মাথায় বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে
ঘুম ভাঙার আগে কয়েকবার ছটফট করলেন কাকাবাবু। তাঁর মাথায় বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে। ঘুমটা যত পাতলা হয়ে আসছে, ততই যন্ত্রণা বাড়ছে।
চোখ মেলেই ধড়মড় করে তিনি উঠে বসলেন। সেই কাল রাতের ধপধপে চাদর পাতা বিছানা। পাশের খাটে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন ক্যাপটেন নরবু।
কাকাবাবু একবার ভাবলেন, কাল রাত্তিরে এই মনাস্টারিতে পৌঁছবার পর থেকে কি তাঁরা এই ঘরেই শুয়ে আছেন? ঘুমের মধ্যে একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন? বাচ্চা ছেলের মতন দেখতে তিনশো বছর বয়েসী প্রাচীন লামা, ঘরের মধ্যে বিদ্যুতের চমক, এসব তো মানুষ দুঃস্বপ্নেই দেখে!
কিন্তু মাথায় চোট লাগল কী করে? মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন, একটা ব্যান্ডেজের মতন ফেট্টি বাঁধা আছে। পেছন দিকে এক জায়গায় বেশ ব্যথা।
তিনি পাশের খাটে উঁকি মেরে দেখলেন, ক্যাপটেন নরবুর ওদিকে সন্তু আছে কি না। সন্তু নেই। সন্তু তা হলে অন্য কোথাও শুয়েছে।
ক্যাপটেন নরবুকে ধাক্কা দিয়ে তিনি ডাকলেন, নরবু! নরবু! ওঠো!
ক্যাপটেন নরবুর যেন কুম্ভকর্ণের মতন ঘুম। কিছুতেই উঠতে চান না। কাকাবাবু দু হাত দিয়ে তাঁকে ঝাঁকাতে লাগলেন।
হঠাৎ এক সময় ক্যাপটেন নরবু লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, কাল রাত্তিরে কী হয়েছিল বলো তো? মনে আছে। তোমার?
ক্যাপটেন নরবু অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন কাকাবাবুর মুখের দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, কাল রাত্তিরে? কাল রাত্তিরে? ওঃ কী দেখলাম! জীবন ধন্য হয়ে গেছে! সত্যিকারের মহামানব। তাঁর শরীর থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে। তিনি চোখ মেলতেই সারা ঘর আলো হয়ে গেল!
কাকাবাবু এবার বুঝলেন যে কাল রাত্তিরের ঘটনাগুলো দুঃস্বপ্ন নয়। দুজন মানুষ একই সঙ্গে এক দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে না।
তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম? আমাকে কি এই ঘরে ওরা বয়ে নিয়ে এসেছে?
ক্যাপটেন নরবু বললেন, সে কথা আমারও মনে নেই। আমিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। বজ্র লামা ঠিকই বলেছিলেন, মহামানবের দিব্যদৃষ্টি সহ্য করা যায় না। তিনি কী সুন্দর করে হাসছিলেন, আমাদের আশীর্বাদ করলেন, কিন্তু তাঁর শরীর থেকে যে আলো বেরোতে লাগল, তাতেই আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। তারপর ঠিক ইলেকট্রিক শক খাবার মতন আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল! তারপর আর কিছু মনে নেই।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু কোথায়?
ক্যাপটেন নরবু বললেন, জানি না তো? বোধ হয় বাইরে গেছে। এখন কত বেলা হয়েছে?
প্রায় এগারোটা বাজে।
ওরে বাবা, এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! যাই বলল রাজা, সত্যি জীবনটা ধন্য হয়ে গেল। তিনশো বছরের বৃদ্ধ প্রাচীন লামার কী অপরূপ শরীর! একেবারে তাজা। ঠিক যেন আলো দিয়ে গড়া। এমন কোনওদিন দেখব, কল্পনাও করিনি। নিজের চোখে দেখলাম, আর তো অবিশ্বাস করা যায় না!
আমি অবশ্য নিজের চোখকেও বিশ্বাস করি না। নিজের চোখও ভুল দেখতে পারে। নিজের কানও ভুল শুনতে পারে। মানুষের চোখ কান-নাকও কখনও কখনও ভুল করতে পারে। কিন্তু মানুষের মন ভুল করে না। অবশ্য যুক্তিবোধটা ঠিক রাখতে হয়।
তার মানে?
ধরো, আমি যদি দেখি একটা দড়ি হঠাৎ সাপ হয়ে গেল, সাপের মতনই। ফোঁসফোঁস শব্দ করতে লাগল, তা হলে আমি হয়তো একটুক্ষণের জন্য ভয় পেতে পারি। ভয় পেয়ে পালিয়েও যেতে পারি। তা বলে কি আমি বিশ্বাস করব, দড়ি হঠাৎ সাপ হয়ে যেতে পারে?
দড়ি যদি সাপ না হয়, তা হলে তুমি তা দেখবেই বা কী করে?
দরজা ঠেলে একজন লোক ঢুকল। তার হাতের কাঠের গোল ট্রে-তে এক পট চা ও দুটো কাপ।
কাকাবাবু ক্যাপটেন নরবুকে বললেন, এই লোকটিকে জিজ্ঞেস করো তো, সন্তু কোথায়?
ক্যাপটেন নরবু নিজের ভাষায় সেকথা জিজ্ঞেস করতে লোকটি শুধু দুদিকে মাথা নাড়ল কয়েকবার। তারপর বেরিয়ে চলে গেল। অর্থাৎ, সে কিছু জানে না।
কাকাবাবু কাপে চা ঢেলে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, এরা বেশ। অতিথিপরায়ণ। যখন চা দরকার, তখনই ঠিক এসে যায়, চাইতে হয় না। চা-টা খেতেও বেশ ভাল।
ক্যাপটেন নরবু বললেন, তোমার মাথায় ব্যান্ডেজ কে বাঁধল?
জানি না। আমার মাথায় চোট লেগেছিল। এরাই ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। মাথায় খুব ব্যথা আছে এখনও।
আচ্ছা রাজা, তুমি কেন দড়ির সাপ হয়ে যাওয়ার কথা বললে? ওরকম কি কেউ কখনও দেখে?
স্টেজে ম্যাজিশিয়ানরা যখন-তখন দেখায়। একদম সত্যি বলে মনে হয়।
কিন্তু কাল যা দেখেছি, তা ম্যাজিক হতে পারে না।
মড়া মানুষের মাথার খুলির চোখ দিয়ে কিছুতেই আলো বেরুতে পারে না। কিছুতেই পারে না। নিজের চোখে যদি সেরকম কখনও দেখি, তাও বিশ্বাস করা উচিত নয়।
রাজা, এসব তোমার গোঁড়ামি। তোমার-আমার জানার বাইরে আরও অনেক কিছু থাকতে পারে না? আমাদের যুক্তিবোধের বাইরেও অনেক কিছু ঘটে। মহাপুরুষ প্রাচীন লামার মুখখানা বাচ্চা ছেলের মতন, কিন্তু তাঁর মাথার চুল ধপধপে সাদা। এরকম কেউ কখনও দেখেছে?
একেবারে থুরথুরে বুড়ো হয়ে যাবার পর আবার নতুন করে দাঁত ওঠে, চোখের দৃষ্টি ফিরে আসে, মুখের কোঁচকানো চামড়া বাচ্চা ছেলেদের মতন মসৃণ হয়ে যায়। শুধু মাথার সাদা চুল কালো হয় না, তাই না?
না, পাকা চুল কখনও কালো হতে পারে না। রাজা, কাল তুমিও প্রাচীন লামাকে দেখে অভিভূত হয়েছিলে। তুমিই প্রথম ওঁকে নমস্কার করে আবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে চেয়েছিলে।
হ্যাঁ, নরবু, আমি ওঁকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম! পারিনি বোধ হয়, তাই না?
তুমি কি ভাবছ, প্রাচীন লামা একটা সাজানো পুতুল? আমি হলফ করে বলতে পারি, তিনি একজন জ্যান্ত মানুষ, তাঁর সারা গা দিয়ে আলো বেরুচ্ছিল।
দরজাটা আবার খুলে গেল। এবার এসে ঢুকলেন বজ্র লামা।
তিনি সদ্য স্নান করে এসেছেন, মাথার চুল ভেজা। গায়ে একটা কম্বলের তৈরি ঢোলা জামা। কাল রাতের মতনই তাঁর হাতে একগুচ্ছ জ্বলন্ত ধূপ। দেওয়ালের একটা কুলুঙ্গিতে সেগুলো খুঁজে দিয়ে বললেন, মঙ্গল হোক। সকলের মঙ্গল হোক। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়েছিল তো?
ক্যাপটেন নরবু বিগলিতভাবে বললেন, খুব ভাল ঘুম হয়েছে। এত বেলা হয়ে গেছে, টেরই পাইনি। কালকের রাতটা আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। কোনওদিন ভুলব না। আপনার কাছে আমরা দারুণ কৃতজ্ঞ।
বজ্র লামা কাকাবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মাথায় এখন বেশি যন্ত্রণা নেই তো? তা হলে একটা ওষুধ দিতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, না, ওষুধ লাগবে না। এখন ঠিক আছে। কী হয়েছিল বলুন তো? আমার মাথায় চোট লাগল কী করে?
বজ্র লামা হেসে বললেন, আপনার মনে নেই? আপনি মহামানব প্রাচীন লামার বেশি কাছে এগিয়ে গেলেন জোর করে। আমি তো আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম, সাধারণ মানুষ তাঁর দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না বেশিক্ষণ। একমাত্র মৈত্রেয় পারবেন। লক্ষ করেননি, আমিও প্রাচীন লামার সামনে দাঁড়াই না, পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন, তাতেই আপনার মাথার পেছন দিকটা খানিকটা কেটে গিয়েছিল।
কাকাবাবু বিড়বিড় করে বললেন, আমি জীবনে কখনও এমনি এমনি পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হইনি?
বজ্র লামা বললেন, আপনি জীবনে প্রাচীন লামার মতন তিন শতাব্দী জয়ী মানুষ দেখেছেন?
কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক? ক্যাপটেন নরবু বললেন, এই মহাপুরুষ প্রাচীন লামার কথা সারা পৃথিবীর জানা উচিত।
বজ্র লামা বললেন, জানবে, সময় হলেই জানবে। যখন ভগবান মৈত্রেয় আবির্ভূত হবেন, তখনই ইনি সকলের সামনে আত্মপ্রকাশ করবেন। সেদিনের আর বেশি দেরি নেই।
কাকাবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধূপের গোছাটা দেখতে লাগলেন। কাল রাত্তিরে এইরকম ধূপকাঠি থেকে নানা রঙের আলোর ফুলকি ঝরে পড়ছিল এক সময়। আজ এগুলোকে সাধারণ ধূপকাঠির মতনই মনে হচ্ছে, শুধু ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।
বজ্র লামা বললেন, এবার আপনাদের ফিরতে হবে। আমিও অন্য গুফায় ফিরে যাব। অনেক কাজ আছে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, চলুন যাওয়া যাক। আমার ভাইপো সন্তু কোথায়?
বজ্র লামা সহাস্যে বললেন, ও, আপনাদের একটা সুসংবাদ দেওয়া হয়নি। আপনাদের সঙ্গের ছোট ছেলেটি আর ফিরে যাবে না। ও এখানেই থেকে যাবে।
কাকাবাবু ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে?
বজ্র লামা বললেন, সে আর যেতে চাইছে না। আমাদের এখানে একটি গুরুকুল বিদ্যালয় আছে। সাতটি ছেলে সেখানে ধর্মীয়পাঠ নেয়। আপনার ভাইপো সেই জায়গাটা সকালে দেখতে গিয়েছিল। সেখানকার সব কিছু দেখে তার এমন পছন্দ হয়ে গেল যে, আমার হাত ধরে বলল, সে আর ফিরে যেতে চায় না এখান থেকে। ছেলেটির মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তার খুব মেধা আছে। মনটাও পবিত্র।
কাকাবাবুও এবার হেসে বললেন, তা হয় নাকি? ওকে ফেলে আমরা চলে যেতে পারি? কয়েকদিন পরেই ওর কলেজ খুলবে।
বজ্র লামা বললেন, কিন্তু সে তো কিছুতেই যাবে না বলছে। এর মধ্যেই পাঠ নিতে শুরু করেছে।
কাকাবাবু বললেন, সে হয়তো ওর একটা ছেলেমানুষী শখ হয়েছে। আমি বললেই বুঝবে। ও আমার দাদার ছেলে। ওকে না নিয়ে আমি যদি একা ফিরে যাই, দাদাবউদি রক্ষে রাখবেন?
বজ্র লামা বললেন, তাকে আমরা জোর করে ধরে রাখতে চাই না। আবার সে যদি ফিরে যেতে না চায়, তাকে জোর করে ঠেলে পাঠাতেও পারি না। কারুর মনে যদি ধর্মতৃষ্ণা জাগে, তাকে আমরা নিষেধ করব কেন? সে এখানে থাকার জন্য বদ্ধপরিকর।
ক্যাপটেন নরবু বললেন, মুশকিল হল তো! সন্তু যদি ফিরে যেতে না চায়,…সে একেবারে ছেলেমানুষ নয়…কলেজে পড়ে…বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে…
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, তাকে একবার ডাকুন। আমি বুঝিয়ে বলছি!
বজ্র লামা একটু চিন্তা করে বললেন, ছাত্রদের এদিকে আসার অনুমতি নেই। আপনি চলুন, তার কাছে চলুন। তার সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন।
কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো নরবু। ক্যামেরাটা ব্যাগে ভরে নাও। এ-ঘরে আর ফিরব না। সন্তুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব।
বজ্র লামা এবার অন্য একটা গলিপথ দিয়ে সবাইকে নিয়ে এলেন মঠের পেছন দিকে। সেখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তারপর টালির চাল দেওয়া একটা লম্বাটে ঘর। সেই ঘরের সামনে একটা টানা বারান্দা।
সেই বারান্দায় হাঁটু গেড়ে বসে আছে নানা বয়েসী আটটি ছেলে। প্রত্যেকের পরনে ঢোলা আলখাল্লা। যেন সেখানে একটা পাঠশালা বসেছে। ছাত্রদের সামনে একটা মোটা কাঠের গুড়ির আসনে বসে আছেন বৃদ্ধ মহালামা।
কাকাবাবু পেছন দিক থেকেই সন্তুকে দেখে চিনতে পারলেন। তিনি ডাকলেন, সন্তু, এই সন্তু!
সন্তু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। অত ঘোরলাগা তার দৃষ্টি। কাকাবাবুকে দেখেও তার মুখে কোনও ভাব ফুটল না, সে কোনও উত্তরও দিল না। আবার মুখ ফিরিয়ে নিল।
ছাত্রদের সামনে কোনও বই নেই। বৃদ্ধ মহালামা কী যেন একটা কথা উচ্চারণ করলেন, সবাই মিলে তিনবার সেই কথাটা জোরে জোরে বলল।
কাকাবাবু একটু এগিয়ে গিয়ে বললেন, এই সন্তু, উঠে আয়! সন্তু এবারে আর মুখ ফেরাল না।
ক্যাপটেন নরবু ফিসফিস করে বললেন, আশ্চর্য! আশ্চর্য!
কাকাবাবু বেশ রাগী চোখে একবার তাকালেন ক্যাপটেন নরবুর দিকে। তারপর সন্তুর খুব কাছে গিয়ে বললেন, এই সন্তু, ওঠ। আমরা এবার ফিরে যাব।
সন্তু মুখ ফিরিয়ে বিরক্তভাবে বলল, কে? আপনি কে? আপনাকে আমি চিনি না! আমি কোথাও যাব না। আমি এখানেই থাকব। এখানেই থাকব!
কাকাবাবু সন্তুর জামাটা ধরে জোর করে টেনে তুলে বললেন, এসব কী ন্যাকামি হচ্ছে? চল, আমাদের যেতে হবে।
সন্তু বলল, আমি যাব না, আমি যাব না, আমি যাব না!
কাকাবাবু বললেন, তোর কলেজ খুলে যাবে, সে খেয়াল নেই। তোকে রেখে আমি একা-একা ফিরব নাকি?
সন্তু বলল, কে আপনি? কে আপনি? কে? কে?
কাকাবাবু বললেন, তাকা, আমার চোখের দিকে ভাল করে তাকা, দ্যাখ চিনতে পারিস কি না।
সন্তু তবু মুখ ফিরিয়ে নিতেই কাকাবাবু ঠাস করে এক চড় কষালেন তার গালে। বেশ জোরে। সন্তু এবার পাগলাটে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, এটা কে? এটা কে? আমায় মারছে কেন? আমায় মারছে কেন? আমায় মারছে কেন? আমি যাব না, যাব না, যাব না?
দুজন বলশালী লোক দুদিক থেকে কাকাবাবুকে চেপে ধরে হিচড়ে সরিয়ে আনল সেখান থেকে।
কাকাবাবু জোর করে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও পারলেন না। তিনি রাগের চোটে চিৎকার করে বললেন, ছাড়ো, আমায় ছাড়ো, ওকে আমি নিয়ে যাব। নিয়ে যেতেই হবে।
বজ্র লামা কাকাবাবুর সামনে এসে তাঁর থাবার মতন বিশাল এক হাত দিয়ে কাকাবাবুর পুতনিটা চেপে ধরলেন, তারপর বললেন, ছিঃ এখানে চেঁচাতে। নেই। এখানে কেউ কারুকে মারে না। ওই ছেলেটি যাবে না। আপনারা ফিরে যান।
কাকাবাবু গর্জন করে বললেন, না, আমি সন্তুকে না নিয়ে যাব না!
যে-লোক দুটি কাকাবাবুকে ধরে আছে তাদের আদেশ দিলেন বজ্র লামা, তারা কাকাবাবুকে ঠেলতে লাগল ফাঁকা জায়গার দিকে। কাকাবাবু এবার বৃদ্ধ মহালামার দিকে তাকালেন। তিনি আগাগোড়া সবকিছু দেখছেন চোখ পিটপিট করে। কাকাবাবু তাঁর উদ্দেশে ব্যাকুলভাবে বললেন, মহালামা, আপনি বিচার করুন, আমাকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমার ভাইপোকে আটকে রাখবেন না। ছেড়ে দিন।
বৃদ্ধ মহালামা বললেন, ওয়েলকাম! ওয়েলকাম! কাকাবাবু হতাশভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বৃদ্ধ মহালামার কাছ থেকে সাহায্য পাবার কোনও আশা নেই। উনি ওই একটাই ইংরেজি শব্দ জানেন। বজ্র লামার কোনও কাজে বাধা দেবার ক্ষমতাও বোধ হয় ওঁর নেই। কাকাবাবুকে যে লোক দুটো ঠেলছে, তাদের গায়ে দৈত্যের মতন শক্তি।
কাকাবাবু আর-একবার মুখ ফিরিয়ে প্রায় আর্ত চিৎকার করে বললেন, সন্তু, সন্তু, তুই আমার সঙ্গে আসবি না?
সন্তু এদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, না, না, না, না, যাব না, যাব না, যাব না, যাব না।
কাকাবাবু চোখ বুজে ফেললেন। বোধ হয় তাঁর চোখে জল এসে যাচ্ছিল, তিনি অতি কষ্টে সামলালেন।
সন্তুকে নিয়ে তিনি কতবার কত জায়গায় গিয়েছেন। কেউ কাকাবাবুকে জোর করে ধরে রেখেছে, অথচ সন্তু সাহায্য করতে ছুটে আসছে না, এরকম আর আগে কখনও ঘটেনি।
লোক দুটি কাকাবাবুকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল দেওয়ালের ধারে। সেখানে একটা ছোট দরজা রয়েছে। সেই দরজা দিয়ে কাকাবাবুকে নিয়ে আসা হল বাইরে। কাকাবাবুর হাত থেকে ক্রাচ দুটো আগেই খসে গেছে। লোক দুটো এবার প্রায় চ্যাংদোলা করে কাকাবাবুকে তুলে এনে বসিয়ে দিল একটা টাটুঘোড়র ওপরে।
কাকাবাবু কোটের পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছলেন। রুমাল বার করতে গিয়ে কোটের ভেতরের পকেটে তাঁর রিভলভারটায় হাত ঠেকে গেল। কাকাবাবু সেই পকেটে হাত ঢুকিয়েও থেমে গেলেন। নাঃ, এখানে রিভলভার দেখিয়েও কোনও লাভ হত না। সন্তু নিজেই যে আসতে চাইছে না!
একটু পরেই ক্যাপটেন নরবু কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো হাতে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে এল এদিকে। কাছাকাছি আরও কয়েকটা টাটুঘোড়া বাঁধা রয়েছে। ক্যাপটেন নরবু আর একটা ঘোড়ার পিঠে চেপে বললেন, চলল, যাওয়া যাক!
দুজনের ঘোড়া চলতে লাগল ধীর কদমে।
ক্যাপটেন নরবু বললেন, কী হল বলো তো? সন্তু তঅমাকে চিনতেই পারল না?
কাকাবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, কাওয়ার্ড! দুটো লোক যখন আমায় চেপে ধরল, তখন তুমি আমায় একটু সাহায্য করতে পারলে না?
ক্যাপটেন নরবু দারুণ অবাক হয়ে বললেন, সাহায্য…মানে কী সাহায্য করব? ওরা তো তোমাকে মারেনি? মারলে নিশ্চয়ই আমি প্রতিবাদ করতাম। তুমি হঠাৎ সন্তুকে চড় মারতে গেলে কেন? রাগের মাথায় ওই কাজটা তুমি ঠিক করোনি?
কাকাবাবু বললেন, বেশ করেছি। বেশ করেছি। আমার ভাইপো-কে আমি দরকার হলে একটা চড় মারতে পারব না? সন্তুকে আরও দু-তিনটে চড় মারতে পারলে ঠিক কাজ হত!
ক্যাপটেন নরবু বললেন, যাঃ, কী বলছ, রাজা! ধর্মস্থানের মধ্যে এরকমভাবে কারুকে মারা ঠিক নয়।
কাকাবাবু বললেন, কাল রাতে বজ্র লামা একজন প্রহরীকে লাথি মারেনি? আমাদের সামনেই?
ক্যাপটেন নরবু বললেন, ওঃ, সে লোকটা ঘুমোচ্ছিল। তার কাজে গাফিলতির জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সেটা অন্য ব্যাপার।
কাকাবাবু বললেন, ওরা সন্তুকে এখানে আটকে রেখে দেবে? সন্তুকে না নিয়ে আমি ফিরে যাব?
ক্যাপটেন নরবু বললেন, সন্তু নিজেই যে আসতে চাইছে না। বজ্র লামা অন্যায় কিছু বলেননি। সন্তু নিজে ওখানে থেকে যেতে চাইলে তাকে ওরা জোর করে তাড়িয়ে দেবে কী করে?
সন্তু আসতে চাইছে না, তা ঠিক নয়। সন্তুকে ওরা জোর করেই ধরে রেখেছে।
সন্তু নিজের মুখে কতবার বলল, সে আসবে না! তুমি-আমি নিজের কানে শুনলাম।
সন্তু নিজের মুখে বলেছে, তুমি আর আমি নিজের কানে শুনেছি, তবুও ওটা সত্যি নয়। ওটা সন্তুর মনের কথা হতে পারে না। ওরা সন্তুকে সম্মোহন করেছে! ওর চোখ দুটো অন্য রকম দেখোনি?
অ্যাঁ? কী করেছে বললে?
সম্মোহন। হিপনোটাইজ করেছে। কাল থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওই বজ্র লামা সম্মোহন করে সন্তুর মনটাকে বশ করছে। সন্তু বারবার নো ফিভার, নো পেইন বলছিল, সন্তু কক্ষনো ওইভাবে কথা বলে না। সন্তুর ওই
ঘোর কাটাবার জন্যই ওকে আমি চড় মেরেছিলাম।
শোনো রাজা, সম্মোহন হোক আর যাই হোক, সন্তু এখন আর আসতে চাইছে না, এটা তো ঠিক? দুটো-তিনটে দিন এখানে ছেলেটা থাকুক না। দু-তিন দিনের বেশি ওর ভাল লাগবে না, তারপর ও নিজেই চলে আসবে। এই কদিন তুমি আমার বাড়িতে থেকে যাও। আমরা রোজ সন্তুর খোঁজ নেব?
না, সন্তুকে আমি এখানে একদিনও রাখতে চাই না!
শোনো রাজা, পাগলামি কোরো না। এখন ফিরে গিয়ে কোনও লাভ নেই। বজ্র লামার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমরা সন্তুকে কিছুতেই জোর করে ফিরিয়ে আনতে পারব না। আমরা দুজনে গায়ের জোর দেখালেও সুবিধে হবে না।
কাকাবাবু ঘোড়াটা থামিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন। তাঁর মুখখানা রাগে লালচে হয়ে গেছে। চোখ দুটো জ্বলছে।
তিনি বললেন, আমি আজই পুলিশ ডেকে এনে সন্তুকে উদ্ধার করব। এর মধ্যে যদি সন্তুর কোনও ক্ষতি হয়, ওই বজ্র লামাকে আমি শেষ করে দেব। এদের এই সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব।
তারপর তিনি ক্যাপটেন নরবুকে জিজ্ঞেস করলেন, কাছাকাছি থানা কোথায় আছে?
এখানে একটু বড় থানা আছে বিজনবাড়িতে।
চলো সেখানে!
একটু দূরেই ডিংলা ঝরনা। আজ তাতে জল খানিকটা বেশি। তবু পার হওয়া গেল কোনওক্রমে।
এপারে এসেই কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বিজনবাড়ি কোন দিকে?
ক্যাপটেন নরবু বললেন, খানিকটা দূর আছে। চলো, আগে আমরা এই ঘোড়া নিয়েই আমার জিপটার কাছে যাই। জিপে করে বিজনবাড়ি যেতে সুবিধে হবে।
কাকাবাবু দু-এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, জিপটাই নেওয়া যাক।
তাঁর যেন আর একটুও দেরি সহ্য হচ্ছে না। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা, দিনের আলোয় চেনার কোনও অসুবিধে নেই। কাকাবাবু খুব জোর ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন!