হায় হায় ,
জীবনের তরুণ বেলায় ,
কে ছিল রে হৃদয় – মাঝারে ,
দুলিত রে অরুণ – দোলায় !
হাসি তার ললাটে ফুটিত ,
হাসি তার ভাসিত নয়নে ,
হাসি তার ঘুমায়ে পড়িত
সুকোমল অধরশয়নে ।
ঘুমাইলে , নন্দনবালিকা
গেঁথে দিত স্বপনমালিকা ;
জাগরণে , নয়নে তাহার
ছায়াময় স্বপন জাগিত ;
আশা তার পাখা প্রসারিয়া
উড়ে যেত উধাও হইয়া ,
চাঁদের পায়ের কাছে গিয়ে
জ্যোৎস্নাময় অমৃত মাগিত ।
বনে সে তুলিত শুধু ফুল ,
শিশির করিত শুধু পান ,
প্রভাতের পাখিটির মতো
হরষে করিত শুধু গান ।
কে গো সেই , কে গো হায় হায় ,
জীবনের তরুণ বেলায়
খেলাইত হৃদয় – মাঝারে
দুলিত রে অরুণ – দোলায় ?
সচেতন অরুণকিরণ
কে সে প্রাণে এসেছিল নামি ?
সে আমার শৈশবের কুঁড়ি ,
সে আমার সুকুমার আমি ।
প্রতিদিন বাড়িল আঁধার ,
পথমাঝে উড়িল রে ধূলি ,
হৃদয়ের অরণ্য – আঁধারে
দুজনে আইনু পথ ভুলি ।
নয়নে পড়িছে তার রেণু ,
শাখা বাজে সুকুমার কায় ,
ঘন ঘন বহিছে নিশ্বাস
কাঁটা বিঁধে সুকোমল গায় ।
ধুলায় মলিন হল দেহ ,
সভয়ে মলিন হল মুখ
কেঁদে সে চাহিল মুখপানে
দেখে মোর ফেটে গেলে বুক ।
কেঁদে সে কহিল মুখ চাহি ,
“ ওগো মোরে আনিলে কোথায় ?
পায় পায় বাজিতেছে বাধা ,
তরুশাখা লাগিছে মাথায় ।
চারি দিকে মলিন আঁধার ,
কিছু হেথা নাহি যে সুন্দর ,
কোথা গো শিশির – মাখা ফুল ,
কোথা গো প্রভাতরবিকর ?”
কেঁদে কেঁদে সাথে সে চলিল ,
কহিল সে সকরুণ স্বর ,
“ কোথা গো শিশির – মাখা ফুল ,
কোথা গো প্রভাত রবিকর । ”
প্রতিদিন বাড়িল আঁধার
পথ হল পঙ্কিল মলিন —
মুখে তার কথাটিও নাই ,
দেহ তার হল বলহীন ।
অবশেষে একদিন , কেমনে , কোথায় , কবে
কিছুই যে জানি নে গো হায় ,
হারাইয়া গেল সে কোথায় ।
রাখো দেব , রাখো , মোরে রাখো ,
তোমার স্নেহেতে মোরে ঢাকো
আজি চারি দিকে মোর এ কী অন্ধকার ঘোর ,
একবার নাম ধরে ডাকো ।
পারি না যে সামালিতে , কাঁদি গো আকুল চিতে ,
কত রব মৃত্তিকা বহিয়া ।
ধূলিময় দেহখানি ধুলায় আনিছে টানি ,
ধুলায় দিতেছে ঢাকি হিয়া ।
হারায়েছি আমার আমারে ,
আজি আমি ভ্রমি অন্ধকারে ।
কখনো বা সন্ধ্যাবেলা আমার পুরানো সাথি
মুহূর্তের তরে আসে প্রাণে ,
চারি দিকে নিরখে নয়ানে ।
প্রণয়ীর শ্মশানেতে একেলা বিরলে আসি
প্রণয়ী যেমন কেঁদে যায় ,
নিজের সমাধি – ‘ পরে নিজে বসি উপছায়া
যেমন নিশ্বাস ফেলে হায় ,
কুসুম শুকায়ে গেলে যেমন সৌরভ তার
কাছে কাছে কাঁদিয়া বেড়ায় ,
সুখ ফুরাইয়া গেলে একটি মলিন হাসি
অধরে বসিয়া কেঁদে চায় ,
তেমনি সে আসে প্রাণে — চায় চারি দিক – পানে ,
কাঁদে , আর কেঁদে চলে যায় ।
বলে শুধূ , “ কী ছিল , কী হল ,
সে – সব কোথায় চলে গেল !”
বহুদিন দেখি নাই তারে ,
আসে নি এ হৃদয় – মাঝারে ।
মনে করি মনে আনি তার সেই মুখখানি ,
ভালো করে মনে পড়িছে না ।
হৃদয়ে যে ছবি ছিল ধুলায় মলিন হল ,
আর তাহা নাহি যায় চেনা ।
ভুলে গেছি কী খেলা খেলিত ,
ভুলে গেছি কী কথা বলিত ।
যে গান গাহিত সদা সুর তার মনে আছে ,
কথা তার নাহি পড়ে মনে ।
যে আশা হৃদয়ে লয়ে উড়িত সে মেঘ চেয়ে
আর তাহা পড়ে না স্মরণে ।
শুধু যবে হৃদি-মাঝে চাই
মনে পড়ে — কী ছিল , কী নাই ।