খাটে বসে খেলা
আমি এত বড় একজন বিশেষজ্ঞ হলাম কী করে, এ প্রশ্ন যদি কেউ করেন তাহলে বলব, আমার সাধনভূমি হল খাট আর উপকরণ হল গোটা চারেক বালিশ আর হাত চারেক তফাতে একটা টিভি। মাঠ নয়, ময়দান নয়, দুরূহ কোনও প্র্যাক্টিস সিডিউল নয়, স্রেফ আড় হয়ে শুয়ে শুয়ে দু চোখ খোলা রেখে, আমি ফুটবলার, ক্রিকেটার, টেনিস চ্যাম্পিয়ন। হকি, ব্যাডমিন্টন কোনও খেলাই আর আমার অনায়ত্ত নয়। এমনকী বিশ্বের সেরা জিমন্যাস্ট। অবশ্য জিমন্যাস্ট হবার জন্যে প্রতিদিন আমাকে কড়া একটা প্র্যাক্টিস শিডিউল অনুসরণ করতে হয়। পি টি ঊষা কি মহম্মদ আলির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এ আমাকে প্রাণের দায়ে করতে হয়। আমার ভাত ভিক্ষা। না করলে হাঁড়ি চড়বে না। আসলে আমি একজন জিমন্যাস্ট। আর যে কোনও একটা দিকে প্রতিভার উন্মেষ হলেই তার সব আয়ত্তে এসে যায় একে একে। যেমন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সায়েব সেতার-সরোদ এসরাজ মায় সব তারের যন্ত্র বাজাতে পারতেন, আবার গানও গাইতে পারতেন। প্রতিভা হল কর্পোরেশনের পাইপফাটা জলের মতো। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ভাসিয়ে মহাজাতি সদনের পাশ দিয়ে কলাবাগান বস্তি ভেদ করে ঠনঠনিয়ায় মায়ের পায়ে আছড়ে পড়ে।
আমি জিমন্যাস্ট হতে চাইনি। যেমন চোরেরা থানা অফিসারকে বলে হজৌর আমি চোর হতে চাইনি। যেমন মাতাল, স্ত্রী-র ঝাঁটা পেটা খেতে খেতে বলে, মাইরি বলছি আমি ছুঁতে চাইনি, সাধনটা জোর করে খাইয়ে দিলে। আমি যে রাজ্যের ভোটার, রেশনকার্ড হোল্ডার, মানুষ আর। বলব না, কারণ আমি, যাদের মানুষ বলে, অন্যান্য দেশে যাদের মানুষ বলা হয়, আমি সে দলে পড়ি না।
আমার রাজ্যে গত স্বাধীনতার পর থেকে, গত বলছি এই কারণে স্বাধীনতা মারা গেছে। এখন আমরা আর শৃঙ্খলমুক্ত নই শৃঙ্খলামুক্ত অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা, তা সেই স্বাধীনতার পর থেকে এ রাজ্যে সর্বব্যাপক-অ্যাথলিট-তৈরি-প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এমন কায়দায় করা হয়েছে, কারুর বোঝার উপায় নেই। সকাল-বিকেল ট্রেনিং হয়ে যাচ্ছে। ছেলে, বুড়ো, মেয়েম কেউ বাদ পড়েনি। এই ট্রেনিং-এর যিনি ডিরেক্টার, তাঁর মতো কোচ পৃথিবীতে আর দুটি নেই। তিনি অদৃশ্য, অথচ ট্রেনিং পুরোদমে চলছে। নিজেরাই নিজেদের ট্রেনিং দিচ্ছে। ইংরেজি করলে দাঁড়ায়,
সেলফ-প্রপেলড ট্রেনিং কোর্স। কবীর সাহেব গান লিখেছিলেন, যার ভাবটা ছিল এইরকম, আকাশ আর ভুমি দুটো বিশাল চাকি, সেই দুই চাকির মাঝখানে মানুষ যেন গমের দানা, অহরহ। পেষাই হয়ে চলছে। অদৃশ্য চাকির মতো, প্রচ্ছন্ন প্রশিক্ষণ প্রকল্প। কেউ জানল না, কেউ বুঝল না, অ্যাথলিট হয়ে গেল, জিমন্যাস্ট হয়ে গেল। সকালবেলা অফিস যেতে হবে, ব্যবসায় বেরোতে হবে। জীবিকার সন্ধানে সুস্থ সমর্থ মানুষকে বেরোতেই হবে। বাস, ট্রাম, ট্রেন ধরতেই হবে। না ধরে উপায় নেই। উপোস করে মরতে হবে। পৃথিবীর সব সভ্য দেশে কী হয়! ঝকঝকে, তকতকে একটা বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ায়। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। টুকটুক করে এক-একজন উঠে পড়ে। বাস ছেড়ে দেয়। আমাদের সিস্টেম অন্যরকম। অনেকে মনে করেন, এ আবার কী! এ আবার কী মানে! আমরা অ্যাথলিট চাই। স্বামী অ্যাথলিট, স্ত্রী অ্যাথলিট, ছাত্র, শিক্ষক, বড়বাবু, ছোটবাবু, জামাইবাবু, কামাইবাবু, হেঁপো রুগি, বেতো রুগি, ইচ অ্যান্ড এভরিওয়ান, হবে জিমন্যাস্ট।
সেই কারণে, আমাদের দৃশ্যটা হয় এই রকম:বাস আসছে। বাস আসছে, না তাল তাল মানুষ আসছে বোঝার উপায় নেই। ইঁদুর ধরা কলের মতো। এদিকে ঝুলছে, ওদিকে ঝুলছে। এদিকে মাথা, ওদিকে পা। ন্যাল ব্যাল, ঝাল ঝাল বাঙালি পাঁঠার দোকানের রেওয়াজি মালের মতো।
আর কী! সামনের আর পেছনের গেটে দুই ওস্তাদ হাতল ধরে জানালার রড ধরে, কখনও ঝুলে, হাত তুলে, পা তুলে, ডিগবাজি খেয়ে, চিৎকার করে, আশপাশের লোকের পিলে চমকে দিয়ে কর্পোরেশনের কুকুর ধরা গাড়ির মতো, কি একটা সামনে এসে হ্যাঁচকা মেরে থামল। অনেকের সঙ্গে আমিও দাঁড়িয়ে আছি। এই সময় আমি, টেনিস আর ফুটবল দুটোকে এক সঙ্গে পাঞ্চ করে টেনিফুটুস খেলি। সেটা কী? ওই খাট আর টিভি চাই। এ খেলার কোনও গ্রামার নেই। কোনও কোচ নেই। খাটে বসে, টিভি দেখে শিখতে হয়।
নাভ্ৰাতিলোভার খেলা দেখতে হবে। এ পাশে তিলোভা, ওপাশে মার্টিনা। মার্টিনা সার্ভিস। করছেন। তিলোভা এপাশে কী করছেন? ভালোভাবে লক্ষ করুন। তিলোভা সামনে ঝুঁকে পড়েছেন। পেছনটা দুলছে। কীভাবে দুলছে! দুটো বাচ্চা বেড়াল যখন খেলা করে তখন একটা আর একটার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে পেছনটা যেভাবে দোলায়, ঠিক সেইভাবে। বাস আসছে। আমি সামনে ঝুঁকে পড়ে পেছন দোলাচ্ছি। মার্টিনার সার্ভিস আসছে। খপ করে বাসের হাতলটা ধরতে হবে, তারপর ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের কায়দা। ডাইনে-বাঁয়ে ডজ করে গোলে ঢুকে যাও। ভেতরে ট্রাপিজের খেলা। ফ্রি স্টাইল রেসলিং। সামারসল্ট। সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ একটি অলিম্পিক।
জাতীয় পরিকল্পনায় আমরা যেটার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি, সেটা হল ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা। দাঁড়িয়ে থাকো। বাসের জন্যে দাঁড়াও। দাঁড়িয়েই থাকো। গ্যাসের লাইনে দাঁড়াও। গ্যাসের সঙ্গে ওয়েট লিফটিংও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আজকাল রিকশায় খালি সিলিন্ডার চাপিয়ে ডিপোয় নিয়ে যেতে হয়। সিলিন্ডার নামানো, সিলিন্ডার ওঠানো একটা ভালো ব্যায়াম। হাতের গুলিটুলি বেশ ভালো হয়। ঘাড়ের ব্যায়াম হয়। এই কাজটা আজকাল মেয়েদের করতে হয় বেশির ভাগ। ফলে মেয়েদের স্বাস্থ্য আজকাল ভালোই হচ্ছে। কেরোসিনের লাইন। ব্যাঙ্কের কাউন্টারে লাইন। রেশনের দোকানে লাইন। দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে থাকো। এই দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পায়ের হাড়গুলো বেশ ভালো হচ্ছে। কোমরের জোর বাড়ছে। আর বাড়ছে ধৈর্য। মায়েদের স্কুলে ছেলেমেয়ে নিয়ে যাওয়া তারপর ছুটির আগে গেটের সামনে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। এ সবই হল ওই বৃহত্তর জাতীয় পরিকল্পনার অঙ্গ। খেলোয়াড় তৈরি করো।
মাঠে-ময়দানে যাবার দরকার নেই। খাটে বালিশের পর বালিশে পিঠ রেখে বোলো ঠ্যাং ছড়িয়ে, সামনে খুলে রাখো টিভি। একদিনের ক্রিকেট তো অনবরত হচ্ছে। আগে কলেরা-টলেরা হলে বলতো, মড়ক লেগেছে। এ যেন ক্রিকেটের মড়ক! কোনও কিছু করার উপায় নেই। টিভি-র সামনে থেকে নড়ার উপায় নেই। সকাল ন’টা পনেরো কি দশটা। বাজার করা কি দোকান করা মাথায় উঠে গেল। দাড়ি কামানো বন্ধ। এমনকী নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠে গেল। যা হয় ভাতে ভাত করেই ছেড়ে দাও। হোল ফ্যামিলি সারি দিয়ে টিভির সামনে। কত বড় সমস্যা! গাভাসকার কেন যে তেড়ে মারছেন না। এই ঠুকঠুক করে খেলার সময়। মাঠের সঙ্গে ডিরেক্ট টেলি-লিঙ্ক থাকলে, আমার উপদেশ ছুড়ে দিতুম, এটা আপনার টেস্ট নয়। আর রেকর্ডে দরকার নেই। আপনার ওই এক দোষ, একের পর এক কেবল রেকর্ড করার চেষ্টা। মারশালের বল কি ওভাবে মারে! ফাস্ট বলে খেলার নিয়ম হল, উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে আসুন, খুব বেশি না, সামান্য কয়েক পা, তারপর হাঁকড়ান। একেবারে তছনছ করে দিন। মারুন ছয়। ছয়ের পর ছয়। তারপর ছয়। মেরে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিন। এই বলটা মনে হল হুগলি ছিল।’
‘হুগলি নয় গুগলি।’
‘গুগলি কী করে ছাড়ে?’
‘খুব সোজা, বলটাকে ছাড়ার আগে আঙুলের কায়দায় নিজের দিকে টেনে দেয়।’ ‘তার মানে ওইদিকের উইকেটে না গিয়ে এই দিকের উইকেটে চলে আসে।’
‘ওইটাই তো কায়দা। এগোতে পেছোতে, পেছোতে এগোতে মানে সেই গানটার মতো, যাব কি যাব না, পাব কি পাব না, হায়।’
‘আর স্পিন?
‘ভেরি সিম্পল। বলটাকে আঙুলের কায়দায় লাটুর মতো ঘুরিয়ে দেয়।’
‘কী আঙুল, ভাবা যায়, কী করে শেখে?’
‘কেন, কলকাতায় এলেই শিখে যাবে। প্রেমিকাকে ফোন করার জন্যে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাবে। ঘোরাতেই থাকবে। প্রতিবারই খট। নো কানেকশান। আবার ঘোরাবে। আবার, আবার। একদিনেই স্পিন বোলার।’
‘আর লেক-ব্রেক!’
‘খুব সোজা, ব্যাটসম্যানের পা লক্ষ করে বল ছোড়া। সায়েবরা একটা শাস্ত্র বানিয়ে ব্যাপারটাকে কী না কী করে তুলেছে! আসলে কিছুই নয়। ঢিল ছুড়ে আম পাড়ার মতো স্টাম্প পাড়া, কথা ছুড়ে যৌথ পরিবার ভাঙার মতো উইকেটের যৌথ পরিবার ছিটকে দেওয়া। খেলা তো আর জীবনের বাইরে নয়, জীবনটাই খেলা। এই খেয়ালটা রাখতে পারলেই খেলোয়াড়। যেমন নিজের জান সম্পর্কে যে সচেতন, সে জানোয়ার। লোহালক্কড় ছাড়া যে ভাবতে পারে না, সে কালোয়ার। যুদ্ধের ইংরেজি হল ওয়ার। ওয়ার প্রত্যয়ান্ত শব্দই হল খেলোয়াড়।
ভারত হল ক্রিকেট, ফুটবল আর হকির দেশ। হকিতে আজকাল আমরা প্রায়ই হেরে ভূত হয়ে যাই। হকি আর বাঙালির একই হাল। দুটোরই একসময় খুব গর্ব ছিল। সেই গৌরব ভাঙিয়ে আজও চলছে। তবে হকি পশ্চিমবাংলায় তেমন পপুলার হয়নি। অদ্ভুত এক দুর্বোধ্য খেলা। বলটা এত ছোট, চোখে পড়ে না। শুধু লাঠি হাতে পাঁই পাঁই দৌড়। আর গোলকিপারকে এমন অসহায় মনে হয়। সে বেচারার কিছুই করার থাকে না। পায়ে ইয়া দুই লেগগার্ড পরে ভূতের মতো। দাঁড়িয়ে থাকে। হকি পপুলার না হলেও হকিস্টিক এক সময়ে খুব কাজে লাগত। মারামারির করার জন্যে, মাথা ফাটাফাটি করার জন্যে! পরমাণু বোমা জন্মাবার পর যেমন কামান, গোলাগুলির যুদ্ধ প্রায় অচল হয়ে এল, সেইরকম ছুরি, ব্লেড, চপার, বোমা, পাইপগান এসে হকিস্টিককে অচল করে দিয়েছে। ক্রিকেটের আলাদা একটা ইজ্জত! পরশপাথর যা ছোঁয়, তা-ই সোনা হয়। ইংরেজ যা নাড়াচাড়া করে তাই জাতে উঠে যায়। তারা যদি ড্যাংগুলি খেলত তাহলে ড্যাংগুলিরও টেস্ট সিরিজ হত। কলকাতার অধিকাংশ বাই লেন এখন ক্রিকেট সাধনার পিচ। যে কোনও খেলারই কিছু টার্মস জানা থাকলেই সমঝদার। যেমন ক্রিকেট মাঠের কোন পজিশানে। কী নাম মুখস্থ করতে হবে। চেনার দরকার নেই। কণ্ঠস্থ করলেই হবে। স্লিপ, গালি, পয়েন্ট, কভার পয়েন্ট, একস্ট্রা কভার, মিড অফ, সিলি মিড অফ, মিড অন, সিলি মিড অন, লং অন, লং অফ, শর্ট লেগ, স্কোয়ার লেগ, ডিপ স্কোয়াল লেগ, ডিপ ফাইন লেগ। জানতে হবে বল করার ধরনের কিছুনাম—গুগলি, ইয়র্কার, স্পিন, লেগব্রেক। আর কী! কেউ তো আর বলছেনা, তুমি খেলে দেখাও। তুমি করে দেখাও।
আমি তো খাটে বসে আছি। পিঠে তিন থাক বালিশ। সামনে টিভি। ইন্ডিয়া ভার্সেস ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ঘরে আরও অনেক দর্শক। ওই সব নাম মাঝে মাঝে বলতে হবে।
‘দেখছ, দেখছ, বলটা, ইয়র্কার।’
‘শ্রীকান্তের দোষ কী, ইয়র্কার খেলার ক্ষমতা ব্র্যাডম্যানেরও ছিল না।’
‘কপিলের উচিত আজাহারকে স্লিপ থেকে গালিতে সরিয়ে আনা।’
কেউ চ্যালেঞ্জ করবে না, বলটা ইয়র্কার ছিল কি না। গুগলি কি না। মাঠে খেলা খুবই কঠিন। খাটে খেলা খুব সহজ। স্মরণশক্তি থাকলেই হয়ে গেল। তখন আর হাতের খেলায় নয়, মাথার খেলা। টেস্ট ক্রিকেটের অতীত কিছু রেকর্ড মনে রাখতে হবে। কথা বলতে হবে জোর দিয়ে। আর তো কোনও কিছুর প্রয়োজন নেই। সত্যি খেলোয়াড় হলে পলিটিক্সের মধ্যে পড়তে হবে। তা না হলে, ইন্ডিয়ান টিমে কেন বাঙালি নেই। গাভাসকারে কপিলে মাঝে মাঝেই কেন সংঘর্ষ! কেন একবার ও বসে তো ও ওঠে, ও ওঠে তো সে বসে। সিনেমার মতো ক্রিকেট-গসিপে কাগজ ঠাসা। আমার খাটেই ভালো। আর ভালো কিছু বই, ব্লাসটিং ফর রানস, সানি উইকেট।
ফুটবল তো আমাদের খেলা। তবে মুশকিল বাধিয়েছে আমার খাট আর টিভি। দুটো ওয়ার্ল্ড কাপ। দেখে আমাদের খেলায় আর খেলা পাই না। কথায় কথায় মারাদোনা, সক্রেটিস। আমাদের এখানে খেলোয়াড় যত না খেলে, বেশি খেলে সাপোর্টার। কিছু খেলা আছে যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, যার ওপর ঝোঁক না থাকাটাইজ্জতের প্রশ্ন। আভিজাত্য। ব্লাড সুগার, প্রেসার, হার্ট ডিজিজ হল অ্যারিস্ট্রোক্র্যাসির লক্ষণ, সেইরকম ফুটবল আর ক্রিকেট। ফুটবল দুটো বড় দলের
যে-কোনও একটি দলের সাপোর্টার হতে হবে। আর গোটাকতক টার্মস শিখে রাখতে হবে— যেমন অফসাইড, ডিফেন্স, ফরওয়ার্ড লাইন, রাইট ইন, রাইট আউট, টাইব্রেকার। এর মধ্যে অফসাইডটা অবশ্যই জানতে হবে। মাঝে মাঝে খেলা দেখতে দেখতে বলতে হবে অফসাইড, অফসাইড। অফসাইড না বললে ভালো রেফারি হওয়া যায় না, বিশিষ্ট দর্শক হওয়া যায় না। উচ্চাঙ্গ সংগীতে মাঝে মাঝে মাথা দোলাতে হয়, ‘অহো অহো’ করতে হয়। ফুটবলে সেইরকম অফসাইড। এবারের বিশ্বকাপে কোনও খেলোয়াড়েরই তো বিপক্ষের গোলের কাছাকাছি যাবার উপায় ছিল না। এগিয়েছে কি অফসাইড। চেষ্টাচরিত্র করে যা-ও বা একটা গোল দিলে, অফসাইড। হয়ে গেল। আপদ চুকে গেল। অফসাইডের মতো জিনিস নেই। সব সাধনা এক কথায় পণ্ড। সাধকরা বলেন, সংসার থেকে দূরে থেকে সংসার করাটাই বেদান্তের একটা পথ। নির্লিপ্ত। নিরাসক্ত। তাঁরা উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘মনে করো তুমি একটা সিনেমা দেখছ। সিনেমা দুভাবে দেখা যায়। সিনেমার চরিত্রে নিজেকে হারিয়ে ফেললে, কখনও হাসবে, কখনও কাঁদবে, আতঙ্কের দৃশ্যে চেয়ারের হাতল চেপে ধরবে। সারাক্ষণ সে এক যন্ত্রণা! কিন্তু যদি মনে রাখা যায়, আরে এ তো সিনেমা, এ তো মায়া, তাহলে আর কিছুই হবে না। তখন চোখ আর মন দুটোই যাবে সমালোচনার দিকে। কার অভিনয় ভালো হল। কার ঝুলে গেল! কাহিনিটির ত্রুটি কোথায়। সুর কেমন। পরিচালনা কেমন! খেলা তো খেলার খেলা। বেদান্ত বলছেন, জীবন হল মায়া, অভিনয়, খেলা স্বপ্ন। ইংরেজ শেকসপিয়র বলছেন, লাইফ ইজ এ স্টেজ। শাক্ত কবি। বলছেন, জীবন রঙ্গমঞ্চ।
সেই জীবনখেলায়, ফুটবল, ক্রিকেট হল খেলারও খেলা। তার মানে তামাশার তামাশা, মহাতামাশা। টিভি-র পরদাই হল খেলার উপযুক্ত স্থান। দূরে বসে ক্যামেরার চোখে দেখো আর মনে মনে খেলো। ওই যে কপিল ব্যাটটা তুলল, তারপর শরীরটাকে স্লাইট বাঁয়ে মুচড়ে সোজা করার সময় দ্বিধাটা কাটাতে পারলে ওইভাবে স্টাম্প ছিটকে যেত না। আমি হলে সোজা ছয়। মেরে গ্যালারিতে ফেলে দিতুম। শ্রীকান্তের চোখ সেট হবার আগে লেগব্রেক ওভাবে মারলে। আউট তো হবেই। আমি হলে আরও দু-চারটে মেরে তারপর চার কি ছয় মারবার চেষ্টা করতুম। আমরা আসলে অ্যাডভাইসারের জাত। উপদেষ্টা। কোনটা বেশি প্রয়োজনীয়, অ্যাকশন না অ্যাডভাইস? ভালো উপদেশ না পেলে জীবনে কিছুই করা যায় না। লেখাপড়া, কলকারখানা,
মামলা-মোকদ্দমা, চুরি ডাকাতি। ভালো উপদেষ্টার উপদেশ না নিলে সব ভেস্তে যায়। খাটে বসে টিভি-র পর্দায় খেলা না দেখলে খেলোয়াড়কে মানুষ করা যায় না। কোচ এত কাছে থাকেন, খেলার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে থাকেন, তাঁর পক্ষে কী করলে কী হত, এই উপদেশ দেওয়া সম্ভব নয়। এ একমাত্র খাট-এক্সপার্টরাই দিতে পারে। আমরা সবসময় দিয়েও থাকি। খাটে বসে, গ্যালারিতে বসে দিয়েও থাকি, ওঁরা শুনতে পান না। আমাদের উপদেশে চললে, কি ক্রিকেট, কি হকি, কি ফুটবল, আমরা হয়ে যেতুম অজেয়।
শুধু! এই শুধুটাই হল আসল, স্ট্যামিনা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য ভালো করতে হবে। ষাঁড়ের ডালনা নাকী বলে, খেতে হবে। তবে ভুঁড়ি বাড়ালে চলবে না। আমাদের কাল হল হুঁড়ি। আমাদের জাতীয় পরিকল্পনায় অনবরত দৌড়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, বাসের পেছনে, ট্রামের পেছনে, ট্যাক্সি কি মিনির পেছনে। না দৌড়োলে কিছুই ধরা যায় না। আরও ভালো দৌড়ের জন্যে নিয়মিত বোমাবাজি, লাঠিবাজি, টিয়ারগ্যাসের ব্যবস্থা তো আছেই। আর আছে পথ-দুর্ঘটনার পর যানবাহনে ইটপাটকেল ছোড়া, আগুন, পুলিশের তাড়া। সারা দেশটাকে আমরা খেলার মাঠ। করেছি। পথঘাট করে তুলেছি ট্রেকিং-এর উপযোগী। ধর্মতলা থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে ব্রিজ পেরিয়ে বিটি রোড বরাবর ব্যারাকপুর যাত্রা, কোথায় লাগে, লে, লাদাখ, সান্দাকফু! তবু আমাদের ভুঁড়ি বাড়ছে। ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম প্রথম ৪৫ মিনিট বেশ দৌড়ঝাঁপ করে, তারপর সেকেন্ড হাফে হাঁপায়। দরকার প্রাণায়াম। এই প্রাণায়ামের কথায় মনে পড়ল, আমরা সবাই ডাক্তার, সবাই অ্যাস্ট্রোলজার, আমরা সবাই যোগী। শশঙ্গাসন, ভুজঙ্গাসন, হলাসন, উষ্ট্রাসন। মুখে মুখে ফেরে। বাসে, ট্রামে, বাজারে এমনকী বিয়ের আসরে। কন্যা সম্প্রদান করতে গিয়ে মেয়ের মামা, চাদর গলায় জামাতার নাদুস ভুঁড়ির দিকে তাকিয়ে ফিশফিশ করে বললেন, বাবা, ফুলশয্যাতেই হলাসনটা শুরু করে দাও। আর পারলে শেষ রাতে উঠে পদহস্তাসন।
তবে খাটে বসে টিভি দেখতে দেখতে এক্সপার্টর্স কমেন্টস করার দিন আমার শেষ হয়ে এল। গত বিশ্বকাপে সারারাত ঠ্যং-এর ওপর ঠ্যাং তুলে টিভি দেখেছি। বোতলভরা জল ঢুকুর ঢুকুর খেয়েছি। আর বেলা অবধি ভোঁস ভোঁস ঘুমিয়েছি। এতে আমার পালিকার, অর্থাৎ আমি যাঁর গৃহপালিত, তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে। স্নায়ু উত্তেজিত হয়েছে। ফরাসি দেশ হলে আমার নামে লাখ টাকার ডেমারেজ স্যুট ঠুকে দিত। টিভিতে তালা মেরে এবার থেকে রেশনিং সিসটেমে, যেমন চাল গম চিনি ছাড়ে, সেই রকম প্রোগ্রাম ছাড়বে। সারা রাত হ্যা হ্যা করা চলবে না।