Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বিলাস ইদানীং আপনার ব্যাধিমুক্ত হাতখানি বাডাইয়া দিয়াছে, এ সময় তাহার সুন্দর কালো দুখানি চোখ জলসিক্ত হয়, কম্পিত কণ্ঠে সে কহিল “আমি জানি না কেমন করে…”
“আ আ…ধন্যবাদ দেবো এই ত”
“পুনরায়”
“ও ডিয়ার ও ডিয়ার. . ‘বলো না বলো না” বলিয়া চক্ষুদ্বয় বড় করিয়া রঙ্গস্বামী পুনৰ্ব্বার কহিলেন “বলো…বিদায়”
বিলাস হরিণশাবকের মত করিয়া মুখখানি তুলিয়া কহিল “কেমন করে বলি আপনাকে…”
ঠিক এই সময় পাশের হল হইতে কেমন যেন ভৌতিক গোলমাল ভাসিয়া আসিল ; অনুচ্চ এবং মৰ্ম্মান্তিক, গুহার প্রতিধ্বনি যেমন, গহ্বর আপনার প্রাচীনতম আবহাওয়া লইয়া দীর্ঘকায়া হইয়া উঠিল । এ কক্ষের সকলেই উৎকীর্ণ, ঝটিতি উদ্বিগ্ন হয় ; স্নেহপ্রবণ রঙ্গস্বামী আপনার চেয়ার ছাড়িয়া দ্রুতপদে ঘর ছাড়িয়া যাইবার কালে, বিলাসের উদ্বেগ ব্যস্ততা লক্ষ্য করিয়া কহিলেন “উত্তেজিত হ’য়ো না, দৌড়ে না”
বিলাস এবং ওমি ডাক্তারের পিছন পিছন করিডোরে আসিতেই দেখিল, মোহিত সবেগে হাতছানি দিয়া তাহাদের ডাকিতেছে । বিলাস কৰ্ত্তব্যপরায়ণ এবং ওমি কৌতুহলপরতন্ত্র, দুইজনে হল অভিমুখে অগ্রসর হইল। হলের দরজার অনতিদূরে মনোরম আঙুরলতার কেয়ারি করা সিল্কের খাড়া স্ক্রীনের পাশ দিয়া দেখে, প্রত্যেক বিছানায় শুয়ে-শুয়ে নিরাকার রোগীসকল ঊর্দ্ধে দৃষ্টি রাখিয়া আত্মঘাতী সৰ্ব্বনাশের আওয়াজ করিতেছে, সে আওয়াজে গিরিনদী ভূমিকার পূৰ্ব্বেকার স্তব্ধতা ছিল, যে স্তব্ধতায় দশাসই উৎকণ্ঠিত যৌবনার কেশরাশির আঁধার ছিল, যে আঁধার বাঁশরীর বিচিত্র অন্তরীক্ষ—তথাপি বিলাস আপনার সংযম হারায় নাই, স্পষ্ট করিয়া চাহিতে চেষ্টা করিল।
বিলাস দেখিয়াছিল, হলের প্রায় মধ্যস্থলে চেট্রি—সে আপনার খাট ছাড়িয়া এখন ঐখানে—তাহাকে দেখিয়া মনে হয় যে ঘোর উত্তেজনাবশত তাহার প্রায় নির্বাপিত শরীরের মধ্যে যেটুকু ঔদ্ধত্য ছিল, তাহাও কম্পমান, সে ঊর্দ্ধে দৃষ্টি রাখিয়া অতি পরিশ্রান্ত নৃত্যরত বাইজীর মত তাহার ঠোঁট অদ্ভূত ভঙ্গিমায় বিকৃত হইতেছে মাত্র, কিন্তু স্বর নাই…এইবার চেট্টি, ভয়ঙ্করভাবে আহত যেমন, টলিতে টলিতে অন্য আর খাটের বাজু ধরিয়া একটি হাত সঞ্চালন করিয়া সহসা উদাত্ত কণ্ঠে কহিল “ইয়া চলন্ত নিদ্রা অহো ভ্ৰাম্যমাণ এপিটাপ”
সকলেই দেখিল একটি বুদ্বুদ—সাবানজলের বুদ্বুদ—এ হলে হাওয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে, এখন এইমাত্র, ঝাড়ের কলমে লাগিয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল । ( ফলে পুনরায় আমরা বিস্ময় ফিরিয়া পাইলাম)। কালহত ঘরটিকে বুদ্বুদ ভীত হইল না।
অথচ বিলাস স্বচক্ষে দেখিল, স্বল্পালোকিত রঙ্গমঞ্চ, তাহার গভীরতা হইতে একটি কিশোর আপনার বক্ষদেশে একটি হস্তস্থাপন করিয়া অন্য হস্তটি ডানার মত মেলিয়া এই বলিতে বলিতে অগ্রসর হইতেছে যে, “আর নয় আর নহে আমারে ফিরায়ে দাও মোর মনোভাব”। বিলাস স্তম্ভিত হইয়াছিল ।
রঙ্গস্বামীকে হলের অস্থিরতা যারপরনাই বিমূঢ় করিয়াছিল, কৰ্ত্তব্যজ্ঞান সত্ত্বেও তিনিও হয়ত বা মুগ্ধ হইয়াছিলেন। সাবানজলের বুদ্বুদটি লুপ্ত অদৃশ্য হইবার পরক্ষণেই দেখা গেল, চেট্টির ব্যাধি-ক্লান্ত শরীরটি উৎসাহিত, উত্তেজিত, হিম, বীরদপ, গীতব্যঞ্জক উদাত্ত কণ্ঠস্বরের উপরেই যেন বা ঝরিয়া পড়িল, এতদর্শনে হলময় সকরুণ ব্যথিত বাণবিদ্ধ কষ্টের ধ্বনি উৎসারিত হয় এবং আপনা হইতে একটি বর্তমানকাল দেখা দিল, আর যে বাস্তবতা ঝটিতি অনিত্যতাকে কেন্দ্র করিয়া সকলের সমক্ষে অত্যন্ত সহজরূপ পরিগ্রহ করিল।
চেট্টি এখনও সেইভাবে পড়িয়া আছে, সমস্ত দেহে হারমানা লাঞ্ছিত ভাব, উপরের জানালার লিনটেলের লাল নীল সবুজ কাঁচের আলো-খেলান ছায়া ইদানীং চেট্টির মুখে দেহে পড়িয়াছিল, ওষ্ঠের এক কোণ বাহিয়া চাপ রক্ত অনেক দূর আসিয়াছে, কাঁচের লাল সবুজ ছায়ায় রক্ত অধিক কালো, ওলিভকুঞ্জের ঘনঘটা করা রাত্র যেমন বা তার বক্ষে ছিল, ইদানীং ঝরিয়া পড়িল । বিলাস শান্তভাবে ইহা দেখিতে লাগিল ।
যে নাপিত ৬নং রোগীকে কামাইতেছিল, সে খুব ব্যগ্রভাবে ধরিয়া এতাবৎ ঘটনা পরম্পরা সাক্ষ্য দিবার মত করিয়া দেখিতেছিল ; হঠাৎ নিস্তব্ধতায় সে পুনরায় আপনার কার্য্য করিবার মানসে ডান হাতের খুর বাম হস্তে লইয়া বুরুশ জলে ডুবাইয়া যেন সম্বিৎ ফিরিয়া পাইল ।
বিলাস এখনও ঝরিয়া পড়া রাত্র দেখিতেছিল, অনেকদিন পূৰ্ব্বে বিদ্যুতের আলোয় আর একজনের মুখে এরূপ রক্ত দেখিয়াছে,—সে আত্মারাম । বেচারী আত্মারাম, অনেক কথাই বিলাসের মনে পড়িল, যখন প্রায় সে হার স্বীকার করিয়া আসিয়াছে, তখন কোথা হইতে একটি থারমোমিটার সে যোগাড় করিয়াছিল, আপনার টেম্পারেচার দেখিয়া রুদ্ধশ্বাসে জিগির দিয়া উঠিল “নৰ্ম্মাল নৰ্ম্মাল —দেখ ডাক্তার” রঙ্গস্বামী তাহার থারমোমিটার দেখিয়া কিছুটা সন্দেহের বশে অন্য রোগীকে দিলেন, সেখানেও ‘নৰ্ম্মাল’ ; এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের থারমোমিটার বাহির করিতেই ব্যাপারটা যেন তাঁহার বোধগম্যে আসিল । অবশেষে তিনিও সায় দিয়াছিলেন “হ্যাঁ নৰ্ম্মাল—তোমার বাড়িতে চিঠি দেবো ।” তারপর পরদিন আত্মারামকে কেহ আর দেখে নাই…কেহ কোন প্রশ্নও করে নাই । এই আত্মারাম বিলাসকে দু’তিনটি প্রেমপত্র লিখিয়াছিল, তারপর একদিন রাত্রে বিলাস ঘুম ভাঙ্গিয়া দেখে আত্মারাম তাহাকে সস্নেহে চুম্বন করিতেছে, এবং ধীর কণ্ঠে বলিতেছে “আমি তোমায় ভালবাসি বিলাস” এবং ঠিক তখনই বিলাস চমকিত বিদ্যুৎ আলোকে শাপগ্রস্ত আত্মারামের মুখে রক্ত রেখা দেখে ।
এতক্ষণে ডাক্তার রঙ্গস্বামী প্রায় চেট্টির কাছে । চেট্টি যারপরনাই শান্ত। তথাপি তাহার গর্ব্বিত দৃষ্টি এখনও ঊর্দ্ধে বুদ্বুদ অনুসন্ধানে ব্যস্ত, যদিচ বুদ্বুদ আর নাই তবুও তাহার খরচৈত্রে বিদীর্ণ পলিমাটি-প্রায় ওষ্ঠযুগল কোন এক এপিটাপ আবৃত্তিতে চঞ্চল।
বিলাসের, এতদ্দর্শনে, আপনার যুবরাজ সদৃশ মুখমণ্ডল কালো হইয়া উঠে, আর যে চেট্টির দূরদৃষ্ট তাহাকে নিঃসন্দেহে অতিমাত্রায় মৰ্ম্মাহত করিয়াছিল, ফলে তাহার সুন্দর রাধিকার ন্যায় চক্ষুদ্বয় আরক্ত হইল ; সে কেবল মাত্র অস্ফুট অসংযত কণ্ঠে বলিয়া উঠিয়াছিল “ও চেট্টি” এবং যুগপৎ অনুভব করিল আসন্ন সন্ধ্যায় কোন বেলাতটে দাঁড়াইয়া নিকটের, নিম্নে, বহমান উচ্ছসিত জলধারার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া সে অদ্ভুত টান টানা স্বরে বলিয়া চলিয়াছে ।
সলুই কি সি ম্যৎনাঁ দোর
ভি প্লু দ্য পিতিয়ে ক্য দাঁভি
এ সুফরি মিল ফোয়া লা মোর
আভাঁ ক্য দ্য পারদ্যর লা ভি
পাসাঁ ন্য ফে ইসি দ্য ব্রুই
গারদ বিয়াঁ ক্য তু ন্য ল্য ভেই
কার ভোয়াসী লা প্রমিয়ের নুই
ক্য ল্যু পভ্যয়র স্কারোঁ স্যমেই।
এইটি চেট্টির খুব প্রিয় এপিটাপ, এইটি তাহার নিকট হইতেই শেখা। এ-আবৃত্তির কালে বিলাসের মুখ-নিঃসৃত একটি গুনগুন আওয়াজ শোনা গেল, নিশ্চয়ই বিলাস সম্ভবত, সদর্পে এ সময়ে আপনার প্যাচ-পকেটে—যাহা অত্যন্ত স্পোর্টস—একটি হাত ঠেলিয়া রাখিয়াছিল। এবং আরবার আপনার মস্তকখানি আন্দোলিত করত চেট্টির মুখের দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিয়াছিল “এ সুফরি মিল ফোয়া লা মোর, আভাঁ ক্য দ্য পারদ্যর্‌ লা ভি” এক্ষেত্রে তাহার কণ্ঠস্বর শুনিলে মনে হয় সে যেমন বা বেদান্তের অভিধা ক্রমে ক্রমে মিশাইয়া ফেলিতেছে, পরক্ষণেই মনে হয় যে তাহা স্বপ্নমাত্র, উক্ত এপিটাপের অতি সাধারণ মায়াপ্রবণ অর্থই তাহা জ্ঞাপন করিতেছে যথা “এবং সহ করেছে হাজারবার মরণ, ঠিক পূৰ্ব্বে জীবন হারাবার অর্থাৎ জীবন হারাবার পূৰ্ব্বে সে হাজার বার মরিয়াছে” একথা অবশ্যই যে বিলাসের এই আবৃত্তির পশ্চাতে যথাযথ শ্লেষ ছিল ।
চেট্টির এপিটাপ উদ্ধৃতির জ্বালায় সকলেই পাগল হইয়াছে, তাহার লাল চামড়ায় বাঁধান সোনার কাজ করা খাতাটিতে অজস্র এপিটাপ সংগ্রহ, নিজেও সে এপিটাপ রচনা করিত । সে নিজের বিছানায় বসিয়া, ইদানীং জৌলুষহীন মরা এককালের সুন্দর মুক্তার মত দাত চাপিয়া ধীরে ধীরে আবৃত্তি করিত তখন অন্যান্য বিছানার স্বাস্থ্যহীন মানুষেরা ভয়ে শুষ্ক হয় । বাক্যগুলির মধ্যে বাঘের গন্ধ ওতপ্রোত হইয়া উঠিত। পাঠের পরই চেট্টির বিদ্রুপাত্মক হাস্যে সারা হল ত্ৰাহি ত্ৰাহি, কে জানে চেট্টি অত্যন্ত নির্দয় ছিল কি না ! হয়তো ছিল ! চেট্টির নামে অনেকেই ডাক্তারকে বলিয়াছে কিন্তু কোন ফল হয় নাই ।
বিলাস প্রথম চেট্টির গলার স্বর শুনিলেই ত্রস্ত হইয়া উঠিত, তাহার পর একরূপ সে চেট্টিকে সহ্য করিয়া ফেলিয়াছিল। অদ্য সকালে যখন সে অন্যান্তের নিকট হইতে বিদায় লইয়া, চেট্রির কাছে দাঁড়াইল, চেট্টি তাহার হাতে নীল কাগজটি দিয়া কহিল “বিদায়”
“এটা কি”
“তোমার নামে এপিটাপ, পড়” বিলাস সহাস্যে কহিল “কি নির্দ্দয় তুমি” বলিয়া সে কাগজটি ধীরে আপনার পকেটে রাখিয়া দিল… এবং চেট্টির একটি হাত লইয়া আপনার সুন্দর গণ্ডদেশে বুলাইয়াছিল ।
হলের এ দুর্ঘটনাবু সামনে দাঁড়াইবার মত শিক্ষা তথা ধৈর্য্য ওমির ছিল না, তথাপি সে স্ক্রীণ পার হইয়া খানিক অগ্রসর হইয়াছিল । হলের এ-ঘটনা এত বেশী গোপনীয় ব্যক্তিগত (?) যে তাহার এখানে দাঁড়ান এক প্রকার দুঃসহ বলিয়া বোধ হইতেছিল, ফলে একবার সে জানালা দিয়া দূর পৰ্ব্বতমালার দিকে চাহিল। এবং এই নিৰ্য্যাতন হইতে অব্যাহতি পাইবার নিমিত্ত বিলাসের কোটে মৃদু আঘাতও করিল। বিলাসের বস্তুত, তখন কোন ব্যবহারিক জ্ঞান পর্য্যন্ত ছিল না ।
হলের অবস্থা যখন প্রায় শান্ত তখন ওমি বিলাসকে জোর করিয়া ধরিয়া পুনরায় করিডোরে আসিল। উহাদের দুজনকে দেখিয়া মোহিত উচ্চকণ্ঠে সুরু করিবামাত্র নিম্ন কণ্ঠে কহিল…”তোমাদের সাধারণ কাণ্ড পর্য্যন্ত নেই…এখান থেকে চল্লিশ মাইল তারপর ট্রেন…”
“সরি”—বলিয়াই ওমি ভাইকে কহিল…“বিলা খুব সাবধান…এতটুকু একসাইটমেন্ট নয়”
“আমার কিন্তু বড্ড কষ্ট হচ্ছে…”
“টমিরট…থাকলেই পারতে” মোহিত কহিল…এবং পরে মহাবিরক্তি সহকারে যোগ দিল “এক মুহূৰ্ত্ত থাকতে ভাল লাগছে না…”

গাড়ীতে জিনিসপত্তর তোলাই ছিল । মোহিত সত্বর গাড়ীতে উঠিয়া বসিল । বিলাস একবার বলিবার চেষ্টা করিল ডাক্তারের কাছ হইতে বিদায় লওয়া উচিত । মোহিত সাধারণভাবেই কহিল “পরে হবে…” পরক্ষণেই নিজের কথা সংশোধন করিয়া কহিল…“মানে কতবার নেবে…চল…চল ট্রেন ফেল হবে ।”
এখন বিলাস সিঁড়ির কাছেই, তাহার চোখ সম্মুখের জমিতে কি যেন বা খুঁজিতেছিল ; যাহা খুঁজিতেছিল তাহা তাহার নজরে পড়িল, সেই নীল কাগজের পিণ্ড, এখন ঘুমন্ত পক্ষীশাবকের মত চুপ! বিলাস এক পা অগ্রসর হইতে গিয়া থামিল, এতকাল সে শুধু আশাই করিয়াছে, মানুষ যে মনস্থ করিতে পারে এ ক্ষমতা তাহার জানা ছিল না । মনস্থ করিতে গিয়া হঠাৎ সে এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল ; এ-শ্বাস যে কি হেতু তাহা ভাবিবার মত সময় ছিল না ; এবং সে আর সময়ক্ষেপ না করিয়া কাগজের পিণ্ডটি তুলিয়া পকেটে রাখিল । এইসূত্রে রঙিন কাচের ছায়ায় চেট্টির মুখখানি তাহার দৃষ্টিপথে ভাসিয়া উঠে !
এ ব্যাপার মোহিত অথবা ওমির দৃষ্টি এড়ায় নাই, মোহিত সোল্লাসে বলিয়া উঠিল “বলিনি প্রেমপত্তর”
বিলাস স্বভাবত লাজুক, তিৰ্য্যক দৃষ্টিতে মোহিত এবং দিদির দিকে চাহিল, মনে মনে নিশ্চয়ই সে বলিয়াছিল “সত্যিই প্রেমপত্র, আত্মারামের লেখা নয় বা অন্যান্ত ছেলেদের লেখা নয়” গাড়ীতে উঠার সময় মোহিত প্রশ্ন করিল “বিলা কখন প্রেমপত্তর লিখেছ…”
বিলাস কি যেন বলিতে যাইতেছিল, সম্ভবত “না” । সহসা ওমি বাধা দিয়া কহিল “না আবার সুধীরকে…লোকনাথকে…”
“মেয়েদের নয় ?” মোহিত কহিল ।
“আমার মেয়ে ভাল লাগে না” “
কিন্তু ছেলে দিয়ে কি হবে…গোঁফ দাড়িতে গাল বড় কড়া হয়”
ওমি ক্ষুদ্র একটি ধমক দিয়া কহিল “ও না থাম” বিলাস বাল্যের এবং কৈশোরের কোন বন্ধুকে একদৃষ্টে এবং আড়ে তাকাইয়াও বিশেষ স্পষ্ট করিয়া স্মরণ করিতে পারিল না…। কেবল একবার যেমত বা দেখিল, লোকেন সবুজ মাঠে বলের উপর একটি পা দিয়া দাঁড়াইয়া, চুল হাওয়ায় দোলে, পিছনে কালোমেঘ, ওমির ধমকে মোহিত স্ত্রীর মুখপানে চাহিয়া স্মিতহাস্য সহকারে আপনকার বেতের টুপিতে ঈষৎ ঠিক দিয়া কহিল “সানাটোরিয়ামটা অদ্ভুত টেরিব্‌ল না” বলিয়া আধো রক্তিম চক্ষু দুইটি মেলিয়া অতীব দূরের দিকে ভয়ে ভয়ে নিরীক্ষণ করত ক্রমে ক্রমে আপনাকে ব্যক্ত করিল “adoring garlic with humble face. সেই দলই আমার ভাল…”
ওমি আপনার স্বামীর দিকে তাকাইয়া ছেলেমানুষের মত হাসিয়া মন্তব্য করিল “ও ডিয়ার…সানাটোরিয়াম জিনিষটা তোমার কাছে হাইলি ইণ্টালেকচুয়াল বলে বোধ হল…”
“সত্যি” প্রতিউত্তর করিয়া মোহিত বিলাসের মুখের দিকে লক্ষ্য করিল, ওমির মুখের মত গাড়ীর কম্পনের সহিত থর থর করিয়া তাহা কাঁপিতেছে না, উহা সহজ এক সুন্দর । বিলাস খুব সোজা করিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিবার জন্য আপনার দেহটি হেলাইয়া দিয়াছিল । মোহিত ঝটিতি “আঃ” স্বরে চীৎকার করিয়া কহিল “ড্রাইভার রোকও…” মুখে হাত দিয়া “সস” শব্দে কথা কহিতে মান করিয়া বলিল “আঃ কি সুন্দর হরিণটা—বন্দুকটা ওমি”
ওমি শুধুমাত্র আপত্তি জানাইল “আঃ মোহিত” যেমন সে আপত্তি জানাইয়াছিল তেমন অন্তপক্ষে সে হরিণশাবকের দিকে শুদ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। আশ্চর্য্য এখানকার হরিণরা চলন্ত গাড়ীকে নিশ্চয়ই ভয় পায় না বিলাস, আপনার সম্মুখে ওমির স্তব্ধ দৃষ্টি তথা নয়নযুগল এবং ক্ষণিক পরেই হরিণটিকে দর্শন কালে শুনিল যে মোহিতের কথাটি তাহার কানের কাছে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। বিলাসের কেন বার বার “কি সুন্দর–বন্দুকটা” এ-হেন বাক্য পরম্পরা গুঞ্জন করিয়া ফিরিতেছিল, নিঃসন্দেহে কথা দুইটি দৈনন্দিন সহজ গোলমালের মধ্যে মিশিবে না ; এ কারণে যে, এ-প্রকাশের অনেকটা মনোভাব একদা আকাশে উড়িয়া খেই হারাইয়াছে, কিছুটা স্থাপত্যের অহঙ্কারে কিছুটা সঙ্গীতের নিখাদ পর্য্যন্ত আবিষ্কারে ক্ষয় হয়, যেটুকু আছে এটুকু আছে। এ-কথায় মনুষোচিত ভাবধারা অদ্য বৰ্ত্তমান । এখন সে, বিলাস ঘুরন্ত হরিণ এবং পশ্চাতে সুঠাম বনরাজি ও পর্বতমালা হইতে চক্ষুদ্বয় ফিরাইয়া মোহিতকে দেখিল, দেখিল মোহিত কালহত নহে । এতদর্শনে মন্দিরের অভ্যস্তরস্থ, আশ্চৰ্য্য, তাহাকে ছাইয়াছিল। শ্রদ্ধায় তাহার মধ্যে যেমন রৌদ্র দেখা দিল, সূক্ষ্মতা গণিতের মানকে ক্ষুব্ধ করিতে চাহিল, মধ্যরাতের নৈসর্গিক স্তব্ধতার আশ্রয়ে উপলব্ধ নম্র উষ্ণতা সারাদেহে প্লাবিত হইল। এ সময় বিলাসের দৃষ্টি যে শূন্ততায় নিবদ্ধ ছিল, সে শূন্ততা গোলাপের রক্তিমতা বহন করে । ফলে বিলাস অতিমাত্রায় উৎফুল্ল হইয়া আপনাকে জ্ঞাপন করে “আমায় বন্দুকটা দাও…”
“ও না পাগল, ড্রাইভার…গাড়ী চালাও… রিকয়েল করবে না…” ওমি বলিয়াছিল ।
“তাহলে গান নিয়ে বার হওয়া কোন মানেই হয় না” মোহিত উত্তর করিল… !
“না বার হবে না, যে স্বদেশীর যুগ…বন্দুকটা চুরি যাক” ওমি কহিল ।
বিলাস কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল কিন্তু হঠাৎ তাহার চোখে লিনটেলের ফুলকাটা লাল নীল ভাসিয়া উঠিল, আশ্চৰ্য্য এই যে এই আলোর মধ্যে সে হারমানা মুখখানি নাই… । বিলাসের মনে হইল, ছেলেবেলার জর উপশমে প্রথম মাগুর মাছের তেজপাতা জীরে মরিচ বাটা ঝোলের মধ্যে যেরূপ মুখচোরা লাজুক পৃথিবীর নিমন্ত্রণটি থাকিত, এখানেও মোহিতের উক্তির মধ্যে সেই বাহু বিস্তার করা স্বাগতম স্বাগতম ধ্বনিটি ছিল ।
বিলাস আপনার সহিত একটি সমান্তরাল রেখা টানিয়া আপনাকে স্বতন্ত্র করত, শ্ৰাম মোহিনী মায়ার সচেতন রূপ এই সুবিস্তৃত পৃথিবীকে মহ আবেশভরে দেখিয়া লইল । তবু কি হেতু জানা নাই, যে—চাতুর্য্য অথবা সরলতা—সে বলিল, “ওমি আমার কাশী থাকাই ভাল” এবং এক নিমেষে ওমি প্রশ্নমান দৃষ্টি লক্ষ্য করিয়া কহিল, “কাশীতে গঙ্গা আছেন…”
এ-হেন উক্তিতে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই ছোট করিয়া হাসিল ।
ঐ হাস্যের উত্তর না করিয়া অন্তপক্ষে বিলাস পুনরায় এই যশস্বিনী সৃষ্টিকে দর্শন করিয়াছিল, এ পৃথিবীতে অদ্যও নিশ্চিন্ত নিদ্রা আছে এবং আরবার জাগিবে বলিয়াই, জানিয়াই যেখানে মানুষে ঘুমায়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress