Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছট্ পুজো || Piyali Parua

ছট্ পুজো || Piyali Parua

সাঁজু আর আমার মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল পাঁচ’ছ বছর। ইউনিভার্সিটি এবং বিয়ের জল একই সঙ্গে চেনা শুরু করেছি তখন আমি। পক্ষকালের হেরফেরে উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গ ওড়াউড়ি। এমনই ছোটাছুটির ফাঁকে সাঁজুর সঙ্গে আমার আলাপ।
অফিস কলোনির মস্ত শরীরটা দু’ফাঁক করে এগিয়ে চলেছে চরা পরা ক্লান্ত মহানন্দা। তারই পাশে ছুটে বেড়াচ্ছে দুরন্ত এক শিশু। শেষ বর্ষার ঝোড়ো হাওয়ায় হিমসিম মায়ের ওড়না উড়ে যায় প্যারাস্যুটের মতো। তেজপাতা ডালে আটকে ঝুলতে থাকে আমার ঠিক পাশের গাছটিতেই। আমার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুতের এক হাসি উপহার দিলো অপরিচিতা। একবার ওড়নার দিকে সকরুণ দৃষ্টি দিয়ে ছুট লাগায় ছেলেকে ধরতে। আব্রুর থেকে নাড়ির টানের অসহায়তা বেশি।
আমি ফিরছিলাম কলকাতা থেকে কর্তার অফিস আবাসন। সবে সবে রবিমামা হামা দিয়ে কাঞ্চনরাণীর আদুরে কোল ছেড়ে আকাশের বুকে দুষ্টু দুষ্টু চোখ মেলছে। শিশুটির হাবভাব বুঝিয়ে দিচ্ছে, তার দুষ্টুমি সূর্য চোখ মেলার অপেক্ষা করে না। নদী চরের বাঁধানো পার ধরে তার হুটোপুটি চলতেই থাকে কলবল হাসির সাথী হয়ে। রাস্তা থেকে চর ঢালু হয়ে মিলিয়েছে নদী কিনারে। একটু পা হড়কালে নিশ্চিন্ত জলটুপ। মায়ের আতঙ্ক ফুটে উঠেছে চোখে মুখে। আমার পাশ কাটিয়ে ড্রিবলিং করার সময় সুযোগ বুঝে জাপটে ধরে ফেললাম বাচ্চাটিকে। সাইজে ছোটো হলে কি হবে, গোটা শরীর দিয়ে আপত্তি জানাতে একটুও সময় নষ্ট করল না বিচ্চুটা। মা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে কোলে জড়িয়ে নিয়ে রাস্তার উপরেই বসে পড়ল থপ্ করে। দম নিয়ে বলল;
“শুক্রিয়া”।
আমি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে চুমকি জরির ওড়নাটা নামিয়ে আনলাম টেনেটুনে।
“ধনয়বাদ্ বৈহনজী। পতা নহী ঁ। কৈসে নিকল আয়া কোয়ার্টারসে। আজ দো নাম্বার গেট পর সিকিউরিটি ভী দিখাঈ নহী দী। অগর গির জাতা! ইধর মেরী জান নিকল গয়ী।‌ শুক্র হৈ‌। তুম নে পাকর লিয়া”।
পরিচয় হলো। সাঁজুর সঙ্গে। শ্বশুর শাশুড়ি আর ছেলেকে নিয়ে এ-টাইপ ওয়ানে থাকে সে। বর অন্য জায়গায় চাকরি করে। ছেলে আংশু পরের বছর তিন পুরবে। ছেলের হাত শক্ত করে ধরে কথা বলতে বলতে সে এবার উঠে দাঁড়াল। জামায় আটকে যাওয়া ঝুরো বালি ধুলো ঝেড়ে এগিয়ে চলল। আংশুর দুদিকে আমরা দুজন হাত ধরে রেখেছি। একসময় সে দুজনের হাত ধরে ঝুলতে থাকল ব্যাঙের মতো।
আমরা থাকতাম এ টাইপ সিক্সে। তার সামনে দেখা মিলল গেট কিপার টু সুরজ বাহাদুর’এর। খানিক বাক্য বিনিময়ের পর জবরদস্তি আংশুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এরপর থেকেই আমার সাথে দুম করে ভাব হয়ে গেল সাঁজুর। ভাব জমে উঠল পরের কয়েক মাসের অল্প সাক্ষাতেই। এরপর পুজোর ছুটিতে আমি পুরোপুরি বরের কাছে। কলোনির পুজোয় একসাথে রিক্রিয়েশন ক্লাবের আঁধার কোনায় বসে সেই বন্ধুত্ব বেশ ঘন হয়ে উঠল।
যদিও এতে আমার কোনো কৃতিত্ব ছিল না। স্বভাব কুনো আমাকে সাঁজু কেমন করে বেশ সহজ করে নিলো। আসলে বেচারা শ্বশুর শাশুড়ির নিয়ম কানুনে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছিল। দেশ সেবক বর তার আছে দূর দেশে। ছোটো-খাটো গোলগাল চেহারার মেয়েটির খানিক কটা চুলে একমাথা কমলা সিঁদুর। অথচ কপালে রং বেরঙের চকমকি বিন্দী। কানে উপর নীচ করে একাধিক মাকড়ি। হিন্দি ভাষী সাঁজু বাংলা বোঝে ভালোই। ইতিমধ্যেই সে গল্প করে করে আবিষ্কার করেছে আমি তার থেকে বেশ কিছুটা ছোটো।
“ফির ভী তুম মুঝে নাম সে হী পুকারনা। প্লীজ মুঝে দিদি মত বুলানা”।
গজ দাঁত বার করে মিষ্টি করে হাসে সাঁজু।
বর অফিসে চলে গেলে নির্জন মন্থর দুপুরগুলো প্রায়ই সে বকবক করে ভরিয়ে রাখত আমায়। কালীপুজোর পর এমনই একদিন সে এলো আমার কোয়ার্টারে।
“কল তুমহারা নিমন্ত্রণ। কল ছট। মৈ`ছোটী মৈয়া কী পূজা করনে জাউঙ্গী। তুম মেরা সাক্ষী রহোগে”।
~~দাঁড়াও দাঁড়াও। ছট মানে কি? আর পুজোর আবার সাক্ষীই বা কি?
আমার অবাক প্রতিক্রিয়া।
আমি কলকাতার মেয়ে। দুর্গা কালি লক্ষ্মী সরস্বতী এমনকি মনসা শীতলা মঙ্গলচণ্ডী সব মায়ের পুজো জানি। কিন্তু ছোটি মাইয়া! এ আবার কোন মা?
“অরে তুম ছোটী মৈয়া কী পূজা নহী দেখা? তুম নে তো কুছ ভী নহী দেখা”।
সাঁজু আমার থেকেও বেশী অবাক।
“ছোটী মৈয়া কী উপাসনা কে বক্ত্ তুম রহনা মেরে সাথ। আরাধনা কী অ`ন্তমে তুম্হে ভেট দুঙ্গী মৈ। তুম জব খুশ হো জাওগে, তব মৈ পানী পিঊঁগী। ইস বার পূজাকী সাক্ষী রহনা তুম। এহী নিয়ম হৈ”।
পরদিন ভোর রাতে সে এসে নিয়ে গেল আমাকে। মহানন্দার তীরে দাঁড়িয়ে মনে হলো, সত্যিই আমি কত কিছুই দেখিনি। সার বেঁধে উজ্জ্বল রঙ্গিলা সাজপোশাকের নানান বয়সী মেয়েরা আধ কোমর জলে দাঁড়িয়ে তর্পণ বিন্যাসে। কারো দুই হাত জোড় করা প্রণামের ভঙ্গিতে। কারো হাতে কোশাকুশির মতন একটু বড় তামার ডোঙা। কারো শঙ্খ। কারো পঞ্চপ্রদীপ বা কর্পূরদানী। কারো দুহাতে ধরা ধূপদানীতে একগোছ সুগন্ধী ধূপবাতি। অথবা অগুরু ধুনার নির্যাস ছড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা ধুনুচি। অজস্র প্রদীপ জ্বলন্ত শিখা বুকে করে সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে নদী প্রবাহে। স্রোতস্বতী ধারায় ধারায় তাদের প্রতিবিম্ব। নীল জলে কমলা আলোর সারি।
আকাশী আকাশে তখন গোলাপী থেকে লাল হচ্ছে সূর্য। অচেনা কথায় সুর করে মন্ত্র বলছে কেউ কেউ। কি অপূর্ব সে দৃশ্য! অভিনবত্বে চোখ ভরল। পেটও ভরল অর্চনা শেষে। বেতের চাঁচড়ি ডালি ভরা উপহার। ফলমূল আর জীবনে প্রথম বার খাওয়া ঠেকুয়া। প্রথম কামড়েই নাকে মিষ্টি সুঘ্রাণ।
~~কি করে বানিয়েছ? শেখাও না।
“মৈয়া মৈয়া। তুম খা লো। মুঝে নহী পতা। সাসু-মাঁ কো পতা হোগা”।
~~তোমার সাসু-মাঁর কাছে নিয়ে চলো না আমায়।
“চলো। আভী মিলা দেতী হুঁ”।
পরের দিন কলোনীতে হৈহৈ।
*তুমি ঠেকুয়া শিখতে চিফ এঞ্জিনিয়ারের কোয়ার্টারে হানা দিলে?*
আমার স্বামী তখন সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছে। নব্য এসিস্ট্যান্ট এঞ্জিনিয়ারের পুঁচকে বৌ’এর এত সাহস!
এক সহৃদয় মাঝবয়সী বৌদি উদ্ধার কর্তা হয়ে এগিয়ে এলো।
====আহা বেচারী ছোটো মানুষ। ওর এখনও এসব বুঝতে সময় লাগবে।
মাথার চুলে আজ আমার কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝিলিক। বর মশাই’এর দৌলতে এ টাইপ ওয়ানের বাসিন্দা আজও আমি বেচারী। বুঝে উঠতে পারিনি আজও।
যাইহোক। আমি তো সফেদা, সুজি, কলা, নারকেল বাটা, মৌরি ভাজা, চিনি দিয়ে ঘি জুবজুবে ঠেকুয়া গড়তে শিখে গেলাম। কিন্তু ছোটি মাইয়ার পুজোর ইতিহাস কেউ আমাকে বলতে পারল না। সাঁজু, শাশুমা এমনকি স্বয়ং চিফ এঞ্জিনিয়ার ঝাঁ সাহেব। অগত্যা মন ভরা খিদে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। কাগজ কলম নিয়ে বসলাম। অগতির গতি আমার সর্বজ্ঞ দাদার কাছে আকুল আবেদন। সাদা খামে এক্সট্রা টিকিট সেঁটে কোলা ব্যাঙের মোটা পেটের উত্তর পত্র এলো প্রিয় দাদার কাছ থেকে। কিছু অংশ আমার পাঠকদের জন্য।

দীপাবলির ছয়দিন পরে, কার্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে এই পুজো হয়। ষষ্ঠী ~ সংস্কৃত ষষ্ঠ থেকে, প্রাকৃত ছট্ শব্দটি এসেছে।
ছট্ ‌অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পুজো। যা সূর্য থেকেই আসে পৃথিবীতে। জীবন সৃষ্টির স্রোত বহমান রাখার জন্য।
সৃষ্টির মূলে থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতির আছে ছয় রূপ। ষষ্ঠ অংশের পুজো হয় মাতৃরূপে। এই বিশেষ তিথিতে বেদমাতা গায়ত্রীর জন্ম। যিনি শিশুদের জ্বরা এবং মৃত্যুর কবল থেকে মুক্ত করেন।
ভাগবত পুরাণ মতে প্রথম মনু ছিলেন প্রিয়ব্রত। তাঁর স্ত্রী মালিনী। তাঁদের মৃত্যু পথযাত্রী শিশুপুত্রের জীবন দান করেন বৈদিক দেবী ঊষা। ব্রহ্মার মানসকন্যা। সূর্যদেবের কনিষ্ঠতম পত্নী। অপর নাম ছোটি মাইয়া।
প্রচলিত বিশ্বাস, ছোটি মাইয়ার পুজো ছট্ পুজো। জীবনের প্রবাহমানতা রক্ষা করতে উৎপত্তি হয় এই পুজোর। এইভাবে বৈদিক দেবী ঊষা এবং বেদমাতা গায়ত্রী যেন একীভূত হয়ে যান কোথাও।

রামায়ণের পৌরাণিক আখ্যানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে কুলদেবতা আদিত্য আরাধনা। সূর্য বংশের শ্রেষ্ঠতম উত্তরসূরী শ্রীরামচন্দ্র। বনবাস থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন দীপাবলীর দিন। রামরাজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে রামসীতা একত্রে উপবাস করে বিভাবসুর আরাধনা করেন। সেও এই তিথিতেই।

আবার মহাভারতেও মেলে ছট্ পুজোর সূত্র। সূর্য পুত্র কর্ণ ছিলেন সর্বোচ্চ সবিতা উপাসক। মহাবীর কর্ণ সূর্যোদয় কালে আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে দিনমণির বন্দনা করতেন। পুজো শেষে দান বিতরণ করতেন দরিদ্র নরনারায়ণে।
এই প্রথা আজও বহমান। আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে প্রভাকরের স্তব ও উপাসনা করেন ভক্তকুল।

ভাগবত পুরাণে আছে এমন অনেক কাহিনী। প্রত্যক্ষভাবে ছট্ পুজোর সঙ্গে জড়িত আছেন দেবী অন্নপূর্ণা এবং মা গঙ্গা। তবে সে গল্প আজ আর নয়। আবার অন্য কোনো দিন।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress