Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অর্জুন বেড়িয়ে এলো (১৯৯৩) || Samaresh Majumdar » Page 2

অর্জুন বেড়িয়ে এলো (১৯৯৩) || Samaresh Majumdar

বসার ঘরটি সুন্দর। বাহুল্য কিছু নেই। দুটো বেডরুম আছে। ডক্টর গুপ্ত মালপত্র কিচেনে রেখে গরম জল চাপিয়ে দিলেন স্টোভে। অর্জুন চুপচাপ দেখছিল। বৃষ্টি নেমেছে। পাহাড়ি গাছের ঝুটি ধরে নাড়াচ্ছে খ্যাপা বাতাস। ডক্টর গুপ্ত বললেন, সরকারি কারেন্ট যখন আছে তখন জেনারেটারটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। অবশ্য ওটি খুব শক্তিশালী। এক নাগাড়ে চব্বিশ ঘণ্টা চলতে পারে। চোখের আড়ালে চলে গেলেন ভদ্রলোক। তারপরেই শব্দটা থেমে গেল। অর্জুন কাচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। এরকম অবস্থা যদি বিকেল পর্যন্ত চলে তা হলে আজ ফেরার কথা ভুলে যেতে হবে। এমনিতেই ঘরে আলো জ্বলছে এখন।

সে বাইরের ঘরের সোফায় এসে বসল। ব্যাঙ্কে ডক্টর গুপ্ত টাকার কথা বলছিলেন। কিন্তু এই বাড়ির পেছনে যাঁর এত খরচ হয় তাঁকে কি গরিব বলা যায়? কখনও নয়। এত খরচ করে নিরাপদে থেকে উনি কী করছেন? একা থাকতে হাঁফিয়ে ওঠেন না? এই সময় ডক্টর গুপ্ত একটা জুতোর বাক্স নিয়ে নেমে এলেন ওপর থেকে। বললেন, এবার কফিটা বানিয়ে ফেলি, তুমি ততক্ষণ তাতানের সঙ্গে ভাব করো। জুতোর বাক্সটা অর্জুনের সামনের টেবিলে রেখে তিনি চলে গেলেন।

অর্জুন দেখল বাক্সটা একটু অন্যরকমের। গোল-গোল সিকি সাইজের গর্ত আছে ওপরে। একপাশে হুক লাগানো আছে, মানে সেটি দরজা। হুক ধরে টানতেই দরজা খুলে গেল। তারপর অর্জুনের অবাক হওয়া চোখের সামনে এসে দাঁড়াল তাতান। ডক্টর গুপ্ত যেমনটি বলেছিলেন ঠিক তেমনটি। তাতানের গায়ের রং খয়েরি। কান ঝোলা। বাইরে বেরিয়ে এসে পেছনের পা মুড়ে বসে সে অর্জুনকে দেখতে লাগল। তার লেজ নড়ছে। পৃথিবীর কোথাও কেউ এত ছোট কুকুরের কথা শুনেছে? অর্জুন ডাকল, তাতান?

তাতান উঠে দাঁড়াল, তারপর মুখ তুলে ডাকল। খুব মিহি ডাক। অন্যমনস্ক থাকলে এমন ডাক কানেও ঢুকবে না। অর্জুন আঙুল বাড়াতেই চারপায়ে পিছিয়ে যেতে লাগল তাতান। তারপর ঘুরে একদৌড়ে বাক্সের ভেতর।।

এই সময় একটা ট্রেতে কফি আর বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ডক্টর গুপ্ত, কি, ভাব হল তাতানের সঙ্গে? Cথায় গেল?

ট্রে নামিয়ে কফি দিয়ে তিনি চেয়ার টেনে বসে ডাকলেন, তা-তান।

সঙ্গে-সঙ্গে ভেতর থেকে ছুটে এল কুকুরটা। টেবিলের ওপর হাত পেতে দিতেই সে উঠে পড়ল সেখানে। হাত না ভাঁজ করে ডক্টর গুপ্ত তাকে নিয়ে এলেন নিজের মুখের সামনে, আই অ্যাম সরি তাতান। তোর এই দশা আমার জন্যই হয়েছে। কিন্তু আমি যে এখনও অভিমন্যু। ঢুকতে জানি, বেরতে জানি না। বিস্কুটের কুচি ভেঙে তাতানকে খাওয়ালেন তিনি।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ও কি অন্য কুকুরদের মতোই খায়?

হ্যাঁ, সব খায় তাতান। খুব ভাল। তিনি কুকুরটাকে নামিয়ে দিলেন টেবিলের ওপরে। অর্জুনের মনে হল একটা পুতুল কুকুর হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই পুতুলের দাম এখন দশ লক্ষ টাকা উঠেছে? সে জিজ্ঞেস করল, তাতানকে আপনি কী করে পেলেন?

তিস্তাবাজারে এক বুড়ো নেপালি কয়েকটা পাহাড়ি কুকুরের বাচ্চা বিক্রি করছিল। কালিম্পং থেকে ফেরার পথে দেখতে পেয়ে কিনে এনেছিলাম। তখন ওর বয়স হবে মাসদুয়েক। নাম রাখলাম তাতান। বছর দেড়েকের মধ্যে বেশ তাগড়াই হয়ে গেল। পাহাড়ি কুকুর বেশি লম্বা হয় না। তাতান ফুট দেড়েক হয়েছিল। ভারী সুন্দর গায়ের লোম। ওই যে দেওয়ালে ছবি দেখছ, ওই হল তাতান।

অর্জুন দেওয়ালের ফটোটা দেখল। স্বাভাবিক চেহারার একটা কুকুরের ছবি। অবিকল এই তাতানের মতো দেখতে, কিন্তু বহুগুণ বড়। সে প্রচণ্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, অতবড় কুকুর এত ছোট হল কী করে?

আমার ভুলে।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

ডক্টর গুপ্ত কফির কাপে চুমুক দিলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার সমস্যাটা তো এখানেই। বব ওর জানালে ছাপিয়েছে, আমি এমন কিছু আবিষ্কার করেছি যে, বড় জিনিস ছোট করতে পারি। এবার ধরো, একটা জায়গায় বিরাট বস্তি আছে। জমির মালিক কাউকে উচ্ছেদ করতে পারছে না, কিন্তু সেটাই তার বাসনা। লোকটা আমাকে বলল আমি যদি পুরো বস্তিটাকে দুই ইঞ্চি করে দিই তা হলে সে আমাকে অনেক টাকা দেবে। জমির মালিক বেলচায় তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। এক ইঞ্চি সাইজের মানুষগুলোে প্রতিবাদও করতে পারবে না। আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না এটা আমার গবেষণার বিষয় নয়। তাতানেব ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দুর্ঘটনাক্রমে হয়ে গিয়েছে।

কী করে হল?

সেটাও আমি বুঝতে পারিনি এখনও। তবে অনুমান করতে পারি। তার আগে বল পৃথিবীতে আমাদের বয়স কীভাবে বাড়ে?

মিনিট ঘণ্টা দিন সপ্তাহ মাস বছর হিসাব করে।

গুড। পৃথিবী যে সময়টায় সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসে তা মোটামুটি তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে। আমরা বলি এক বছর। কিন্তু আমাদের এক বছর আর চাঁদে বাস করলে যে এক বছর হবে তা এক নয়। একই সময়ে সেখানে বয়স বেশি বাড়ে। অথাৎ তুমি যদি চাঁদে গিয়ে থাকে তা হলে দশ বছর পরে তোমার সমান বয়সী কোনও ছেলের সঙ্গে একটুও মিল থাকবে না। তেমনই সাতশো দিনে সূর্যকে যে গ্রহ প্রদক্ষিণ করে, সেখানে বাস করলে পৃথিবীর থেকে কম বয়স বাড়ে। এটা অঙ্ক। আমি আবিষ্কার করতে চলেছি এমন একটি গ্রহের, যেখানে বাস করলে বয়স আদৌ বাড়বে না। সেটা করতে গিয়ে তাতানকে আমি এমন একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যেখানে স্থির হয়ে যাওয়ার পরের স্টেজ, অর্থাৎ বয়স কমতে থাকে।

অর্জুনের মাথার ভেতরে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করল, বয়স কমলে আকৃতি ছোট হয়ে যাবে কেন?

বয়স বাড়লে একটা সময় পর্যন্ত আকৃতি বাড়ে?

হ্যাঁ, তা বাড়ে। অর্জুন স্বীকার করল।

তাতান যতটুকু বেড়েছিল তার থেকে অনেক বেশি বাড়ত স্বাভাবিক অবস্থায়। সেই ততটুকু কমে যেতে ওর এই অবস্থা হয়েছে। ডক্টর গুপ্ত বললেন।

ঠিক এই সময় ওপরের ঘর থেকে একটা কুকুঁ শব্দ ভেসে এল। অর্জুন দেখল শব্দটা শোনামাত্র তাতান লাফাতে লাগল। ভয় হচ্ছিল, তাল সামলাতে

পেরে বেচারি টেবিল থেকে হয়তো পড়ে যাবে। ডক্টর গুপ্ত টেবিলের কাছাকাছি মুখ নামিয়ে বললেন, নো, ঘরে ঢুকে যাও তাতান। অত উত্তেজিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওই পুঁচকে কুকুর যেন পাগল হয়ে উঠছিল। অনর্গল তার খুদে গলায় ডেকে যাচ্ছিল সে। ডক্টর গুপ্ত এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, কুকুরটাকে একটু নজরে রেখো, আমি আসছি।

উনি ওপরে চলে যেতে অর্জন নিজের কড়ে আঙুলটাকে তাতানের কাছে নিয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে তাতান ছুটে এল সেটাকে কামড়াতে। আঙুল সরিয়ে নিল অর্জুন চট করে। কুকুর কামড়ালে চোদ্দটা ইঞ্জেকশন নিতে হয়। তা সাধারণ মাপের কুকুর হোক আর এই পুঁচকে কুকুরই হোক। দুটোই তো। কুকুর। হঠাৎ কু-কুঁ শব্দটা থেমে গেল। তাতান কান খাড়া করে ওপরের দিকে তাকাল। যেন খুব হতাশ হয়েছে সে। একটু পরে শান্ত হয়ে বসল নিজের ঘরের সামনে। পায়ের শব্দে মুখ তুলে অর্জুন দেখল ডক্টর গুপ্ত নেমে আসছেন। এসে তাতানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর জন্য আমাকে কাজকর্ম ছাড়তে হবে দেখছি। এ তো বড় জ্বালা হল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, অ নি কিন্তু এখনও আপনার সমস্যা বলেননি?

উৎপাত। আমাকে কাজ করতে দিচ্ছে না।

কী করে সম্ভব সেটা? আমি যা দেখলাম বিনা অনুমতিতে এই বাংলোয় কোনও মানুষ ঢুকতে পারবে না। উৎপাত করবে কীভাবে? হ্যাঁ, আপনি যখন বাইরে যাবেন তখন সমস্যায় পড়তে পারেন। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য তো বন্দুক রেখেছেন।

তোমার কি মনে হচ্ছে এখানে আমি খুব নিরাপদে আছি?

নিশ্চয়ই। কেউ আপনাকে বিরক্ত করতে পারবে না, নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন।

হাসলেন ডক্টর গুপ্ত, তুমি বাইরের দেওয়াল আর তার ওপরের ইলেকট্রিক তার দেখেছ। কিন্তু মাথার ওপরে তো খোলা আকাশ রয়েছে হে। উৎপাত হচ্ছে সেখান দিয়েই। রিভলভার ছুঁড়ব তারও তো কোনও উপায় নেই।

অর্জুন চিন্তিত হল। মাথার ওপর আকাশ দিয়ে কেউ আসছে নাকি? আশেপাশের গাছ থেকে লাফিয়ে নামছে? যদি নামেও, তা হলে ফিরে যাওয়ার তো উপায় নেই। সে উঠে জানলার কাছে গেল। বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছে। আজ জলপাইগুড়িতে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। সে গাছগুলোকে দেখল। না, দেওয়াল থেকে অনেক দূরে রয়েছে তারা। কোনও মানুষের পক্ষে ওই গাছে উঠে এদিকে লাফিয়ে পড়া সম্ভব নয়। তা হলে? জানলার কাচের এপাশে দাঁড়িয়ে সে ডক্টর গুপ্তের গাড়িটার দিকে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেল। ডিকিটা খুলে গেল ধীরে-ধীরে। তারপর বাড়তি টায়ার যা ডিকিতে থাকে সেটা বেরিয়ে এল বাইরে। মাটিতে পড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিক। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না অর্জুন। সে দেখল টায়ারটা বৃষ্টির মধ্যে সামনের লনে পাক খাচ্ছে। ঠিক যেভাবে বাচ্চা ছেলেরা চাকা নিয়ে দৌড়য় সেইভাবে পাক খেয়ে চলেছে। অর্জুনের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে কোনওদিন ভূত দ্যাখেনি, ভূত আছে বলে বিশ্বাসও করে না। কিন্তু এ যদি ভূতেব কাণ্ড না হয় তা হলে…। সে চোখ ফেরাল। ভক্টর গুপ্ত তাতানকে বাক্সবন্দি করছেন। চাপা গলায় অর্জুন ডাকল, একবার এখানে আসুন।

ডক্টর গুপ্ত অর্জুনের মুখ দেখে সম্ভবত অনুমান করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন জানলার পাশে। টায়ার তখনও ঘুরে চলেছে। জলে ভেজা ঘাসে এলোমলো দাগ পড়ে যাচ্ছে। ডক্টর গুপ্ত বললেন, যা বলছিলাম তা তো নিজের চোখেই দেখছ। এ তো কিছুই নয়। আপনমনে খেলছে। উৎপাত যখন করে তখন মাথা খারাপ হয়ে যায়।

কী ব্যাপার বলুন তো? অর্জুন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

তোমার কী মনে হয়?

এ তো ভুতুড়ে কাণ্ড।

যা আমরা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পাবি না তাকে ভুতুড়ে বলি। তবে তোমার দেখছি সাহস আছে ছোকরা। অজ্ঞান হয়ে যাওনি।

হয়তো ডক্টর গুপ্ত সঙ্গে আছেন, দিনের আলো নিভে যায়নি বলেই অর্জুন ভয় পায়নি। এখন শোনামাত্র কেমন গা ছমছম করতে লাগল। সে তো ডক্টর গুপ্তকেও ভাল করে চেনে না। জগুদাও বা কতটা চেনেন? এটি একটি হন্টেড বাংলো হতে পারে। ডক্টর গুপ্ত নিজে একজন ড্রাকুলা হতে পারেন। এমন কত গল্পই তো শোনা যায়। অর্জুনের গায়ে কাঁটা ফুটল। সে আড়চোখে দেখল ডক্টর গুপ্তের ছায়া পড়েছে দেওয়ালে। যাক ইনি তা হলে ভূত নন। ভূতেদের ছায়া পড়ে না। অর্জুন দেখল টায়ারটা গড়িয়ে সোজা চলে এল গাড়ির পেছনে। যেভাবে নেমেছিল সেইভাবে লাফিয়ে উঠে পড়ল ডিকিতে। কাত হয়ে শুয়ে পড়তেই ডিকি বন্ধ হয়ে গেল। এসব কাণ্ড ঘটল অথচ কোনও মানুষ গাড়ির ধারে কাছে নেই।

ডক্টর গুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কখন যাবেন কে জানে কিন্তু এবার বুঝলেন উৎপাত কীভাবে এখানে আসে?।

অর্জুনের গলার স্বর কেঁপে উঠল, কে এটা করল?

তাতানের বন্ধু। এখন পর্যন্ত আমার কোনও ক্ষতি সে করেনি কিন্তু ওর উপস্থিতি আমি সহ্য করতে পারছি না। তুমি বসো আমি তাতানকে ওপরে রেখে আসি। ডক্টর গুপ্ত টেবিল থেকে বাক্সটা তুলে নিলেন।

অর্জুন পাশে এসে দাঁড়াল, আমি আপনার কথা বুঝতেই পারছি না। তাতান একটা কুকুর। ওর বন্ধু এভাবে অদৃশ্য হয়ে অমন কাণ্ড কীভাবে করতে পারে?

বন্ধুটি দেহধারণ করতে পারছে না কোনও কারণে।

বিদেহী?

বিদেহী মানে আমাদের ধারণায় ভূত। ও তা নয়। তাতানকে আমি যে গ্রহে পাঠিয়েছিলাম, মানে যেখানে গিয়ে তাতানের আকৃতি ছোট হয়ে গেছে, ওর বন্ধু সেখান থেকেই এসেছে। দাঁড়াও, আমি আগে তাতানকে রেখে আসি। ডক্টর গুপ্ত দ্রুতপায়ে ওপরে চলে গেলেন।

অর্জুন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। একী ভুতুড়ে কাণ্ড বাবা! অন্য গ্রহের প্রাণী একটা কুকুরের জন্য এখানে ঘুরঘুর করছে? পৃথিবী ছাড়া অন্য গ্রহেও প্রাণী আছে বলে সন্দেহ করেন বৈজ্ঞানিকরা। কিন্তু সেটা তো শুধুই সন্দেহ। ডক্টর গুপ্তের কথা যদি সত্যি হয়…। মায়ের কথা মনে পড়ল। তাঁর দেশের বাড়ির অনেক ভুতুড়ে গল্প তিনি শুনিয়েছেন। ঝড় নেই হাওয়া নেই হঠাৎ মড়মড় করে গাছের ডাল ভে পড়ল। অথবা দরজা-জানলা হুটহাট করে খুলেই আবার বন্ধ হয়ে গেল। এ তো প্রায় সেইরকম ব্যাপার। অর্জুন অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ দেখল চায়ের কাপ টেবিল থেকে উঠে যাচ্ছে। ঠিক চার ফুট উঁচুতে উঠল কাপটা। ধীরে-ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অর্জুনের গলা শুকিয়ে কাঠ, চোখ ছানাবড়া। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে কাপটা সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ল।

একটু-একটু করে সাহসী হল অর্জুন, নিচুগলায় জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?

কেউ উত্তর দিল না। অর্জুন একটু অপেক্ষা করে আবার বলল, আপনাকে।

আমি দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন?

এবারও কোনও জবাব নেই। এই সময় ডক্টর গুপ্ত ওপর থেকে খালি হাতে নেমে আসছিলেন। অর্জুন তাঁকে সতর্ক করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ওঁর পা পড়ল প্লেটের ওপর। ছিটকে গেল সেটা। মেঝেতে পড়ে দু টুকরো হল। উলটে পড়তে-পড়তে কোনওমতে সামলে নিলেন ডক্টর গুপ্ত। বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কাপ রাখতে গেলে কেন? এটা কি রাখার জায়গা?

সত্যি, বড় অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারত। অর্জুন বলল, আমি রাখিনি।

ডক্টর গুপ্ত চোখ ছোট করলেন, ও। সরি। এভাবে তোমাকে বলা ঠিক হয়নি। কাপ তুলে নিয়ে কিচেনে নিয়ে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, আমার বেসিনটা প্রায় সাড়ে চার ফুট ওপরে। ও নাগাল পাবে না।

কাপ ফুট চারেক ওপরে উঠেছিল। অর্জুন জানাল।

ঠিকই। আমার বিশ্বাস ওর হাত মাথার ওপরে তুললে চার ফুটের ওপরে যায় না। মুশকিল হল আমি ওর সঙ্গে কোনওরকম কম্যুনিকেট করতে পারছি না। ও বাংলা হিন্দি ইংরেজি অথবা জর্মান ভাষা বোঝে না।

কিন্তু এই ঘরে ঢুকল কী করে?

হয়তো শরীরটাকে খুব ছোট করতে পারে। আমার কিচেনের জল যাওয়ার গর্তটা বেশ বড়। তাই দিয়েই আসে। ডক্টর গুপ্ত চারপাশে তাকিয়ে নিলেন।

এই সিদ্ধান্তে এলেন কী করে?

বললাম তো চার ফুটের ওপরে যেমন জিনিস আছে সেগুলোতে ও কখনওই হাত দেয় না। আমার দোতলায় ওঠার দরজাটায় এক চিলতেও ফাঁক নেই। ঘরটাও এয়ারটাইট। সেখানে কখনওই ও যায় না।

এয়ারটাইট মানে সাউন্ডপ্রুফ? অর্জুন কুঁ-কুঁ শব্দটাকে মনে করতে পারল।

না, সাউন্ডপ্রুফ নয় পুরোপুরি। এই হল আমার সমস্যা। পুলিশের পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। তোমার কী মনে হয়? পারবে?

এমন সমস্যা এর আগে কোনও সত্যসন্ধানী সমাধান করেছেন বলে অর্জুনের জানা নেই। স্বয়ং অমল সোম থাকলেও পারতেন কি না সন্দেহ। কিন্তু ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। চট করে না বলতে ইচ্ছে হল না অর্জুনের। সে বলল, খুব কঠিন ব্যাপার, কিন্তু আমি চেষ্টা করতে পারি। তবে কদিন এখানে থাকতে হবে।

অফকোর্স। স্বচ্ছন্দে থাকো। তোমার দক্ষিণা কত?

অর্জুন হেসে ফেলল, সেটা নিয়ে এখন কথা না বললেই ভাল হয়।

নো। তুমি কাজ করবে আর আমি জানতে পারব না কত পারিশ্রমিক নেবে? না না, এভাবে হবে না।

বেশ। আপনি যা স্থির করবেন তাই নেব। কিন্তু সফল হলে।

কবে থেকে এসে থাকছ তুমি? আমি না হয় শিলিগুড়িতে গিয়ে নিয়ে আসব।

আমি কাল থেকেই আসতে চাই। কিন্তু এই প্রলয়ের মধ্যে ফিরব কী করে?

হুম। আমি ভাবিনি এরকম বৃষ্টি পড়বে। ঠিক আছে, চলো আমি তোমাকে না হয় পৌঁছে দিয়ে আসি। ডক্টর গুপ্ত উঠে দাঁড়ালেন।

সেই সময় মেঝেতে শব্দ হল। ওরা দুজনেই দেখল একটা চেন সাপের মতো এগিয়ে আসছে। চেনটা যে তাতানের ছিল তাতে সন্দেহ নেই। এবার চেনটা মাটি থেকে খানিক ওপরে দুলতে লাগল। ডক্টর গুপ্ত বলে উঠলেন, অর্জুন, সাবধান, ও বোধ হয় আমাদের মারতে চাইছে। বলতে বলতে তিনি ছুটে ঘরের কোণে রাখা লম্বা টুলের ওপর উঠে বসলেন। অর্জুন নড়ল না। ঠিক করল চেনটা তাকে আঘাত করতে এলেই সে ওটাকে ধরবে। দেখা গেল চেনটা টুলের দিকে সামান্য এগিয়ে গিয়ে থেমে গেল শূন্যে। তারপর ঘরের এক কোণে ছিটকে পড়ল। অর্থাৎ যে ওটাকে এতক্ষণ নাচাচ্ছিল সে বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

অর্জুন উঠে চেনটাকে কুড়িয়ে নিতে ডক্টর গুপ্ত নেমে এলেন, ভয়ঙ্কর, এই প্রথম ও এমন ব্যবহার করল। আক্রমণাত্মক।

এই সময় বাইরে কড়কড় করে বাজ পড়ল। এবং সেইসঙ্গে সারা বাড়িতে এলার্ম বাজতে লাগল। অর্জুন চমকে ডক্টর গুপ্তের দিকে তাকাতেই তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ঝড়ে বোধ হয় কোনও গাছের ডাল ইলেকট্রিক তারের ওপর ফেলেছে।

অর্জুন জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেওয়ালটা দেখতে পেল। না, এদিকের তারে কিছু জড়িয়ে নেই। সে বর্ষাতিটা পরে নিয়ে টুপি মাথায় দিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বৃষ্টিতে চারধার সাদা হয়ে গিয়েছে। বাঁ দিকের দেওয়ালের দিকে এগোতেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। এই বৃষ্টির মধ্যেই একটি মানুষের শরীর দেওয়ালের ওপরে তারের গায়ে ছটফট করছে। সে দ্রুত ফিরে এসে ডক্টর গুপ্তকে বলল, তাড়াতাড়ি দেওয়ালের কারেন্ট অফ করে দিন। একটা মানুষ মারা যাবে।

মানুষ? দরজায় দাঁড়ানো ডক্টর গুপ্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, আবার চেষ্টা করেছে বুঝি? যারা ওখান দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চায় তাদের মরাই উচিত।

প্লিজ এখন ওসব বলবেন না। অফ করুন তাড়াতাড়ি। অর্জুন ধমকে উঠল।

ডক্টর গুপ্ত ভেতরে চলে গেলেন। এবং তার খানিক বাদেই অর্জুন দেখল শরীরটা তার থেকে খসে ওপাশে পড়ে গেল। লোকটা নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক রকমের আহত হয়েছে। নিশ্চয়ই ভোল্টজ বেশি নয় তাই এতক্ষণ ছটফট করছিল। অর্জুন দেখল ডক্টর গুপ্ত আবার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। সে বলল, মেইন গেট খুলে দিন। লোকটাকে দেখা দরকার।

কিন্তু ঠিক তখনই কানে একটা গাড়ির শব্দ ভেসে এল। দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এর মানে লোকটা একা ছিল না। যারা ওকে পাঠিয়েছিল তারাই চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। অর্জুনের মনে হল ডক্টর গুপ্তেব ঘরে বাইরে বিপদ। এই সময়টুকু বৃষ্টিতে দাঁড়াতেই অর্জুনের মনে হল জলপাইগুড়িতে যাওয়া যাবে না। অন্তত আজ তো নয়ই।

ঘরে ঢোকার আগে ওভারকোট আর টুপি খুলতেই অনেকটা জল ঝরল। ডক্টর গুপ্ত বললেন, কি হে, চেষ্টা করবে নাকি?

আপনার এখানে ফোন নেই?

আছে। কিন্তু অর্ধেক দিন সাড়া দেয় না। ঝড়বৃষ্টি হলে কথাই নেই।

তবু দেখুন তো। মিস্টার গাঙ্গুলিকে এখও ব্যাঙ্কে পাওয়া যাবে।

ওপাশে আর-একটি ঘর রয়েছে। সম্ভবত গেস্ট রুম। ফোনটা সেখানে। এখানে ডায়াল করে লাইন পাওয়া যায় না। অপারেটারের সাহায্য নিতে হয়। দেখা গেল টেলিফোনে কোনও সাড়া নেই।

অতএব সিদ্ধান্ত নেওয়া হল অর্জুন এখানে আজকের রাতটা থাকবে। কাল সকালে শিলিগুড়িতে গিয়ে কাজের ব্যাপারটা মাকে জানানোর জন্য জগুদাকে বলে আসবে। ডক্টর গুপ্ত বললেন, এই ঘরটি তোমার। আমি ঠিক তোমার মাথার ওপরে শোব। প্রয়োজন পড়লে বিছানার পাশে এই যে বোতাম আছে চাপ দিও, আমার ওখানে অ্যালার্ম বাজবে। যাই, আবার বিদ্যুৎ চালু করি।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress