আর না
দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পর তোকে দেখলাম এ বছর আমার জন্মদিনে। প্রতিবছরই যাই হয় কোন না কোন বৃদ্ধাশ্রমে অথবা অনাথ আশ্রমে। সদ্য শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছি। আমি তোর ডিভোর্সী বা বলা যায় পরিত্যক্তা। না আর কাউকে জীবনে জায়গা দিতে পারিনি।
তোকে দেখেই মনে পড়লো সেদিনের তোর কথা। স্ত্রীর জায়গা যে আমি পাবো না, তা পরিস্কার করে দিয়েছিলি। এটাও জানিয়েছিলি, তোর ভালোবাসা অন্য কেউ। আমিও পারিনি জোর করতে। তাই ছিঁড়ে গেল বন্ধনটা। তোকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল জেনে খুব আত্মসম্মানে লেগেছিল। চোখে হাজারো স্বপ্নের বলিদান দিয়ে তোকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম।
এক অনাথ আশ্রম থেকে একটা বাচ্চা দত্তক নিয়েছিলাম নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য। সিঙ্গেল মাদার হিসেবে মানুষ করেছি। আজ সে প্রতিষ্ঠিত।
বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ারটেকার ছেলেটা বলল, তুই নাকি গত মাসেই এসেছিস। ছেলে বিদেশে কর্মরত। বৌ মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে, দীর্ঘ রোগ ভোগের পর।
ডিভোর্সের পর অবশ্য শুনেছিলাম, আবার বিয়ে করেছিস। ছেলে হয়েছে এটাও শুনেছিলাম। তারপর ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসি মুর্শিদাবাদ। ওখান থেকেই পুত্র দত্তক নেওয়া।
জানিস আমার ডিভোর্সের ধকলটা বাবা সামলাতে পারেন নি। মাও চলে গেলেন তার পরপরই। ভাইয়ের কাছে আর থাকতে চাই নি। পোড়া কপাল নিয়ে নিজেই নিজেকে নির্বাসিত করেছিলাম।
অবসর নেওয়ার পর কলকাতার বুকে দু কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকি। ছেলের বিয়ে দিয়েছি। বৌমা ভীষণ আন্তরিক। সবটাই জানে, যে ছেলে আমার নিজের নয়।
জন্মদিনের উপহার এক এক করে সবাইকে দিলাম। তোর কাছে আসতেই, যখন বললি,” কেমন আছো শচী?”
উত্তর দিতেও মন সায় দিচ্ছিল না। দায়সারা গোছের একটা উত্তর দিয়েছিলাম। আমার আবেগগুলো কত সহজেই যে হত্যা করেছিল, আজ সে জিজ্ঞাসা করছে কেমন আছি?
সারাদিন সবাই খুব মজা আনন্দ করছিল। তোর কথামত যে যার নিজের পছন্দ মত গান আমাকে উপহার দিচ্ছিল। তোর পালা আসতেই তুই সুর ধরেছিলি, পুরোনো সেই দিনের কথা…..
ভীষণ বিরক্ত লাগছিল আমার।
রাত অনেকটা হয়ে গেছে দেখে ছেলে এসেছিল নিতে। সবাই হাসিমুখে বিদায় জানাচ্ছিল আমায়। শুধু তোর মুখটা ছিল আবেগমিশ্রিত। জানতে চেয়েছিলি, আবার কবে আসবো। ছোট্ট করে বলেছিলাম, আর না।