের প্রতি অত্যধিক নজর দেয়। নিজের ডিজাইনে দর্জির কাছ থেকে বানানো নিত্যনতুন কায়দার শার্ট তার গায়ে।

কোনওক্রমে বি.এসসি পাশ করে, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে অরুণাংশু কাজ নিল এক কারখানায়, যে-কারখানার নামে তখন ব্রিটিশ গন্ধ। এম.এ-তে পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র পরিমল তখন ছাত্র নেতা, সুশোভন হবু-ইঞ্জিনিয়ার এবং ডন জুয়ান। পরিমলের মধ্যে প্রেমিকের ভাব কখনও দেখা না গেলেও সিক্সথ ইয়ারে উঠেই সে গোপনে বিয়ে করে সহপাঠিনী সুলেখাকে। তার বিয়ের সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র অনুপস্থিত ছিল অরুণাংশু, সে তখন দ্বিতীয় বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে এবং কারখানার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।

ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তেমন কিছু কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি সুশোভন, কয়েক বছর এখানে ওখানে অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে সে চলে যায় নাইজিরিয়ায়। তার মধ্যেই অরুণাংশুর পর পর তিনটি কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়ে রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছে। শত শত কবিদের মধ্যে থেকে এক লাফে ওপরে উঠে এসেছে অরুণাংশু। বিনীত ও লাজুক অরুণাংশুর সে-সময়কার কবিতার বৈশিষ্ট্য ছিল অত্যন্ত হিংস্র ও অসভ্য শব্দ ব্যবহার। এম.এ ফাইনাল পরীক্ষা দেবার আগেই সুলেখার সঙ্গে জেলে যায় পরিমল, জেলে বসেই সে অরুণাংশুর কবিতা পড়ে অবাক হয়েছিল। বাংলায় কোনও দিন ভাল নম্বর পায়নি অরুণাংশু, সে এমন কবিতা লিখতে পারে?

সুশোভন আর অরুণাংশুকে এখন বাংলার সকলেই এক ডাকে চেনে। বাংলা ছাড়িয়ে আরও দূরে গেছে তাদের খ্যাতি। অরুণাংশুর জীবনযাপনের নানা সত্য-মিথ্যে কাহিনি লোকের মুখে মুখে ঘোরে, কোথায় সেই লাজুক কিশোর, এখন সে দারুণ উগ্র ও অহঙ্কারী, কথায় কথায় সে লোকের সঙ্গে মারপিট বাধায় এবং মদ্যপানের রেকর্ডে ইতিমধ্যেই সে মাইকেলকে ছাড়িয়ে গেছে। যারা তার কবিতার ভক্ত, তারাই তার হাতে মার খেতে ভালবাসে।

নাইজিরিয়ায় গিয়ে সুশোভন প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে একটা শৌখিন নাটকের দল গড়েছিল। ভারতে ফিরে এল সে পুরোপুরি নাট্যকার হিসেবে। বেতার নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে সে প্রথমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর সে গড়ল নিজের দল। এখন সে প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের পুরোধা। সুশোভনের পরিবর্তন আরও বিস্ময়কর। সেই উৎকট সাজপোশাকে আগ্রহী, ডন জুয়ানের সামান্য চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না তার মধ্যে, স্ত্রী ও দুটি সন্তান থাকলেও সুশোভন এখন অনেকটা যেন গৃহী-সন্ন্যাসীর মতো, খদ্দেবের পাজামা ও পাঞ্জাবি ছাড়া কিছু পরে না, নাট্য প্রযোজনার অবসরে বা অবসর করে নিয়ে সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় দেশের মানুষের সমস্যার গভীরে পৌঁছবার জন্য, তার কথাবার্তার মধ্যেও ফুটে ওঠে ব্যাকুল অনুসন্ধানীর সুর। শান্তিগোপালের যাত্রাদল যেবার রাশিয়ায় যায় নিমন্ত্রণ পেয়ে, সেবাবই এক সেবা সংস্থার আমন্ত্রণে সুশোভন তার পুরো নাটকের দল নিয়ে ঘুরে এল আমেরিকা ও কানাডায়। তার সাম্প্রতিক নাটকটিতে ছিল ধনতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন দেশের প্রতি সমালোচনা ও কঠিন ব্যঙ্গ বিদ্রূপ।

পরিমলের বাবার খুব আশা ছিল যে ছেলে আই.এ.এস পরীক্ষা দেবে। পরিমল জেল খেটে আসায় সে-সম্ভাবনা ঘুচে গেল, তার ওপরে আবার ছাত্র অবস্থাতেই অসবর্ণ বিয়ে। এ-সবের জন্য পরিমলের বাবার ধরল কথা-না-বলা রোগ। পরের বছর পরিমল এম এ-টা পাশ করে। পরিমল আর সুলেখা বাসা ভাড়া করল বরানগরে, বেহালার একটি কলেজে পরিমল যোগ দিল লেকচারার হিসেবে, আর দক্ষিণেশ্বরের একটা স্কুলে সুলেখা। তবে রাজনীতির সঙ্গে সুলেখা জড়িয়ে রইল বেশি করে। দ্বিতীয় বার গর্ভবতী অবস্থায় একাই জেলে গিয়ে সুলেখা ছাড়া পায় ঠিক তার প্রথম সন্তানের জন্মের দেড় মাস আগে।

একই স্কুলের এক ক্লাসের এক বেঞ্চের তিন জন ছাত্রের মধ্যে এক জন খ্যাতিমান নাট্যকার ও পরিচালক, অন্যজন বিশিষ্ট কবি। অথচ বাংলায় সব চেয়ে ভাল ছাত্র ছিল পরিমল। সে লেখার দিকে না গিয়ে অন্তত কোনও মন্ত্রী বা লোকসভা কিংবা বিধানসভায় বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্য নেতা হলেও মানানসই হত। কিন্তু পরিমল সে-দিকে গেল না।

সক্রিয় রাজনীতি করার বদলে পরিমল আস্তে আস্তে হয়ে উঠল তাত্ত্বিক। সে পড়ুয়া মানুষ, মিছিলে গিয়ে চিৎকার কিংবা মাঠে গিয়ে আগুন ঝরা বক্তৃতা দেওয়ার চেয়ে সে ঘরোয়া বৈঠকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকতত্ত্ব বিশ্লেষণ করতেই ভাল পারেও ভালবাসে। তাত্ত্বিকরা থাকে পেছনের দিকে, ক্যাডাররা সকলে তাদের চেনে না। তবু এই অবস্থাতেই পরিমল সন্তুষ্ট ছিল। সুলেখা তো অন্তত প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আছে।

ভেতরে ভেতরে কবে যে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে তা পরিমল নিজেও ঠিক টের পায়নি প্রথমে।

সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করার পর দুটি ব্যাপারে গুপ্ত কাঁটার মতো পরিমলকে সর্বক্ষণ একটু একটু পীড়া দিত। বরানগর থেকে সেই বেহালায় কলেজে পড়াতে যাওয়া। এই যাতায়াতে শুধু সময় নয়, জীবনীশক্তিরও অনেকটা খরচ হয়ে যায়। প্রতি দিনের বিরক্তি। অথচ বাড়ি পালটানো যায় না নানা কারণে। বরানগরের বাড়ি থেকে সুলেখার স্কুল কাছে। সুলেখার বেশি সময় দরকার। অনেক চেষ্টা করে নিজের জন্য চাকরি জোটাবে, সেরকম মানুষই পরিমল নয়। তাছাড়া, এম.এ-তে তার রেজাল্টও ভাল হয়নি, সাধারণ সেকেন্ড ক্লাস। সুলেখা তো আর এম.এ পরীক্ষা দিলই না।

বাড়িটা বদলানো দরকার ছিল নানা কারণে। কিন্তু এ-দেশে চাকরিজীবীদের সন্তান জন্মালে আয় বৃদ্ধি হয় না, যদিও খরচ বেড়ে যায়। মিতু আর খোকন তখন জন্মে গেছে। বাড়ি পালটানো মানেই বেশি ভাড়া। প্রফুল্ল সেনের আমলে ডামাডোলের সময় কলকাতার বাড়ি ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেল, তারপর লাফাতে লাগল তিনগুণ চারগুণের দিকে।

দুখানা ঘর, একটা বারান্দা, আলাদা বাথরুম, রান্নাঘর, দো-তলায় মোটামুটি ভোলামেলা, ভাড়া একশো পঁচাত্তর, ছাড়লেই অন্তত চারশো। ও-বাড়ির বাড়িওয়ালা অবশ্য পরিমলদের উঠিয়ে দেবার জন্য কোনও চক্রান্ত করেনি, লোকটা জানত যে ওই স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রাজনীতি করে, ওদের পেছনে জোর আছে। তবু ওই বাড়িওয়ালার জন্যই পরিমলের মনে হত, আঃ, যদি এ বাড়িটা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া যেত। লোকটির অন্য কোনও দোষ নেই, দেখা হলে হেসে কথা বলে। তবু, ওই ব্যক্তিটি অসম্ভব রকম অমার্জিত। যখন তখন পরিমলের সামনেই লোকটা ফ্যাঁৎ করে সিকনি ঝাড়ে, ওয়াক ওয়াক শব্দ তুলে গয়ের ফেলে, এক তলায় উঠোনে খোলা নর্দমার কাছে দাঁড়িয়ে বাঁ-দিকের ধুতি ঊরু পর্যন্ত তুলে পেচ্ছাপ করে।

সুলেখা এ-সব গ্রাহ্য করে না, কিন্তু পরিমল কিছুতেই সহ্য করতে পারে না এমন অমার্জিত কোনও মানুষকে। লোকটা তার নিজের বাড়ি নোংরা করছে, তাতে তার বলারই-বা কী আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকটি কদর্য অশ্লীল ভাষায় অন্যদের সঙ্গে কথা বলে। সব নাকি রসিকতা। কিছু বলতে পারত না বলেই পরিমলের বেশি কষ্ট। তার সব সময় ভয়, যদি তার ছেলে মেয়েরা এসব দেখে শেখে।

সুলেখার সময় কম বলে পরিমলই বেশি নজর রেখেছিল মিতু আর খোকনের ওপর। সময় পেলেই সে ওদের নিয়ে পড়াতে বসেছে। সে জানত, মাস্টার-দম্পতির পুত্র-কন্যা, ওরা যদি ভাল রেজাল্ট না করে স্টাইপেন্ড স্কলারশিপ না পায়, তাহলে ওদের বেশি দূর পড়ানো সম্ভব হবে না। বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে শুধু মুখই করে, এই স্লোগান তখন উঠতে শুরু করেছে, তত্ত্বের দিক থেকে একথা পরিমল মানেও বটে, কিন্তু তার ছেলে মেয়েদের স্কুল ছাড়িয়ে পড়া বন্ধ করে দেবার কথা সে চিন্তাও করতে পারে না। এই বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থার এক-একটি যন্ত্র হয়েই তো সে আর সুলেখা জীবিকা সংগ্রহ করছে।

শুধু বেহালার দূরত্ব বা বাড়ি না পালটাবার জন্যই নয়, ভেতরে ভেতরে অন্য ভাবেও ক্ষয় হচ্ছিল পরিমল। দলের বৈঠকে নীরস তাত্ত্বিক আলোচনাতেও সে এক সময় ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল। এর চেয়ে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো অনেক ভাল। মাটিতে পা দিয়ে হাঁটা, নদীর ধারে বা গাছতলায় বসা মানুষকে তার নিজের পরিবেশে পাওয়া।

বিবাহিত জীবনের এগারো বছর পূর্ণ হবার পর পরিমল এক দিন অপ্রত্যাশিতভাবে সুলেখাকে জিজ্ঞেস করল, সুন্দরবনের জয়মণিপুরে একটা কো-এড হাইস্কুলের দু’জন টিচারের চাকরি খালি আছে, তুমি যাবে?

পাঁচ মিনিট কথা বলেই সুলেখা অনেকটা বুঝে ফেলল। স্বামীর মনের এই নিঃস্বতার দিকটির সন্ধান সেবিশেষ নেয়নি। সে পালটা প্রশ্ন করল, তুমি পারবে?

ইন্টারভিউ দিতে গেল দুজনেই। সেই প্রথম ক্যানিং থেকে লঞ্চে চেপে ওদের সুন্দরবন দেখা। অনেকটা যেন বেড়াতে যাবার ভাব। স্বামী-স্ত্রীতে একসঙ্গে বেড়াবার সুযোগ এ-রকম বিশেষ হয়নি। গোসাবার ভাতের হোটেলের গরম গরম ভাত আর পাতলা মাঝের ঝোল খেতেও খুব মজা লেগেছিল। অসুবিধে হল পরিমলকে নিয়ে। স্কুলের এম.এ পাশ শিক্ষকরা কলেজে সুযোগ নেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে, আর পরিমল কলেজ ছেড়ে স্কুলে আসতে চায় কেন? স্কুলে রাজনীতি ঢোকার ব্যাপারে সবাই তখন চিন্তিত। অর্থাৎ সবাই সতর্ক, অন্য পার্টির লোক যাতে না ঢুকে পড়ে।

পরিমল জবাব দিয়েছিল, খুব ছেলেবেলায় আমি গ্রামে কাটিয়েছি, তারপর টানা পঁচিশ-তিরিশ বছর শহরে। এখন আমার আবার গ্রামে এসে থাকতে ইচ্ছে করে।

হেডমাস্টারমশাই সদাশিব ধরনের। অর্থাৎ ভালো মানুষ কিন্তু অকর্মণ্য। তিনি পরিমলের মুখের ভাব দেখে আন্দাজ করলেন, এই লোকটির কাঁধে অনেক ভারচাপানো যাবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যখন আসতে চায়, তখন সহজে চলে যাবে না বলেই মনে হয়।

এ-দিকে আসতে চাইছেন কেন, বাদা অঞ্চলের মানুষজন চেনেন? থাকতে পারবেন এদের সঙ্গে? দখনে মানুষদের সম্পর্কে লোকে কী বলে জানেন না?

যেখানেই যাই, মানুষের সঙ্গেই তো থাকতে হবে।

গ্রাম ভালবাসেন, নেচার লাভার, কবিতা-টবিতা লেখেন নাকিমশাই?

ক্লান্তভাবে পরিমল বলেছিল, নাঃ, আমি জীবনে এক লাইনও কবিতা লিখিনি।

তারপর এখানে কেটে গেছে দশ বছর। এখন ক্যানিং থেকে মোল্লাখালি, এর মধ্যে পরিমল মাস্টারের নাম জানে না এমন কেউ নেই। মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবার এতখানি শক্তি বা উৎসাহ যে তার মধ্যে নিহিত ছিল, পরিমল তা নিজেই জানত না। এখানেও লোকে ফড়াত করে সিকনি ঝাড়ে, শব্দ করে গয়ের তোলে, পেচ্ছাপ করে যেখানে সেখানে, তবুপরিমলের খারাপ লাগে না। অল্প চেনা লোককে তুই বলতে একটুও আটকায় না তার। এখানেও পোশাকের বাহুল্য নেই। মুখের ভাষাটাও বদলে নিয়েছে। প্রথম প্রথম লোকের মুখে নির্দোষী শুনলে বলত নির্দোষ বলো, অলসকে কেউ আয়েসী বললে তার কানে লাগত, আয়েসী মানে তো পরিশ্রমী। এখন এসব চুকে গেছে। এই যে বদন, ও কিছুতেই সমবায় বলবে না, সব সময় বলে সামবায়। পরিমল ওর পিঠ চাপড়ে বলে, ঠিক আছে, ওতেই চলবে।

কী ব্যাপার, অরুণাংশু? এত রাত্রে?

তোর ওখানে সুশোভন গিয়েছিল গত সপ্তায়? আমাকে বলিসনি কেন?

সুশোভন তো নিজে থেকে হঠাৎ এসেছিল।

শালা, আমাকে বাদ দিতে চাস?

কোথা থেকে কথা বলছিস?

পার্ক স্ট্রিট থেকে। সুশোভনের সঙ্গে তোর বেশি খাতির? ও-সব নাটক-ফাটক আমি গ্রাহ্য করি না। বঙ্গের গ্যারিক! একদিন একটা থাপ্পড় কষাব।

তুই কী বলছিস অরুণাংশু, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

এখানে আসবার পর প্রথম পাঁচ ছ বছর পরিমল কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেনি। কলকাতায় গেলেও বন্ধুদের সঙ্গে পারতপক্ষে দেখা করত না। সকলের ধারণা হয়েছিল, সপরিবারে পরিমল অজ্ঞাতবাসে গেছে। রাজনৈতিক সহকর্মীরা দু-এক জন এখানে আসতে চাইলেও পরিমল বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি, এড়িয়ে গেছে। সুশোভনকেও ডাকেনি। কুমিরমারির হাটে সুশোভনের সঙ্গে এক দারুণ বৃষ্টিবাদলার সন্ধ্যায় হঠাৎ দেখা। সুশোভন নিজেই একা ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে পড়েছিল। দু’জনেই দুজনকে দেখে সবিস্ময়ে বলে উঠেছিল, আরে! যেন জঙ্গলের মধ্যে লিভিংস্টোন ও স্ট্যানলির সাক্ষাৎকার।

তারপর থেকে সুশোভন মাঝে মাঝেই আসে। দু-তিন দিনের জন্য গ্রামের মধ্যে হারিয়ে যায়, ফিরে এসে পরিমলের কোয়ার্টারে পুরো এক দিন ঘুমোয়। অরুণাংশুও একবার এসেছিল গত বছর, সেই সূত্র ধরে বেশ কয়েক জন সাংবাদিক। সুন্দরবনে বেড়াবার নামে দল বেঁধে শহুরে লোকের এখানে আসা পরিমল মাস্টারের একেবারেই পছন্দ নয়। ক্রমশ তার মনে এই বিশ্বাসটা দানা বাঁধছে যে, শহরের ছোঁয়াচটাই খারাপ।

পার্ক স্ট্রিটের আলোর রাজ্যে বসে অরুণাংশু বোধ হয় কল্পনাই করতে পারছে না যে এখানে একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ওখানে বাজছে বিলিতি বাজনা, এখানে ঘ্যা-ঘো-ঘ্যা-ঘোশব্দে ডাকছে কোলা ব্যাঙ। মদের টেবিলে অরুণাংশুর বন্ধুরা এক সন্ধেবেলা যা খরচ করবে, তাতে এখানকার একটি পরিবারের এক মাস সংসার চলে যায়। একটি পরিবার নয়, দুটি পরিবার।

অরুণাংশু আরও কিছুক্ষণ টেলিফোনে রাগারাগি করল। তারপর ঘোষণা করল, আগামী রবিবার সে এখানে আসছে, মুরগি-ফুরগি কিচ্ছু চাই না, শুধু মাছ, টাটকা মাছ খাওয়ালেই হবে।

আপত্তি জানিয়ে কোনও লাভ নেই। বিখ্যাত লোকদের অনেক রকম যোগাযোগ থাকে, হয়তো অরুণাংশু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কোনও লঞ্চ নিয়ে এসে উপস্থিত হবে। অরুণাংশু তা পারে।

অরুণাংশু, তুই আসবি, খুব ভাল কথা, শুধু একটা অনুরোধ করব? সঙ্গে বেশি লোকজন আনিস না।

যদি বউ-বাচ্চা নিয়ে আসি?

তাহলে তো আরও ভাল। সুলেখা বলছিল–।

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! গুন্নাইট মাই বয়!

লাইন কেটে দিয়েছে অরুণাংশু। শেষকালে অমন হেসে উঠল কেন? এর মধ্যে হাসির কী খুঁজে পেল? পরিমল ভাবল, আমরা সবাই মধ্যবয়স্ক হয়ে গেছি, অরুণাংশুর মধ্যে খানিকটা ছেলেমানুষি রয়ে গেছে এখনও। কবিতা লিখতে গেলে, বা কিছু সৃষ্টি করতে গেলে বুকের মধ্যে বোধহয় শৈশব জাগিয়ে রাখতে হয়।

গত বছর এসে অরুণাংশু যেমন জ্বালিয়েছিল খুব, সে-রকম একটা ব্যাপারে অবাকও করেছিল।

অরুণাংশুর বায়নাক্কার শেষ নেই। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল পাঁচ জনকে। দিনের মধ্যে দশ-বারোবার চায়ের হুকুম, তা ছাড়াও সর্বক্ষণ এটা চাই, ওটা চাই। গ্রামের একটি মাত্র দোকানে যা সিগারেট ছিল, তা মাত্র দু’দিনে অরুণাংশু বলতে গেলে একাই সব শেষ করে ফেলল, তারপর নৌকোয় করে একজন লোককে পাশের গ্রামের হাটে পাঠাতে হল সিগারেট আনবার জন্য। অরুণাংশু এখানে যাতে মদ্যপান না করে সেজন্য কাকুতি-মিনতি করেছিল পরিমল মাস্টার, কিন্তু অরুণাংশু শোনেনি, তার ওপর দুটো কাঁচের গেলাস ভেঙেছে, এবং খালি বোতলটা রাত্রির অন্ধকারে ফাঁকা মাঠ ভেবে ছুঁড়ে দিয়েছে মেয়েদের হস্টেলের কম্পাউন্ডে। এ-রকম মূর্তিমান উপদ্রব পরিমল মাস্টার এখানে চায় না।

ফিরে গিয়ে সুন্দরবনের গ্রামের পটভূমিকায় অরুণাংশু একটা ছোট গল্প লিখেছিল। সে-গল্পটা পড়ে পরিমলমাস্টার বিস্মিত না হয়ে পারেনি। একেবারে এখানকার গ্রামের নিখুঁত ছবি। সমস্যার খুব গভীরে সে ঢুকতে পারেনি হয়তো, সে-চেষ্টাও করেনি, কিন্তু চমৎকার ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। অরুণাংশু গ্রামে ঘুরল না, লোকজনের সঙ্গে কথা বলল না, শুধু আড্ডা দিয়ে আর মদ খেয়ে চলে গেল, তবু সে এত সব পেল কী করে? তবে কি ওদের একঝলক দেখে নিলেই চলে? এরই নাম কি অন্তর্দৃষ্টি?

অরুণাংশুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় অন্যমনস্কভাবে পরিমল মাস্টার প্যাকেটের সবকটা সিগারেটই শেষ করে ফেলেছে। এবার সে বদনকে বলল, একটা বিড়ি দে, বদন!

বদন বিড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব মাস্টারমশাই?

না রে পাগল! আমি ঠিক গান গাইতে গাইতে চলে যাব।

পরিমল মাস্টারের স্টকে একটিই মাত্র গান। আগুন আমার ভাই, আমি তোমারই জয় গাই। এক-এক সময় এই গানটাকেই সে প্রেম সঙ্গীতের মতো খুব ভাব দিয়ে গান, তখন তার চোখ দু’টি আধো-বোজা হয়ে যায়।

সুলেখা জেগে আছে। থাকবেই, কৌতূহল চেপে মানুষ ঘুমোত পারে না। সব শুনে সে বলল, এর থেকে খারাপ খবরও তো হতে পারত।

একবার সিগারেট খেতে শুরু করায় পরিমল মাস্টারের মুখ শুল শুল করছে আর একটা সিগারেটের জন্য। অথচ উপায় নেই, এখন যত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া যায়। পরিমল মাস্টার মশারি তুলে বিছানায় ঢুকে পড়ল আর সুলেখা গেল শিয়রের কাছে জানালাটা বন্ধ করতে।

তখনই সে শুনতে পেলেন কান্নার আওয়াজটা।

বাইরের অন্ধকারে নিঃসাড়ে পড়ে আছে পৃথিবী। আলো নেই, তাই কোনও ছায়া নেই, সেই জন্য কোনও কিছুর অস্তিত্বও নেই। এর মধ্যে কান্নার আওয়াজে কেমন যেন অপ্রাকৃত মনে হয়।

এক জন নয়, অনেকের কান্না। সুলেখা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনে মুখ ফেরাল।

কী?

কারা যেন কাঁদছে। এখন তো সাপখোপের দিন নয়।

মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে একটু দ্বিধা করল পরিমল মাস্টার। জানলার কাছ থেকে। সরে এসে খুব কাতর গলায় বলল, আমার খুব ঘুম পেয়েছে, এত রাতে করবার কিছু নেই। জানলাটা বন্ধ করে দাও, আমি একটু ঘুমাই।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 1 of 5 ): 1 23 ... 5পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress