Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একমুখী রুদ্রাক্ষ (২০০০) || Samaresh Majumdar » Page 3

একমুখী রুদ্রাক্ষ (২০০০) || Samaresh Majumdar

গলিতে ঢোকার মুখে বুড়িদির সঙ্গে দেখা। বুড়িদি তাদের বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়িদি জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, তোর মা এখন নেই বলে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? হলে বলবি।

থ্যাঙ্ক ইউ বুড়িদি। বলতে বলতে অর্জুন লক্ষ করল বুড়িদির মুখে সেই আগের মতো কালচে ছোপ জমছে। এক সময় এটা এত ঘন হয়ে গিয়েছিল যে, ঘরের বাইরে বেরোত না বুড়িদি। খুঁটিমারি জঙ্গল থেকে একটা শেকড় নিয়ে এসে সে বুড়িদিকে দিয়েছিল। সেটা ঘষে দাগটা সম্পূর্ণ চলে গিয়েছিল। কথাটা সে তুলল।

বুড়িদি বলল, দ্যাখ না, আবার ওরকম হচ্ছে। অনেক বছর বেশ ভাল ছিলাম। সেই শেকড়টাকে যে কোথায় পাওয়া যাবে কে জানে! অর্জুন ঠিক করল যদি কখনও সে খুঁটিমারির জঙ্গলে যায় তা হলে বুড়িদির জন্যে আবার চেষ্টা করবে।

কাজের লোককে দায়িত্ব দিয়ে ওরা বেরিয়ে এসেছিল। বাড়ি ফিরে দেখল তার কাজ শেষ, রান্নাও হয়ে গেছে, সে চলে যাওয়ার জন্যে তৈরি। অর্জুন তাকে সন্ধেবেলায় আসতে নিষেধ করায় সে খুব খুশি হয়ে চলে গেল।

সকাল থেকে চা ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি। আজকাল ওর খুব খিদে পায়। অর্জুন খানিকটা কেক খেয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার মন থেকে অস্বস্তিটা যাচ্ছিল না। বিশ্বনাথের ব্যাপারে অমল সোমের ওই নিস্পৃহ ভাব সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। বরং সুদর্শন ব্যানার্জিকে তার অনেকটা ঠিক বলে মনে হচ্ছে। হাবুকে অমল সোম খুব স্নেহ করেন অথচ ওর অবস্থা দেখেও তিনি শীতল হয়ে আছেন। ধর্মভাব প্রবল হলে মানুষ কি এরকম নিরাসক্ত হয়ে যায়?

স্নান করবে বলে জামা খুলতেই রুদ্রাক্ষের কথা মনে পড়ল। সে পকেট থেকে মালাটা বের করে দেখতে লাগল। রুদ্রাক্ষগুলো এত টাইট হয়ে এ ওর গায়ে বসে আছে যে, কী দিয়ে মালা গাঁথা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। রুদ্রাক্ষগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। এরকম রুদ্রাক্ষ সে কখনও দেখেনি। মায়ের কাছে কয়েকটা আছে কিন্তু তার অনেক মুখ। সে শুনেছে রুদ্রাক্ষ পরলে শরীরের নানান উপকার হয়। অর্জুন মালাটাকে নাড়তে নাড়তে অলসভাবে মাথা গলিয়ে গলায় নিয়ে এল। ঠিক বুকের ওপর মালাটা শেষ হচ্ছে।

হঠাৎ শরীর গরম হয়ে উঠল। জ্বালা নয়, একটা তপ্ত হওয়া যেন ঢেউয়ের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল সমস্ত শরীরে। অর্জুন ব্যাপারটা বুঝতে পারার আগেই মাটিতে পড়ে গেল সশব্দে। পড়ে স্থির হয়ে থাকল অনেকক্ষণ।

যখন সে সংবিৎ পেল তখন মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা, শরীরে কোনও উত্তাপ নেই। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। ব্যাপারটা কীরকম হল? হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক তারে হাত পড়লে মানুষ যেভাবে ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, তারও তো সেই অবস্থা হয়েছিল। সে রুদ্রাক্ষমালায় হাত রাখল। একদম স্বাভাবিক, অথচ এই মালা পরার পরই কাণ্ডটা ঘটেছিল। আর একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, ওইভাবে মাটিতে পড়া সত্ত্বেও তার শরীরে কোনও আঘাত লাগেনি।

অর্জুনের মনে হল ঘটনাটা অমল সোমকে জানানো উচিত। রুদ্রাক্ষের এই মালার কোনও ক্ষমতা আছে কিনা সেটা উনি বলতে পারবেন। সে আবার পোশাক বদলে সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে বাইরে পা বাড়াল। রামগোপালবাবু আসছেন। ওদের পাড়ার খুব মাতব্বর লোক। দিনবাজারে বিশাল কারবার। ভদ্রলোক যথেষ্ট কৃপণ এবং কাউকে সাহায্য করেন না বলে দুর্নাম আছে। অর্জুন দূর থেকেই বলল, রামগোপালকাকা, ভাল আছেন?

রামগোপালবাবু দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মুখ ভেটকে হাসলেন যার মানে দাঁড়ায়, এই চলে যাচ্ছে আর কী! কিন্তু অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, এই শখের টিকটিকিটার মতলব কী? এমনি এমনি জিজ্ঞেস করছে বলে মনে হয় না।

গলাটা অবিকল রামগোপালবাবুর। অথচ তিনি এখনও মুখ ভেটকে ঘাড় কাত করে আছেন। ওভাবে কথা বলা যায় না। এ কী রে! এ আবার আমাকে ওভাবে দেখছে কেন? রামগোপালবাবুর মাথা সোজা হল।

অর্জুন মুখে বলল, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। হ্যাঁ, আপনার কয়েকটা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছি। প্রথম কথা, আমি টিকটিকি নই। টিকটিকি বলা হত গুপ্তচরদের। পুলিশের স্পাই হলে তাকে। দ্বিতীয়ত, আমার কোনও মতলব নেই, আমি এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা, চলি।

রামগোপালবাবুর চোয়াল ঝুলে গেল। অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, এইটুকুনি ছেলের কী লম্বা লম্বা বাত। তুই টিকটিকি কিনা তাতে আমার কী লাভ!

অর্জুন মাথা নাড়ল, কী যে বলেন রামগোপালকাকা! রামগোপালবাবু এবার মুখ খুললেন, তুমি কি ছায়ার সঙ্গে কথা বলছ? তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি একটাও কর্থী বলিনি।

অর্জুন হাসল, তা হলে আমি ভুল শুনেছি।

কী শুনেছ তুমি?

আমি লম্বা লম্বা বাত বলি। আমি টিকটিকি কিনা তাতে আপনার কী লাভ! নিশ্চয়ই ভুল শুনেছি। আচ্ছা। অর্জুন হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করল যে জায়গায় রামগোপালবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখান থেকে আর নড়তে পারছেন না।

রিকশা নিল অর্জুন। তার বাইকটা ঘরে বন্দি হয়ে রয়েছে। বন্দি করে গেছেন মা। সে বাইক চালায় বলে তাঁর খুব টেনশন হয়। তিনি বাইরে গেলে ছেলের যদি অ্যাকসিডেন্ট হয় সেই ভয়ে চাবি সরিয়ে রেখেছেন।

রিকশা চলছিল। হঠাৎ কানে এল, এই বাবুটা খুব ভাল। মানুষের উপকার করে।

অর্জুন চমকে চারপাশে তাকাল। তারপর সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কদমতলায় থাকো?

না বাবু। তিস্তার চরে আমার বাসা। আপনি এই প্রথম আমার রিকশায় উঠলেন।

অবিকল এক গলা। অর্থাৎ সে রিকশাওয়ালার মনে মনে বলা কথা শুনেছে। এটা কী করে সম্ভব? রিকশা ততক্ষণে থানার মুখে পড়েছে। থানার গেটে একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে, জিপের পাশে সুদর্শনবাবু। সম্ভবত কারও জন্যে অপেক্ষা করছেন। অর্জুন রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল।

সে এগিয়ে যেতে সুদর্শনবাবু বললেন, এই যে মশাই, সুখবর দিচ্ছি। মূল আসামি ধরা পড়ে গেছে। ওকে জেরা করতে মণ্ডলপাড়া যাচ্ছি। যাবেন নাকি? অর্জুন কান পাতল। না, ভদ্রলোক মনে মনে অন্য কথা বোধ হয় বলেননি। অদ্ভুত সে কিছু শুনতে পেল না।

কজন ধরা পড়েছে?

আপাতত বিশ্বনাথকে ধরেছে লোক্যাল থানা। কান টানলেই মাথা আসবে। মিস্টার সোম বলেছেন ওকে ধরলে আমরা প্রমাণ করতে পারব না। উনি যে ঠিক বলেননি সেটা ওঁকে জানাবেন। সুদর্শনকে খুব খুশি দেখাল।

বিশ্বনাথকে দেখার ইচ্ছে হল। ট্রেন-ডাকাত নয়, এক রাতের মধ্যে মণ্ডলপাড়া থেকে খবর পেয়ে জলপাইগুড়ি চলে এসে অমল সোমের বাড়িতে যে হামলা করেছে তার দর্শন পেতে আগ্রহী হল সে।

পুলিশের জিপে সে পৌঁছে গেল শহরতলির থানায়। সেখানকার প্রৌঢ় দারোগার সঙ্গে সুদর্শন অর্জুনের পরিচয় করিয়ে দিতেই লোকটা কৃতার্থ হয়ে হাসল কিন্তু অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, এই গোয়েন্দাটা আবার এখানে কেন? যত্তসব ঝামেলা।

অর্জুন কিছু বলল না। তার মজা লাগছিল। দারোগাবাবুর ঘরে বসার পর ভদ্রলোক বললেন, কিছুতেই মুখ খুলছে না। অনেক চেষ্টা করেছি। শেষপর্যন্ত একটু রগড়ালাম কিন্তু কাজ হল না। আমার মনে হচ্ছে কোথাও ভুল হয়েছে। এ ছছাকরা যে ট্রেন-ডাকাতি করে সে কথা গ্রামের লোকেরও জানা নেই।

অর্জুন জিজ্ঞেস না করে পারল না। ওদের বাড়ি সার্চ করেছেন? দারোগা তাকালেন। অর্জুন শুনতে পেল, ও ছোকরা আমাকে কী ভাবে? দারোগা হাসলেন,একটা সুচও বাকি রাখিনি। লুটের জিনিস পাওয়া গেলে তো হয়েই যেত।

অর্জুন বলল, কিন্তু বিশ্বনাথের বাবা বলেছিলেন ও অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করে এবং জিনিসপত্র একটা ঘরে রাখে। এই ব্যবসাটা তো ভাঁওতা।

হতে পারে। কিন্তু আমি সেই ঘরে কিছুই পাইনি। এখন এই অবস্থায় কোর্টে পাঠালে তো জাজ আমার বারোটা বাজিয়ে দেবে।

সুদর্শন বললেন, ছেলেটাকে এখানে আনুন তো?

একজন সেপাইকে সেই হুকুম দিয়ে দারোগা বললেন, এমনভাবে ওকে মারধোর করবেন না যা ও কোর্টকে দেখাতে পারে। ইতিমধ্যেই আমাকে ছোকরা মানবাধিকার কমিশনের নাম দুবার শুনিয়েছে।

সুদর্শন অবাক হলেন, বাঃ। এ তো বেশ সেয়ানা বলে মনে হচ্ছে। বিশ্বনাথকে নিয়ে এল দুজন সেপাই। তার হাত খোলা কিন্তু কোমরে দড়ি বাঁধা রয়েছে। দেওয়ালের পাশে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।

অর্জুন দেখল ছেলেটার বয়স একুশের বেশি নয়। রোগা লম্বা, গায়ের রং শ্যামলা। পরনে পাজামা আর ফুলশার্ট। সুদর্শন বললেন, দ্যাখো বিশ্বনাথ, তুমি ধরা পড়ে গেছ। ট্রেন-ডাকাতের দলে তুমি ছিলে। এই সাহেবের কাছে সেটা যতই অস্বীকার করো কিন্তু যা সত্যি তা তো সবসময় সত্যি। আজ না হয় কাল তা প্রমাণিত হবে। তখন যা শাস্তি পাবে সেটার কথা ভাবে। তার চেয়ে যদি তুমি এখনই স্বীকার করে নাও আর যারা দলে ছিল তাদের নাম বলে দাও তা হলে আমরা তোমাকে ঠিক রাজসাক্ষী করে দেব। রাজসাক্ষী হলে তোমার শাস্তি কম হবে, নাও হতে পারে।

বিশ্বনাথ কোনও জবাব দিল না। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

সুদর্শন একটু অপেক্ষা করে বললেন, আমি জানি তুমি তোমার সঙ্গীদের ভয় পাচ্ছ। ওরা তোমার ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু পুলিশ যদি তোমার পাশে থাকে

তা হলে ওরা কী করতে পারে? উত্তর দাও।

অর্জুন খানিকটা দূরে বসে শুনছিল। হঠাৎ মনে হল ছেলেটার কাছে যাওয়া দরকার। সে চেয়ার ছেড়ে কাছে এগিয়ে যেতেই শুনতে পেল, আমি কিছু জানি না, কিছু করিনি, এর বেশি একটা কথাও বলব না।

অর্জুন দাঁড়িয়ে গেল। বিশ্বনাথ ঠেটি টিপে দাঁড়িয়ে আছে।

সে মৃদু গলায় ডাকল, এই যে ভোলানাথ।

বিশ্বনাথ তাকাল, জবাব দিল না। কিন্তু অর্জুন শুনল, এ কেন ভোলানাথ বলল? যাই বলুক আমি কিছু জানি না।

ওর নাম বিশ্বনাথ, ভোলানাথ নয়। দারোগাবাবু শুধরে দিলেন।

এই সময় দুজন লোক ঘরে চলে এল। একজন বলে উঠল, এই তো, এই তো আমার ছেলে। হ্যাঁ রে, তোকে কেউ মারধোর করেনি তো?

বিশ্বনাথ জবাব দিল না। দ্বিতীয় লোকটি বলল, দারোগাবাবু, আমি ওর উকিল। আমার মক্কেলকে কোন চার্জে ধরে নিয়ে এসেছেন জানতে পারি?

কোর্টে গিয়ে জানবেন।

না। আপনাকেই বলতে হবে। কারণ আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে কোনও স্পেসিফিক চার্জ আপনার নেই। কাল রাত্রে দুটো লোক ওদের গ্রামে গিয়ে রটিয়ে দিয়েছে যে ওরা ট্রেন-ডাকাত, সঙ্গে সঙ্গে ওকে আপনারা অ্যারেস্ট করে নিয়ে এলেন? উকিল ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিত।

সুদর্শন চুপচাপ শুনছিলেন। বললেন, মাননীয় উকিলবাবু, ওর বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ আছে। গতরাতে দলবল নিয়ে ও আমার এলাকায় একটি বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। গৃহকর্তাকে না পেয়ে তার কাজের লোককে জখম করেছে। আর এইসব ঘটনার সাক্ষী আমাদের হাতে আছে। আপনি জামিন চাইলে কোর্টে আবেদন করতে পারেন।

কাল রাত্রে?

হ্যাঁ।

অদ্ভুত ব্যাপার। কাল সারারাত ও শিলিগুড়ি হাসপাতালে জেগে বসে ছিল। ওর বন্ধুর বাবা মৃত্যুশয্যায়। ও যে সেখানে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ছিল তার সাক্ষী অনেকেই। ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে কথা বললেই জানা যাবে বিশ্বনাথ সেখানে ছিল কিনা। তা হলে নিশ্চয়ই ওর পক্ষে আপনার এলাকায় গিয়ে একই রাত্রে ওইসব কাজ করা সম্ভব নয়। তাই না? উকিল খুব দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশ্ন করলেন।

স্থানীয় দারোগা বললেন, তা হলে তো ব্যাপারটা জটিল হয়ে গেল।

কোনও জটিল ব্যাপার নয়। একজন নিরপরাধ লোককে আপনারা জোর করে থানায় ধরে রাখতে পারেন না। উকিল জানালেন।

সুদর্শন বললেন, পারি। সন্দেহজনক যে-কোনও মানুষকে আমরা থানায় ধরে আনতে পারি। আমরা ওকে আজই কোর্টে প্রোডিউস করে বিচারকের অনুমতি চাইব আরও কিছুদিন তদন্তের জন্যে পুলিশ হেপাজতে রাখতে। আপনারা বিরোধিতা করে যদি জামিন পেয়ে যান, ভাল কথা।

ওর বিরুদ্ধে এফ আই আর আছে?

আছে। জলপাইগুড়ির কোর্টে আসুন।

স্থানীয় দারোগা বিশ্বনাথকে সুদর্শনের হাতে ছেড়ে দিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। হাতকড়ি পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে সেপাইদের সঙ্গে জিপে বসিয়ে ওকে জলপাইগুড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন সুদর্শন। তাঁর পাশে বসে ছিল অর্জুন। কেউ কোনও কথা বলছে না। ফাটাপুকুরের কাছে আসতেই অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, বদমাশটা নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গেছে। ও যদি রেল গেটে এসে দাঁড়ায়।

অর্জুন চমকে তাকাতেই বিশ্বনাথের সঙ্গে চোখাচোখি হল। একটু বাদেই জিপ চলে এল রেলগেটের সামনে। এখন ট্রেনের সময় নয় বলে গেট খোলা। অর্জুন সুদর্শনকে বলল, জিপ থামাতে বলুন তো।

ড্রাইভার জিপ থামাতেই অর্জুন নীচে নেমে দাঁড়াল। এখানে কেউ নেই। দূরে দোকানগুলোর সামনে কয়েকজন অলসভাবে রয়েছে। অর্জুন জিপের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে বলল, হারাধন তো আসেনি। খবর পায়নি বোধ হয়।

শোনামাত্র বিশ্বনাথ যে অবাক হয়েছে তা বোঝা গেল। সুদর্শন জিজ্ঞেস করলেন, কে হারাধন?

বিশ্বনাথকে জিজ্ঞেস করুন।

বিশ্বনাথ মুখ ফিরিয়ে নিতেই অর্জুন শুনতে পেল, এই লোকটা আমার মনের কথা জানল কী করে? ম্যাজিক জানে নাকি?

বিশ্বনাথ, হারাধন কে? সুদর্শন গম্ভীর।

আমি জানি না।

পুলিশের জিপকে দাঁড়াতে দেখে দু-তিনজন কৌতূহলী এগিয়ে এসেছিল। অর্জুন তাদের সামনে গিয়ে বলল, ভাই, একটু হারাধনকে খবর দেবেন। খুব দরকার।

একজন বলল, হারু তো ওই চায়ের দোকানের সামনে বসে আছে।

অর্জুন চেঁচিয়ে ডাকল, সুদর্শনবাবু, চলে আসুন।

সুদর্শন গাড়ি থেকে নেমে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই বদমাশ লোকটাকে আপনি কী করে জোগাড় করলেন?

পরে বলব। একটু সাবধানে চলুন। আপনার সঙ্গে অস্ত্র আছে তো?

ওটা না থাকলে অস্বস্তি হয়।

চায়ের দোকানের সামনে পৌঁছে ওরা দেখল, গোটা তিনেক ছেলে গল্প করছে। কাউকে দেখতে অপরাধীর মতো নয়। সুদর্শন সাদা পোশাকে ছিলেন। ওরা কথা থামিয়ে তাকাল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, হারাধন কে?

আমি, কেন?

তোমার বন্ধু বিশ্বনাথ গাড়িতে বসে আছে, ডাকছে।

কোন বিশ্বনাথ?

মণ্ডলপাড়ার বিশ্বনাথ।

আমি চিনি না। ওই নামে আমার কোনও বন্ধু নেই।

এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে যার নাম হারাধন?

খোঁজ নিন, আমি জানি না।

ওর পাশের ছেলেটি বলল, আর কোনও হারাধন এখানে নেই।

না থাকলে আমি কী করব? আমি বিশ্বনাথ বলে কাউকে চিনি না।

সুদর্শন অর্জুনের দিকে তাকালেন। অর্জুন আরও দুপা এগিয়ে যেতেই শুনতে পেল, এরা নিশ্চয়ই পুলিশ। ভোলানাথ নিশ্চয়ই ধরা পড়ে নাম বলে দিয়েছে। কী করে পালানো যায়।

অর্জুন বলল, ভোলানাথের নামই তো বিশ্বনাথ, তাই না? শোনামাত্র ছেলেটির চোয়াল ঝুলে গেল।

অর্জুন বলল, বুঝতেই পারছ আমাদের কোনও ভুল হয়নি। জোর জবরদস্তি করলে সবাই জেনে যাবে। তার চেয়ে ভদ্রভাবে চলো, ওই জিপে তোমার বন্ধু বসে আছে। আমরা কোনও ঝামেলা করতে চাই না।

ছেলেটি বাধ্য হল উঠে দাঁড়াতে। সুদর্শন বললেন, দৌড়ে পালাবার চেষ্টা কোরো না। পেছন থেকে গুলি ছুড়লে মাথায় লাগতে পারে। বলতে বলতে তিনি অস্ত্রটা বের করে দেখালেন।

একটা কথাও না বলে হারাধন রাস্তাটা হেঁটে এসে জিপে উঠতেই সুদর্শনের নির্দেশে সেপাইরা তাকে হাতকড়া পরিয়ে দিল। বিশ্বনাথের পাশে বসেই হারাধন চাপা নিষ্ঠুর গলায় বলে উঠল, তুই আমাকে ধরিয়ে দিলি, এর শাস্তি তুই কল্পনাও করতে পারবি না।

ইতিমধ্যে পিলপিল করে মানুষ ছুটে আসছে। স্থানীয় ছেলে হারাধনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে এই খবরটা দ্রুত চাউর হয়ে যাচ্ছে। অর্জুন বলল, হারাধনের বাড়িতে চলুন, ডাকাতির জিনিসগুলো ওখানে থাকলেও থাকতে পারে।

মাথা নেড়ে ড্রাইভারকে সোজা জোরে চালাতে বলে সুদর্শন গলা নামালেন, খেপেছেন? এই ক্রাউড পেছন পেছন যাবে। কেউ যদি খেপিয়ে দেয় তা হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ছিনিয়ে নেবে, আমার সঙ্গে ফোর্স নেই।

ওদিকে পেছনের সিটে বন্দি অবস্থায় হারাধন সমানে গালাগালি করছে। বিশ্বনাথকে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বনাথ বলল, আমি তোকে ধরিয়ে দিইনি।

মিথ্যে কথা। তুই না বললে এখানে গাড়ি থামল কেন? ওরা আমার খোঁজে চায়ের দোকানে কেন গেল?

আমি মুখে কিছু বলিনি। এদের জিজ্ঞেস কর। পাশে বসা একজন সেপাই হাসল, না। এ কিছু বলেনি। কথাই বলেনি।

না বললে এরা জানল কী করে?

বিশ্বনাথ করুণ গলায় বলল, জানি না। আমি মনে মনে বলেছিলাম অথচ উনি শুনে ফেললেন?

হারাধন রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বলল না। অর্জুন শুনতে পেল, কথাটা ঠিক। আমি মনে মনে ভোলানাথ বলেছিলাম অথচ এই লোকটা শুনতে পেয়েছিল। সে একদম চুপ হয়ে যাওয়ার আগে ফিসফিস করে বিশ্বনাথকে বলল, শোন, তুই কোনও কথা মনে মনে ভাববি না।

জলপাইগুড়ির সদর থানায় না আসা পর্যন্ত কোনও কথাবার্তা হল না। সেকেন্ড অফিসারকে ওদের কাগজপত্র তৈরি করতে বলে সুদর্শন অর্জুনের সঙ্গে আলাদা বসলেন, কী ব্যাপার বলুন তো? অনেকক্ষণ ধরে আমি কৌতূহল চেপে আছি।

কী ব্যাপারে বলুন?

আপনি রেলগেটে গাড়ি থামাতে বললেন, হারাধনের নামও সহজে উচ্চারণ করলেন। অথচ আমি নিশ্চিত এব্যাপারে আপনার আগে কিছু জানা ছিল না।

আপনি ঠিকই বলেছেন। মানুষ যা চিন্তা করে তা কেউ কেউ পড়তে বা শুনতে পান, এটা জানেন তো?

শুনেছি। থট রিডিং গোছের কিছু।

ওই ধরে নিন। অর্জুন হাসল, এই যেমন আপনি জিপে বসে এই কথাটা অনেকবার ভেবেছেন। আমি ম্যাজিক দেখাচ্ছি বলে মন্তব্য করেছেন।

অ্যাঁ? সেটাই আপনি শুনতে পেয়েছেন। সুদর্শন অবাক!

অর্জুন বলল, কিন্তু এটা ম্যাজিক নয়। অর্জুন উঠতে চাইল।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমাকে শিখিয়ে দেবেন?

এটা কাউকে শেখানো যায় না। গুরু দয়া করলে হয়ে যায়।

গুরু? আপনার গুরু কে?

অমল সোম।

যাচ্চলে! আপনি বুঝতে পারছেন না অর্জুন, এই ব্যাপারটা আমাদের ডিপার্টমেন্টে কী চমৎকার কাজে আসবে। অনেক ঘুঘু অপরাধীকে ধরার পর মারধোর দিয়েও মুখ খোলাতে পারি না। স্রেফ প্রমাণের অভাবে তারা পার পেয়ে যায়। ওদের মনের কথা পড়তে পারলে শাস্তি দিতে কোনও সমস্যা হবে না। আন্তরিক গলায় বললেন সুদর্শন।

আমি অমলদাকে আপনার প্রস্তাবের কথা বলব।

প্লিজ বলুন। দরকার হলে এস পি সাহেবকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে যেতে পারি আমি। এই আবিষ্কারের কথা জানাজানি হলে সমস্ত পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে। সুদর্শন যেন স্বপ্ন দেখছিলেন।

কিন্তু ওদের আজ কোর্টে তুলবেন যখন, তখন চার্জশিট দেবেন না?

সময় চাইব। আগে হারাধনকে রগড়াই, যদি খবর বের হয়। আমি বুঝতে পারছি এরাই ট্রেনে ডাকাতি করেছে কিন্তু এখনও হাতে কোনও প্রমাণ নেই। গাড়িতে উঠে বিশ্বনাথকে দেখে হারাধন যেরকম রি-অ্যাক্ট করল তাতেই স্পষ্ট, ওরা একটা অপরাধ করেছে।

কিন্তু শুধু এই কথাগুলো কি কোর্টে বিশ্বাস করবে?

না।

অমলদার বাড়িতে হামলা করে হাবুকে মারধোর করার অপরাধে বিশ্বনাথকে আপনি ধরে রাখতে পারবেন না। ওর উকিল ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে গতরাতে ও কোথায় ছিল।

হ্যাঁ। নিশ্চয়ই সাক্ষী রাখবে।

তা হলে? হামলা করল কে? বিশ্বনাথ নিজে না এসে ওর বন্ধুদের পাঠিয়েছিল? সেই বন্ধুদের মধ্যে হারাধন ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। অর্জুন এবার উঠে দাঁড়াল।

সুদর্শন মাথা নাড়লেন, আমার মনে হচ্ছে বিশ্বনাথ কাল রাতে এই শহরে আসেনি। সে যখন শুনেছে ট্রেন ডাকাতির ব্যাপারে মিস্টার সোম তার খোঁজে গ্রামে গিয়েছিলেন, ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে নিজের ঠিকানা দিয়ে এসেছেন, তখন সে যদি হামলা করতে আসে তা হলে পুলিশ আগে তাকেই সন্দেহ করবে। ও চলে গেছে শিলিগুড়িতে। সেখানে থাকার অজুহাত খাড়া করেছে এবং বন্ধুদের পাঠিয়েছে।

কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ অর্জুনের মনে হল ঘটনাটা এইরকম সহজভাবে ঘটেনি। বিশ্বনাথের বাড়ি এবং গ্রাম সে দেখেছে। বিশ্বনাথকেও। একটু রোগা হলেও ওর শরীরে শক্তি আছে। পড়াশুনো বেশি করেনি। কিন্তু এধরনের অপরাধ অর্গানাইজ করার মতো বুদ্ধি এবং দক্ষতা ওর কিছুতেই থাকতে পারে না।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনারা ওদের কখন কোর্টে তুলবেন?

সেকেন্ড হাফে।

কোন চার্জে?

ট্রেন ডাকাতি এবং বাড়িতে হামলা। দুটো জুড়ে দেব।

আমি একবার বিশ্বনাথের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে পারি?

নিশ্চয়ই। সুদর্শন হুকুম দিলেন বিশ্বনাথকে আনার জন্যে।

অর্জুন বলল, ওদের কি একসঙ্গে রেখেছেন?

না। একসঙ্গে থাকলেই তো পরামর্শ করবে।

বিশ্বনাথকে নিয়ে আসা হল। তাকে চেয়ারে বসতে বললে সে ইতস্তত করে বসল। অর্জুন বলল, বিশ্বনাথ, গতকাল আমি আর আমার দাদা তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে শুনলাম গ্রামের লোকজন তোমার বাবার ওপর খুব অসন্তুষ্ট। ব্যাপারটার কারণ কী বলো তো?

বাবাকে জিজ্ঞেস করলে পারতেন।

আমরা তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি রাত সাড়ে নটার পরে। তুমি নিশ্চয়ই তারও পরে বাড়িতে ফিরে আমাদের কথা শুনেছ। তাই তো?

অর্জুন শুনতে পেল, বিশ্বনাথ ভাবছে, আমি কোনও জবাব দেব না।

তুমি ভাবলে কোনও জবাব দেবে না, তাই তো?

বিশ্বনাথ চোখ তুলে তাকিয়ে ভাবল, এই লোকটা আমার মন পড়তে পারছে কী করে? যা ভাবলাম তা জেনে ফেলছে? আমি তা হলে আর ভাবব না। দুর, ভাবব না বললেই পারা যায় নাকি? যদি হারাধন মুখ খোলে!

অর্জুন মাথা নাড়ল, ঠিক কথা। হারাধন মুখ খুললে তুমি খুব বিপদে পড়ে যাবে। তার চেয়ে আমরা তোমার সঙ্গে গেল রাত্রে গ্রামে ফিরে যাই। গিয়ে বৈদ্যনাথবাবুর সামনে দাঁড়াতেই তিনি তোমাকে কী বলতে পারেন? এখন টাকাপয়সা রোজগার করছ আর তোমার বাবা যেহেতু ওই বস্তুটিকে খুব ভালবাসেন তাই তোমাকে বকাঝকা অথবা মারধোর না করে সতর্ক করেন। বলেন তোমার স্টোররুমে যা সাপ্লাই-এর জিনিস ছিল সব তিনি বের করে আলাদা রেখে দিয়েছেন। কিন্তু তোমাকে তখনই জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় অমল সোমের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বলবেন। ঠিক বললাম?

ঠোঁট টিপে থাকল বিশ্বনাথ। আর মনে মনে বলল, আমি কোনও কিছু ভাবব। যা বলার বলে যাক।

তারপর তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে দলবল জুটিয়ে একটা গাড়ি ম্যানেজ করে চলে এলে জলপাইগুড়িতে। ঠিকানা খুঁজে অমল সোমের বাড়িতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাউকে না পেয়ে ওঁর কালা বোবা চাকরটাকে মারলে। ঠিক? সজোরে মাথা নাড়ল বিশ্বনাথ, না, আমি জলপাইগুড়িতে যাইনি।

তা হলে শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছিলে।

হ্যাঁ।

কিন্তু শিলিগুড়িতে নেমেই তুমি হাসপাতালে যাওনি। কারণ সেখানে তোমার কোনও বন্ধুর বাবা অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন একথা তুমি জানতে না। তুমি কি কাউকে ফোন করে ঘটনাটা বলেছিলে, না নিজে গিয়েছিলে?

আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম।

কেন? সেখানে তো তোমার যাওয়ার কথা নয়। যদি তেমন কেউ অসুস্থ থাকত যার জন্যে রাত জাগা যায় তা হলে তুমি সন্ধে থেকেই সেখানে থাকতে, মণ্ডলপাড়ায় ফিরে যেতে না।

অর্জুন শুনল বিশ্বনাথ ভাবছে, কথাটা ঠিক বলছে! মহামুশকিল হয়ে গেল! লোকটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কথার চাপ দিচ্ছে।

অর্জুন হাসল, তোমার তাই মনে হচ্ছে? আমি কথার চাপ দিচ্ছি?

বিশ্বনাথ সোজা হয়ে বসল, আপনি কে?

আমার নাম অর্জুন।

আপনি এইভাবে মনের কথা বলেন কী করে?

কোথায় আর বললাম তুমি তো মনে মনে ভাবছ না কাল রাত্রে শিলিগুড়িতে পৌঁছে ঠিক কী করেছিলে।

আমি হাসপাতালে ছিলাম।

হ্যাঁ। সেটা আমিও বিশ্বাস করি। তুমি জলপাইগুড়িতে যাওনি।

অর্জুন শুনল বিশ্বনাথ ভাবছে, সত্যি কথা বলছে কিনা কে জানে!

বিশ্বনাথকে ফেরত পাঠিয়ে সে সুদর্শনকে বলল হারাধনকে আনাতো সুদর্শন সেই আদেশ দিয়ে বলল, আপনি তো আমার কেস খারাপ করে দিচ্ছেন অর্জুন। আপনি বিশ্বাস করেন বিশ্বনাথ জলপাইগুড়িতে আসেনি?

হ্যাঁ।

তা হলে তো ওর বিরুদ্ধে হামলার মামলা টিকবে না।

না। কারণ কোনও বুদ্বুও দল নিয়ে আসবে না হামলা করতে যখন সে জানে তার গোপন খবর লোকটার জানা। কিন্তু হামলা হয়েছিল তার কারণ ট্রেনডাকাতির একমাত্র সক্রিয় সাক্ষীকে সরিয়ে দেওয়া দরকার বলে ওর মনে করেছিল। অর্জুন কথা শেষ করতেই হারাধনকে নিয়ে সেপাই ঢুকল। তাকে আদর করে বসিয়ে অর্জুন বলল, এখন তুমি কী করবে তা তোমাকেই ঠিক করতে হবে হারাধন।

মানে?

বিশ্বনাথ বলে গেছে সে জলপাইগুড়িতে হামলা করতে আসেনি। ওর বাবার কাছে গত রাত্রে মণ্ডলপাড়ায় ফিরে যখন জানতে পারল ট্রেনডাকাতির দুজন সাক্ষী বাড়িতে খোঁজ করতে এসেছিল তখনই ও গ্রাম ছেড়ে শিলিগুড়িতে ফিরে যায়। শিলিগুড়িতে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে। তুনি তখন ওখানেই ছিলে। আজ সকালে বাড়ি ফেরার প্ল্যান ছিল। খবরটা শুনে তুমিই বন্ধুদের জোগাড় করে একটা গাড়ি নিয়ে মাঝরাতে জলপাইগুড়িতে যাও সাক্ষীকে সরিয়ে দিতে। সাক্ষীকে না পেয়ে কাজের লোককে মারধোর করে ফেরার পথে রেলগেটের কাছে নেমে গিয়েছ, কারণ তার কাছেই তোমার বাড়ি। অর্জুন হাসল।

মিথ্যে কথা। মাথা নাড়ল হারাধন। কোনটা মিথ্যে?

আমি কিছু জানি না।

তুমি যে কাল সারারাত বাড়ি ছিলে না, ভোরে ফিরেছ, এ খবর এতক্ষণ আমরা পেয়ে গেছি। এটাও মিথ্যে?

হারাধন চুপ করে রইল। কিন্তু সে কিছু ভাবছে না?

চুপ করে থাকলে তোমার উপকার হবে না। কাল রাত্রে শিলিগুড়িতে বিশ্বনাথ তোমার সঙ্গে দেখা করেনি?

না।

তুমি তা হলে এব্যাপারে কিছু জানো না?

না।

গতকাল ট্রেনে ডাকাতির একটু আগে বিশ্বনাথকে ভোলানাথ বলে ডাকোনি? যার জন্যে বিশ্বনাথ তোমার ওপর রেগে গিয়েছিল!

হারাধন এমনভাবে চমকে উঠল যে, সুদর্শন পর্যন্ত হেসে উঠলেন, আর লুকিয়ে লাভ নেই ভাই। বুঝতেই পারছ বিশ্বনাথ একটু আগে সব কথা ফাঁস করে গেছে।

হারাধন মাথা নিচু করল। বোঝাই যাচ্ছিল ওর মনে ঝড় বইছে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কাল ট্রেনে তোমরা কজন দলে ছিলে?

আটজন। মিনমিনে গলায় জবাব এল।

আটজনই কি বন্ধু?

না। কাজ করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল।

তুমি রেলগেট, বিশ্বনাথ মণ্ডলপাড়ার, আর বাকিরা?

কেউ বেলাকোবা, কেউ আমবাড়ি ফালাকাটার, বাকিরা শিলিগুড়ির।

এর আগে কতবার ট্রেনডাকাতিতে ছিলে তোমরা?

আমি সেকেন্ড টাইম।

কী করে এদের সঙ্গে যোগাযোগ হল?

সিনেমা দেখতে গিয়ে।

কীরকম?

শিলিগুড়ির মেঘদূত সিনেমায় মিঠুনের বই এসেছিল। অ্যাডভান্স হাউসফুল ছিল, কারেন্ট টিকিটের লাইন ব্ল্যাকাররা ম্যানেজ করে নিচ্ছিল বলে আমার সঙ্গে ঝামেলা হয়। আমি দুজনকে খুব মেরেছিলাম। তখন একজন এসে মিটিয়ে দিয়ে টিকিট দিল। সিনেমা দেখে বেরনোর সময় লোকটা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল একটা রেস্টুরেন্টে। চা, কাটলেট খাইয়ে আমার খবর নিল। আমি বেকার শুনে কাজ পাইয়ে দেবে বলে। পরদিন লোকটা রেলগেটে এসে আমার বাড়িতে যায়। সব দেখেশুনে বলে পরদিন শিলিগুড়িতে যেতে।

শিলিগুড়ির কোথায়? হারাধন তাকাল, আমি মরে যাব। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। বস্ বলে দিয়েছে কেউ পুলিশের কাছে মুখ খুললে তার জান নিয়ে নেওয়া হবে।

কেউ জানবে না। বস্ জানবে কী করে?

এইসব কথা আপনারা কোর্টে বললেই বস্ জেনে যাবে।

তোমাকে কথা দিচ্ছি কোর্টে কিছু বলব না আমরা।

আপনি পুলিশ?

না। আমি পুলিশ নই। উনি এখানকার চার্জে আছেন এবং আমি জানি উনি আমার কথা রাখবেন।

হারাধন মাটির দিকে তাকাল। অর্জুন শুমতে পেল, বলেই ফেলেছি যখন তখন আর চেপে গিয়ে লাভ কী! ওরা যদি কোর্টে কিছু না বলে তা হলে আমিও বলব আমি কিছু বলিনি।

অর্জুন হাসল, ঠিক কথা। তুমি ঠিক ভাবছ ভাই।

হারাধন হাউমাউ করে উঠল, আচ্ছা, আমি যা ভাবছি তা আপনি বুঝতে পারছেন কী করে বলুন তো?

ভগবানের আশীর্বাদে। হ্যাঁ, বাকিটা বলো!

হারাধন কয়েকবার নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ওই মেঘদূত সিনেমার সামনে।

তারপর?

সেখানে ওই লোকটা ছিল।

কী নাম লোকটার?

মানাভাই।

বাঙালি?

জানি না। বাংলা নেপালি হিন্দি। এমনকী ইংরেজিতেও কথা বলে।

বেশ। মানাভাই তোমাকে কী বলল?

বলল, আমার গায়ে জোর আছে, সাহসও আছে, আমি কেন আরও বেশি রোজগারের ধান্দায় না গিয়ে চাকরির চেষ্টা করছি। ওর বস্ নাকি আমাদের মতো বেকার ছেলেদের উপকার করার জন্যে একটা ক্লাব করেছেন। আমি ইচ্ছে করলে সেই ক্লাবের মেম্বার হতে পারি।

তারপর?

মানাভাই আমাকে নিয়ে গেল সেবক রোডের একটা বাড়িতে। বাড়িটায় ঢোকার গেটের ওপর একটা সাইনবোর্ড ছিল। তাতে চায়ের ব্যবসা করার কথা লেখা ছিল। সামনে অনেক চায়ের বাক্স ছিল। পেছনের দরজা দিয়ে যে ঘরে মানাভাই আমাকে নিয়ে গেল সেখানে ছজন ছেলে বসে ছিল।

বিশ্বনাথ তাদের মধ্যে ছিল?

না। ও পরে এসেছিল।

তারপর কী হল?

ওখানে একজন মাস্টারমশাই এলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমরা ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে গরিব হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না কি ভাগ্যকে জয় করতে চাই। প্রথমটা চাইলে এখনই চলে যেতে পারি। সবাই একসঙ্গে বললাম, ভাগ্যকে জয় করতে চাই। তিনি খুশি হলেন। বললেন, ভাগ্যকে জয় করার অনেক পথ আছে। সাহস, বুদ্ধি এবং শক্তিকে এক করতে হবে। এই পৃথিবীতে কেউ মুখ দেখে হাতে কিছু তুলে দেয় না। ওই তিনটি গুণ এক করে সেটা আদায় করে নিতে হয়। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের কিছু নেই। আবার কিছু মানুষ আছে যাদের প্রচুর আছে। আমরা চাইলে ওই প্রচুর থাকা মানুষদের কাছ থেকে কিছু আদায় করে নিতে পারি। কিন্তু ওই আদায় করতে গেলে সহজে সেটা দেবে না। তখন জোর খাটাতে হবে।

একজন জিজ্ঞেস করল, জোর করে আদায় করতে গেলে পুলিশ ধরবে। কিন্তু মাস্টারমশাই হেসে বললেন, তোমরা সেখানে এই কাজটা করবে যেখানে পুলিশ থাকবে না। খবর পেয়ে পুলিশ আসার আগেই তোমরা অনেক দূরে চলে আসবে। আমরা চাই না এইসব করার সময় ওদের কেউ আহত হোক। কিন্তু তেমন প্রয়োজন হলে আর কী করা যাবে। প্রথমদিন ওই পর্যন্ত হয়েছিল। আমাদের একটা কাগজে সই করতে হয়েছিল। একজন ক্যামেরাম্যান এসে প্রত্যেকের ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছিল। বলা হল, আজ থেকে এই ক্লাবের কথা যে বাইরে বলবে সে বিশ্বাসঘাতক এবং বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যু।

তারপর একটু একটু করে আমাদের শেখানো হল কী করে কোন ট্রেনে ডাকাতি করতে হবে। কীভাবে হাইওয়েতে বাস- আটকে ডাকাতি করতে হবে। ট্রেন বা লংরুটের বাসযাত্রীরা নিজেদের খুব অসহায় ভাবে। ডাকাত দেখলে তেমন প্রতিরোধ করে না। আর রিভলভার দেখলে তো কথাই নেই। আমি বা বিশ্বনাথ বাস ডাকাতি করিনি, ট্রেনে করেছি। প্রথমবার কেউ বাধা দেয়নি। দ্বিতীয়বারে একটা লোক রিভলভার দেখিয়েছিল বলে একটু মুশকিল হয়েছিল। তবু কেউ ধরা পড়িনি।

তারপর?

রাত্রে বিশ্বনাথ বসকে জানিয়েছিল দুটো লোক মণ্ডলপাড়ায় তাদের বাড়িতে গিয়ে ডাকাতির কথা বলে জলপাইগুড়িতে যেতে বলেছে, বস ঠিক করল বিশ্বনাথ যাবে না। সে হাসপাতালে থাকবে। সেখানে সত্যিই একজন অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে, আমাদের পাঠাল গাড়ি দিয়ে লোকদুটোকে শেষ করে দিতে। আমরা ভোর পাঁচটায় পৌঁছে হাকিমপাড়ায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। একটা লোক হাফপ্যান্ট পরে হেঁটে এলে তাকে জিজ্ঞেস করে বাড়িটায় পৌঁছে গেলাম। কিন্তু লোকদুটোর কপাল ভাল বলে ওরা রাত্রে বাড়িতে ফেরেনি। ওদের চাকরটা জবাব দিচ্ছিল না বলে বেশ ধোলাই খেয়েছে। শেষপর্যন্ত ওরা আমাকে রেলগেটে নামিয়ে দিয়ে শিলিগুড়ি চলে গেল।

অর্জুন সুদর্শনের দিকে তাকাল, এ সত্যি কথা বলেছে। তোমাকে বলি হারাধন, যে দুজনকে তোমরা খুন করতে গিয়েছিলে তার একজন হলাম আমি। আর যে চাকরটাকে মেরেছ সে বোবা এবং কালা, বেচারা কথা বলতে পারে না?

হারাধন মুখ নিচু করল। সুদর্শন ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, এ ছোকরা যদি সত্যি কথা বলে থাকে তা হলে আর দেরি করার কোনও মানে হয় না। এখনই শিলিগুড়িতে খবর পাঠাই। ওই চায়ের অফিসে গিয়ে সবকটাকে হাতেনাতে ধরে ফেলুক। আমার মনে হচ্ছে ওটাই ডাকাতির জিনিস রাখার গুদাম।

আমার তা মনে হয় না। অর্জুন মাথা নাড়ল।

কেন?

ওরা অত বোকা নয়। এখন পুলিশ গেলে কাউকে খুঁজে পাবে না। ওরা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে, বিশ্বনাথ এবং হারাধকে পুলিশ ধরেছে। নিশ্চয়ই সতর্ক থাকবে এখন।

তা অবশ্য। কিন্তু এই বস লোকটা কে?

যে মানাভাই বা মাস্টারমশাইকে চালায়। এখন তো মনে হচ্ছে এই অঞ্চলের সমস্ত ট্রেনবাস ডাকাতি এই লোকটির জন্যে হচ্ছে।

অর্জুন কথা শেষ করামাত্র সেকেন্ড অফিসার এসে দাঁড়ালেন, সার, এই দুটোকে কোর্টে নিয়ে যাব?

যাবেন। কিন্তু কী কেস দিয়েছেন?

ট্রেনডাকাতি, খুনের জন্যে বাড়িতে হামলা। এটা না দিলে হয়তো জামিন পেয়ে যাবে।

সুদর্শন কিছু বলার আগে অর্জুন বলল, একটি অনুরোধ করব?

সুদর্শন মাথা নাড়লেন।

ওদের দুজনের বিরুদ্ধে শুধু ট্রেনডাকাতির অভিযোগ রাখুন।

শুধু ট্রেনডাকাতি? সেকেন্ড অফিসার মাথা নাড়লেন, না, তা হলে বিচারক জিজ্ঞেস করবেন প্রাথমিক কোনও প্রমাণ আছে কিনা? তেমন বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি না দেখলে ওরা ছাড়া পেয়ে যাবে।

যাক না! অর্জুন বলল।

কী বলছেন অর্জুন? প্রতিবাদ করলেন সুদর্শন।

ভেবে দেখুন, বিশ্বনাথ এবং হারাধনকে আপনারা যখন ইচ্ছে তখনই ধরতে পারবেন, যদি ওরা পালিয়ে না যায়। পালিয়ে গেলেও ওরা ওদের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেশিদিন থাকতে পারবে না। ধরা পড়বেই। কিন্তু আপনাদের কী লাভ হবে? ওদের দল, বিশেষ করে ওদের বস্ বিশ্বাস করবে ওরা মুখ না খোলায় পুলিশ কেস সাজাতে পারেনি। ফলে লোকটা আবার ডাকাতির মতলব আঁটবে। তখন ওদের হাতেনাতে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন আপনারা। এদের শাস্তি দিয়ে কী লাভ, যতক্ষণ না ওদের বসূকে ধরতে পারছেন। বরং যদি সম্ভব হয় কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে ওরা কোথায় যায় তা কাউকে দিয়ে ফলো করিয়ে দেখুন। অর্জুন বলল।

সুদর্শন একটু চিন্তা করে বললেন, বেশ ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে কিন্তু চুনোপুঁটি ধরে কোনও লাভ নেই। তুমি আর একবার বদমাশটাকে নিয়ে এসো। সেকেন্ড অফিসার সমর্থন করতে পারছিলেন না কিন্তু বড়বাবুর আদেশ মানতে তিনি বাধ্য।

একটু বাদেই হারাধনকে একজন সেপাই পৌঁছে দিয়ে গেল।

সুদর্শন বললেন, হারাধনবাবু, আমরা আমাদের কথা রাখছি, তুমি যা বলেছ তা কাকপক্ষীতেও টের পাবে না। আজ কোর্ট থেকেই ছাড়া পেয়ে যাবে তোমরা। আমরা এখনই সব খবর প্রকাশ করছি না। কিন্তু বলো তো বাবা, তোমাদের ওই বসকে কোথায় পাওয়া যাবে?

আমি জানি না। সত্যি বলছি জানি না।

সুদর্শন অর্জুনের দিকে তাকালেন। অর্জুন ইশারায় বলল, সত্যি বলছে।

মানাভাই?

মানাভাইয়ের বাড়ি কোথায় জানি না, তবে ওঁকে এয়ারভিউ হোটেলের উলটোদিকের মারুতি স্ট্যান্ডে বেশিরভাগ সময় দেখা যায়।

গুড। শোনো হারাধন, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ এইরকম ডাকাতি করে বেশিদিন কেউ জেলের বাইরে থাকতে পারে না। তোমার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী আমরা তোমাকে শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু তুমি শাস্তি পেলে ডাকাতি বন্ধ হবে না। তোমাদের বস্ নতুন ছেলেকে দলে নেবে। তাই আগে তাকে ধরা দরকার। আমি তোমার কাছে খবর চাই। সুদর্শন বললেন।

হারাধন চুপ করে থাকল। অর্জুন শুনল, আমি খবর দিচ্ছি জানতে পারলে ব, আমাকে মেরে ফেলবে। তার চেয়ে জেলে যাওয়া ভাল।

অর্জুন হাসল, তুমি ঠিকই ভাবছ।

সুদর্শন জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছে ও?

আপনাকে খবর দিয়েছে জানতে পারলে ওর বস্ ওকে মেরে ফেলবে।

হারাধন চেঁচিয়ে উঠল, আপনি কী করে মনের কথা টের পান?

অর্জুন বলল, উত্তরটা আগেই দিয়েছি। শোনো, খবর দিতে তোমাকে এখানে আসতে হবে না। যে-কোনও খবর তুমি টেলিফোনে জানিয়ে দিও। এই আমার নম্বর, ওকে লিখে দিন।

সুদর্শন কাগজ টেনে লিখে এগিয়ে দিলেন।

অর্জুন বলল, এটা ভাল করে মুখস্থ করে ছিঁড়ে ফেলল। সঙ্গে রাখা ঠিক হবে না। আচ্ছা, এবার আমি উঠি।

অর্জুন বেরিয়ে এল।

গলিতে ঢুকতেই বুড়িদিকে দেখতে পেল সে। বুড়িদি তাদের বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু কাছে যেতেই সে স্পষ্ট বুড়িদির গলা শুনতে পেল, খালি হাতে আসছে? মুখে বড় বড় কথা কিন্তু উপকার করার বেলায় নেই। যখন গোয়েন্দাগিরি করত না তখন ভাল ছেলে ছিল। এখন খুব নাম হয়ে গেছে তাই ল্যাজ মোটা হয়ে গেছে।

বুড়িদির ভাবনা শুনতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল অর্জুন। বুড়িদি তার সম্পর্কে এইরকম ভাবে? সে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

আর-একটু এগোতেই একগাল হেসে বুড়িদি জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, পেলি?

এখনও পাইনি। অর্জুন সহজ হতে পারছিল না।

দ্যাখ না বাবা। আমার মুখের দাগ রোজ বেড়ে যাচ্ছে।

অর্জুন আর দাঁড়াল না। তার বাড়ির দরজায় পৌঁছনোমাত্র সে ডাক শুনতে পেল, ও অর্জুন। একটু ওয়েট করো।

সে দেখল, রামগোপালবাবু এগিয়ে আসছেন, আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমার অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছি। বুঝলে?

কেন বলুন তো?

কথা আছে। তালা খুলে ভেতরে চলো।

বাইরের ঘরের চেয়ারে বসে গলা নামালেন ভদ্রলোক, শোনো, আমি স্বীকার করছি তুমি অন্তর্যামী।

কী যা-তা বলছেন? অর্জুন তীব্র আপত্তি করল।

একদম যা-তা নয়। আমার মনের কথা তুমি ঠিকঠাক বলে গেলে তখন। আমি যা ভেবেছি তাই বলেছ। বাবা, ওইসব ভাবনা আমি ইচ্ছে করে ভাবিনি, হঠাৎ মাথায় এসে গিয়েছিল কিন্তু তুমি সেটা হুবহু বলে দিয়েছ। আমি অনেক সাধু সন্ন্যাসীর কাছে ঘোরাঘুরি করেছি কিন্তু তাঁদের কেউ এমন ক্ষমতায় অধিকারী নন।

আপনি চা খাবেন কাকা?

প্রশ্নটা করেই অর্জুন শুনতে পেল রামগোপালবাবু ভাবছেন, আমাকে কাটিয়ে দেওয়ার মতলব করছে ছোকরা। কিন্তু আমি ছাড়ব না।

না ছেড়ে কী করবেন?

অ্যাঁ? তবে? দ্যাখো বাবা, আমার সঙ্গে লীলা কোরো না।

কী বলতে চাইছেন আপনি?

আর-একটু এগিয়ে এলেন রামগোপালবাবু, তুমি তো স্টেডি কাজকর্ম করো। মাঝে মাঝে গোয়েন্দাগিরি করে বটে, তাতে কটা টাকাই বা হয়। তোমাকে আমি মাস মাইনের চাকরি দেব। ধরো, মাসে পাঁচ হাজার।

সে কী? এত টাকা?

দিতাম। ছেলেবেলা থেকে দেখছি তোমাকে। এটুকু নাহয় করলাম।

আমাকে কী কাজ করতে হবে?

আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হবে। চারধারে প্রচুর শত্রু আমার। সবাই প্যাঁচ কষছে কীভাবে আমাকে গর্তে ফেলা যায়। কারও মনের কথা বুঝতে পারি না

আমি। তুমি সঙ্গে থাকলে ওদের মনের কথা আমি শুনে ফেলব। মানে তুমি বলবে আমি শুনব। তৃপ্তির হাসি হাসলেন রামগোপালবাবু। যেন শত্রুকে কবজা করে ফেলেছেন।

তাতে একটু অসুবিধে আছে কাকা।

কীরকম?

আপনার শত্রুরা যেই জানতে পারবে আপনি নন আমি জেনে আপনাকে ওদের মনের কথা বলে দিচ্ছি অমনই ওরা আমাকে হাত করতে বেশি টাকা অফার করবে। আমার কাছে আপনার মনের কথা জানতে চাইবে।

আমার মনের কথা? চুপসে গেলেন রামগোপালবাবু।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

রামগোপালবাবু তাকালেন, অর্জুন শুনতে পেল, এ দেখছি মহাধূর্ত!

আমাকে মহাধূর্ত বলুন আর যাই বলুন কথাটা সত্যি।

সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীর ভঙ্গি করলেন ভদ্রলোক, ছি ছি ছি। আমি ভাবতে চাইনি কিন্তু ভেবে ফেলেছি। তা তোমাকে বেশি টাকার লোভ দেখালেই বা ওদের দলে যাবে কেন? তোমার বিবেক বলে কিছু তো আছে!

তা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমি যে আপনার মনের কথাও জেনে যাব। সেটা কি আপনার ভাল লাগবে?

না। লাগবে না। মাথা নাড়তে লাগলেন রামগোপালবাবু।

তা হলে?

আচ্ছা বাবা, এই বিদ্যে তুমি কোথায় আয়ত্ত করলে?

স্বপ্নে। মাটি থেকে এক হাত ওপরে শরীরটাকে তুলে নিয়ে যেতে পারলেই দেখবেন মানুষের মনের কথা শুনতে পাচ্ছেন।

সে তো শুনেছি যোগী-ঋষিরা পারেন।

হ্যাঁ। আপনার শরীর ভারী হয়ে গেছে, বাস্তবে পারবেন না। আপনি স্বপ্নে চেষ্টা করে দেখুন। পেয়ে যাবেন।

রামগোপালবাবু চলে গেলেন বিষন্ন মুখে। এখন হয়তো কয়েক রাত তিনি ওরকম স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করবেন। সফল না হলে জলপাইগুড়ি শহরে প্রচার করবেন অর্জুনের ক্ষমতার কথা।

একলা ঘরে বসে অর্জুন রুদ্রাক্ষর মালাটাকে দেখল। এটা পরলে মানুষ অদ্ভুত ক্ষমতা পায়। ঠিক কথা। কিন্তু সেইসঙ্গে দুঃখকে ডেকে আনা হয়। এই যে বুড়িদি তার সম্পর্কে এরকম ভাবে তা রুদ্রাক্ষ পরার আগে সে জানত না। পরিচিত প্রিয় মানুষের মনের খারাপ দিকটা জেনে ফেললে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে। যাকে আমি খুব ভালবাসি সে আমার সম্পর্কে মনে এক আর মুখে আর-এক বলে সেটা জানার পর সম্পর্ক রাখা কি সম্ভব? অর্জুনের মনে হল, এই মালা তার ভাবার ক্ষমতাকে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। সত্যসন্ধান করতে যদি তাকে এই মালার ওপর নির্ভর করতে হয়, অ হলে তার স্বকীয়তা কোথায় রইল। বরং খুব প্রয়োজনে যেমন রিভলভার বের করতে হয় তেমনই কোনও উপায় না থাকলে এটাকে পরবে সে।

দুপুরের খাওয়া শেষ করে মনে হল অমল সোমের সঙ্গে দেখা করে এলে হয়। এই রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলোচনা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না সে।

গেট খুলে ভেতরে ঢুকে অর্জুন দেখল বাইরের ঘরের দরজা বন্ধ। অমল সোম দুপুরে ঘুমোন না। নির্দ্বিধায় দরজায় শব্দ করল সে। কোনও সাড়া নেই। বেশ কয়েকবারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর খিড়কি দরজায় পোঁছে ফাঁক দিয়ে আঙুল গলিয়ে শেকল খুলল সে।

এখন দুপুরের শেষ। ভেতরের বারান্দায় ছায়া পড়েছে। অর্জুন দেখল অমল সোমের থাকার ঘর দুটোর ভেতরদিকের দরজায় তালা ঝুলছে। বুকের ভেতরটায় ছ্যাঁত করে উঠল। তালা কেন? অমলদা কি চলে গেছেন। সে হাবুর ঘরের দিকে তাকাল। দরজা খোলা। সেখানে গিয়ে দেখল হাবু ভেতরে নেই। অতএব বাগানে চলে এল অর্জুন। এবং তখনই হাবুকে দেখতে পেল। পেয়ারা গাছের নীচে মাদুর পেতে চিত হয়ে শুয়ে আছে হাবু। না, ঘুমোচ্ছে না। ওর চোখ গাছের ডালে বসে থাকা একটা নীলকণ্ঠ পাখির দিকে স্থির। অর্জুনকে দেখে পাখিটা ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। পাখির উড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে মুখ ফেরাতে হাবু তাকে দেখতে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল।

অর্জুন হাতের ইশারার সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইল অমল সোম কোথায়?

হাবুর মাথায় এখনও ব্যান্ডেজ। পাটি মাটি থেকে তুলে ভাঁজ করছিল সে, কিন্তু অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেল, ঘর থেকে যার মন উঠে গেছে তাকে আর ঘরে পাবে কী করে?

হাবুর গলার স্বর কোনওদিন শোনেনি অর্জুন, কারণ সে কথা বলতে পারে না। এখন যে কণ্ঠস্বর কানে এল সেটা বেশ ঘষঘষে, অমার্জিত অর্জুন চমকৃত। সে হাবুর মনের কথা শুনতে পাচ্ছে? বাঃ।

পাশ কাটিয়ে হাবু চলে গেল তার ঘরে। যাওয়ার সময় অর্জুনের কানে এল, আর আমার এখানে থাকার ইচ্ছে নেই। আমিও চলে যাব।

হাবু ফিরে এল একটা খাম নিয়ে। সেটা খুলতেই চিঠি দেখতে পেল অর্জুন। কল্যাণবরেষু, আশা করি আজ বিকেলের মধ্যে তুমি এই বাড়িতে একবার আসবে। গতকাল আমি নিউ বঙ্গাইগাঁও যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিলাম। পথে কয়েকটা রেলডাকাতের জন্যে যাত্রা বিঘ্নিত হয়েছিল। তাই আজ আবার রওনা হচ্ছি। এখানে এসে বুঝলাম একা থেকে-থেকে শ্রীমান হাবু খুব কাহিল হয়ে পড়েছেন। তার নার্ভ এই একাকিত্ব সহ্য করতে পারছে না। তার ওপর বিনা কারণে তার কপালে গত রাতে প্রহার জুটেছে। ওকে আর এভাবে একা ফেলে রাখা উচিত নয়। আমি দিন সাতেকের মধ্যে নিউ বাইগাঁও থেকে ফিরে আসব। তারপর যা হোক একটা ব্যবস্থা করব। তোমার মা সম্ভবত দিন সাতেকের মধ্যে জলপাইগুড়িতে ফিরে আসছেন না। খুব যদি অসুবিধে না হয় তা হলে তুমি কি হাবুকে একটু সঙ্গ দিতে পারবে? -তোমার মঙ্গলাকাঙক্ষী, অমল সোম।

তার নীচে আবার পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন, রুদ্রাক্ষের মালাটি যদি কোনও সমস্যা তৈরি করে তা হলে হাবুর কাছে রেখে দিও।–অমল সোম।

এইটুকু? যেন রুদ্রাক্ষের মালার কোনও ভূমিকা নেই যে তাকে নিয়ে কিছু লেখার প্রয়োজন আছে! সমস্যা হয় বলতে কী বোঝাচ্ছেন? অমলদা কি জানেন না এই মালার মাহাত্ম্য কী?

অর্জুন শুনল, কী লিখেছে কে জানে!

অর্জুন ইশারা করে বোঝাল অমল সোম সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসবেন এবং ততদিন তাকে এবাড়িতে থাকতে বলেছেন।

হাবুর মুখে হাসি ফুটল। অর্জুন শুনল, বাঃ, খুব ভাল কথা। তা হলে আজ রাত্রে মাংস রাঁধতে হয়।

অর্জুন পকেট থেকে টাকা বের করে হাবুর হাতে দিতে হাবু খুব অবাক হয়ে তাকাল। অর্জুন বলল, একটু পরে মাংস কিনে এনো।

ঠোঁট নাড়া দেখে কথা বোঝার ক্ষমতা আছে হাবুর। অর্জুন তাকে মাংস আনতে বলছে বুঝতে পেরে তার চোখ বড় হয়ে গেল। অর্জুন শুনল, শুধু মাংস না, সঙ্গে মিষ্টি দই আনব।

অর্জুন মাথা নাড়ল, রাত্রে মিষ্টি দই খেতে নেই।

ঠোঁট নাড়া দেখে কথাটাকে বুঝতে পেরে হাবু মাটিতে বসে পড়ল। সে একদৃষ্টিতে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আজ পর্যন্ত অমল সোম ছাড়া কেউ তার মনের কথা বুঝতে পারেনি। অমল সোমও এত স্পষ্ট কোনওদিন বলতে পারেননি।

অর্জুন সরে এল। বাগানে হাঁটতে হাঁটতে সে স্থির করল কদিন না হয় এখানেই থেকে যাবে। কিন্তু অমল সোম বিশ্বনাথদের সম্পর্কেও কোনও কথা চিঠিতে লেখেননি! হঠাৎ এত নিরাসক্ত হয়ে গেলেন কী করে? এই সময় সামনের বনফুলের গাছের ডালে বসে একটা দাঁড়কাক কুৎসিত গলায় চিৎকার করে উঠতেই অর্জুন কাকটাকে দেখতে পেল। দুপা এগোতেই সে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। কেউ কিছু বলছে কিন্তু তার কোনও শব্দ সে বুঝতে পারছে না। সেই শব্দহীন স্বর ঘষঘষে। কাকটা উড়ে যাওয়া মাত্র সেই স্বর কান থেকে মিলিয়ে গেল।

অর্জুন হতভম্ব হয়ে গেল। ব্যাপারটার ব্যাখ্যা এই যে, কাকটা তাকে দেখে বা ভাবছিল তা তার কানের পরদায় শব্দ হয়ে এসে আঘাত করছিল। যেহেতু ওর ভাষা তার জানা নেই তাই সে কোনও অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি। তার মানে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু অথবা নেপালি ছাড়া অন্য ভাষাভাষী মানুষ যদি কিছু ভাবে তা হলে এই রুদ্রাক্ষের মালা কোনও সাহায্য করতে পারবে না। সে একটুআধটু ওড়িয়া ভাষা বুঝতে পারে। একজন উৎকলৰ্বাসী কিছু ভাবলে সে যেটুকু বোঝে সেটুকুই বুঝতে পারবে?

ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে সে বাড়ির বাইরে চলে এল। গেটের বাইরে একটা গোরু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন তার দিকে এগোতেই গোরুটা সতর্ক হয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা রাগী শব্দ কানে এল। অথচ গোরুটা মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। এই শব্দের সঙ্গে কাকের ভাবনার শব্দের কোনও মিল নেই। অর্জুন ধীরে-ধীরে আবার পিছিয়ে যেতে শব্দটা স্বাভাবিক হয়ে মিলিয়ে গেল। অর্জুন দেখল গোরুটা নিশ্চিন্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অর্জুন মালাটার রুদ্রাক্ষে আঙুল রাখল। ঠিকই। গোরুদের ভাষা তার জানা নেই বলে সে শব্দটার অর্থ পরিষ্কার বুঝতে পারল না। তবে ওই আওয়াজের ধরন বলে দিচ্ছে সে এগিয়ে যাওয়াতে গোরুটা খুব বিরক্ত হয়েছিল।

বিকেলে হাবু বাজার করে নিয়ে আসার পর অর্জুন বের হল। করলা নদীর পাশ দিয়ে এগোতেই দেখল একটা মারুতি ভ্যান বেশ জোরে এগিয়ে আসছে। ভ্যানটা তার পাশে এসে বেশ জোরে ব্রেক কষে থেমে যেতেই অর্জুন বিরক্ত হয়ে দেখল একটা লোক দ্রুত চালকের আসন থেকে নেমে পড়েছে। তার সামনে এসে লোকটা হাতজোড় করে বলল, ভাল আছেন দাদা? অনেকদিন বাদে আপনার দর্শন পেলাম।

লোকটি রোগা, মধ্যবয়সী, প্যান্টের ওপর ধূসর রঙের গেঞ্জি, যা ময়লা হলেও বোঝা যাবে না। লোকটি বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না দাদা?

অর্জুন সত্যি কথা বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না।

সে কী? আমার কপালটাই খারাপ। ঠোঁটকাটা চাঁদুকে মনে আছে?

মনে পড়ে গেল। মালবাজারে থাকত ঠোঁটকাটা চাঁদু। ঠোঁটের ওপরটায় অনেকটা কাটা ছিল বলে সবাই ওকে ডাকত ঠোঁটকাটা চাঁদু বলে। সেবার একটা কাঠচুরির কেসে পুলিশ ওকে জড়িয়ে ফেলেছিল। সে-সময় অর্জুন লোকটার উপকারে এসেছিল। সেই ঠোঁটকাটা চাঁদুর সঙ্গে একে দেখেছে সে।

আমার নাম মাধব। ডাকনাম মাধু।

তাই বলো। চাঁদু-ধুর মাধু তুমি। তখন তো এরকম পোশাক পরতে না?

খুব লজ্জা পেয়ে গেল মাধব, আজ্ঞে, এখন গাড়ি চালাই, টু-পাইস হয়, এখন এসব না পরলে খারাপ দেখায়। কোথায় যাচ্ছেন, চলুন পৌঁছে দিচ্ছি।

না, না। আমি হাঁটতে বেরিয়েছি। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, গাড়িটা কার?

শিলিগুড়ির মালিক। আমি মান্থলি কন্ট্রাক্টে চালাই। জলপাইগুড়িতে এসেছিলাম একজন প্যাসেঞ্জার ছাড়তে। আমার গাড়িতে একটু উঠবেন না দাদা?

তুমি তো যাচ্ছ আমার উলটোদিকে।

কোনও জরুরি কাজে যাচ্ছিলাম না, এক বন্ধুর বাড়ি ঘুরে যেতাম। আপনি উঠুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব। মাধবের অনুরোধ আর এড়ানো গেল না।

কদমতলার মোড়ে যখন ওরা পৌঁছল তখন সন্ধে হব হব। ভ্যান থামলে অর্জুন বলল, তুমি তো বেশ ভালই চালাও।

আপনাদের আশীর্বাদে এসব হয়েছে। নইলে এখনও মালবাজারে পড়ে থাকতাম। পেট চালাতে কী না করতে হত।

এখন কেমন রোজগার করো।

দুনম্বরি না করলে দিনে শদুয়েক থাকে। মাধব হাসল।

কীরকম দুনম্বরি?

টানা জিনিস পাচার করছে বুঝেও না বোঝার ভান করে ভাড়া খাটলে ডাবল ইনকাম। আরও কত কী!

তুমি দুনম্বরি করো না?

সত্যি কথা বলছি দাদা, বাধ্য না হলে করি না।

বাধ্য না হলে মানে?

যন্ত্র দেখিয়ে বলে যেতে হবে। কথা না শুনলে লাশ হয়ে যাব।

পুলিশকে বলে দাও না কেন?

এ কী বলছেন দাদা! ভাড়া খেটে খাই, পুলিশ আমাকে কতক্ষণ বাঁচাবে? চুকলি করেছি বলে আরও সর্বনাশ করে ছাড়বে।

মাধব চলে গেল গাড়ি নিয়ে। একসঙ্গে ভাল এবং খারাপ লাগছিল অর্জুনের মাধবের জন্যে। তারপরেই খেয়াল হল এতক্ষণ মাধবের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ওর মনের কথা সে একবারও শুনতে পায়নি। এর অর্থ, মাধব একবারও মনে মনে অন্য চিন্তা করেনি? তা হলে তো ছেলেটাকে সত্যি সৎ বলতে হবে।

বাড়িতে গিয়ে সব বন্ধ করে অমল সোমের বাড়িতে ফিরে এল সে সন্ধের পরে। হাবু তাকে চা বানিয়ে দিল। অমল সোমের ঘরের তালা খুলে দিয়েছে হাবু। এর মধ্যে এখন বেশ ফুর্তির ভাব। যখনই সে অর্জুনের কাছাকাছি হয়েছে তখনই সেই ফুর্তির প্রকাশ জানতে পেরেছে ওঁর ভাবনায়। একটা মানুষ যদি বাড়িতে থাকে তা হলে কোনও কষ্ট হয় না। কাজে আমি ভয় পাই না। কিন্তু নিজের জন্যে কাজ করতে একটুও ভাল লাগে না। তা ছাড়া অর্জুনবাবু মানুষটা ভাল। আজ কতদিন হল ওকে দেখছি। যখন প্রথম বাবুর কাছে এসেছিল তখন তো প্রায় বাচ্চা ছেলে।

এইসব কথা কানে গেলেও অর্জুন কিছু বলল না। হাবু তার রান্নাঘরে চলে গেলে সে অমল সোমের চেয়ারে বসল। টেবিলের ওপর পেপারওয়েট, কিছু। কাগজ আর অনেক বই। এইসব বই বিচিত্র। গীতা, বাইবেল, সৈয়দ মুজতবা আলির রচনাবলীর সঙ্গে আগাথা ক্রিস্টি মিলেমিশে রয়েছে। অর্জুন ওসবে হাত না দিয়ে গলা থেকে মালাটাকে খুলে টেবিলে রাখল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সে কিছুই হতে পাচ্ছে না। কানের পরদা যেন ফেটে গেছে এমন একটা আওয়াজ মস্তিষ্ক সূর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। সে কান চেপে ধরল কিছুক্ষণ। ধীরে-ধীরে কান স্বাভাবিক হয়ে এল। তখন শরীরে বেশ অবসাদ, যেন দুমাইল টানা ছুটে এসেছে।

রুদ্রাক্ষগুলো গোল নয়, অনেকটা ঢোলকের সাইজ। একটাই মুখ। এ ছাড়া অন্য কোনও বিশেষত্ব নেই। প্রতিটি বীজের মধ্যে ফাঁক নেই বললেই চলে। এখনও কী দিয়ে মালাটা গাঁথা, ঠাওর করতে পারল না অর্জুন। পৃথিবীর মানুষের বুদ্ধির বাইরে একটি কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে এই মালা। বিজ্ঞান যেখানে থমকে থাকবে, সেখানে এ সক্রিয়। অমল সোমের হাতে না পড়ে কোনও বুদ্ধিমান শিক্ষিত অপরাধীর হাতে পড়লে লোকটা মালার সাহায্যে কত কিছু করতে পারত। এখন প্রশ্ন হল, অমল সোম মালাটাকে কোত্থেকে পেলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, এমন মূল্যবান জিনিস তিনি অবহেলায় কেন হাতছাড়া করলেন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর একমাত্র অমল সোমই দিতে পারেন। কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে নানান কারণ অনুমান করা যায়। একথা ঠিক অমল সোম তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। এই মালা তাকে দিয়ে তিনি যাচাই করতে চেয়েছেন। সে কীভাবে এর ব্যবহার করে তা দেখতে চেয়েছেন। মালাটা কোনও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে হলে তাঁর সন্দেহ ছিল এবং সেক্ষেত্রে হাবুর কাছে রেখে দিতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। আর কিছু না হোক, উনি জানতেন মালা নিয়ে অর্জুন বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। অর্জুন বইগুলোর দিকে তাকাল। একটি নাম তাকে আকর্ষণ করল। বইটির নাম, মনের কথা। বইটি হাতে নিয়ে দেখল লেখকের নাম স্বামী হৃদয়ানন্দ। মাত্র একশো পাতার বই। সে পাতা ওলটাল। মানুষের মন নিয়ে লেখক গবেষণা করেছেন। পাতা ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ পেন্সিলের দাগ চোখে পড়ল। যদি অমল সোম দাগিয়ে থাকেন তা হলে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। এই পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যেসব শব্দ বেজে যাচ্ছে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আমাদের শ্রবণযন্ত্র গ্রহণ করতে সক্ষম। মানুষের ইন্দ্রিয়গুলোর কার্যক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এই কারণে মানুষ অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। কখনও কখনও কোনও পশুর ইন্দ্রিয় মানুষের থেকে অনেকগুণ শক্তিশালী বলে প্রমাণিত। শকুন যে দূরত্ব থেকে তার খাদ্যবস্তু আবিষ্কার করে সেই দূরত্বে মানুষের দৃষ্টি শক্তিহীন। ঝড়বৃষ্টির আগে পিপড়েরা আতঙ্কিত হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে দৌড়ায় অথচ আকাশে তখনও দুর্যোগের চিহ্ন ফুটে ওঠে না সেসময়। মানুষের পক্ষে আগাম এই অনুমান করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও কোনও মানুষ এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই সক্ষমতা এসেছে চিন্তার ব্যায়ামের মাধ্যমে। ব্যায়াম যেমন শরীরকে মেদশূন্য করে তেমনই চিন্তার ব্যায়ামে মন চিন্তাশূন্য হয়। যখন সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় তখন দ্বিতীয় শ্রবণযন্ত্রের জন্ম হয়, যা বাতাসে মিশে থাকা শব্দাবলী শুনতে সাহায্য করে। কথিত আছে হিমালয়ের কোনও কোনও যোগীপুরুষ তাঁদের সাধনালব্ধ শক্তি পৃথিবীর জাগতিক কোনও বস্তুর মধ্যে নিহিত করে রাখেন। যেভাবে পাথর ধারণ করলে মানুষের নানান উপকার হয় তেমনই সেইসব বস্তু ধারণে সাধনা ছাড়াই মানুষ ফললাভ করতে পারে। পাথর, মাদুলি অথবা তাবিজে যেসব সভ্য শিক্ষিত মানুষ অত্যন্ত আস্থাবান তাঁরা নিশ্চয়ই এই তথ্য অস্বীকার করতে পারবেন না।

এখানেই দাগ শেষ হয়েছে। অমল সোম এখানে কবে দাগ দিয়েছেন? এবারে, না অনেক আগে?

হাবু কখন ঘরে ঢুকেছে টের পায়নি অর্জুন। হাবুর হাতে রাতের খাবারের থালা। ইশারায় খেতে বসতে বলছে। অর্জুন ঝটপট মালাটা পরে ফেলল। পরামাত্র শরীর গরম হয়ে উঠল। জ্বালা নয়, একটা তপ্ত হাওয়া যেন ঢেউয়ের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল সমস্ত শরীরে। মাটিতে পড়তে পড়তে চেয়ারে বসে পড়ল অর্জুন ধপ করে। পড়ে স্থির হয়ে রইল কিছুক্ষণ। সে চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হল।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল থালা হাতে হাবু। অর্জুনের শরীর খারাপ হয়েছে ভেবে সে হাউমাউ করে থালাটাকে খাওয়ার টেবিলের ওপর রাখতে ছুটল। ততক্ষণে শরীর শান্ত হয়েছে অর্জুনের। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানো মাত্র হাবু ছুটে ফিরে এল। তাকে কোনও পাত্তা না দিয়ে খেতে বসে গেল অর্জুন। হাবু ইশারায় জিজ্ঞেস করে গেল, শরীর খারাপ কিনা, অর্জুন মাথা নেড়ে না বলে গেল। অর্জুন শুনল, হাবু ভাবছে, চোখের সামনে দেখলাম চোখ বন্ধ হয়ে গেল, পা টলে গেল, তবু স্বীকার করছে না।

সকালে সুদর্শন এ-বাড়িতে হাজির হলেন, আপনি এখানে যে আছেন তা তো জানি না। আপনার বাড়িতে লোক পাঠালাম, ফিরে এসে জানাল তালাবন্ধ।

বসুন। কী ব্যাপার?

পাখি তো উড়ে গেল।

তার মানে?

কোন শেষবেলায় কোর্টে প্রোডিউস করতেই ওদের উকিল হইচই লাগিয়ে দিল। যেহেতু আমাদের চার্জে কোনও জোরালো পয়েন্ট নেই তাই পুলিশ আটকে রাখতে পারে না। জামিন পেয়ে গেল।

তারপর?

ওরা কদমতলায় গিয়ে বাসে উঠেছিল। হারাধন রেল গেটে নেমে গেছে, বিশ্বনাথ মণ্ডলপাড়ায়। কিন্তু উকিল ফিরে গেছে শিলিগুড়িতে।

ওঁকে ফলো করেনি আপনার লোক?

কী বলব বলুন! যেহেতু বলা ছিল ওই দুজনকে কভার করতে হবে তাই তাঁর মাথায় উকিলের কথা ঢোকেনি।

একটা সুযোগ হারালেন। আমার বিশ্বাস উকিলকে শিলিগুড়ি থেকে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছিল। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই রিপোর্ট দিয়েছেন।

হ্যাঁ। আমিও তাই মনে করি। তবে পালা করে মণ্ডলপাড়া বাসস্টপে লোক রেখেছি৷ বিশ্বনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে উঠলেই ওকে ফলো করবে।

ওরকম জায়গায় অচেনা লোককে দেখলে সবাই সন্দেহ করবে না?

জলপাইগুড়ির কেউ নয় এখানকার লোক।

কিন্তু ধরুন, যদি ও বাসে না গিয়ে প্রাইভেট কারে যায়?

এটা তো আমার মাথায় ছিল না। কিন্তু ওর মতো একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে প্রাইভেট কার পাবে কোথায়?

যার প্রয়োজন সে পাঠাতে পারে। হারাধন ফোন করেছিল?

না। আপনি আমাকে চিন্তায় ফেললেন। এদিকে কাল রাতে এস পি সাহেব ডেকেছিলেন ট্রেনডাকাতির সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করেছি, অ্যারেস্ট করে এনেছি অথচ জামিনের বিরোধিতা তেমন করে করলাম না কেন জানতে চাইছিলেন। কেন আরও সিরিয়াস চার্জ ওদের বিরুদ্ধে সাজালাম না? আমি আপনার কথা বললে সেটা আমার বিরুদ্ধে যেত। কোনওমতে ম্যানেজ করেছি। কিন্তু উনি খুশি হননি।

অর্জুন বলল, আমাদের পরিকল্পনার কথা ওঁকে খুলে বললেন না কেন?

বলে লাভ হত না। কারণ হারাধন যে ফিরে গিয়ে আমাদের সাহায্য করবে তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। সুদর্শনকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

ওঁর জিপ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্জুন দেখল একজন সেপাই বেশ উত্তেজিত হয়ে গেট খুলে ছুটে আসছে। সুদর্শন জিজ্ঞেস করল, কী হল?

সার মেসেজ এসেছে, আজ সকালে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে ডাকাতি হয়েছে।

সে কী! এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে জিপে পৌঁছে গিয়ে ওয়াকিটকি চালু করলেন সুদর্শন। অর্জুন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। কথা শেষ করে সুদর্শন বললেন, আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না। একেবারে নাকের ডগায় ডাকাতিটা হয়েছে।

কোথায়?

রানিনগর আর জলপাইগুড়ি রোডের মাঝখানে। আমি চলি।সুদর্শন জিপে উঠে বসতেই অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ওখানেই যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। ট্রেনটাকে জলপাইগুড়ি রোডে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

আমি সঙ্গে গেলে অসুবিধে হবে?

সুদর্শন একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, আসুন।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress