জঙ্গলমহলের অচেনা অন্ত্যজ
কংসাবতী ও সুবর্ণরেখার অববাহিকা ঝাড়গ্রামও মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম প্রান্তস্হ বিহার ও উড়িষ্যার সীমান্ত সংলগ্ন—– এই অঞ্চলের বসবাসকারী এক অচেনা জনগোষ্ঠী”–“জেতোড়”! এদের প্রকৃত পরিচয় কুয়াশাচ্ছন্ন! স্হানীয় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ—
“যার নাই জাত কুল
সে যায় কাঁসাই কুল”
লোক প্রচলিত এই প্রবাদের সূত্র ধরে বলা যায় যে কাঁসাই কুলে জাতি কুল ভ্রষ্ট মানুষেরা এসে বসবাস করত। এই জাতি কুল ভ্রষ্ট শংকর জনগোষ্ঠীর এক বিশিষ্ট রূপ–জেতোড়। এই জনগোষ্ঠীর নারীরা ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী। এটাই এই সম্প্রদায়ের প্রধান জীবিকা ছিল। সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। এই জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক নৈপুণ্য রয়েছে মাছ ধরা সংগীত ও ধাত্রীবিদ্যায়। মাছকে এরা বলে” গঙ্গা ফল”!
জেতোড় জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে এই লোক কথাটি বহুল প্রচলিত—–
সে এক প্রাচীন কালের কথা— আদিম জঙ্গলমহল– শালডুংরি জঙ্গল পাহাড় এর মধ্যে মানুষের বসবাস। জঙ্গলে পশু শিকার গাছের ফল মূল ঝর্ণার জলই ছিল এদের খাদ্য-পানীয়। জঙ্গলমহলে এরা দলবদ্ধভাবে বাস করত। প্রত্যেক দলের একজন সর্দার বা মোড়ল থাকতো।
তাঁর কথামতো সবাইকে চলতে হতো। কেউ যদি কোন অন্যায় অত্যাচার করত তবে তাকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতো বা প্রাণে মেরে ফেলা হতো। খাদ্যের অভাব হলে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিত। তখনকার দিনে একমাত্র বড়াম ঠাকুরই ছিলেন তাদের একমাত্র উপাস্য দেবতা। এই মানুষেরা নানা প্রকার গাছ গাছরার রস দিয়ে নানান প্রকার মাদক দ্রব্য তৈরি করত। যেমন— তাল খেজুর গাছের রস থেকে তাড়ি, মহুয়া দিয়ে মদ, চালের থেকে হাড়িয়া, গাঁজা গাছের ফুল ফল দিয়ে গাঁজা, পাতা দিয়ে ভাঙ প্রভূতি। এইসব মাদকদ্রব্য খেয়ে নারী-পুরুষেরা সবাই মিলে নাচ-গানে মত্ত হয়ে আনন্দ-উৎসব করত। এরা এইসব অনুষ্ঠানে বড়াম ঠাকুরের পূজা আর্চনা খুব ধুমধাম করে করতো। শিকারে যাবার আগে ,চাষ বাস করার আগে, বা কোথাও যাওয়ার আগে বড়াম ঠাকুরের পূজা দিত! এইভাবে তখন বড়াম ঠাকুরের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল মানব সমাজের উপরে সর্বাধিক! তখনকার দিনে বড়াম ঠাকুর ও দলের সর্দার ই ছিল একমাত্র হর্তাকর্তা!
এই সময় জঙ্গলমহলের পাহাড় ডুংরি জঙ্গলে সাত উপদেবী বোন ছিলেন। কিন্তু তাদের কেউ মান্য করত না। এরা মানুষের অবজ্ঞা ও বড়াম ঠাকুরের প্রতিপত্তিতে হিংসায় জ্বলছে থাকতো। তাই মাঝে মাঝে এরা জঙ্গল বাসীদের বিভিন্নভাবে ক্ষতি করত। এদের প্রভাবে নানা প্রকার অসুখ-বিসুখ, মহামারী দেখা দিত! তখন বড়াম ঠাকুরের আশ্রয় ছাড়া জঙ্গল বাসীদের আর কোন উপায় থাকতো না! যখন এই সাত উপদেবী আর কিছুতেই আধিপত্য বিস্তার করতে পারল না তখন তারা সবাই মিলে বড়াম ঠাকুরের শরণাপন্ন হলো। বড়াম ঠাকুর তখন গাঁজা ভাঙ হাড়িয়া খেয়ে উন্মত্ত অবস্থায় ছিলেন। সাত বোন হাতজোড় করে প্রার্থনা জানায়— হে ঠাকুর— মানুষ তোমাকে মান্য করে পূজা দেয় কিন্তু আমাদের এই সাত বোনকে কেউ মান্য করে না। যদি মানুষ আমাদের পূজা করে তাহলে মর্তধামে আমাদের মহিমা বিস্তার করতে পারি। আর মানুষের মঙ্গল কামনাও করবো। এইভাবে স্তব-স্তুতি করে বড়াম ঠাকুর কে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। বড়াম ঠাকুর তাদের স্তব-স্তুতি তে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের সাথে নাচ গানে মেতে ওঠেন। এইভাবে সাত উপদেবীর সাথে বড়াম ঠাকুরের মিলন ঘটে। বড়ামঠাকুর তাদের বর দেন যে— মানুষেরা তোমাদের সেবা করবে ও পূজা দেবে! সাত উপদেবী বোনেরা বড়াম ঠাকুরের বরে সাতটি ছেলে মেয়ে প্রসব করেন। সন্তান হওয়ার পর তারা মহা সমস্যায় পড়লেন। কারণ এরা অবৈধ সন্তান। সাত বোন যুক্তি করে সাতটি সন্তানকে কাছাকাছি কাঁসাই সুবর্ণরেখা নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। এদিকে বড়াম ঠাকুর সব জানতে পারলেন। সাতটি সন্তান নদীর স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বড়াম ঠাকুর দলমার হাতিদের পাঠালেন তাদের উদ্ধার করতে। হাতিরা শুঁড় দিয়ে সাত সন্তানকে জল থেকে তুলে রক্ষা করলেন। বড়ামঠাকুরের দয়ায় তারা প্রাণে বেঁচে গিয়ে এই নদীর তীরে আটকে গেলেন। বড়ামের স্বপ্নাদেশে তার ভক্তরা সাত সন্তানকে মানুষ করতে লাগলেন। সাতটি সন্তান বড় হয়ে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে সংসার পাতলো এবং বংশবিস্তার করতে লাগলো। এরা জলের তোড়ে ভেসে এসেছিল বলে এদের বংশধরদের নামকরণ হয় জলতোড ।এই জলতোড থেকে বর্তমানে “জেতোড়” নামকরণ হয়েছে!
এদিকে সাত সন্তানের মা সাত উপদেবী বোনেরা তাদের সন্তানদের মায়া কাটাতে না পেরে এইসব এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নাম নিয়ে বিরাজ করছেন। যেমন লালগড় এলাকায় শাঁখা সিনিবুড়ি। কাঁসাই নদীর তীরে একটি তেঁতুলগাছের তলায় এই দেবীর পূজা হয় মাঘ মাসের 2 তারিখে। এইসব উপ দেবীদের জেতোড সম্প্রদায়ের লোকেরা ধুমধাম করে পূজা করেন। এছাড়াও এই দেবীরা অব্রাহ্মণ দেহুরী বা লায়া দ্বারা পূজিত হন। যেমন গুপ্ত মনি ,গোপন নন্দিনী, দুয়ারসিনি ,ঘাঘরা সিনি ,স্বর্গবাউরি ইত্যাদি। এইসব দেবীর পূজার বলি প্রথা প্রচলিত। এছাড়া দেবীর থানে বা আটনে মাটির হাতি ঘোড়ার ছলন মূর্তি উৎসর্গ করা হয়। এই দেবীদের পূজার কোন মন্ত্র লাগে না। মনের ভক্তি ও লৌকিক রীতিতে এই পূজা হয়ে থাকে। আর এই সম্প্রদায়ের এক বিশেষ গুপ্ত দেবীর পূজা প্রচলিত আছে–” রাঙ্গা হাড়ি বিষুই চন্ডী”! এই পূজা সম্পূর্ণভাবে এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব এবং তা ব্যক্তিগতভাবে গোপনে আরাধনা করা হয়!
তথ্যসূত্র- লোকভাষ
ক্ষেত্র সমীক্ষা
জেতোড়– ডক্টর নির্মলেন্দু দে