Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » এইখানে সূর্যের || Jibanananda Das

এইখানে সূর্যের || Jibanananda Das

এইখানে সূর্যের ততদূর উজ্জ্বলতা নেই।
মানুষ অনেক দিন পৃথিবীতে আছে।
‘মানুষের প্রয়াণের পথে অন্ধকার
ক্রমেই আলোর মতো হ’তে চায়;’-
ওরা বলে, ওরা আজো এই কথা ভাবে।
একদিন সৃষ্টির পরিধি ঘিরে কেমন আশ্চর্য এক আভা
দেখা গিয়েছিলো; মাদালীন দেখেছিলো- আরো কেউ-কেউ;
অম্বাপালী সুজাতা ও সংঘমিত্রা পৃথিবীর লৌকিক সূর্যের
আড়ালে আর-এক আলো দেখেছিলো;
হয়তো তা লুপ্ত এক বড়ো পৃথিবীর
আলোকের নিজ গুণ,
অথবা তখনকার মানুষের চোখের ও হৃদয়ের দোষ।

এই বিশ শতকে এখন
মানুষের কাছে আলো আঁধারের আর রকম মানে :
যেখানে সূর্যের আলো নক্ষত্র বা প্রদীপের ব্যবহার নেই
সেইখানে অন্ধকার;
যেখানে চিন্তার ধারা রীতিহীন- শব্দের প্রয়োগ অসংগত-
প্রাণের আবেগ ঢের শতকের আপ্রাণ চেষ্টায়
যেখানে সহিষ্ণু স্থির মানুষের সাধনার ফলে
বিপ্লবিনী নদীর বাঁধের মতো হ’য়ে- তবু কোনো একদিন
কেন যেন জলের গর্জনে আলুলায়িত হয়েছে
সেখানে (ওদের মতে) আলো নেই;
অথবা নিজেকে নিজে প্রতিহত ক’রে ফেলে আলো
সেইখানে অন্ধকার।

মনীষীরা এ-রকম ভাবে আজ শুদ্ধ চিন্তা করে,
সমাজের কল্যাণ চায়,
দিক নির্ণয় করে।
অটুট বাঁধের মতো মনে হয় জ্ঞানীদের মন যেন-
টেনিসির দামোদর অথবা কোশীর।
তবুও আগুন জল বাতাসের প্লাবনের মানে
সেতু ভেঙে নব সেতু প্রণয়ন; আজ তা ,আত্মস্থ সেতু জানে?
মাঝে-মাঝে বাসুকির লিপ্ত মাথা টলে,
ক্লান্ত হ’য়ে শান্তি পায় অপরূপ প্রলয়-কম্পনে;
পৃথিবীর বন্দিনীরা হেসে ওঠে ।
রেলের লাইনের মতো পাতা জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্তহীন কার্যকারিতায় –
সুখ আছে, সৃষ্টি নেই। অনেক প্রসাদ আছে,প্রেম নেই।
অনেক কল্যানশীল নগর জাগছে;
সেইখানে দিনে সূর্য নিজে,
নিয়ন টিউব গ্যাস রাত্রির;
উন্মুক্ত বন্দর সব নীল সমুদ্রের
পারে-পারে মানুষ ও মেশিনের যৌথ শক্তিবলে
নীলিমাকে আটকেছে ইঁদুরের কলে ।
সূর্য ভারত চীন মিশরের-ক্যালডিয়ার আদিম ভোরের
প্রাথমিক উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেছে ?
দিন প্রায় শেষ হ’য়ে এলে শাদা ডানার ঝিলিকে
আলো ঠিকরিয়ে গেলে বুঝেছি সংবাদবাহী আশ্চর্য পায়রা
উড়ে যায় সূর্যকে টুকরো ক’রে ফেলে;
খণ্ড আলোর মতো সঞ্চারিত করেছে আবেগে
প্রকৃতিতে; কোনো-কোনো মানুষের বুকে; তারপর
মানুষের সাধারণ ভাবনার বজেট ইনকম-ট্যাকস প্রভৃতি বিষয়ে
ঠেকে নিভে গেছে।

উৎসব হৃদয় মনে কাজ ক’রে গেছে একদিন
সমুদ্রের নীল পথে মহেন্দ্র চলেছে-,
সমস্ত ভারত শিলালিপির উদ্যমে আনন্দে ভ’রে গেছে;
এরকম উৎসাহের দিন আজ তবু তো নেই আর?
আমাদের কাজ আজ ছক ছলা,কিছু দূর চিন্তার সাধুতা
ততদূর শব্দযোজনার সতর্ক সংগতি নিয়ে;
মাঝে-মাঝে হৃদয়েরও খুচরো টুকরো ব্যবহার;
(শাদা কালো রং এসে বার-বার- কেবলি মিশছে অন্ধকারে)
সে-হৃদয় মানুষের আধুনিক সভ্যতার পটভূমিকায়
শচীর মতন এসে দাঁড়াচ্ছে;
অথবা সে ইন্দ্রাণীকে ভেদ ক’রে অহল্যার মতো;
সহস্র চোখ না যোনি একদিন পরে আজ কলকাতায় ইন্দ্রের শরীরে?
ইন্দ্র আজ এরা- ওরা;
ইন্দ্রের আসনে আজ বেটপ্‌কা অন্তত বসা যায়
শুল্ক আয়কর সুদ- বেশি খুদ-অল্পকে অস্পষ্টভাবে দিলে।

আজো তবু অবিরাম প্রয়াণ চলেছে মানুষের :
শব্দের অঙ্গার থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো ভাষা জ্ঞান
জ্ঞানের নিরবচ্ছিন্ন শববাহনের শক্তি খুঁজে তবু প্রেম
পাওয়া যায় কিনা তার অক্লান্ত সন্ধানে ?
মহাযুদ্ধ শেষ হ’য়ে গেলে
আবার যুদ্ধের ছায়া;
পটভূমি দ্রুত স’রে গেলে রূঢ় দেয়ালের মুখোমুখি এসে
আমরা সূর্যের যেই প্রাণ উজ্জ্বলতা
চীনে কুরুবর্ষে গ্রীসে বেথলেহমে হারিয়ে ফেলেছি-
তাকে শিশুসরলতা মূর্খের আরাধ্যে স্বর্গ ভেবে
সূর্যের মধ্যন্দিন বড়ো ভাস্বরতা
এখনও পাইনি খুঁজে ।
এখানে দিনের- জীবনের স্পষ্ট বড়ো আলো নেই;
ধ্যানের সনির্বন্ধ অন্ধকার এখনো আসেনি ।
চারিদিকে ভোরের কি বিকেলের কাকজ্যোৎস্না ছায়ার ভিতরে
আহত নগরীগুলো কোনো এক মৃত পৃথিবীর
ভেতরের চিহ্ন ব’লে মনে হয়; তবু
মৃত্যু এক শেষ শান্ত পবিত্রতা;
আমাদের আজকের পৃথিবীর মানুষ নগরগুলো সে-রকম
আন্তরিকভাবে মৃত নয়।

বাজারদরের চেয়ে বেশি কালো টাকা-ঘুষ দিয়ে
জীবনকে পাওয়া যাবে ভেবে
যেন কোনো জীবনের উৎস-অন্বেষণে তারা সকলে চলেছে;
পরস্পরের থেকে দূরে থেকে; ছিন্ন হ’য়ে; বিরোধিতা করেছে
সকলের আগে নিজে- অথবা নিজের দেশ- নিজের নেশন
সবের উপর সত্য মনে ক’রে,- জ্ঞানপাপে, অস্পষ্ট আবেগে ।

মানুষের সকল ঘটনা গল্প নিস্ফলতা সফলতা যদি হাইড্রোজেনে
পুড়ে ছাই হ’য়ে যায় তবে হ’য়ে যাক
এ-রকম অপূর্ব অপ্রীতি চারাদিকে
আমাদের রক্তের ভেতরে অনুরণিত হচ্ছে

কোথাও সার্থককাম কেউ নয়;
আমাদের শতাব্দীর মানুষের ছোটো বড়ো সফলতা সব
মুষ্টিমেয় মানুষের যার-যার নিজের জিনিস,
কোটি মানুষের মাঝে সমীচীন সমতায় বিতরিত হবার তা নয়।
এইখানে মর্মে কীট র’য়ে গেছে মানুষের রীতির ভিতরে
রীতির বিধানদাতা মানুষের শোকাবহ দোষে।
প্রকৃতি আবিল কিছু, তবু মানুষের
প্রয়োজন-মতো তাতে নির্মলতা আছে
আরো কিছু আছে তাতে; যেন মানুষের সব-রকম প্রার্থনা
মিটিয়ে বা না-মিটিয়ে প্রকৃতি ঘাসের শীর্ষে একফোঁটা নিঃশব্দ শিশিরে
নিঃশব্দ শিশিরকণা- সব মূল্য বিনাশের তীরে।

পাখিদের ডানা-পালকের থেকে বিকেলের আলো
নিভে গেলে রাত্রির নক্ষত্রেরা হৃদয়ের আচ্ছন্নতা নেড়ে
বাতাসের মুক্ত প্রবাহের মতো; যেন কোনো ঘুমন্তের মনে
কথা কাজ চিন্তা স্বপ্ন অকুতোভয়তা
নিজের স্বদেশে এলো।

চারিদিকে অবিরল নিমিত্তের ভাগীর মতন
এই সব আকাশ নক্ষত্র নীড় জল;
মানুষের দিনরাত্রি প্রণয়নে অহেতুক নির্দেশের মতো
র’য়ে গেছে শতাব্দীর আঁধারে আলোয়।
কেউ তাকে না বলতে এ-পৃথিবী সকালের গভীর আলোয়
দেখা দেয়; কেউ তাকে না চাইতে তবু ইতিহাসে
দুপরের ঢেউ তার কেমন কর্কশ ক্রন্দনে কেঁপে ওঠে;
নিসর্গের কাছ থেকে স্বচ্ছ জল পেয়ে তবু নদী মানুষের
মূঢ় রক্তে ভ’রে যায়; সময় সন্দিগ্ধ হ’য়ে প্রশ্ন করে, ‘নদী,
নির্ঝরের থেকে নেমে এসেছো কি? মানুষের হৃদয়ের থেকে?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *