Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিত্রাঙ্গদা || Rabindranath Tagore » Page 2

চিত্রাঙ্গদা || Rabindranath Tagore

অনঙ্গ-আশ্রমচিত্রাঙ্গদা মদন ও বসন্ত
চিত্রাঙ্গদা।তুমি পঞ্চশর?
মদন।আমি সেই মনসিজ,
টেনে আনি নিখিলের নরনারী-হিয়া
বেদনাবন্ধনে।
চিত্রাঙ্গদা।কী বেদনা কী বন্ধন
জানে তাহা দাসী। প্রণমি তোমার পদে।
প্রভু, তুমি কোন্‌ দেব?
বসন্ত।আমি ঋতুরাজ।
জরা মৃত্যু দৈত্য নিমেষে নিমেষে
বাহির করিতে চাহে বিশ্বের কঙ্কাল;
আমি পিছে পিছে ফিরে পদে পদে তারে
করি আক্রমণ; রাত্রিদিন সে সংগ্রাম।
আমি অখিলের সেই অনন্ত যৌবন।
চিত্রাঙ্গদা।প্রণাম তোমারে ভগবন্‌। চরিতার্থ
দাসী দেব-দরশনে।
মদন। কল্যাণী, কী লাগি
এ কঠোর ব্রত তব ? তপস্যার তাপে
করিছ মলিন খিন্ন যৌবনকূসুম–
অনঙ্গ-পূজার নহে এমন বিধান।
কে তুমি, কী চাও ভদ্রে।
চিত্রাঙ্গদা।দয়া কর যদি,
শোনো মোর ইতিহাস। জানাব প্রার্থনা
তার পরে।
মদন।শুনিবারে রহিনু উৎসুক।
চিত্রাঙ্গদা।আমি চিত্রাঙ্গদা মণিপুররাজকন্যা।
মোর পিতৃবংশে কভু পুত্রী জন্মিবে না-
দিয়াছিলা হেন বর দেব উমাপতি
তপে তুষ্ট হয়ে।  আমি সেই মহাবর
ব্যর্থ করিয়াছি। অমোঘ দেবতাবাক্য
মাতৃগর্ভে পশি দুর্বল প্রারম্ভ মোর
পারিল না পুরুষ করিতে শৈব তেজে,
এমনি কঠিন নারী আমি।
মদন।শুনিয়াছি
বটে। তাই তব পিতা পুত্রের সমান
পালিয়াছে তোমা। শিখায়েছে ধনুর্বিদ্যা
রাজদণ্ডনীতি।
চিত্রাঙ্গদা।তাই পুরুষের বেশে
নিত্য করি রাজকাজ যুবরাজরূপে,
ফিরি স্বেচ্ছামতে; নাহি জানি লজ্জা ভয়,
অন্তঃপুরবাস; নাহি জানি হাবভাব,
বিলাসচাতুরী; শিখিয়াছি  ধনুর্বিদ্যা,
শুধু শিখি নাই, দেব, তব পুষ্পধনু
কেমনে বাঁকাতে হয় নয়নের কোণে।
বসন্ত।সুনয়নে,সে বিদ্যা শিখে না কোনো নারী;
নয়ন আপনি করে আপনার কাজ,
বুকে যার বাজে সেই বোঝে।
চিত্রাঙ্গদা।এক দিন
গিয়েছিনু মৃগ-অন্বেষণে একাকিনী
ঘন বনে, পূর্ণা-নদীতীরে। তরুমূলে
বাঁধি অশ্ব, দুর্গম কুটিল বনপথে
পশিলাম মৃগপদচিহ্ন অনুসরি।
ঝিল্লিমন্দ্রমুখরিত নিত্য-অন্ধকার
লতাগুল্মে  গহন গম্ভীর মহারণ্যে
কিছু দূর অগ্রসরি দেখিনু সহসা,
রুধিয়া সংকীর্ণ পথ রয়েছে শয়ান
ভূমিতলে চিরধারী মলিন পুরুষ।
উঠিতে কহিনু তারে অবজ্ঞার স্বরে
সরে যেতে– নড়িল না, চাহিল না ফিরে।
উদ্ধত অধীর রোষে ধনু-অগ্রভাগে
করিনু তাড়না–সরল সুদীর্ঘ দেহ
মুহূর্তেই তীরবেগে উঠিল দাঁড়ায়ে
সন্মুখে আমার–ভস্মসুপ্ত অগ্নি যথা
ঘৃতাহুতি পেয়ে, শিখারূপে উঠে উর্ধ্বে
চক্ষের নিমেষে। শুধু ক্ষণেকের তরে
চাহিলা আমার মুখপানে– রোষদৃষ্টি
মিলাল পলকে; নাচিল অধরপ্রান্তে
স্নিগ্ধ গুপ্ত কৌতুকের মৃদূহাস্যরেখা
বুঝি সে বালক-মূর্তি হেরিয়া আমার।
শিখে পুরুষের বিদ্যা, প’রে পুরুষের
বেশ, পুরুষের সাথে থেকে, এতদিন
ভুলে ছিনু যাহা, সেই মুখে চেয়ে, সেই
আপনাতে-আপনি -অটল মূর্তি হেরি’,
সেই মুহূর্তেই জানিলাম মনে, নারী
আমি। সেই মূহূর্তেই প্রথম দেখিনু
সম্মুখে পুরুষ মোর।
মদন।সে শিক্ষা আমারি
সূলক্ষণে। আমিই চেতন করে দিই
একদিন জীবনের শুভ পুণ্যক্ষণে
নারীরে হইতে নারী, পুরুষে পুরুষ।
কী ঘটিল পরে?
চিত্রাঙ্গদা। সভয়বিষ্ময়কণ্ঠে
শুধানু,”কে তুমি?” শুনিনু উত্তর,”আমি
পার্থ, কুরুবংশধর।”
রহিনু দাঁড়ায়ে
চিত্রপ্রায়, ভুলে গেনু প্রণাম করিতে।
এই পার্থ? আজন্মের বিস্ময় আমার?
শুনেছিনু বটে, সত্যপালনের তরে
দ্বাদশ বৎসর বনে বনে ব্রক্ষ্ণচর্য
পালিছে অর্জুন। এই সেই পার্থবীর!
বাল্যদুরাশায় কত দিন করিয়াছি
মনে, পার্থকীর্তি করিব নিস্প্রভ আমি
নিজ ভুজবলে; সাধিব অব্যর্থ লক্ষ্য;
পুরুষের ছদ্মবেশে মাগিব সংগ্রাম
তাঁর সাথে, বীরত্বের দিব পরিচয়।
হা রে মূগ্ধে, কোথায় চলিয়া গেল সেই
স্পর্ধা তোর! যে ভূমিতে আছেন দাঁড়ায়ে
সে ভূমির তৃণদল হইতাম যদি,
শৌর্যবীর্য যাহা কিছু ধুলায় মিলায়ে
লভিতাম দুর্লভ মরণ, সেই তাঁর
চরণের তলে।
কী ভাবিতেছিনু মনে
নাই। দেখিনু চাহিয়া ধীরে চলি গেলা
বীর, বন-অন্তরালে। উঠিনু চমকি;
সেইক্ষণে জন্মিল চেতনা; আপনারে
দিলাম ধিক্কার শতবার। ছি ছি মূঢ়ে,
না করিলি সম্ভাষণ, না শুধালি কথা,
না চাহিলি ক্ষমাভিক্ষা, বর্বরের মতো
রহিলি দাঁড়ায়ে–হেলা করি চলি গেলা
বীর। বাঁচিতাম, সে মূহুর্তে মরিতাম
যদি।
পরদিন প্রাতে দূরে ফেলে দিনু
পুরুষের বেশ। পরিলাম রক্তাম্বর,
কঙ্কণ কিঙ্কিণী কাঞ্চি। অনভ্যস্ত সাজ
লজ্জায় জড়ায়ে অঙ্গ রহিল একান্ত
সসংকোচে।
গোপনে গেলাম সেই বনে
অরণ্যের শিবালয়ে দেখিলাম তাঁরে–
মদন।বলে যাও বালা। মোর কাছে করিয়ো না
কোনো লাজ। আমি মনসিজ ; মানসের
সকল রহস্য জানি।
চিত্রাঙ্গদা।মনে নাই ভালো
তার পরে কী কহিনু আমি,কী উত্তর
শুনিলাম। আর শুধায়ো না ভগবন্‌।
মাথায় পড়িল ভেঙে লজ্জা বজ্ররূপে,
তবু মোরে পারিল না শতধা করিতে–
নারী হয়ে এমনি পুরুষপ্রাণ মোর।
নাহি জানি কেমনে এলেম ঘরে ফিরে
দূঃস্বপ্নবিহ্বলসম। শেষ কথা তাঁর
কর্ণে মোর বাজিতে লাগিল তপ্ত শূল–
“ব্রক্ষ্ণচারিব্রতধারী আমি। পতিযোগ্য
নহি বরাঙ্গনে।”
পুরুষের  ব্রক্ষ্ণচর্য!
ধিক্‌ মোরে, তাও আমি নারিনু টলাতে।
তুমি জান, মীনকেতু, কত ঋষি মুনি
করিয়াছে বিসর্জন নারীপদতলে
চিরার্জিত তপস্যার ফল। ক্ষত্রিয়ের
ব্রক্ষ্ণচর্য। গৃহে গিয়ে ভাঙিয়ে ফেলিনু
ধনুঃশর যাহা কিছু ছিল, কিণাঙ্কিত
এ কঠিন বাহু–ছিল যা গর্বের ধন
এত কাল মোর– লাঞ্ছনা করিনু তারে
নিস্ফল আক্রোশভরে। এতদিন পরে
বুঝিলাম, নারী হয়ে পুরুষের মন
না যদি জিনিতে পারি বৃথা বিদ্যা যত।
অবলার কোমলমৃণালবাহুদুটি
এ বাহুর চেয়ে ধরে শতগুণ বল।
ধন্য সেই মুগ্ধ মূর্খ ক্ষীণতনুলতা
পরাবলম্বিতা লজ্জাভয়ে-লীনাঙ্গিনী
সামান্য ললনা, যার ত্রস্ত নেত্রপাতে
মানে পরাভব বীর্যবল, তপস্যার
তেজ।
হে অনঙ্গদেব, সব দম্ভ মোর
এক দন্ডে লয়েছ ছিনিয়া–সব বিদ্যা
সব বল করেছ তোমার পদানত।
এখন তোমার বিদ্যা শিখাও আমায়,
দাও মোরে অবলার বল, নিরস্ত্রের
অস্ত্র যত।
মদন।আমি হব সহায় তোমার।
অয়ি শুভে, বিশ্বজয়ী অর্জুনে জিনিয়া
বন্দী করি আনি দিব সন্মুখে তোমার।
রাজ্ঞী হয়ে দিয়ো তারে দণ্ড পুরস্কার
যথা-ইচ্ছা।  বিদ্রোহীরে করিয়ো শাসন।
চিত্রাঙ্গদা।সময় থাকিত যদি, একাকিনী আমি
তিলে তিলে হৃদয় তাঁহার করিতাম
অধিকার, নাহি চাহিতাম দেবতার
সহায়তা। সঙ্গীরূপে থাকিতাম সাথে,
রণক্ষেত্রে হতেম সারথি, মৃগয়াতে
রহিতাম অনুচর, শিবিরের দ্বারে
জাগিতাম রাত্রির প্রহরী, ভক্তরূপে
পূজিতাম, ভূত্যরূপে করিতাম সেবা,
ক্ষত্রিয়ের মহাব্রত আর্ত-পরিত্রাণে
সখারূপে হইতাম সহায় তাঁহার।
একদিন কৌতূহলে দেখিতেন চাহি,
ভাবিতেন মনে মনে, “এ কোন্‌ বালক,
পূর্বজনমের চিরদাস, এ জনমে
সঙ্গ লইয়াছে মোর সুকৃতির মতো।”
ক্রমে খুলিতাম তাঁর হৃদয়ের দ্বার,
চিরস্থান লভিতাম সেথা। জানি আমি
এ প্রেম আমার শুধু ক্রন্দনের নহে;
যে নারী নির্বাক্‌ ধৈর্যে চিরমর্মব্যথা
নিশীথনয়নজলে করয়ে পালন,
দিবালোকে ঢেকে রাখে ম্লান হাসিতলে,
আজন্মবিধবা, আমি সে রমণী নহি,
আমার কামনা কভু হবে না নিস্ফল।
নিজেরে বারেক যদি প্রকাশিতে পারি,
নিশ্চয় সে দিবে ধরা। হায় হতবিধি,
সেদিন কী দেখেছিল! শরমে কুঞ্চিত
শঙ্কিত কম্পিত নারী, বিবশ বিহ্বল
প্রলাপবাদিনী। কিন্তু আমি যথার্থ কি
তাই? যেমন সহস্র নারী পথে গৃহে,
চারি দিকে, শুধু ক্রন্দনের অধিকারী,
তার চেয়ে বেশি নই আমি? কিন্তু হায়,
আপনার পরিচয় দেওয়া, বহু ধৈর্যে
বহু দিনে ঘটে, চিরজীবনের কাজ,
জন্মজন্মান্তরে  ব্রত। তাই অসিয়াছি
দ্বারে তোমাদের, করেছি কঠোর তপ।
হে ভুবনজয়ী দেব, হে মহাসুন্দর
ঋতুরাজ, শুধু এক দিবসের তরে
ঘুচাইয়া দাও–জন্মদাতা বিধাতার
বিনাদোষে অভিশাপ, নারীর কুরূপ।
করো মোরে অপূর্ব সুন্দরী। দাও মোরে
সেই একদিন–তার পরে চিরদিন
রহিল আমার হাতে।–যখন প্রথম
দেখিলাম তারে, যেন মুহূর্তের মাঝে
অনন্ত বসন্ত ঋতু পশিল হৃদয়ে।
বড়ো ইচ্ছা হয়েছিল সে যৌবনোচ্ছ্বাসে
সমস্ত শরীর যদি দেখিতে দেখিতে
অপূর্বপুলকভরে উঠে প্রষ্ফুটিয়া
লক্ষীর চরণশায়ী পদ্মের মতন।
হে বসন্ত, হে বসন্তসখে, সে বাসনা
পুরাও আমার শুধু দিনেকের তরে।
মদন। তথাস্তু।
বসন্ত। তথাস্তু।  শুধু একদিন নহে,
বসন্তের পুষ্পশোভা এক বর্ষ ধরি
ঘেরিয়া তোমার তনু রহিবে বিকশি।
Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress