আমার বালিকাবেলা
পাবনা আমার জন্মভূমি, বাপ-দাদার বাড়ি। কোনদিন ভাবতেই পারিনাই যে একদিন এই পাবনা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবো ! আমার শৈশব আর কৈশোরের মধু মাখা দিনগুলো এখানেই কেটেছে। ছোটকাল বলতে বুঝতে হবে— পঞ্চাশের দশক। ষাটের দশকে তো আমি বড়ই হয়ে গেলাম। তো–এই পাবনা শহরে ছোটকালে খুব ঘুরে বেড়িয়েছি। জুতো-স্যান্ডেলের কোন বালাই ছিল না, খালি পায়ে সেই শালগারিয়া, রাধানগর, পৈলেনপুর, কিস্টপুর, রাগুবপুর–তাছাড়াও শীতলাই জমিদার বাড়ি, আবার আব্বার সাথে আরিফপুর গোরস্তানের পাশে ঈদগাহের মাঠে নামাজ পড়া—মোটকথা ছোট্ট পাবনা শহরের প্রায় সব জায়গা আমি চষে বেড়িয়েছি। কখনো আমার মেজো বোন মাহমুদার সাথে, কখনোবা আমার ছোট বোন রোকেয়ার সাথে। আম্মাই পাঠাতেন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে এটা ওটা দরকারে।
মাঝে মাঝে পাড়ায় বায়োস্কোপওয়ালা আসতো বায়োস্কোপ দেখাতে। আম্মার কাছ থেকে ঘ্যান ঘ্যান করে দুই চারটে ফুটো পয়সা আদায় করে নিয়ে বায়োস্কোপের চোঙ্গের মধ্যে চোখ রাখতাম, কি-যে ভালো লাগতো ! বায়োস্কোপওয়ালা চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক-একটা ছবি দেখাতো আর সুর করে করে গান গাইতো –“তাহার পহরে দেহেখেন ভাল, উড়ে জাহাজ চহলিয়া গেল !” সঙ্গে সঙ্গে ভোঁ করে একটা উড়োজাহাজের ছবি চলে যেতো ! আবার আসতো চানাচুরওয়ালা সঙ সেজে। রঙ বেরঙের কাপড়ের তালি মারা আলখেল্লা পরে মাথায় রঙিন লম্বা কাগজের টুপি আর পায় ঘুঙুর দিয়ে। গলায় ঝোলানো থাকতো চানাচুরের বাক্স। একহাতে থাকতো একটা ডুগডুগি। নেচে নেচে গান করতো , ” ছেলেপুলে ছব আও, দৌড় দৌড়ছে যাও, মার কাছে যাও, পয়ছা লিয়ে আও, চ্যানা কিনে কিনে খাও ! লায়ে মজাদার চ্যানাচুররর গরম !”
আবার মাঝে মাঝে পাড়ায় সাপ খেলা আর বাঁদর খেলাওয়ালা আসতো। আম্মা সহজে পয়সা দিতে চাইতেননা। তা–আমরা ওদের সাথে সাথে হাঁটা দিতাম ! যেখানেই খেলা হতো সেখানেই দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম, ফ্রী ! এইরকম হাঁটতে-হাঁটতে কোথায় না কোথায় চলে যেতাম। দুপুরে খিদে পেলে বাড়ির কথা মনে পড়তো । উল্টো পথে হাঁটা ধরতাম আর নির্ঘাত হারিয়ে যেতাম ! আমি আর মেজোবুবু মাহমুদা। আমরা সদর রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম , খুঁজতাম কোন না কোন চেনা জায়গা। কোন পুকুর , কোন বিল্ডিং, কোন বাড়ি, কোন ব্রীজ বা কোন বাজার। পেয়ে গেলেই ব্যাস ! সেখানথেকে সোজা ভবানী সার চারতলা বিল্ডিং হয়ে পাথরতলা আমাদের বাড়ি। সারা পাবনা শহরে ওই একটাই চারতলা বিল্ডিং ছিলো –যার নিচে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালে মনে হতে বিল্ডিংটা আকাশ ছুঁয়েছে ! আর এখন আসে পাশের পাঁচ-ছয় তলা বিল্ডিংয়ের মধ্যে এই জীর্ণ বাড়িটাকে কত ছোটই না লাগে ! বিকালের দিকে বাড়ি ফিরতাম। সদর দরজায় টোকা দেওয়ার সাহস হতো না। পিছনের খিড়কি দিয়ে ঢুকে চোরের মতো দাঁড়াতাম জামরুল গাছের তলে। আমাদের দেখেই আম্মা লাঠি হাতে তেড়ে আসতেন। আম্মাকে দেখেই মাহমুদা একলাফে গেটের বাইরে চলে যেতো। আমি দৌড়া দৌড়ি করতাম না। পড়তো দুই একটা লাঠির বাড়ি পিঠে। আম্মা মাহমুদাকে শাসাতেন, “ধরবের পারলি তোর পিঠির চামড়া তুলে ফেলা দেবোনে।” কিন্তু তাকে ধরে কে ! আম্মা তো গেটের বাইরে যেতে পারতেন না। মাহমুদা মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গেট দিয়ে ঢুকে চেঁচিয়ে বলতো, ” আম্মা, আসবো ?” আম্মা ঘরথেকে বের হয়ে বলতেন, ” আয়, তোক আসাচ্ছি !” সাথে সাথে সে আবার গেটের বাইরে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে আব্বা বাড়ি এসে তারপর সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। আব্বা থাকলে আম্মা কিছুতেই আমাদের মারতে পারতেন না।
আমার ছোট বোন রোকেয়ার অভ্যাস ছিলো, দূর থেকে লাঠি হাতে আম্মা্কে দেখলেই “ওরে বাবারে, মারে- মরে গেলাম !” বলে এমন জোরে চেঁচাতো যে আম্মা কাছে আসার আগেই আস পাশথেকে লোকজন এসে ধরে ফেলতো।
এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আমি মনে হয় বেশি মার খেতাম। আসলে তা না। আমি দোড় ঝাঁপ মা্রতাম না বলে আম্ম বেশি মারতেন না, দু একটা বাড়ি দিতেন, তাও আস্তে। মাহমুদা আর রোকেয়াকে সহজে ধরা যেতো না। হঠাৎ কখনো ধরে ফেললে তারা হাত পা ছুড়ে এঁকে বেঁকে এমন লাফালাফি করতো যে সহজে ওদের গায়ে লাঠির বাড়ি লাগানো যেতো না, কিন্তু যেটা লাগতো, এহেবারে মোক্ষম !
এটাও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আমার আম্মা মনেহয় খুব রাগি ছিলেন , আমাদের সব সময় মার ধর করতেন ! আসলে তাও না। অন্য সময় আম্মা আমাদের সাথে গল্প করতেন, হাসাহাসি করতেন। আব্বার গল্প, দাদার গল্প। তাকে রাগাতাম আমরা। আমাদের বাড়িতে নিয়ম ছিলো কাউকে অশালীন ভাষায় গালি দেওয়া যাবে না, কারও নামে নালিশও করা যাবে না। নালিশ করলে–যার নামে নালিশ তাকে ধরে মার আবার যে নালিশ করেছে তাকেও ধরে মার ! আমরা ছিলাম আট ভাই বোন। বড়বুবুর পরে আনার ভাই, তারপর আশরাফ ভাই, তারপর মাহমুদার পর থেকে আমরা পিঠে পিঠি চার বোন। সকলের শেষে আমাদের ছোটভাই নুরুজ্জামান বাবুল। চার বোন পিঠেপিঠি হওয়ায় আমরা বোনেরা সারাদিন হুটোপুটি, মারামারি কাঁদাকাটি করতাম, আম্মা অতিস্ট হয়ে মার লাগাতেন !