Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও মরণফাঁদ || Sunil Gangopadhyay » Page 3

কাকাবাবু ও মরণফাঁদ || Sunil Gangopadhyay

চারদিনের মধ্যেই সবার বেশ পার্ট মুখস্থ হয়ে গেল।

কাকাবাবুর নিজেরও সব মনে পড়ে গেছে। গানগুলো তিনি বই না দেখেই গেয়ে শোনাতে পারেন।

ছোটমামা এরমধ্যে পোস্টার ছাপিয়ে ফেলেছেন। টাকি থেকে বসিরহাট পর্যন্ত অনেক দেওয়ালে দেওয়ালে সেই পোস্টার। পরিচালক হিসেবে বড় বড় অক্ষরে লেখা : রাজা রায়চৌধুরী, ব্রাকেটে কাকাবাবু।

সকালবেলা বেড়াতে বেরিয়ে সেই পোেস্টার দেখে কাকাবাবু লজ্জা পেয়ে গেলেন।

বাড়িতে ফিরে এসে তিনি ছোটমামাকে বললেন, আরে চাদু, এটা কী করেছ, তুমি আমার নামটা দিতে গেলে কেন?

ছোটমামা বললেন, তোমার নামে বেশি টিকিট বিক্রি হবে!

কাকাবাবু বললেন, ধ্যাত, আমাকে এখানে কে চিনবে? লোকে ভাববে বুঝি, কোনও যাত্রাদলের অধিকারী!

ছোটমামা বললেন, তুমি জানো না রাজাদা, তুমি কতটা বিখ্যাত। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ইনিই কি সেই সবুজ দ্বীপের রাজার কাকাবাবু? অনেকেই তো টিভি-তে তোমার আরও সিনেমা দেখেছে!

কাকাবাবু বললেন, বেশি লোকে আমাকে চিনে ফেলুক, আমি মোটেই তা চাই। আমার শত্রুরও তো অভাব নেই!

সব পোস্টার দেওয়ালে দেওয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে, এখন তো আর তুলে ফেলাও যায় না।

বৃষ্টির জন্য রিহার্সালে ব্যাঘাত হচ্ছে খানিকটা। এক এক সময় এত জোর বৃষ্টি নামে, কেউ বাড়ি থেকে বেরোতেই পারে না। তবু কিছু কিছু ছেলে এমনই মজা পেয়ে গেছে যে, সেই বৃষ্টির মধ্যেও দৌড়ে দৌড়ে এসে হাজির হয়।

আজ সকাল ও দুপুরে একটানা বৃষ্টি হল।

এরমধ্যেই বাড়িতে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিকেলবেলা ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত যাইই হোক, চারটে থেকে রিহার্সাল শুরু করতেই হবে। থিয়েটার করতে গেলে ভালভাবে করা উচিত।

সৌভাগ্যবশত দুপুর সাড়ে তিনটের পরই বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশ পরিষ্কার। চারটে বাজতেই কাকাবাবু বললেন, সন্তু, দ্যাখ, সবাই এসেছে কিনা! হ্যাঁ। প্রত্যেকেই এসেছে বলতে গেলে, শুধু সুকোমল ছাড়া। অন্যদিন কিন্তু সুকোমল আগে আগেই এসে হাজির হয়। অনেক নাটকের দলে, কেউ একজন অনুপস্থিত থাকলে প্রক্সি দিয়ে রিহার্সাল শুরু হয়ে যায়। কাকাবাবু সেটা পছন্দ করেন না। তিনি মাঝখান থেকেও রিহার্সাল দেন না। প্রত্যেকদিন-একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকে টানা শেষ পর্যন্ত। রাম আছে প্রথম দৃশ্যেই। কিছুক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করা হল। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, আধঘণ্টা কেটে গেল, সুকোমল এল না।

যে ছেলেটি লক্ষ্মণের পার্ট করছে, তার নাম দিবাকর। সে সুকোমলকে পছন্দ করে না। এক সময় সুকোমলের সঙ্গে তার কী নিয়ে যেন ঝগড়া হয়েছিল, অর্থাৎ রাম আর লক্ষ্মণের মধ্যে ভাব নেই।

দিবাকর উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, সুকোমল এলে আপনি তাকে কান ধরে ওঠবোস করাবেন?

কাকাবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, নিশ্চয়ই! পুলিশসাহেবের ছেলেকে সত্যি সত্যি কান ধরে ওঠ-বোস করানো হবে কি না তা নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল আছে। সবাই ঘন ঘন তাকাচ্ছে দরজার দিকে।

আরও দশ মিনিটের মধ্যেও সুকোমল এল না।

কাকাবাবু বেশ বিরক্ত হয়েছেন। বইটার পাতা থেকে চোখ তুলছেন না।

একটু বাদে বললেন, আর তো দেরি করা যাবে না। ততক্ষণ গানগুলো প্র্যাকটিস হোক। সুকোমলের বাড়ি কত দূরে? কেউ গিয়ে খবর নিয়ে আসতে পারবে?

দিবাকরই উঠে দাঁড়াল। সাইকেলে যেতে-আসতে দশ মিনিটও লাগবে না।

কয়েকটা কোরাস গান আছে, সেগুলো এখনও ঠিক তৈরি হয়নি। কাকাবাবু সে-গুলোই ভাল করে শেখাতে লাগলেন।

দিবাকর ফিরে এসে জানাল, সুকোমল বাড়িতেও নেই। তার মা বলেছেন, সে রিহার্সাল দেওয়ার জন্য চারটের আগেই বেরিয়ে গেছে।

তবে কি সুকোমল নাটকের রিহার্সাল দেওয়ার নাম করে অন্য জায়গায় আড্ডা দিতে গেছে? ছি ছি ছি। নাটক সম্পর্কে তার উৎসাহ নেই? তা হলে জোর করে

সে রামের পার্ট নিতে গেল কেন?

এর পরেও একঘণ্টা, দেড়ঘণ্টা কেটে গেল, সুকোমল আর এলই না। রিহার্সাল শেষ হল সাড়ে সাতটায়।

এখানে প্রায়ই লোডশেডিং হয়। অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটা বিপজ্জনক। এই বর্ষাকালে সাপটাপ বেরোয়, তাই ছেলেদের আর আটকে রাখা যায় না।

সবাই চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু বারান্দায় বসলেন এক কাপ কফি নিয়ে। জোজো আর সন্তু এসে বসল কাছে।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি যে লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকে অভিনয় করেছিলেন, কেমন হয়েছিল? ভাল? না কি কোনও গণ্ডগোল হয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, সে অনেকদিন আগের কথা, কিন্তু আমার মনে আছে সব। একটু-আধটু গণ্ডগোল হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেসব কথা এখন বলতে ইচ্ছে করছে। পরে সে গল্প শোনাব। আমি ভাবছি সুকোমলের কথা। কেন সে আজ এল? তাকে এমনিতে বেশ সিনসিয়ার মনে হয়েছিল। রিহার্সালের নাম করে সে অন্য কোথাও যাবে আড্ডা দিতে?

জোজো বলল, নিশ্চয়ই ট্রাফিক জ্যামে পড়েছে!

কাকাবাবু বললেন, সাইকেলে যার বাড়িতে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে, তার মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম?

সন্তু জানে, কাকাবাবু কোনও একটা কাজে হাত দিলে সেটা ঠিকঠাক শেষ না করা পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি বোধ করেন না। আজ রাত্তিরে সুকোমলের কথা চিন্তা করে ঘুমোতেই পারবেন না তিনি।

কথা ঘোরাবার জন্য সে বলল, কাকাবাবু, শিশির ভাদুড়ি নামে একজন বড় অভিনেতার কথা আমরা বইতেই পড়েছি। তুমি কি তার থিয়েটার দেখেছ?

কাকাবাবু কিছু বলার আগেই জোজো বলল, আরে শিশির ভাদুড়ি তো আমার বাবার শিষ্য ছিলেন। একবার তার গলায় এমন ব্যথা হল—

জোজো গল্পটা শেষ করতে পারল না।

ছোটমামা এসে বললেন, রাজাদা, একটা খুব চিন্তার ব্যাপার হল। সুকোমল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল রিহার্সালে আসবে বলে। এখানে সে আসেনি। বাড়িতেও

সে ফেরেনি। কেউ তার কোনও খবর বলতে পারছে না!

কাকাবাবু বললেন, বাড়িতে ঝগড়াটগড়া করেছিল নাকি?

ছোটমামা বললেন, না, সেসব কিছু হয়নি। বাড়ি থেকে দুধ-কলা আর মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছিল। ওর মা বলল, সবটা খায়নি, রিহার্সালের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে তাড়াতাড়ি জামাটামা পরে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল, আবার ফিরেও এল, বইটা নিয়ে যায়নি। তখন চারটে বাজতে ঠিক দশ মিনিট বাকি।

কাকাবাবু বললেন, ধরা যাক, রিহার্সালে না এসে সে মিথ্যে কথা বলে অন্য কোথাও গেছে। এত রাত পর্যন্ত সে বাড়ির বাইরে থাকে?

ছোটমামা বললেন, এখানে তো সন্ধের পর আর করার কিছু নেই। কোথায় থাকবে? অন্য সময় সে বাবলু নামে তার এক বন্ধুর বাড়িতে ক্যারাম খেলতে যায়। সে ছেলেটির জ্বর হয়েছে কদিন থেকে। তার বাড়িতেও খোঁজ নেওয়া হয়েছে, সেখানেও সে যায়নি।

সামনের রাস্তা দিয়ে বিকট শব্দে একটা মোটরসাইকেল ছুটে গেল।

তারপরেই দেখা গেল, বাগানের মধ্যে গোলমতন কী একটা জিনিস এসে পড়েছে, তাতে চিড়িক চিড়িক করে আগুন জ্বলছে।

সন্তু আর জোজো সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, যাবি না, কাছে যাবি না!

সঙ্গে সঙ্গে সেটা প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গেল।

ছোটমামা দারুণ অবাক হয়ে বললেন, কী, আমার বাড়িতে বোমা? কার এত সাহস?

কাকাবাবু বললেন, আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছি, ওটা আসল বোমা নয়। বোমাবাজি। এমনি কেউ ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছে।

ছোটমামা বললেন, আমাকে কে ভয় দেখাবে? কীসের জন্য ভয় দেখাবে?

কাকাবাবু বললেন, তুমি গ্রামের মানুষের জন্য অনেক কাজ করছ। অনেকে তোমায় ভালবাসে। আবার তোমার বিরুদ্ধপক্ষও আছে নিশ্চয়ই!

ছোটমামা বললেন, তা তো থাকবেই। কেউ কেউ আমার পেছনে লাগতে যায়। সে আমি গ্রাহ্য করি না।

কাকাবাবু বললেন, তুমি যে এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছ, কলকাতা থেকে বড় বড় আর্টিস্ট আনাচ্ছ, সে ব্যাপারে সবাই তোমাকে সাহায্য করছে?

ছোটমামা বললেন, সবাই কি আর একমত হয়? গগন সাহা নামে এখানে একজন পাণ্ডাগোছের লোক আছে, মাছের ব্যবসায় অনেক টাকা করেছে, সে চেয়েছিল কমিটির সেক্রেটারি হতে। এখানে জানেন তো, কিছু করতে গেলেই একটা কমিটি হবে, আর তার সেক্রেটারি হওয়ার জন্য কিছু লোক ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেই গগন সাহাকে সেক্রেটারি করা হয়নি?

ছোটমামা বললেন, গগন এমনিতে বেশ কাজের লোক, খুব খাটতে পারে, কিন্তু একটাই ওর দোষ। কিছু হলে তার থেকে ও টাকা চুরি করবেই। এমনিতে ওর এখন খুব ভাল অবস্থা, গ্রামে মস্ত বাড়ি, শহরে বাড়ি। তবু পাবলিকের টাকা চুরি না করে পারে না। সেইজন্যই গগন সাহাকে নিলে অন্য অনেকে আপত্তি করত।

কাকাবাবু বললেন, তাতে গগন সাহা নিশ্চয়ই চটে গেছে। সে তোমার অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার চেষ্টা করতেই পারে। অনুষ্ঠানটা শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক না হলে তোমারই তো বদনাম হবে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ওই গগন সাহার কি মোটরসাইকেল আছে?

ছোটমামা একটু থমকে গিয়ে বললেন, ঠিক বলেছিস তো! আজকাল গগন একটা নতুন মোটরবাইক হাঁকিয়ে বেড়ায়!

তারপরই তিনি আবার বললেন, তা বলে গগন আমার বাগানে বোমা ছুড়ে যাবে, এত সাহস তার হবে না। আমাকে সে ভয়ও পায়।

কাকাবাবু বললেন, তোমাকে ভয় পাবে কেন? তোমার কীসের জোর? পুলিশ তোমাকে সাহায্য করে?

ছোটমামা বললেন, না, না, আমি নিজের কোনও ব্যাপারে পুলিশের সাহায্য নিই না। সুকোমলের বাবাকেও কখনও বাড়িতে ডাকিনি। গ্রামের মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমার মুখের কথায় হাজার হাজার মানুষ ওর বাড়ি ঘিরে ফেলতে পারে। দু-একবার এমনিই গ্রামের মানুষ ওকে মারতে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমিই ওকে বাঁচিয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি ওকে বাঁচিয়েছ, সেইজন্য তোমার ওপর ওর আরও রাগ বাড়বে। সেটাই তো নিয়ম!

জোজো জিজ্ঞেস করল, সুকোমলের বাবা কোথায়?

কাকাবাবুও মনে মনে এই কথাটাই ভাবছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। সুকোমলের বাবা এর মধ্যে একবারও আসেননি। সন্তু আর জোজোও জানে, কাকাবাবু যেখানে যান পুলিশের কর্তারা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যায়।

ছোটমামা বললেন, সুকোমলের বাবার নাম নিখিল মাহাতো। উনি বিশেষ কাজে বারাসত গেছেন, টেলিফোনেও তাকে ধরা যায়নি। উনি এখনও কিছু খবর পাননি!

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, একবার গগন সাহার সঙ্গে দেখা করে আসি!

ছোটমামা বললেন, এখন যাবেন? অনেক রাত হয়ে গেছে। খাওয়াদাওয়া হয়নি।

কাকাবাবু বললেন, খাওয়াদাওয়া পরে হবে। কীরে সন্তু, জোজো, তোদের খিদে পায়নি তো? আজ রাত্তিরের মধ্যেই সুকোমলের খোঁজ বার করতে হবে। কাল রিহার্সাল বন্ধ রাখা চলবে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress