আট
যার মন অস্থির হয় তার জীবনে আর কোনো সুখ থাকে না। আমার ভেতরে দুটো মানুষ যেন ঢুকে বসে আছে। একজনের আকাঙ্ক্ষা, মায়ামোহমুক্ত সন্ন্যাসী হব। সংসার—শৃঙ্খলে জড়াব না কিছুতেই। সে বলছে, সংসার আমি দেখেছি। অনেকের অনেক রকম সংসার। বড়োলোকের গাড়িবাড়িঅলা সংসার আমি দেখেছি। ব্যাংকে অনেক টাকা, লকারে অনেক সোনা। মেয়েরা অলস। ছেলেরা অহংকারী কাপ্তেন। কত্তা কেবল টাকার পেছনে ছুটছে। রাতে ঘুমোতে পারে না। হার্টের দেয়ালে চর্বি। মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট। কুলকুল ঘাম। ব্লাডসুগার। হাইপ্রেসার। ভালোমন্দ কিছু খাওয়ার উপায় নেই। নানা নিয়মে বাঁধা জীবন। তিনি কামাই করেন, অন্য সবাই ওড়ায়। টাকা ওড়াবে, তবু অভাবীকে দান করবে না। বড়ো মেদবহুল শরীর; কিন্তু মনটা ইঁদুরের মতো ছোটো। গুরু ধরে দীক্ষা নিয়েছেন। পয়সা আছে বলে খাতিরও যথেষ্ট। রবিবারে ধোপদুরস্ত হয়ে ততোধিক সংকীর্ণমনা হয়ে শীর্ণ না হয়ে স্থূলকায় স্ত্রীকে নিয়ে ঝকঝকে গাড়ি চেপে আশ্রমে যান। তাঁকে প্রবেশ করতে দেখে গুরু খাড়া হয়ে বসেন। ঘ্যানঘ্যানে মধ্যবিত্ত শিষ্য—শিষ্যাদের তখন দুর্গন্ধী আবর্জনা বলে মনে হয়। ‘আরে এসো এসো, এসো মা এসো’ বলে গুরু চনমন করে ওঠেন। এই শিষ্যটি যে মালদার! আশ্রমের লাল মেঝে ভেঙে গত বছর মোজাইক করে দিয়েছেন। ঠাকুরঘরে মার্বেল বসিয়েছেন। গুরুকে ড্রাইভার সমেত একটা গাড়ি যে—কোনোদিন দিতে পারেন। কে গুরু? গুরুকে পুষছেন কে? বড়োলোক শিষ্য। এইরকম আরও শিষ্য আছেন। এঁরা সব কামধেনু। আর গুরু হলেন আশ্রমের গোশালায় সন্দেশ ফল আর পায়েসলালিত আধ্যাত্মিক জীব। একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারে বারে বলেন। খুবই মোটা দাগের সাধারণ কথা, বুঝলে। এ দেহ কী আর থাকবে বাবা! রক্ত মাংসের খাঁচা। এর ওপর এত আসক্তি কেন? পরক্ষণেই শিষ্য—সেবককে খিঁচিয়ে উঠলেন, পাঁচটা বেজে গেল এখনও আমাকে ওষুধ দিলি না! তোরা আমাকে মারবি দেখছি! জীবের মুক্তির জন্যে আরও কিছুদিন এই শরীরটার প্রয়োজন আছে রে! ছানাটা জলে গুলে সরবতের মতো করে দিস। গুরুদেব! আপনার সুগার হল কেন? পরিশ্রমের অভাব?
মূর্খটাকে কান ধরে বুঝিয়ে দে তো, এ শরীরটা কোন শরীর! এ হল ভগবতী তনু। সেই বেদমন্ত্রটা শুনিয়ে দে,
মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ
মাধ্বীর্ণঃ সন্ত্বোযধীঃ।
মধূনক্তযুতষসো মধূমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা।।
মানেটা কী? ঈশ্বরকে ধরতে পারলে সব মধু। বাতাসে মধু, সমুদ্রে মধু, রক্তে মধু। মধু চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়বে। সিদ্ধ মহামানবের এইটাই তো যন্ত্রণা। আমার এখন সুগার কত রে? দুশো কুড়ি। তাহলে বোঝো! আমার বাণীতে এত মধু আসছে কোথা থেকে? একেবারে আখ হয়ে বসে আছি! মৌচাকও বলতে পারো। আর কিছু দিন পরে দেখবে মৌমাছি আমাকে ছেঁকে ধরেছে। চুটিয়ে সাধনভজন করলে এইরকম হয় বাবা।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যে এঁদের চিনতেন। সাবধান করেছিলেন, ‘গুরু, বাবা ও কর্তা—এই তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। আমি তাঁর ছেলে, চিরকাল বালক, আমি আবার ‘বাবা’ কি? ঈশ্বর কর্তা আমি অকর্তা; তিনি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র। যদি কেউ আমায় গুরু বলে, আমি বলি, ‘দূর শালা’—গুরু কিরে? এক সচ্চিদানন্দ বই আর গুরু নাই। তিনি বিনা কোনো উপায় নাই। তিনিই একমাত্র ভবসাগরের কাণ্ডারী।’
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘আচার্যগিরি করা বড়ো কঠিন। ওতে নিজের হানি হয়। অমনি দশজন মানছে দেখে, পায়ের উপর পা দিয়ে বলে, ‘আমি বলছি আর তোমরা শুন।’ এই ভাবটা বড়ো খারাপ। তার এই পর্যন্ত! ওই একটু মান; লোকে হদ্দ বলবে, ‘আহা বিজয়বাবু বেশ বললেন, লোকটা খুব জ্ঞানী। ‘আমি বলছি’ এ জ্ঞান করো না। আমি মাকে বলি, ‘মা তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; যেমন করাও তেমনি করি; যেমন বলাও তেমনি বলি।’
সচ্চিদানন্দ ছাড়া আর কে গুরু হতে পারেন? কেউ না। মানুষ তো প্রকৃত গুরু চায় না। চায় একটা ঢং। আমার ঠাকুরের কাছে সবাই ঠান্ডা। ট্যাঁ ফোঁ করার উপায় নেই। কেমন বলছেন, ‘যাদের একটু সিদ্ধাই থাকে তাদের প্রতিষ্ঠা, লোকমান্য এইসব হয়। অনেকের ইচ্ছা হয় গুরুগিরি করি—পাঁচজনে গণে মানে—শিষ্য—সেবক হয়; লোকে বলবে, গুরুচরণের ভাইয়ের আজকাল বেশ সময়—কত লোক আসছে যাচ্ছে—শিশু সেবক অনেক হয়েছে—ঘরে জিনিসপত্র থইথই করছে। কত জিনিস কত লোক এনে দিচ্ছে—সে যদি মনে করে—তার এমন শক্তি হয়েছে যে, কত লোককে খাওয়াতে পারে!’
এরপর আমার ঠাকুর বোমা ফাটিয়েছেন। বলছেন, ‘শোন, গুরুগিরি বেশ্যাগিরির মতো।—ছাড় টাকা—কড়ি লোকমান্য হওয়া, শরীরের সেবা, এই সবের জন্যে আপনাকে বিক্রি করা। যে শরীর মন আত্মার দ্বারা ঈশ্বরকে লাভ করা যায়, সেই শরীর মন আত্মাকে সামান্য জিনিসের জন্য এরূপ করে রাখা ভালো নয়। একজন বলেছিল, সাবির এখন খুব সময়—এখন তার বেশ হয়েছে—একখানা ঘর ভাড়া নিয়েছে—ঘুঁটে রে, গোবর রে, তক্তপোশ, দুখানা বাসন হয়েছে, বিছানা, মাদুর, তাকিয়া—কত লোক বশীভূত, যাচ্ছে আসছে। অর্থাৎ সাবি এখন বেশ্যা হয়েছে তাই সুখ ধরে না। আগে সে ভদ্রলোকের বাড়ির দাসী ছিল, এখন বেশ্যা হয়েছে। সামান্য জিনিসের জন্য নিজের সর্বনাশ!’
বড়োলোকেদের ফ্যাশান হল গুরু ধরা। আর গুরুদের ধান্দা হল বড়োলোক চেলাদের খেলানো। এইসব আমি খুব দেখেছি ঠাকুর। সাষ্টাঙ্গে ভক্তিভরে প্রণাম করছি। যেমন আপনি বলেছিলেন বারে বারে, গুরু পথ দেখান। গুরুকৃপা হলে মায়া, মোহ, অজ্ঞান দূর হয়ে যায়, অষ্টপাশ ছিন্ন হয়, সেই ভেবেই আপ্লুত প্রণাম। তিনি একবার ফিরেই তাকালেন না। আমাকে পথ দেখাবেন কী, নিজেই নিজের পথ খুঁজতে ব্যস্ত! প্রোমোটার সেনমশাই এসেছেন। বহুতল বাড়ি তৈরির ব্যাবসা। একালের কবুতর সভ্যতার কপোত—কপোতীদের তিনি খোপ তৈরি করে দেন। সেই সেনমশাইকে তৈলমর্দন করছেন তিনি, বিমানে করে সপার্ষদ নেপাল যাবেন। বাবা পশুপতিনাথ ভয়ংকর টানছেন। রাতে স্বপ্নদর্শন হচ্ছে। আমার মতো অভাজনকে তিনি দেখবেন কেন? আমার না আছে ব্যাবসা, না আছে গাড়ি।
গুরুকে ঘিরে ব্যবসায়ী, বড়ো ফার্মের ডিরেকটার, বড়ো সরকারি চাকুরেদের একটা ক্লাব মতো গড়ে ওঠে। তাতে লেনদেনের সুবিধে হয়। গুরু মধ্যস্থতা করেন। সেন, তোমার কোন কাজটা আটকেছে বল না! অ প্ল্যান স্যাংশান? আরে আজই আমি বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের মল্লিককে বলে দিচ্ছি।
গুরুদেব আপনার কী কৃপা!
ঠাকুর এইসব গুরুদের দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘গুরুগিরি করা ভালো নয়। ঈশ্বরের আদর্শ না পেলে আচার্য হওয়া যায় না। যে নিজে বলে ‘আমি গুরু,’ সে হীনবুদ্ধি। দাঁড়িপাল্লা দেখ নাই? হালকা দিকটা উঁচু হয়, যে ব্যক্তি নিজে উঁচু হয়, সে হালকা। সকলেই গুরু হতে যায়—শিষ্য পাওয়া যায় না!’
আর একটা কথা তোমাকে বলেছিলুম, সেটা কি মনে আছে?
কোন প্রসঙ্গে ঠাকুর?
এই গুরু—প্রসঙ্গে!
হ্যাঁ মনে আছে। একটা গল্পের প্রসঙ্গে জের টেনেছিলেন এই বলে,
‘যদি সদগুরু হয়, জীবের অহংকার তিন ডাকে ঘুচে। গুরু কাঁচা হলে গুরুরও যন্ত্রণা, শিষ্যেরও যন্ত্রণা। শিষ্যের অহংকার আর ঘুচে না, সংসারবন্ধন আর কাটে না। কাঁচা গুরুর পাল্লায় পড়লে শিষ্য মুক্ত হয় না।’