ভাদ্র মাস পড়িয়া গিয়াছে
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ভাদ্র মাস পড়িয়া গিয়াছে।
সেদিন ষষ্ঠীর দিন। চাষী গ্রামটির পাড়ায় পাড়ায় এক এক ঘরে হুলুধ্বনি পড়িয়াছে। মেয়েরা ষষ্ঠীর ব্ৰত-কথা শুনিয়া উলু দিতেছে। রোদে শরতের আমেজ ধরিয়াছে। ভাল চাষীদের চাষ প্রায় শেষ। মহাতাপ তো রোয়ার কাজ শেষ করিয়া নিড়ানের কাজ আরম্ভ করিয়াছে।
সেতাবের বাড়ির ভিতরেও মেয়েরা বসিয়া ষষ্ঠীর ব্ৰত-কথা শুনিতেছে।
সেতাব গোয়াল-বাড়িতে দাঁড়াইয়া ছিল। রাখালটা দুধ দুহিতেছে। গোয়াল-বাড়ির উঠানে ধানের বীচনের একটি বোঝা পড়িয়া আছে। বীচনের বোঝাটি ঘোতনের জমির জন্য তুলিয়া আনা হইয়াছে।
বাড়ি আসিয়া ঢুকিল পুঁটি।
সেতাব তাহাকে দেখিয়া বেশ প্ৰসন্ন হইয়াই বলিল, এই দেখ বীচন তোলা আজ তিন দিন। পড়ে আছে।
পুঁটি লজ্জিত হইয়া বলিল, কি করব। জমির পাট হয় নাই। লোকজন নাই। নেপালের এক হাতের কাজ। তার ওপরে ভাগীদের কাজ।
সেতাব অগ্রসর হইয়া আসিল। বলিল, আজ আবার ষষ্ঠী। আজও ভাবলাম–। সে হাসিল।
পুঁটি বীচনের বোঝাটা নাড়িতে চেষ্টা করিল।
সেতাব বলিল, ওইওই! একে বলে, ওই বোঝা তুমি তুলতে পার? বীচন নেবে কে? নেপাল কই?
–নেপাল জমিতে মই দিচ্ছে। ষষ্ঠীর দিন নেপালের বউ আসে নাই।
–তবে?
–আমিই নিয়ে যাব।
—এই দেখ বলি তাই হয় নাকি?
পুঁটি এবার ডাকিল, দাদা, অ দাদা!
বাহির হইতে ঘোঁতন সাড়া দিল, কি? আয় না বোঝাটা মাথায় তুলে নিয়ে?
সেতাব বলিল ঘোঁতন এয়েছে! কই? অ ঘোঁতন! ঘোঁতন!
ঘোঁতন এবার ঘরে ঢুকিল। তাহার পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা হাফশার্ট—অবশ্য দুইটাই পুরনো। সে ঘরে ঢুকিতেই সেতাব বলিল, বাইরে দাঁড়িয়ে ক্যানে রে? দেখ দেখি। তা তোর লোক কই–এ বোঝা নেবে কে?
ঘোঁতন একটা বিড়ি ধরাইয়া বলিল—শুধাও তাই পুঁটিকে। বললাম, আজ ষষ্ঠী, কাল নেপালের বউ আসবে, কাল সে-ই নিয়ে যাবে। তা বলে—তুমি তুলে দিয়া আমি নিয়ে যাব। আমি বললাম—তাই যাবি তো চ! আমার কি!
পুঁটি বলিল, তাই দাও না তুলে। ধর।
সেতাব ব্যস্ত হইয়া বলিল,—এই! ওরে নোটন! নোটন! যা তো, যা তো, বীচনের বোঝাটা মাঠে দিয়ে আয় তো! যা তো!
ঠিক এই সময়েই বাড়ির ভিতরে উলু পড়িল।
বাড়ির ভিতরে উঠানে ৫/৬টি মেয়ে সুপারি হাতে ব্ৰত-কথা শুনিতে বসিয়াছে। সকলেই স্নান সারিয়া এলোচুলে গোল করিয়া বসিয়াছে।
উলু দিয়া প্ৰণাম করিয়া সকলে উঠিল।
যে প্রবীণা ব্ৰত-কথা বলিতেছিল, সে বলিল, এ ব্রত করলে কি হয়?
নিজেই উত্তর দিল—নিঃসন্তানের সন্তান হয়। সন্তান মরলে, সেই সন্তান জিউ পায়। রণে গোনে অরুণ্যে মা ষষ্ঠী বুক দিয়ে রক্ষা করেন।
চাঁপাডাঙার বউ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং দরজার চৌকাঠে একটি ফোঁটা দিল। ষষ্ঠীর প্রসাদী হলুদতেলের ফোঁটা।
একটি মেয়ে বলিল, দরজার মাথায় কাকে ফোঁটা দিচ্ছ চাঁপাডাঙার বউ?
বিষণ্ণ হাসিয়া বড় বউ বলিল, দেওরকে ভাই! সে তো মাঠে। শাউড়ি বলে গিয়েছে। বউমা, ওকে ফোঁটা তুমি চিরকাল দিয়ো।
মেয়েরা বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
এবার চাঁপাডাঙার বউ ডাকিল, মানিক? মানু, মানিক কই?
মানু কাছে আসিয়া বলিল, তাকে পুরে রেখেছি ঘরে। কোথায় বেরিয়ে পালাবে। বলিয়াই সে চাঁপাডাঙার বউয়ের হাতের হলুদতেলের বাটি হইতে খানিকটা হাতের তেলোয় তুলিয়া লইয়া বন্ধ ঘরের দরজা খুলিয়া ঘরে ঢুকিল।
বড় বউ চকিত বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিল। এটা সন্দেহ তাহার মনে সাড়া দিয়াছে। পাছে সে আগে মানিককে ফোটা দেয়, এই ভয়েই কি মানু এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছে?
মানু মানিককে কোলে লইয়া বাহির হইয়া আসিল এবং বড় বউয়ের সামনে দাঁড়াইল।
বড় বউ মানিকের মুখের দিকে চাহিয়া বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া বলিল, এই যে ফোঁটা দিয়েছিস তুই? বলিয়া সেও ফোঁটা দিল মানিকের কপালে।
মানু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল, কিন্তু তুমি হাসলে ক্যানে বড়দি?
–আমি পাছে আগে ফোঁটা দিই, তাই তুই আগে ফোঁটা দেবার জন্যেই ওকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলি। তাই হাসলাম। তা আমাকে আগে বললেই পারসি!
মানু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, তোমাতে আর ভাসুরে সেদিন ঘরে কথা বলছিলে, সেসব কথা আমি শুনেছি বড়দি। মানিক নিয়েও তো তোমাদের বুক ভরে না।
মানু মানিককে লইয়া ঘরে ঢুকিয়া গেল। চাঁপাডাঙার বউ দেওয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইল। দেহখানা তার অবশ হইয়া গিয়াছে। সে তাহার গলায় সুতার ড়ুরিতে বাধা কয়েকটা মাদুলি টানিয়া বাহির করিয়া নাড়িতে-চাড়িতে লাগিল।
দিন কয়েক পর সেতাব বাড়িতে আসিয়া ঢুকিল। হনহন করিয়া ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া গেল। মিনিটখানেক পরেই ডাকিল, শোন তো একবার! বলি শুনছ?
বড় বউ আসিয়া ঘরে ঢুকিল।
সেতাব তাহার কোঁচড়ে কিছু গুঁজিতেছিল। দেখিয়া বুঝিতে কষ্ট হয় না যে বস্তুটা টাকা। বড় বউ আসিয়া দাঁড়াইতেই সেতাব বলিল, দেখ ঘোঁতন ঘোষ এয়েছে। বুয়েচ? একে বলে বলছে, নবগ্রামের রাখহরি দত্তর ছেলে চার-পাঁচ ভরির সোনার হার বাধা রেখে টাকা নেবে। বলেছে তিনশো, তা আমি বলছি, দুশো! মেরে কেটে আড়াইশো। সুদ টাকায় মাসে ছ পয়সা। দোব? বলব তাকে আসতে?
বড় বউ বলিল, মহাতাপকে শুধাও।
—তুমি ক্ষেপেছ নাকি?
–না। তাকে না শুনিয়ে কোনো কাজ তুমি করতে পাবে না।
স্ত্রীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া সেতাব বলিল, এ তো ভ্যাল আবদার রে বাবা। মহাতাপ, মহাতাপ, মহাতাপ করে আমাকে জ্বালিয়ে খেলে তুমি। বলি মহাতাপ তো আমার মায়ের পেটের ভাই। নাকি? তুমি এত হাঁপাও ক্যানে?
বলিয়াই সে বাহিরে চলিয়া গেল।
সে যখন দাওয়ায় বাহির হইল, তখন মানদা এদিক হইতে ওদিকে চলিয়া যাইতেছিল।
বাহিরে ঘোঁতন দাওয়ার উপর মোড়ায় বসিয়া পা নাচাইতেছিল এবং ছোট একটা আয়নাচিরুনি লইয়া চুল অ্যাঁচড়াইতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে শিস দিতেছিল।
কাছে দাঁড়াইয়া ছিল গোবিন্দ—সেই রাখাল ছেলেটি।
সেতাব আসিতেই গোবিন্দ পলাইল।
সেতাব বলিল, এই লাও। বলিয়া পাঁচটি টাকা ঘোঁতনকে দিল এবং বলিল, দোব, তাই দোব। বুঝলে, বলে দিয়ে।
ঘোঁতন আয়না-চিরুনি পকেটে রাখিয়া টাকা পাঁচটা রুমাল বাহির করিয়া খুঁটে বাঁধিল। বলিল, তোমাকে লোকে খারাপ লোক বলত বুয়েচ, আমিও বলতাম। কিন্তু তুমি তা লও। বুয়েচ, এ আমি বুঝেচি। বুয়েচ! মুখখুতে বলবে, কিন্তু আমি মুখখু লই। তুমি গুড ম্যান, তবে হ্যাঁ, স্ট্রিকট্ ম্যান–
সেতাব বুদ্ধি ধরে বিচক্ষণ, সে চ্যাংড়াও নয়। তাহার উপর সে পঞ্চায়েতের মণ্ডল। সে বলিল, তুই বড় ফাজিল ঘোঁতন। বড় বেশি বকিস। যা, বাড়ি যা। রাখহরির ছেলেকে পাঠিয়ে দিস। আর শো, আর একটা কথা বলি। নিজে একটু খাঁটিস। এত বড় আইবুড়ো বোনটাকে অমন করে খাটাস না। বুঝলি?
ঘোঁতন বিচিত্র মুখভঙ্গি করিয়া বলিল, ওরে বানাস্ রে! তা এক কাজ কর না। সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর নিম্ন করিয়া বলিল, তুমি পুঁটিকে বিয়ে কর না। তোমার তো ছেলেপুলে হল না।
সেতাব প্রথমটা অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল ইয়েকে বলে, ইয়েকে বলে। তারপর অকস্মাৎ চিৎকার করিয়া উঠিল, ঘোঁ-ত্-না-
—এই দেখ, রাগ করছ ক্যানে? ঘোঁতনা হাসিল।–ও-বউয়ের ছেলেপুলে হবে না তোমার। আর তোমার উপর টানও নাই তার। সে যা কিছু–
সেতাব আবার আরও জোরে চিৎকার করিয়া উঠিল, ঘোঁ-ত্-না–
ঘোঁতন আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই মহাতাপের গলা শোনা গেল রাস্তার বাঁকে। সে গান গাহিতে গাহিতে আসিতেছিল—
কাজুলী কাজুলী ও আমার আখের
বনের আদুরী, কালো বরণ কাজুলী–
তোর পয়ে হরে আমার বউয়ের
আমার হবে মাদুলী।
ঘোঁতন চমকিয়া উঠিয়া প্রায় লাফ দিয়া নামিল রাস্তায়। বলিল, চলো। পাঠিয়ে দোব রাখহরির ছেলেকে।
সে দ্রুতপদে পলাইয়া গেল।
সেতাবের উঁকা ধরা হাতখানি থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। চোখে তাহার বিচিত্র দৃষ্টি ফুটিয়াছে। মুখ কেমন হইয়া গিয়াছে।
মহাতাপ ওদিক হইতে দুই জন ব্যবসায়ীকে সঙ্গে লইয়া প্রবেশ করিল, বলিল; এই লাও। গুড় কিনতে এসেছে। আলুর বীচন কিনবে। সাহজী, এই হামারা দাদা। ওই দামদর করো।
চমকিয়া উঠিল সেতাব। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া হ্রকায় টান দিতে লাগিল।
মহাতাপের সর্বাঙ্গে কাদা। সে জমি নিড়াইতেছিল। বাড়ি ফিরিবার পথে গুড়ের পাইকারদের সঙ্গে দেখা হইয়াছে। তাহাদের সঙ্গে লইয়া আসিয়াছে।
তাহাদের বসাইয়া সে হাঁকিতে হাঁকিতে বাড়ি ঢুকিল, বড় বউ! ও বড় বউ! সুর করিয়া। আবদারের ডাক।
ছোট বউ দাওয়ায় বসিয়া ময়দা মাখিতেছিল। সে বলিল, অ মাগো। ডাকের ঢঙ দেখ একবার।
মহাতাপ গ্রাহ্য করিল না। বলিল, কোথা গেল বড় বউ?
ছোট বউ বলিল—উত্তাপের সহিতই বলিল, তার শরীর খারাপ! ঘরে শুয়ে আছে।
মহাতাপ বলিল, শরীরের কিছু না বলেছে! রোজ শরীর খারাপ! রোজ শরীর খারাপ! অ বড় বউ! বড় বউ!
বড় বউ বাহির হইয়া আসিল। বলিল, কি বলছ?
–বলি ফোঁটা দেবে না আমাকে? ষষ্ঠীর ফোঁটা?
বড় বউ হাসিয়া বলিল, দেব বৈকি। চৌকাঠে দিয়েও মন তো মানে নি। জল না খেয়েই বসে আছি।
—আর একটি কথা শোন।
–বল।
–গুড়-আলুর খরিদ্দার নিয়ে এসেছি। হিন্দুস্থানি পাইকার।
–তা বেশ তো। বেচ দুই ভাইয়ে যুক্তি করে।
—সে যুক্তি তুমি তার সঙ্গে কর গিয়ে। ওসব আমি জানি না। আমার কৃষাণের ভাগের দশ। মণ গুড় চাই। আমি বিক্রি করেগা। সে কথা হয়ে আছে। তুমি সাক্ষী। সে টাকা হাম লেঙ্গে। ১৮ করে মণ। ১৮০ রুপেয়া।
–আচ্ছা পাগল তুমি। সবেরই তো অর্ধেক ভাগ তোমার। নাও না দাদার কাছে।
–উঁহুঁ। উ সব নেহি মাংতা। এই আমার কৃষাণের ভাগটা চাই।
–মানু বলিয়া উঠিল, পাগল লোক সাধে বলে না! মরণ!
—চুপ রহো, চুপ রহো, আরে দুষ্ট সরস্বতী, চুপ রহে। ওহি টাকাসে হম হার গড়ায়েগা। বড়া বহুকে লিয়ে আর তুমহারা লিয়ে। কেয়া দুটু সরস্বতী, এরে ময়না—বোলো রাধা কিষণ, বোলো মিঠি বাত। সেনেকা হার। সেনেকা হার।
মানু বলিয়া উঠিল, একশো আশি টাকায় দুজনের সোনার হার! এ যে সেই দু পয়সার মণ্ডা কিনলাম, আমি খেলাম, আমার দাদা খেলে, তারপর ফেলে দিলাম, কুকুরে খেলে, তাও শেষ করতে পারলে না, পড়ে থাকল। নব্বই টাকা সোনার ভরি।
মহাতাপ এবার হুঙ্কার দিয়া উঠিল—এ, তু মু সামালকে বাত কহো—আশি রুপেয়াকে হারসে মন উঠতা নেহি; অঃ, তেরা লিয়ে পাঁচশো আশি রুপেয়াকে আর চুরি করকে আনেগা হম। দেখো বড়া বহু–
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, চুপ কর মহাতাপ। ছি, কতবার বলেছি তোমাকে, এমন কথা বোলো না মানুকে। আর মানু, মানুষটা বড় মুখ করে কথা বললে, তাকে কি ওই ভাবে কথা বলে?
–না, বলে না! আশি টাকার হার—তাও রুপোর না সোনার! সেই পাঁচ সিকের জমিদারি!
–বেশ তো, হার শুধু তোর জন্যেই হবে।
–নেহি। কভি নেহি। কখনও না।
–আমি হার পরব না। আমার চাই না ভাই।
মানু এবার হঠাৎ খুব ভাল মানুষ হইয়া গেল; একেবারে একমুখ হাসিয়া অত্যন্ত মিষ্টি ভাষায়। অতি মোলায়েম করিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আশি টাকার হার পরে, না, মানায় দিদিকে। পাঁচশো আশি টাকার হার পুরবে দিদি, হারের বায়না হয়ে গেল। বুঝেছ?
বলিয়াই সে ময়দার থালাটা হাতে লইয়া অত্যন্ত দ্রুত উঠিয়া চলিয়া গেল।
বড় বউ আৰ্তকণ্ঠে ডাকিল–মানু—হুঁ। তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে এক মুহূর্তে কে যেন তাহাকে অতর্কিতে নিষ্ঠুর আঘাতে চাবুক হানিয়াছে মুখের উপর।
ছোট বউ ঘরে ঢুকিবার মুখে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, চার পাঁচ ভরির হার দুশো আড়াইশো টাকায় খুব সস্তা বড়দিজলের দর। ওতে তুমি এতটুকু খুঁতখুঁত কোরো না, বড় ভাল মানাবে তোমাকে।
বলিয়াই ঘরে ঢুকিয়া গেল।
মহাতাপ কিন্তু উল্লসিত হইয়া উঠিল; সে পরমোল্লাসে বলিয়া উঠিল, সত্যি কথা? বড় বউ আমার দিব্যি, বল? আরে বাপ রে বাপ রে। চামদড়ি কিপটের এ কি সুমতি! সেদিন পুঁটি আসবামাত্র বীচন দিয়ে দিলে। আজ তোমাকে সোনার হার! বলিহারি বলিহারি! আজ দাদাকে পেনাম করেগা, পায়ের ধুলো লেখা।
সে পরমানন্দেই বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
বাহির-বাড়ির রাস্তার ধারের দাওয়ার উপর হিন্দুস্থানি দুই জন বসিয়া পিতলের থালায় ছাতু ভিজাইছে, লঙ্কা-নুন রাখিয়াছে। লোটার জলে হাতমুখ ধুইতেছে। সেতাব বসিয়া কা টানিতেছে। তখনও সে যেন কেমন হইয়া আছে। মাথাটা তাহার কেমন করিতেছে।
মহাতাপ আসিয়া হঠাৎ গড় হইয়া প্ৰণাম করিয়া বসিল।
সেতাব চমকিয়া উঠিল—ওই! ওই! এ কি রে বাপুঃ ও কি!
—পরনাম। তোমাকে পেনাম করলাম।
–ওই। হঠাৎ পেনাম ক্যানে রে বাপু?
—তুমি—। তারপর ওই হিন্দুস্থানি দুই জনের কথা মনে করিয়া চুপ করিয়া গেল। বলিল, শুনেছি, আমি শুনেছি। হাসিতে লাগিল।
কি?
–বলব, বলব। দাও, হুঁকোটা দাও।
সে কোটা প্ৰায় টানিয়াই লইল সেতাবের হাত হইতে এবং পিছন ফিরিয়া হুঁকা টানিতে গিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল ওই গুড়ের পাইকারদের কাছে। ভিজানো ছাতুর দিকে তাহার দৃষ্টি
পড়িল। ভিজানো ছাতু বেশ ফুলিয়া উঠিয়াছে। সে বলিল, ই কেয়া হ্যায়? ছাতু? সাহজী?
সাহুজী উত্তর দিল, হুঁ, সন্তু!
মহাতাপ বলিল, হুঁ হুঁ! বহুত আচ্ছা চিজ! নুন-লঙ্কা দিয়ে আচ্ছা লাগতা হ্যায়, না!
সাহু হাসিল। বলিল, বাঙালিকে হজম নেহি হোতা।
বিকালের দিকে ওজন করিয়া গুড় বিক্রয় হইতেছিল। খামারে একটা কাঁটা-ওজন খাটাইয়া টিনবন্দি করিয়া গুড় ওজন করিতেছিল রাখাল পাল। সেতাব দাওয়ায় বসিয়া খোলার কুচিতে করিয়া মাটির উপর একটার পর একটা দাগ দিয়া হিসাব রাখিতেছিল। পাশেই একটা গামলা। গামলায় আধ-গামলা গুড় রহিয়াছে। টিনে গুড় বেশি হইলে তাহার ভিতর হইতে হাতায় করিয়া গুড় তুলিয়া গামলায় রাখিতেছিল, আবার কম হইলে পূরণ করিয়া দিতেছিল। কাটার ওজন করিতে রাখালের দক্ষতার খ্যাতি আছে। সে খ্যাতি—খোল বাজানোর খ্যাতির সমান। রাখালের ওজন-করা জিনিস কখনও কম-বেশি হয় না। আর তেমনি দ্রুত ওজন করে।
একদিকে একটা আধ মণ, অন্যদিকে টিন।
কাঁটাটা দুলিতেছিল। রাখাল কাটার উপরে একটা হাত রাখিয়া কাঁটার দিকে তাকাইয়াছিল, আর সুর করিয়া বলিতেছিল, তের রাম তেরতের রাম, তের রামতের রাম–
খানিকটা গুড় তুলিয়া লইয়া বলিল, তের রামে চৌদ্দ। চৌদ্দ। ওঠাও।
নোটন টিনটা নামাইয়া রাখিল। তেরটা টিন আগে হইতেই সাজানো ছিল। এটা রাখিতেই চৌদ্দ হইল। রাখাল বলিল, চৌদ্দ, চৌদ্দ, চাপাও।
নোটন আর একটা টিন চাপাইল।
চৌদ্দ রাম। চৌদ্দ রাম। চৌদ্দ রাম।
ওদিকে ককালে একটা, মাথায় একটা, দুইটা টিন লইয়া বাড়ির ভিতর হইতে আসিয়া হাজির হইল মহাতাপ।
—ধর্ নোটনা ধরা। আগে কাঁকালেরটা।
নোটন ককালেরটা ধরিতেই সে নিজেই মাথারটা নামাইল। তাহার গায়ে হাতে গুড় লাগিয়াছে। রাখাল হাকিল, চৌদ্দ রাম, চৌদ্দ রামপনের। পনের। পনের।
মহাতাপ নিজের হাতটা লইয়া গিয়া গরুটার মুখের কাছে ধরিলালে, চেটে লে। গরুটাকে চাটাইয়া লইয়া বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল।
রাখাল হাকিতেছিল—পনের পনের পনের।
ওদিকে বাড়ির ভিতরে জালার ভিতর হইতে বাটিতে করিয়া গুড় বাহির করিয়া টিনে ঢালিতেছিল বড় বউ। গাছকোমর বাঁধিয়া সে কাজ করিতেছে।
দাওয়ায় বসিয়া মানিক মুড়ি ও গুড় খাইতেছে। পাশেই তাহার বাঁশিটি পড়িয়া আছে। মধ্যে মধ্যে পু করিয়া দিতেছে।
মানদা টিনের পাশে বসিয়া টিনের গায়ে যে গুড় পড়িতেছে সেই গুড় চাচিয়া লইয়া একটা পাত্রে জমা করিতেছে।
মহাতাপ ঘরে আসিয়া ঢুকিল। টিনে ভরা হয় নাই দেখিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল, বলিল, আরে রাম রাম, এখনও টিন ভরে নাই?
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, দিচ্ছি, দিচ্ছি, হাত তো আমাদের দুটো, চারটে তো নয়। চতুর্ভুজো দেখে বউ আনলেই তো পারতে তোমরা! সবুর কর, ঘোড়াটা বাঁধ।
এখন কাজের মধ্যে চাঁপাডাঙার বউয়ের সে বিষণ্ণতাটুকু আর নাই। এই সময়ই বাহির হইতে রাখাল ডাকিল, এক ঘটি জল দেবে বউমা? বড় তেষ্টা পেয়েছে।
মানদা বলিল, গুড়ের লোভে আবার জল খেতে এসেছে গেঁজাল। ওজন করবার আর লোক পেল না।
বাহির হইতে রাখাল বলিল, শুনছ, অ বড় বউমা!
চাঁপাডাঙার বউ একটা বাটিতে গুড় লইয়া বাহির হইয়া গেল। মহাতাপকে বলিল, তুমি বার কর হে ততক্ষণ।
রাখাল বলিল, গুড় কিন্তু ফাস্টো কেলাস মা। কি সুবাস! আর কি তার! সুন্দর! সে বলিয়া। হাত চাটিতেছিল। চাঁপাডাঙার বউকে দেখিয়া হাতখানা পাতিয়া বলিল, তা দেব নাকি একটুকুন? তা দাও।
চাঁপাডাঙার বউ বাটিটা নামাইয়া দিয়া অন্য ঘরে জল আনিবার জন্য চলিয়া গেল। রাখাল লম্বা জিভ বাহির করিয়া বাটি হইতে চাটিয়া চাটিয়া গুড় খাইতে লাগিল। হঠাৎ মহাতাপ ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল—যেন পলাইয়া আসিল এবং খিলখিল করিয়া হাসিতে লাগিল।
ঘরের ভিতর হইতে প্রায় কাঁদিতে কাঁদিতে মানদাও পিছন পিছন বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, দেখ দেখ, কি করল দেখ! কাণ্ড দেখ! কথাগুলির মধ্যে আদরের সুর। ছলনা করিয়া মিছামিছি কান্নার ভান। মহাতাপ তাহার দুই গালে গুড় মাখাইয়া দিয়াছে। পুলকিত হইয়াই মানু কাঁদিতেছে।
সেই কৌতুকে মহাতাপ খিলখিল করিয়া হাসিতেছে।
রাখালও কৌতুকে খুখুক করিয়া হাসিতে লাগিল। বড় বউ আসিয়া জলের ঘটিটা নামাইয়া দিয়া বলিল, মানিককে বল চেটে খেয়ে নেবে, পরিষ্কার হয়ে যাবে। যাও তো বাবা মানিক, মায়ের গালের গুড় চেটে—
এই রঙ্গ দেখিয়া মানিকও উৎসাহিত হইয়া উঠিল। সে খুব জোরে জোরে বাঁশি বাজাইতে লাগিল, পু—পু—পু–পু—
পাগল মহাতাপ এই কথা শুনিয়া যাহা করিল তাহাকে অসম্ভব কাণ্ড ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। সে অতর্কিতে তাহার দুই হাতের গুড় বড় বউয়ের গালে মাখাইয়া দিয়া বলিল, তা হলে তোমার গালের আমি চেটে খেয়ে লোব।
রাখাল অট্টহাস্যে ফাটিয়া পড়িল।—বলিহারি—বলিহারি—বলিহারি।
ঠিক এই মুহূর্তেই গলা পরিষ্কারের শব্দ তুলিয়া সেতাব বলিল, বলি সব হচ্ছে কি? অ্যাঁ! প্রথমেই সে চটিয়া উঠিল রাখালের উপর। বলিল, বলি গুড় খাওয়া হল কবার? রাখাল! বলি হাহা-হা-হা হাসিই বা কিসের?
রাখাল অপ্রতিভ হইয়া বলিল, মহাতাপ, বুঝলে কিনা সেতাব, ও আমাদের কি বলেও ভারি আমুদে। ওঃ–
সেতাব রুদ্ধ রোষে ভাঙাইয়া বলিল, ওঃ! ও! ভারি আমুদে। দায়ে করে নিজের গলায় কুপিয়ে আমারও আমোদ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমোদ, আমোদ–
মানদা মহাতাপকে বলিল, তুমি মুর তুমি মর।
মহাতাপ দুই হাত নাড়িয়া বলিল, কেয়া, হুয়া কেয়া? আরে, হল কি?
বড় বউ স্বামীর দিকে একটা তীব্র দৃষ্টি হানিয়া বলিল, কিছু হয় নি, এস, গুড় বের করে বিক্রির কাজটা শেষ কর। বাইরে লোকেরা বসে আছে। সে ঘরে ঢুকিয়া গেল।