কড়ি দিয়ে কিনলাম (Kari Diye Kinlam) : প্রথম খণ্ড – তেরো বছরের সালতামামি
এখন থেকে তেরো বছর আগে এই উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয়। আজ এর ত্রয়োদশ সংস্করণের ভূমিকায় এই সুযোগে এই উপন্যাস সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য রাখার প্রয়োজনের অনিবার্যতা বোধ করছি। কোনও বই-এর সংস্করণ-সংখ্যা দিয়ে তার গুণাগুণ বিচার করা অবিচারেরই সামিল। কিন্তু তবু যে এই ভূমিকা লিখছি তার কারণ এই তেরো বছরে এই বই উপলক্ষে আমি এতে প্রশংসা স্তুতি এবং এত অপপ্রচার ও তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি যে এখানে তা লিপিবদ্ধ না করলে ভবিষ্যৎ বংশীয়দের কাছে সে-সব চিরকাল অজ্ঞাতই থেকে যাবে।
Modern Library (26€ garro Dostoyevskey-1 45 “Brothers Karmazoy”-এর ভূমিকায় সম্পাদক প্রথম লাইনেই একটি চমৎকার কথা বলেছেন “The last and crowning work of Dostoyevskey’s life, The Brothers Karmazov, first appeared as a serial in “Russky Vistnik’, A Moscow maguine, starting 1879-1880. written under severe external and internal pressure, each instalment created a national furore comparable only to the excitement stirred by the appearence, in 1866 of ‘Crime and Punishment.” “কড়ি দিয়ে কিনলাম” উপন্যাস সম্বন্ধেও এই একই কথা প্রযোজ্য। ১৯৬০, ১লা জানুয়ারি থেকে ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ১০৭টি দীর্ঘ কিস্তিতে সাপ্তাহিক “দেশ” পত্রিকায় এই উপন্যাস ধারাবাহিক প্রকাশের সময় যে শশারগোল পড়ে যায়, তার সঙ্গে তুলনা করা যায় একমাত্র ১৯৫২ নভেম্বর থেকে ১৯৫৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিক প্রকাশিত “সাহেব বিবি গোলাম” উপন্যাসের সঙ্গে। যে মানসিক যন্ত্রণা, শত্রুতা ও বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতা সে-সময়ে আমাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে তার সাক্ষী নেই কেউই। “দেশ” পত্রিকার অফিসে তখন যে-সব অসংখ্য চিঠি পত্র এসেছে তা যে-কোনও লেখককে বিভ্রান্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। তবু মনে হয় অনুকূল পরিবেশের চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই বোধ করি আমার একাগ্রতার তীব্রতা বৃদ্ধি লাভ করে। মনে আছে উপন্যাস দুটি প্রকাশিত হবার কালে যখন “দেশ” পত্রিকার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগলো তখন পাঠক-পাঠিকাদের কাছ থেকেও এই মর্মে চিঠি আসতে লাগলো যেন এই উপন্যাস কখনও কোনওকালে শেষ না হয়। অর্থাৎ তাদের ভালো লাগায় যেন কখনও ছেদ না ঘটে! বইটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হওয়ার সময়েই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের অনুমতির জন্যে অনুরোধ আসতে থাকে। ভারতের বাইরে পাকিস্তানে উর্দুভাষার শ্রেষ্ঠ ত্রৈমাসিক লাহোরের “নুকুশ” পত্রিকায়, এবং ভারতের ভেতরে মালয়ালম ভাষায় কেরালার “জনযুগম্” সাপ্তাহিকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দি ভাষায় গ্রন্থটি দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়ে অভূতপূর্ব আন্দোলনের আকার ধারণ করে। তখনকার দিনে যে-কোনও ভাষার পক্ষে যে-কোনও একটি উপন্যাস-এর দাম ৪২ টাকা ৫০ পয়সা দুমূল্যের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দি ভাষা-ভাষীদের কাছে বইটি অভূতপূর্ব সমাদর অর্জন করে। মনে আছে সেই সময়ে অনেক অপরিচিত পাঠক সশরীরে আমার বাড়িতে এসে খবর নিতেন আমি দিনেরাত্রে কখনও ঘুমোই কি না। এ হেন গ্রন্থ যখন প্রথম প্রকাশিত হলো তখন পাঠক সাধারণের মধ্যে অন্তহীন কৌতূহলের সঙ্গে কেবল একটি প্রশ্নই ধ্বনিত হতে লাগলো–সেটা এই যে এই ব্যস্ততার যুগেও এমন এপিক উপন্যাস লেখা সম্ভব হলো কেমন করে! প্রকাশক “মিত্র ও ঘোষ” পাঠক সাধারণের কৌতূহল নিরসনকল্পে একটি বিশেষ পুস্তিকা প্রকাশ করে তাতে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, এবং সেই পুস্তিকাটি দশ সহস্র কপি ছাপিয়ে পাঠকদের কাছে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। এই উপন্যাস আয়তনের দিক দিয়ে যে-কোন ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে বৃহত্তম। পরে এই উপন্যাসটি সম্পর্কে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় Amrita Bazar Patrika Puza special 1964-তে “Recent trends in Bengali literature’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন–Bimal Mitra’s encyclopaedic novel “Karhi diye Kinlam” (1962), sums up the complexities and unsolved riddles of modern life in a representative individual character and studies life against the background of an ever-widening environment. This is truly a novel with a third dimension that packs up the meaning of the lives of all classes of people and events of far-reaching magnitude into the life of a single individual… This is a book which has an intellectual appeal not exhausted at the first reading of the story. With this novel, modern Bengali fiction may be said to have stepped into a new sense of life-values or a new world of cosmic proportions…..” এই তো গেল সমালোচকদের কথা। কিন্তু এ-সম্বন্ধে আমার নিজের কথা এখন বলি। বলি, কেন এবং কেমন করে এ-বই লিখেছিলাম। তবে স্বামী-স্ত্রী দু’জন জীবিত থাকতে যেমন তাঁদের বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে সত্য কথা বলা বিপজ্জনক, লেখকের নিজের লেখা সম্বন্ধেও ঠিক তাই। লেখকের জীবিতাবস্থায় তাঁর লেখা ভাল কিম্বা মন্দ বলা চলে কিন্তু সে-সম্বন্ধে সত্য কথা বলা চলে না। আজ পর্যন্ত সাহিত্যের ইতিহাসে তা কখনো ঘটে নি। সুতরাং সে চেষ্টা করবো না। তবে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ লেখাকালীন যে-সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তা এখন এই তেরো বছর পরে বললে বোধ করি অন্যায় হবে না। আমার অবর্তমানে অন্য কেউ সে চেষ্টা করলে তা অনুমান বলে গ্রাহ্য হতে পারে কিন্তু কোনওদিনই তা প্রমাণ বলে স্বীকৃত হবে না। তাই আমি এখানে এই রচনার উৎস ও রচনাকালীন যন্ত্রণা এবং তার আনুষঙ্গিক ইতিবৃত্তের অবতারণা করি।
সতেরো শ ঊননব্বই সালে কবে একদিন ফ্রান্সে বিপ্লব হয়েছিল। তার স্মৃতি যেন লোকে তখন ভুলতে বসেছে। টাটকা মনে আছে উনিশ শ চোদ্দ সালের বিশ্বযুদ্ধটার কথা। কিন্তু তখনও লুই-দ্য-ফোর্টিন্থ আর ম্যাডাম-দু-ব্যারিরা পৃথিবী থেকে মুছে যায় নি। তাদের কেউ বসেছে ইংলন্ডের সিংহাসনে, কেউ জার্মানীতে, কেউ আমেরিকায়, আর কেউ বা ফ্রান্স-এ। সেই Liberty, Equality আর Fraternity-র বাণী তখন আর কারো কানে ঢোকে না। কে একজন বলেছিল–That government is best which governs not at all. সে-কথাও আর তখন কানে ঢুকছে না কারো। দেখতে দেখতে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রে বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে একদিন শেষও হয়ে গেল। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের অপমৃত্যু দিয়েও মানুষ তাদের চাওয়া গভর্নমেন্ট পেলে না। শ্রমিকরাও তাদের শৃঙ্খল ভাঙতে পারে নি তখন। মানুষের সংসারের লক্ষ্মী নিরুদ্দেশ, হয়ে গেছে ঘর থেকে। ইন্ডিয়ার টাকা, ইংলন্ডের পাউন্ড, আমেরিকার ডলার, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্ক, জার্মানীর মার্ক, রাশিয়ার রুবল, ইটালির লীরা, জাপানের ইয়েন, সকলকে ট্যারিফ বোর্ডের চাবি দিয়ে সেফডিপোজিট ভল্টে আটকে রাখবার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তবু কোথাও স্ট্রাইক বন্ধ হচ্ছে না, হরতাল বন্ধ হচ্ছে না, অসন্তোষ থামছে না। দিন দিন সায়েন্স আর ইন্ডািস্ট্রি কেবল লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে আর মানুষের সমাজ স্থাণুর মত হতভম্ব হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তাই দেখছে আর বাঁচবার পথ খুঁজে মাথা কুটে মরছে।
ঠিক এই সময়ে মানুষের ঘরে একটা নতুন নাম জন্মাল। সে দীপঙ্কর।
জন্ম তো হলো। কিন্তু তার পর?
তারপর আমার কথা বলি।
তার পর পলে-পলে অপমান, অত্যাচার আর অপমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমি বড় হতে লাগলাম। দেখলাম আমার চারদিকে শুধু ঘৃণা, শুধু লজ্জা, শুধু কলঙ্ক, শুধু ভয়। দেখলাম অঘোরদাদুকে, চনুনীকে, লক্কাকে, লোটনকে, ছিটে-ফোঁটাকে, দুনিকাকাকে, আর তাদের মত অসংখ্য মানুষকে, যারা ন্যায়-অন্যায়ের বালাই নিয়ে মাথা ঘামায় না। যারা তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দেয় সত্যকে, ধর্মকে আর সুন্দরকে। যারা এক ফু-এ চিরকালের প্রতিষ্ঠিত সমস্ত সত্যকে তুচ্ছ করে দিয়ে মহা-আরামে দিন কাটিয়ে দেয়। অথচ এই সংসারে তাদেরই পাশাপাশি দেখলাম প্রাণমথবাবুকে, সতাঁকে, দাতারবাবুকে। দেখলাম আরো অনেকের সঙ্গে সনাতনবাবুকেও। কিন্তু মানুষের লেখা পুঁথির সঙ্গে সেই সব মানুষের জীবনকে যাচাই করতে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম। ১৭৮৯ সালের ফরাসী দেশেও ঠিক এমনি অবস্থা ছিল একদিন। অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই পৃথিবীতে যন্ত্র-সভ্যতার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সেখানেও আর এক নতুন সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছিল। সেদিন সেখানকার অবস্থাও ছিল ঠিক এখানকার মত। সেখানকার অঘোরদাদুরাও ঠিক এমনি করে ঠাকুরের ।নৈবেদ্য চুরি করে যজমান ঠকাতো। সেখানকার চনুনীরাও লেখাপড়া শিখতে না পেরে কুৎসিত গালাগালি দিয়ে জীবন কাটাত। সেখানেও ছিল দুনিকাকা, সেখানেও ছিল পঞ্চাদা, ছোনেদা, মধুসূদনের বড়দা। সেখানে সেই ফরাসীদেশেও ছিল কালীঘাটের মতন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন। সেখানকার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনেও রোদ ঢুকত না, শিক্ষা ঢুকত না, সভ্যতা ঢুকত না সেদিন। সি-আর-দাস মারা যাবার দিন সেখানেও সবাই নির্বিকার হয়ে আড্ডা দিত। হুজুগের দিন চরকা কাটত আবার হুজুগ চলে গেলে চরকা ফেলে দিত। সেখানেও লক্ষ্মীদির মত মেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে দীপঙ্করের মত ছোট ছেলেদের ধরে চকোলেট দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে শম্ভুদের কাছে প্রেমপত্র পাঠাত। সেখানেও কিরণরা রাস্তায় রাস্তায় হাতেকাটা পৈতে বিক্রি করত আর দীপঙ্করের মায়েরা পরের বাড়িতে রান্না করত আর ছেলে মানুষ করার স্বপ্ন দেখত। আর সেখানেও যারা বড়লোক, যারা ব্যারিস্টার পালিতের মতন বড়লোক, যারা অঘোরদাদুর যজমানদের মত বড়লোক, সেই ‘লখার মাঠে’র একাদশী বাঁড়ুজ্জে আর চাউলপটির শশধর চাটুজ্জের দল কড়ি দিয়ে সব কিনে ফেলত-পাপ কিনত, পুণ্য কিনত, অধর্ম কিনত। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি যশ সম্মান কীর্তি অমরত্ব সব কিনে ফেলত!
এই সব পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যেত দীপঙ্কর। কোথাও কোনও নিয়ম পেত না, কোথাও কোনও ফরমুলা পেত না। চিরকাল কি এমনিই চলবে? এমনি অনাচার আর এমনি অরাজকতা? তিন শো বছর আগেকার লেখা বই-এর পাতাতেও দেখলাম Babeuf (বাবা) লিখছেন, “When I see the poor without the clothing and without the shoes which they themselves are engaged in making, and contemplate the small minority who do not work and yet want for nothing, I am convinced that Government is still the old conspiracy of the few against the many, only it takes a new form.”
সেদিন হাজরা রোডের মোড়ে হঠাৎ অমলবাবুর সঙ্গে দেখা।
আশুতোষ কলেজের হিস্ট্রির প্রফেসর অমল রায়চৌধুরী। লম্বা-চওড়া চেহারা। হিস্ট্রিও যে উপন্যাসের মত উপাদেয় হতে পারে তা অমলবাবুর লেকচার শুনেই। বুঝেছিলাম। নানা কলেজের ছাত্ররা আশুতোষ কলেজে আসত তার লেকচার শুনতে। কিন্তু আমাকে তিনি চিনতে পারলেন না।
বললেন–তুমি কে? কোন্ ইয়ারে পড়? তোমার নাম কী?
সব বললাম। তার পরে বললাম–একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার?
বললেন–কী?
শেষ পর্যন্ত কথাটা বলেই ফেললাম। কয়েকদিন আগের কথা। কাসে সক্রেটিসের কথা পড়াচ্ছিলেন। পড়াতে পড়াতে বললেন সক্রেটিসের একটা কথা। সক্রেটিস Th1186919-Be hopeful then, gentlemen of the jury, as to death; and this one thing hold fast that to a good man, whether alive or dead, no evil can happen, nor are the gods indifferent to his well-being. POTETE মানে সেদিন ক্লাসে বুঝতে পারি নি। দাঁড়িয়ে উঠে মানে জিজ্ঞেসও করতে পারি নি সঙ্কোচে। ক্লাসের সবাই কথাটার অর্থ বুঝতে পেরেছিল কিনা তাও জানি না। তাই রাস্ত য় দেখা হতেই সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম–কথাটার মানে কী? অর্থাৎ কথাটা। কতদূর সত্যি?
অমলবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কোথায় থাক তুমি? ম্যাট্রিকে রেজাল্ট কী হয়েছিল তোমার?
সব প্রশ্নেরই উত্তর দিলাম। তার পর বললাম–আপনি হয়তো এখন খুব ব্যস্ত আছেন স্যার, আমি পরে আর একদিন দেখা করব!
বলে চলে আসছিলাম। কিন্তু অমলবাবু থামিয়ে দিলেন। বললেন–না, দাঁড়াও, তুমি একটা কাজ করো, আমার সঙ্গে লাইব্রেরিতে একবার দেখা করো।
–কখন স্যার?
–যখন ইচ্ছে–বলে অমলবাবু চলে যাচ্ছিলেন। আমিও চলে আসছিলাম।
হঠাৎ যেতে যেতে অমলবাবু আবার ফিরলেন। বললেন–দেখা করো ঠিক, বুঝলে?
বললাম–করব স্যার।
কিন্তু যাব-যাব করেও আর বহুদিন অমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে সাহস হয় নি। ক্লাসের মধ্যেই বই-এর ওপর মুখ দিয়েই পড়িয়ে যেতেন। কারোর দিকে চেয়ে দেখতেন না। কিন্তু সেদিন সব দ্বিধা-সঙ্কোচ এড়িয়ে তার লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তিনি তখন ফোর্থ ইয়ার ক্লাস শেষ করে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন সেই সময়ে দরজার কাছে গিয়ে বললাম–স্যার!
বললেন–কী চাও?
বললাম। সব কথা তাঁকে মনে পড়িয়ে দিলাম। কথাটা শুনে তিনি আমার আপাদ মস্তক আবার ভাল করে দেখে নিলেন। বললেন–মনে পড়েছে, কিন্তু এতদিন কলেজে পড়াচ্ছি, তোমার মত কেউ আমাকে এ-প্রশ্ন তো করে নি! তা তুমি এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা চাও, না ইকনমিক ব্যাখ্যা চাও?
আমি চুপ করে রইলাম।
অমলবাবু বললেন–বুঝেছি, তবে শোন–
বলে তিনি আরম্ভ করলেন বোঝাতে। অনেকদিন আগেকার ঘটনা। সেদিন সেই লাইব্রেরির অন্ধকার ঘরে বসে অমলবাবু যে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা আমার আজো মনে আছে। আজ সেই পুরোন আশুতোষ কলেজও নেই, সেই বিল্ডিংটাও নেই। তার জায়গায় নতুন কলেজ হয়েছে, নতুন বিল্ডিং। কিন্তু কথাগুলো মনে আছে।
সে দক্ষিণেশ্বরের কথা। পরমহংসদেব তখন বেঁচে। এগারো শ ক্রোশ দূর থেকে এক সাধু এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। সাধু হীরাচাঁদ। এসে স্বামী বিবেকানন্দকে জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা বলুন তো, ভক্তের এত দুঃখ কেন?
বিবেকানন্দ বললেন–The scheme of the universe is devilish, I could have created a better world.
সাধু আবার জিজ্ঞেস করলেন–তা দুঃখ না থাকলে সুখ বুঝবেন কী করে?
তখন বিবেকানন্দ বললেন–Our only refuge is in Pantheism-ভক্ত আর ভগবান সবই এক, এই বিশ্বাসটুকু হলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়–অর্থাৎ আমিই সব করছি, এই বিশ্বাস–
গল্পটা বলে অমলবাবু একটু থামলেন। তারপর বললেন–আমি ইতিহাস পড়াই, ইতিহাসেরও একটা দিক আছে, ভারি ইম্পর্ট্যান্ট দিক, সেটা শোন।
-এ তার অনেক পরের কথা। উনিশ শো পাঁচ সালের কথা। একদিন কয়েক হাজার লোক সবিনয়ে এক দেশের রাজার প্রাসাদের সামনে গিয়ে দরবার করলে। গেটের সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল সেপাই-সান্ত্রী। তারা জিজ্ঞেস করলে-কী চাই তোমাদের?
লোকরা বললে–হুজুরের কাছে আমরা একটা দরখাস্ত পাঠাতে চাই
দরখাস্তখানা সেপাই রাজার কাছে নিয়ে গেল। অতি বিনীত দরখাস্ত। দরখাস্তে লেখা ছিল: “We come to thee sire, to seek truth and redress. We have been oppressed; we are not recognised as human beings, we are treated as slaves, who must suffer their bitter fate and keep silence. The limit of patience has arrived. Sire, is this in accordance with the devine law by the grace of which thou reignest? Is it not better to die, better for all the people, and let the capitalists, the exploiters of the working class live? Do not refuse assistance to thy people. Destroy the wall between thyself and thy people and let them rule the country with thyself.”
দরখাস্তখানা পাঠাবার খানিক পরেই এক কাণ্ড হলো। ওপরের বারান্দা থেকে বলা নেই-কওয়া-নেই, তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চলতে লাগল, গুলির ওপর গুলি। সেই হাজার হাজার নিরীহ লোকের ওপর লক্ষ লক্ষ গুলির ঝাক এসে পড়তে লাগল। হাজারে হাজারে মরে পড়ল লোক, তারা কাতরাতে লাগল, ছটফট করতে লাগল যন্ত্রণায়–
আর মজা এই, ঠিক তার বারো বছর পরে ঠিক সেই বারান্দা থেকেই ১৯১৭ সালে একদিন আর একজন লোক হাজার হাজার লোকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলেন–Comrades, feeding people is a simple task. We will take from the rich and give to the poor. Take milk from the rich and give to the children of workers. He who does not work shall not eat. Workers will receive cards. Cards will bring food.
আরো অনেক কথা বলেছিলেন অমলবাবু। সব ভালো বুঝতে পারি নি। বেশি সময়ও ছিল না। ক্লাসের ঘণ্টা পড়তেই অমলবাবু চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন–পরে তোমাকে এ-সম্বন্ধে আরো অনেক কথা বলব।
কিন্তু তখন কি জানতাম সেই অমলবাবু অত শিগগির চলে যাবেন। কিন্তু পরে আর একদিন মাত্র এ-বিষয়ে কথা হয়েছিল অমলবাবুর সঙ্গে। ক্লাসের মধ্যে চুপ করে বসেছিলাম এক কোণে।
–রোল নাম্বার সিক্স, রোল নাম্বার সিক্স—
দাঁড়িয়ে উঠে বললাম–ইয়েস স্যার—
অমলবাবু হঠাৎ বললেন–তুমি তোমার সেই কোশ্চেনের উত্তর পেয়েছ?
বললাম–এখনও ঠিক বুঝতে পারি নি স্যার
অমলবাবু বললেন–পাবে পাবে, এর উত্তর কারো কাছে জিজ্ঞেস করে পাওয়া যায় না, এর উত্তর জীবন দিয়ে পেতে হয়, জীবন দিয়ে সন্ধান করলে তবে এর উত্তর পাবে তুমি–
১৯৬০ সালের ১লা জানুয়ারি দেশ পত্রিকায় দীপঙ্কর সেই যাত্রা শুরু করল। আরম্ভ হলো সন্ধান। মানুষের মহাযাত্রার মিছিলে মিশে গেল নগণ্য একটি গ্রামের ছেলে। ছোট, বড়, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র সাহেব মেমসাহেব-কলকাতার তাবৎ জনসাধারণ। ফ্রি-স্কুল স্ট্রীট থেকে শুরু করে একেবারে কালীঘাটের ডাস্টবিন পর্যন্ত পরিক্রমা শুরু হলো তার। কেউ তাকে ভালবাসল, কেউ ঘৃণা করল, কেউ আঘাত দিলে, কেউ আনন্দ। কিন্তু দিনে দিনে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায়, প্রতিমুহূর্তের অনুভাবনায় দীপঙ্কর তখন মানুষ হয়ে উঠছে আর মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি মানুষকে একে একে তার মনের তালুকদারির সমস্ত স্বত্ব উপস্বত্ব সুস্থ চিত্তে বহালতবিয়তে দান করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো সে। সর্বরিক্ত হয়ে দীপঙ্কর তার সর্বস্ব নিবেদনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলে!
কিন্তু আমি মুক্তি পাই নি। দীপঙ্করের যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছি তখন। দীপঙ্করের পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে আমারও পরিক্রমা চলছে তখন স্বর্গ-মর্ত্য-ভুবন। রাত্রে ঘুম নেই। সারা পৃথিবী যখন ঘুমোচ্ছে, তখন আমি আর আমার বাড়ির সামনের বার্লি ফ্যাক্টরিটা জেগে আছি। জেগে-জেগে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছি। মাথার মধ্যে সমস্ত গোলমাল হয়ে যায়। আমিও দীপঙ্করের সঙ্গে ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট, প্যালেস-কোর্ট আর গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এ ঘোরাফেরা করছি। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছি। সব অন্ধকার!
বাড়ির ডাক্তার কানাইলাল সরকার। কানাই বললে–ডাক্তার নীহার মুন্সীকে একবার দেখাও তুমি চোখটা।
জিজ্ঞেস করলাম–কত নেবেন তিনি?
ডাক্তার বললেন–মস্ত বড় ডাক্তার, দুদিন দেখাতে হবে, ষোল ষোল-বত্রিশ টাকা
বত্রিশ টাকা! বত্রিশ টাকার দাম তখন আমার কাছে অনেক। কিন্তু চোখ যদি অন্ধ হয়ে যায়? দেখবো কী দিয়ে? লিখবো কী করে? শেষ পর্যন্ত বত্রিশটা টাকা পকেটে নিয়ে আগের থেকে দরখাস্ত দিয়ে দিন-ক্ষণ স্থির করে গিয়ে হাজির হলাম তার গরচা লেনের বাড়িতে। বহু লোক বাইরে অপেক্ষা করছেন তখন। ভেতরের ঘরে তিনি রোগী দেখছেন। তার পরিচারককে একটা স্লিপে নাম লিখে ভেতরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। ভয়ে ভয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ তিনি বাইরে এলেন সশরীরে। একেবারে নমস্কারের ভঙ্গি। বললেন–আমার বহু সৌভাগ্য–
আমি তো অবাক! সৌভাগ্য তার না আমার!
যাহোক, পরীক্ষা করতে শুরু করলেন তিনি। প্রায় আধঘণ্টা ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা।
শেষকালে চলে আসবার সময় জিজ্ঞেস করলাম–কত দিতে হবে?
–কিছু না।
আমি আরো অবাক! এমন কথা আগে কখনও শুনি নি কোনও ডাক্তারের কাছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তখনও। আমার হতভম্ব দৃষ্টির দিকে চেয়ে তিনি আবার বললেন–তার চেয়ে বরং আপনার একটা বই আমাকে দেবেন, সেইটেই আমি। বেশি দামী মনে করবো!
তারপর ১৯৬২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারিতে একদিন শেষ হলো কড়ি দিয়ে কেনা। সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা-স্তুতি মিশ্রিত অজস্র অসংখ্য চিঠিপত্র। ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশ থেকে সহস্রাধিক পত্রাঘাত। কিন্তু আমাকে তা স্পর্শ করেনি। কারণ আমি তখন বোম্বাইতে নির্জন নিরিবিলিতে নিবিষ্ট। আমি জানতে পারি নি, জানতে চাইও নি কড়ি দিয়ে কী কিনলাম আর কী কিনলাম না। দেশ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ একটি চিঠিতে লিখলেন, “গতকাল কড়ি দিয়ে কিনলাম, ১ম খণ্ড, হস্তগত হলো। বইটা হাতে নিয়ে অনুভব করলাম কী বিরাট কীর্তি আর কী অসাধ্যসাধনই না করেছেন। এর পর আছে দ্বিতীয় খণ্ড। প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি আসছে, আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। অকুণ্ঠ অভিনন্দন। পাঠকদের যে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে এই অগণিত চিঠিই তার প্রমাণ!”
কলকাতায় ফিরে এসে চিঠিগুলো পড়লাম। যারা এই উপন্যাস পড়ে আমাকে পত্রযোগে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তখন তাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি। আজকে এতদিন পরে এই সুযোগে তাঁদের প্রত্যেককে আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ উপন্যাস যাদের ভালো লেগেছে সে তাদেরই মহত্ত্ব, আমার কেবল সৌভাগ্য! আমার এই সাহিত্যার্থের বিনিময়ে মাত্র সেইটুকুই আমার প্রাপ্য।
কিন্তু এবার এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা কিছু না লিখলে এ ভূমিকা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই তেরো বছরে অনেক স্মৃতি যেমন কালের অতল-গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে, তেমনি কিছু সঞ্চয়ও মনের কোণে জমা পড়েছে।
মনে আছে এই বই প্রকাশকালে একজন শ্রদ্ধেয় অগ্রজ লেখক আমার এই গ্রন্থের প্রকাশককে তার শুভাকাঙ্খী হিসেবেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন–তুমি ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ছাপছো বটে কিন্তু এ-বই পাঁচশো কপির বেশি বিক্রি হবে না
কিন্তু তাতেই তিনি নিবৃত্ত হন নি। যখন তিনি দেখলেন তার ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যেয় পরিণত হলো তখন তিনি ‘অমৃত’ সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে এই উপন্যাসের অসারতা প্রমাণ করবার জন্যে একটি অপব্যাখ্যা সূচক প্রবন্ধ লেখার কষ্ট স্বীকার করে আমায় বিব্রত করতে প্রাণপাত চেষ্টা করেছিলেন।
একজন সহযোগী সাহিত্যিক সেই একই ‘অমৃত’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে তিনি নিজে লিখলে এই দুহাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসকে আড়াইশো পাতার মধ্যে সঙ্কুচিত করে লিখতে পারতেন।
যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালের এক মুমূর্ষ রোগী আমাকে পত্রযোগে জানিয়েছিলেন যে আমার এই বই পড়ে তিনি রোগ-যন্ত্রণা ভুলতে পেরেছেন।
সম্প্রতি নাগপুরে থাকার সময় এক বিখ্যাত প্রবীণ ডাক্তার (ডাঃ ব্যানার্জি) আমাকে জানিয়েছিলেন যে তাঁর এক অনিদ্রা-গ্রস্ত রোগীকে তিনি প্রতিদিন তীব্র ওষুধ (পেথিড্রিন) ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়াতে যেতেন। কিন্তু একদিন রোগীটি আর ইনজেশান নিতে অস্বীকার করায় তার কারণ জানতে চাওয়ায় জবাবে জানতে পারেন যে হিন্দি ভাষায় কড়ি দিয়ে কিনলাম” পড়তে আরম্ভ করার পরে রোগীটির ঘুমের ওষুধের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। তার অনিদ্রা-রোগ দূর হয়েছে।
কেরলের একজন কথক শ্রী ভি শম্ভশিব ‘মালায়ালাম্’ ভাষায় এই উপন্যাসের কাহিনী কথকতা করে এখনও শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে চলেছেন।
এ-রকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে।
কিন্তু এই ঘটনাগুলি অত্যন্ত তুচ্ছ। হয়ত বা উল্লেখেরও যোগ্য নয়। তবে আমার বিনীত বক্তব্য এই যে এই তেরো বছরের দীর্ঘ পরিধিতে ওই নিন্দা-প্রশংসা-কুৎসা কটুক্তি-শ্রদ্ধা-আশীর্বাদ-সম্মান সব মিলিয়ে যা কিছু পেয়েছি সমস্তই আমি নতমস্তকে গ্রহণ করেছি। যা আমার প্রাপ্য তাও গ্রহণ করেছি এবং যা আমার প্রাপ্য নয় তাও গ্রহণ করতে আমি কখনও অস্বীকার করিনি। আসলে যে-সমাজে মানুষকে সম্মান পেতে গেলে নিজের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তা পেতে হয় সে-সমাজ আমার কাছে সম্মানীয় নয়। তাই প্রয়োজনবোধে এই উপন্যাসের মধ্যে আমি সেই সমাজকে অনেক স্থানে আঘাত দিয়েছি। আঘাত দিয়েছি বটে কিন্তু তজনিত আঘাত পেয়েছিও আমি অনেক। আমার রচনায় অনেক দোষ-ত্রুটি আছে, এবং সেগুলির রসের বিচারে কতখানি দোষাবহ তাও আমার অপরিজ্ঞাত নয়। এই তেরো বছরের নিন্দা-স্তুতির জঞ্জাল আজ আমার মানসিকতাকে এমন এক স্তরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছে যেখানে এই সম্পদগুলি একান্তই আমার নিজস্ব বলে দাবি করবার আর উপায় নেই। এর সমস্ত দায়ই এখন পাঠক-সম্প্রদায়ের। আমি এখানে সেই সম্পদের সামান্য একজন অছি মাত্র।
আজকাল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষতা একটি বিশেষ ধরনের কূটনীতি বলে স্বীকৃত, কিন্তু সাহিত্য-ক্ষেত্রে এই জোটনিরপেক্ষতা চিরকাল ধরেই একটি অপরিহার্য এবং অবশ্যপালনীয় ধর্ম বলে পালিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেই জাতীয় একজন জোটনিরপেক্ষ লেখক। সেই কারণেই আমার সাহিত্য-নীতি কখনও অপরের মতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়নি এবং আমার সাহিত্য-যাত্রার পথ সেই কারণেই এত বাধা-বিঘ্নিত ও এত কুৎসা-কণ্টকিত। এবং সেই একই কারণে এই ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ একাধারে এত বহু-নিন্দিত ও এত বহু-প্রশংসিত।
রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি লিখেছেন–”যে-সমাজে মানুষ নিজের সত্য আদর্শকে বজায় রাখিয়া নিজের সত্য মতকে খর্ব না করিয়াও শ্রদ্ধা লাভ করিতে পারে সেই সমাজই যথার্থ শ্রদ্ধাভাজন। যেখানে আদর পাইতে হইলে মানুষ নিজের সত্য বিকাইয়া দিতে বাধ্য হয় সেখানকার আদর আদরণীয় নহে। একে আমার দলে, কে আমার দলে নয় সেই বুঝিয়া যেখানে স্তুতি-সম্মানের ভাগ-বণ্টন হয় সেখানকার সম্মান অস্পৃশ্য। সেখানে যদি ঘৃণা করিয়া কেহ গায়ে ধূলা দেয় তবে সেই ধূলাই যথার্থ ভূষণ, যদি রাগ করিয়া কেহ গালি দেয় তবে সেই গালিই যথার্থ সংবর্ধনা।” তিনি আরো লিখেছেন–”যাহা অবহেলায় রচিত তাহা অবহেলার সামগ্রী। যাহাতে কেহ যথার্থ জীবনের সমস্ত অনুরাগ অর্পণ করে নাই তাহা কখনও অমোঘ বলে কাহারও অন্তর আকর্ষণ করিতে পারিবে না।”
আজ এই বই-এর ত্রয়োদশ সংস্করণের ভূমিকা মাত্র এই বলেই শেষ করি যে আমার এই ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ অবহেলায় রচিত নয়।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫