কাঠামো
থিতিয়ে এসেছে উৎসবের রমরমা। কদিন বেশ আনন্দের সমারোহে দিনগুলোয় মানুষজন দুঃখ ভুলে উল্লাসের মহাযজ্ঞে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যেও ব্যতিক্রম থাকে।নিতু তার মা-র সাথে শহরের একপ্রান্তে একটা কুঁড়েঘরে থাকে। বয়েস ১৩-১৪। তার স্মৃতিতে খুব উজ্জ্বল বাবার মুখখানা। এত আর্থিক অনটনের পাহাড়-প্রমাণ ঝাঁকুনিতেও সুতান অটল মানসিকতায় একটা মুদিখানায় সহকারীর কাজ করতো।
কিন্তু অমন কাজে আয় ছিল যৎসামান্য। যাকে বলে দিন আনি দিন খাই। সংসার চলতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। নিতু বাবার অসহয়তা খুব বুঝতো। সুতানের সাথে যে কতবার পুজোর ভাসানের সময় কূলে দাঁড়িয়ে সবকিছুই নেকনজরে রাখতো। দেব-দেবীর মূর্তিগুলো জলে পড়তেই মন ভারী চঞ্চল হয়ে উঠতো। কারণ জলে ধুয়ে সিল্কের জামা-কাপড় খুলে পড়লেই সুতান জলে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কারণ ওটাই যে মোক্ষম সময়। প্রতিমার যাবতীয় বস্ত্রাদি সংগ্ৰহ করে আবার সে বাজারে বিক্রি করে বেশ কিছু রসদ সংগ্ৰহের জন্য।
নিতু খুব উৎসাহে বাবার এই কাজে দর্শক হয়ে মাঝে মাঝে হাত লাগিয়ে আনন্দ পেত। কতবার সে বাজারে বসেছে বাবার সাথে। বাড়ীতে এসে মাকে বলতো, জানো মা, আজ ভালো উপার্জন হয়েছে।
প্রতিবছর বিভিন্ন দেবদেবীর ভাসানটাই তাদের পাখির চোখ ছিল। কাঠামোর সাথে কত স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য। সংসারের স্বচ্ছলতা তখন মনে প্রাণে একমাত্র প্রার্থিত।
এখন নিতুর দুটি চোখে অশ্রুর বন্যা। ওগুলো সব অতীতের খেলাঘরে লালিত হয়েছে। সুতান গত হয়েছে বছর চার হলো। আর এখন নিতু শুধোই বাবার মুদিখানায় যায়। কিন্তু কর্ণিয়ায় আঠার মতো লেগে আছে ঐসব প্রতিমার মূল্যবান বসন-কাঠামো। সরকার বাহাদুরের তৎপরতায় নিতু শুধই শূন্য চোখে বিসর্জনে আসা বিভিন্ন প্রতিমার দিকে চেয়ে থাকে। প্রতিমার কাঠামো জলে ভেসে থাকলে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জল ভয়ানক দুষিত হয়। ফলে পরিবেশ সংরক্ষণে প্রসাশন কর্ম-তৎপর হয়েছে। এছাড়া জলজ প্রাণীমৃত্যুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। পৌরসভা ক্ষতির এত সম্ভাবনায় নিজেদের দায়িত্বে সব ব্যবস্থা করায় নিতুর মতন অনেকেই জলে ঝাঁপিয়ে কাঠামো স্পর্শ করতে পারে না। মাঝে মাঝে তাই নিতুর মনে হয়, ভগবান এইভাবে আমার পেটে লাথি মারলো!!