Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অর্জুন বেড়িয়ে এলো (১৯৯৩) || Samaresh Majumdar » Page 4

অর্জুন বেড়িয়ে এলো (১৯৯৩) || Samaresh Majumdar

প্রবল একটা ঝাঁকুনি, মনে হল হাড়গোড় সব ভেঙে যাচ্ছে, অর্জুন বন্ধ চোখে অন্ধকার দেখল। এবং তারপরেই শরীরে ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া লাগল। বাইরে বৃষ্টি হলেও এই ঘরে তো হাওয়া ঢোকার উপায় নেই। সে চোখ খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেল। ওগুলো নিশ্চয়ই তারা। একফোঁটা মেঘ নেই কোথাও। তার মানে বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু ঘরের ছাদটা কোথায় গেল! সে তারা দেখছে কীভাবে? মাথা ঘোেরাতেই সেটা ভোঁ-ভোঁ করে উঠল। ঘর কোথায়? তার চারপাশে তো গাছগাছালি। মাথার ওপরে আকাশ। সামনে সেই ড্যাশবোর্ড, যেখানে এখনও আলো জ্বলছে। শব্দ বাজছে। সে কোথায় চলে এল? চটপট মেশিন থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়াল অর্জন। একটা রাতের পাখি বেশ ভয় পেয়েই ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল দিগন্তে। দু-তিন পা জঙ্গল ভেঙে এগিয়েও কোনও দিশা পেল না সে। শুধু যন্ত্রটা থেকে আসা আওয়াজ রাত্রের নিস্তব্ধতাকে চূর্ণ করছে। অর্জুন আবার ফিরে এল ওটার কাছে। কীভাবে আওয়াজটাকে বন্ধ করা যায়। তার মনে পড়ল শেষবার সে যে সুইচটাকে টিপেছিল তার কথা। পাশাপাশি আর-একটি সুইচ আছে। সেটিকে টিপতেই সব শব্দ আচমকা থেমে গেল। সুইচটির গায়ে দ্বিতীয়বার চাপ দিতেই আবার শব্দ চালু হল। বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে সে তৃতীয়বার চাপ দিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল।

কিছুক্ষণ সে সময় নিল ব্যাপারটা বুঝতে। যন্ত্রটায় সে বসে ছিল। সে ছিল ঘরের মধ্যে। এখন জঙ্গলে। তার মানে সে খুবই বিস্ময়কর এক জায়গায় চলে এসেছে মেশিনের কল্যাণে। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার একমাত্র বাহন হল ওই মেশিনটি। অতএব একে হারালে চলবে না। অর্জুন ডালপালা ভেঙে পাতার আড়ালে মেশিনটাকে এমনভাবে ঢেকে রাখল যাতে চট করে কারও নজরে না পড়ে। অনেকটা নিঃসন্দেহ হওয়ার পর সে মেশিনটাকে পেছনে রেখে সোজা হাঁটতে লাগল। জায়গাটায় এত বুনো ঝোপ যে, বোঝাই যায় অনেককাল কেউ এদিকে আসেনি। হাঁটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। মিনিটচারেক হাঁটার পর চোখের সামনে একটা বিশাল রাস্তা দেখতে পেল। তার মনে পড়ল এতবড় রাস্তা সে যখন আমেরিকায় গিয়েছিল তখন দেখেছিল। রাস্তার দুদিক দিয়ে একসঙ্গে আটখানা গাড়ি স্বচ্ছন্দে যেতে পারে। মাঝখানে তিরিশ গজ অন্তর তীব্র আলো জ্বলছে।

সে নিজের কবজির দিকে তাকাল। এখন সন্ধে সাতটা, সেপ্টেম্বর মাসের বারো তারিখ, উনিশশো একানব্বই। এই সন্ধেবেলায় আকাশ নির্মেঘ। অথচ সেখানে আকাশ দেখা যাচ্ছিল না। কাছাকাছি জনবসতি আছে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তায় নেমে বাঁ না ডান, কোনদিকে হেঁটে যাবে ঠাওর করতে পারছিল না অর্জুন।

হঠাৎ মাথার ওপরে এয়ারবাসের ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যেতে সে চোখ ওপরে তুলল। কী আশ্চর্য, ওটা কী? নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে এমন একটা আকাশযান যার আকার গোল টুপির মতো, ওই শব্দ করতে করতে উড়ে গেল পশ্চিমে। খানিক বাদে পশ্চিম থেকে ওই একই ধরনের যান ওপরে উঠে শূন্যে মিলিয়ে গেল। এগুলো কি প্লেন? তা হলে তার ডানা কিংবা লেজ কোথায়?

অর্জুনের সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। ডক্টর গুপ্তের মেশিনটা যদি সঠিক কাজ করে তা হলে সে আর তিস্তাপারের ওই বাংলোয় নেই। কিন্তু কোথায় আছে? এতবড় চওড়া রাস্তায় এই সন্ধেবেলায় গাড়ি ছুটছে না কেন? সে ঠিক করল রাস্তায় নামবে না। পাশের জঙ্গল দিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল। শুধু জায়গাটা ছাড়ার আগে ভাল করে দেখে রাখল যাতে পরে চিনতে অসুবিধে না হয়। তিন-তিনটে সিড়িঙ্গে গাছ অদ্ভুতভাবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গা ঘেঁষে সোজা গেলেই ডক্টর গুপ্তর মেশিনটা পাওয়া যাবে।

অর্জুনের ঘড়িতে যখন নটা, মানে রাত্তির নটা, তখন পুবের আকাশে সূর্যদেব দেখা দিলেন। খুব স্বাভাবিক ভোর, নরম রোদে গাছগাছালি ঝলমল। অর্থাৎ সে সময়ের দিক থেকে অন্তত আট ঘণ্টা পিছিয়ে আছে, একটি দিনের পরিমাপে।

দিন শুরু হতেই অদ্ভুত চেহারার গাড়িতে রাস্তাটা ভরে গেল। ষাট কিলোমিটার স্পিডে গাড়িগুলো ছুটছে, একটার সঙ্গে পরেরটার ব্যবধান দশ বারো ফুটের। পাশাপাশি দুমুখো রাস্তার সবকটা লেন এখন একটু-একটু করে ভরে উঠেছে। এই গাড়িগুলোকে যেন কেউ এতক্ষণ আটকে রেখেছিল, ছাড়া পেয়ে সবাই হুড়মুড়িয়ে চলছে। জঙ্গলের আড়ালে দাঁড়িয়ে অর্জুনের মনে হল হুড়মুড়িয়ে শব্দটায় একটা বিশৃঙ্খল মানে বোঝায় কিন্তু গাড়িগুলো যাচ্ছে খুবই শিষ্ট হয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, এতগুলো গাড়ি রাস্তায় ছুটছে, কিন্তু একটিও হর্নের আওয়াজ নেই, গাড়ির বিকট শব্দ অথবা ধোঁয়া বেরোচ্ছে না। মাঝে একটি টু-হুইলার বেরিয়ে গেল। জলপাইগুড়িতে অর্জুনের লাল বাইক হলে এতক্ষণে কান ফাটাত। এই রাস্তায় কোনও ফুটপাত নেই। আমেরিকার হাইওয়েগুলোকে যেমন সে দেখেছিল তার সঙ্গে হুবহু মিল। অর্জুনের মনে হল সে নিঘাত আমেরিকায় এসে পৌঁছেছে। ওখানকার হাইওয়েতে কেউ হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাতে যায় না। চাইলেও গাড়ি থামবে না। অতএব এখানে অর্জুনও সেই চেষ্টা করল না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল।

ঘড়িতে যখন রাত এগারোটা, এখানে তখন চনমনে রোদুর। হঠাৎ জঙ্গলটা শেষ হয়ে গেল। একটু ঢালু মাঠের পরে কিছু রঙিন ঘরবাড়ি, তাদের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। দূর থেকে বোঝা যায় মানুষজন আছে। অনেকটা কৌতূহল নিয়ে অর্জুন এগিয়ে যেতে বিপ-বিপ শব্দ কানে এল। সে মুখ ফিরিয়ে দেখল দুটো বাচ্চা মেয়ে দ্রুতগতিতে সাইকেল চালিয়ে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সাইকেল দুটো সম্ভবত ফাইবার গ্লাসের। চলে যাওয়ার সময় দুটো মেয়েই তার দিকে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে গেল।

অর্জুন বাড়িঘরগুলোর কাছাকাছি আসতেই ভেতর থেকে কেউ একজন বেরিয়ে এল। লোকটি ঈষৎ খাটো, পরনে শর্টপ্যান্ট কিন্তু তার সেলাই অন্যরকম। চোখাচোখি হতে লোকটিকেও অবাক হতে দেখল সে। কী ভাষায় কথা শুরু করবে বুঝতে না পেরে অর্জুন হাসল। তারপর ইংরেজির আশ্রয় নিল, গুড মর্নিং।

লোকটি ঠোট কামড়াল। তারপর ঘুরে ভেতরে চলে গেল। অর্জুন ফাঁপরে পড়ল। নিশ্চয়ই ও ইংরেজি জানে না। ইংরেজি না-জানা সভ্য দেশ ইউরোপে অনেক আছে। কিন্তু এই লোকটিকে দেখে মোটেই ইউরোপিয়ান বলে মনে হচ্ছে না। চিন বা জাপানের সাধারণ মানুষও ইংরেজিতে কথা বলা দরকার বলে মনে করে না। সাধারণত যেসব দেশ এককালে ব্রিটিশদের অধীনে ছিল তারাই ইংরেজি শিখেছে বাধ্য হয়ে।

অর্জুন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে কি না ভাবছিল এমন সময় সেই লোকটি আবার বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে। বৃদ্ধের পাকা দাড়ি, লম্বা চুল আবার জিনসের প্যান্ট এবং কায়দা করা শার্ট, সব মিলিয়ে অন্যরকম দেখাচ্ছে। অর্জুন খুব বিনয়ের সঙ্গে নমস্কার করল।

বৃদ্ধ হাসলেন এবং নমস্কার ফিরিয়ে দিলেন। তারপর হাত নেড়ে তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন। অর্জুন ওঁদের পেছন-পেছন ভেতরে ঢুকল। সুন্দর সাজানো একটি ঘর। এবং দেওয়ালের একটি ছবির দিকে তাকাতেই সে খুব অবাক হয়ে গেল। ছবিটা কাচে বাঁধানো নয়, পুরো দেওয়াল জুড়ে আঁকা।

সে প্রশ্ন না করে পারল না, রবীন্দ্রনাথ টেগোর? বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, টেগোর? না। ঠাকুর। আমাদের পরমপিতা।

আ-আপনি বাঙালি?

বাঙালি? হ্যাঁ, আমরা বঙ্গভাষাভাষী। প্রায় দুশো বছর আগে পরমপিতা পৃথিবীতে এসেছিলেন। আমাদের যা কিছু গৌরব তা ওঁরই দান। বৃদ্ধ হাসলেন, আপনি বঙ্গভাষা জানেন জেনে খুশি হলাম। আপনার নিবাস?

আমার বাড়ি জলপাইগুড়ি শহরে।

বৃদ্ধ যেন খুব অবাক হলেন। তিনি সঙ্গীর দিকে তাকালেন। সঙ্গীর চোখ ছোট হল। বৃদ্ধ ইঙ্গিতে অর্জুনকে বসতে বললেন, মনে হচ্ছে আপনি আপাতত অনেকদূর পথ ভ্রমণ করেছেন। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?

অর্জুন একটি সুদৃশ্য চেয়ারে বসল। তারপর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বৃদ্ধ তাঁর সঙ্গীকে ইশারা করতে সে ভেতরের দরজা দিয়ে চলে গেল। বৃদ্ধ এবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পোশাক দেখছি প্রায় নতুন। আমাদের বালক বয়সে ওইরকম কাপড়ের পোশাক দেখেছি। আপনি কোত্থেকে এগুলো সংগ্রহ করলেন?

এই বৃদ্ধ তার ছেলেবেলায় এমন জামাপ্যান্ট দেখেছে? লোকটার মাথা ঠিক আছে তো? সে হেসে বলল, আমি দোকান থেকেই কিনেছি।

এই সময় সেই যুবক বেরিয়ে এসে বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কিছু বলল। বৃদ্ধ ব্যস্ত হলেন, আপনাকে দেখে খুব ভাল লাগল। আপাতত এই ঘরে বিশ্রাম নিন। বাইরের রোদ হয়তো আপনার পক্ষে ক্ষতিকর হবে। আমাকে এখনই একটু বিশেষ কাজে বেরোতে হবে। ততক্ষণ পুত্র আপনাকে দেখাশোনা করবে। বৃদ্ধ তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

অর্জুনকে অবাক হতে দেখে যুবক বলল, বাবার একটা জরুরি কাজ আছে মিনিট দশেকের মধ্যে। উনি সেটা খেয়াল করেননি।

এই সময় ঘরে মিষ্টি বাজনা বাজতে লাগল। যুবক উঠে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে লাগানো একটা সুইচ টিপতেই সেখানে সিনেমার পর্দার মতো আলো ফুটে উঠল। বাজনা বন্ধ হয়ে গেছে। চৌকো আলোর মধ্যে সুন্দরী মেয়ের মুখ ভেসে উঠল, বাবা বেরিয়ে গেছে দাদা?

হ্যাঁ, এইমাত্র। আমি মনে করিয়ে দিলাম। যুবকের দেওয়ালের দিকে মুখ।

আজকাল বাবার যে কী হচ্ছে! তুমি কী করছ?

একজন অতিথি এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলছি।

অতিথি? কে? আমি চিনি?

না। মানে সম্ভবত না। তিনি বলছেন জলপাইগুড়ি থেকে আসছেন। কথাটা বলেই যুবক হাসল। সুন্দরী বেশ অবাক, কী যা-তা বলছ?

আমি ঠিকই বলছি। অর্জুন শুনতে পেল সুন্দরী চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, মাথা ঠিক আছে?

এখনও বুঝতে পারছি না। কখন ছুটি হচ্ছে?

আধঘণ্টার মধ্যেই। ঠিক আছে।

ঠিক আছে। দেওয়ালের আলো মিলিয়ে গেল। যুবক সুইচ অফ করে ফিরে এসে হাসল, আমার বোন। ওর রাতের চাকরি।

অর্জুন হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। তার মুখ থেকে প্রশ্ন ছিটকে বের হল, উনি আপনার সঙ্গে কীভাবে কথা বললেন?

কেন? এই পদ্ধতি আপনি আগে দেখেননি?

না। আমরা টেলিফোনে কথা বলি। সেখানে শোনা যায়, দেখা যায়।

আমরা শ্রবণ এবং দর্শন একই সঙ্গে বাস্তবায়িত করতে পেরেছি। আচ্ছা, আপনি মনে করার চেষ্টা করুন তো, এখানে আসার ঠিক আগে কোথায় ছিলেন?

কোথায় ছিলেন মানে?

কোনও চিকিৎসালয়ের কথা আপনার কি মনে পড়ে?

হঠাৎ অর্জুনের খেয়াল হল। এদের কাছে তার কথা, পোশাক, আচরণ নিশ্চয়ই অন্যরকম লাগছে। স্বভাবতই এরা ভাবতে পারে সে কোনও মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছে। এই ভাবনাটা ওদের বেশি বিচলিত না হতে সাহায্য করছে। অতএব এদের ভুল না ভাঙানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

সে অভিনয় করল, আমার মাথায় যন্ত্রণা হত খুব। তবে আজ সকাল থেকে সেই যন্ত্রণা আর নেই।

আপনার বাবা-মা-স্ত্রী অথবা বাড়ির ঠিকানা মনে আছে?

না। কিছুই মনে করতে পারছি না। তবে শরীর খুব ভাল লাগছে।

এই পোশাকগুলো আপনি পেলেন কী করে? কোনও চিকিৎসালয়ে তো এমন পোশাক ব্যবহার করতে দেবে না। সেখানে কি মজাদার পোশাক পরার কোনও অনুষ্ঠান হয়েছিল। মনে করে দেখুন!

অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, মনে পড়ছে। সেরকম একটা কিছু…।

যুবক এবার গম্ভীর হল, দেখুন, একজন নাগরিক হিসাবে আমার কর্তব্য এখনই জনস্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনাকে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু আপনি আমার বাবার অতিথি। তাছাড়া বলছেন আপনার শরীর ভাল আছে। অনেক সময় অবশ্য বাইরের আলো হাওয়া খুব কাজে দেয়। দাঁড়ান, আপনার খাবার নিয়ে আসি। যুবক ভেতরে চলে গেল।

অর্জুন কিছুক্ষণ একা-একা আকাশপাতাল ভাবল। তার নিজেকে উন্মাদ ভাবতে কিছুতেই ভাল লাগছিল না। যুবক ফিরল একটা সুন্দর ট্রেতে খাবার নিয়ে। অর্জুনের সামনের টেবিলে ট্রেটা বসিয়ে দিয়ে বলল, মোটামুটি এই বাড়িতে ছিল।

অর্জুন দেখল এক বাটি সুপ, অনেকখানি সবজি সেদ্ধ আর গোল ফুলকো রুটি দুখানা প্লেটে রয়েছে। সে চুপচাপ খেয়ে গেল। খিদে যে মারাত্মক পেয়েছিল তা খাবার মুখে দিতে মালুম হল। এমন স্বাদহীন খাবার শেষ করতে বেশি সময় লাগল না। খাবার শেষ করা মাত্র দরজায় শব্দ হল। এবং দেওয়ালে যার ছবি দেখেছিল সেই সুন্দরীকে ভেতরে ঢুকতে দেখল সে। সুন্দরী ঘরে ঢুকতেই তাকে দেখতে পেয়েছিল। যুবক বলল, আসুন, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার বোন বলাকা। আপনার নামটা জানা হয়নি।

অর্জুন। সে দুই হাত যুক্ত কবল নমস্কার জানাতে। বলাকা স্বচ্ছন্দে এগিয়ে এসে ডান হাত বাড়িয়ে অর্জুনের আঙুল স্পর্শ করল, আপনার বাড়ির লোক নিশ্চয়ই চিত্রাঙ্গদাব খুব ভক্ত।

চিত্রাঙ্গদা? অর্জুন হতভম্ব।

নইলে অর্জুন নামটি তাঁরা রাখতেন না তাই না?

এবার বুঝল অর্জন। বলাকা রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের কথা বলছে।

বলাকা এবার তার দাদার দিকে তাকাল, আমি দুটো প্রবেশপত্র পেয়েছি। আর ঠিক এক ঘণ্টা বাদে লন্ডনে খেলা শুরু হবে।

যুবক বলল, ক্রিকেট আমার ভাল লাগে না। ফুটবল হলে যেতাম। সে এবার অর্জুনের দিকে তাকাল, আপনি ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাবেন?

কোথায় হচ্ছে? অর্জুন ভয়ে-ভয়ে জানতে চাইল।

লন্ডনে। ভারত বনাম ইংল্যান্ড। বলাকা বলল, এ-খবর আপনি জানেন না?

যুবক নিচু গলায় বলল, ওর জানার কথা নয়।

আমার কাছে একটি অতিরিক্ত প্রবেশপত্র আছে। যেতে চাইলে সঙ্গে আসুন।

এই ঘব থেকে বেরনো যাবে, প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না, অর্জুন তাই উঠে দাঁড়াল। যুবক জিজ্ঞেস করল, তোমরা কখন ফিরছ?

বলাকা জবাব দিল, দু ঘণ্টার তো খেলা, শেষ হলেই ফিরব।

বলাকাকে অনুসরণ করে অর্জুন হাঁটতে-হাঁটতে ভেবে পাচ্ছিল না ক্রিকেট কী করে দু ঘণ্টার খেলা হবে? পাঁচদিনের টেস্ট, তিনদিনের ম্যাচ থেকে এখন ওয়ান ডে-তে এসেছে। অথচ বলাকা বলছে দু ঘণ্টার খেলা।

পার্কিং লটে একটা লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে সেটায় উঠে বসে পাশের দরজা বোতাম টিপে খুলে দিল বলাকা। অর্জুন দেখল গাড়িতে গীয়ার নেই, ক্ল্যাচ নেই। সুইচ অন করে একটা বোতাম টিপতে গাড়ি ভুস করে ছুটে চলল। কয়েক সেকেন্ডেই হাইওয়ে। হঠাৎ মাথার ওপরে একটা বিরাট হোর্ডিং নজরে এল, জলপাইগুড়ি শহরে সুস্বাগতম।

জলপাইগুড়ি শহর? অর্জুন সোজা হয়ে বসল, এটা জলপাইগুড়ি শহর নাকি? যে-শহরে সে জন্মেছে, বড় হয়েছে, তার কিছুই চেনা মনে হচ্ছে না? এতবড় হাইওয়ে কবে জলপাইগুড়িতে ছিল? শহরের মধ্যে সরু ঘিঞ্জি কিছু রাস্তায় যাতায়াত করত সবাই।

সে জিজ্ঞেস করল, তিস্তা নদীটা কোন দিকে?

বলাকা হাসল, শুনলাম আপনি বলেছেন যে, জলপাইগুড়িতে আপনার বাড়ি, তিস্তা নদীর কী অবস্থা তা জানেন না।

অর্জুন বুঝল। কেন বৃদ্ধ এবং যুবক তার কথা শুনে অমন অবাক হয়েছিল। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলাকা জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমাকে সত্যি কথা বলুন তো? আপনার পরিচয় কী?

অর্জুন হাসল। সত্যি কথা বলে কোনও লাভ নেই। কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না। সে মাথা নাড়ল, আমার কোনও কথাই মনে পড়ছে না।

কোনও কষ্ট হচ্ছে?

বিন্দুমাত্র নয়।

পিলপিল করে গাড়ি ছুটে চলেছে। নানা ধরনের গাড়ি, কিন্তু কোনও শব্দ নেই। দিনটা ভালই। বলাকা বলল, আমরা স্টেডিয়ামের দিকে যাচ্ছি। আপনি তিস্তার কথা বলছিলেন, এই দেখুন।

বলাকার আঙুল অনুসরণ করে অর্জুন দেখল একটা বড় নোটিস বোর্ডে লেখা আছে, আপনারা তিস্তার ওপর দিয়ে যাচ্ছেন।

মানে? বলাকা যা বলল তা হল, এককালে তিস্তা নাকি সারা বছর শুকিয়ে থাকত। অনেকখানি জায়গা শহরের পাশে বালির চর হয়ে পড়ে নষ্ট হত। মাঝে-মাঝে বর্ষায় বন্যা হত এই যা। বেশ কিছু বছর আগে পাহাড় থেকে যেখানে তিস্তা নীচে নামছে সেখান থেকেই মাটির তলায় বিশাল টানেল করে নদীর জল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ না থাকায় সারাবছর সেখানে জল থাকে। স্রোতও। ফলে ভাল বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। আর ওপরের বালি জমিকে নানান কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। শহরের পাশে সেই বিরাট চরেই গড়ে উঠেছে খেলাধুল-রি নানান ঘেরা মাঠ।

পেটের ভেতর চিনচিন করতে লাগল অর্জুনের। সেই বিখ্যাত চর উধাও? তিস্তা-ব্রিজের দরকার নেই। এখানে স্টেডিয়াম হয়েছে। জলপাইগুড়িতে স্টেডিয়াম বলতে ছিল কয়েকটা গ্যালারি নিয়ে হাকিমপাড়ার টাউন ক্লাব। আর বলাকা যেখানে গাড়ি পার্ক করল, লম্বা ট্রলি জাতীয় গাড়ি তাদের তুলে নিয়ে যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে অর্ধেকটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল স্টেডিয়াম। কবে হল এসব? এত লোক আজ খেলা দেখতে এসেছে তবু ঝামেলা হচ্ছে না এতটুকু! প্রবেশপত্র দেখিয়ে মাঠে ঢোকা হতে চোখ জুড়িয়ে গেল অর্জুনের। এমন সবুজ মাঠ, ঝকঝকে স্টেডিয়াম সে কখনও দেখেনি। মাঠের দুদিকে স্কোরবোর্ড রয়েছে। আর একপাশে বিশাল একটা ক্যামেরাজাতীয় যন্ত্র মাঠেব দিকে মুখ করে রাখা হয়েছে। গ্যালারি ইতিমধ্যেই ভরে উঠেছে।

এই সময় আকাশবাণী শোনা গেল, প্রিয় বন্ধুগণ, আর কিছুক্ষণ বাদেই ইংল্যান্ডের লর্ডস মাঠে ভারত বনাম ইংল্যান্ডের ক্রিকেট খেলা শুরু হবে। দুই দলে যাঁরা খেলছেন তাঁদের নাম নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। তবু আর-একবার জানানো হচ্ছে। ভারতীয় দলের অধিনায়ক স্বপনলাল। দলে আছেন…।

অর্জুন কান পেতে শুনল। একটি নামও তার চেনা বলে মনে হল না। পাশে বসা বলাকাকে সে না জিজ্ঞেস করে পারল না, শচীন খেলছে না?

কে শচীন?

শচীন তেণ্ডুলকর। বিস্ময় বালক।

বিস্ময় বালক মানে? এরকম নাম তো কখনও শুনিনি। বলাকা অবাক।

অর্জুনের ডান দিকে বসা এক বৃদ্ধ বললেন, শচীন তেন্ডুলকর? নামটা কিন্তু কোথায় পড়েছি বলে মনে হচ্ছে।

তাঁর ওপাশে বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, অনেকদিন আগে ওইরকম নামের এক ভদ্রলোক নাটক লিখতেন। মারাঠি ভাষায়।

কতদিন আগে? প্রথম বৃদ্ধ জানতে চাইলেন।

সময়টা ঠিক মনে নেই। নাটকের ওপর একসময় পড়াশোনা করেছিলাম। তখন পড়েছিলাম। তবে প্রথম নামটা নিশ্চয়ই শচীন নয়। দ্বিতীয় বৃদ্ধ জবাব দিলেন।

অর্জুন আর কথা বাড়াল। হঠাৎ বাজনা বেজে উঠল। আকাশবাণী হল, খেলা শুরু হচ্ছে। এখন আমরা আপনাদের সামনে লর্ডস মাঠকে উপস্থিত করছি।

সঙ্গে সঙ্গে মাঠের একপাশে দাঁড় করানো ক্যামেরাজাতীয় যন্ত্রটা চালু হল। অর্জুন অবাক হয়ে দেখল স্টেডিয়ামের মাঝখানে মাঠটা মুহূর্তেই বদলে গিয়ে লর্ডস মাঠে পরিণত হল। আম্পায়ার দুই অধিনায়ককে দিয়ে টস করাচ্ছেন। ইংল্যান্ড টসে জিতে প্রথম ঘন্টার ব্যাটিং নিল। এই মুহূর্তে লর্ডসে বসে থাকলে সে যেমনটি দেখত, জলপাইগুড়িতে বসে ঠিক তেমনই দেখছে। মাঠ, খেলোয়াড়। এক শুধু দর্শকরা পালটে গেছে। সে বলাকাকে না জিজ্ঞেস করে পারল না, অত হাজার মাইল দূরে যে খেলা হচ্ছে তা এই মাঠে কী করে দেখানো সম্ভব?

বলাকা হাসল, আপনি সত্যি সব ভুলে গেছেন! আমার ঠাকুর্দার ঠাকুদারা ঘরে বসে লর্ডসের খেলা দূরদর্শন যন্ত্রে দেখতেন। সেটা কী করে সম্ভব হয়েছিল? শুধু চারচৌকো বাক্সের পরদায় ছবিটাকে না রেখে এই বড় মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে মেজাজটা ভাল পাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্তত তিনশোটা মাঠে একই সঙ্গে মানুষ খেলাটা দেখতে পাচ্ছে।

খেলা চলাকালীন এমন মগ্ন হয়ে গিয়েছিল অর্জুন যে, অন্যদিকে মন ছিল। প্রথম ঘন্টায় ইংল্যান্ড আশি রান করল তিন উইকেট হারিয়ে। ভারত বল করেছে কুড়ি ওভার। দ্বিতীয় ঘণ্টার জন্য ভারত নেমেই একটা উইকেট খোয়াল। সমস্ত স্টেডিয়াম জুড়ে হাহাকার। ইংল্যান্ড উনিশ ওভার বল করলে ভারত রান তুলল তিন উইকেটে ছিয়াত্তর। খেলা শেষ। কিন্তু যেহেতু ইংল্যান্ড এক ওভার কম বল করেছে তাই ভারত চার রান বোনাস পেল। ফলে দুই দলের স্কোর হয়ে গেল সমান-সমান, আশি। ম্যাচ ড্র। বলাকা বলল, আজকাল প্রায়ই দেখছি ম্যাচ ড্র হচ্ছে। চলুন।

অর্জুন নিজের ঘড়ির দিকে তাকাতে পুরনো সময় দেখতে পেল। বলাকার চোখ পড়েছিল তার ঘড়ির ওপর। সে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, ও মা, এ কীরকম ঘড়ি আপনার? দেখি, দেখি।

বাধ্য হয়ে নিজের কবজিটাকে তুলে ধরল অর্জুন। বলাকা সেটাকে দেখতে-দেখতে বলল, খুব দাম হবে ঘড়িটার। পুরনো জিনিস সহজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আপনার ঘড়ি যে উলটোপালটা সময় দিচ্ছে।

অর্জন মাথা নাড়ল, ঠিক করা হয়নি।

কিন্তু তারিখটা? কী লেখা আছে?

অর্জুন ইংরেজিতে তারিখটা দেখল। এবং তখনই খেয়াল হল এখানে আসার পর থেকে সে একটিও ইংরেজি শব্দ শুনতে পায়নি। বলাকাদের পরিবারের কেউই কথার মধ্যে ইংরেজি বলেনি। হয়তো এখানে কেউ ইংরেজি শেখে না। এই কারণেই বলাকা পড়তে পারছে না তারিখটা, সে দেখল অদ্ভুত দৃষ্টিতে বলাকা তাকে দেখছে। একটা কিছু জবাব দিতেই হয়। কিন্তু তার আগেই বলাকা বলল, নিশ্চয়ই এটাও আপনার মনে পড়ছে না। চলুন।

বলাকার পেছন-পেছন হাঁটতে-হাঁটতে অর্জুনের মনে হল মেয়েটা তার অস্তিত্ব সম্পর্কে এবার বেজায় সন্দেহ করছে, সে কী করে এদের বোঝাবে উনিশশো একানব্বই খ্রিষ্টাব্দে শিলিগুড়ির কাছে একটা বাংলোয় ছিল! আর এখন ঠিক কোন সাল তাই তো বোঝা যাচ্ছে না।

গাড়িগুলো ফিরছিল। হাইওয়ের গায়ে মাঝে-মাঝে লেখা, ডান দিকের সরু পথ দিয়ে জলযোগকেন্দ্র, বিশ্রামালয়। তিন নম্বর বাহিবপথ বিমানবন্দরের জন্য। বিমানবন্দর? জলপাইগুড়ি শহরে এয়ারপোর্ট আছে নাকি?

হঠাৎ বলাকা বলল, আপনি এতক্ষণ আমাদের সঠিক কথা বলেননি। হতে পারে আপনার মস্তিষ্ক স্থির নেই কিন্তু আপনার পোশাক, ঘড়ি, কথাবার্তায় এখনকার কিছুই ধরা পড়ছে না। আপনাকে সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু তার আগে আপনাকে আমি জলপাইগুড়ি শহরটা ঘুরিয়ে দেখাব। কথা বলতে বলতেই বলাকা হাইওয়ে থেকে শহরে যাওয়ার পথ ধরে ডান দিকে বাঁক নিল। অর্জুনের মনে পড়ল আমেরিকার হাইওয়েতে এইরকম পথগুলোকে এগজিট বলে। গঠনটা ঠিক একই ধাঁচের, বাঁ দিকের কার পার্কিং-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলাকা গাড়ির বোম টিপল। সঙ্গে-সঙ্গে চার ইঞ্চিটাক টিভি স্ক্রিন বেরিয়ে এল ড্যাশ বোর্ডের একধারে। বাজনা বাজছে কোথাও। এবারে সেই স্ক্রিনে বলাকার দাদাকে দেখা গেল, কী ব্যাপার?

বাবা ফিরেছেন?

হ্যাঁ। একটু আগে। তোমরা কোথায়?

ছয় নম্বর বাহির পথে। আমরা একটু শহরে যাচ্ছি।

কেন?

অর্জুনকে শহর দেখাব।

একটু সতর্ক থেকো। বাবা ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা অত্যন্ত কৌতূহলী হয়েছেন। ঠিক এক ঘন্টা বাদে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে সবাই এখানে আসছেন। এর ভেতরেই চলে এসো। আলো নিভে গেল। বলাকা সুইচ টিপে স্ক্রিনটাকে আবার ভেতরে চালান করে দিয়ে বলল, শুনলেন তো? এবার সত্যি কথা না বলে আপনার কোনও উপায় নেই। এই শহরের কোথাও আপনি লুকিয়ে থাকতে পারবেন না। আপনি আমাকে সব কথা খুলে বলতে পারেন।

অর্জুনের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। বলাকা যে একটুও মিথ্যে বলছে না তা সে বুঝতে পারছিল, কিন্তু কী করে সঠিক ব্যাপারটা সে বোঝাবে। বলাকা আবার গাড়ি চালু করে গুনগুন করে সুর ধরল, আর আমি যে কিছু চাহিনে। হঠাৎই সে থেমে গিয়ে প্রশ্ন করল, পরের লাইনটা কী বলুন তো?

অর্জুনের মনে পড়ল দেবব্রত বিশ্বাসেব গলায় রবীন্দ্রনাথের এই গানটি সে শুনেছে। মনে করেই সে জবাব দিল, জননী বলে শুধু ডাকিব।

বাঃ। খুব ভাল। এবাব বলুন।

গাড়ি এখন শহরেব মধ্যে ঢুকছে, সব পালটে গেছে, সব। যদি অতবড় তিস্তা নদীকে ছোট কবে পাতালনদী করে দেওয়া সম্ভব হয়ে থাকে তা হলে শহরটার ভোল পালটাবেই। সে জিজ্ঞেস করল, করলা নদী কোথায়?

করলা? সেটা আবার কী?

অর্জুন এবার মরিয়া হল। যা হওয়ার হোক, বলাকাকে ব্যাপারটা বলা দরকার। সে বলল, অনুগ্রহ করে কোথাও গাড়ি দাঁড় করাবেন যেখানে আমরা কথা বলতে পারি?

বলাকা ওর দিকে তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল। দুপাশে বড় বড় ঝকঝকে বাড়ি। মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত যানবাহন চলছে। সব আধুনিক গাড়ি। একটা সিঁড়ি দিয়ে কিছু লোক নীচে নেমে গেল, তার মানে এখানে পাতালরেলও রয়েছে, জলপাইগুড়ি শহরের একটি বাড়ি বা দোকানকে সে এখন কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।

এখন পার্কিং প্লেস পাওয়া খুবই মুশকিল, বলাকা আধ ঘণ্টার জন্য একটা জায়গায় গাড়ি রেখে পাশের রেস্টুরেন্টে তাকে নিয়ে ঢুকল। রেস্টুরেন্টে একজনই কর্মচারী। থরেথরে খাবার সাজানো আছে। মানুষজন সেগুলো প্লেটে তুলে কর্মচারীটিকে দাম দিয়ে টেবিলে গিয়ে বসছে। এমন ঝকঝকে রেস্টুরেন্ট জলপাইগুড়িতে কখনও ছিল না।

দু কাপ কফি নিল বলাকা। নিল মানে কফির লিকার কাপে ঢেলে চিনি মিশিয়ে নিল, দুধ ঢালল না। তারপর ট্রে হাতে এগিয়ে গেল দাম দেওয়ার জন্য। অর্জুনের মনে হল বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এরা এর মধ্যে প্রচুর উপকার করেছে তার। অতএব কফির দাম তারই দেওয়া উচিত।

পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বলাকা কিছু বলার আগেই সে কর্মচারীটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, দুটো কফির দাম কত?

দু হাজার। কর্মচারী জবাব দিল।

হকচকিয়ে গেল অর্জুন। দু হাজার টাকা দু কাপ কফির দাম? তার কাছে তো অত টাকা নেই। পেছন থেকে বলাকা বলল, আপনি সরে দাঁড়ান, আমি দিচ্ছি। ট্রে-টাকে পাশের টেবিলে রেখে সে নিজের ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে কর্মচারীটিকে দিতেই ভদ্রলোক মেশিনে সেটা পাঞ্চ করে ফিরিয়ে দিল।

রেস্টুরেন্টের এক কোণে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে বলাকা জিজ্ঞেস করল, আপনার হাতে ওটা কী?

দশ টাকার নোট তখনও হাতেই ছিল, সেটা নিঃশব্দে এগিয়ে দিল অর্জুন। বলাকা সবিস্ময়ে সেটাকে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এটা কোথায় পেলেন?

আমার কাছেই ছিল। আমাদের সময় এই দশ টাকায় পাঁচ কাপ কফি পাওয়া যেত।

আপনাদের সময়ে মানে?

উনিশশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দ। আপনাকে আমি সব কথা খুলে বলছি। তার আগে বলুন, এটা কোন সাল, মাস, খ্রিস্টাব্দ?

আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ চব্বিশে বৈশাখ, পনেরোশো আটষট্টি সাল। বলাকা জবাব দিল।

তার মানে, কাল পঁচিশে বৈশাখ? রবীন্দ্রনাথের তিনশো বছর পূর্ণ হবে?

হ্যাঁ। কাল আমাদের বিরাট উৎসব।

অর্জুন মনে-মনে হিসাব করল, বলাকার কথা যদি ঠিক হয় তা হলে সে একশো সত্তর বছর পরের জলপাইগুড়ি শহরে বসে আছে। তার মানে ডক্টর গুপ্তের মেশিন তাকে একশো সত্তর বছর ভবিষ্যতে নিয়ে এসেছে। সে ধীরে-ধীরে সব কথা বলাকাকে খুলে বলল।

শুনতে-শুনতে বলাকা খুব উত্তেজিত, আপনি প্রমাণ দিতে পারবেন?

নিশ্চয়ই। এই পোশাক উনিশশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দে আমরা পরি। এই ঘড়ি তখন স্বাভাবিক ছিল। এই যে নোট দেখছেন, এটা দশ টাকার, তখন সারা ভারতবর্ষে এটাই চালু ছিল। অর্জুন বোঝাতে চাইল।

বলাকা কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে জিজ্ঞেস করল, আপনার এখন বয়স কত?

অর্জুন জবাব দিল, তেরোশো আটানব্বই সালে বাইশ বছর ছিল।

তা হলে তো এখন একশো বিরানব্বই হয়েছে?

হয়নি, কারণ আমি এক মুহূর্তে এখানে এসেছি। আপনি মহাভারত পড়েছেন? মহাভারতে অর্জুন নামে একজন বীর ছিলেন। তিনি স্বর্গে গিয়েছিলেন আচমকাই, জীবিত অবস্থায় সেখানে থাকার সময় তার বয়স বাড়েনি।

মহাভারত? নাম শুনেছি। আসলে রবীন্দ্রনাথের নাম ছাড়া আর কিছু পড়ার সময় আমাদের নেই। ওঁর গানই আমাদের পুজোর মন্ত্র। কী অদ্ভুত লাগছে আপনাকে দেখে, সবাইকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে।

প্লিজ, সেটা করবেন না, আমার বিপদ হবে।

প্রথম শব্দটা কী বললেন?

প্লিজ, মানে অনুগ্রহ করে। এটি ইংরেজি শব্দ।

ও, ব্রিটিশদের ভাষা। আমরা বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বলি না।

কিন্তু ভারতবর্ষ তো বিরাট দেশ, তার ভাষাও অনেক…।

নিশ্চয়ই। শুনেছি এই কারণে এক সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে দাঙ্গা হত। কেউ-কেউ বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল। শেষপর্যন্ত ঠিক হল প্রত্যেক প্রদেশকে একমাত্র বৈদেশিক ব্যাপাব ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধিকার দেওয়া হবে। এর পরে আর কোনও সমস্যা নেই। দেশের মধ্যে আমরা সাধারণত নিজেদের নিয়ম মেনে চলি। কিন্তু আপনার কথা যদি সত্যি হয় তা হলে আপনি আমার পূর্বপুরুষ? অদ্ভুত চোখে তাকাল বলাকা।

অর্জুনের লজ্জা হল। বলাকা তার সমবয়সী বলা যায়।

আপনি সত্যি এই শহরে ছিলেন?

হ্যাঁ। শহরটা তখন এরকম ছিল না।

কী রকম ছিল?

মফস্বল শহর যেমন হয়। হাইওয়ে ছিল না। একটা বাইপাস ছিল। নদী ছিল বিশাল এবং প্রায়ই জল থাকত না। উনিশশো আটষট্টি খ্রিস্টাব্দের বন্যার পর শহরটা প্রায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তিন-চারতলা বাড়ি হাতে গোনা যেত। মানুষজন ছিল ভাল, কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সুযোগ-সুবিধে থেকে বঞ্চিত ছিল। তখন লন্ডনে খেলা হলে আমরা টিভিতে দেখতে পেতাম।

বলাকা বলল, আমি আপনার এসব কথা অনুমানও করতে পারছি না। ঠিক আছে, আপনি আমার সঙ্গে ইতিহাস-ঘরে চলুন।

ইতিহাস-ঘর?

হ্যাঁ। আমাদের শহরের যাবতীয় অতীতের তথ্য সেখানে রাখা আছে। যদিও আমার হাতে বেশি সময় নেই, তবু আপনার কথা জানার পর যেতে ইচ্ছে করছে।

কফির কাপ এবং ট্রে একটি বিশেষ বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে বলাকা অর্জুনকে নিয়ে বের হল। গাড়ি মিনিট-তিনেকের মধ্যেই পৌঁছে গেল একটা দশ তলা বাড়ির সামনে। নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বলাকা সেখানকার ছুটন্ত সিঁড়িতে চেপে অর্জুনকে নিয়ে সাত তলায় পৌঁছে গেল। দরজার ওপর লেখা আছে, অতীত দুশো বছর। নিস্তব্ধ বিশাল হলঘর। শীর্ণদেহ কিন্তু খুব স্মার্ট এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, কোনও সাহায্যে আসতে পারি?

হ্যাঁ। আমরা এই শহরটার অতীত সম্পর্কে জানতে চাই।

কী জানতে চান আপনারা?

শহরটা তৈবি হয়েছিল কবে?

জলপাইগুড়ির মূল শহর তৈরি হয় কয়েকশো বছর আগে, পুনর্গঠিত হয় আশি বছর। বৃদ্ধ ওদের নিয়ে একটা বড় ডেস্কের সামনে চলে এলেন।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, উনিশশো একানব্বই মানে তেরোশো আটানব্বই সালের জলপাইগুড়ি সম্পর্কে কিছু বলুন।

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। তারপর নানারকম বোতাম টিপতে লাগলেন। ধীরে-ধীরে বোর্ডের ওপর একটা ম্যাপ ফুটে উঠল। অর্জুন উত্তেজিতভাবে তাকাল। হ্যাঁ, শহরের ম্যাপ। বাড়ি, রাস্তা। বৃদ্ধ বললেন, অনেকটাই অনুমান-নির্ভর ম্যাপ। কিছু ছবি. আর বইপত্র ঘেঁটে তৈরি। তখন তিস্তা শহরের পাশে ছিল অনেকটা জায়গা নিয়ে। এই যে।

বৃদ্ধের স্টিক অনুসরণ রে অর্জুন তাকাতে নদীর চিহ্ন দেখতে পেল। তিস্তা যদি ওটা হয়, তা হলে পাশেই সেনপাড়া এবং হাকিমপাড়া। সে জিজ্ঞেস করল, তিস্তা সেতুটা কোথায়, যার ওপর দিয়ে ড়ুয়ার্সে যাওয়া যেত?

সেতু? শহরের ছবিতে তিস্তার ওপরে কোনও সেতু নেই। রাস্তাগুলো ছিল খুব সরু। কিছু ব্যক্তি চা ব্যবসার কল্যাণে ধনী ছিলেন, কিন্তু অনেকেই দরিদ্র।

হঠাৎ অর্জুন চিৎকার করে উঠল, ওই তো করলা নদী!

বৃদ্ধ ফিরে তাকালেন, হ্যাঁ, তখন ওই নামে একটা খাল ছিল কিন্তু এ-তথ্য আপনি জানলেন কী করে?।

অর্জুন হকচকিয়ে গেল। উত্তেজিত হওয়াটা ঠিক হয়নি। বলাকা বলল, উনি ওই সময় সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।

তাই নাকি? আমাদের এই ইতিহাস-ঘরের বাইরে তথ্য আছে? বেশ, তখন অঞ্চলগুলোকে কীভাবে ভাগ করা হত বলুন তো?

পাড়া হিসাবে। আলাদা নাম ছিল পাড়ার। এই যে তিস্তার পাশে আর করলার মধ্যে জায়গাটা, এর নাম ছিল হাকিমপাড়া। এইটে স্টেডিয়াম। আমরা টাউন ক্লাব স্টেডিয়াম হিসাবে জানি। অর্জুন উজ্জ্বল মুখে বলল।

আপনি ঠিক বলছেন। এত বিশদ আমিও জানি না।

এই ইতিহাস-ঘর ওই ম্যাপের কোনখানে হবে?

বৃদ্ধ তাঁর স্টিকটি যেখানে রাখলেন সেদিকে তাকিয়ে অর্জুন বলল, আরে, এটা তো জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি। পাশে একটা মন্দির ছিল, মন্দিরের পাশে বিরাট বিল। দাঁড়ান, এই সোজা চলে এলাম, দিনবাজারের পুল পেরিয়ে সোজা কদমতলার রাস্তায়, হ্যাঁ, এই জায়গাটাকে এখন কী বলে?

পাতালরেল দফতর।

অর্জুন হতভম্ব। বাড়িটা যেখানে সেখানে একশো সত্তর বছর বাদে পাতাল রেলের দফতর হবে। রাজবাড়ির চিহ্ন থাকবে না। সে জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলটাকে খুঁজল। শ্যামাপ্রসাদবাবু এখন হেডমাস্টারমশাই। খুব ভাল লোক।

সে জায়গাটা দেখিয়ে বলল, এইটে একটা বড় স্কুল।

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, ওটিকে মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। কিন্তু মহাশয়, আপনি এত তথ্য জানতে পারলেন কী করে?

অর্জুন হাসল, জেনেছি। আচ্ছা, মোটে তো একশো সত্তর বছর। এমন কোনও প্রবীণ মানুষের কথা কি জানেন, যিনি তাঁর পিতা বা পিতামহের কাছে অতীত দিনের কথা শুনে মনে রেখেছেন?

বৃদ্ধ হাসলেন, আমিই শুনেছি। আমার পূর্বপুরুষের চা-বাগান ছিল। আপনি যে সময়ের কথা বলছেন তার একটু আগে একজন পূর্বপুরুষ ছিলেন যাকে নাকি জলপাইগুড়ি শহরের পিতা বলা হত।

অর্জুন আচমকা জিজ্ঞেস করল, তাঁর নাম কি এস পি রায়?

এস পি? হ্যাঁ তিনি রায় ছিলেন। সত্যেন্দ্রপ্রসাদ রায়।

আপনি সত্যেন্দ্রপ্রসাদের বংশধর? অর্জুন হতভম্ব।

আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন তাঁকে চেনেন? বৃদ্ধ এবার বেশ অবাক হলেন। এই সময় বলাকার হাতের ঘড়িতে বি বি শব্দ শুরু হল। সে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, আপনার দূরাভাষ আমি ব্যবহার করতে পারি?

অবশ্যই। দূরের একটি ডেস্ক দেখিয়ে দিলেন।

বলাকা সেদিকে এগিয়ে গেল। ডেস্কের উলটোদিকে দূরদর্শনের পরদার মতো একটা পরদায় আলো জ্বলে উঠল বলাকা বোতাম টিপতেই। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, সেই সময় যে-সমস্ত মানুষ বিখ্যাত ছিলেন তাঁদের নাম জানা যাবে?

বৃদ্ধ বললেন, নিশ্চয়ই। কলকাতার বিখ্যাত মানুষদের সংখ্যা অনেক। সেসব তথ্য পেতে কষ্ট হয়নি। বিভিন্ন জেলার মানুষদেরও আমরা যতটা সম্ভব এই সংগ্রহে রেখেছি। ভদ্রলোক বোতাম টিপতেই ম্যাপ মুছে গেল। এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী ধরনের মানুষের কথা জানতে চান?

ভাল খেলোয়াড়?

বোতাম টেপা হল। অর্জুন দেখল দুটো নাম ফুটে উঠেছে। তেরোশো পঞ্চাশের পর দুজন বিখ্যাত খেলোয়াড় হলেন, রুণু গুহঠাকুরতা এবং মণিলাল ঘটক। এঁরা ফুটবলে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।

শিল্পী?

বোতাম টেপা হল। না। সেই সময় জলপাইগুড়িতে ভারতবিখ্যাত শিল্পী ছিলেন না।

হঠাৎ অর্জুনের মাথায় ডক্টর গুপ্তের কথা ভেসে উঠল। ডক্টর গুপ্ত নিশ্চয়ই বিখ্যাত মানুষ। যদিও অনেকেই তখন তাঁর নাম জানত না। কিন্তু শিলিগুড়ির কাছে যেখানে ওঁর গবেষণাগার সেটা জলপাইগুড়ি জেলায় পড়ে না। সে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, দার্জিলিং জেলার বিবরণ আছে?

বৃদ্ধ তাকে পাশের টেবিলে নিয়ে গেলেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তেরোশো আটানব্বই সালে ডক্টর গুপ্ত নামে একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ছিলেন…।।

বৃদ্ধ বোতাম টিপলেন। পরদায় ফুটে উঠল দার্জিলিং জেলার দুশো বছরের বিখ্যাত বিজ্ঞানী-ডক্টর এস. বি. গুপ্ত এবং তাঁর পরে অনেক নাম।

অর্জুনের মনে পড়ল না, ডক্টর গুপ্তর প্রথম নাম এস বি কি না। তবে এই মানুষটি যে তিনিই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে বলল, ওই ডক্টর এস বি গুপ্ত সম্পর্কে বেশি কিছু জানলে ভাল লাগবে।

ডক্টর গুপ্তের নামের পাশের একটা নীল আলো দপদপ করতে লাগল। তারপর পরদায় লেখাগুলো ফুটে উঠল, ডক্টর সুরব্ৰত গুপ্ত। মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করে চোদ্দশো সাত সালে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি অকৃতদার ছিলেন। তেরোশো আটানব্বইতে এক দুর্ঘটনায় তাঁর মস্তিষ্কে আঘাত লাগে এবং কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকেন। সুস্থ হওয়ার পর দেখা যায় তিনি অসাধারণ মেধাসম্পন্ন হয়েছেন। চোদ্দশো দশ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর গবেষণার জন্যই এখন সূর্যের সংসারের বাইরে অন্য একটি গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। গ্রহটির নামকরণ তাঁর সম্মানে করা হয়েছে সুরব্রত।

অর্জুনের কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। তার মানে ডক্টর গুপ্ত মারা যাননি। আরও নয় বছর গবেষণা করার পরে উনি নোবেল পাবেন। এই উত্তেজনাপূর্ণ খবর তিনি নিজেও জানেন না।

কতক্ষণ এইসব নিয়ে সে মগ্ন ছিল জানে না। চৈতন্য হল যখন সে দেখল, বলাকার সঙ্গে আরও চারজন প্রৌঢ় তার দিকে এগিয়ে আসছে। একজন তাকে বলল, আপনি অর্জুন? বেশ। আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।

কোথায়?

প্রধান তদন্তকেন্দ্রে।

কেন?

আপনাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব। তারপরে যদি প্রয়োজন হয় আপনি আইনের সাহায্য নিতে পারেন। আসুন।

অর্জুন অসহায় হয়ে বলাকার দিকে তাকাল। বলাকা মাথা নিচু করল। অগত্যা প্রৌঢ়দের অনুসরণ না করে উপায় রইল না অর্জুনের।

যেভাবে হাতকড়া না পরিয়ে বন্দিদের গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় সেইভাবেই ওরা অর্জুনকে নিয়ে চলল শহরের প্রান্তে। রাস্তাঘাট চিনতে পারল

সে। মূল প্রবেশদ্বারে কোনও রক্ষী নেই। ড্রাইভার মাইক্রোফোনে সাঙ্কেতিক শব্দ বলতেই গেট খুলে গেল। গাড়ি চলল সরু পথ দিয়ে। আরও দুটো গেট পার হওয়ার পর সবাই গাড়ি থেকে নামল। বিশেষ একটি ঘরে ওদের সঙ্গে ঢুকে অর্জুন দেখল আরও দুজন মানুষ সেখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।

একজন প্রশ্ন করল, ইনিই সেই অবাঞ্ছিত অতিথি? কী নাম?

দাঁড়িয়ে থেকেই অর্জুনকে জবাব দিতে হল, অর্জুন।

আপনি বলেছেন, জলপাইগুড়িতে আপনার বাড়ি। কোথায়?

এখন সেই বাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আপনাদের পাতাল রেলের যেখানে দফতর সেখানেই আমাদের বাড়ি ছিল, অর্জুন নির্বিকার মুখে জবাব দিল।

জবাবটা শোনামাত্র সবাই নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল। একজন বলল, আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন, পাতাল রেলের দফতর প্রতিষ্ঠিত হয় অন্তত একশো বছর আগে।

আমি আপনাদের সময়ের একশো সত্তব বছর আগে ওখানে থাকতাম।

আপনি যা বলছেন তা আপনার ধারণায় সত্যি?

অবশ্যই।

তার মানে আপনি অতীতের মানুষ, এই বর্তমানে কীভাবে এলেন?

ডক্টর গুপ্তর বাংলোয় তাঁর তৈরি মেশিনে চড়ে।

ডক্টর গুপ্ত কে?

তিনি একশো সত্তর বছর আগে সময়, মহাকাশ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করতেন।

অর্জুন দেখেনি, ইতিহাসঘরের সেই বৃদ্ধকেও নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। ইঙ্গিতমাত্র তিনি এগিয়ে এসে নিচু গলায় কিছু জানালেন। সম্ভবত একটু আগে ডক্টর গুপ্ত সম্পর্কে জানা কিছু তথ্য। এবার যেন সত্যি অর্জুনের অস্তিত্ব বিশ্বাস করল ওরা। সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে গেল। একজন প্রশ্ন করল, আপনি তরুণ। ওই সময়ে জলপাইগুড়িতে আপনি কি করতেন?

প্রচলিত অর্থে তেমন কিছু নয়।

ডক্টর গুপ্ত একজন বৈজ্ঞানিক। তাঁর সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা হল কী করে?।

তাঁকে আমি সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। তিনি গবেষণার কাজে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন। দুঃখের বিষয়, আমি সেটা সক্ষম হইনি

তাঁরই আচরণের জন্য।

আপনার সাহায্য তিনি কেন চেয়েছিলেন?

আমি একজন সত্যসন্ধানী।

এজন্য আপনি শিক্ষা নিয়েছেন?

হ্যাঁ। আমার গুরু অমল সোমের সহকারী হিসাবে আমি অনেকটা শিখেছি।

তিনি কি বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন?

যে-কোনও শিক্ষিত ব্যক্তি তাঁকে চিনতেন।

সঙ্গে-সঙ্গে ইতিহাসঘরের বৃদ্ধকে নির্দেশ দেওয়া হল, অমল সোম সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য। তিনি টেলিফোন-ডেস্কের সামনে গিয়ে বোতাম টিপে সংযোগ করতেই ইতিহাসঘরের সহকারীকে পরদায় দেখা গেল। সেই ভদ্রলোক নির্দেশ শুনে সেটা পালন করতেই টেলিফোনের উলটো দিকের পরদায় ফুটে উঠল, অমল সোম—বিস্তারিত বিবরণ শুন্য।

প্রশ্নকারীর একজন হাসল, কীরকম বিখ্যাত সেটা বুঝতেই পারছি। গুরুর যখন কিছুই পাওয়া গেল না তখন একবার শিষ্যের খোঁজ করুন।

ইতিহাসঘরের বৃদ্ধ অর্জুনের নাম জানাতেই তাঁর সহকারী পরদায় ফুটিয়ে তুলল, অর্জুন, সত্যসন্ধানী, নানান রহস্য উদ্ধার করেছেন। বর্তমান থেকে অতীতে তিনি পরিক্রমা করে এসেছেন। পঞ্চাশ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় মারা যান।

এবার এই ঘরে কোনও কথা নেই। বৃদ্ধ টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মুখ্য প্রশ্নকর্তা অর্জুনের দিকে এগিয়ে এলেন, আমি জানি না আপনি খুব বড় প্রতারক কি না। হয়তো এসব তথ্য জেনেই আপনি আমাদের বিভ্রান্ত করতে এখানে এসেছেন। আবার এও হতে পারে, আপনি যা বলছেন তা সত্যি। সেক্ষেত্রে আপনি আমাদের পূর্বপুরুষদের একজন। আপনার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগবে। সেই সময় পর্যন্ত আপনাকে আমাদের অতিথি হিসাবে থাকতে হবে। ভদ্রলোক ইঙ্গিত করতে দুজন রক্ষী অর্জুনকে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

যে-ঘরটিতে তাকে নিয়ে আসা হল তার একটিমাত্র জানলা। কিন্তু তার কাচ বন্ধ। ঘরটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। রক্ষীরা চলে গেলে অর্জুন বুঝল তাকে ওরা বন্দি করে রেখে দিল। হয়তো আরও খোঁজখবর করবে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেসব জানার পর রায় দেবেন। সেই রায় যদি তার বিপক্ষে যায় তা হলে? জানতের খোঁজ করুই পারছি। গুরুত্ব এরা কি তাকে মেরে ফেলবে? এখানে এখন শাস্তির পরিমাপ কী? সে তো কোনও অন্যায় করেনি।

সে ঘরটিকে খুঁটিয়ে দেখল। একটি সুন্দর বিছানা, বিছানার পাশেই টেলিফোন-ডেস্ক। দেওয়ালে কিছু বই। সে এগিয়ে গেল। প্রথম বইটি গীতবিতান। অন্য বইগুলো গীতবিতানের গান নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান যাদের কাছে বেদ অথবা মহাভারতের মতো, তারা কি তার সম্পর্কে ভয়ঙ্কর হতে পারে?

অন্যমনস্ক অর্জুন পকেটে হাত ঢোকাতে সিগারেটের প্যাকেটের স্পর্শ পেল। সিগারেট সে খুবই কম খায়। গত আট-দশ ঘণ্টায় তো খায়নি। সে সিগারেট ধরাল। নার্ভের যে অবস্থা তাতে সিগারেট সাহায্য করবে হয়তো।

অর্জুন ধোঁয়া ছাড়তেই অদ্ভুত কাণ্ড হল। ঘরের ভেতর দপ করে আলো জ্বলে উঠে সোঁ-সোঁ শব্দ শুরু হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলে গেল এবং বেশ কিছু উত্তেজিত মুখকে উঁকি মারতে দেখা গেল। অর্জুন হতভম্ব। লোকগুলো তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। দরজা খোলা থাকায় কানে আসছে সাইরেন জাতীয় কিছু একটা তীব্রম্বরে বাজছে। এই সময় একজন কর্তাব্যক্তি ছুটে এলেন, আপনি ওটা কী করছেন?

আমি? সিগারেট খাচ্ছিলাম।

সিগারেট? ওর ভেতর কী আছে?

তামাক। সাধারণ তামাক।

নিভিয়ে ফেলুন। চটপট। তামাক পোড়ার ধোঁয়া মানুষের স্বাস্থ্যের শত্রু। আপনি নিজে মরবেন, আমাদেরও মারবেন।

এখানে কেউ তামাক খায় না? সিগারেট বিক্রি হয় না?

ওসব এখানে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ ওসব খাচ্ছে জানলে তাকে কড়া শাস্তি দেওয়া হয়। নিভিয়ে ফেলুন বলছি।

অর্জুন সিগারেট নেভাল। ওরা এবার একটা যন্ত্র নিয়ে এসে ঘরে যেটুকু ধোঁয়া ছিল সব টেনে নিল। তারপর একটা পাত্রের ভেতর সিগারেট, দেশলাই ফেলে দিতে বলল অর্জুনকে। হুকুম পালন না করে কোনও উপায় ছিল না। ওরা দরজা বন্ধ করে চলে যাওয়ার আগে বলে গেল একজন চিকিৎসক আসবেন ওর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে। অর্জুন খাটের পাশে রাখা একটা চেয়ারে গিয়ে চুপচাপ বসল।

সিগারেট খাওয়া নিয়ে এমন কাণ্ড হবে কে জানত। উনিশশো একানব্বইতে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সতর্কীকরণ লিখে ছেড়ে দেওয়া হত। দেশের ভেতর প্লেনে চাপলে সিগারেট খাওয়া যেত না, হাসপাতালে নয়, ট্রামবাস অথবা সিনেমা হলে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এমন আতঙ্ক তখন সৃষ্টি হয়নি। হঠাৎ অর্জুনের মনে হল, সেই সময় যদি এটা হত তা হলে মানুষের উপকারে লাগত।

কী আশ্চর্য! এর মধ্যেই সে সেই সময় বলে ভাবতে আরম্ভ করেছে। ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাও করা যায় না। এখন যদি সে ওখানে থেকে যায় তা হলে তার বয়স একশো সত্তর বছর বেশি হয়ে যাবে? অসম্ভব। অর্জুন নিজের গালে হাত বোলালো। গতকাল সকালে সে দাড়ি কেটেছে। কোথাও যাওয়ার না থাকলে সে একদিন অন্তর দাড়ি কাটে। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা বাদে যতটুকু দাড়ি সাধারণত বাড়ে তার অর্ধেকও বাড়েনি। কেন এমন হল? তার কি এখানে থাকার সময় বয়স বাড়ছে না? সে যদি দশ বছর এখানে থাকে তা হলেও বয়স বাড়বে না?

এই সময় দরজায় শব্দ হল। সেটা খুলে যেতে দুজন মানুষ কয়েকটা যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তাদের আপাদমস্তক মহাকাশচারীদের মতো পোশাকে ঢাকা। একজন বললেন, আমরা চিকিৎসক। আপনার শরীর পরীক্ষা করব। দয়া করে উঠে আসুন।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল, এমন অদ্ভুত পোশাক আপনারা পরেছেন কেন?

সংক্রামিত হতে পারে এমন রোগ থেকে সতর্ক থাকতে চাই।

কিন্তু আমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ।

আপনি ধূমপান করেন। এটা জানার পর এই সতর্কতার প্রয়োজন হয়েছে।

অর্জুনের সমস্ত শরীর রশ্মিযন্ত্র দিয়ে পরদায় ফুটিয়ে তুলে বিশ্লেষণ করা হল। তার রক্তচাপ, হৃদযন্ত্র, রক্তের ঘনত্ব ইত্যাদি পরীক্ষা করার পর চিকিৎসক বললেন, এখনও আপন, ফুসফুস নিকোটিনের কবলে পড়েনি। কিন্তু আপনি যদি আর কিছুদিন ধূমপান করেন তা হলে সেই আশঙ্কা থাকছে।

ওরা আবার দরজা বন্ধ করে চলে গেল। এবার চেয়ারে বসে অর্জুনের মনে হল, অনেক হয়েছে, এবার ফেরার কথা ভাবা দরকার। সে চিরকাল এখানে পড়ে থাকতে পারে না। বাড়িতে মা আছেন। তা ছাড়া, এদের রেকর্ড যদি ঠিক কথা বলে তা হলে সে পৃথিবীতে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবে। তাকে মরতে হবে একটা দুর্ঘটনায় পড়ে। অর্জুনের এখনই শিরশির করল শরীর, যদিও পঞ্চাশে পৌঁছতে তার ঢের দেরি আছে। কিন্তু তাকে ফিরে যেতে হলে সেই হাইওয়ের পাশের জঙ্গলে যেতে হবে। এখান থেকে সোজা বেরিয়ে যেতে এরা নিশ্চয়ই দেবে না। অর্জুনের মনে হল, এখানকার মানুষজন একটু আলাদা ধরনের। আবেগ কম, কেমন ছাড়া-ছাড়া ভাব।

তবে হ্যাঁ, এখানে এসে তার কয়েকটা লাভ হয়েছে। প্রথমত, ডক্টর গুপ্ত তাঁর গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন এই তথ্য জানা গেল। ভদ্রলোক নোবেল পুরস্কার পাবেন। দ্বিতীয়ত, সে নিজে পঞ্চাশ বছরের আগে মারা যাবে না। তৃতীয়ত, একশো সত্তর বছর পরে জলপাইগুড়ির কী অবস্থা হবে সেটাও নিজের চোখে দেখা গেল।

চুপচাপ কতক্ষণ কেটে গিয়েছে খেয়াল নেই, হঠাৎ মিষ্টি বাজনার আওয়াজ কানে আসতেই সে সোজা হল। ঘরের এককোণে টেলিফোন-ডেস্কে আলো ফুটে উঠেছে। অর্জুন পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল। যেভাবে এর আগে কথা বলার সময় অন্যদের বোতাম টিপতে দেখেছে সেইভাবে সে একমাত্র বোতামটি টিপতেই পরদায় একটি পুরুষের ছবি ভেসে উঠল। ভদ্রলোক বললেন, শুভসন্ধ্যা। তথ্য ও জনকল্যাণ দফতর থেকে বলছি। আজ দুপুরে আমাদের আপনার কথা জানানো হয়েছে। দেশবাসী আপনার সম্পর্কে জানতে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে পড়েছেন। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

করুন। কিন্তু আমার খুব খিদে পেয়েছে।

আচ্ছা। এখনই সেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি…।

দাঁড়ান। এখানে আসার পর আমি স্যুপ আর সবজিসেদ্ধ খেয়েছি। আসলে ওতে আমার মন ভরে না, খিদেও মেটে না।

আপনি কী ধরনের খাবার খেতে চাইছেন?

একদম দিশি। ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ কিংবা মাংসের ঝোল। অবশ্য এখন যদি সন্ধেবেলা হয়, আপনি শুভসন্ধ্যা বললেন বলেই বলছি, পরোটা আর কাবাব পেলেও চলবে। সঙ্গে এক কাপ ভাল চা।

এক মিনিট দাঁড়ান। ভদ্রলোক সময় চেয়ে নিয়ে কাউকে ইঙ্গিত করলেন দেখা গেল। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, আপনি অর্জুন। একশো সত্তর বছর আগে এই শহরে বসে সত্যসন্ধান করতেন। হঠাৎ ভবিষ্যতে এসে আপনার কেমন লাগছে? কী কী পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

সব কিছুই পরিবর্তিত। এসব আমরা ভাবতে পারতাম না।

তখনকার জীবন আর এখনকার জীবনের মধ্যে কোনটা ভাল?

জীবনযাপনের সুবিধেগুলো এখানে বেশি।

আমাদের পূর্বপুরুষ ডক্টর গুপ্তর মহাকাশ এবং সময়সম্পর্কিত আবিষ্কার এখনকার বৈজ্ঞানিকদের খুব সাহায্য করছে। আমরা এখন স্বচ্ছন্দে সময়কে নিয়ন্ত্রণে রেখে অন্য গ্রহে যেতে পারি। ডক্টর গুপ্তকে আপনি দেখেছেন। একজন মানুষ হিসাবে তিনি কেমন ছিলেন?

আমি তাঁকে মাত্র একটি সন্ধে দেখেছি। সেই সময় তিনি আতঙ্কিত ছিলেন, কারণ, তাঁর ভয় ছিল, কেউ তাঁর গবেষণা নষ্ট করে দিতে পারে।

কারা?

আমি জানি না।

ওহো, এইমাত্র আমাদের খাদ্য দফতর জানিয়েছে, আপনি যেসব খাবার খেতে চেয়েছেন তা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভাল নয়। ভাত-ডাল-তরকারি বা মাছের ঝোলে শুধু উদর ভর্তি হয় কিন্তু কর্মক্ষমতা বাড়ে না। আর পরোটা, কাবাব সুপাচ্য নয়, আপনার পেটের পক্ষে ক্ষতিকর। আসলে এই অনাবশ্যক খাবারগুলো অনেকদিন হল বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের সেইসব খাবার খাওয়া উচিত যা তার শরীরকে পরিপূর্ণ করবে। আপনি মুরগির মাংস সেঁকা অবস্থায় খেতে পারেন এবং তাই আপনাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে ভাল দুধ। ভদ্রলোক হাসলেন।

অর্জুন বিমর্ষ হল, এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।

আপনি কি কিছু বলছেন? ভদ্রলোক যেন ঠিক বুঝতে পারেননি।

আমি যা বলছি তা আপনি বুঝতে পারবেন না।

কেন?

যে পায়েস, মালপোয়া বা গোকুল পিঠে খায়নি সে শীতকালের খাবার কত ভাল হতে পারে জানবে কী করে?

ভদ্রলোক গম্ভীর হলেন, হ্যাঁ, এবার আপনার সঙ্গে একটি পরিবারের পরিচয় করিয়ে দেব। সারা দুপুর সন্ধানকাজ চালিয়ে এঁদের আমরা আবিষ্কার করেছি। চেয়ে দেখুন, একেবারে বাঁ দিকে যিনি বসে আছেন তাঁর নাম মধুসূদন। মধুসূদনের পাশে তাঁর স্ত্রী লাবণ্য। লাবণ্যের পাশে ওঁদের ছেলে ক্ষেমঙ্কর এবং পুত্রবধূ মালিনী।

অর্জুন দেখল পরিবারের চারজনই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল, এবার নমস্কার করল। তথ্য দফতরের ভদ্রলোক বললেন, এই পরিবার আপনার উত্তরপুরুষ। আপনার রক্ত এঁদের দুজনের শরীরে বর্তমান।

অর্জুন হতভম্ব। বৃদ্ধ, যাঁর নাম মধুসূদন বেশ উত্তেজিত এখন, আপনি, আপনি আমার প্রপিতামরে প্রপিতামহ? এভাবে আপনার দর্শন পাব আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি।

আপনি, আপনি আমার উত্তরপুরুষ? কথা খুঁজে পাচ্ছিল না অর্জুন।

আজ্ঞে হ্যাঁ, দয়া করে আমাকে আপনি বলবেন না। আমি কত ছোট।

কিন্তু কী করে নিশ্চিন্ত হলেন?

মানে? আমার প্রপিতামহের ডায়েরি আমার কাছে আছে। তাতে তিনি তাঁর আটজন পূর্বপুরুষের নাম লিখে গিযেছেন। তাঁর পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের সম্পর্কে বিশদ লেখা আছে। আপনি সত্যসন্ধানী ছিলেন। দেশে-বিদেশে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আপনার দুই পুত্র সন্তান। একজন সন্ন্যাসী হয়ে যান। দ্বিতীয়জনের বংশধর আমরা। আপনার যখন পঞ্চাশ বছর বয়স তখন পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। এসব আমি জানি। গল্প পড়ার কৌতূহলে পড়েছি। কিন্তু আপনাকে চোখে দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য হবে আমরা তা ভাবিনি। এই হল আমার পুত্র ক্ষেমঙ্কর। ওকে আশীর্বাদ করুন। বৃদ্ধ মধুসূদন হাত বাড়িয়ে নিজের ছেলেকে দেখিয়ে দিতে সে আশীর্বাদ নেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল। অর্জুনের অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। যে-বংশধরদের মানুষ কখনওই দ্যাখে না তাদের সামনে অনেক কমবয়স্ক শরীর নিয়ে সে বসে আছে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম মধুসূদন, কিন্তু ওঁর ক্ষেমঙ্কর, কেন?

আসলে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রাবলী থেকে নামকরণ করা এখন নিয়ম।

কিন্তু ক্ষেমঙ্করের স্ত্রী তো মালিনী ছিলেন না?

এবার সুন্দরী মহিলা যাঁর নাম মালিনী, জবাব দিলেন, না, ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন, মালিনী ক্ষেমঙ্করকেই ভালবাসত।

নাটকটি দেখেছে অর্জুন। কিন্তু এমন কিছু ছিল কিনা মনে পড়ল না। তাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে মালিনী বললেন, একেবারে শেষে মালিনী বলেছেন, মহারাজ, ক্ষমমা ক্ষেমঙ্করে। তারপরেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন পতন এবং মূছা। ওটা হয়েছিল ভালবাসার কারণেই।

এবাব লাবণ্য জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আমাদের বাড়িতে আসবেন?

আমি কোথায় যেতে পারি তা জানি না। এঁরা আমার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করছেন।

তথ্য দফতরের ভদ্রলোক বললেন, আপনার মঙ্গলের জন্যই তা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যদি জানে আপনি বিংশ শতাব্দীর মানুষ তা হলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। সেটা আমরা চাই না।

বিপদে কেন পড়ব?

ইতিহাস বলে বিংশ শতাব্দীব মানুষেরা অত্যন্ত সন্দেহপরায়ণ ছিল। তারা অকারণে বিশ্বজুড়ে দু-দুবাব মারাত্মক যুদ্ধ করেছে। সেই যুদ্ধে নৃশংসভাবে তারা শত্রুপক্ষের মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি।

সেটা জামানি, ব্রিটেন এবং আমেরিকার রাষ্ট্রনায়কেরা করেছিলেন। সাধারণ মানুষ কখনওই সেটাকে মেনে নিতে পারেনি।

দেখুন, আপনাদের ইতিহাসে সবসময় রাষ্ট্রনায়কদের কথাই লেখা থাকত, সাধারণ মানুষকে অবহেলা করা হত। যা হোক, আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে হল। এবার আপনি বিশ্রাম করুন।

চট করে আলো নিভে গেল। অর্জন সুইচ অফ করতেই ঘরের দরজা খুলে গেল। দুজন মানুষ একটা ট্রলিতে করে খাবারের ডিশ, গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল। কোনও কথা না বলে তারা আবার বেরিয়ে গেল। অর্জুন দেখল এক প্লেট রোস্টেড মুরগি আর একগ্লাস দুধ রয়েছে ট্রলির ওপরে। মুরগির মাংসের পরিমাণ প্রচুর। একটুও সময় নষ্ট না করে সে খাবারে মন দিল। নরম মাংস, কিন্তু লবণের পরিমাণ খুব কম। এরা নুনও কম খায় বোধ হয়। পেট ভরে না যাওয়া পর্যন্ত খেয়ে গেল সে। তারপর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। যেখানে যাই হোক, এখন তার শরীর একটু ঘুম চাইছে।

অথচ ঘুম এল না। ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। লোকে নাতি কিংবা পুতির মুখ দেখে, ও দেখল কয়েক প্রজন্মের পরের মানুষগুলোকে। দেখে অবাক হয়েছিল কিন্তু কোনওরকম টান যা স্নেহ-ভালবাসা থেকে তৈরি হয় তা মনে আসেনি। ওদের কেমন বানানো-সাজানো মানুষ বলে মনে হচ্ছে এখন।

এরা তাকে নিয়ে ঠিক কী করতে চায় ভেবে পাচ্ছিল না অর্জুন। কিন্তু আর নয়, এবার তার ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা দরকার। সে এখন ঠিক কোথায় আছে তা জানা নেই। হাইওয়ের পাশে জঙ্গলের মধ্যে ডক্টর গুপ্তের মেশিনটাকে সে লুকিয়ে রেখে এসেছে। ওই মেশিনটার সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে ফেরা অসম্ভব। যেমন করেই হোক, মেশিনটার কাছে সবার অলক্ষে তাকে পৌঁছতেই হবে।

অর্জুন উঠে বসল। তাকে একই সঙ্গে উত্তেজিত এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল। কী করে সেই জায়গাটায় যাওয়া যায়? বলাকা যখন তাকে গাড়িতে নিয়ে হাইওয়ে ধরে যাচ্ছিল তখন তো কোনও জঙ্গল চোখে পড়েনি। অথচ সেই জঙ্গল থেকে হাঁটা শুরু করেই সে বলাকাদের বাড়িতে পৌঁছেছিল। অতএব, সেই নির্দিষ্ট হাইওয়েতে যেতে হলে বলাকাদের বাড়ির দিকে যেতে হবে। অর্জুনেব মনে পড়ল, দুপুরের পর থেকে বলাকার দেখা সে পাচ্ছে না।

কিন্তু কী করে সেই জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে? প্রথম কথা, তাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই বাড়ির অন্য দরজাগুলোয় নিশ্চয়ই ভাল পাহারা আছে। এখানে কোনও ট্রামবাস চোখে পড়েনি। হয়তো পাতাল রেল সেই জায়গাটার কাছাকাছি যায়। কিন্তু কীভাবে যেতে হয় তা সে জানে না। খুবই অসহায় হয়ে পড়ল অর্জুন।

ঘুমিয়ে পড়েছিল অর্জুন। সেটা কতক্ষণ তা বোঝার উপায় নেই। কারণ, সে আবিষ্কার করল ঘড়ির কাঁটা অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে আছে। কী করে একটা অটোমেটিক ঘড়ি হাতে পরে থেকেও বন্ধ হয়ে যায় কে জানে!

অর্জুনের বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছিল। ঘরের ওপাশে একটা দরজা আছে, ঢোকার পরেই চোখে পড়েছিল। সে বিছানা ছেড়ে সেই দরজায় চাপ দিতে একটা মাঝারি ঘর দেখতে পেল। হালকা আলো জ্বলছে। ঝকঝকে তকতকে আধুনিক টয়লেট। লোকগুলোর তা হলে রুচি আছে।

শরীর হালকা হওয়ার পর সে জানলাটার দিকে তাকাল। কাচের জানলা। ভেতর থেকেই বন্ধ। সে একটু চেষ্টা করতেই জানলাটা খুলে গেল। চোখের সামনে নীল আকাশ। অনেক তারার ভিড় সেখানে। তার মানে এখন রাত অনেক। কোথাও কোনও শব্দ নেই। সে রয়েছে বেশ কয়েক তলা ওপরে। এই জানলা দিয়ে নীচের দিকটা আদৌ দেখা যাচ্ছে না। জানলার গরাদ ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেও কোনও লাভ নেই। অত ওপর থেকে পড়লে আর দেখতে হবে না।

ফিরে আসছিল অর্জুন। হঠাৎ খেয়াল হল, তার মৃত্যু হবে পঞ্চাশ বছর বয়সে। পঞ্চাশ হতে তো বহুত বহুত দেরি। অতএব ওই জানলা দিয়ে বেরতে গিয়ে পড়ে গেলেও তার বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু মরবে না এ কথা বলা হয়েছে, হাত-পা ভেঙে জবুথবু হয়ে বেঁচে থাকবে না এমন কথা তো ওরা বলেনি।

তবু মারা যাবে না যখন, তখন একবার চেষ্টা করা উচিত। অর্জুন টয়লেটে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে জানলার গরাদে হাত দিল। অসম্ভব। সমস্ত জানলাটাই ইস্পাতের মোটা জালে মোড়া। তার একার চেষ্টায় সামান্য নড়ানোও সম্ভব নয়।।

অর্জন ফিরে এসে ঘরে একটা পাক খেল। তারপর সদর দরজায় ধাক্কা মারল। তৃতীয়বারের পর সেই দরজাটা খুলল। যে-লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, সে রক্ষী ছাড়া কেউ নয়। অর্জুন তাকে জিজ্ঞেস করল, আমাকে এখানে কতক্ষণ বন্দি থাকতে হবে?

রক্ষী গম্ভীর গলায় জবাব দিল, ওসব বিষয় আমার জানার কথা নয়। আপনি আগামিকাল সকাল সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

এখন কটা বাজে?

রাতের তৃতীয় প্রহর সবে শেষ হল। কথাটা বলেই রক্ষী দরজা বন্ধ করে দিল। ঠোঁট কামড়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে মনে-মনে প্রহরের হিসাব করছিল অর্জুন। তুলসীদাসেব গান আছে। প্রথম প্রহরে সবাই জাগে, দ্বিতীয় প্রহরে ভোগী, তৃতীয় প্রহরে তস্কর জাগে, চতুর্থ প্রহরে যোগী। তার মানে তিন ঘণ্টায় এক প্রহর হলে তৃতীয় প্রহর শেষ হচ্ছে নয় ঘণ্টায়। সন্ধে ছটা থেকে নয় ঘণ্টা মানে এখন সবে তিনটে বেজেছে। সে ঘড়ির কাঁটা তিনটেতে নিয়ে গেলেও সেটা চালু হল না। হঠাৎ খেয়াল হতে সে দিন এবং বছরের কাঁটা ঘুরিয়ে একশো সওর বছর এগিয়ে নিয়ে আসা মাত্র আশ্চর্যজনকভাবে ঘড়ি চালু হল। অর্থাৎ, ঘড়িও ঠিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে চায়?

হঠাৎ কানে একটা শব্দ হল। কোনও কিছু যেন ঘষটে গেল। অর্জুন চারপাশে তাকাল। সবই তো স্বাভাবিক। সে বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেল গরাদের ইস্পাত অদ্ভুতভাবে বেঁকে গিয়েছে। একটু আগেও ওরকম ছিল না। এখন অন্তত এক ফুট ফাঁক হয়ে গিয়েছে। কী ভাবে হল? অর্জুন এগিয়ে গিয়ে জায়গাটা পরীক্ষা করল। এখনই কেউ এমন কর্ম করেছে। কে করল! এই সময় তার কানে মৃদু স্বরে একটা ডাক পৌঁছল। খুব মৃদু। কিন্তু ডাকটা যে কুকুরের, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখানে আসার পর সে কোনও জীবজন্তু দেখতে পেয়েছে কি না খেয়াল করতে পারল না। এত ওপরে কুকুরের ডাক? ওরা কি তার ওপর নজর রাখার জন্য কুকুর রেখেছে? অর্জুন অন্যমনস্কভাবে ঘরে ফিরে বিছানায় বসতে যেতে খুব কাছ থেকে কুকুরের ডাক শুনতে পেল। ভাল করে তাকাতেই চক্ষুস্থির। এ তো তাতান! ডক্টর গুপ্তের সেই ছোট হয়ে যাওয়া কুকুর, যার সন্ধানে অন্য গ্রহ থেকে উপদ্রব আসত!

সেই ছোট্ট কুকুর সমানে ডেকে যাচ্ছে। অর্জুন অনেকটা ঝুঁকে আদুরে গলায় ডাকল, তাতান। তা-তান। সঙ্গে-সঙ্গে কুকুরটা ডাক থামিয়ে কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল লেজ নাচিয়ে। অর্জুন ওকে হাতে তুলে নিল, তাতান, তুই এখনও বেঁচে আছিস? অদ্ভুত ব্যাপার। তুই এখানে এলি কী করে?

তাতান পেছনের দু পায়ে ভর দিয়ে সামনের পাদুটো তুলে লাফাবার চেষ্টা করল। মনে হচ্ছিল অনেককাল পরে সে একটা চেনা মানুষকে দেখতে পেয়েছে। অর্জুন কোনও ব্যাখ্যা পাচ্ছিল না। সে যখন মেশিনে উঠে বসেছিল তখন তাতান ছিল বাক্সে। সময়যন্ত্রের মাধ্যমে এতদূর আসা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ওই ছোট্ট কুকুর এত ওপরে উঠে এসে ইস্পাত বাঁকাতেও পারবে না।

অর্জুন তাতানের গলায় আঙুল বুলিয়ে আদর করল, তাতান, আমি এখন বন্দি। কীভাবে ফিরে যাব জানি না। তোকে দেখে খুব ভাল লাগছে।

হঠাৎই খাটের খানিকটা দূরে রাখা চেয়ারটা ঘষটে একটু এগিয়ে এসে দুলতে লাগল। অর্জুন হতভম্ব। এরকম ভৌতিক ব্যাপার দেখে অন্য সময় কী করত সে জানে না কিন্তু তাতান সঙ্গে থাকায় সে শক্ত হয়ে তাকাল। তার মনে পড়ল ডক্টর গুপ্তের গাড়িটার কথা। ডক্টর গুপ্ত যাকে উপদ্রব বলতেন সেই ভিন্ন গ্রহের প্রাণীটি এসে গাড়ির ডিকি খুলে কত না ভৌতিক কাণ্ড করেছিল সেই বিকেলে।

এখানেও তেমনই কিছু ঘটছে? অর্জুন সন্ধিগ্ধ চোখে তাকাল। চেয়ারটা চুপচাপ এখন। তাতান তার মুখের দিকে তাকিয়ে। অর্জুনের মনে হল সেই উপদ্রবটি নিশ্চয়ই তাতানকে নিয়ে এসেছে, নইলে এর এখানে আসার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু তাতান একশো সত্তর বছর পরেও বেঁচে আছে?

অর্জুন চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কে জানি না, তবে মনে হচ্ছে আপনি তাতানের বন্ধু। আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?

কোনও জবাব এল না। শুধু চেয়ারটা সামান্য সরে গেল। অর্জুন আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমার ভাষা বুঝতে পারছেন না?

কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

এবার তাতানকে দেখা গেল উত্তেজিত হয়ে বিছানার ধারে চেয়ারের দিকে ছুটে যেতে। একেবারে কিনারে পৌঁছে চেয়ারের দিকে মুখ করে সে সমানে চিৎকার করতে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে চেয়ারটা সরে এল বিছানার পাশে। তাতানের গলা থেকে গোঁ-গোঁ শব্দ বের হচ্ছিল এবার। রাগী কুকুরকে আদর করলে এমন শব্দ বের করে তারা। অর্থাৎ ওই আদরে তাতান খুশি হচ্ছে না।

ঘরের ভেতর এখন তিনটি প্রাণী, যার একজন অদৃশ্য। অর্জুন ঝুঁকে তাতানের গায়ে হাত রাখতেই মনে হল কিছু যেন চট করে সরে গেল হাতের তলা থেকে। অদ্ভুত অস্বস্তিকর অনুভূতি হল সেই মুহূর্তে। অর্জুন তাতানকে কোলে তুলে নিল, তাতান, তোমার বন্ধুকে বল আমি খুব বিপদে পড়েছি, আমি সাহায্য চাই।

কুকুরের কাছে প্রশ্নের জবাব চায়নি অর্জুন, যার কাছে চেয়েছিল সে রইল চুপচাপ। অর্জুন মরিয়া হল, যদি আমাকে সাহায্য করতে ইচ্ছে থাকে তা হলে ওই চেয়ারটাকে খাটের নীচের দিকে সরিয়ে দেওয়া হোক।

প্রায় দশ সেকেন্ড কিছুই হল না, তারপর সবিস্ময়ে অর্জুন দেখল চেয়ারটা সরে গেল খাটের একপাশে। আর তারপরেই বাথরুমের জানলায় মটমট করে শব্দ হতে লাগল। শব্দ থেমে যাওয়ার পর অর্জন এগিয়ে গেল তাতানকে খাটের ওপর রেখে বাথরুমের ভেতর। গিয়ে সে দেখল জানলার অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। এখন সে স্বচ্ছন্দে জানলা দিয়ে বাইরে বেরতে পারে। অর্জন ঘরের দরজায় ফিরে অবাক, তাতান নেই। কিন্তু তার ডাকটা কানে আসছে জানলার দিক থেকে। অর্থাৎ তাতানকে আড়ালে নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে উপদ্রবটি। অর্জুনের মনে হল এই মুহূর্তে আর ভিন্ন গ্রহের অধিবাসীকে উপদ্রব বলাটা ঠিক হবে না। সে দু হাতে ভর রেখে জানলায় উঠে শরীরটাকে গরাদের বাইরে নিয়ে এল। অনেক নীচে রাত্রের রাজপথ। সেখানে কোনও মানুষ অথবা যানবাহন দেখা যাচ্ছে না। সেদিকে তাকিয়ে। মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হল। এত ওপর থেকে নীচে নামবে কী করে?

অর্জুন পাশের দেওয়ালগুলো দেখল। না, জলের পাইপ বা ওই জাতীয় কোনও বস্তু নেই যা বেয়ে নীচে নামা যায়, কার্নিসে দাঁড়িয়ে সাতপাঁচ ভাবছে যখন, তখনই একটা বড় ধাক্কা খেল সে। ধাক্কা এমন আচমকা ছিল যে, তার পদস্খলন হল এবং প্রায় ডিগবাজি খেয়ে শূন্যে হু-হু করে নামতে লাগল। অর্জুন বাঁচার জন্য মরিয়া হল। কোনওরকমে মাথাটাকে ওপরে নিয়ে যেতে পারল সে। কিন্তু যে গতিতে সে নামছে তাতে হাড়গোড় গুঁড়িয়ে যেতে বিন্দুমাত্র সময় লাগবে না। মাটির কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছে তখন দুই কাঁধ এবং কোমরে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীত একটা টান অনুভব করল সে। শরীরে প্রবল ঝাঁকুনি লাগল, কিন্তু নিজের শরীরটাকে ধীরে-ধীরে ফুটপাথে নেমে আসতে দেখল সে। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার কোমর, কাঁধ টনটন করছে। অত ওপর থেকে পড়ার পরেও বেঁচে থাকার বিস্ময়টা সেইসঙ্গে প্রবল, সে এখন বুঝে গিয়েছে ডক্টর গুপ্তের সেই উপদ্রবটা এবার তাকে বাঁচাল। কিন্তু তারা ধারেকাছে নেই বা থাকলেও সে দেখতে পাচ্ছে না।

অর্জুন ভেবেছিল পা বাড়ালেই পড়ে যাবে, কিন্তু পড়ল না। এক পা এক পা ১৬৪

করে সে ফুটপাথের ধারে এসে দাঁড়াল। পেছনের ঘরবাড়িগুলো এখন অন্ধকার, দরজা বন্ধ। এখান থেকে কিভাবে হাইওয়ের ধারের জঙ্গলে পৌঁছনো যায়? সে হাঁটা শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে, রাস্তাঘাট কী, তা সে জানে না। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা চিহ্ন, তার নীচে লেখা, পাতাল রেল। পাশ দিয়ে নীচে নামার সিঁড়ি।

সেখানে পা দিয়ে ও জলপাইগুড়িব ম্যাপ দেখতে পেল। একটু খুঁটিয়ে দেখে সে স্টেডিয়ামটাকে চিনতে পারল, ওইখানে বলাকা তাকে নিয়ে গিয়েছিল। বলাকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেডিয়ামে যাওয়ার সময় সুস্বাগতম লেখা দেখতে পেয়েছিল। তার মানে বলাকার বাড়ি শহরের বাইরে, স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকে। অনেকক্ষণ দেখার পর আন্দাজে মনে হল জায়গাটাকে সে চিনতে পারছে। বলাকাদের বাড়ি ছাড়িয়ে যে হাইওয়ে চলে গিয়েছে, সেইখানে তাকে যেতে হবে। মূল শহরের ম্যাপের পাশে পাতাল রেলের ম্যাপ। অর্জুন দেখল সেদিকটায় পাতাল রেলের একটা লাইন শেষ হয়েছে। লাইনের নাম, মুক্তধারা। এদের পাতাল রেলের বিভিন্ন লাইনের নামকরণ হয়েছে কবিগুরুর নাটক থেকে।

কিন্তু পাতাল রেলে চড়তে গেলে টিকিট লাগবে। অভিজ্ঞতা আছে তার। টিকিট যন্ত্রের ভেতর না ঢোকালে দরজা খোলে না। টিকিট কেনার পয়সা তার নেই। একশো সত্তর বছর আগেকার নোট যে এখন বাতিল হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে কথা বলাও বিপদ। মুহূর্তেই কর্তৃপক্ষ তার অস্তিত্ব জেনে যাবে। এখন কি পাতাল রেল চলছে? অর্জুন ইতস্তত করছিল এমন সময় একটা লোককে ন্ধকার যুঁড়ে এগিয়ে আসতে দেখল। লোকটার রকমসকম খুব চেনা। হিন্দি সিনেমায় যে গুণ্ডাদের দেখা যায় এর ভাবভঙ্গি তাদের মতন।

লোকটা ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়াল, বাঁচতে চাও তো পকেটে যা আছে দাও।

অর্জুন এমন অবাক যে, না বলে পারল না, এখানে এখনও গুণ্ডামি হয়?। আবার বাজে কথা! দাও? রীতিমতো ধমকে উঠল লোকটি।

অর্জুন বিনা বাক্যব্যয়ে পকেটের সব টাকা লোকটার হাতে দিয়ে দিল। আধা-অন্ধকারে লোকটা বলল, এসব কী হাবিজাবি দিচ্ছ? তোমার ক্রয়পত্র নেই?

না। অর্জুনের মনে পড়ল বলাকা একটা কার্ড নিয়ে ঘোরে।

এগুলো কী?

টাকা।

দুস। লোকটা খুব বিরক্ত হয়ে টাকাগুলো ফেরত দিয়ে বলল, কপালটাই খারাপ। তা ক্রয়পত্র সঙ্গে না নিয়ে বেরিয়েছ, পাতাল রেলে চড়বে কী করে বুদ্ধরাম?

সে কথাই ভাবছি।

বুঝেছি, তুমি আমারই মতন শিকার খুঁজছ। নাম কী?

অর্জুন।

আমি রঘুপতি, তোমার দলে কেউ আছে?

না, আমি একা।

আমিও। এখনও ধরা পড়িনি। তুমি পড়েছ?

না।

বেশ ভাল হল। কোথায় যাবে?

মুক্তধারার শেষ প্রান্তে।

আরে, ওখানেই তো আমার বাড়ি। তোমাকে আগে দেখিনি কেন? চলো, আজ রাত্রে আর কিছু হবে না। তবে ক্রয়পত্র সঙ্গে না নিয়ে এলে কী করে? লোকটা হাঁটতে-হাঁটতে প্রশ্ন করল।

এসে গেলাম। অর্জুন সমানে তাল দিচ্ছিল।

উচিত হয়নি। পাতাল রেলকে ঠকানো উচিত নয়। এবার আমি তোমার প্রবেশপত্র কিনে নিচ্ছি। লোকটা এগিয়ে গেল একটা মেশিনের দিকে। ওরা তখন পাতাল রেলের মূল দ্বারে পৌঁছে গিয়েছে। অর্জুন দেখল, মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করে লোকটা দুটো টিকিট বের করে নিল। সেই টিকিট গেটের গর্তে ঢুকিয়ে ওরা প্ল্যাটফর্মে চলে এল। এখন প্রায় ভোর পাঁচটা। মাটির নীচে পাশাপাশি আটটি প্ল্যাটফর্ম এই ভোরে দু-তিনজন যাত্রী দাঁড়িয়ে। রঘুপতি বলল, এখানে কিছু করবে না। চারধারে জাল পাতা আছে।

ঠিক পাঁচটা দশে ওবা ট্রেনে উঠল। ট্রেনের ভেতরটা রবীন্দ্রনাথের নানা লাইন ছবির মতো লেখা। কিছু চরিত্রেব ছবিও আছে।

অর্জুন ছুটন্ত ট্রেনে বসে জিজ্ঞেস কবল, তুমি কী করো?

মাংস বিক্রি করতাম। পাঁচ মাস আগে ওরা আমার লাইসেন্স কেড়ে নিয়েছে।

কেন?

মাংসটা ভাল ছিল না।

এখন চলে কী করে?

বেকার ভাতা দেয়। তাতে চলে নাকি? তাই সপ্তাহে একদিন বেরিয়ে এসে এই কাণ্ড করি। ক্ৰয়পত্র হাতিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে তাই দিয়ে জিনিসপত্র কিনে সেটাকে ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। তুমি কী করো?

সত্যসন্ধান।

সেটা কী জিনিস?

তুমি বুঝবে না। ধরা পড়লে কী হবে তোমার?

কুড়ি বছর। তোমার?

আজীবন। অর্জুন হাসল। তা হলে তো তুমি আমার চেয়েও বড় কিছু করো?

এক-একটা স্টেশনে পাতাল রেল দাঁড়াচ্ছিল আর যাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে চলছিল। তারা উঠে অর্জুনের দিকে তাকাচ্ছিল বারেবারে। কিন্তু সে একজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলছে দেখে চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল।

রঘুপতি হাসল, এই পোশাক কোথায় পেলে?

পেয়ে গেলাম।

খুব মজাদার পোশাক।

মুক্তধারার শেষ প্রান্তে ওরা ট্রেন থেকে নামল। গেট থেকে বাইরে পা দিতেই আকাশবাণী হল, জলপাইগুড়ি শহরের অধিবাসীদের জানানো হচ্ছে গতকাল অতীত-থেকে-আসা একটি মানুষকে গ্রেফতারের পর যখন পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হয়েছিল তখন সে বিভ্রম তৈরি করে পালিয়ে গিয়েছে। তার পোশাক মজাদার কিন্তু সে অতীব বুদ্ধিমান। ইস্পাতের গরাদ ভেঙে বহুতল বাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েও সে জীবিত অবস্থায় এই শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক ওই ব্যক্তিকে দেখামাত্র কর্তৃপক্ষকে খবর দিলে পুরস্কৃত করা হবে।

রঘুপতি দাঁড়িয়ে পড়েছিল ঘোষণাটা শুনতে। স্টেশনের মাইকে ঘোষণাটা শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ রঘুপতি সাঁ করে অর্জুনের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই কেউ তাকে নির্দেশ দিল আঘাত করো। অর্জুনের হাত এবং পা একই সঙ্গে রঘুপতির শরীরে আঘাত করতেই সে ছিটকে পড়ল মাটিতে। কে দেখছে না দেখছে লক্ষ করে অর্জুন দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।

এদিকের রাস্তাঘাট পরিষ্কার এবং বাড়িঘরের সংখ্যা কম। এখন তোর বলেই সম্ভবত রাস্তায় মানুষ নেই। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সে দেখল একজন বৃদ্ধা তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন। গাড়িতে কোনও ড্রাইভার নেই। সম্ভবত বৃদ্ধাই চালাবেন। অর্জুন একেবারে বৃদ্ধার সামনে পৌঁছে গেলে তিনি মুখ ফেরালেন। ভদ্রমহিলা প্রচণ্ড স্থূলকায়। কিন্তু হাসিখুশি।

তিনি অর্জুনকে বললেন, সুপ্রভাত।

সুপ্রভাত। অর্জুন চটপট জবাব দিল।

বৃদ্ধা এবার ঝুঁকে গাড়ির দরজা খুলতে গেলেন। চাবি নয়, দরজার গায়ের চাকতির নম্বর ঠিক জায়গায় নিয়ে এলে দজা খুলে যাবে। বৃদ্ধা সেটা মন দিয়ে করার চেষ্টা করতেই তাঁর হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেল। অর্জুন সেটা কুড়িয়ে ফেরত দিতে বৃদ্ধা খুব খুশি হলেন, অনেক ধন্যবাদ। আজকাল করে চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছে না। আপনি খুব ভাল মানুষ। বাতের ব্যথার জন্য ঝুঁকে কিছু কুড়োতে আমার কষ্ট হয়।

অর্জুন বলল, আমাকে আপনি বলবেন না, আমি অনেক ছোট।

বাঃ। এরকম কথা তো এখনকার যুবকদের মুখে শুনি না। বৃদ্ধা গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং-এ বসলেন, তুমি এদিকে থাকো?

না। হাইওয়ের ওপাশে থাকি।

হাইওয়ের ওপাশে? সে তো অনেকদূর। এলে কী করে?

আমার এক বন্ধুর গাড়িতে। এখন ফিরব কী করে তাই ভাবছি।

আহা। এসো, এসো, আমার যদিও অতদূরে যাওয়ার কথা ছিল না, তবু চল, তোমাকে খানিকটা এগিয়ে দিচ্ছি। কী নাম তোমার?

তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসে সে জবাব দিল, অর্জুন।

চমৎকার নাম। আমার মেয়ের নাম চিত্রাঙ্গদা। বৃদ্ধা গাড়ি চালাতে আরম্ভ করলেন। অর্জুন লক্ষ করল, এই গাড়িটা বলাকার গাড়ির মতনই, তবে ড্যাশবোর্ডে সেই টিভির পরদাটা নেই। শান্ত সকালে গাড়ি ধীরে-ধীরে শহর থেকে বেরিয়ে আসছিল। অর্জুনের চোখে পড়ল রাস্তার মোড়ে-মমাড়ে সাদা ইউনিফর্ম-পরা পুলিশেরা দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধাও সেটা দেখলেন। নিজের মনেই বললেন, হঠাৎ এত রক্ষী কেন? আমার বাপু ওদের ভাল লাগে না।

অর্জুন সিঁটিয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এত পুলিশ রাস্তায় শুধু তাকেই খুঁজে বের করার জন্য। হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন বৃদ্ধা। বাড়িটার মাথার ওপরে লেখা রয়েছে, উপাসনা মন্দির। বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন, আমি কিছুক্ষণ মন্দিরে থাকব। তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও?

হ্যাঁ বললে বৃদ্ধা খুশি হতেন। কিন্তু আশেপাশে গাড়ির সংখ্যা দেখে অর্জুন বুঝল, মন্দিরে ভাল ভিড় হবে। ইতিমধ্যে ঘোষণা শুনে ফেলা কোনও লোক তাকে দেখে সন্দেহ করলেও দফা রফা হয়ে গেল। সে হাসল, আমি না হয় অপেক্ষা করি।

বেশ। বৃদ্ধা নেমে গেলেন। থপথপ করে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে, হাতে ব্যাগ নিয়ে। অর্থাৎ ব্যাগটির ব্যাপারে তিনি বেশ সতর্ক।

অর্জুন গাড়িতে বসে ছিল চুপচাপ। তারপর কী মনে হতে গাড়ির ড্যাশবোর্ড খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এইটে ইঞ্জিন চালু বা বন্ধ করার সুইচ। বৃদ্ধা এইটে নীচে নামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করেছিলেন। এইটে কী? পাশে কিছু লেখা নেই। গোটা-আটেক নানা ধরনের সুইচ সে টিপতে লাগল ইঞ্জিন চালু করার সুইচটিকে বাদ রেখে। হঠাৎ রেডিও বেজে উঠল। গান হচ্ছে, ও আমার সোনার বাংলা। বাঃ, চমৎকার। অর্জুনের মনে হল, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে যাঁরা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন কপিরাইট আইনের সময় শেষ হওয়ায় তাঁর গান নিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড হবে, তাঁদের এখানে এসে শোনা উচিত। মৃত্যুর একশো সত্তর যোগ পঞ্চাশ বছর পরেও কী সততার সঙ্গে গাওয়া হচ্ছে।

গান শেষ হতেই ঘোষক বললেন, সতর্কীকরণ! আজ ভোরবেলায় জাতির পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক এক ব্যক্তি আমাদের সুরক্ষা দফতরের জানলা ভেঙে পালিয়ে গিয়েছে। লোকটির পোশাক বিংশ শতাব্দীর মানুষের মতো, ধূমপান করে এবং নিজের নাম অর্জুন বলে পরিচয় দেয়। লোকটি একা কি না তা জানা নেই। তবে যেভাবে সে নিখোঁজ হয়েছে তাতে বোঝা যায়, তার সঙ্গী থাকতে বাধ্য। যে-কেউ এই লোকটির সন্ধান পাবেন তাঁকেই কালবিলম্ব না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

অর্জুনের শিরদাঁড়া কনকন করে উঠল। ওরা এখন তাকে খুঁজে বের করতে নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠেছে। উপাসনা মন্দিরে যদি ওই ঘোষণা শোনা যায় তা হলে বৃদ্ধা এতক্ষণে…! সে রেডিওর সুইচ অফ কবল। তারপর জায়গা পরিবর্তন করে স্টিয়ারিংয়ের সামনে বসল। স্টিয়ারিং বলতে একটা গোল চাকতি। ক্ল্যাচ নেই, গিয়ার নেই শুধু অ্যাসেল্যারেইট আর ব্রেক। সে ইঞ্জিন চালু করে অ্যাকসেলারেইটর চাপ দিতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। প্রথমে হাত কাঁপছিল। কিন্তু মোটরবাইক চালানোর অভ্যাস থাকায় গাড়ির চলাকে আয়ত্ত করতে অসুবিধে হল না। এমন মজার ড্রাইভিং যদি বিংশ শতাব্দীতে জলপাইগুড়ির মানুষ করতে পারত! প্রথম মোড় এগিয়ে এল। দুজন পুলিশ তার দিকে অলস চোখে তাকিয়ে আছে। দমবন্ধ করে অর্জুন মোড়টা পার হতেই বাহির পথ লেখা বোর্ড দেখতে পেল। সে দ্রুত গাড়ি সেই পথে নিয়ে যেতে-যেতে গতি সামলালো। সামনে এখন প্রচুর গাড়ি। এভাবে চালিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে কোনও লাভ নেই। এ-জীবনের জন্য এখানেই থেকে যেতে হবে।

ধীরে-ধীরে সে অন্য গাড়িদের অনুসরণ করে হাইওয়েতে উঠে এল। ওঠার পরেই মনে হল সে জানে না কোন দিকে যেতে হবে। ডান না বাম। বামে যেতে হলে ফ্লাইওভারে উঠে ওপাশে গিয়ে গাড়ির স্রোতে মিশতে হবে। অর্জুন অনুমান করল তাকে ডান দিকেই যেতে হবে, কারণ সে শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

হাইওয়েতে যে-গতিতে গাড়ি যাচ্ছে, আনাড়ি হাতে তার সঙ্গে তাল রাখা মুশকিল। দু-দুবার দুটো গাড়ির ধাক্কা লাগতে-লাগতে বেঁচে গেছে। লেন ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে পড়ছে। তবু স্পিড বাড়াতে দ্বিধা করছে না অর্জুন। হঠাৎ চোখে পড়ল মাথার ওপর সাইনবোর্ড, বিদায় অতিথি, জলপাইগুড়ির স্মৃতি সুখকর হোক। সাইনবোর্ডটার তলা দিয়ে বেরিয়ে এসে সে দেখল এপাশে সুস্বাগতম লেখা। আঃ। সে ঠিক পথেই যাচ্ছে। বলাকা তাকে এই পথেই নিয়ে গিয়েছিল।

হঠাৎ পেছন থেকে বিপ-বিপ শব্দ ভেসে এল। গাড়ির আয়নায় অর্জুন দেখল একটা লাল আলো জ্বালানো গাড়ি তার পেছন-পেছন আসছে ওই শব্দ করতে করতে। এটা নিশ্চয়ই পুলিশের গাড়ি। পুলিশ তার খবর পেল কী করে? বৃদ্ধা কি তাঁর গাড়ি হারানোর ব্যাপারটা পুলিশকে জানিয়েছেন? অর্জুন আরও গতি বাড়াল। তার গাড়িই একমাত্র হর্ন দিচ্ছে। ফলে অন্য গাড়ি সামনে থেকে সরে গিয়ে পথ করে দিতে লাগল। এঁকেবেঁকে অর্জুনের গাড়ি ছুটতে লাগল সামনে। পেছনে পুলিশের গাড়িটা একটু হকচকিয়ে গিয়ে গতি বাড়াল। খানিকটা যাওয়ার পর অর্জুন বুঝতে পারল পুলিশের গাড়িটা অনেক শক্তিশালী। প্রায় তার গায়ের কাছে চলে এসে পুলিশ অফিসার হাত-মাইকে আদেশ করলেন গাড়ি থামাও নইলে গুলি করব।

অর্জুন কান দিল না। এদিকটায় রাস্তার দুপাশে ফাঁকা জমি। হঠাৎ ডান দিকে জঙ্গল দেখতে পেল। পুলিশের গাড়ি এবার তার ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। রিভলভারটাকে প্রায় নাকের ডগায় দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে গেল অর্জুন। তার হাত কেঁপে উঠল। ব্রেকে পা দেওয়ার বদলে চাপ বাড়ল অ্যাসেল্যারেইটরে। দড়াম করে একটা আওয়াজ হল। অর্জুনের গাড়ির ধাক্কায় পুলিশের গাড়ি ছিটকে গেল রাস্তার একপাশে। অর্জুনের গাড়ি পাক খেতে-খেতে শেষ পর্যন্ত সামলে নিয়ে ছুটল আরও জোরে। পেছনে কাত হয়ে থাকা পুলিশের গাড়ির দিকে তার নজর দেওয়ার সময় নেই।

মিনিটখানেকের মধ্যেই বি-বিপ আওয়াজে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। অর্জুন বুঝল আরও পুলিশের গাড়ি ছুটে আসছে তার দিকে। এরা সম্ভবত হাইওয়ের ধাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার ওবা গুলি করবেই। অর্জুন পাশের জঙ্গলের দিকে তাকাল। এই জঙ্গলটাই তো? তিনটে সিড়িঙ্গে গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। সেগুলো কোথায়? বুলডগের মতো গাড়িগুলো ছুটে আসছে পেছনে। অর্জুন দেখতে পেল হাইওয়ে থেকে একটা সরু পথ চলে গেছে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে। সে চকিতে স্টিয়ারিং ঘোরাল। ব্রেক কষেও শেষরক্ষা করতে পারল না, গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল রাস্তার পাশের রেলিঙে। মেরে স্থির হয়ে গেল।

দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে অর্জুন জঙ্গলের দিকে দৌড়তে লাগল। পুলিশের গাড়িগুলো ব্রেক কষে থামতে-থামতে সে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এবং তখনই তার কানে খুব নিচু পরদায় ঘেউ-ঘেউ ডাক ভেসে এল। অর্জুন চিৎকার করে উঠল, তাতান।

কিন্তু চিকারটা এবার পেছন থেকে। অর্জুন দেখল একগাদা পুলিশ চেনবাঁধা কুকুর হাতে নিয়ে ছুটে আসছে। কুকুরগুলো হিংস্র, ডাকছে তারাই। অর্জুন ছুটল। একটা সময় কুকুরের ডাক মিলিয়ে গেল, কিন্তু খুব কাছ থেকে নিচু গলার ডাক ভেসে এল। অর্জুনের মনে হল তাতানকে নিয়ে সেই অন্য গ্রহবাসী তার সামনে এগিয়ে চলেছে। এর মানে ওরা সারাক্ষণ তার সঙ্গে ছিল।

মাথার ওপর এখন বিমানের আওয়াজ। অদ্ভুত চেহারার বিমানগুলো এখন জঙ্গল খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎই তাদের একটা অর্জুনকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে জোরালো আগুনের একটা রশ্মি নেমে এল ওপর থেকে। অর্জুন দৌড়ে সময়মতো সরে গিয়ে দেখল সেই জায়গার গাছপালা পুড়ে কালো হয়ে গেল।

স্তিমিত হয়ে আসা কুকুরের ডাক অনুসরণ করে কিছুটা যেতেই সে তিনটে সিড়িঙ্গে গাছ দেখতে পেল। অর্জুন এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, খেয়াল করেনি একজন পুলিশ অফিসার তার দিকে এগিয়ে আসছে। যখন দেখতে পেল তখন মেশিনটার উদ্দেশ্যে না দৌড়ে কোনও উপায় নেই।

মাথার পাশ দিয়ে দু-দুবার গুলি ছুটে গেল। মেশিনটার কাছে পৌঁছে দরজা খুলে সে পেছনে তাকিয়ে হিংস্র পুলিশটিকে দেখতে পেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে বন্দুক তাক করেছে। হঠাৎই লোকটা হতভম্ব হয়ে পাশে ঘুরে দাঁড়াল। অদৃশ্য কিছু তাকে ধাক্কা মেরেছে বলে মনে হল। অর্জুন আর অপেক্ষা না করে মেশিনে উঠে বসে ইঞ্জিন চালু করার সুইচে হাত দিয়ে নব ঘোরাতে লাগল। একশো সত্তর বছর পিছিয়ে যেতে হবে তাকে।

প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনিতে শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা। অর্জুন চোখ মেলে দেখল চারপাশ-কেমন অন্ধকার-অন্ধকার। সে কোথায়, প্রথমে ঠাওর করতে পারল না। শরীর একটু স্থির হতে সে মেশিন থেকে নামার চেষ্টা করল। কয়েক সেকেন্ড বাদে সে বুঝতে পারল এটা ডক্টর গুপ্তর গবেষণাগার। কোনও পুলিশ অফিসার সামনে নেই বন্দুক উঁচিয়ে।

অর্জুন ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগোল। না। বিদ্যুতের ছোঁয়া নেই ওখানে। দরজা ঠেলল সে। ধীরে-ধীরে খুলে গেল সেটা। সেই সিঁড়ি এখন অন্ধকারে ঢাকা। নীচের ঘরে একটা হ্যাজাক জ্বলছে। কিছু লোক কথাবার্তা বলছে। অর্জুন হ্যাজাকের আলো লক্ষ করে নীচে নেমে আসতেই একজন চিৎকার করে উঠল, কে? কে ওখানে? অর্জুন দেখল, খাঁকি পোশাক পরা পুলিশ অফিসার।

ভদ্রলোক একা নন, সঙ্গে আরও তিনজন সেপাই আছেন। চারজনেই উঠে এসেছেন অর্জুনের সামনে। প্রত্যেকের চোখেমুখে বিস্ময়।

অর্জুন বলল, আমি অর্জুন। ডক্টর গুপ্ত আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন।

অফিসারটির চোখ ছোট হল, কখন নিয়ে এসেছিলেন?

সন্ধেবেলায়। ঠিক সন্ধে হয়নি তখনও।

আপনি ওপরে ছিলেন সেই থেকে?

হ্যাঁ।

মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাননি? আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি এই বাড়ি। ওপরের ঘরে কেউ ছিল না। এই, একে অ্যারেস্ট করো। অফিসার হুকুম করলেন।

এর কিছুক্ষণ বাদে, গভীর রাত্রে অর্জুন শিলিগুড়ির থানায় বসে ছিল। দারোগাবাবু বাইরে গিয়েছেন কাজে। তিনি না ফেরা পর্যন্ত কেউ তার কথা

শুনবে না।

অর্জুন হতাশ হয়ে পড়ছিল। একশো সত্তর বছর আগে গিয়ে তাকে পুলিশের হাতে পড়তে হয়েছিল। প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেও সেই একই অবস্থা?

দারোগাবাবু এলেন রাত দুটোর সময়। রিপোর্ট নিশ্চয়ই আগেই পেয়েছিলেন, ঘরে ঢুকে বললেন, কে হে তুমি? ওই বাংলোয় কোন মতলবে ঢুকেছিলে?

অর্জুন বলল, আপনারা খুব ভুল করছেন। আমি একজন সত্যসন্ধানী। আমার নাম অর্জুন। জলপাইগুড়ি শহরে থাকি। ডক্টর গুপ্তই আমাকে ওখানে নিয়ে যান।

হঠাৎ দারোগাবাবুর মুখচোখ বদলে গেল, আরে তাই তো! আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? ডক্টর গুপ্তকে যখন হসপিটালাইজড করা হয় তখনও তিনি আপনার নাম বলছিলেন।

উনি কেমন আছেন?

খুব খারাপ। বাঁচার কোনও চান্স নেই। হেড ইনজুরি। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

বেঁচে যাবেন। অর্জুন বলল।

মানে?

কিছু না। আর কী হয়েছে?

যারা এসেছিল ডাকাতি করতে তারা নীচের তলাই তছনছ করেছে, ওপরের ঘরে ঢুকতে পারেনি। কিন্তু একটা খবর আমরা ডক্টর গুপ্তকে দিতে পারিনি। ওঁর যা কন্ডিশন।

কী খবর?

কারেন্ট অফ করে ওপরের ঘরে ঢুকে আমরা কোনও কুকুরের দেখা পাইনি। আপনিও ছিলেন না। ডাক্তার গুপ্ত কেবলই তাতান-তাতান করছিলেন! দারোগার আবার মনে পড়ল, আপনি কোথায় ছিলেন?

ওপরের ঘরে অনেকগুলো যন্ত্র ছিল, তার একটাতে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অঘোরে ঘুমিয়েছি। অর্জুন হাসল।

আচ্ছা। হ্যাঁ, যন্ত্রগুলো দেখেছি কিন্তু কী থেকে কী হয়ে যাবে ভেবে আর খুলে দেখিনি। তা হলে কুকুরটাও তার একটাতে থাকতে পারে। দারোগা চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

না, নেই। তাতান এখানে নেই। মাথা নাড়ল অর্জুন।

দারোগাবাবুই রাত্রে শাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঘুম ভাঙার পর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাজ্জব অর্জুন। ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। ঘড়ির তারিখ একশো সত্তর বছর এগিয়ে। সে কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সময়টাকে সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনতেই ঘড়ি আবার চালু হল। প্রায় ঘণ্টা-চব্বিশ সে এই সময়ে ছিল না। কিন্তু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সে রওনা হয়েছে এক সকালে, পৌঁছল রাতের বেলায়। যাওয়ার সময় তো এমন কাণ্ড হয়নি। পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পুবে এলে সময় বেড়ে যায়, সেইরকম কিছু?

সকালবেলায় দারোগাবাবুর সৌজন্যে লুচি-তরকারি আর চা খেতে যে কী আরাম লাগল তা কাউকে বোঝাতে পারবে না অর্জুন। আহা, একশো সত্তর বছর পরের মানুষগুলো এসবের স্বাদ জানবে না।

ঠিক নটা নাগাদ শিলিগুড়ির হাসপাতালে গিয়ে শুনল কলকাতা থেকে বড় বড় চিকিৎসকরা এসেছেন। ডক্টর গুপ্তের মাথায় অপারেশন হবে। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় সে এক মুহূর্তের জন্য ডক্টরের দেখা পেল। অজ্ঞান হয়ে আছেন। অর্জুন বিড়বিড় করল। পাশে দাঁড়ানো দারোগাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কি বলছেন?

অর্জুন বলল, আর কয়েক বছর বাদে উনি নোবেল পুরস্কার পাবেন।

তার মানে? উনি ভাল হয়ে যাবেন? দারোগা অবাক।

অবশ্যই। মাথার এই আঘাতটা ওঁকে সাহায্য করবে।

অর্জুন আর দাঁড়াল না। হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠল। জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলায় রূপমায়া সিনেমার সামনে বাস থেকে নেমে কিন্তু ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কী ঘিঞ্জি রাস্তা, রিকশা, গাড়ি মানুষের ভিড়ে হাঁটা মুশকিল। একশো সত্তর বছরের পরে এই জায়গাটাকে চেনা যাবে না। এখনকার ভাল আর তখনকার ভালগুলোকে যদি এক করা যেত!

হঠাৎ তাতানের কথা মনে পড়ে গেল। তাতানকে সেই রাত্রেই তার। ভিন্নগ্রহের বন্ধু নিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই সেই এহে বয়স বাড়ে না। তাই তাতান একশো সত্তর বছর পরেও একই রকম আছে। ইচ্ছেমতন মাঝে-মাঝে বন্ধুর সঙ্গে পৃথিবীতে ঘুরে যায়। ডক্টর গুপ্ত ব্যাপারটা জানতে পারলে খুশি হবেন।

অর্জুন নিজের গালে হাত বোলাল। যাঃ, এর মধ্যেই খরখরে দাড়ি বেরিয়ে গেছে। ভাল ভাবে শেভ করে স্নান করা দরকার। সে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress