ভাদ্র শেষ হইয়া গিয়াছে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ভাদ্র শেষ হইয়া গিয়াছে। আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ। পূজার ঢাক বাজিতেছে। পূজার ঢাক বাঁজা কথাটার মানে পূজার কাজ পড়িয়াছে। পূজার ঢাক সত্য সত্য বাজে বোধনের দিন হইতে। অবশ্য বোধন কোথাও এক মাস আগে হয়, কোথাও বা পনের দিন, কোথাও বা শুক্লপক্ষের পূর্ববর্তী অমাবস্যায় অর্থাৎ মহালয়ার দিন হইতে। যেখানে যেমন নিয়ম। এখানে বোধনের ঘট আসে মহালয়ার দিন। গ্রামের মধ্যে একখানি পূজাওই চণ্ডীমণ্ডপে হইয়া থাকে। কয়েক শরিকের পূজা। বোধনের দেরি আছে। তবুও আশ্বিন পড়িতেই পূজার কাজের ধুম পড়িয়া গিয়াছে। পল্লীতে পল্লীতে। কিন্তু আজ ঢাক সত্যই বাজিতেছে। আজ ইদপূজা বা ইন্দ্ৰপূজা। সকালবেলাতেই ইদপূজার স্থানটায় ঢাকী ধুমুল দিতেছে। ইদপূজা সরকারি পূজা অর্থাৎ আইনমতে জমিদার মালিক। আইনমতে জমিদার মালিক হইলেও আসল মালিক গ্রামের মণ্ডলেরা। পঞ্চমণ্ডলে পূজার কাজ চালাইয়া থাকে। তাহারাই তত্ত্বাবধান করে, তাহারাই খরচ যোগায়, পরে খরচ জমিদারের খাজনা হইতে হিসাব করিয়া বাদ লইয়া থাকে।
সেতাব ইঁদপূজার বেদির স্থানটার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল। মোটা মোড়ল চণ্ডীমণ্ডপের কিনারায় বসিয়া মোটা একটা কায় তামাক খাইতেছিল। চণ্ডীমণ্ডপে একখানি একমাটি-করা দশভুজা প্রতিমা শুকাইতেছে। এখনও মুণ্ড বসানো হয় নাই। কতকগুলা উলঙ্গ অর্ধউলঙ্গ ছেলে ঘুরিতেছে এদিক ওদিক। তাহার সঙ্গে মানিকও রহিয়াছে। গোবিন্দ রাখালটা তাহাকে লইয়া আসিয়াছে। মানিককে নামাইয়া দিয়া সে ইন্দ্র-দেবতার বেদিটা গড়িতেছে। দশ-হাত-লম্বা দারুময়-দেহ দেবতাটি একটা বিরাটকায় ফড়িংয়ের মত ঠ্যাং উল্টাইয়া পড়িয়া আছে। মূর্তিটার মধ্যে মূৰ্তিত্ব নাই, নাক কান চোখের বালাই নাই। দশ-হাত-লম্বা একটা বৃক্ষশাখা, ছালটা তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, একদিকে মাথায় ঢেঁকির মত ছোট দুইটা কাঠের সঙ্গে খিল পরাইয়া গাঁথা; ওই ছোট কাঠ দুইটাকে বেদিতে পুঁতিয়া দেবতাকে টোকো দিয়া উন্নত এবং ঊর্ধ্বশির করিয়া পূজার সময় খাড়া করা হইবে।
চণ্ডীমণ্ডপের সামনে গ্রাম্য রাস্তা। রাস্তার উপর দিয়া চাষীরা চলিয়াছে। কয়েকটি মেয়ে ঝুড়ি করিয়া লাল মাটি লইয়া চলিয়াছে। কয়েক জনের মাথায় খড়িমাটি। তাহারা হাকিতেছিল লাল মাটি লেবে গো, লাল মাটি।
খড়িমাটিওয়ালা হাকিল—খড়িমাটি চাই, ঘর নিকুবার খড়িমাটি! দুধের মত অং লবেন। খড়িমাটি!
চণ্ডীমণ্ডপ হইতে খানকয়েক বাড়ির পরে শিবকেরামকেষ্টর বাড়ি। শিবকেষ্টর বাড়ির দাওয়া হইতে টিকুরীর খুড়ী উঁকি মারিয়া মুখ বাড়াইয়া সমান জোরে হাকিয়া প্রশ্ন করিল, কি লা? কি?
—মাটি গো, মাটি।
–লাল মাটি, খড়িমাটি।
খুড়ী মুখ ভ্যাঙাইয়া বলিল, মাটি গো মাটি! লাল মাটি। খড়িমাটি! মাটি নিয়ে কি বুকে চাপাবে নোকে? মাটি গো মাটি! ঘরে চাল সেজে না (অর্থাৎ সিদ্ধ হয় না), লোকে তা বোঝে না। ঘরে ধান নাই, চাল নাই, খাবার নাই; যার ঘরে ধান ছিল লেবি না মেরি করে নিয়ে গেল (লেভিপ্রথা)। যার আছে সে লুকিয়ে রেখেছে। ঘর নিকুবে! লোকে রঙ করবে! মরণ!
—তা মাটি না লিলে মোরা খাব কি?
—কি খাবি তা আমি কি জানি? আমি কি খাব, পঞ্চায়েত ভেবেছে? জমি দিয়েছে আমাকে? সেই পাপেই হচ্ছে এসব। গতবারে পোকা লেগেছিল ধানে। এবারে শুকোতে যাবে। শুকিয়ে যাবে, ধান ফুলোবে না। ফুললে শুকিয়ে তুষ হবে। আর জল হবে না। আর জল হবে না। ঠায় দাঁড়িয়ে ধান মরবে। দেখবি! টিকুরীর বউ যেন নাচিতেছিল। সর্বাঙ্গ দোলাইয়া সুর টানিয়া টানিয়া কথা বলিতেছিল। আনন্দ যেন তাহার ধরিতেছে না।
মাটিওয়ালী মেয়েগুলা তাহার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া ফেলিল। একজন ঠিক তাহারই মত সুর করিয়া বলিলতা হবে না মোল্যান, আর সিটির জো নাই। ক্যানেল এয়েছে। মৌরক্ষী বেঁধেছে। পাকা দেওয়াল দিয়ে গো, লোহার ফটক বেঁধে। ফটক বন্ধ করলেই জল চলে আসবে।
—আসবে না, আসবে না, আসবে না; ঘোঁতন বলেছে আসবে না। খালের ভেতর গোঙাল পড়ে জল চলে যাবে পাতালে। লয় তো বাঁধ ভেঙে যাবে। লয় তো সি জলে ধান বাঁচবে না। বাঁচলে পচে যাবে, লয় তো পোকা লাগবে। ধান হবে না, তুষ হবে। ঘোঁতন বলেছে।
একটি মেয়ে বলিল, ঘোঁতন ঘোষের অমনি কথাই বটে! বলে, হরিনামের নিকুচি করি আমি।
খুড়ী খাক করিয়া উঠিল—ঘোঁতন ঘোষের অমনি কথাই বটে! ঘোঁতন নেকাপড়া জানে। বিদ্যে আছে পেটে। হোত-ত্যা-ত্যা করে না। এক লজরে ধরতে পারে। আমাকে সেদিন বলেছিল, ভাবলী। রেগেছিলাম আমি। হুঁ বাবা। তা ভাবলীই হলাম আমি। ভাজের গায়ে গুড় মাখিয়ে চেটে খায়! মা গো! কোথায় যাব! বলিতে বলিতে হঠাৎ সে থামিয়া গেল। কণ্ঠস্বর খাটো করিয়া বলিল, অ-মা! মহাতাপ আসছে যে। গোঁত গোঁত করে আসছে দেখ, বুনো শুয়োর আসছে। অমা, হারামজাদী রাঙীকে ধরে আনছে ক্যানে। এই মরেছে। সঙ্গে আবার মোটা মোড়ল।
সে ঘরে ঢুকিয়া গেল। মেয়ে কয়টা এ উহার মুখের দিকে চাহিয়া চলিতে শুরু করিল। একজন হাকিয়া উঠিল—মাটি চাই মাটি, রাঙা মাটি, খড়িমাটি।
মহাতাপ একটা গরুর গলায় দড়ি বাঁধিয়া লইয়া আসিতেছিল; সোজা টিকুরীর খুড়ীর বাড়ির সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়া হাকিয়া বলিল, তোমার গরু আমি খোঁয়াড়ে দিতে চললাম। গরু ভগবতী না হলে, এ যদি ছাগল-ভেড়া হত তো ওকে মেরে ফেলতাম আমি।
পিছনে পিছনে মোটা মোড়ল বিপিনও আসিয়াছিল। সে গরুর দড়িটা হাতে লইয়া বলিল, চেঁচাস নে। যা বলবার আমি বলছি।
—তুমি কি বলবে? আমার এক ভিলি আকের নেতা মেরে দিয়েছে। কিছু রাখে নাই। ওটা গরু, আর মালিক হল বিধবা মেয়েছেলে, আমি কি করব বল দিকিনি?
নিজের চুলগুলা টানিয়া কঠিন আক্ৰোশে ক্ষোভে বলিয়া উঠিল, আমার চুল ছিঁড়ে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমার অমল ভাল আক, লকলকে কষকষে হয়ে উঠেছিল—
বিপিন ডাকিল, টিকুরীর বউ! বেরিয়ে এস বাছা। শোন!
টিকুরীর বউ বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, কি শুনব? আমি কারু কথা শুনি না। সব মিছে। কথা। আমার রাঙীকে আমি কখনও বাঁধি না। দিব্যি মাঠে ঘুরে চরে এসে ঘরে ঢোকে। আমি বিধবা মানুষ, আমি বেঁধে খেতে দিতে পাব কোথা? যারা ফসল আজ্জায়, তারা বেড়া দেয় না ক্যানে? ক্ষেতে যখন যায় তখন হেটহেট করে তাড়িয়ে দেয় না ক্যানে?
বিপিন বলিল, তুমি ক্ষেপেছ নাকি? কি সব বলছ—
–ঠিক বলছি। দাও, আমার গরু দাও। আমি ভাসুর বলে খাতির করব না। আমি মোড়ল বলে মানব না। খোঁয়াড়ে দেবে। অঃ!
সে আগাইয়া গেল গরুটা বিপিনের হাত হইতে ছাড়াইয়া লইবে বলিয়া। মহাতাপ অবাক হইয়া এতক্ষণ খুড়ীর দাপট দেখিতেছিল। সে এবার হাঁক দিয়া উঠিল, কভি নেহি! দাও, গরু দাও। বলিয়া ঝটকা মারিয়া দড়িটা বিপিনের হাত হইতে কাড়িয়া লইল।-খোঁয়াড়ে দেব আমি।
গরুটাকে সে টানিতে লাগিল।
টিকুরীর খুড়ী গাছকোমর বাঁধিয়া বলিল, ওরে, আমি তোর পরিবারের মত ম্যানমেনে নই। তোর হাঁকারিকে আমি ভয় করি না–
সে আগাইয়া গিয়া মহাতাপের হাত হইতে গরুটা ছিনাইয়া লইবার জন্য প্রস্তুত হইল। মহাতাপ গ্রাহ্য করিল না। সে টানিতে লাগিল গরুটাকে।
–আয়, আয়।
টিকুরীর খুড়ী বলিয়াই চলিয়াছিল—আমি ঘরের কোণে চোখের জল ফেলব না। লাজের চড় গাল পেতে খেয়ে মনের দুঙ্গু মনেই রাখব না। আমি দরখাস্ত করব। হ্যাঁ, দরখাস্ত করব। এখুনি ঘোঁতনের কাছে যাব।
তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে শিবকেষ্ট টলিতে টলিতে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, মহাতাপ! ভাই! আমি হাতজোড় করছি, মিনতি করছি। আমার জ্বর, ঘরে পয়সা নাই, ধানচালও নাই। খোঁয়াড়ে দিলে, ছাড়াতে হবে আমাকে। নবগ্রাম হাঁটতে হবে। পয়সা লাগবে। আমার দশা দেখ। গরুটা ছেড়ে দে ভাই।
মহাতাপ থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল।
বিপিন বলিল, দে, গরুটা ছেড়ে দে বাবা।
মহাতাপ বলিল, আহা-হা শিবে, তু যে মরে যাবি রে! অ্যাঁ! আহা-হা-হা রে, কি দশা হয়েছে তোর?
শিবকেষ্টর দাঁড়াইয়া থাকিবার ক্ষমতা ছিল না, সে উপুড় হইয়া বসিয়া হাঁটুর উপর কনুই। রাখিয়া দুই হাতে মাথা ধরিয়া বলিল, জ্বরে একেবারে হাড় ভেঙে দিলে রে! তিনখানা কথাতে কাঁপন থামে না। গরুটা ছেড়ে দে ভাই।
খুড়ী আগাইয়া আসিয়া মহাতাপের শিথিল হাত হইতে গরুর দড়িটা টানিয়া লইয়া বলিল, দেবে আর ভাল বলবে। দেবে না?
মহাতাপ গরুটা ছাড়িয়াই দিল, বলিল, আজ ছেড়ে দিলাম শিবের মুখ চেয়ে। ফের দিনে কিন্তু ছাড়ব না।
খুড়ী বলিল, শিবের মুখ চাইতে হবে না। যার মুখ চাইলে ধর্ম হবে, তার মুখ চেয়ে দেখ গে! ভাজের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিজের পরিবারের মুখের পানে তাকাগে যা। শিবের মুখ। মরণ!
খুড়ী গরুটা লইয়া চলিয়া গেল।
বিপিন মোড়ল শিবকেষ্টকে বলিল, টিকুরীর বউকে নিয়ে বিপদ হল শিবু! ওকে সাবধান করিস-কথাগুলি ভাল কথা নয়। বলিয়া চলিয়া গেল।
শিবকেষ্ট মাথার উপর হাতটা উল্টাইয়া দিল। সে কি করিবে?
মহাতাপ হাত বাড়াইয়া শিবকেষ্টকে বলিল, ওঠ, আমাকে ধরে ওঠ।
শিবকেষ্ট ধীরে ধীরে উঠিল।
মহাতাপ তাহাকে ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া বাহির হইয়া আসিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল। খুড়ী যেন কী কথাটা বলিয়া গেল! কি ভাজের মুখ! পরিবারের মুখ! কি সব বলিল। শিবকেষ্টর অবস্থা দেখিয়া সে তখন এমনই অভিভূত হইয়াছিল যে, কথাটা ঠিক শুনিয়াও বুঝিবার চেষ্টা করে নাই। এতক্ষণে কথাটা মনে হইল। কি বলিল? সে হাকিয়া ডাকিল—এই, এই খুড়ী, এই বিষমুখী টিকুরীর খুড়ী! বলি শুনছ?
খুড়ী ঘরের ভিতর হইতে উত্তর দিল—কেন রেড্যাকরা? বলি বলছিস কি?
—কি বললে কি তখন? আর একবার বল দিকিন? কি ভাজের–মুখ বউয়ের মুখ–কি বলছিলে?
টিকুরীর খুড়ী হাসিয়া বলিল—তোমাদের বড় বউয়ের মুখখানি বড় সুন্দর রে, চাঁদের পারা। তাই বলছিলাম। তোর বউয়ের মুখ কিন্তু এত সুন্দর নয়, তাই বলছিলাম আমি।
মহাতাপ খুশি হইয়া গেল। সে উচ্চকণ্ঠে সমর্থন করিয়া বলিল, হাজার বার লক্ষ বার। এ তুমি ঠিক বলেছ। আমি বলি কি বলছ! না, এ তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু এবার গরু সামলে রেখো। তা বলে গেলাম। সে হনহন করিয়া মাঠে চলিয়া গেল। স্তব্ধ দ্বিপ্রহর তখন। মাঠে ধান। ভরিয়া উঠিয়াছে। নিড়ান চলিয়াছে। নিদারুণ রৌদ্রের মধ্যে ধানের ক্ষেতে হামাগুড়ি দিয়া আগাছা তুলিয়া চলিয়াছে চাষীরা। দূরে তখনও মাটিওয়ালীদের হক শোনা যাইতেছে। মাটি, মাটি চাই গো! মাটি, লাল মাটি–খড়িমাটি!
সেতাবের বাড়িতে সেদিন দুপুরে ঢেঁকিতে ভোলা কলাই কুটিয়া বেশম তৈয়ারি হইতেছিল। বেশম হইতে সেউই ভাজিয়া গুড়ে পাক করিয়া পূজার নাড় হইবে। দুই জন ভানাড়ী মেয়ে টেকিতে পাড় দিতেছিল, ঢেঁকির মুখে নাড়িয়া-চাড়িয়া দিতেছিল।
স্তব্ধ দ্বিপ্রহর বেলা, বাড়িটা নির্জন। বড় বউকে দেখা যাইতেছে না। এই নির্জনতার মধ্যে তাহারা গান গাহিতেছে। মানদা গাহিতেছে মূল গান, মেয়েগুলি গাহিতেছে ধুয়া।
মেয়েগুলি ধুয়া গাহিতেছিল–
আমার বাজুবন্ধের ঝুমকো দোলায়
বঁধুর মন তো দুলল না,
ও-তার সিথিপাটির লালমানিকের
ছটাতে চোখ খুলল না
হায় সখি, লাজে মরি লাজে মরি গো।
মানদা গাহিল—
আমার মন যে দোলন খেলে
ওতার বনমালার দোলাতে।
আমার মন সেই গেল ভুলে,
তারে এসে ভুলাতে।
ভানাড়ী মেয়েগুলি আবার ধুয়া ধরিল—
আমার বাজুবন্ধের ঝুমকো দোলায়
বঁধুর মন তো দুলল না!
হায় লাজে মরি লাজে মরি লাজে মরি সখি গো!
মানদা আবার গাহিল—
মন কাড়িতে এসেছিলাম
মন হারায়ে ঘর ফিরিলাম–
লাজে গলার চিক মাদুলি পড়ল ছিঁড়ে ধুলাতে।
সঙ্গে সঙ্গে ভানাড়ীরা ধরিল—
হায় লাজে মরি লাজে মরি লাজে মরি সখি গো।
মানদা আবার গাহিল—
খুলতে গেলাম বাজুবন্ধ বধন যে সেই খুলল না।
ভুলতে গেলাম তারে সখি ভুল যে মোকে ভুলল না।
কালনাগে ধরতে গেলাম–
কালীয়ারে জড়াইলাম–
মারতে গিয়ে অমর হলাম জ্বলতে জ্বলন জ্বালাতে!
–লাজে মরি লাজে মরি লাজে মরি সখি গো!
রাধাকৃষ্ণের লীলার স্পর্শ জড়াইয়া এমন ধরনের প্রেমের গান বাংলার পল্লী অঞ্চলে কালে কালে কালোপযোগী ভাষায় ছন্দে উপমায় রচিত হইয়া আসিতেছে। এ ভাব পুরনো হয় না। নূতন ভাষায় নবীন হইয়া দেখা দেয়। সকল কালেই পুরবধূরা এ গান–বাউল বৈরাগী পঁচালি দল, যাত্রার দলের গায়কদের কাছে শুনিয়া শিখিয়া লয়। কালে কালে এইভাবে নির্জন দ্বিপ্রহরে গাহিতে থাকে। ঘরে গায়—ঢেঁকিশালে, ঘাটে গায়—জলে গলা ড়ুবাইয়া, সখিরা মিলিয়া জল আনিবার পথে গায়।
গানের মধ্যেই দরজায় ধাক্কা পড়িল। কেহ শিকল বাজাইয়া দরজার ওপাশে সাড়া দিতেছে। মানদা সেদিকে তাকাইয়া বলিল, কে?
মেয়েলি গলায় সাড়া আসিল, একবার দরজাটা খোল।
মানদা ভানাড়ীদের একজনকে বলিল, দে তো লা খুলে।
মেয়েটি দরজা খুলিয়াই বলিল, অ। পুঁটি মোল্যান! মানদার দিকে তাকাইয়া বলিল, ঘোঁতন ঘোষের বুন গো! বলিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।
পুঁটি বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া বলিল, ওরে বাপরে। এ যে পুজোর ধুম পড়ে গিয়েছে যে! খুব কলাই কুটছ! খুব গান জুড়েছ!
মানদা মুখ চমকাইয়া বলিল, তা কুটছি। কিন্তু তুমি কি মনে করে হে? এই ভত্তি দুপুরে?
–বড় বউ কই? চাঁপাডাঙার দিদি? একটা কথা বলতে এসেছি।
মানদা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কি কথা হে?
–না ভাই, সে আমি তাকেই বলব। আমার মা বলে পাঠিয়েছে, অন্য কাউকে বলতে বারণ করেছে।
–আমি জানি হে, আমি জানি। গয়না তো? টাকা?
—তা জানবে বৈকি ভাই। তুমি অর্ধেকের মালিক। জানবে বৈকি। তবে আমি চাঁপাডাঙার দিদিকে বলে যাই; তুমি তার কাছে শুনো। কই, দিদি কোথায়?
মানদা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, ধান সেদ্ধ করছে, ওদিকের চালায়।
পুঁটি আগাইয়া গেল।
মানদা হাতের কুঁচিগাছটা লইয়া বলিল, ললাটে তিন ঝাঁটা মারতে মন হয়—তিন ঝাঁটা।
বাড়ির আর একদিকে খোভড়া চালায় উনান হাঁড়িতে ধান সিদ্ধ হইতেছিল। ছোট এক টুকরা উনান, সেখানে সিদ্ধ-করা ধান মেলা রহিয়াছে। একটি মজুর মেয়ে পায়ে পায়ে ধানগুলি টানিয়া ওলটপালট করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। চাঁপাডাঙার বউয়ের কাপড়খানা ময়লা, ধোঁয়ায় কালো। গাছকোমর বাঁধিয়া কাপড় পরা। মাথায় ঘোমটা নাই। চুলগুলি রুখু দেখাইতেছে। এখনও স্নান হয় নাই। মুখচোখ আগুনের অ্যাঁচে এবং এখনও অস্নাত অভুক্ত বলিয়া শুকাইয়া গিয়াছে। একটু বেশি কালো দেখাইতেছে।
পুঁটি গিয়া একটু অবাক হইয়াই বলিল, তোমার কি অসুখ করেছে নাকি দিদি? এ কি মুখ হয়েছে তোমার? যেন বড় অসুখ থেকে উঠেছ? সে সকরুণ বিস্মিত দৃষ্টিতে কাদুর দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
–পুঁটি? পুঁটিকে দেখিয়া বড় বউ একটু বিস্মিত হইয়া গেল।—এমন অসময়ে?
–মা পাঠালে তোমার কাছে। কিন্তু–
—সইমা? কেন রে? অসুখ শুনেছিলাম সইমায়ের—; শঙ্কিত হইয়া উঠিল সে। পুঁটি কি তবে টাকা-পয়সার জন্য আসিয়াছে।
—উঠেছে অনেক ভুগে। কিন্তু তোমার এমন চেহারা কেন?
এবার সলজ্জ হাসিয়া বড় বউ বলিল, উপোস কিনা আজ। তার উপর–
–উপোস। ইঁদপুজোর?
–না, আজ সংক্রান্তি। সংক্রান্তিতে কালীর উপোস করি।
–কালীর কবচ নিয়েছ বুঝি দিদি? ছেলের জন্যে?
–হবে না জানি, তবুও নিয়েছি। চাঁপাডাঙার বউ হাসিল–বড় বিষণ্ণ সে হাসিটুকু। উপবাসশুষ্ক মুখে ঠোঁটের সে হাসিটুকু অনাবৃষ্টি আকাশের বর্ষণহীন বন্ধ্যা মেঘের ক্ষীণ বিদ্যুৎ রেখার মতই বিশীর্ণ।
পুঁটি বলিল, তুমি কলকাতায় গিয়ে ডাক্তার দেখাও না কেন দিদি? ওই তো বাবুদের গায়ের রবীনবাবুর বউ কলকাতায় গিয়ে কি সব চিকিৎসা করালে—দিব্যি বছর না ঘুরতে ছেলে হয়েছে।
বড় বউ বলিল, ওসব বাবুদের যা হয় তাই কি আমাদের হয়, না সাজে? এখন কি বলেছে। সইমা ব?
পুঁটি বলিল—কেন কাদু দিদি, জামাই মোড়লের পয়সা তো অনেক। বাবুদের চেয়ে কম নয়। তবে কেন হবে না? না-না, তুমি ধর। তুমি কলকাতায় যাও।
কাদু বলিলটাকা খরচ করবে তোর জামাই মোড়ল? তার থেকে সে নতুন বিয়ে করবে!
পুঁটি সভয়ে যেন চাপা গলায় চিৎকার করিয়া উঠিল—না—কাদুদি না।
কাদু হাসিয়া ফেলিল পুঁটির এমন ভয় দেখিয়া। হাসিয়া বলিল—মরণ। ভয় দেখ ছুঁড়ীর। ভয় নেই, তাও পারবে না তোর জামাই মোড়ল। দুটো বউকে ভাত দিতে হবে না? তাতে খরচ কত জানিস?
পুঁটি স্তব্ধ হইয়া কাদুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কাদু হাসিয়াই প্ৰশ্ন করিল–কি—এমন করে চেয়ে রয়েছিস কেনে?
পুঁটি বলিল–ব্যাটাছেলেদের জান না দিদি, ওদের ঝোঁক চাপলে–ওরা সব পারে।
–ব্যাটাছেলেদের খবর তুই এত জানলি কি করে লা?
যেন অপ্রতিভ হইয়া গেল পুঁটি। পায়ের নখ দিয়া মাটি খুঁটিতে খুঁটিতে বলিল চোখের উপর দেখছি দিদি।
—তোর দাদাকে?
–হ্যাঁ। আরও কতজন দেখছি।
—মরুক গে। যে যা করছে করুক। তোর কেপন জামাই মোড়ল আর যা করবে করুক এ কাজ করবে না। এখন সইমা কি বলেছে বল।
পুঁটি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল, কাদুর শেষ কথায় চমকিয়া উঠিল—একটু আড়ালে চল দিদি।
—আড়ালে? আয়।
পুঁটিকে লইয়া সে একটা ঘরে ঢুকিল। জিজ্ঞাসা করিল, কি রে?
—জান কি না জানি না, তোমার স্বামীর সঙ্গে আমার দাদার আজকাল খুব মাখামাখি। হঠাৎ অঘটন ঘটেছে যেন। মোড়ল প্রায় যায় দাদার কাছে।
চমকিয়া উঠিল চাঁপাডাঙার বউ। কিন্তু সে বড় শক্ত মেয়ে। মুহূর্তে আত্মসংবরণ করিয়া হাসিয়া বলিল—তোর দাদার কাছে যায়? তাতে কি হল? তোর দাদার সঙ্গে এককালে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল বলে, চিরকালই কি আক্রোশ থাকবে নাকি?
—তুমি আমার দাদাকে জান না চাঁপাডাঙার দিদি।
–দাদার ওপরে এত রাগ ক্যানে রে? বিয়ে দেয় না?
—মরণ আর কি, বিয়ের জন্যে ভাবি নে। কথাটা কিন্তু আমার নয়, মায়ের। মা বলে দিলে। দাদা বড় মোড়লকে ঠকাচ্ছে। রাখহরি দত্তের ছেলের সঙ্গে জোট করে ফাঁদ পেতেছে। দু ভরির গয়নার ভেতর লোহার তার ভরে, সীসের টোপা ফেলে, চার ভরি ওজন দেখিয়ে বাধা দিচ্ছে। মা বললে—আমার সইয়ের মেয়ে, তারপরে মহাতাপ এবার ধান ছেড়ে দিয়ে উপকার করেছে, তাতে এসব জেনেশুনে চুপ করে থাকলে আমার ধর্মে সইবে না। তোমার স্বামী সেই লোভে মজেছে দাদার সঙ্গে।
—সে তো ভাই স্যাকরাকে দেখিয়ে শুনিয়ে নেয় নিশ্চয়।
–না। নেয় না। সেই তো! মা বললে কিসে যে সেতাবকে ও বশ করলে ভগবান জানেন। কাল দুশো টাকা দিয়ে এক জোড়া ফারফোরের অনন্ত বাধা রেখেছে। তার ভেতরে নাকি দুটো লোহার সরু সিক ভরা আছে। মা নিজের কানে শুনেছে। সে গয়না না ভাঙলে ধরা যাবে না।
চাঁপাডাঙার বউ বলিলবলব আমি তাকে। সে আসুক।
পুঁটি বলিল, আমার নাম কোরো না দিদি। দোহাই তোমার! তা হলে দাদা আমাকে–
–তোকে মারে নাকি পুঁটি?
পুঁটি হাসিল, বলিল, ও কথা ছেড়ে দাও। আর একটা কথা বলি–
চাঁপাডাঙার বউ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পুঁটির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পুঁটি বলিল—যা করে হোক তোমার স্বামীকে ওর সঙ্গ ছাড়াও। নইলে তোমাদের ঘর থাকবে না। ভেঙে দেবে। নিশ্চয়ই ভেঙে দেবে। বড় মোড়ল আমাদের বাড়ি যায়, গুজগুজ করে দাদার সঙ্গে। আমার ভাল লাগে না। হয় তোমার নিন্দে, নয় ছোট মোড়লের নিন্দে! বড় মোড়ল মধ্যে মধ্যে বলে, ইচ্ছে। হয় কি জান ঘেঁ,তন—ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়ে যাই, নয়ত আগুন লাগিয়ে দিই ঘরে। তোমার স্বামী আর সে মানুষ নাই দিদি। তুমি সাবধান হও।
বড় বউ বিস্ফারিত নেত্ৰে সম্মুখের শরৎকালের গাঢ় নীল মধ্যাহ্ন আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। সেখানে ছোটবড় হালকা মেঘের পুঞ্জগুলি ভাসিয়া মন্থরগতিতে যাইতেছিল। পুঞ্জ পুঞ্জ হালকা দুধের মত রঙের নব লক্ষ গাভীর পাল। আকাশগঙ্গার অসীম-বিস্তার কোমল নীল তটভূমিতে স্বচ্ছন্দ চারণে মন্থরগতিতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। রৌদ্রে উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিয়াছে। হঠাৎ দুই-একটার গায়ে একেবারে মাঝখানে হয়ত ঈষৎ কালো রঙের আমেজ। যেন দধিমুখী ধবলী গাইটার পিঠে টুকরাখানেক কালো রঙের বিচিত্র সমাবেশের মত। ছোট ছোট টুকরাগুলা যেন লাকী বাছুর, বড় মেঘের টুকরার চেয়ে ওইগুলা ছুটিতেছে দ্রুততর বেগে। প্রাণের আবেগে পিঠে লেজ তুলিয়া আকাশের অঙ্গনময় দাপাদাপি করিয়া ফিরিতেছে।
বাইরে একটা গাই ডাকিয়া উঠিল।
সেই ডাকে বউয়ের চমক ভাঙিল। পুঁটি তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া ছিল। গরবিনী চাঁপাডাঙার বউয়ের নিজের মনে হইল—সে এক মুহূর্তে যেন কত গরিব হইয়া গিয়াছে। পুঁটি তাহার সে মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে পারি না, তাড়াতাড়ি বলিল—আমি যাই, দিদি।
সে ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেছিল। চাঁপাডাঙার বউ তাড়াতাড়ি আসিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, পুঁটি!
পুঁটি তাহার দিকে সবিস্ময়ে তাকাইয়া বলিল—কি? চাঁপাডাঙার বউয়ের দৃষ্টি যেন কেমন! ভদ্রের ভরা দিঘির মত তাহার চেহারা। কূলে কূলে ভরা অথৈ জলতল হইতে যেন কোন একটা জলচারী নড়িয়া উঠিতেছে। সে নড়ার উপরটায় কাপন জাগিয়াছে।
চাঁপাডাঙার বউ বলিল—অত্যন্ত চাপা স্বরে, আমার স্বামী আর সে মানুষ নাই? আমার নিন্দে করে? কি নিন্দে করে পুঁটি? আমি কি করেছি? কি বলে?
পুঁটি তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া ছিল, সে ভয় পাইয়া গিয়াছিল; সভয়ে হাত টানিয়া লইয়া সে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, জানি না চাঁপাডাঙার দিদি, আমি জানি না।
সে একরকম ছুটিয়াই পলাইল। যাইতে যাইতে থমকিয়া দাঁড়াইয়া কাতর কণ্ঠে বলিল, গুজগুজ করে কথা বলে দিদি। শুনতে পাই না। শুনতে পাই না। কিন্তু অনেক কথা অনেক কথা।