Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অর্জুন বেড়িয়ে এলো (১৯৯৩) || Samaresh Majumdar » Page 3

অর্জুন বেড়িয়ে এলো (১৯৯৩) || Samaresh Majumdar

ভদ্রলোক চলে গেলে অর্জুন চেয়ারে বসল। থাকার কথা তো ঠিক হল কিন্তু সঙ্গে যে একটা পাজামাও নেই। রাত্রে শোবে কী পরে? হঠাৎ তার খেয়াল হল তাতানের বন্ধুর কথা। অনেকক্ষণ তার কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সে চারপাশে তাকাল। অন্যগ্রহের সেই ছোট্ট প্রাণী হয়তো এই ঘরেই দাঁড়িয়ে আছে এখন। সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখানে আছ?

কেউ সাড়া দিল না।

তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারো। আমি লোক খারাপ নই। মানে, আমরা বন্ধু হতে পারি। বুঝতে পারছ? আচ্ছা, এবার বলল, তুমি কীভাবে এখানে এসেছ? তোমার কি কোনও মহাকাশযান আছে?

কোনও জবাব নেই। হাল ছেড়ে দিল অর্জুন। এইভাবে একা শূন্যঘরে কাউকে কথা বলতে দেখলে সে তাকে পাগল ভাবত। প্রাণীটা কত ছোট? ডক্টর গুপ্ত বললেন হাত তুললে চার ফুটের বেশি হবে না। ধরে নেওয়া যেতে পারে মাথায় সে আড়াই থেকে তিন ফুট। ওঃ, এর চেয়ে ছোট প্রাণী পৃথিবীতে ছিল। গালিভার যাদের লিলিপুট বলেছেন। হাজার-হাজার ছিল তারা। হয়তো অন্যগ্রহ থেকে এসেছিল। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণীদের আকৃতি ছোট হয়। একসময় এই পৃথিবীতেই বিশাল বিশাল প্রাণী দাপটে ঘুরে বেড়াত। ডাইনোসরাস এখন কোথায়? এমনকী এখন যে হাতি দেখে অবাক হতে হয়। সেকালে এর আকৃতি ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আদিম মানুষের যে পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছে তার পাশে আমাদের পায়ের ছাপ লিলিপুট। আজ থেকে তিন হাজার বছর পরে একটা হাতি যদি গোরুর উচ্চতায় নেমে যায় তা হলে মানুষ তিন ফুটের বেশি লম্বা থাকবে না। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে পৃথিবীর বিবর্তনকালের অনেক আগে বিবর্তন শুরু হওয়া অন্য কোনও গ্রহের প্রাণীই আজ ডক্টর গুপ্তের বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে ধরে নিলে একটা সহজ সমাধান তৈরি হয়।

কিন্তু সেই প্রাণী কোথা থেকে আসছে এবং কেমন ভাবে, তা বোঝা যাচ্ছে না। ডক্টর গুপ্ত কি জানেন? লোকটা বেশ রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে অর্জুনের। অথচ কুকুরের চেনটাকে শূন্যে ভাসতে দেখে কীরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় আগন্তুকের সঙ্গে ডক্টর গুপ্তের সম্পর্ক ভাল নয়। ভেবেচিন্তে কোনও সুরাহা করতে পারছিল না অর্জুন। আজ জলপাইগুড়িতে যেতে পারলে অমল সোমের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা যেত।

বৃষ্টি পড়ছে একনাগাড়ে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গাছেরা মাথা দোলাচ্ছে পাগলের মতো। অর্জুন চুপচাপ বসে দেখল দিন ফুরিয়ে আসছে। অথচ ঘড়িতে এখন মাত্র তিনটে বাজে। এদিকে ডক্টর গুপ্ত সেই যে ওপরে গিয়েছেন আর নামেননি। ভদ্রলোক তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন অন্য কেউ ওপরে যাক তা তিনি পছন্দ করেন না। অর্জুন উঠল।

অন্যগ্রহের মানুষটি এখন এ বাড়িতে আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। কারণ দীর্ঘ সময় সে তার অস্তিত্ব জানাচ্ছে না। কিছুদিন আগে অর্জুন রূপশ্রী সিনেমায় একটা খুব পুরনো ছবি দেখেছিল। ইনভিজি ম্যান। ব্যাপারটা কি সেইরকম? সে নীচের তলার ঘরগুলো দেখতে লাগল। এবাড়িতে কাজের লোক পর্যন্ত নেই। সব কিছুই ডক্টর গুপ্তকে করতে হয়। ফলে একটু অগোছালো ভাব চারধারে।

ঠিক চারটের সময় দপ করে আলো নিভে গেল। ঘরের ভেতর এখন পাতলা অন্ধকার। ওপর থেকে ডক্টর গুপ্তের গলা ভেসে এল, এক মিনিট, জেনারেটার চালিয়ে দিচ্ছি।

জেনারেটার চালু হওয়ামাত্র আলোকিত হল বাংলো। ডক্টর গুপ্ত নেমে এলেন ওপর থেকে। সোফায় বসে বললেন, মনে হচ্ছে আজকের রাতটায় আর উপদ্রব হবে না।

অর্জুন বলল, কেন মনে হচ্ছে?

খুব সোজা ব্যাপার। পৃথিবীর আকাশে এখন মেঘে-মেঘে ঘষা লেগে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। এই স্তর ভেদ করে আসাটা খুব ঝুঁকির কাজ। কেউ বোকামি করবে না।

আপনি নিশ্চিত, যে আসছে সে অন্যগ্রহের বাসিন্দা?

অবশ্যই।

কোন গ্রহ?

আমরা এর অস্তিত্বই জানতাম না যে নামকরণ করব। সূর্যের চারপাশে যেমন পৃথিবী সমেত অন্য গ্রহগুলো ঘুরছে তেমনই সূর্যের মতো আরও অনেক নক্ষত্র তাদের পরিবার নিয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেইরকম একটি পরিবার থেকে এই উপদ্রবটি এখানে পৌঁছেছে।

পৃথিবীতে আসতে ওর কত সময় লাগছে?

এইটেই আমাকে ভাবাচ্ছে। আমি আলোর চেয়ে দ্রুতগামী একটা রকেট তৈরি করেছিলাম। ট্যাকিয়ন রকেট। সেই রকেটে করে তাতানকে মহাকাশে পাঠিয়েছিলাম। রকেটের লক্ষ্য ছিল ৭.৫ আলোকবর্ষ দূরের একটি নক্ষত্রের গ্রহজগৎ। মাত্র ঘণ্টা দশেকের মধ্যেই তাতান সেই নক্ষত্রের একটি গ্রহে পৌঁছে যায়।

…তুমি নিশ্চয়ই আলোর গতি জানো? ডক্টর গুপ্ত প্রশ্ন করলেন।

ব্যাপারটা জানা ছিল অর্জুনের, এক বছরে, মানে আমাদের এক বছরে আলো মহাকাশে যায় প্রায় ছয় মিলিয়ন মাইল।

গুড। খুশি হলেন ডক্টর গুপ্ত।

আপনি যে তাতানকে রকেটে করে মহাকাশে পাঠালেন, এখানে কি সেরকম পাঠানোর ব্যবস্থা আছে? আর তার জন্য তো প্রচুর টাকা লাগে।

অর্জুন অকপটে তার মনের কথা বলে ফেলল।

ডক্টর গুপ্ত মাথা নাড়লেন, তুমি ঠিক বলেছ। আমার মতো সাধারণ মানুষ অত টাকা পাবে কোথায়? তা ছাড়া একজন সাধারণ নাগরিককে সরকার রকেট ছোঁড়ার অনুমতি দেবেন কেন?

তা হলে? অর্জুন বেশ বিস্মিত হচ্ছিল।

এক মুহূর্ত ভাবলেন ডক্টর গুপ্ত। সম্ভবত অর্জুনকে নিজের কথা বলবেন কি না তাই চিন্তা করলেন। এবার তাঁকে হাসতে দেখা গেল, অর্জুন, এককালে লোকে গোরুর গাড়ি-ঘোড়ায় চেপে যাতায়াত করত। কলকাতা থেকে দিল্লিতে একদিনে যাওয়ার কথাই ভাবতে পারত না। তারপরে যখন ট্রেন চলল তখন দু ঘণ্টায় যাওয়ার কথাও কেউ বিশ্বাস করেনি। এখন তো সেটাই জলভাত। এমন দিনও তো আসতে পারে, ছ মিনিটে আমরা কলকাতা থেকে দিল্লি পৌঁছে যেতে পারি। তাই না?

হয়তো! অর্জুন আর কী বলতে পারে!

রকেট চালিয়ে মহাকাশে যান পাঠানো এখনকার রীতি। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার যে দুটো আবিষ্কার তা এই রীতি থেকে অবশ্য ঠিক প্রশ্ন অন্য অনেক গুনবে এগিয়ে। কিন্তু সেটা জানার আগে বল যে জন্য তোমায় নিয়ে এলাম তার কী করলে?

অর্জুন তাকাল। তারপর বলল, এত অল্প সময়ে কিছু করা সম্ভব? আপনি বলছেন অন্য গ্রহ থেকে জীবন এখানে আসছে। কীভাবে আসছে?

ঠিক প্রশ্ন করেছ তুমি। না, সে সাধারণ মহাকাশযানে চেপে আসছে না। এই ব্যাপারটা অন্য অনেক গ্রহে খুব পুরনো বলে বাতিল হয়ে গিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, যেভাবে তাতানকে পাঠিয়েছিলাম সেভাবে এই উপদ্রবটি যাওয়া-আসা করছে। তাতানকে সাধারণ মহাকাশযানে পাঠালে ওর সঙ্গে দেখাই হত না। সম-স্তর বলেই যোগাযোগ হয়েছিল। ঠিক আছে, তুমি আমার সঙ্গে ওপরে চলল।

ওপরে? অর্জুন প্রশ্ন না করে পারল না।

হ্যাঁ। আমি কাউকে ওপরে নিয়ে যাই না। কিন্তু তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।

আচমকা অর্জুন প্রশ্ন করল, আপনি তো আজই আমাকে প্রথম দেখলেন, ভাল করে চেনেনও না। আপনার গোপন গবেষণার ঘরে আমাকে নিয়ে যাওয়া কি উচিত হচ্ছে?

ডক্টর গুপ্ত মাথা ঘোরালেন। তাঁকে খুব হতভম্ব দেখাল প্রথমটায়। তারপর অকস্মাৎই অট্টহাস্যে ভেঙে পড়লেন, গুড। গুড। আমার মন আরও পরিষ্কার হয়ে গেল।

কীরকম?

খুব সাধারণ ব্যাপার। তোমার মনে অন্য কিছু থাকলে এই প্রশ্ন করতে। তা ছাড়া তোমাকে য়ে আমার কোনও ভয় নেই। যে কোনও দিন মোটরগাড়ি দেখেনি তাকে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিলেও সে গাড়ি নিয়ে পালাতে পারবে না। চলো।

ডক্টর গুপ্তর পেছন-পেছন অর্জুন ওপরে উঠল। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে তিনি বললেন, একটু সাবধানে আসতে হবে। আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। যদিও মনে হচ্ছে উপদ্রবটি তার গ্রহে ফিরে গেছেন তবু কে জানে। এখানেই ঘাপটি মেরে পড়ে আছেন কি না। তুমি যখন ভেতরে ঢুকবে তখন তোমার শবীর একটি বিদ্যুৎপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে যাবে। সামান্য চিনচিন করবে। অশরীরী অস্তিত্বের কাছে সেটা খুবই মারাত্মক অবশ্য। এসো।

দরজা খুলে ডক্টর গুপ্ত এগিয়ে গেলেন। অর্জুন পা বাড়াতেই মনে হল সমস্ত শরীরে ঝিঝি ধরে গিয়েছে। অর্থাৎ সে বিদ্যুৎপ্রবাহের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনওমতে শরীরটা সামনে ঠেলে দিয়ে আসার পর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ডক্টর গুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, কোনও অসুবিধে হয়নি তো? একটু চিনচিন? প্রত্যহ এক-দুবার নিলে জীবনে বাত হবে না তোমার। আমি তো অনেকবারই নিই, দ্যাখো, কী ফিট বডি আমার।

এসব কথায় মন ছিল না অর্জুনের। তার চোখ এখন ঘরের চারপাশে। বেশ লম্বা হলঘর এটি। চারপাশে নানা যন্ত্রপাতি ছড়ানো। এক কোণে জানলার পাশে ফ্রেমের মতো কিছু, যার মুখে আয়না জাতীয় বস্তু লাগানো। তার পাশেই অদ্ভুত টেবিল-চেয়ার। প্রতিবন্ধীদের জন্য যে-ধরনের হুইল চেয়ার তৈরি করা হয় তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি ছোট্ট টেবিলও। ডক্টর গুপ্ত জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাচের জানলার ওপাশে বিদ্যুৎ চমকে বারংবার পৃথিবী আলোকিত হচ্ছে। ভদ্রলোক হাত মাথার ওপরে তুললেন, আমাদের পৃথিবীর আর মহাকাশের মধ্যে যোগাযোগ এখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। রুকাউয়াট কে লিয়ে খেদ নেহি হ্যায়।

অর্জুনের মজা লাগল। তা হলে এই ভদ্রলোক টিভিও দেখেন!

ডক্টর গুপ্ত ঘুরে দাঁড়ালেন, এই হল আমার জায়গা। আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। সারাজীবন ধরে তিল-তিল পরিশ্রম করে এটিকে আমি তৈরি করেছি। এখানে দাঁড়িয়ে আমি মহাকাশের অনেকটাই ঘুরে আসতে পারি। ববকে, মানে রবার্ট সিনক্লেয়ারকে এই ঘরে ঢুকতে দিইনি আমি। সে এই লাইনের লোক। আমার এই ভাঙাচোরা যন্ত্র নিয়ে কোনওমতে যে কাজ করছি আমি, তা দেখতে পেলে সে দেশে ফিরেই বেশ সফিসটিকেটেড মেশিন তৈরি করে ফেলতে পারত। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার সেই ভয় নেই। বোসো, বোস। হাত বাড়িয়ে সেই চেয়ারটিকে দেখিয়ে দিলেন তিনি। চেয়ারের তলায় চাকা আছে। সাবধানে না বসলে পিছলে যেতে পারে। অর্জুন অস্বস্তি নিয়ে সেখানে বসল। ডক্টর গুপ্ত তখন সেই বাক্স থেকে তাতানকে বের করে একটা গামলার মধ্যে রেখেছেন। ঝুকে পড়ে চুকচুক করে তাকে ডাকছেন। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ব্যাটার খুব মন খারাপ দেখছি। একবার গিয়ে এমন মন খারাপ হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে

উপদ্রবটি এখানে এসেছিল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কিছু মনে করবেন না, একটা প্রশ্ন করব?

নিশ্চয়ই।

এসব তো সায়েন্স ফিকশনে হয়ে থাকে। স্পিলবার্গ নামের একজন চিত্রপরিচালকও এমন বিষয় নিয়ে ছবি করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকেরা পৃথিবী ছাড়া অন্যগ্রহে প্রাণীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পেরেছেন বলে শুনিনি।

মাথা নাড়েন ডক্টর গুপ্ত, কারেক্ট। পৃথিবী ছাড়া সূর্যের চারপাশে যারা ঘুরছে তাদের আবহাওয়ায় প্রাণের জন্ম হওয়া সম্ভব নয়। মঙ্গলে তবু একটু সম্ভাবনা ছিল কিন্তু সেখানে জলের অভাবই বোধ হয় এর অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তা হলে?

ডক্টর গুপ্ত বললেন, দ্যাখো বাবা, বিরাট মহাকাশে সূর্য এবং তার পরিবার এটুখানি জায়গা নিয়ে থাকে। ওরকম কত সূর্য আর তাদের ঘিরে কত গ্রহ ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। সেই রকম অনেক গ্রহেই দেখা যাবে আমাদের পৃথিবীর মতো আবহাওয়া। সূর্য থেকে যতটা দূরত্বে থাকায় পৃথিবীতে এমন আবহাওয়া তৈরি হয়েছে সেই গ্রহগুলো তাদের সূর্য থেকে ঠিক একই দূরত্বে থাকলে সমান আবহাওয়া পাবে এবং পাচ্ছে। ফলে প্রাণের অস্তিত্ব একশো ভাগ সম্ভব।

এর কোনও প্রমাণ আছে?

নিশ্চয়ই। সূর্য থেকে ছিটকে আসা গ্রহগুলো স্থিতাবস্থায় আসার পর যখন পৃথিবীতে অ্যামিবার জন্ম হল, সেই সময় থেকে মানুষের জন্ম পর্যন্ত বিবর্তনের ইতিহাস আমরা জানি। মহাকাশের অন্য সূর্যগুলো থেকে একই প্রক্রিয়ায় এমন অনেক গ্রহের উৎপত্তি হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশই পৃথিবী থেকে কয়েক কোটি বছর বয়স্ক। ফলে সেখানে প্রাণ এসেছে আমাদের অনেক আগে। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মানুষজাতীয় প্রাণী জন্ম নিয়েছে বহু বহু আগে। তাই তাদের বোধবুদ্ধি এবং কার্যক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এটাই তো স্বাভাবিক। তারা ইচ্ছে করলে তাদের বিজ্ঞানের সাহায্যে সমস্ত মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে। আমরা শুধু চাঁদে মানুষ নামাতে পারি, মঙ্গল গ্রহে পাঠাতে পারি। হ্যাঁ, বলতে পারো আমি তার থেকে এক ধাপ এগিয়েছি। কিন্তু সেখানে কোন গ্রহের অস্তিত্ব তার নাম জানি না। তাতান যদি কথা বলতে পারত তা হলে সেটা জানা যেত।

অর্জুন একমনে শুনছিল। ডক্টর গুপ্তের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সঠিক প্রমাণ বলতে যা বোঝায় তা তিনি দিতে পারেননি। সে জিজ্ঞেস করল, মহাকাশে যে মানুষজাতীয় বুদ্ধিমান প্রাণীর কথা আপনি বলছেন তারা কি আমাদের মতো দেখতে?

অসম্ভব। হতে পারে না। দাঁড়াও, তোমাকে ছবিগুলো দেখাই। ডক্টর গুপ্ত এগিয়ে গেলেন দেওয়ালের দিকে। সেখানে দেওয়াল-আলমারি জুড়ে প্রচুর বই রয়েছে। তার একটি বের করে পাতা খুলতে খুলতে এগিয়ে এলেন, এটা কীসের ছবি?

অর্জুন দেখল বিশাল চেহারার হাতি, সারা শরীরে লোম। ডক্টর গুপ্ত বললেন, এটি হল ম্যামথ। আদিকালের হাতি। এখনকার হাতির চেয়ে দেড়গুণ বড় শরীর। এর পাশে চিড়িয়াখানার হাতিদের শিশু বলে মনে হবে। যতদিন যাচ্ছে তত আকার ছোট হচ্ছে। তুমি যদি কয়েকশো বছর পিছিয়ে যাও তা হলে দেখবে তখনকার মানুষ যেসব পোশক ব্যবহার করত তাতে তোমার মতো দুজন ঢুকে যাবে। আমাদের মুগল সম্রাট যেসব অস্ত্র স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতেন তা আমাদের পক্ষে তুলে ধরাই বেশ কষ্টকর। তার মানে ওঁদের শরীর আমাদের চেয়ে বড় ছিল। আবার যদি কয়েকশো বছর এগিয়ে যাও তা হলে দেখবে সব কিছু কেমন ছোট-ছোট অথচ তোমার থেকে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত। এটাই নিয়ম। পৃথিবীর বাইরে যে প্রাণ, তার জন্ম হয়েছে আমাদের অনেক, অনেক আগে। ফলে সেখানকার প্রাণীর আকার, বিবর্তন মেনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে গেছে। হয়তো মস্তিষ্ক, উ, হাত-পা ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের।

সত্যি, অতবড় হাতি ছবিতেও দেখেনি অর্জুন। শুধু শুড় এবং চারটি পা ও লেজ ছাড়া এখনকার হাতির সঙ্গে তেমন মিল নেই। বিশাল লোম, একটা বিকট আকৃতির জন্য ম্যামথকে বেশ বীভৎস বলে মনে হচ্ছিল। বই রেখে দিয়ে ডক্টর গুপ্ত বললেন, অর্জুন, তোমার নামের সেই বিখ্যাত পাণ্ডবটি স্বর্গে গিয়েছিলেন একথা মহাভারতে আছে। স্বর্গে সময় স্থির হয়ে আছে। স্বৰ্গটি কোথায়? কাউকে জিজ্ঞেস করো, সে যত নিরক্ষরই হোক স্বর্গ বললে মাথার ওপরে হাত তুলে দেখাবে। অর্থাৎ স্বর্গ ওই মহাশূন্যে, মাটির নীচে বা পাশাপাশি কোথাও নেই। মানুষকে কিন্তু কেউ বলেনি স্বর্গ মাথার ওপরে আছে। জন্মজন্মান্তর থেকে একটা ধারণা তার রক্তে সে বয়ে নিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই এর কারণ আছে। সে পড়েছে দেবতারা স্বর্গ থেকে নেমে আসেন। নেমে আসা মানে আমাদের ওপরে তাঁরা থাকেন। আর ওপর বলতে তো আকাশ, মহাকাশ। অথাৎ, মহাকাশেই কোথাও স্বর্গ আছে যেখানে সময় স্থির হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই সূর্যের সংসারের কোনও গ্রহে স্বর্গ নেই। সেখানে তো

প্রাণের অস্তিত্বই অসম্ভব। তা হলে অন্য কোথাও, অন্য সূর্যের সংসারে স্বর্গ বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে। সেখান থেকে মাঝে-মাঝে দেবতারা এই পৃথিবীতে নেমে আসেন।

অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, আসতেন।

আসতেন? নো। আসতেন কেন? এখনও আসেন। ওই যে উৎপাতটা তাতানের খোঁজে আসছে, ওকে নিশ্চয়ই আমাদের গ্রামবৃদ্ধরা উপদেবতা বলতেন।

অর্জুনের খেয়াল হল সে কিছুদিন আগে দানিকেন সাহেবের লেখা কয়েকটা বই পড়েছে এবং ডক্টর গুপ্তের মতো এতবড় বিজ্ঞানী সেইরকম কথাই বলছেন। দানিকেন সাহেবের কথা তুলতেই ডক্টর গুপ্ত হাত নাড়লেন, যা বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না তাই অন্য গ্রহের মানুষের কাজ বলে চাপাতে আমি রাজি নই। অর্জুন, আমার গবেষণা দুটো বিষয় নিয়ে। এক, মহাকাশের অন্য গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ করা। অংশত আমি সফল। তাতানকে আমি পাঠিয়েছিলাম, ওর পেছন-পেছন যে নেমে এসেছে সেই প্রমাণ দিচ্ছে মহাশূন্য প্রাণীহীন নয়।

আপনি কীভাবে তাতানকে পাঠিয়েছিলেন?

সেটা তোমাকে বলব না। যতক্ষণ না গবেষণা সফল হচ্ছে ততক্ষণ বলা ঠিক হবে না। আমি পৃথিবীকে একবারেই চমকে দিতে চাই।

কিছু মনে করবেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

ডক্টর গুপ্ত যেন রেগে গেলেন। তারপর বললেন, তুমি মহাশূন্যে যেতে চাও?

অর্জুন তাতানের দিকে তাকাল। মহাশূন্যে গেলে যদি তার অবস্থা ওই তাতানের মতো হয়ে যায়? লম্বায় চার ইঞ্চি। অসম্ভব। সে মাথা নাড়ল।

ডক্টর গুপ্ত এবার হাসলেন, ভয় পাচ্ছ মনে হচ্ছে! আরে মহাশূন্যে যাওয়া মানে তাতান হয়ে যাওয়া এমন ভাবছ কেন? তাতান এমন একটা গ্রহে গিয়ে পড়েছিল যেখানে গেলে ওই অবস্থা হয়। তুমি এই সূর্যের সংসারগুলো দেখে এলে পারতে। অবশ্য চাঁদের বাইরে কিছুটা বাদে আমাদের বৈজ্ঞানিকরা তেমন কোনও প্রতিক্রিয়ার খবর এখনও পাননি।

ডক্টর গুপ্ত এগিয়ে গেলেন সেই ক্রেনের মতো দেখতে মেশিনটার কাছে। মেশিনটার গায়ে হাত রেখে বললেন, এইটে আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমি মানুষকে তার ভবিষ্যৎ জানাতে চাই। আজ তুমি যে সময়টায় দাঁড়িয়ে আছ সেই সময়টাকে স্থির রেখে আমি, ধরো, দুশো বছর এগিয়ে নিয়ে গেলাম। অর্থাৎ দুশো বছর বাদে কী ঘটবে তা দেখতে চাইলাম এখনকার মানসিকতা নিয়ে। এটা করতে পারলে ভবিষ্যতে যাঁবা হাত দেখে কুষ্ঠি বিচার করে চলে তাদের জব্দ করা যাবে। আবার মানুষ তার ভবিষ্যতের কাজকর্ম দেখে বর্তমানের ভুল শুধরে নিতে পারবে।

এই গবেষণায় কতটুকু এগিয়েছেন?

তেমন কিছু না। এক-দু পা মাত্র। এদিকে এসো, এই যে সুইচটা দেখছ, এটা টিপলে যন্ত্র চালু হবে এবং তোমার চারপাশের সময়টা চাপ বেঁধে স্থির হয়ে যাবে। এবার দ্বিতীয় বোতামটা টিপলে তোমার ওই সময় সচল হবে। এখানে দ্যাখো, মিটার আছে। বর্ষমিটার। তুমি পাঁচ থেকে পাঁচশো পর্যন্ত মিটার ঘোরাতে পারো। অথাৎ, ইচ্ছে করলে পাঁচ থেকে পাঁচশো বছর ভবিষ্যতে চলে যেতে পারে। কিন্তু এ-জায়গায় আমি সবসময় সাফল্য পাচ্ছি না। একবার হয়েছিল। নাইন্টি ফোরে আমেরিকায় ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। ইতালিকে দু গোল দিয়েছিল জার্মানি। ফিরে এলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর মেশিনটা কাজ করছে না। প্রথমবারে যা-যা করেছিলাম তা করেও নয়। এটাই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্জুন হতভম্ব। নাইন্টি ফোর আসতে এখনও তিন বছর বাকি আছে। হ্যাঁ, সেই সময় আমেরিকায় ওয়ার্ল্ড কাপ হওয়ার কথা। কিন্তু ডক্টর গুপ্ত গোল দিয়েছিল বললেন? সেকথাটা তুলতেই ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, আসলে খেলা শেষ হওয়া অবধি আমি লস অ্যাঞ্জেলিসের স্টেডিয়ামে ছিলাম। গোল দেওয়া হয়ে গেলে, গিয়েছিল তো বলবই।

তার মানে আপনি বলছেন ওই টুর্নামেন্টে জার্মানি দু গোলে ইতালিকে হারাবেই? এটা এখন থেকে আপনি জানতে পারছেন? অর্জুন উত্তেজিত।

মাথা নাড়লেন ডক্টর গুপ্ত, হ্যাঁ, জানতে পারছি কিন্তু কাউকে জানাতে চাইছি না। পৃথিবীর কিছু মানুষ সেটা জেনে গেলে ফাটকা খেলবে। লক্ষ-লক্ষ মানুষকে ভুয়ো জুয়ায় হারাবে। জুয়াড়িরা যদি জেনে যায় জার্মানি জিতে যাবেই, তা হলে ইতালির সমর্থকদের কোটি-কোটি টাকা তারা বেমালুম হজম করে ফেলবে। হাসলেন তিনি, এ তো গেল খুব সামান্য দিক। এর বড় দিকটাই আসল চিন্তার ব্যাপার।

ঠিক এই সময় ঘরের এক কোণে লাল আলো জ্বলে উঠে বিপ-বিপ শব্দ শুরু হল। অর্জুনের গায়ে কাঁটা ফুটল। তার মনে হল মহাকাশ থেকে নিশ্চয়ই কেউ কোনও সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। কিন্তু ডক্টর গুপ্তকে বেশ হতাশ দেখাল, একটু একা থাকতে দেবে না। এই ঝড়বাদলে অন্ধকারে আবার কে এল?

আপনি বললেন মেঘের আস্তরণ, বিদ্যুতের ঝলকানি থাকায়…।

এসেছে নীচের গেটে। অবশ্যই গাড়িতে। এখানে হেঁটে কে আর আসবে। চলো, নীচে যাই। দেখি গিয়ে। ডক্টর গুপ্ত দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

এতক্ষণ এই পরিবেশে বেশ ভাল লাগছিল অর্জুনের। বিজ্ঞানের মাধ্যমে কতরকম কাণ্ড ঘটছে পৃথিবীতে। জলপাইগুড়িতে বসে সেসব কথা জানাই যেত না। জলপাইগুড়ির অনেক মানুষ এখনও বলতে পারবে না কীভাবে টিভির পর্দায় ছবি ফোটে, রেডিওতে গান বাজে অথবা টেলিফোনে কথা শোনা যায়! সে ক্রেনের মতো দেখতে যন্ত্রটার দিকে তাকাল। যন্ত্রটা গোলমাল করছে। নইলে সে ডক্টর গুপ্তকে বলত কাছাকাছি সময় থেকে তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে।

সদর দরজা খুলে বাইরের আলো জ্বালাতেই বৃষ্টিভেজা বাগানটার সামান্য অংশ দেখা গেল। ডক্টর গুপ্তের গাড়ির গায়ে অঝোরে জল পড়ছে। কারণ গাড়িটা এখন গাড়িবারান্দার বাইরে দাঁড়িয়ে। ওটা আগে ওখানে ছিল না।

গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে ডক্টর গুপ্ত চিৎকার করলেন, হু ইজ দেয়ার? কে এসেছেন? আগে নিজের পরিচিতি জানান।

পনেরো ফুট দেওয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া, মজবুত গেট, তার ওপর বৃষ্টির শব্দ, ডক্টর গুপ্তের গলা আগন্তুক শুনতে পেল কি না সন্দেহ। ডক্টর গুপ্ত বললেন, লাউড স্পিকারের কথা কখনও ভাবিনি, এখন মনে হচ্ছে সেরকম একটা কিছু থাকলে ভাল হত।

কেউ যে এসেছেন তা বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টি ভেদ করে একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ছে ওপাশের গাছের ওপর। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এত রাত্রে আপনার কাছে এর আগে কেউ এসেছেন?

ডক্টর গুপ্ত মাথা নাড়লেন, সচরাচর নয়। তবে শিলিগুড়ির কে পুলিশ অফিসার এ-পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝে-মাঝেই খোঁজখবর নিয়ে যান।

এই সময় বৃষ্টিটা একটু ধরল। ঝোড়ো বাতাস শব্দ বাড়াচ্ছে গাছের পাতায় আঘাত করে। ডক্টর গুপ্ত চেঁচালেন আবার, হু ইজ দেয়ার?

প্লিজ ওপেন দ্য গেট। দিস ইজ বিল।

ডক্টর গুপ্ত অর্জুনের দিকে তাকালেন, বিল? মানে? উইলিয়াম উইলিয়াম জোন্স? বলেই তিনি ছুটে গেলেন বৃষ্টির মধ্যে আচমকা।

অর্জুন কোনও বাধা দিতে পারল না। উইলিয়াম জোন্স নিশ্চয়ই তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ কেউ, নইলে ছুটবেন কেন? কিন্তু একটা ছাতা সঙ্গে নিয়ে গেলে পারতেন। গেট খুলে যাচ্ছে। হয়তো রিমোট ডক্টর গুপ্তের পকেটেই ছিল। গাড়ির হেডলাইটের সামনে এখন ডক্টর গুপ্তের শরীর শ্যিলুট হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অর্জুন ভদ্রলোককে ঘুরে দাঁড়াতে দেখল। তিনি চিৎকার করে কিছু বললেন। গাড়ি সটান এগিয়ে আসছে তাঁকে চাপা দেওয়ার জন্য। ডক্টর গুপ্ত একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। গাড়িটা এবার তার দিকে এগিয়ে আসছে। অর্জুন দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসল। সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ এবং ঝনঝন শব্দ শুরু হয়ে গেল। অর্জুন কী করবে বুঝতে পারছিল না। ডক্টর গুপ্ত নিশ্চয়ই আহত হয়ে বৃষ্টির ভেতর পড়ে আছেন। তাঁকে সাহায্য করতে গেলে বন্দুকবাজদের সামনে পড়তে হবে।

দরজায় আঘাত শুরু হল। ওরা সেটাকে ভাঙতে চাইছে। গাড়িতে ঠিক কজন মানুষ ছিল, অন্ধকার এবং বৃষ্টির কারণে বোঝা যায়নি। অর্জুনের মনে হল, আপাতত ডক্টর গুপ্তকে দেখার বদলে তাঁর গবেষণার জিনিসগুলো বাঁচানো বেশি জরুরি। সে দ্রুত দোতলায় উঠে এল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সেটাকে প্রথমে বন্ধ করতেই শরীরে চিনচিনে অনুভূতি হল। অর্থাৎ কারেন্ট পাস হচ্ছে এখান থেকে। সে ঘরের ভেতর ঢুকে ভাল করে তাকাল। নীচে তখনও সমানে গুলির আওয়াজ হয়ে যাচ্ছে। ডান দিকের দেওয়ালের গায়ে রেগুলেটরের মতো একটা নব। ওটার গায়ে লেখা আছে এক দুই তিন চার। রেগুলেটারের মার্কিংটা এক নম্বরে রয়েছে। যদি ওটাকে দুই বা তিনে নিয়ে যাওয়া হয় তা হলে কি এখানকার কারেন্ট আরও তীব্রতর হবে? সেক্ষেত্রে কেউই এ-ঘরে ঢুকতে পারবে না। অর্জুন নবটাকে ঘোরাল। দরজার সামনে গিয়ে নিজের শরীর নিয়ে পরীক্ষা করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা সে করল না। এক নম্বরেই যদি অমন চিনচিনানি হয় তা হলে…!

এই সময় নীচের দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। হয়ে গেল। ওরা এবার একতলায় ঢুকে পড়বে। ডক্টর গুপ্ত এত সাবধানতা অবলম্বন করে এখানে ছিলেন কিন্তু কী লাভ হল তাতে? সামান্য একটা ভুলে সব নষ্ট হতে চলেছে। অর্জুন চুপচাপ দরজা ছেড়ে জানলার কাচের পাশে চলে এল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না বাইরের।

এবার দোতলার সিঁড়ির গায়ে ধাক্কা। এবং সঙ্গে সঙ্গে চিঙ্কার। কেউ যেন ছিটকে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ল নীচে। মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে। দ্বিতীয়বার ধাক্কা হওয়ামাত্র আবার চিৎকার। অর্জুন একটু নিশ্চিন্ত হল। নব ঘুরিয়ে কারেন্ট বাড়ালে নিশ্চয়ই সমস্ত দরজাটাই ইলেকট্রিফাইড হয়ে গিয়েছে।

একটু চুপচাপ। হঠাৎ গুলির আওয়াজ হল। দরজা ভেদ করে একটা গুলি এসে লাগল ঘরের ছাদে। খানিকটা কাঠের টুকরো পড়ল মেঝেতে। দ্বিতীয় গুলিটা দরজা ফুটো করে ছুটে এল অনেকটা নীচ দিয়ে। প্রায় অর্জুনের কান ঘেঁষে সেটা লাগল ক্রেনের মতো দেখতে যন্ত্রটায়। অর্জুন চমকে গেল এমন যে, মাটিতে না বসে পারল না। তৃতীয় গুলিটা ছুটে গেল ছাদে। কিন্তু ততক্ষণে অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুরু হয়েছে ঘরের ভেতর। অর্জুন মুখ তুলে শুনল। আওয়াজটা আসছে ওই ক্রেন জাতীয় যন্ত্রটার শরীর থেকে। গুলিটা লাগার পরই ওর পিস্টন চালু হয়ে গিয়েছে। সে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনটাকে দেখতে লাগল। ক্রেনের ভেতরে একটা বসার জায়গা আছে। তার সামনে মোটরগাড়ির হুইল। ড্যাশবোর্ডের মতো জায়গায় নানারকম আলো জ্বলছে। ডক্টর গুপ্ত ইঞ্জিনটাকে চালু করতে পারছিলেন না, কিন্তু একটা বন্দুকের গুলি আচমকা সঠিক জায়গায় আঘাত করায় ওটা চালু হয়ে গেল। কী তাজ্জব ব্যাপার!

যিনি বাইরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়ছেন তিনি সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। এবার তাঁর গুলি লাগল দরজার ভেতরে তালার গায়ে। ভাল শব্দ হল। অর্জুন জানে নোকটার উদ্দেশ্য এই ঘরে ঢুকে যন্ত্রপাতির দখল নেওয়া। যদি বুদ্ধি করে ইলেকট্রিকের লাইন কেটে দিয়ে দরজা ভেঙে ঢোকে তা হলে বন্দুকের সাহায্যে সেই উদ্দেশ্য সফল করতে একটুও বেগ পেতে হবে না। ওদের। এ-অবস্থায় সে কী করতে পারে?

ইতস্তত ভাবতে-ভাবতে অর্জুন মেশিনটার দিকে তাকাতেই দ্বিতীয় মতলব মাথায় এল। সে চুপচাপ মেশিনের মাঝখানের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। এটিকে কী করে চালু করতে হয় তা সে জানে না। মেশিন থেকে যেরকম শব্দ বের হচ্ছে তাতে মনে হয় ওটা ইতিমধ্যেই সচল হয়েছে। কিন্তু এখন কী করা যাবে? অর্জুন সামান্য ঝুঁকে ড্যাশবোর্ডের আলোগুলো দেখল। দশ-বিশ-ত্রিশ পঞ্চাশ-একশো-হাজার-দশ হাজার লেখা রয়েছে যেখানে, তার নীচেই একটা বোতাম। অর্জুন বোতামটাকে টিপতেই বি-বিপ শব্দ বাজতে লাগল এবং নম্বরগুলোর একপাশে একটা একটা কাঁটাকে ভেসে উঠতে দেখা গেল। অর্জুন সেটাকে ঘোরাবার চেষ্টা করতেই কাঁটাটাকে এক লাফে কুড়ি এবং ত্রিশের মাঝখানে চলে আসতে দেখা গেল। অর্জুনের সমস্ত শরীর থর-থর করে কাঁপছিল। মেশিনটা যেন পাগলের মতো আচরণ করছে এখন। এবার তার নজরে এল পাশাপাশি দুটো সুইচ রয়েছে। তার একটাতে চাপ দিল সে উদভ্রান্তের মতো।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress