রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – রাবণের সহিত মান্ধাতার যুদ্ধ ও সখ্যতা স্থাপন
মুনি বলে রাবণ আছয়ে রথোপর।
দিব্য রথে চড়ি যায় এক নরবর।।
সোনার রথখান সে বহে রাজহংসে।
সাত শত দেবকন্যা পুরুষের পাশে।।
কেহ হাসে কেহ নাচে কারো মুখে বাঁশী।
সে পুরুষ স্ত্রীগণ বেষ্টিত স্বর্গবাসী।।
রথের উপরে যায় শৃঙ্গার-কৌতুকে।
আপনার রথে থাকি রাবণ তা দেখে।।
রাবণ বলিছে কোথা পুরুষ পলাও।
লঙ্কার রাবণ আমি মোরে যুদ্ধ দাও।।
দেখিয়া তোমার নারী ব্যাকুলিত প্রাণ।
কতগুলা নারী মোরে দিয়া যাও দান।।
পুরুষ ডাকিয়া বলে শুন লঙ্কেশ্বর।
বহুদিন করিলাম তপস্যা বিস্তর।।
পৃথিবীতে রাজা আমি ছিলাম প্রধান।
তোমা হেন অনেকের লইয়াছি প্রাণ।।
না করিল কেহ মোরে যুদ্ধে পরাজয়।
স্বর্গবাসে যাই আমি এ কথা নিশ্চয়।।
আমারে জিনিতে কেহ নারিল সংগ্রামে।
পূর্ব্বেতে ছিলাম আমি পূর্ব্বমুনি নামে।।
স্ত্রীগণ বেষ্টিত আমি যাই স্বর্গবাসে।
এমন সময়ে যুদ্ধ যুক্তি না আইসে।।
রাবণ বলিল তুমি মোর ধর্ম্মবাপ।
পূর্ব্বে মোর পিতৃসহ তোমার আলাপ।।
দিগ্বিজয় করি আমি ত্রিভুবন জিনি।
কার সনে যুদ্ধ করি মনে অনুমানি।।
দিনেক রহিতে নারি আমি বিনা রণে।
তুমি যুক্তি বল আমি যুঝি কার সনে।।
পূর্ব্বমুনি বলে আছে মান্ধাতা নৃপতি।
তার সনে যুঝহ সে সপ্তদ্বীপপতি।।
উত্তর দিকেতে গেল সে দেশ ভ্রমিতে।
থাক আজি বাসা করি রম্য এ পর্ব্বতে।।
এ পর্ব্বতে তার সনে হবে দরশন।
মান্ধাতা আইলে যুদ্ধ করিও তখন।।
এত বলি পূর্ব্বমুনি গেল স্বর্গবাসে।
হেনকালে মান্ধাতা কটক শুদ্ধ আসে।।
মান্ধাতাকে দেখিয়া সে রুষিল রাবণ।
মান্ধাতা রাবণ দোঁহে বাজে মহারণ।।
দিগ্বিজয় করিয়া বেড়ায় দুইজন।
নানা অস্ত্র দুই রাজা করে বরিষণ।।
দুইরাজা নানা অস্ত্র করে অবতার।
উভয় রাজার সেনা পলায় অপার।।
মান্ধাতা হীরার টাঙ্গি পাক দিয়া এড়ে।
রাবণ খাইয়া টাঙ্গি রথ হৈতে পড়ে।।
পড়িল রাবণ রাজা বেড়ে সেনাপতি।
হর্ষে সিংহনাদ ছাড়ে মান্ধাতা নৃপতি।।
চক্ষুর নিমিষে পায় রাবণ সম্বিত।
ধনুক পাতিয়া যুঝে মান্ধাতা চিন্তিত।।
অগ্নিবাণ এড়িলেক রাক্ষস রাবণ।
জ্বলিয়া আগ্নেয়-বাণ উঠিল গগন।।
দেখিয়া ত্রিদশগণে লাগে চমৎকার।
মান্ধাতা পড়িল সৈন্য করে হাহাকার।।
সম্বিত হইয়া উঠে চক্ষুর নিমেষে।
উঠি সিংহনাদ করে মান্ধাতা হরিষে।।
উভয়ের সিংহনাদে পৃথিবী উলটে।
দুই রাজা বাণ এড়ে দুই রাজা কাটে।।
দুই রাজা ক্রোধে বাণ এড়িছে বিস্তর।
মহাশব্দ করে বাণ তূণের ভিতর।।
কেহ কারে জিনিবারে নাহি পায় আশ।
একই সমান যুদ্ধ করে দশমাস।।
মান্ধাতা এড়িল বাণ নামে পাশুপত।
স্থাবর জঙ্গম কাঁপে পৃথিবী পর্ব্বত।।
সপ্ত-স্বর্গ কাঁপে আর সে সপ্ত-সাগর।
শুনিয়া বাণের শব্দ স্বর্গে লাগে ডর।।
ব্রহ্মা পাঠাইয়া দিলা ভার্গব মহর্ষি।
অবিলম্বে কহিছেন সেইখানে আসি।।
সমর সম্বর ক্রোধ না কর মান্ধাতা।
ব্রহ্মা পাঠাইয়া দিলেন শুন তার কথা।।
আছে যে ব্রহ্মার বর রাবণ না মরে।
তব বাণে রাবণের কি করিতে পারে।।
তব বংশে যে পুরুষ জন্মিবেন শেষে।
তাঁর ঠাঁই দশানন মরিবে সবংশে।।
তব বাণে না মরিবে লঙ্কার রাবণ।
অস্ত্র সম্বরিয়া প্রীতি কর দুই জন।।
মুনির বচন রাজা না করিল আন।
সম্প্রীতি করিয়া দোঁহে গেল নিজস্থান।।
মান্ধাতা রাবণেতে সমান গেল রণে।
জয়-পরাজয় কারো নহিল সেক্ষণে।।
অগস্ত্যের কথা শুনি রাম উল্লাসিত।
কহ বলি মুনিকে করেন উৎসাহিত।।
মান্ধাতা ছাড়িয়া কোথা গেল দশানন।
কহ দেখি মুনি শুনি অপূর্ব্ব কথন।।