প্রাণহরি পোদ্দারের মৃত্যুরহস্য
অতঃপর তিনদিন আমরা প্রায় নিষ্কর্মার মত কাটাইয়া দিলাম, প্রাণহরি পোদ্দারের মৃত্যুরহস্য ত্ৰিশঙ্কুর মত শূন্যে বুলিয়া রহিল। নূতন তথ্য আর কিছু পাওয়া যায় নাই, পূর্বে সামান্য যেটুকু পাওয়া গিয়াছিল তাঁহাই সম্বল। কটক হইতে ইন্সপেক্টর বরাটের বন্ধু পট্টনায়ক প্রাণহারির অতীত সম্বন্ধে যে পত্র দিয়াছিলেন তাহার দ্বারাও খুনের উপর আলোকপাত হয় নাই। প্রাণহরি পোদ্দার পেশাদার জুয়াড়ী ছিল, কিন্তু কোনও দিন পুলিসের হাতে পড়ে নাই। সে বছর-দুই কটকে ছিল, কোথা হইতে কটকে আসিয়াছিল তাহা জানা যায় না। তাহার পোষ্য কেহ ছিল না, কাজকর্মও ছিল না। নিজের বাড়িতে কয়েকজন বড়মানুষের অবচীিন পুত্রকে লইয়া জুয়ার আডডা বসাইত। ক্রমে অবচীিনেরা বুঝিল প্ৰাণহোর জুয়াচুরি করিয়া তাঁহাদের রুধির শোষণ করিতেছে, তখন তাহারা প্রাণহারিকে উত্তম-মধ্যম দিবার পরামর্শ করিল। কিন্তু পরামর্শ কর্যে পরিণত করিবার পূর্বেই একদিন প্রাণহরি পোদ্দার নিরুদ্দেশ্য হইল। তাহার বাড়িতে একটি যুবতী দাসী কাজ করিত, সেও লোপাট হইল। অনুমান হয় বৃদ্ধ প্রাণহারির সহিত দাসীটার অবৈধ ঘনিষ্ঠতা ছিল।
পট্টনায়কের চিঠি হইতে শুধু এইটুকুই পরিস্ফুট হয় যে প্রশক্তি কর্মজীবনে একটা বিশিষ্ট প্যাটার্ণ ছিল।
বোমকেশের চিত্তে সুখ নাই। ইন্দিরার চোখে অবার উদ্বেগ ও আশঙ্কা ঘনীভূত হইতেছে। ফণীশ ছট্ফট করিতেছে। মণীশবাবু গভীর প্রকৃতির লোক, কিন্তু তিনিও যেন একটু অধীর হইয়া উঠিতেছেন। কয়লাখনির অনামা দুৰ্বত্তেরা এখনও ধরা পড়ে নাই।
এই তিন দিনের মধ্যে কেবল একটিমাত্র বিশিষ্ট ঘটনা ঘটিয়াছে যাহার উল্লেখ করা যায়। বিকাশ দত্ত আসিয়াছে এবং কয়লাখনির হাসপাতালে যোগ দিয়াছে। আমরা একদিন বিকাশের সঙ্গে দেখা করিয়াছে এবং উপদেশ দিয়া আসিয়াছে।
এই তিন দিনের মধ্যে কেবল একটিমাত্র বিশিষ্ট ঘটনা ঘটিয়াছে যাহার উল্লেখ করা যায়। ব্যোমকেশ ক্রমান্বয়ে বিছানায় শুইয়া, ঘরে পায়চারি করিয়া অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। তাই কাল সন্ধ্যার পর আমাকে বলিল, ‘চল, রাস্তায় একটু বেড়ানো যাক।’
রাস্তাটা নির্জন, আলো খুব উজ্জ্বল নয়, বাতাস বেশ ঠাণ্ডা। মাঝে মাঝে দু’ একজন পদচারী, দুই একটি মোটর যাতায়াত করিতেছে। ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল, ‘প্রাণহরি পোদ্দারের মত একটা থার্ড ক্লাস লোকের হত্যারহস্য তদন্ত করার কী দরকার? যে মেরেছে বেশ করেছে, তাকে সোনার মেডেল দেওয়া উচিত।’
বলিলাম, ‘সোনার মেডেল দিতে হলেও তো লোকটাকে চেনা দরকার।’
আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, মোহিনীর কাছে আর একবার যেতে হবে। তাকে একটা কথা জিগ্যেস করা হয়নি।’
এই সময় বাইসাইকেল প্রথম লক্ষ্য করিলাম। আমরা রাস্তার একটু পাশ ঘেষিয়া পায়চারি করিতেছিলাম, দেখিলাম সামনের দিকে আন্দাজ পঞ্চাশ গজ দূরে একটা সাইকেল আসিতেছে। সাইকেলে আলো নাই, রাস্তার আলোতে আরোহীকে অস্পষ্টভাবে দেখা যায়; তাহার মাথায় সোলার টুপি মুখখানাকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। দেখিতে দেখিতে সাইকেল আমাদের কাছে আসিয়া পড়িল, তারপর আরোহী আমাদের পায়ের কাছে একটা সাদাগোছের বস্তু ফেলিয়া দিয়া দ্রুত পেডাল ঘুরাইয়া অদৃশ্য হইল।
ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেগে আমাকে হাত ধরিয়া টানিয়া লইল। দশ হাত দূরে গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি শ্বেতাভ বস্তুটার দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু কিছু ঘটিল না, টেনিস বলের মত বস্তুটা জড়বৎ পড়িয়া রহিল। উহা যে বোমা হইতে পারে একথা আমার মাথায় আসে নাই; তখন ব্যোমকেশের ভাবভঙ্গী দেখিয়া আমার বুক ঢ়িবটিব করিতে লাগিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, চাটু করে বাড়ি থেকে একটা টর্চ নিয়ে এস তো।’
সে দাঁড়াইয়া রহিল, আমি পিছু হটিয়া বাড়িতে গেলাম। ফণীশ ও মণীশবাবু দু’জনেই খবর শুনিয়া আমার সঙ্গে আসিলেন।
‘কি ব্যাপার?’ ব্যো
মকেশ বলিল, ‘কাছে আসবেন না। হয়তো কিছুই নয়, তবু সাবধান হওয়া ভাল। অজিত, টর্চ আমাকে দাও।’
টর্চ লইয়া সে ভূ-পতিত বস্তুটার উপর আলো ফেলিল। আমি গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, কাগজের একটা মোড়ক ধীরে ধীরে খুলিয়া যাইতেছে। ব্যোমকেশ কাছে গিয়া আরও কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করিয়া বস্তুটা তুলিয়া লইল। হাসিয়া বলিল, ‘কাগজে মোড়া এক টুকরো পাথুরে কয়লা।’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘কয়লা–!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কয়লা মুখ্য নয়, কাগজটাই আসল। চলুন, বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক।’
ড্রয়িং-রুমে উজ্জ্বল আলোর নীচে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ সস্তপণে মোড়ক খুলিল। পাথুরে কয়লার টুকরো টেবিলে রাখিয়া কুঞ্চিত কাগজটির দুই পোশ ধরিয়া আলোর দিকে তুলিয়া ধরিল। কাগজটা আকারে সাধারণ চিঠির কাগজের মত, তাহাতে কালি দিয়া বড় বড় অক্ষরে দু’ছত্র লেখা—‘ব্যোমকেশ বক্সী, যদি অবিলম্বে শহর ছাড়িয়া না যাও তোমাকে আর ফিরিয়া যাইতে হইবে না।’
‘কী ভয়ানক, আপনার নাম জানতে পেরেছে।’ মণীশবাবু হাত বাড়াইয়া বলিলেন, ‘দেখি কাগজখানা।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না, আপনার ছুঁয়ে কাজ নেই। কাগজে হয়তো আঙুলের ছাপ আছে।’
কাগজখানি সাবধানে ধরিয়া ব্যোমকেশ শয়নকক্ষে আসিল। আমিও সঙ্গে আসিলাম। টেবিলের উপর একটি সচিত্র বিলাতি মাসিকপত্র ছিল, তাহার পাতা খুলিয়া সে কাগজখানি সযত্নে তাহার মধ্যে রাখিয়া দিল। আমি বলিলাম, ‘কোন পক্ষের চিঠি। অবশ্য কয়লা দেখে মনে হয়। কয়লাখনির আসামীরা জানতে পেরেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা ধাপ্পা হতে পারে। গোবিন্দ হালদার জানেন আমি কয়লাখনি সম্পর্কে এখানে এসেছি।’
ড্রয়িং-রুমে ফিরিয়া গিয়া দেখিলাম অফিসের বড়বাবু সুরপতি ঘটক আসিয়াছেন, কর্তার সঙ্গে বোধকরি অফিসঘটিত কোনও পরামর্শ করিতেছেন। আমাদের দেখিয়া সবিনয়ে নমস্কার করিলেন।
তিনি বাক্যালাপ করিয়া প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ মণীশবাবুকে বলিল, ‘আপনি সুরপতিবাবুকে কিছু বলেননি তো?’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘না।–পাঁজি ব্যাটারা কিন্তু ভয় পেয়েছে।’
ব্যেমাকেশ বলিল, ‘ভয় না পেলে আমাকে ভয় দেখাতো না।’
মণীশবাবু খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আপনি তলে তলে কি করছেন আমি জানি না। কিন্তু নিশ্চয় কিছু করছেন, যাতে পাজি ব্যাটারা ঘাবড়ে গেছে। —যাহোক, চিঠি পেয়ে আপনি ভয় পাননি তো?’
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল, ‘ভয় বেশি পাইনি। তবু আজ রাত্তিরে দোর বন্ধ করে শোব।’
সকালবেল ফণীশ আমাদের থানায় নামাইয়া দিয়া বলিল, ‘আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে, ইন্দিরার একটা জিনিস চাই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরব। অসুবিধা হবে না তো?
‘না। আমরা এখানে ঘণ্টাখানেক আছি।’
ফণীশ মোটর লইয়া চলিয়া গেল, আমরা থানায় প্রবেশ করিলাম।
প্রমোদবাবু টেবিলের সামনে বসিয়া কাগজপত্র লইয়া ব্যস্ত ছিলেন, ব্যোমকেশ সচিত্র বিলাতি মাসিকপত্রটি তাঁহার সম্মুখে রাখিয়া বলিল, ‘এর মধ্যে এক টুকরো কাগজ আছে, তাতে আঙুলের ছাপ থাকতে পারে। আপনার finger-print expert আছে?
পত্রিকার পাতা তুলিয়া দেখিয়া বরাট বলিলেন, ‘আছে বৈকি। কি ব্যাপার?’
ব্যোমকেশ গত রাত্রির ঘটনা বলিল। শুনিয়া বরাট বলিলেন, ‘কিয়লাখনির ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। এখনি ব্যবস্থা করছি। আজ বিকেলবেলাই রিপোর্ট পাবেন।’
তিনি লোক ডাকিয়া পত্রিকাসমেত কাগজখানা করাঙ্ক বিশেষজ্ঞগণের কাছে পঠাইয়া দিলেন, তারপর বলিলেন, ‘তিনদিন আপনি আসেননি, ওদিকের খবর কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যথা পূর্বং তথা পরং, নতুন কোনো খবর নেই। কিন্তু একটা খট্কা লাগছে?’
‘কিসের খট্কা?’
‘মোহিনীকে প্রাণহরি পনেরো টাকা মাইন দিত। হিসেবের খাতা কিন্তু মোহিনীর মাইনের উল্লেখ নেই।’
বরাট চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘হুঁ। প্রাণহারির হিসেবের খাতায় দেখছি বিস্তর গলদ। এখন কি করবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোহিনীকে প্রশ্ন করে দেখতাম। সে এখনো আছে তো?’
বরাট বলিলেন, ‘দিব্যি আছে, নড়বার নামটি নেই। আমিও ছাড়তে পারছি না, যতক্ষণ না এ মামলার একটা হেস্তনেস্ত হয়–’
‘তাহলে আমরা একবার ঘুরে আসি।’
চলুন।’
না না, আপনার অন্য কাজ রয়েছে, আপনি থাকুন। আমি আর অজিত যাচ্ছি। আপনার সেই তরুণ কনস্টেবলটিকে সেখানে পাব তো?’
বরাট হাসিলেন, ‘আলবৎ পাবেন।’
থানা হইতে বাহির হইলাম। ফণীশের এখনও ফিরিবার সময় হয় নাই, আমরা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডের দিকে চলিলাম।
থানার অনতিদূরে রাস্তার ধারে একটি বিপুল পাকুড় গাছের ছায়ায় ট্যাক্সি দাঁড়াইবার স্থান। সেইদিকে যাইতে যাইতে আমি বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, প্ৰাণহারির সঙ্গে কয়লাখনির ব্যাপারের কি কোনো সম্বন্ধ আছে?
সে বলিল, ‘কিছু না। একমাত্র আমি হচ্ছি যোগসূত্র।’
ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডের কাছাকাছি গিয়া দেখিলাম। গাছতলায় মাত্র একটি ট্যাক্সি আছে এবং রাস্তার ধার ঘোষিয়া একটা প্রকাণ্ড কালো–রঙের মোটর আমাদের দিকে পিছন করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। ট্যাক্সি-ড্রাইভার ভুবন দাস কালো মোটরের জানালার কাছে দাঁড়াইয়া চালকের সহিত কথা বলিতেছে। আমরা আর একটু নিকটবর্তী হইতেই কালো মোটরটা চলিয়া গেল। ভুবন দাস নিজের ট্যাক্সির কাছে ফিরিয়া চলিল।
ব্যোমকেশ গভীর ভ্রূকুটি করিয়া বলিল, ‘কার মোটর চিনতে পারলে? গোবিন্দ হালদারের মোটর। প্রথমদিন নম্বরটা দেখেছিলাম।’
‘গোবিন্দ হালদার ট্যাক্সিওয়ালার কাছে কী চায়?’
‘বোধ হয় সাক্ষী ভাঙাতে চায়। এস দেখি।’
আমরা যখন ট্যাক্সির কাছে পৌঁছিলাম তখন ভুবন গাড়ির বুট্ হইতে জ্যাক বাহির করিয়া চাকার নীচে বসাইবার উদ্যোগ করিতেছে। আমাদের দেখিয়া স্যালুট করিল, বলিল, ট্যাক্সি চাই স্যার?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, একবার প্রাণহারিবাবুর বাড়িতে যেতে হবে। সেখানে একজন মেয়েলোক থাকে তার সঙ্গে দরকার আছে।’
ভুবন আড়চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিল, মাথা চুলকাইয়া বলিল, ‘আমার তো একটু দেরি হবে স্যার। টায়ার পাঞ্চার হয়েছে, চাকাটা বদলাতে হবে।’
ব্যোমকেশ অতর্কিতে প্রশ্ন করিল, ‘গোবিন্দ হালদার তোমার সঙ্গে কী কথা বলছিলেন?’
ভুবন চমকিয়া উঠিল, ‘আজ্ঞে?—উনি—উনি আমাকে চেনেন, তাই দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলছিলেন। ভারি ভাল লোক।’ বলিয়া জ্যাকের যন্ত্র প্রবলবেগে ঘুরাইয়া গাড়ির চাকা শূন্যে তুলিতে লাগিল।
ব্যোমকেশের মুখের দিকে চোখ তুলিয়া দেখি সে তন্দ্রাহতের মত দাঁড়াইয়া আছে, তাহার চক্ষু, ভুবনের উপর নিবদ্ধ কিন্তু সে মনশ্চক্ষে অন্য কিছু দেখিতেছে। আমি ডাকিলাম, ‘ব্যোমকেশ।’
সে আমার দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বিড়বিড় করিয়া বলিল, ‘অজিত, পনরোর সঙ্গে পয়ত্রিশ যোগ দিলে কত হয়।
বলিলাম, ‘পঞ্চাশ। কী আবোল-তাবোল বকছ?’
সে বলিল, ‘এস।’ বলিয়া থানার দিকে ফিরিয়া চলিল। কিছুদূর গিয়া আমি ফিরিয়া চাহিলাম, ভুবন একাগ্র দৃষ্টিতে আমাদের পানে তাকাইয়া আছে।
থানায় উপস্থিত হইলে বরাট মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘এ কি, গেলেন না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রমোদবাবু্, আপনার থানায় কোনও নিরিবিলি জায়গা আছে? আমি নির্জনে বসে একটু ভাবতে চাই।’
সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। বরাট তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বলিলেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
থানার পিছন দিকে একটি ঢাকা বারান্দা, লোকজন নেই, কয়েকটা চেয়ার পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশ একটি ইজি-চেয়ারে লম্বা হইয়া সিগারেট ধরাইল। বরাট মৃদু হাসিয়া প্রস্থান করিলেন।
আধা ঘণ্টার মধ্যে গোটা পাঁচেক সিগারেট নিঃশেষ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, হয়েছে।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, কী হয়েছে?’
সে বলিল, ‘দিব্যচক্ষু উম্মীলিত হয়েছে, সত্যদর্শন হয়েছে। এস।’
বরাটের ঘরে গিয়া তাঁহার টেবিলের পাশে দাঁড়াইতেই তিনি উৎসুক মুখ তুলিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রমোদবাবু্, কোন ব্যাঙ্কে প্রাণহরির টাকা আছে?’
বরাট বলিলেন, ‘সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে। কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সেখানে সেফ-ডিপজিট ভল্ট আছে কিনা জানেন?ট
‘আছে বোধ হয়।’
হাতের ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতক্ষণ ব্যাঙ্ক খুলেছে। —চলুন।’
বরাট আর প্রশ্ন না করিয়া উঠিয়া পড়িলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম ফণীশ ফিরিয়াছে এবং গাড়ি হইতে নামিবার উপক্রম করিতেছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘নেমো না, আমাদের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে পৌঁছে দিতে হবে।’
শহরের মাঝখানে ব্যাঙ্কের বাড়ি, দ্বারে বন্দুকধারী শান্ত্রীর পাহারা। গাড়ি হইতে নামিবার পূর্বে ব্যোমকেশ ফণীশকে বলিল, ‘ফণীশ, তুমি বাড়ি যাও, আমাদের ফিরতে একটু দেরি হবে।–ভালো কথা, বৌমার বাপের বাড়ি কোথায়?’
ফণীশ সবিস্ময়ে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল, ‘নবদ্বীপে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। তাহলে নিশ্চয় মালপো তৈরি করতে জানেন। তাঁকে বলে দিও আজ বিকেলে আমরা মালপো খাব।’
আমরা নামিয়া গেলাম, ফণীশ একটু নিরাশভাবে গাড়ি লইয়া চলিয়া গেল। সে বুঝিয়াছিল, প্রাণহোরর মৃত্যুরহস্য সমাধানের উপান্তে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।
বিরাট আমাদের ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের ঘরে লইয়া গেলেন; ম্যানেজারের সঙ্গে তাঁহার আগে হইতেই আলাপ ছিল। বলিলেন, ‘প্ৰাণহরি পোদ্দারের ব্যাপারে এসেছি। আপনার ব্যাঙ্কে সেফ-ডিপজিট ভল্ট আছে?
ম্যানেজার বলিলেন, ‘আছে।’
বরাট ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্ৰাণহরি পোদ্দার ভল্ট ভাড়া নিয়েছিলেন নাকি?’
ম্যানেজার একজন কর্মচারীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সে বলিল, ‘হ্যাঁ, নিয়েছিলেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তার সেফ-ডিপজিট কী আছে আমরা দেখতে চাই।’
ম্যানেজার কুণ্ঠিত হইয়া বলিলেন, ‘কিন্তু ব্যাঙ্কের নিয়ম নেই। অবশ্য যদি পরোয়ানা থাকে—’
বরাট বলিলেন, ‘প্রাণহরি পোদ্দারকে খুন করা হয়েছে। তার সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ, কাগজপত্র অনুসন্ধান করবার পরোয়ানা পুলিসের আছে।’
ম্যানেজার ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘বেশ। চাবি এনেছেন?’
‘চাবি?’
‘সেফ-ডিপজিটের প্রত্যেকটি বাক্সের দুটো চাবি; একটা থাকে যিনি ভাড়া নিয়েছেন তাঁর কাছে, অন্যটা থাকে ব্যাঙ্কের জিন্মায়। দুটো চাবি না পেলে বাক্স খোলা যায় না।’
ব্যোমকেশ বরাটের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করিল। বিরাট বলিলেন, ‘ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় আছে?’
ম্যানেজার বলিলেন, ‘আছে। কিন্তু ব্যাঙ্কের ডিরেকটারদের হুকুম না পেলে আপনাদের দিতে পারি না। হুকুম পেতে চার-পাঁচ দিন সময় লাগবে।’
ব্যোমকেশ বরাটকে বলিল, ‘চলুন, আর একবার প্রাণহোরর সিন্দুক খুঁজে দেখা যাক। নিশ্চয় ওই ঘরেই কোথাও আছে।’
বরাট উঠিলেন, ম্যানেজারকে বলিলেন, ‘আমরা আবার আসছি। যদি চাবি খুঁজে না পাই, দরখাস্ত করব।’
আমরা থানায় ফিরিয়া গেলাম, সেখান হইতে আরও দুইজন লোক লইয়া পুলিস-কারে প্ৰাণহারির বাড়িতে উপনীত হইলাম।
আজ তরুণ কনস্টেবলটি বাড়ির সামনে টুল পাতিয়া বসিয়া ছিল, আমাদের দেখিয়া সাড়ম্বরে স্যালুট করিল।
দ্বারের সামনে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ বরাটকে বলিল, ‘আমি মোহিনীকে দু-একটা প্রশ্ন করি, ততক্ষণ আপনারা ওপরের ঘর তল্লাশ করুন গিয়ে। আমার বিশ্বাস চাবি খুঁজে বার করা শক্ত হবে না। হয়তো সিন্দুকেই আছে, আপনারা লুকোনো জিনিস খোঁজেননি, তাই পাননি। তখন তো আপনারা জানতেন না যে প্ৰাণহারির সেফ-ডিপজিট আছে।’
পুলিসের দল সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেল। ব্যোমকেশ ও আমি রান্নাঘরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলাম।
মোহিনী দ্বারের দিকে পিছন ফিরিয়া রান্না করিতেছিল, আমাদের পদশব্দে ঘাড় ফিরাইয়া চাহিল। আমাদের দেখিয়া চকিত ত্ৰাসে তাহার চক্ষু একবার বিস্ফারিত হইল, তারপর সে উনান হইতে কড়া নামাইয়া আচলে হাত মুছিতে মুছিতে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
‘কিছু দরকার আছে বাবু? তাহার ক্ষণিক ত্ৰাস কাটিয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুমি এখনো আছ দেখছি। দেশে ফিরে যাচ্ছ না কেন?’
মোহিনী বলিল, ‘কি করব বাবু্, পুলিস ছেড়ে না দিলে যাই কি করে?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তোমার বাপ-মাকে কিংবা স্বামীকে খবর দিয়েছ?’
মোহিনী ক্ষণকাল চক্ষু নত করিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘স্বামী কোথায় জানি না। বাপ-মাকে খবর দিইনি। তারা বুড়ো মানুষ, কি হবে তাদের খবর দিয়ে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা বটে। আচ্ছা, একটা কথা বল দেখি, যে-রাত্রে প্রাণহারিবাবু খুন হয়েছিলেন, সে-রাত্রে তিনি যখন খেতে নামলেন না, তখন তুমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলে?’
মোহিনী সায় দিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ বাবু।’
‘ঘরে আলো জ্বলছিল?’
‘হ্যাঁ বাবু।’
‘ঘরের পিছন দিকের দরজা, অর্থাৎ স্নানের ঘরের দরজা খোলা দেখেছিলে?’
‘না বাবু।’ মোহিনীর চোখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল।
‘দরজা বন্ধ ছিল?’
পলকের জন্য মোহিনী দ্বিধা করিল, তারপর বলিল, ‘আমি কিছুই দেখিনি বাবু। কর্তাবাবু মরে পড়ে আছেন দেখে ছুটে পালিয়ে এসেছিলুম।’
‘তুমি স্নানের ঘরের দরজা বন্ধ করে দাওনি?’
‘আজ্ঞে না।’
‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ একটু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিল, ‘প্রাণহারবাবু তোমাকে পনেরো টাকা মাইনে দিতেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘প্রতি মাসে ঠিক সময়ে মাইনে দিতেন?’
মানুষ যখন মনে মনে এক কথা ভাবে এবং মুখে অন্য কথা বলে তখন তাহার মুখ দেখিয়া বোঝা যায়, তেমনি অন্যমনস্কভাবে মোহিনী বলিল, ‘আমার মাইনে কর্তাবাবুর কাছে জমা থাকত, দরকার হলে দুএক টাকা চেয়ে নিতুম।’
ব্যোমকেশের পানে কটাক্ষপাত করিয়া দেখিলাম সে মৃদু হাসিতেছে। সে বলিল, ‘তোমার মাইনের টাকা বোধহয় মারা গেল। আচ্ছা, এবার আমার শেষ প্রশ্ন : তুমি কোনো ন্যাটা লোককে চোন?’
মোহিনী অবাক হইয়া বলিল, ‘ন্যাটা লোক! সে কাকে বলে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ন্যাটা জান না? যে ডান হাতের চেয়ে বাঁ হাত বেশি চালায় তাকে ন্যাটা বলে।’
মোহিনী সহসা বুকের উপর হাত রাখিয়া বলিল, ‘না। বাবু্, সে রকম কাউকে আমি চিনি না।’
মোহিনী দাঁড়াইয়া রহিল, আমরা উপরে প্রাণহারির শয়নকক্ষে উঠিয়া গেলাম।
চাবি পাওয়া গিয়াছে। বেশি খোঁজাখুঁজি করিতে হয় নাই; সিন্দুক ও দেয়ালের মাঝখানে যে স্বল্প-পরিসর স্থান ছিল সেই স্থানে সিন্দুকের পিঠে চাবিটা মোম দিয়া আটকানো ছিল। বরাট বলিল, ‘এই নিন।’
নম্বর খোদাই করা লম্বা একটি চাবি। ব্যোমকেশ তাহা পরিদর্শন করিয়া বলিল, ‘চলুন আবার ব্যাংকে।’
ব্যাঙ্কে গিয়া ম্যানেজারের নিকট চাবি পেশ করা হইল। তিনি এবার আর দ্বিরুক্তি করিলেন না, স্বয়ং উঠিয়া আমাদের ভল্টে লইয়া গেলেন। ব্যাঙ্কের বাড়ির নীচে মাটির তলায় ঘর, তাহার তিনটি দেয়াল জুড়িয়া কাতারে কাতারে দ্বারযুক্ত স্টীলের খোপ শোভা পাইতেছে।
দুইটি চাবি মিলাইয়া প্রাণহারির খোপের কবাট খোলা হইল। খোপের মধ্যে টাকাকড়ি, গয়নাগটি কিছু নাই, কেবল কয়েকটি পুরাতন চিঠি এবং এক বাণ্ডিল বন্ধকী তমসুক।
চিঠিগুলি প্রাণহরিকে লেখা নয়, প্রাণহারির দ্বারাও লিখিত নয়। অজ্ঞাতনামা পুরুষ বা নারীর দ্বারা অজ্ঞাতনামা লোকের নামে লেখা। সম্ভবত এই পত্রগুলিকে অস্ত্র করিয়া প্ৰাণহরি লেখক ও লেখিকাদের রুধির শোষণ করিতেন।
চিঠিগুলিতে ব্যোমকেশের প্রয়োজন ছিল না, সে তমসুকগুলি লইয়া উপরে উঠিয়া আসিল। ম্যানেজারের ঘরে বসিয়া সে একে একে তমসুকগুলিতে চোখ বুলাইল। তারপর একটি তমসুক তুলিয়া ধরিয়া বরাটকে বলিল, ‘এই নিন। আপনার আসামী।’
তমসুকে আইনসঙ্গত ভাষায় লেখা ছিল, মহাজন প্রাণহরি পোদ্দার ভগবানপুর নিবাসী ভুবনেশ্বর দাসকে ক্ৰেতব্য মাটরগাড়ি বন্ধক রাখিয়া আড়াই হাজার টাকা কর্জ দিয়াছেন। কীভাবে ভুবনেশ্বর দাস এই ঋণ শোধ করিবে তাহার শর্তও দলিলে লেখা আছে : পঞ্চাশ টাকা নগদ; প্রাণহরি মোটর ব্যবহার করিবেন তাহার মাসিক ভাড়া পাঁচশ টাকা; একুনে পঁচাত্তর টাকা হিসাবে মাসে শোধ হইবে।
বরাট ভ্রূ তুলিয়া বোমকেশের পানে চাহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার কাজ শেষ হয়েছে, এবার যা করবার আপনি করবেন।’
বরাট বলিলেন, ‘কিন্তু খুনের প্রমাণ?’
‘প্রমাণ আছে। তবে আদালতে দাঁড়াবে কিনা বলতে পারি না। এবার আমরা বাড়ি ফিরব, বেলা দেড়টা বেজে গেছে।’
‘চলুন, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।’
পুলিস-কারে যাইতে যাইতে বেশি কথা হইল না। একবার বিরাট বলিলেন, ‘ভুবনকে অ্যারেস্ট করি তাহলে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘করুন। সে যদি স্বীকার করে তাহলে সব ন্যাটা চুকে যাবে।’
বাড়ির ফটকের সামনে আমাদের নামাইয়া দিয়া গাড়ি চলিয়া গেল, বরাট বলিয়া গেলেন, ‘বিকেলবেলা আসব।’
অপরাহ্নে আন্দাজ পাঁচটার সময় আমরা ক্ষীরের মালপোয়া লইয়া বসিয়াছি এমন সময় প্রমোদ বরাট আসিলেন।
মণীশবাবু কয়লাখনিতে গিয়াছেন, ফণীশ বাড়িতে আছে। ইন্দিরা এতক্ষণ আমাদের কাছেই ছিল, এখন বিরাটকে দেখিয়া ভিতরে গিয়াছে। আসামী কে তাহা শুনিবার পর আমার মাথাটা হিজিবিজি হইয়া গিয়াছিল, এখন কতকটা ধাতে আসিয়াছে।
ইন্সপেক্টর বরাটের মুখখানা শুষ্ক, মন বিক্ষিপ্ত; সকালবেলা যে ইউনিফর্ম পরিয়া ছিলেন, এখনও তাঁহাই পরিয়া আছেন মনে হয়। তিনি আসিয়া হাস্যহীন মুখে পকেট হইতে একটি খাম বাহির করিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিলেন; বলিলেন, ‘এই নিন। আঙুলের ছাপের ফটো আর রিপোর্ট। তিনজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।’
ব্যোমকেশ খামটি না খুলিয়াই পকেটে রাখিল, বরাটের মুখের পানে চাহিয়া বলিল, ‘আজ দুপুরে আপনার খাওয়া হয়নি দেখছি।’
বরাট মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘খাওয়া হবে কেথেকে। আপনার আসামী পালিয়েছে।’ ব্যোমকেশ এমনভাবে ঘাড় নাড়িল যেন ইহার জন্য সে প্রস্তুত ছিল। তারপর বিরাটকে বসিতে বলিয়া সে ফণীশের পানে চাহিল। ফণীশ দ্রুত অন্দরের দিকে চলিয়া গেল। বিরাট হেলান দিয়া ক্লান্ত স্বরে বলিলেন, ‘শুধু আসামী নয়, মোহিনীও পালিয়েছে। দু’জনে ট্যাক্সিতে চড়ে হাওয়া হয়েছে। কনস্টেবলটা প্ৰাণহারির বাড়িতে পাহারায় ছিল, কিন্তু মোহিনীকে আটক করবার হুকুম তার ছিল না। ভুবন দাস ট্যাক্সিতে এসে রাস্তা থেকে হর্ন বাজালো, মোহিনী বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। দু’জনে চলে গেল।’
ফণীশ এক থালা খাবার আনিয়া বরাটের সম্মুখে রাখিল, বরাট বিমৰ্ষভাবে আহার করিতে লাগিলেন। আমরাও মালপোয়াতে মন দিলাম। নীরবে আহার চলিতে লাগিল।
বৈষ্ণবীয় জলযোগ সমাধা করিয়া সিগারেট ধরাইবার উপক্রম করিতেছি, বাহিরের দিক হইতে আদলি জাতীয় একটি লোক ঘরে প্রবেশ করিল। মাথায় গান্ধী-টুপি, পরিধানে খন্দরের চাপকন ও পায়জামা; তাই হঠাৎ তাহাকে চিনিতে পারি নাই। সে মাথার টুপি খুলিয়া মেঝোয় আছাড় মারিল। তারপর বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলিল, ‘শালাদের ধরেছি স্যার।’
বিকাশ দত্ত। টুপি খুলিতেই তাহার স্বরূপ প্রকাশ হইয়াছে। ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া বলিল, ‘এস এস বিকাশ। কাজ সেরে ফেলেছি তাহলে?’
‘সেরেছি স্যার। আমার মাথা ফাটাবার তালে ছিল, তাতেই ধরা পড়ে গেল।’ বিকাশ হাত-পা ছড়াইয়া একটা সোফায় বসিয়া দৃঢ়স্বরে বলিল, ‘দু’জনেই শালা।’
‘দু’জনেই শালা-কাদের কথা বলছ?’
বিকাশ উত্তর দিবার পূর্বেই সুরপতি ঘটক প্রবেশ করিলেন। শৌখিন বেশবাস সত্ত্বেও একটু ভিজাবিড়াল ভাব, চোখে সতর্ক বিড়ালদৃষ্টি। তিনি ঘরের পরিস্থিতি ক্ষিপ্র-মসৃণ চক্ষে দেখিয়া লইয়া বিনীত স্বরে বলিলেন, ‘কর্তা আছেন কি? তাঁর সঙ্গে—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন সুরপতিবাবু।’
বিকাশ সহসা খাড়া হইয়া বসিল, একাগ্র চক্ষে সুরপতিবাবুকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘এঁর নাম সুরপতি ঘটক? বড় অফিসের বড়বাবু?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। কেন বল দেখি?’
বিকাশ সুরপতিবাবুর দিকে তর্জনী নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘এঁর দুই শালার কথা বলছিলাম স্যার। বিশ্বনাথ আর জগন্নাথ রায়। তারাই কয়লাখনিতে বজ্জাতি করছে।’
সুরপতির চোখে ভয় উছলিয়া উঠিল, তিনি শীর্ণকণ্ঠে বলিলেন, ‘কী? কী? আমি তো কিছু—’
বরাট তাঁহার দিকে ধীরে ধীরে চক্ষু ফিরাইয়া নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুরপতিবাবু্, যে দু’টি ছোকরাকে আপনি আমাদের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টায় ছিলেন, তারা আপনার শালা?’
সুরপতিবাবু বলিলেন, ‘মানে—তাতে কি হয়েছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হয়নি কিছু। কাল রাত্রে আমি একটা চিঠি পেয়েছি, তাতে তিনজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। আমরা মিলিয়ে দেখতে চাই, তিনজনের মধ্যে আপনি আছেন। কিনা—ইন্সপেক্টর বরাট, আপনি সুরপতিবাবুর আঙুলের ছাপ নিন। মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে উনি এই ষড়যন্ত্রে কতদূর আছেন। ফণীশ, বাড়িতে রবারস্ট্যাম্প-কালির প্যাড আছে?’
সুরপতিবাবু এক-পা এক-পা করিয়া পিছু হটতেছিলেন, দ্বারের কাছাকাছি গিয়া তিনি পাক খাইয়া পালাইবার চেষ্টা করিলেন। ঘটনাক্রমে এই সময় মণীশবাবু ঘরে প্রবেশ করিতেছিলেন, দুজনেই পড়িতে পড়িতে তাল সামলাইয়া লইলেন, তারপর সুরপতি ঘটক তুরঙ্গ গতিতে পলায়ণ করিলেন।
মনীশবাবু এইমাত্র কয়লাখনি হইতে ফিরিয়াছেন, ঘরে প্রবেশ করিয়া বিস্ময়ব্যাকুল চক্ষে চারিদিকে চাহিলেন। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম। তিনি বলিলেন, কী হচ্ছে এখানে?–ইন্সপেক্টর বরাট–সুরপতি আমন লাফ মেরে পালালো কেন?’
বরাট বলিলেন, ‘আপনি বসুন। আপনার খনিতে যারা অনিষ্ট করছিল তারা ধরা পড়েছে।’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘ধরা পড়েছে!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। এই ছেলেটির নাম বিকাশ দত্ত, ও আমার সহকারী। ইন্সপেক্টির বরাটের সঙ্গে পরামর্শ করে বিকাশকে হাসপাতালের আর্দালি সাজিয়ে খনিতে পাঠিয়েছিলাম। ও ধরেছে।’
মণীশবাবু বলিলেন, ‘কে-কারা-?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুরপতি ঘটক ও তার দুই শালা।’
‘অ্যাঁ! সুরপতি!’ মণীশবাবু চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন, ‘কিন্তু–সুরপতি! সে যে আমার অফিসে বিশ বছর কাজ করছে। তার এই কাজ।’
আমরা আবার উপবেশন করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘মণীশবাবু্, দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করলে মানুষ স্ত্রীর বশীভূত হয়, সুরপতিবাবু শালাদের বশীভুত হয়েছেন। খুব বেশি তফাৎ নেই।’
মনীশবাবু বলিলেন, ‘কিন্তু কেন? ওরা আমার অনিষ্ট করতে চায় কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সেটা এখনো আবিষ্কার করা যায়নি। তবে আবিষ্কার করা শক্ত হবে না। আমার মনে হয়, যে মাড়োয়ারি আপনার খনি কিনতে চেয়েছিল। সেই আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ছে। কিংবা অন্য কেউ হতে পারে। সুরপতিবাবুকে চাপ দিলেই বেরিয়ে পড়বে।’
‘কিন্তু–সুরপতির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু পেয়েছেন?’
‘এখনো পাইনি। কিন্তু আঙুলের ছাপ নেবার নামে উনি যেরকম লাফ মেরে পালালেন, ওঁর মনে পাপ আছে।’
মণীশবাবু নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। মনে হইল, তিনি যত না বিস্মিত হইয়াছেন, ততোধিক দুঃখ পাইয়াছেন। তিনি বলিলেন, ‘আপনারা বসুন। ফণী, তুমি আমার সঙ্গে এস। অফিসের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আর সুরপতির–তিনি সপ্রশ্ন নোত্রে বরাটের পানে চাহিলেন।
বরাট বলিলেন, ‘সুরপতির ব্যবস্থা আমি করব।’
মণীশবাবু পুত্রকে লইয়া অফিসের দিকে চলিয়া গেলেন।
আমরা চারজন কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ অলসকণ্ঠে বলিল, ‘ভুবনের নামে হুলিয়া জারি করেছেন নিশ্চয়?’
বরাট বলিলেন, ‘সারাদিন তাতেই কেটেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আশাপ্রদ কোনো খবর নেই?’
বরাট বলিলেন, ‘চল্লিশ মাইল দূরে একটা রেলওয়ে স্টেশন থেকে খবর পেয়েছি, একটা চালকহীন নম্বরহীন ট্যাক্সি সেখানে পড়ে আছে। লোক পাঠিয়েছি। হয়তো ভুবনের ট্যাক্সি্্, সে ওখানে ট্যাক্সি ছেড়ে ট্রেন ধরেছে।’
‘বোম্বাই গেছে কি মাদ্রাজ গেছে কে জানে।’
‘হুঁ। আজ উঠি।’
‘আচ্ছা, আসুন। আসামীকে ধরা আপনার কর্তব্য, আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন জানি। তবু্, যদি ওদের ধরতে না পারেন। আমি খুশি হব।’
ইন্সপেক্টর বিরাট একটু হাসিলেন।