Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারি || Sunil Gangopadhyay » Page 7

কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারি || Sunil Gangopadhyay

বুকের মাঝখানে আর ঘাড়ের কাছে চুরুট দিয়ে পোড়ানো দুটো জায়গায় জ্বালা করছে খুব! পেটের কাছে একটা জায়গায় চুলকোচ্ছে। কাকাবাবু ভাবলেন, এখনই কী, এর পর যখন পিঁপড়েরা আসবে, তখনই আসল যন্ত্রণা শুরু হবে। সামান্য একটা পিঁপড়েকেও মারার উপায় নেই তাঁর এখন।

কতক্ষণ এইভাবে থাকতে হবে?

তিনি সত্যি-সত্যি মরে যাবেন, তা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না। এর আগে তো আরও কত বিপদে পড়েছেন, শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হবে টিকেন্দ্রজিতের মতন একটা লোকের কাছে? এইরকমভাবে জঙ্গলে, সবার চোখের আড়ালে?

এর চেয়ে সামনাসামনি কারও সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করা অনেক বেশি সম্মানজনক!

যদি কোনও জন্তু-জানোয়ার এসে পড়ে তো কী হবে?

হাতির পাল এলে বোধ হয় গ্রাহ্য করবে না। হাতিরা মানুষ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। গণ্ডার এলেও বিপদ নেই। ওরকম ভয়ঙ্কর চেহারা হলেও গণ্ডাররা সাধারণত নিরীহ প্রাণী। খুব রাগিয়ে না দিলে তারা কাউকে আক্রমণ করে না। তা ছাড়া, গণ্ডাররা নিশ্চয়ই বুঝবে, কাকাবাবু তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করছেন!

অসমের বাঘ সাধারণত মানুষখেকো হয় না সবাই বলে। কিন্তু কোনও বাঘ এসে যদি দেখে, একটা মানুষ বাঁধা পড়ে রয়েছে, তা হলেও কি এমন একটা সহজ খাদ্য ছেড়ে দেবে? কোনওরকম শিকার করার ঝঞ্ঝাট নেই, শুধু কামড়ে কামড়ে গা থেকে মাংস খেলেই হল!

দিনের বেলা বাঘ বেরোবার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে ভালুক আসতে পারে। এখানকার জঙ্গলে ভালুক অনেক কমে গেলেও যেকটা আছে, খুবই হিংস্র। হয়তো এদিকে কোথাও ভালুকের আস্তানা আছে। টিকেন্দ্রজিৎ জানে। ভালুক মানুষ দেখলে তার গা আঁচড়ে নখের ধার পরীক্ষা করে।

নাঃ, কোনও জন্তু-জানোয়ারের হাতে প্রাণ দিতে হবে, এটা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না!

সন্তু ঠিক আসবে। প্রথমে ওরা ভাববে, কাকাবাবু মর্নিং ওয়াক করতে গেছেন। তারপর বেলা বাড়লে নিশ্চয়ই চিন্তিত হয়ে পড়বে দু জনে। বড়ঠাকুরকে খবর দেবে। বড়ঠাকুর মানুষটি ভাল, বেশ নির্ভরযোগ্য, উনি নিশ্চয়ই চতুর্দিকে খবর পাঠাবেন।

ওঃ হো, সকালে উঠেই তো ওরা দেখতে পাবে ক্রাচ দুটো পড়ে আছে। খাটের পাশে রয়েছে জুতো। তা হলেই বুঝতে পারবে, কাকাবাবু মর্নিং ওয়াকে যাননি, কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। তা হলে সকাল থেকেই শুরু হবে খোঁজাখুঁজি। এটা একটা আশার কথা!

এখন কটা বাজে?

কাকাবাবুর হাতে ঘড়ি নেই। ঘড়ি থাকলেও দেখা যেত না, হাত দুটো যে পেছন দিকে মুড়িয়ে বাঁধা। এর মধ্যেই কাঁধ টনটন করছে। কী জ্বালাতন, কতক্ষণ থাকতে হবে এভাবে?

টিকেন্দ্রজিৎ নিশ্চয়ই জঙ্গলের এমন জায়গায় এনেছে, যেখানে কোনও টুরিস্ট আসে না। আশপাশের গ্রামের লোকও আসে না। হঠাৎ কেউ এসে পড়ে যে উদ্ধার করবে, তার সম্ভাবনা নেই। কোনও জন্তু-জানোয়ারও দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় এখন সকাল সাড়ে আটটা-নটা।

হঠাৎ হুপ-হুপ শব্দে কাকাবাবু চমকে উঠলেন। কারা আসছে? মনে হচ্ছে যেন কয়েকটা বাচ্চা ছেলে খেলা করতে করতে এগিয়ে আসছে এদিকে।

না, বাচ্চা ছেলে নয়, কয়েকটা বানর। একটার পর একটা গাছ লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে এদিকে। গায়ের রং সোনালি, লম্বা লম্বা ল্যাজ, এইগুলোই কি গোল্ডেন লাঙ্গুর? খুব দুর্লভ জাতের বানর। ওরা কাকাবাবুকে লক্ষই করছে না। খেলা করছে নিজেদের মধ্যে।

কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, হ্যালো, হ্যালো, লুক অ্যাট মি! আই অ্যাম হিয়ার।

বলেই তিনি লজ্জা পেলেন। অসমের জঙ্গলের বানররা ইংরেজি বুঝবে কেন? ওদের গায়ের রং অনেকটা সাহেবদের মতন, সেইজন্যই কাকাবাবুর ইংরেজি মনে এসেছে।

বানরগুলো কাকাবাবুর গলার আওয়াজ শুনে লাফিয়ে উঠল, পিছিয়ে গেল খানিকটা। তারপর সবাই সার বেঁধে বসে চোখ পিটপিট করে দেখতে লাগল। এক জন মানুষের এ রকম অবস্থা তারা কখনও দেখেনি।

কাকাবাবু বললেন, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাদের সাহায্য চাই!

তারপরই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, চকোলেট! চকোলেট খাবে? আমার কোটের পকেটে আছে, নিয়ে যাও না!

ইস, যদি হাত দুটো খোলা থাকত, কাকাবাবু ওদের চকোলেটের লোভ দেখিয়ে কাছে ডাকতে পারতেন!

আর কোনও জন্তু-জানোয়ার কাকাবাবুর বাঁধন খুলে দিতে পারবে না। একমাত্র বানরই ইচ্ছে করলে পারে। কারণ, ওরা হাতের ব্যবহার জানে।

ডারউইন সাহেব বলেছেন, বানররাই মানুষদের পূর্বপুরুষ। তা হলে বানরেরা কথা বলতে শেখে না কেন? ময়না, চন্দনা পাখিও মানুষের মতন কথা বলে। কুকুর কথা বলে না, কিন্তু মানুষের অনেক কথা বুঝতে পারে।

কাকাবাবু কাকুতি-মিনতি করে অনেকভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি বলতে লাগলেন, তোমাদের বাঁদর বলব না। বাংলায় বাঁদর মানে দুষ্টু ছেলে। তোমরা আসলে কপি! শাখামৃগ! কিষ্কিন্ধার অধিবাসী! রামচন্দ্র যখন সেতুবন্ধন করেছিলেন তখন তোমরা কত সাহায্য করেছিলে! লঙ্কার রাক্ষসদের কী রকম নাস্তানাবুদই না করেছিলে! তোমরা আমার বাঁধন খুলে দাও না ভাই। তোমরা যা চাও তাই খাওয়াব। অনেক চকোলেট, লজেন্স আর কলা, খুব ভাল মর্তমান কলা, আর যা খেতে চাও বলো!

ওদের মধ্যে যে পালের গোদা সে একলাফে একেবারে চলে এল কাকাবাবুর সামনে। কাকাবাবুর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল, তা হলে ওরা তাঁর কথা বুঝতে পেরেছে? এই বানরটার চেহারা বেশ বড়, লম্বা-লম্বা আঙুল, সে ইচ্ছে। করলেই গিট খুলে দিতে পারে।

পালের গোদা বানরটা সে-চেষ্টা না করে হঠাৎ হুপ- হুপ শব্দ করে লাফাতে শুরু করল মাটিতে। খুব যেন তার আনন্দ হয়েছে। কী ব্যাপার, ও এখন নাচছে নাকি? এই কি নাচবার সময়?

গোদা বানরটা নেচেই চলেছে, নেচেই চলেছে। গাছের ডালে বসে অন্য বানররা যেন এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে হাসছে। একজন মানুষের এরকম অসহায় অবস্থা দেখে বুঝি খুব মজা পাচ্ছে ওরা?

হঠাৎ অন্য বানররা একসঙ্গে হুপ-হুপ চিৎকার করে আর-একটা গাছে চলে গেল, সেখান থেকে আর-একটা গাছে। গোদা বানরটাও লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল। তারপর তারা ঢুকে গেল গভীর জঙ্গলে।

কাকাবাবু বেশ হতাশ হয়ে পড়লেন।

কিছু উপকার হল না ওদের দিয়ে। বানর তো বানরই! সাধে কি আর লোকে বাঁদর বলে গালাগালি দেয়!

আবার সব চুপচাপ। তেমন কোনও পাখিও ডাকছে না। একটু দূরে একটা গাছতলায় একঝাঁক ছাতারে পাখি কিচুলু মিচুলু করছে। ওরা সবসময় ছ-সাতটা পাখি একসঙ্গে থাকে আর মনে হয় যেন ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে। এদিকে যে একটা মানুষ রয়েছে, তা ওরা গ্রাহ্যও করছে না।

আর কিছু নেই, অনেকক্ষণ আর কিচ্ছু নেই।

কাকাবাবুর একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে তিনি চমকে উঠলেন।

ঘুমের মধ্যে যেটা বিকট শব্দ, সেটা আসলে ময়ূরের ডাক। ময়ূর দেখতে এত সুন্দর, কিন্তু তার ডাক এত কর্কশ! ছাতারে পাখিগুলো উড়ে গেছে। খুব কাছের একটা গাছের ডালে কখন এসে বসেছে একটা ময়ূর। বেশ বড় ময়ূর, অনেকখানি লম্বা ল্যাজ।

এত কাছ থেকে এরকম একটা সুন্দর ময়ূর কাকাবাবু আগে দেখেননি। ঠিক যেন একটা ছবি। ময়ূরটা এদিক-ওদিক মাথা ঘোরাচ্ছে। আর তার লম্বা গলায় ঝিলিক দিচ্ছে ময়ূরকণ্ঠী রং।

কিন্তু এই কি সুন্দর জিনিস দেখার সময়!

তবু কাকাবাবু একদৃষ্টে ময়ুরটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবু তো একটা জীবন্ত প্রাণী, যেন একজন সঙ্গী!

পায়ে সুড়সুড়ি লাগতেই কাকাবাবু নীচের দিকে তাকালেন। এই রে, পিঁপড়ে আসতে শুরু করেছে! লাল পিঁপড়ে। সর্বনাশ! কালো পিঁপড়েরা নিরীহ হয়, গায়ের ওপর দিয়ে ঘোরাঘুরি করলেও কামড়ায় না। কিন্তু লাল পিঁপড়েগুলো কুটুস কুটুস করে কামড়ায়, ওইটুকু প্রাণী, তবু কী বিষ! লাল পিঁপড়ে আর কালো পিঁপড়ের এত তফাত কেন? এরা টের পায়ই বা কী করে? কাকাবাবুর পা বেয়ে-বেয়ে উঠে এসে ঢুকে পড়ছে কোটের পকেটে।

সামান্য পিঁপড়েদের জন্য কাকাবাবু ময়ুরটার কথাই ভুলে গেলেন।

পিঁপড়ের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। এখন কাকাবাবুর কোটের পকেটে শুধু নয়, সারা গায়ে ছড়িয়ে গেছে পিঁপড়ে। যেখানে সেখানে কামড়াচ্ছে, কাকাবাবু ছটফট করতে লাগলেন। চুলকোচ্ছে সারা গা, কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। তিনি ভাবলেন, বাঘ-ভালুকের দরকার নেই, পিঁপড়ের কামড়েই তিনি শেষ হয়ে যাবেন।

ময়ূরটা কখন উড়ে গেছে তিনি টেরও পাননি।

পিঁপড়েদের শেষ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলল তাদের অত্যাচার। কিছুই যখন করার উপায় নেই, কাকাবাবু তখন চোখ বুজে ভাবতে লাগলেন সন্তুর কথা। সন্তুকে একটা খবর পাঠাতে হবে। ওয়্যারলেসে যেমন খবর পাঠানো যায়, তেমনই মানুষের চিন্তারও তো তরঙ্গ আছে। মনটাকে একাগ্র করে খুব তীব্রভাবে একজনের কথা চিন্তা করলে সে সাড়া দেবে না?

কাকাবাবু চোখ বুজে মনে-মনে বলতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু, চলে আয়, তোকে আসতেই হবে। আমি একটা জঙ্গলের মধ্যে রয়েছি, কোথায় ঠিক জানি না, তোকে খুঁজে বের করতে হবে। তুই পারবি না? চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই পারবি। সারারাত এই জঙ্গলে যদি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আমাকে থাকতে হয়, তা হলে আমি পাগল হয়ে যাব! তুই আয় সন্তু, তুই আয়, তুই আয়

ভালুক দুটো এল বিকেলের দিকে। টিকেন্দ্রজিৎ যা-যা বলেছিল, ঠিক মিলে যাচ্ছে। পিঁপড়েরা এখনও আছে, চকোলেট-লজেন্সগুলো নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে, এখন তারা সারা শরীরে ঘুরে-ঘুরে আরও কিছু খুঁজছে, কামড়াচ্ছে মাঝে-মাঝে।

ভালুক দুটো ঠিক যেন বেড়াতে বেরিয়েছে। মাঝে-মাঝে ওরা চার পায়ে হাঁটছে, এক-এক বার দু পায়ে ভর দিয়ে সোজা উঠে দাঁড়াচ্ছে। গাছের গুঁড়ি থেকে খুঁটে-খুঁটে তুলে কী খাচ্ছে কে জানে! ওদের থাবায় বড়বড় নখ! ওই নখ দিয়ে মানুষের গা চিরে দিতে পারে।

কাকাবাবু প্রায় দম বন্ধ করে রইলেন। ভালুকের দৃষ্টিশক্তি ভাল নয়, বেশি দূর দেখতে পায় না। কোনও রকম শব্দ করলে চলবে না।

সকালবেলা টিকেন্দ্রজিতের লোকেরা যে জায়গাটায় বসে ছিল, ঠিক সেই জায়গায় ভালুক দুটো ঘুরতে লাগল। কিছু যেন গন্ধ পেয়েছে। কাকাবাবুর গাছটা মাত্র দশ-বারো হাত দূরে। ওরা এখনও এদিকে তাকায়নি।

সূর্য অস্ত গেছে, আকাশে লাল রঙের আলো এখনও রয়েছে। জঙ্গলের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে আসছে আস্তে-আস্তে। কাকাবাবু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ভালুক দুটোর দিকে। ওরা চলে যাচ্ছে না কেন? এই জঙ্গলে, ভালুকের হাতে প্রাণ হারাতে হবে, এটা এখনও তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না! বাঁচতে হবেই। টিকেন্দ্রজিতের ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে না? পৃথিবীর যে-কোনও জায়গাতেই টিকেন্দ্রজিৎ লুকোক না কেন, কাকাবাবু তাকে ঠিক খুঁজে বের করবেনই। তাকে কঠিন শাস্তি দিতে হবে।

ভালুক দুটো কাকাবাবুর অস্তিত্ব টের পায়নি বটে, কিন্তু চলেও যাচ্ছে না। ঘুরঘুর করছে এক জায়গায়। কাকাবাবু ভাল করে শ্বাস নিতে পারছেন না। তাঁর মাথা ঝিমঝিম করছে। এবার বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন! সন্তুরা এখনও আসছে না কেন?

পেছন দিকের জঙ্গলে সরসর শব্দ হতেই কাকাবাবু সেদিকে ঘাড় ঘোরালেন। ভালুক দুটোও সেই শব্দ শুনতে পেয়েছে, তারা একটু একটু করে পিছিয়ে গেল একটা ঝোপের দিকে।

কাকাবাবুকে দারুণ অবাক করে দিয়ে সাইকেল চেপে একজন লোক হাজির। হল সেখানে। অস্পষ্ট আলোতেও কাকাবাবু চিনতে পারলেন। জলিল শেখ!

সে নিশ্চয়ই ভালুক দুটোকে দেখতে পায়নি। নিশ্চিন্তভাবে সাইকেলটাকে একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখল। তারপর কাঁধের থলে থেকে মস্ত বড় একটা ছোরা বের করে দাঁড়াল এসে কাকাবাবুর সামনে।

কাকাবাবু কটমট করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটুও ভয় না। পেয়ে ধমকের সুরে বললেন, আমাকে খতম করে দিতে এসেছ! একজন হাত-পা বাঁধা লোককে মারতে বীরত্ব লাগে না। মারতে চাও, মারো, কিন্তু জেনে রেখো, এর শাস্তি তুমি পাবেই। তোমাকে আমি ফাঁসিতে ঝোলাবই।

জলিল শেখ হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।

তারপর দ্রুত কাকাবাবুর হাত-পায়ের বাঁধন কাটতে কাটতে বলতে লাগল, বাবু, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি পাপ করেছি, তার শাস্তিও পেয়েছি। আমার মেয়েটা, সে আমার নয়নের মণি, সে নেই!

কাকাবাবু চমকে গিয়ে বললেন, তোমার মেয়ে ফিরোজা … সে নেই মানে?

জলিল শেখ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, কাল তাকে আমি খুব মেরেছিলাম। কাল আমি আবার পাখি ধরে বাড়িতে রেখেছিলাম, মেয়েটা খাঁচা খুলে সব পাখি ছেড়ে দিল। আমার রাগ হয়ে গেল খুব, তাই তাকে মারলাম। মেয়েটা রাত্তিরে কিছু খায়নি। আজ সকালে বাড়ি ফিরে দেখি, সে নেই। কে বলল, সে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে, কেউ বলল, জঙ্গলে চলে গেছে … বাবু, আমার ওই একমাত্র মেয়ে … আমি এত বড় পাপী …

হাত-পায়ের বাঁধন মুক্ত হওয়ার পরই কাকাবাবু ক্রাচ দুটোর অভাব বোধ করলেন। গাছে হেলান দিয়ে সারা গা চুলকে পিঁপড়ে তাড়াতে-তাড়াতে বললেন, অতটুকু মেয়ে, সে কোথায় যাবে? ভাল করে খোঁজ করা গিয়ে। তুমি যে আমায় ছেড়ে দিলে, টিকেন্দ্রজিৎ যদি জানতে পারে?

জলিল শেখ বলল, ওসবের আর আমি পরোয়া করি না। আর আমি পাপ কাজ করব না। না খেয়ে যদি মরতে হয় সেও ভাল।

কাকাবাবু বললেন, কাছাকাছি দুটো ভালুক রয়েছে।

জলিল শেখ যেন সেকথা শুনতেই পেল না। সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি এখান থেকে নিজে নিজে ফিরে যেতে পারবেন?

কাকাবাবু বললেন, ক্রাচ ছাড়া আমি হাঁটতে পারি না। রাত্তির হয়ে গেলে জঙ্গলের রাস্তাও চিনতে পারব না।

জলিল শেখ বলল, আপনাকে আমার সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যেতে পারি। ডাকবাংলোর কাছে ছেড়ে দেব। আমার মেয়েটা যে কোথায় গেল!

কাকাবাবু ওর সঙ্গে কথা বললেও একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সামনের জঙ্গলের দিকে। দুটো ছায়া যেন দুলতে-দুলতে এগিয়ে আসছে।

কাকাবাবু বললেন, জলিল, তোমার পেছনে ভালুক!

জলিল ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ওরে বাপ রে!

কাকাবাবু বললেন, তোমার ছোরাটা শিগগির আমাকে দাও। তোমার কাছে আর কোনও অস্ত্র আছে?

জলিল বলল, আজ্ঞে না। হ্যাঁ, মানে একটা গুলতি আছে।

কাকাবাবু বললেন, ও দিয়ে কিছু হবে না। আমার পেছনে এসে চেঁচাও, খুব জোরে চেঁচাতে থাকো!

কাকাবাবু ছোরাটা সামনে উঁচু করে ধরে রইলেন। সারাদিন হাত-পা বাঁধা ছিল, শরীরে রক্ত-চলাচল হয়নি ঠিকমতো, দারুণ ক্লান্ত লাগছে, তবু লড়তে তো হবেই। জলিলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও চেঁচাতে লাগলেন, আয়, আয় দেখি তোদের গায়ে কত জোর!

ভালুক দুটো খানিকটা এসে থমকে গেল। মনে হল, কতা-গিন্নিতে বেড়াতেই বেরিয়েছে, এখন মারামারি করার ইচ্ছে নেই। চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত হয়ে আবার পেছন ফিরে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

জলিল সাইকেলটা কাছে এনে বলল, উঠে পড়ুন স্যার, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন।

এর মধ্যেই অন্ধকার হয়ে গেছে। জঙ্গলের মধ্যে পায়েচলা পথও নেই। ঝোপঝাড় ঠেলেঠুলে এগোতে হচ্ছে। একবার তো একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে উলটেই পড়ে গেলেন দুজনে।

আবার সাইকেলটা সোজা করার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ডাকবাংলোতে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?

জলিল বলল, তা আজ্ঞে চার-পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে!

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এত দূর! সমস্ত শরীরে ব্যথা। মনে-মনে বললেন, টিকেন্দ্রজিৎ, কোথায় পালাবে তুমি? তোমার ওপর এর সব কিছুর প্রতিশোধ আমি নেবই!

আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখা গেল দূরে একটা আলো। আলোটা এগিয়ে আসছে। তারপর শব্দ পাওয়া যেতেই বোঝা গেল, সেটা একটা গাড়ির হেডলাইট। একটা গাড়ি আসছে এদিকে। শত্রুপক্ষ, না মিত্রপক্ষ? হয়তো টিকেন্দ্রজিই কোনও লোককে পাঠিয়েছে তার বন্দির অবস্থাটা দেখবার জন্য!

সাইকেলটা থামিয়ে জলিল আর কাকাবাবু একটা বড় গাছের আড়ালে লুকোলেন। যদি শত্রুপক্ষ হয়, তা হলে ধরা পড়ে গেলে খুবই বিপদ। ওদের কাছে বন্দুক-পিস্তল থাকলে লড়াই করা যাবে না।

কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, জলিল, তুমি পালাও। শব্দ না করে দূরে সরে যাও।

জলিল বলল, আপনাকে ফেলে আমি পালাব? কিছুতেই না।

গাড়িটা আসছে আস্তে-আস্তে। একটা জিপগাড়ি। ভেতর থেকে কেউ টর্চের আলো ফেলছে। এদিক-ওদিক।

কাকাবাবু হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ডাকলেন, সন্তু!

সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি থেকে সাড়া এল, কাকাবাবু!

কাকাবাবু বুক খালি করে নিশ্বাস ছাড়লেন। সন্তুকে তিনি মনে-মনে ডাক পাঠিয়েছিলেন, সন্তুকে আসতেই হবে। শুধু একটু দেরি হয়েছে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে এসে সন্তু কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরল। ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করতে লাগল, কী হয়েছিল? কে এখানে ধরে এনেছিল? তোমার কোনও ক্ষতি হয়নি তো, আমরা সারাদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

কাকাবাবু কোনও কথা বললেন না। সন্তুর কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে জিপ গাড়িটার সামনের সিটে বসলেন।

তারপর বললেন, বড্ড ক্লান্ত রে আমি, ঘুম পাচ্ছে, পরে সব বলব! তাঁর মাথা ঝুঁকে এল বুকে, তিনি ঘুমিয়েই পড়লেন সঙ্গে-সঙ্গে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress